ইভ বনফয়ের একগুচ্ছ কবিতা

মাসুদুজ্জামান-অনূদিত

ফরাসি কবি ও প্রাবন্ধিক ইভ বনফয়। ১৯২৩ সালের ২৪ জুন ফ্রান্সের তুরে জন্মগ্রহণ করা এ-কবি ৯৩ বছর বয়সে গত ১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। বনফয়ের বাবা ছিলেন রেলকর্মী ও শিক্ষক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফরাসি সাহিত্যে বনফয়ের অবদান অসামান্য বলে মনে করা হয়। বনফয়ের কবিতা একাধারে কাব্যিকতা আর তাত্ত্বিকতায় মেশানো। লিখিত ভাষা এবং মুখের বুলি – এ দুই ভাষাভঙ্গি মিশিয়ে কবিতা রচনা করতে গিয়ে আধুনিক ফরাসি কবিতা নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তিনি। শেক্সপিয়রের নাটক অনুবাদের সূত্রেও তিনি খ্যাতিমান। শিল্পকলা, শিল্পকলার ইতিহাস, বিশেষ করে মিরো এবং জিয়াকমেত্তির চিত্রশিল্প নিয়ে প্রকাশনা আছে তাঁর। সদ্যপ্রয়াত এ-কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এখানে তাঁর একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হলো।

ইস্পাতের সেতু

কোনো সন্দেহ নেই দীর্ঘ পথের শেষে আছে সেটা
তেলের একটা সেতু, যেখানে ছেলেবেলায় আমি হেঁটে বেড়িয়েছি,
কালো আকাশের নিচে ঘন মৃত্যুর একটা আয়তক্ষেত্র।

তারপর থেকে, কবিতা
তার জলকে আরেক ধরনের জল থেকে বিভক্ত করে ফেলল
সৌন্দর্য নয়, কোনো রংই তাকে ধরে রাখতে পারল না,
কবিতা ইস্পাত ও রাত্রির জন্য নিদারুণ মনোকষ্টে ভুগতে থাকল।
এটা আরো পরিপুষ্ট হলো
মৃত নদীতীরের দীর্ঘ সুতো, ইস্পাতের সেতুটা
তখনো সেই গভীর রাতে অন্য তীরের জন্য লাফাতে থাকল
এই হলো তার একমাত্র স্মৃতি আর একমাত্র প্রেম।

এখানে, এখনো এখানেই

এখানে, আলোর বাড়ি। কোনো ভোর নেই,
এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে দিন, বলার মতো যত বাসনা।
তোমার স্বপ্নে মরীচিকার গান, এখনো আছে
তবে পাথরের ঝলক আসতে সময় নেবে।

এখানে, সন্ধ্যা অবধি। ছায়াদের ফুল
দেয়ালে ফুটে উঠবে। সময়ের গোলাপ
ঝরিয়ে দেবে তাদের নীরব পাপড়ি।
যেখানে দিনের সঙ্গে ভালোবাসার পদক্ষিপ পড়ছে
ঝলমলে পাথর আমাদের সেখানে নিয়ে যাবে।

এখানে, এখনো ঠিক এখানেই। পাথরের ওপর পাথর
গড়ে তুলেছে দেশ, এই হলো স্মৃতিকথন।
ফলের সামান্য শব্দ খুব কমই শোনা যায়
সময়ের জ্বর তোমার দিকেই আবার ধেয়ে আসে
খুব শিগগির হয়তো জ্বরটা সেরে যাবে।

অন্যস্বর

ফিনিক্সের ছাই অথবা তোমার চুলের ঝাঁকুনি
কোন শরীরী বিভঙ্গে মত্ত তুমি যখন সবকিছু প্রায় নীরব, স্তব্ধ,

অন্তর্গত মধ্যরাত কি টেবিলটাকে আলোকময় করে রেখেছে?
তোমার কালো ঠোঁটে কোন চিহ্ন তুমি ধরে রাখো,
কোন অস্পষ্ট কথাগুলো শুনছি যখন সবকিছুই নীরব,

শেষ স্মারক সেই ফায়ারপেস্নসের জায়গাটা
এখনো কি জ্বলছে আর নিভে আসছে?

তোমার সঙ্গে থেকে কীভাবে জীবনযাপন করব
আমাকে তা শিখে নিতে হবে, তোমার কাছ থেকে
সরে যাওয়া সব আলো ছিঁড়ে ফেলব,

সবই প্রতিমূর্তি, সবই শৈলশ্রেণি, সবই তো নিয়ম।

আর সেই শূন্যতা যেখানে আমি তোমাকে গড়ে তুলে খুলে দেব
আলো-ঝলকিত পথ,

এই তো সেই বিপুল ক্রন্দন একটা মানুষ যা সবসময় চায়।

বালিশ

সকাল পাঁচটা, অনেক তুষার। শুনতে পাচ্ছি
সামনেই কারো কারো কণ্ঠস্বর, পৃথিবীর
শেষ প্রান্তে।

একটা লাঙল
তৃতীয়া চাঁদের মতো ঝলমলে,
কিন্তু বরফের একটা ভাঁজ
এই রাত্রিরে ওকে মুড়িয়ে রেখেছে।

এখন থেকে, এই শিশু
নিজেই নিজের বাড়িতে থাকবে। সে
জানালা থেকে জানালায় ঘুরবে। সে
তার আঙুল দিয়ে কাচ ছুঁয়ে থাকবে। সে
দেখবে, যেখানেই সে থামবে সেখানেই
ফোঁটায়-ফোঁটায় তুষারবৃষ্টি পড়বে
ঝুলন্ত আকাশের দিকে ঘনিয়ে উঠবে কুয়াশা।

স্মৃতি

সে দেখতে অনেক বুড়ো মনে হয়, প্রায় একটা শিশুর মতো।
ধীরে-ধীরে হাঁটে, তার হাত
কাদায় ভেজানো কাপড়ের একটা বল ছুড়ে মারছে।
তারপর তার চোখও বন্ধ :
হয়তো ভাবছে আর মনে পড়ছে আমাদের সবচেয়ে বাজে
গানগুলোর কথা, ওই হাত কি তাহলে
আমাদের ছাইদানির দিকে নিয়ে গেল?
এরপর যখন সে রাত্রির কোটরে চলে গেল
মনে হলো হাসছে।

কী মনে হচ্ছে, এই কি আমি? কিন্তু না, আমি
অবশ্যই ভুল করছি।
স্মৃতি হলো ভেঙে-পড়া কণ্ঠস্বর : খুব
সামান্যই সেই স্বর আমরা শুনতে পাই,
কতটা কাছাকাছি এলাম সেটা বড় কথা নয়।

যদিও সেই স্বর অনেকদিন ধরেই আমরা এখনো শুনছি,
কখনো-কখনো জীবন আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
এরই মধ্যে মৃত্যু আমাদের প্রতিটি চিত্রকল্পকে বলে দেয় – ‘না’।