ইসমত আপা কে নাম : ভিন্ন এক স্বাদ, অনন্য এক অভিজ্ঞতা

অলোক বসু

নাসিরুদ্দিন শাহর নাটক বলে কথা। নাটক শুরু হওয়ার কথা সন্ধ্যা ৭টায়, আর গেট খোলার কথা সন্ধ্যা ৬টায়। অথচ বিকেল ৫টা থেকেই দর্শক লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। এ-চিত্রটা ২১ এপ্রিল, শুক্রবারের। নাসিরুদ্দিন শাহ নির্দেশিত ও অভিনীত ইসমত আপা কে নাম নাটকটি দেখার জন্য ঢাকার দর্শক সেদিন বিপুল উত্তেজনা ও আগ্রহ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার নবরাত্রি হলে। বাইরে বৈরী আবহাওয়া, যে-কোনো মুহূর্তে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হতে পারে, অথচ যথাসময়ে গেট খোলা হচ্ছে না – এ নিয়ে কারো কারো মধ্যে অসহিষ্ণুতা লক্ষ্য করা গেলেও কাউকে ধৈর্যহারা হতে দেখা যায়নি। এমনকি মিলনায়তনের ভেতর ঢোকার পরে যখন দেখা গেল আসন ব্যবস্থাপনা থিয়েটারের অনুপযুক্ত এবং প্রদর্শনী প্রতিশ্রুত সময়ে শুরু হচ্ছে না, তখনো দর্শক অপরিসীম ধৈর্য আর গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। এর কারণ বোধহয় একটাই – নাসিরুদ্দিন শাহ। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি অভিনয়ে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কলেজ জীবনেই মঞ্চে অভিনয় করেছেন। পরবর্তীকালে দিলিস্ন ন্যাশনাল ড্রামা বিদ্যায়তনে পড়াশোনা করেন। শিক্ষকতাও করেন এ-স্কুলে। অভিনয় ও নাট্যকলায় বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন অগণিত পুরস্কার। ২৭ বছর আগে তিনি ও তাঁর দল ঢাকার একটি নাটকে অভিনয় করে নাট্য-অভিনেতা হিসেবে প্রতিভার যে-স্বাক্ষর রেখেছিলেন তা অনেকের স্মৃতিতে আজো অমস্নান। তিনিও সে-মঞ্চায়নের পরিচয় দিলেন সেদিন। প্রতিশ্রুত সময়ের আধঘণ্টা পরে নাসিরুদ্দিন শাহ মঞ্চে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল করতালি দিয়ে ঢাকার দর্শক তাঁকে অভিনন্দিত করলেন। শুরুতেই তিনি নাটক-সম্পর্কিত কিছু প্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলেন। তাঁর ভূমিকামূলক সংক্ষিপ্ত কথায় উঠে আসে ইসমত চুঘতাইয়ের লেখার ধরন, প্রকরণ ও বিষয়বস্ত্ত। একই সঙ্গে উর্দু সাহিত্যে ইসমত চুঘতাইয়ের সমসাময়িক সাহিত্যিকদের প্রসঙ্গও চলে আসে। চলে আসে কৃষণ চন্দর, সাদত হোসেন মান্টো ও ইসমত চুঘতাই যে-সময় সাহিত্য রচনা করেছেন, সে-সময়, সময়ের সমাজচিত্র তিনজনের কে কীভাবে দেখেছেন এবং  উপস্থাপন করেছেন সে-কথাও। প্রসঙ্গক্রমে বললেন প্রগতিশীল লেখক সংঘের কথা। নাসিরুদ্দিন শাহ তাঁর সংক্ষিপ্ত, অথচ জোরালো বক্তব্যে বলেন, রসবোধ ও তীক্ষন লেখনীর মাধ্যমে ইসমত চুঘতাই তাঁর সময়ের সমাজকে একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং সময়ের চেয়ে তিনি যে কত অগ্রসর ছিলেন বোঝাতে চেয়েছিলেন সে-কথা। বললেন, এই যে আজ মঞ্চস্থ করব তাঁর গল্প নিয়ে এ-নাটক, তার মধ্যে দেখতে পাবেন নারীর দুঃখ-কষ্ট-বেদনা ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভঙ্গির বিষয়টি, যা আজো লেখা খুবই দুঃসাহসী বিষয়। ইসমত চুঘতাই সেকালে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সম্মানের আসন অর্জন করেছিলেন। চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে তাঁর গল্প এবং কাহিনি নিয়ে। সে-সময় এক নারীর সমকালীন ভারতবর্ষের সাহিত্যজগতে স্থান করে নেওয়া খুবই কঠিন ছিল। সে-কাজটিই সম্পন্ন করেছিলেন তাঁর সৃজন উৎকর্ষে। গল্প লেখার পাশাপাশি তিনি যে চলচ্চিত্র ও নাটকের জন্যও কাজ করে গেছেন সে-কথাও বলতে ভুললেন না নাসিরুদ্দিন শাহ।

নাটকের শুরুতে মঞ্চে আসেন নাসিরুদ্দিন-তনয়া হীবা শাহ। ইসমত চুঘতাইয়ের ‘চুইমুই’ গল্পটিকে তিনি উপস্থাপন করেন দর্শকদের সামনে। হীবার প্রায় আধঘণ্টা পারফরম্যান্সশেষে মঞ্চে আসেন রত্না পাঠক শাহ। তিনি উপস্থাপন করেন ‘মুঘল বাচ্চা’ গল্পটি। উর্দু ‘ঘুঙট’ অর্থাৎ বাংলায় ‘ঘোমটা’ নিয়ে ঘটে যাওয়া এক নারীর জীবনের গল্প বলেন তিনি। এ-গল্পের শুরুটা হয় বেশ বৈঠকি ঢংয়ে। একটা বেতের চেয়ারে বসে হাতের কাজের ফাঁকে প্রৌঢ় এক নারী খুব অনাড়ম্বরভাবে বলে চলেন তাঁর জীবনের কথা। পুরুষ-মনস্তত্ত্বের অহমিকায় এক নারীর জীবনের সংবেদনশীলতা, আকাঙক্ষা-ভালোবাসা কীভাবে উপেক্ষিত হলো সে-কথাই তিনি বলেছেন চমৎকারভাবে। রত্না পাঠক শাহর উপস্থাপনা ছিল অসাধারণ। ‘মুঘল বাচ্চা’ গল্পের ভেতরে ছিল আরো অনেক ছোটগল্প, আরো অনেক চরিত্র। রত্না গল্পের ভেতরকার গল্প ও অন্যান্য চরিত্র উপস্থাপনে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। নাটকের ভাষায় ডিটেইল অ্যাকটিং বলে একটা ব্যাপার আছে, সেক্ষেত্রেও তিনি অতুলনীয়। বদনি থেকে পানি ঢেলে ওজু করা কিংবা নামাজের প্রস্ত্ততি নিতে নিতে কথা বলা, গল্প বলার যে-জায়গাগুলো তিনি অভিনয় করেছেন, তা অনেকদিন মনে থাকবে ঢাকার দর্শকদের।

সবশেষে মঞ্চে আসেন নাসিরুদ্দিন শাহ। তিনি ইসমত চুঘতাইয়ের ‘ঘরওয়ালি’ গল্পটি উপস্থাপন করেন। এই গল্পটি আবার অন্যরকম, সেখানে নাসিরুদ্দিন শাহ এমন এক পুরুষের কথা বলেন, যিনি দীর্ঘদিন বিয়ে না করেই দিব্যি ছিলেন। একদিন এক বিশেষ মুহূর্তে তার গৃহকর্মের সাহায্যকারিণীকে তার ভালো লেগে যায়। ভালোলাগা থেকে তা সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া পর্যন্ত গড়ায়। নারীকে পর্দার আড়ালে নিয়ে যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টায় মত্ত পুরুষ, অর্থাৎ কিনা পৌরুষতান্ত্রিকতার পরাক্রম। ‘ঘরওয়ালি’র সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল পাওয়া যায় ‘মুঘল বাচ্চা’র। ঘটনার দিক থেকে, কাহিনিবিন্যাসে বিপ্রতীপ হলেও মর্মে যেন তা পরস্পরে সন্নিবেশিত। নাসিরুদ্দিন শাহর অভিনয় নিয়ে বিশেস্নষণ করার যোগ্যতা আমার নেই, তবে এ-কথা বলা চলে, দর্শকদের তিনি মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন পুরোটা সময়।

তাঁর নানা অভিব্যক্তি বাচন ও চরিত্রের অন্তর্নিহিত স্বভাবকে তিনি নানাভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন সেদিন, যা ছিল বহুমাত্রিক। একটি মানুষের স্বভাব, চরিত্রের নানা স্তর তাঁর অভিনয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছিল।

ইসমত আপা কে নাম আমাদের জন্য ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। কথকের ঢংয়ে ঘটনার বিবরণ ও ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংলাপ ব্যবহার করা হয়েছে এ-নাটকে। পরিপূর্ণ থিয়েটারের স্বাদ না পাওয়া গেলেও তিনজনের অভিনয়ের যে অনন্যসাধারণ পারঙ্গমতা, তার কিছু ঝিলিক তো দর্শক সামনাসামনি উপভোগ করতে পারলেন।

সবশেষে বস্নুজ কমিউনিকেশন্সকে ধন্যবাদ জানাতে হয় এমন একটি আয়োজন ঢাকার দর্শকদের উপহার দেওয়ার জন্য। তবে তাদের উদ্দেশে একটি কথা না বললেই নয়। এ-ধরনের আয়োজনের জন্য থিয়েটার উপযোগী হল তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের হয়তো কনসার্ট বা উচ্চাঙ্গসংগীতের বিশাল আসর করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, থিয়েটারটা কিন্তু তার থেকে আলাদা। বিষয়টি মাথায় রাখলে ভবিষ্যতে তারা আর অব্যবস্থাপনার দায়ে দুষ্টু হবেন না। আরেকটি বিষয়ও মাথায় রাখা জরুরি, এত উচ্চমূল্যের টিকিট কেনার সামর্থ্য আমাদের থিয়েটারকর্মী ও থিয়েটারের নিয়মিত দর্শকদের নেই, তাদের জন্যও ভাবা দরকার। r