ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর দশটি কবিতা

অনুবাদ : আন্দালিব রাশদী

 

মা

 

মায়ের আলিঙ্গনে আঁকড়ে থাকা শিশু

কী চমৎকার! কিন্তু দেখো – এই পিচ্ছি ছোকড়ার

এই কোমল আলিঙ্গন থেকে পালাতে কী যে লড়াই

নেমে আসা সোনালি চুলের গোছায় ঘিরে থাকে মুখাবয়ব।

 

মা যখন দুধ, ফর্মুলা খাবার আর ঘন তরল

তার মুখে তুলে দেয় সম্ভবত এ-শিশু তখন

ভদকা আর আচারের কথা ভাবে। তার দাঁতের

মাড়ির ওপর চিনির পাহাড়ের আসত্মরণ।

বিস্মিত মা অবাক হয়ে দেখে তার এই পিচ্ছি শিশু।

ছেলেই তার ঈশ্বর এবং প্রভু; তাকে দেখে গলা ধরে আসে

ছেলে তার প্রতিষ্ঠিত সঙ্গোপনে পরশ পাথরের সিংহাসনে

যা নিয়ে সিংহাসনের ভান তা একটি পাল কেবল

কিন্তু এই ছোট্ট শিশু কোন মুহূর্তে ধূর্ত খামখেয়ালিপনায়

শিখে নেয় মা-র সাথে কৌতুক, তখনো কৌতুক

চলে, ভান করে মাকে বোঝায় সে তার খেলনা কেবল।

 

তবু সে তার ছেলে, তাকে কি বিশ্বাস না করে পারে?

তার কাছে ছেলের অশ্রু ও মেজাজমর্জি সত্য সকল।

তারপর একদিন আসে যেদিন এতকিছুর বদলে

ছেলে বেশ স্পষ্টভাবে মিথ্যে বলে যায়, তার সবচেয়ে

পবিত্র অন্তর্গত বিশ্বাস ভেঙে যায়। অশোধিত অ্যাসিডের মতো

ছেলেটির প্রতারণায় মায়ের অন্ধ হৃদয় জ্বলে যায়।

 

আত্ম-প্রতারক যে প্রথম প্রতারণা করে

তার শৈশবেই, যদিও অতীতে ও ভবিষ্যতে

বহু নারী তার প্রতারণার ফাঁদে পড়েছে।

তার মা-ই প্রথম শিকার, সে যাদের করেছে শোকাহত।

 

 

জখম

 

আমি যে কতবার জখম হয়েছি, কত যন্ত্রণার ক্ষত

কোনোরকম হামাগুড়ি দিয়ে নিজেকে টেনেটুনে বাড়ির পথ ধরেছি

কেবল যে বিষবাষ্প ছড়ানো জিহবাই শরবিদ্ধ করেছে

এমন নয়, পুষ্পের পাপড়ি দিয়েও কেউ জখম করতে পারে।

 

আমি নিজেও পুরোপুরি অজ্ঞাতসারে চলতি পথে

স্বাভাবিক কোমলতার মধ্যে কাউকে জখম করেছি

পরে কেউ যন্ত্রণা অনুভব করেছে।

ব্যাপারটা খালি পায়ে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটার মতো।

 

তাহলে যারা আমার সবচেয়ে কাছের এবং আপনজন

আমি কেন তাদের ধ্বংসাবশেষের ওপর পা ফেলি,

এই আমি যে এত সহজে ও তীক্ষনভাবে জখম হতে পারি

আমি তাহলে কেন স্বাভাবিক ভয়ংকর চালে অন্যদের জখম

করি।

 

 

মিথ্যে

 

ছোটদের কাছে মিথ্যে বলা ভুল

মিথ্যেগুলোকে তাদের কাছে সত্য প্রমাণ করা ভুল

তাদের এটা বলা যে,

ঈশ্বর স্বর্গে আছেন

আর পৃথিবীর সব ঠিকঠাক আছে

এটাও ভুল।

তারা জানে আপনি কী বলতে চাচ্ছেন।

তারাও মানুষ।

তাদের বলুন

সমস্যাগুলো গুনে শেষ করা যায় না

আর তাদের দেখতে দিন

কী ঘটবে কেবল তা নয়

তাদের স্পষ্টভাবে দেখতে দিন

এই বর্তমান সময়।

তাদের বলুন বাধা আছে

কিন্তু তাদের অবশ্যই এর মুখোমুখি হতে হবে

দুঃখ আসে

দুর্ভোগ ঘটে।

আরে রাখো এসব।

যারা সুখের মূল্য জানে না

তারা সুখী হতে পারে না

যে-ভুল ধরতে পেরেছো

ক্ষমা করো না তাহলে

এটা নিজেই পুনঃপুন ঘটতে থাকবে

শতবার

এবং তারপর

আমাদের ছাত্ররা

আমরা যা ক্ষমা করেছি –

সেজন্য আমাদের ক্ষমা করবে না।

 

 

নিরুদ্দেশ হয়ো না

 

নিরুদ্দেশ হয়ো না… আমার কাছ থেকে নিরুদ্দেশ হলে

তুমি নিজের কাছ থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে,

নিজের সাথে চিরদিনের এই বিশ্বাসঘাতকতা,

এটাও হবে কদর্যতম অসততা।

 

নিরুদ্দেশ হয়ো না… নিরুদ্দেশ হওয়া বড্ড সহজ

একজনকে অন্যজনে পুনরাবির্ভাব অসম্ভব ব্যাপার

মৃত্যু অনেক গভীরে টেনে নামিয়ে আনে, এমনকি

মুহূর্তের জন্য মৃত্যু হলেও তা অনেক দীর্ঘ।

 

নিরুদ্দেশ হয়ো না… তৃতীয় ছায়াকে ভুলে যাও

ভালোবাসায় কেবল দুজন, তৃতীয় কেউ নেই

শেষ বিচারের দিন আমরা দুজনই পরিশুদ্ধ হবো

যখন আমাদের হিসাব নিতে শিঙা বাজবে।

 

নিরুদ্দেশ হয়ো না… আমরা পাপমুক্ত হয়ে গেছি

আমরা আর আইনের কাছে বাঁধা নই, আমরা পাপশূন্য

আমরা অনিচ্ছায় যাদের কষ্ট দিয়েছি

আমরা তাদের ক্ষমা পাবার উপযুক্ত হয়েছি।

 

নিরুদ্দেশ হয়ো না… মুহূর্তেই নিরুদ্দেশ হতে পারো

তাহলে শতক শতক পেরিয়ে আমাদের দেখা হবে কেমন করে?

তোমার দ্বৈত কারো কি পৃথিবীতে থাকা সম্ভব

কিংবা আমার সত্তার? থাকতে পারে কিঞ্চিৎ আমাদের সমত্মানে।

 

নিরুদ্দেশ হয়ো না… আমাকে দাও তোমার করতল

এখানেই আমি লিখিত আছি – এটাই আমার বিশ্বাস

কারো শেষ প্রেমকে যে ভয়ংকর করে তোলে

তা প্রেম নয়, তা হারিয়ে ফেলার ভয়।

 

আমেরিকান এক লেখকের সাথে কথোপকথন

 

ওরা আমাকে বলে, ‘তোমার সাহস আছে।’

এটা সত্যি নয়। আমি কখনো সাহসী ছিলাম না

আমি কেবল অনুভব করেছি আমার সহকর্মীদের ভীরুতায়

নিজেকে নত করে আনা বড়ো বেমানান।

 

আমি কোনো বুনিয়াদ টলাতে পারিনি

আমি কেবল ভণ্ডামি আর অমত্মঃসারশূন্য দর্পকে করেছি উপহাস।

পত্রিকায় রচনা লিখেছি, অভিযুক্ত করে লেখাজোখা করিনি

আমার মনে যা আছে বলতে চেয়েছি

হ্যাঁ, আমি মেধাবী মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছি

ভাড়াটে লেখকদের চিহ্নিত করে উঠতি লেখকদের পক্ষে।

 

কিন্তু সাধারণভাবে এটাই তো সবার করার কথা

তারপরও তারা আমার সাহসের ওপর জোর দিচ্ছিল।

সেই অদ্ভুত সময়ের কথা স্মরণ করে আমাদের বংশধর

তিতকুটে লজ্জায় জ্বলে যাবে যখন গর্হিত সব কাজের

শাসিত্ম দিয়ে গিয়ে মনে করবে তখন

সাদামাটা সততাকে দেওয়া হয়েছে ‘সাহস’ খেতাব…

 

জন্মদিন

 

মা, তোমার ছেলের জন্মদিনে

তোমাকে অভিনন্দন জানাতে দাও।

তুমি তাকে নিয়ে বড্ডো বেশি দুশ্চিমত্মায় থাকো।

এখানে সে শোয়, তার কামাই যৎসামান্য, তার বিয়েটাতে

বুদ্ধিশুদ্ধির ছাপ ছিল না, সে বিষণ্ণ হয়ে আছে

শুকিয়ে যাচ্ছে, দাড়ি কামায়নি।

আহ্! কী বিধ্বসত্ম স্নেহময় চাহনি।

 

তোমার উদ্বেগের জন্মদিনে মা তোমাকে আমার

অভিনন্দন জানানো উচিত, যদি পারতাম।

সে তো তোমার কাছ থেকেই পেয়েছে

এ-কালের জন্য করুণাহীন ভক্তি

নিজের বিশ্বাসে উদ্ধত ও বিসদৃশ

তোমার কাছ থেকেই সে নিয়েছে বিশ্বাস-বিপস্নব।

তুমি তো তাকে বিত্তশালী করোনি কিংবা বিখ্যাত

ভয়হীনতাই তার একমাত্র মেধা

তার জানালা খুলে দাও

পাতাভরা শাখার কিচিরমিচির ভেতরে আসতে দাও,

চুমোয় খুলে দিক চক্ষু তার।

তাকে দাও তার নোটবই আর কালির দোয়াত

তাকে দুধের বাটি বাড়িয়ে দাও

আর তার চলে যাওয়া দেখো।

 

ভালোবাসায় তুমি অনেক বড়

 

ভালোবাসায় তুমি অনেক বড়

তুমি সাহসী

আমার প্রতিটি পদক্ষক্ষপ দুর্বল।

আমি তোমার ক্ষতি কিছু করবো না

কিন্তু তেমন ভালো কিছু করার সাধ্যও তো নেই।

আমার মনে হয়

তুমি আমাকে অচেনা পথ থেকে তুলে

অরণ্যের ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে যাচ্ছ।

 

এখন আমাদের কোমর পর্যন্ত বুনোফুল ঢেকে আছে

আমি এমনকি জানিও না

এগুলো কী ফুল।

অতীত অভিজ্ঞতা এখানে সাহায্য করে না।

আমি জানি না কী করতে হবে

আর কেমন করে।

তুমি তো ক্লান্ত

আমার হাতে তোমাকে বহন করতে বলছ,

তুমি তো আমার হাতের ভেতরেই আছ

‘তুমি কি দেখতে পাও

নীল আকাশ কেমন?

তুমি কি শুনতে পাও

বনে কোন পাখি?

বেশ, তাহলে তুমি কিসের জন্য অপেক্ষা করছ?

বেশ?

তাহলে আমাকে বহন করে নিয়ে চলো।’

তোমাকে বহন করে আমি কোথায় নিয়ে যাবো?

ঈশ্বর যেন

 

ঈশ্বর যেন অন্ধকে চোখ ফিরিয়ে দেয়

আর কুঁজোকে সোজা করে

তুমি যেন ঈশ্বর হয়ে ওঠো, একটু সময়

যদিও একটু করে তো তোমাকে ক্রুশবিদ্ধ করা যাবে না।

 

ঈশ্বর যেন তোমাকে রাজত্ব করা থেকে বিমুখ রাখে,

এবং বীরত্বপূর্ণ প্রতারণা থেকে

তুমি সম্পদ গড়ো দম্ভ ঝেড়ে ফেলে

ধরে নাও এটিই একমাত্র পথ

 

ঈশ্বর যেন তোমাকে একটি শক্ত কুকি বানিয়ে দেয়

কারো সাঙ্গপাঙ্গ কখনো তোমাকে গিলে খেতে পারবে না

তোমাকে যেন শিকার না বানায়, কসাইও না

ভিক্ষুক না বানায় আবার সম্ভ্রান্তজনও নয়।

 

ঈশ্বর যেন তোমাকে কম ছেঁড়াকাটা জখম দেয়

চারদিকে যখন বড়ো বড়ো জবাই

যখন অন্যের দেশে ভ্রমণে যাবে

তোমার নিজ দেশের মাটি যেন না হারাও।

ঈশ্বর যেন তোমার দেশবাসীকে এমন না করেন

যারা তোমাকে পরতে পায়ে লাগে না এমন বুট

এবং তুমি যখন এমনকি নিঃস্ব হয়ে পড়ো

তোমার স্ত্রী যেন ভালোবাসার ইতি না টানে।

 

ঈশ্বর যেন সেই ঠোঁট একবারে নীরব করে দেন

যে-ঠোঁট মিথ্যে বলে, শিশুর কান্নায় যেন অশ্রুত তার স্বর

ঈশ্বর আমাদের সুযোগ দিন, সবাই যেন খ্রিষ্টকে দেখি

পুরুষ হিসেবে নয়, সম্ভবত নারীর ছদ্মবেশে।

 

আমরা ক্রুশহীনতা বহন করি, ক্রুশ নয়

যখন পবিত্র ভাব নিয়ে তার সামনে নত হই

ঈশ্বর যেন জনগণের সামনে প্রকাশ করেন

সবকিছুতে বিশ্বাস হারাতে নেই।

 

ঈশ্বর যেন সবাইকে সবকিছু দান করেন

যেন কেউ ধৈর্যচ্যুত না হয়

ঈশ্বর যেন সবই দেন, কিন্তু এমন কিছু নয়

যার জন্য কাউকে না অপদস্থ হতে হয়।

 

পেশা

 

ধর্মযাজক মনে করতেন গ্যালিলিও

ছিলেন একজন ধ্বংসাত্মক ও একরোখা মানুষ।

সবচেয়ে একরোখারাই যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান

তা দেখিয়ে দেওয়ার পথ সময়ের জানা আছে।

 

গ্যালিলিও যুগে একজন সতীর্থ বৈজ্ঞানিক

গ্যালিলিওর চেয়ে বেশি আহাম্মক ছিলেন না

তিনি ভালোই জানতেন যে, পৃথিবীই ঘোরে, কিন্তু

খাওয়ানো-পরানোর জন্য তার ছিল বড় এক পরিবার।

 

স্ত্রীকে নিয়ে ঘোড়াটানা গাড়িতে উঠলেন

জেনেশুনে সত্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার পর

তিনি বিশ্বাস করলেন, এবার পেশাটা তাহলে দাঁড়ালো

যদিও তিনি বাসত্মবে এর কোনো গুরুত্বই দেননি

 

আমাদের গ্রহ নিয়ে সত্যিটাকে দেখিয়ে

দেওয়ার ঝুঁকি একমাত্র গ্যালিলিও নিয়েছেন

এটাই তাকে করেছে মহাপুরুষ – আমি

যেভাবে দেখি, তারই ছিল সত্যিকারের পেশা।

আমি তখন সে-পেশাকে সালাম জানাই

যখন একটি পেশা শেক্সপিয়র কিংবা

পাস্তেরের পেশার মতো; কিংবা

একজন নিউটন বা তলসত্ময় লেভের।

 

তাদের সবার দিকে মানুষ কেন কাদা ছুড়ল

অভিযোগ যাই থাক, মেধাই নিজেকে প্রকাশ করে

যারা তাদের নিপীড়ন করেছে, আমরা তাদের

ভুলে গেছি, মনে রেখেছি অপবাদের ভুক্তভোগীদের।

 

যারা সবাই ছুটে গেছে আন্তর-আকাশে

কলের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিশ্চিহ্ন যেসব ডাক্তার

তারা সবাই ছিলেন পেশার মানুষ

আমি তাদের পেশাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে আনি।

 

আমি তাদের পবিত্র বিশ্বাসে আস্থা রাখি

তাদের বিশ্বাসই আমার একান্ত পৌরুষ

অতএব আমি আমার পেশার পেছনেই ছুটব

অন্য কারো পশ্চাদ্ধাবন না করার মাধ্যমে।

 

 

 

আমি চাই

 

আমি

সব দেশে

জন্ম নিতে চাই

সব পররাষ্ট্র দপ্তরে

আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে

সব দেশের

পাসপোর্ট চাই,

মাছ হতে চাই

সব মহাসাগরের

আর পৃথিবীর

সকল সড়কের কুকুর

আমি আরাধ্য কারো সামনে

মাথানত করতে চাই না

অথবা রুশ অর্থোডক্স চার্চের

হিপি হয়ে বাদ্য বাজাতে

চাই না,

তবে আমি বৈকাল হ্রদের

গভীরে ডুবে গিয়ে

অন্য কোথাও ফোঁস করে

ভেসে উঠতে চাই,

মিসিসিপিতে নয় কেন,

আমার দারুণ ভালোবাসার এই

মহাবিশ্বে

আমি নিঃসঙ্গ আগাছা হয়ে

থাকতে চাই

তবে নাজুক নার্সিসাস নয়

আয়নায় যে নিজের মুখম-লে

চুম্বনরত।

আমি ঈশ্বরের যে-কোনো

সৃষ্টি হতে চাই

এমনকি শেষতক

চর্মরোগগ্রসত্ম হয়ে নাও

কিন্তু কখনো স্বৈরাচার নয়

এমনকি স্বৈরাচারের বিড়ালও নয়

আমি পুনর্জন্ম পেতে চাই

যে-কোনো ভাবমূর্তির

মানুষ হিসেবে!

নির্যাতিত কারাবন্দি নিকারাগুয়ার জেলে

হংকংয়ের বসিত্মতে গৃহহীন শিশু

বাংলাদেশের জ্যান্ত কঙ্কাল

তিববতের পূতভিক্ষু

কেপটাউনের কালোমানুষ

কিন্তু কখনো কোনো

আগ্রাসীর ভাবমূর্তি নিয়ে নয়।

(আংশিক অনূদিত)

 

 

 

ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেস্কোর কবিতা

 

অনুবাদ ও অনুষঙ্গ : অংকুর সাহা

 

ইয়েভগেনি আলেসান্দ্রোভিচ গাংনাসের জন্ম ১৯৩৩ সালের ১৮ জুলাই – সাইবেরিয়ার ইরকুটস্ক প্রদেশের সত্মানত্সিয়া জিমা নামের এক ছোট্ট শহরে। বাবা আলেকসান্দার ছিলেন ভূতাত্ত্বিক, ভালোবাসতেন কবিতা। পরে তিনি মায়ের পদবি নেন – ইয়েভতুশেঙ্কো। যখন তাঁর সাত বছর বয়স, তখন বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায় এবং মা তাঁকে মানুষ করেন। ১৯ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

তাঁর কবিতা রাজনৈতিক ও বর্ণনাধর্মী – কবিতার মাধ্যমে গল্প বলেন তিনি – নিপীড়িত মানুষের কথা। বিতর্ক তাঁর সঙ্গে থাকে সবসময়। তাঁর অনেক কবিতার সুর দিয়ে জনপ্রিয় গান হয়েছে। পঞ্চাশটিরও বেশি গ্রন্থ তাঁর – কবিতা ছাড়াও উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধের। রচনা ও পরিচালনা করেছেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।

চার-চারটি বিবি তাঁর; আরো অসংখ্য নারী-সংসর্গ। পাঁচটি পুত্রসমত্মান। বছরে ছমাস থাকতেন রাশিয়ায়, বাকি ছমাস আমেরিকার ওকলাহোমা রাজ্যের টুলসা শহরে – অধ্যাপনা করতেন টুলসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইয়োরোপীয় সাহিত্য আর চলচ্চিত্রের। চতুর্থ স্ত্রী মারিয়া নভিকোভা ওই শহরে রুশ ভাষা পড়ান একটি হাইস্কুলে। কবি গত পাঁচ-ছয় বছর যকৃতের কর্কটরোগে আক্রান্ত – অস্ত্রোপচারের পর অসুখটি আবার ফিরে আসে। মার্চ ৩১, ২০১৭ ঘুমের মধ্যে তাঁর শান্তির মৃত্যু – পয়লা এপ্রিল সকালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়।

বিদ্রোহের কবি এবং প্রতিবাদী সত্তা হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয়। তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।

 

বাবি ইয়ার

 

ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো

 

বাবি ইয়ারের ওপর কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি।

গিরিখাত নেমে গেছে খাড়াই

অমার্জিতের সমাধিফলকের মতন।

ভীষণ ভয় পাই আমি।

আজকে আমার নিজের বয়স

পৃথিবীর সব ইহুদির বয়সের যোগফলের সমান।

এখন আমার সত্যি সত্যিই মনে হয়

সে আমি প্রাণেমনে ইহুদি।

এখানে আমি এলোমেলো ঘুরে বেড়াই প্রাচীন মিসরে।

এখানেই ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে আমার অন্তিম পরিণতি,

এবং এখনো আমার শরীরজুড়ে পেরেকের ক্ষতচিহ্ন।

আমি নিজেকে মনে করি

সেই ড্রাইফুস।

যে প্যালেস্টাইন একাধারে

গুপ্তচর আর বিচারক।

কারাগারে বন্দি আমি।

চারিদিকে বাধার প্রাচীর।

কুকুর লেলিয়ে দেয় তারা,

গায়ে থুথু দেয়,

অশ্রাব্য গালাগাল করে।

মুখর আর সুন্দর ধনীর দুলারিরা

দামি লেসের ঘাঘরায়

আমার মুখের ওপর রঙিন ছাতা খুলে হেঁটে যায়।

আমি তখন যেন

বাইলোস্টকের সেই ছোকরা

রক্ত ঝরে আর বয়ে যায় মেঝের ওপর।

পানশালায় সমবেত জননেতাদের গায়ে

ভদকা আর কাঁচা পেঁয়াজের বদবু।

নীরবে, বুটের লাথি খেয়ে যাই, অসহায়।

জাতিবিদ্বেষী খুনিরা উত্তেজনায় চেঁচায়,

‘ইহুদিদের মারো, রাশিয়াকে বাঁচাও!’

আমার কাতর মিনতি শোনে না কেউ।

চাল-গমের এক দোকানদার

আমার মাকে ধরে পেটায়।

ও আমার রুশ ভাইবোনেরা!

তোমাদের

আমি চিনি

হাড়ে হাড়ে আন্তর্জাতিক তোমরা।

কিন্তু যাদের হাতে নরকের নোংরা লেগে রয়েছে

তারাও কখনো কখনো মত্ত হয় শুদ্ধতার নামগানে।

আমি জানি আমার দেশের মানুষের ধার্মিকতা।

কী জঘন্য ওই ইহুদিবিদ্বেষীরা-

বিবেকের বিন্দুমাত্র তাড়না ছাড়াই

তারা গর্বভরে নিজেদের নাম দেয়

‘রুশ জনগণের সংঘবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র’!

আমি হতে চাই

অ্যানি ফ্র্যাংক

সজীব, স্বচ্ছন্দ,

বসমেত্মর এক বৃক্ষশাখার মতন।

আমি ভালোবাসতে চাই।

তার জন্যে গালভরা বাক্যের প্রয়োজন নেই।

আমার ভীষণ প্রয়োজন

একে অন্যের চোখে চোখ তুলে তাকানোর।

কতটুকু চোখে দেখার

অথবা গন্ধ শোঁকার ক্ষমতা আমাদের!

গাছের পাতাগুলো আমাদের নাগাল ছাড়িয়ে

আকাশ দেখার অনুমতি নেই আমাদের।

তবু আমরা অনেক কর্মে পারঙ্গম-

কোমলতায়

একে অন্যকে আলিঙ্গন করি অন্ধকার কক্ষক্ষ।

কারা আসছে এদিকে?

ভয় নেই। দূর থেকে আসা ধ্বনিগুলো

বসমেত্মর বজ্রনির্ঘোষ :

বসন্ত আসছে আমাদের দেশে।

তা’হলে আমার কাছে এসো।

এগিয়ে দাও ওষ্ঠ তোমার, দ্রম্নত।

তারা কি ভেঙে ফেলছে দুয়ার?

না, না, বরফের চাঙ ভাঙার শব্দ…

বাবি ইয়ারের বুনো ঘাসে হাওয়ার মর্মর।

গাছগুলো বিচারকদের মতন দাঁড়িয়ে,

অশুভ ইঙ্গিত তাদের ডালপালায়।

চরাচরে শুনি নীরব চিৎকার,

আর, মাথার টুপি খুলে,

অনুভব করি ধীরে ধীরে

শাদা হয়ে যায় মাথার চুল।

আর আমি নিজে

এখানে কবরে শায়িত হাজার হাজার মানুষের মতন

এক বিশাল, শব্দহীন হাহাকার।

এখানে গুলি খেয়ে মৃত

প্রতিটি বৃদ্ধ মানুষ

আমি নিজে।

এখানে গুলি খেয়ে মৃত

প্রতিটি শিশু

আমি নিজে।

আমার প্রতিটি অণু-পরমাণু

ভুলবে না কোনো দিন!

ওই ‘ইন্টারন্যাশনাল’ সংগীত

প্রাণভরে গাইব আমরা

যখন পৃথিবীর অন্তিম ইহুদিবিদ্বেষীকে

চিরকালের জন্যে সমাহিত করা হবে।

আমার রক্তে আর লেগে থাকবে না কোনো ইহুদির শোণিত।

তাদের অযৌক্তিক রাগে

প্রতিটি ইহুদিবিদ্বেষী

আমি ইহুদি বলে, ঘৃণা করে আমায়।

সেই কারণেই প্রাণমনে

আমি এক নিখাদ রুশ নাগরিক।

 

টীকা

– কবিতার রচনাকাল ১৯৬১। প্রকাশ লিতারে তুরনাইয়া গেজেতা সাহিত্যপত্রে।

– রুশ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জর্জ রিভি (১৯০৭-৭৬)।

– ইয়েভতুশেঙ্কোর পাঁচটি কবিতা অবলম্বনে রুশ সংগীতকার দিমিত্রি শস্টাকোভিচ (১৯০৬-৭৫) তাঁর ত্রয়োদশ সিম্ফনি রচনা করেন ১৯৬২ সালে। ‘বাবি ইয়ার’ তার মধ্যে একটি।

– বাবি ইয়ার ইউক্রেনের কিয়েভ শহরের প্রামত্মঃদেশে একটি গিরিখাত। ১৯৪১ সালের ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর সেখানে নাৎসিরা ৩৩ হাজার ৭৭১ ইহুদিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। প্রাণে বেঁচেছিলেন মাত্র ২৯ জন।

– ড্রাইফুস-অ্যালফ্রেড ড্রাইফুস (১৮৫৯-১৯৩৫); ফরাসি সেনাবাহিনীর ইহুদি অফিসার, যাঁকে মিথ্যা অভিযোগে, অন্যায়ভাবে জেলখানায় বন্দি করেছিল ফরাসি সরকার। ইহুদিবিদ্বেষের প্রতীক।

– অ্যানি ফ্র্যাংক (১৯২৯-৪৫) – নাৎসিদের হাতে নিহত এই ইহুদি বালিকার ডায়েরি ভুবনবিখ্যাত।

– বাইলোস্টক-পোল্যান্ডে ইহুদিদের একটি মহলস্না, যার অধিবাসীরা নাৎসি শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল আগস্ট ১৫,
১৯৪৩-তে। এখানকার ৬০ হাজার অধিবাসীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন কয়েকশোজন।

– ইন্টারন্যাশনাল – ১৮৭১ সালে রচিত মুক্তিসংগ্রামের সংগীত। প্রথমে ফরাসি ভাষায় রচিত, পরে কমিউনিস্ট বিপস্নবের সংগীত। বাংলায় এর দুটি বিখ্যাত অনুবাদ করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯১২-৮৭)।

 

 

সত্মালিনের ছানাপোনারা

 

ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো

 

মার্বেল পাথরের দেয়াল বোবার মতন দাঁড়িয়ে

বোবার মতন ঝকমকে জানালার কাচ।

বোকার মতন দাঁড়িয়ে প্রহরীরা

ঝোড়ো হাওয়ায় তাদের মুখ মস্নান।

যখন সমাধিমন্দিরের দরজা খুলে

প্রহরীরা বের করে তাঁকে

কফিন থেকে চুইয়ে বেরিয়ে আসে

মৃদু কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস।

ধীরে ধীরে কফিনটা ভেসে যায়

স্থির বেয়নেটগুলোর ডগা ছুঁয়ে।

তিনিও ছিলেন বোবা-

                        বোবাই বটে!

কিন্তু বিস্ময়কর আর বোবা।

নির্মমভাবে মুষ্টিবদ্ধ হয়

তাঁর মৃত, সংরক্ষক্ষত হাত।

কফিনের ফাঁক থেকে তাকান তিনি

মরার ভান করে শুয়ে থেকে।

প্রতিটি শববাহকের মুখ

জাগরূক তাঁর স্মৃতিপটে :

রিয়াজান আর কুর্স্ক থেকে আসা তরুণ রংরুট,

পরে কোনো সময় তিনি

গায়ে বল পেলেই আক্রমণ চালাবেন,

উঠে আসবেন কবর থেকে মাটিতে

আর প্রতিশোধ নেবেন

প্রতিটি অকৃতজ্ঞের ওপর

মাথামোটাগুলো সব।

মনে মনে ছক বানান তিনি।

এখন ক্লান্ত, গড়িয়ে নেন কিছুক্ষণ।

সরকারের কাছে আমার

নতজানু, বিনীত অনুরোধ :

সমাধিমন্দিরের পাহারা ডবল করে দিন

অথবা তিনগুণ

যাতে সত্মালিন কবর থেকে উঠে আসতে না পারেন

আর সত্মালিনের সঙ্গে – আমাদের অতীত।

আমরা সৎপথে থাকি, ক্ষক্ষতে বীজ বুনি।

সৎভাবে কারখানায় লোহা গলাই।

সৎভাবে কুচকাওয়াজ করি

সেনা আর সেনাপতি – যে যার মতন।

কিন্তু নেতা ভুলেছিলেন আমাদের।

লক্ষ্য ছিল তাঁর উঁচু, কিন্তু ভুলেছিলেন

উপায়গুলোও উপযুক্ত হওয়া উচিত

সেই মহান লক্ষক্ষ্যর।

দূরদর্শী ছিলেন তিনি

যুদ্ধক্ষক্ষত্রের নানান কৌশলে পারদর্শী।

এই পৃথিবীতে রেখে গেছেন তিনি

অনেক অনেক ছানাপোনা।

আমার মনে হয়

তাঁর কফিনের মধ্যে টেলিফোনের লাইন বসানো

সত্মালিন সেখান থেকে

নির্দেশ পাঠান তাঁর চামচাদের

কফিন থেকে বেরিয়ে

টেলিফোনের তারগুলো কোনদিকে যায়?

না, সত্মালিনের মৃত্যু হয়নি।

জেনেশুনেই মৃত্যুর অভিনয় করেছেন তিনি।

আমরা তাঁকে সরিয়েছি

অভিজাত সমাধিমন্দির থেকে।

কিন্তু কার এমন বুকের পাটা যে

সত্মালিনকে সরাবে

তাঁর ছানাপোনাদের হৃদয় থেকে!

ছানাপোনাদের কয়েকজন

অবসর নিয়ে গোলাপবাগান করেন,

কিন্তু গোপনে ভাবেন তাঁরা

এই অবসর সাময়িক মাত্র।

অন্যের।

মঞ্চে উঠে জোরগলায় গালাগাল দেন সত্মালিনকে

কিন্তু

গভীর রাতে

তাদের মনে পুরনো দিনের জন্যে আফসোস।

এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই

যে সংগত কারণেই

আমাদের চোখের সামনে

সত্মালিনের কয়েকটি ছানাপোনার হার্ট অ্যাটাক ঘটেছে।

তার মানে সত্মালিনের চামচাগুলো

ভীষণভাবে অখুশি

বন্দিশিবিরগুলো সব শূন্য দেখে।

কিন্তু প্রেক্ষাগৃহগুলো

যেখানে লোকে কবিতা শুনতে আসেন

উপচে পড়ছে শ্রোতায়।

মাতৃভূমি আদেশ দেন আমাকে শান্ত না হতে।

যদিও নেতারা বলেন : ‘চিমত্মার কিছু নেই…’-

আমি পারি না শান্ত হতে।

সত্মালিনের ছানাপোনারা

যতদিন বেঁচে আছেন পৃথিবীতে,

আমার দৃঢ় বিশ্বাস

সত্মালিনও জীবিত তাঁর সমাধিমন্দিরে।

 

টীকা

– মূল কবিতার নাম ‘নাসলেদনিকি সত্মালিনা’। রচনাকাল ১৯৬২। প্রাভদা দৈনিকপত্রে প্রথম প্রকাশ ১৯৬২ সালের ২১ অক্টোবর।

– রুশ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জর্জ রিভি।

– সত্মালিনের মৃত্যুর পর প্রায় এক দশক কেটে গেলেও ক্রুশ্চেভ-কথিত ‘সমাজতন্ত্রী মানবতাবাদ’ তখন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি সোভিয়েত সমাজে; নব-সত্মালিনবাদ রয়ে গেছে সমাজের সত্মরে সত্মরে এবং যে-কোনো সময় ফিরে আসতে পারে। কবিতাটি সত্মালিনবাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আক্রমণ। সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক ভিক্টর নেক্রাসভ (১৯১৭-৮৭) ওই একই সময়ে তাঁর সমুদ্রের দুই পারে নামক গদ্যগ্রন্থে (ইতালি ও আমেরিকার ভ্রমণকাহিনি) একই রকম বক্তব্য রাখেন।

– নেক্রাসভ এবং ইয়েভতুশেঙ্কোর ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয়েছিল। মাত্র দুবছর পরে (অক্টোবর ১৯৬৪) ক্রুশ্চেভের পতন ঘটে এবং ব্রেজনেভ-কোসিগিন জমানায় সোভিয়েত রাশিয়ায় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উদারপন্থার সমাপ্তি।

– কবিতাটি সোভিয়েত রাশিয়ায় নিষিদ্ধ ছিল দুদশকের বেশি সময়। পঁচিশ বছর পরে গর্বাচেভের আমলে কবিতাটির পুনঃপ্রকাশ ঘটে। r