উত্তর-উপনিবেশবাদ, নারীবাদ ও সেলিনা হোসেনের গল্প

মাসুদুজ্জামান

It is not enough to try to get back to the people in that past out of which they have
already emerged; rather we must join them in that fluctuating movement which
they are giving a shape to, and which, as soon as it has started, will be the
signal for everything to be called in question. Let there be no mistake about
it, it is to this zone of occult instability where the people dwell that we
must come, and it is there that our souls are crystallized and that our
perceptions and our lives are transfused with light.

FRANTZ FANON, The Wretched of the Earth

 

অতীত নয়, যে-অগ্নিগর্ভ বর্তমানের মধ্যে দিয়ে আমরা
চলেছি, যা এ-মুহূর্তে আকার পাচ্ছে, সে-সময়কেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখার কথা
উল্লেখ করেছেন ফ্রানৎস ফানো। সমসময়ের এই যে অনুপুঙ্খ উন্মোচন ও অনুধ্যান, যে-কোনো
সংবেদনশীল লেখকের সেটাই তো আত্মনির্ধারিত অন্বিষ্ট। সেলিনা হোসেন, সমসময় যাঁর
অধিকাংশ রচনার মৌলিক বিষয়-আশয়, তিনি এরই টানে লিখেছেন নারীজীবন আর একান্তই নারীর
গল্প।

 

এক

একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বদলে যাওয়া
বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা গভীরভাবে যেসব লেখকের রচনায় মূর্ত হয়ে উঠতে শুরু করে,
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁদেরই একজন। বলা বাহুল্য, স্বাধীনতার পর থেকে
বাংলাদেশ উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে। গত দু-তিন দশকে
বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলাদেশের সমাজ আরো দ্রুত রূপান্তরিত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে
প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা, মেরুকরণ, সীমাহীন লুণ্ঠন আর
দুর্বৃত্তায়নে জর্জরিত বাংলাদেশ যে নৈরাজ্য আর অবক্ষয়ের কবলে পড়ে, তাতে সামাজিক
সংকট আরো তীব্রতর হয়। স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তিজীবনও এ থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি।
নারী-পুরুষের সম্পর্কেও দেখা দেয় নতুন মাত্রা। তবে রাষ্ট্রিক-সামাজিক ওই সংকট ও
অস্থিতিশীলতার মধ্যেও ব্যক্তিক আত্মমুক্তি ও ব্যক্তিস্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কখনো লোপ
পায়নি। বিশেষ করে সচেতন লেখকরা সামাজিক অসংগতিকে তাঁদের লেখায় নানাভাবে তুলে ধরার
চেষ্টা করেছেন। বুঝে নিতে চেয়েছেন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির আন্তঃসম্পর্কের
টানাপড়েনের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য।

সেলিনা হোসেনেরও বিশেষ লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের
উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্ক কেমন দাঁড়িয়েছে, সেই সম্পর্কের
ভেতরকার অসংগতিগুলো কী – পাঠকের দৃষ্টি, ভাবনা আর বোধের সীমায় এসব প্রসঙ্গ নিয়ে
আসা। উপন্যাস তো বটেই ছোটগল্পের মধ্যে দিয়েও সেলিনা হোসেন নিরন্তর এই কাজ করে
চলেছেন। সেলিনা হোসেনের কথাসাহিত্য সম্পর্কে নির্দ্বিধায় একটি মন্তব্য করা যায়,
তাঁর লেখাতেই উপস্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক নারীজীবনের ছবি। একক কোনো
গল্প নয়, একটিমাত্র কাহিনি নয় – টুকরো টুকরো নানা কাহিনির মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের
নারীর পূর্ণাঙ্গ ছবি পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। বাংলাদেশের নারীরা যে-বিচিত্র
অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করে চলেছে, সেলিনা হোসেন মূলত সেই জীবনেরই রূপকার।
তাঁর গল্প মানেই নারীর গল্প, বাংলাদেশের নারীর পূর্ণাঙ্গ জীবনের গল্প।

ব্রাত্য নারী থেকে অভিজাত নারী, নিম্নবর্গের নারী
থেকে উচ্চবর্গের নারী, সাধারণ সরল গ্রাম্য নারী থেকে প্রখর রাজনীতি-সচেতন নারী,
অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিনিধি-স্থানীয় প্রায় সব নারীকেই গল্পের চরিত্র ও
ন্যারেটিভের অংশ করে তুলেছেন সেলিনা হোসেন। তাঁর গল্পের গুরুত্ব মূলত এখানেই।
এ-গল্পগুলোর মধ্যে দিয়েই পাঠক তাঁর ওই নারীবিষয়ক আত্মসচেতন ভাবনাকে নিঃসন্দেহে
ছুঁয়ে দিতে পারবেন। তাঁর চোখের সামনে খুলে যাবে এমন এক জগৎ, যা কাহিনির মৌলিকত্বে,
ন্যারেটিভের ইঙ্গিতগর্ভ ভাবনার সূত্রে অনন্য। সাদা চোখে কোনো কাহিনিকে সাধারণ
মানুষ যেভাবে দেখে, সেভাবে দেখা নয়; গল্পের ভেতর প্রচ্ছন্ন থাকে যে-জীবন,
সে-জীবনের বৌদ্ধিক দিকটিই পাঠকের বোধের সীমায় নিয়ে আসেন তিনি। সেলিনা হোসেনের গল্প
তখন আর নির্জলা কোনো গল্প হয়ে থাকে না, আমাদের বোধ আর আবেগের কাছে তীব্র আবেদন
তৈরি করে। প্রাসঙ্গিকভাবেই কথার পিঠে আরেকটা কথা চলে আসে – সমস্ত প্রধান লেখকের
রচনাই কী এইভাবে অনন্য হয়ে ওঠার সূত্রে পাঠকের বোধের কাছে আবেদন তৈরি করে না?

কিন্তু কী অর্থে এই অনন্যতা? সেলিনা হোসেন নারী
বলে? জেন্ডার নিয়ে তিনি কাজ করছেন বলে? নাকি কাহিনিকে কীভাবে গল্প করে তুলতে হয়,
তিনি সেই সৃজনক্ষমতার অধিকারী বলে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে, অর্থাৎ তাঁর লেখালেখি প্রসঙ্গে
আমার কাছে এককভাবে এর কোনোটিই গ্রাহ্য বলে মনে হয় না। তাঁর গল্প মূলত তাঁর সমগ্র
জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই ‘সমগ্র’ বলতে কী বুঝবো আমরা? প্রকৃতপক্ষে
এ-প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই তাঁর গল্পের অনন্যতার সূত্রটি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে
উঠতে পারে।

সেলিনা হোসেনের কথাসাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে আরো
একটি কথা সুস্পষ্ট করে বলা যায়। তাঁর গল্প শুধু গল্প নয়, নানা ভাবনার বীজমাত্র।
‘ভাবনা’ শব্দটি দিয়ে আমরা যে-কথাটি বলতে চাই, তা বোঝানো সহজ নয়। এজন্যে আরো কিছু
শব্দ, বিশেষ করে পরিভাষার সাহায্য নিতে চাই। এরকমই কয়েকটি পরিভাষা বা পরিভাষাগুচ্ছ
হচ্ছে ‘উপনিবেশবাদ’, ‘গণতন্ত্র’, ‘রাষ্ট্রতন্ত্র’, ‘প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলন’,
‘ভাষা-আন্দোলন’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ইত্যাদি। সেলিনা হোসেনের যাঁরা অভিনিবিষ্ট পাঠক
তাঁরা জানেন, উল্লিখিত প্রসঙ্গগুলো কীভাবে তাঁর কথাসাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে, এসব
প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে কীভাবে তিনি একটির পর একটি সার্থক উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে
গেছেন। সর্বশেষ তাঁর ভাবনায় যুক্ত হয়েছে জেন্ডার।

বলা প্রয়োজন, জেন্ডারের উৎস হচ্ছে নারীবাদ।
নারীবাদ নারীর জীবনকে এমনভাবে উন্মুক্ত করে দেখাতে শুরু করে যেখানে নারী-পুরুষের
সমসম্পর্ক নয়, বিষম সম্পর্কই প্রাধান্য পায়। প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গল্প
লিখছেন সেলিনা হোসেন। সৃষ্টিশীল জীবনের শুরু থেকেই নারী-পুরুষের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে
তাঁর গল্পের মূল বিষয়বস্ত্ত। তবে প্রথম দিকে সচেতনভাবে নয়, অনেকটা অসচেতন অথচ
লেখকের সংবেদনশীল মন দিয়ে তিনি নারীর জীবনকে তাঁর গল্পে উপজীব্য করে তুলেছিলেন; আর
এখন তিনি নারীবাদ সম্পর্কে সচেতন হয়েই গল্প লিখছেন। সেলিনা হোসেনের গল্পের বিবর্তন
এই ভূমিকার বিষয় নয়, কিন্তু তাঁর গল্পের রূপ-রূপান্তর ঘটে চলেছে মূলত এভাবেই। আগের
যে-কোনো সময়ের তুলনায় সচেতন নারীভাবনাই তাঁর গল্পের কাহিনি থেকে গঠনকাঠামো পর্যন্ত
গড়ে দিচ্ছে।

 

দুই

‘যা কিছু ব্যক্তিগত তাই রাজনৈতিক’ – নারীর জীবনকে
এখন এভাবেই দেখা হয়। নারীজীবনের সংকটের উৎস হচ্ছে তার শরীর আর সামাজিক অনুশাসন বা
সমাজ-নির্ধারিত জীবন। সমাজ নারীর জীবনকে এমন একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে দেয় যে, নারী
সে-বৃত্তের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে। নারীর ব্যক্তিক আচরণ কার সঙ্গে কেমন হবে
সমাজই সেটা নির্ধারণ করে দেয়। পুরুষের জীবনও একইভাবে সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে
থাকে। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, নারী ও পুরুষকে পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি,
রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, অনুশাসন একদৃষ্টিতে দেখে না। নারীর জীবন পুরুষের
তুলনায় তাই অধস্তন। পুরুষের ওপর নারী সামাজিক-অর্থনৈতিক, এমনকি বৌদ্ধিকভাবেও
নির্ভরশীল। বিভিন্ন বিষয়ে পুরুষের যে-অধিকার ও অভিগম্যতা আছে, নারীর সেসব নেই।
নারী-পুরুষের সম্পর্ক তাই অসম, সমানাধিকারের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এসব কারণেই
পুরুষের দ্বারা সামাজিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় নারী। তার আর্থ-সামাজিক জীবন
সীমাবদ্ধ বা শূন্য হয়ে পড়ে, পরিসর যায় সংকুচিত হয়ে। পুরুষ নারীর ওপর আধিপত্য
বিস্তার করে। নারীবাদীরা বলছেন, এসবই হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের ফল। পুরুষ তার স্বার্থে
নারীর জীবনকে এরকম করে তুলেছে।

নারীর জীবন তাই ব্যক্তিগত নয়, পুরোপুরি রাজনৈতিক। সেলিনা হোসেনও নারীর ব্যক্তিগত জীবনকে তাই কোনো ব্যক্তির জীবন বলে মনে করেননি। নারী-পুরুষের সম্পর্ক মূলত কীভাবে নারীর জীবনকে বিপন্ন করে তোলে, সংকটের সেই প্রসঙ্গই তাঁর গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু শুধু নারী-অধস্তনতার ছবি নয়, তাঁর পরাজয়ের কাহিনি নয়, সেলিনা হোসেনের গল্পের অধিকাংশ নারীই দারুণ লড়াকু। পুরুষতান্ত্রিক প্রতিকূল অবস্থাকে অগ্রাহ্য করে তারা আত্মমুক্তির পথ খুঁজে নেয়। আত্মজাগরণের সূত্রে পরাভব নয়, পুরুষবশ্যতা নয়, আত্মপ্রতিষ্ঠাই তাদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। কখনো কখনো মনে হতে পারে, নারী যে এইভাবে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের সমাজ কী সেইভাবে গঠিত, নাকি এ শুধু লেখকের নিজস্ব ভাবনা দিয়ে তৈরি গল্পের এক ইউটোপীয় জগৎ? কোনো সন্দেহ নেই সেলিনা হোসেন তাঁর গল্পের নারীকে প্রজ্ঞা আর সৃষ্টিশীল অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তাঁর গল্পের নারী তাই অধিবাস্তব জগতেরই বাসিন্দা। তারা পুরুষতন্ত্রকে অবলীলায় অগ্রাহ্য করে, আত্মমুক্তির মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে চায়। এ-প্রসঙ্গে এখানে কয়েকটি গল্পের কথা উল্লেখ করতে চাই।

পুরুষতন্ত্রের কারণে নারীর ভাবনা মূলত হয়ে পড়ে
পুরুষেরই ভাবনা। পুরুষের ভাবনার ছকেই তখন নারীর জীবন আবর্তিত হয়। বিশেষ করে আধুনিক
চিন্তা-চেতনার দ্বারা দীক্ষিত নয় যে-নারী, তার পক্ষে কখনই বিকল্প কিছু ভাবা সম্ভব
নয়। আমাদের গ্রামীণ নারী এভাবেই পুরুষকে ধ্যানজ্ঞান মনে করেছে। তার ভেতরে গড়ে
উঠেছে ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্যের বোধ। গ্রামীণ নারীর যৌনজীবনও এভাবেই পুরুষের
বশ্যতা মেনে নিয়েছে। তার জীবনকে সে পুরুষের কাছে নিঃশর্তভাবে সমর্পণ করেছে।
স্বামীকেই ধ্যানজ্ঞান বলে বিবেচনা করেছে। কিন্তু সেলিনা হোসেন নারীভাবনার এই
ছকটাকে ভেঙে দিয়েছেন ‘আকালির স্টেশনের জীবন’ শীর্ষক গল্পের আকালির মাধ্যমে। গ্রাম
থেকে উঠে আসা নিম্নবর্গের অধীন এই ষোড়শী ‘সাধারণ কাজের মেয়েটি’ রাজপুত্রের মতো
দেখতে বাড়ির মালিকের ছেলের সঙ্গে স্বেচ্ছায় শরীরী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সেই
সম্পর্কের মধ্যে সে কোনো পাপ খুঁজে পায়নি, কেননা সেই পুরুষ ছিল তার আকাঙ্ক্ষার
পুরুষ – ‘রাজপুত্র’। তার সঙ্গসুখ আকালির ভালো লেগেছিল। অনুভব করেছিল :

রাজপুত্রের মতো ছেলেটির গরম নিশ্বাস বয়ে যাচ্ছে
ওর শরীরে। একধরনের ব্যাকুলতা প্রবল বেগে ওকে গ্রাস করছিল এবং ছেলেটির সঙ্গসুখ ওর
একটুও খারাপ লাগেনি। এরপর এমনই আরো কত রাত কেটেছে। নিজের ভেতর আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া
আকালির তখন ভালোমন্দ বোধ ছিল না – ওর কাছে সেই ছেলেটির আবেদন ছিল গভীর।

আকালি এও বুঝেছিল, শ্রেণি-অবস্থানের কারণে তার
চেয়ে উঁচু স্তরে অবস্থিত ওই ছেলেটিকে ভালোবাসা যায় না। ওদের সঙ্গে ভালোবাসা হয় না।
‘কিন্তু ঐ সুখটুকু ও নিজেও ভোগ করেছিল। এজন্য ওর কোনো দুঃখ নেই, বরং এখনও মনে করে
সেই দিনগুলো ওর সুখের দিনই ছিল। কখনো মনে হয়নি যে, ও ধর্ষিত হচ্ছে; যে কোনো সময় ওর
পা বেয়ে নতুন তাজা রক্ত নেমে আসতে পারে। ঐ কয়েকটি দিনের স্মৃতিই ওর সুখ – হোক
অন্যায়, তবু যা ওর ভালোলাগা ছিল, তা ন্যায় বলেই মানে।’

তবে বাড়ির গৃহিণী যেদিন তার চুলের মুঠি ধরে ওই
বাড়ি থেকে বের করে দেয়, তখন তার আর কোনো দাঁড়াবার জায়গা থাকে না। বাড়বাড়ন্ত শরীরের
বড় পেট দেখে বস্তির আশ্রয়দাত্রী ‘বিচার’ চাওয়ার কথা জানালে আকালির মাথা ঘুরে ওঠে।
মনে মনে ভাবে, তাদের দুজনের কেউ-ই তো অন্যায় করেনি। তাহলে বিচার কিসের? এরকম
মুহূর্তেই :

চিৎকার করে ওঠে নিশি, কবি না ব্যাডাডা কেডা?

আকালি প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়ে বলেছিল, না।


তোর সন্তানের বাপ লাগবো না?

– না।

আকালির চোখ আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, চকচকে নীল ও
কালো চোখের তারায়। নিশি ওর দিকে তাকিয়ে থমকে যায়। তারপর গলা নামিয়ে বলে, কী কস?

আকালির কাছে মানবিক সম্পর্কটাই প্রধান, এ-কারণেই
সে কত সহজে বলতে পেরেছে, তার সন্তানের বাপ লাগবে না। পুরুষতন্ত্রের প্রভাবে তৈরি
হওয়া নারীভাবনার ছক এভাবেই ভেঙে দিলেন সেলিনা হোসেন। এই ভাবনা নিঃসন্দেহে তাঁর
চেতনাপ্রসূত, নারীর আত্মমুক্তির নতুন সূত্র তুলে ধরে পাঠকের সামনে, বিশেষ করে
আধুনিক নারীর সামনে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই নারী কী আমাদের সমাজের স্বাভাবিক কোনো
নারী? এ-ধরনের কোনো নারীর সঙ্গে কি আমাদের পরিচয় আছে? উত্তরটা না-সূচক হওয়ারই কথা।
কিন্তু এই নারী তো গল্পকার সেলিনা হোসেনের আত্মনির্মিত নারী, তাঁর চেতনার রঙে
নির্মিত, তাঁর ভাবনার প্রভাবে আকালিদের সৃষ্টি। গল্পকারের প্রাগ্রসর ভাবনাই এই
গল্পে প্রধান হয়ে উঠেছে।

‘মতিজানের মেয়েরা’র মতিজানও নিম্নবর্গের নারী।
কিন্তু বিয়ের পর স্বামী আবুলের সংসারে সে হয়ে যায় ‘বাড়তি মানুষ’। নিজের সংসারে তার
কোনো কর্তৃত্ব নেই, শাশুড়ি তার ওপর কর্তৃত্ব করে। মতিজানের হৃদয় থেকে সংসারের সাধ
উবে যায়। স্বামীকে নিয়ে সংসারের সাধ মিটলো না বলে অভিমান হলে স্বামী তাকে বলে দেয়,
‘হামাক কিছু কব্যা না। হামি কিছু জ্যানি না। কিছু করব্যার প্যারমো না। মা-ই সব।
হামার বুকের মদ্যি পা থুয়্যা চ্যাপা র‌্যাখছে।’

নারীবাদের এও এক মাত্রা। নারী পুরুষতন্ত্রের
দ্বারা এমনভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, নারীর দ্বারা নারী নির্যাতিত হয়। মতিজানের
পিতা বিয়ের সময় কথা দিয়ে যৌতুক দিতে না পারায় মতিজান এই সংসারে ‘ভয়ে’র মধ্যে জীবন
কাটায়। বিশেষ করে স্বামীর মুখোমুখি হতে চায় না। স্বামী আবুলের কাছে স্ত্রী ও মা,
অর্থাৎ কোনো নারীই গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে গাঁজা খায় আর নিজের খেয়ালখুশি মতো চলে,
স্ত্রীকে অগ্রাহ্য করে। মতিজানের দিন আর রাত কাটে একা একা, ‘বিছানায় ছটফট করে।’ এই
প্রেক্ষাপটেই তাঁর জীবনে আসে আবুলের বন্ধু লোকমান। লোকমানের সঙ্গে গোপন শারীরিক
সম্পর্কের সূত্রে মতিজান মা হতে চলে। কিন্তু শাশুড়ি আর আবুলের কথা, বংশ রক্ষার
জন্য ‘ছাওয়াল’ জন্ম দিতে হবে।

মতিজান শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার আবার পুরুষ
ছাওয়ালের শখ ক্যানহে? আপনার ছেলে তো আপনাকে পুছে না।’ জবাবে শাশুড়ি বলে, ‘না পুছলে
তোর কি রে হারামজাদি! তুই ছেলে বিয়োবি, না বিয়ালে ভালো হবে না কহ্যা দিল্যাম।’
নারী নিজেই জানে না কেন সে পুরুষ চায়, চায় পুত্রসন্তান, পুত্রের পুত্র। শুধু জানে,
পুরুষ বংশ রক্ষা করে, কিন্তু সত্যিই সেটা কীভাবে ঘটে             সে-বিষয়ে নারী সচেতন নয়। এরপর দুই
মেয়ের জন্ম দেয় মতিজান। আবুল একদিন হো-হো করে হেসে উঠে বলে, বংশ রক্ষা তো হলো না।
পুত্রসন্তান জন্ম না দিলে নারীকে অগ্রাহ্য করে পুরুষ, পুরুষতন্ত্রের দ্বারা
প্রভাবিত নারীর (এখানে শাশুড়ি) কাছেও তার কোনো গুরুত্ব থাকে না।

শাশুড়ি বংশ রক্ষার জন্য ছেলের আবার বিয়ে দিতে উদ্যোগী
হয়। মতিজানের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলে – ‘আজ থিকা হামার সংসারে তুমহার ভাত ন্যাই। হামি
হামার ছাওয়ালোক আবার বিয়া করামো। হামার বংশের বাত্তি লাগবে।’ ঠিক তখনই গল্পের
শেষদিকে আসল ঘটনা ফাঁস করে দেয় মতিজান। সবাইকে সচকিত করে দিয়ে খিক্খিক্ করে হেসে
উঠে বলে, ‘বংশের বাত্তি? আপনার ছাওয়ালের আশায় থ্যাকলে হামি এই মাইয়া দুডাও পেত্যাম
না।’ গ্রামের শক্ত মেয়েমানুষ শাশুড়ির বিস্ফারিত চোখের সামনে দুহাতে দুমেয়েকে বুকের
সঙ্গে অাঁকড়ে ধরে মতিজান আর ‘মায়ের বুকের ভেতর থেকে জ্বলজ্বলে চোখে সবার দিকে
তাকায় মতিজানের মেয়েরা।’ লক্ষণীয়, খুবই ইঙ্গিতগর্ভ এই গল্পের শেষটুকু। মতিজানের
বুকের মধ্য থেকে জ্বলজ্বলে চোখে নতুন পৃথিবীকে দেখছে তারা। নারীর বুকেই নারীর
আশ্রয়। গল্পটি এভাবেই শেষ হয়। এরপর কী ঘটেছিল, গল্পকার সে-কথা জানাননি আমাদের।
কিন্তু ওই সংসার যদি তাকে সত্যি ত্যাগ করতে হয়, তাহলে নারীপ্রধান পরিবারেই গড়ে
উঠবে মতিজানের দুই মেয়ে। নারীই এভাবে হয়ে উঠবে নারীর আশ্রয়, যৌথ জীবনযাপনের অংশ।
সম্প্রতি কন্যাসন্তানের সঙ্গে মায়ের গভীর সম্পর্ক নারীবাদী ভাবনাকে যে নতুন মাত্রা
দিচ্ছে, এ-গল্পের শেষে সেই ইঙ্গিতই পাচ্ছি আমরা।

মতিজান, বলা বাহুল্য, ভিন্ন ধাঁচে গড়া ‘অন্য’
নারী। সে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক অনুশাসন অগ্রাহ্য করে আত্মমুক্তি আর আনন্দের পথ
নিজে নিজেই খুঁজে নিয়েছে। এই নারীও এই সময়ের ব্যতিক্রমী আরেক নারী। সচেতন ভাবনা
থেকে সে যে লোকমানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তা নয়, যা কিছু ঘটেছিল তা ঘটেছিল
স্বাভাবিকতার পথ ধরে – স্বামীর অবহেলা পেয়ে। তবে নারীবাদী ভাবনা থেকেই এর স্রষ্টা
সেলিনা হোসেন তাকে সৃষ্টি করেছেন।
এ-কারণেই সে অবলীলায় বলতে পেরেছে :

যৌতুক প্রসঙ্গে : ‘বাবা তো মিথ্যুক আর ঠগ হয়্যা
গেছে। কিসের আবার ঘড়ি, সাইকেল? আর হামি? হামি তো গরু হয়্যা গেনু। ওরা হামাক ঘাস
খ্যাবার কহে।’

নিজের সংসারে কাজের লোক হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে :
‘হামি তো এই বাড়ির কামের মানুষ। কাম কর‌্যা ভাত খ্যাই। বস্যা বস্যা ভাত খ্যাই না।
হামাক ভাত দেয়্যা ল্যাগবি। মানষে কামের মানুষক ভাত দ্যায় না?’

পুরুষতন্ত্রের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – নারী
নয়, পুরুষকে প্রাধান্য দেয়, পুত্রসন্তান কামনা করে। ‘মতিজানের মেয়েরা’ গল্পে যেমন,
তেমনি এই একই ভাবনায় লেখা হয়েছে ‘মইরম জানে না ধর্ষণ কী’ নামের গল্পটি।
নিম্নবর্গের এক পুরুষ জসিম আরেক নিম্নবর্গের নারী মইরমকে ধর্ষণ করে। কিন্তু মইরম
বুঝতেই পারে না ধর্ষণ কী। সে শুধু শারীরিক আনন্দ পায়নি বলে বিতৃষ্ণা অনুভব করেছে।
জসিম এভাবেই বারবার মইরমের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। মইরম ভাবে, ‘শরীরটা
আর ওর নেই – ওটা জসিমের হয়ে গেছে।… জসিম ওকে চায়ের মতো একটু একটু করে খেয়েছে।’

নারীর শরীর যে নারীর নয়, ওই শরীরের ওপর যে তার
নিয়ন্ত্রণ নেই, নারীভাবনার আরেক বৈশিষ্ট্য প্রতিপাদ্য হলো এই গল্পে। এ-গল্পের
সূত্রেই আমাদের মনে পড়বে নারীবাদী সেই ভাবনার কথা, ‘আমার শরীর আমার, আমার শারীরিক
সম্পর্ক কার সঙ্গে হবে, সেই সিদ্ধান্তও আমার।’ কিন্তু মইরম তার নিজের ইচ্ছার
বিরুদ্ধে গর্ভবতী হলে জসিম আর তার মা সকিনার পীড়াপীড়িতে ধনাঢ্য সত্তর বছরের নূরালি
হাওলাদার তাকে বিয়ে করতে চায়। কারণ সেই পুত্রসন্তান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। পুত্রসন্তান
হচ্ছে ‘বংশের বাত্তি’।

সকিনা আর জসিমের ইচ্ছে মইরম এভাবে নূরালিকে বিয়ে
করলে তারা পাবে বাস্ত্তভিটে আর জীবনে থিতু হওয়ার শেকড়। গড়ে তুলতে পারবে ‘পরিবারের
ধারণা’, পাবে ‘নিজের ভূমি’। কিন্তু এজন্যে জসিমকে যে তার ভালো লাগার মানুষ মইরমকে
হারাতে হচ্ছে, এতে তার অনুশোচনা বা গ্লানি নেই। সে শুধু মইরমের শরীর চায়। কিন্তু
মইরম তাতে আনন্দ খুঁজে পায় না। তার মনে হয়, ‘কোনো কিছু বোঝার আগেই পুরুষের শরীর
গায়ের উপর চেপে যায় – এই অনুভবে ওর প্রবল বিতৃষ্ণা জাগে।’ পুরুষ এভাবেই একদিকে
নারীর শরীরকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে, অন্যদিকে ব্যবহার করে সম্পত্তি পাওয়ার উপায়
হিসেবে। উভয় ক্ষেত্রেই সে পুরুষের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। নারীর গুরুত্ব এইটুকু। জসিম
‘বুঝে যায়, মইরমের কেন এত দাম। নূরালি হাওলাদার মইরমের কাছে ছেলে চায়। আর ও নিজে
মইরমের কাছে জমি চায়। যে জমি ওকে দেবে বলে নূরালি কথা দিয়েছে। জসিমের বিশ্বাস
নূরালি কথা রাখবে। আর ওর সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার আগে জমিটা লিখিয়ে নিতে পারলে আর পায়
কে! নূরালি গাঁয়ের ধনী কৃষক, কিন্তু বাপ হতে না পারার দুঃখ বয়ে বেড়ায়। নূরালি
মইরমের হাত ধরে বলেছিল, ‘আমি তোরে ভালোবাসি মইরম। তোরে আমি সতীনের ঘরে নিমু না।
আলাদা দাম দিমু।’ নারী, এখানে শুধুই পণ্যপাত্র, এক পুরুষের কাছে সম্পত্তি পাওয়ার
মাধ্যম, আরেক পুরুষের কাছে পুত্রপ্রাপ্তির। তবে মইরম পুত্রসন্তান জন্ম দিতে পারে বলে
বুঝে ফেলেছে কেন ‘মাইয়াগো এত দাম’।

আধুনিক নারীবাদী ভাবনার এটি হচ্ছে সর্বশেষ
অভিজ্ঞান – নারীর মর্যাদা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি কারণ সে সন্তান ধারণ ও জন্ম দিতে
পারে। তার গর্ভ আর শরীরকে ঘিরেই মানব প্রজন্মের বেড়ে ওঠা এবং বংশ রক্ষা। বিস্ময়কর
হচ্ছে, সেলিনা হোসেনের গল্পে এইসব তাত্ত্বিক প্রসঙ্গও আসে খুব সহজভাবে, গল্পের
নিজস্ব টানে, নিজস্ব প্রয়োজনে। সেলিনা হোসেন গল্পের মধ্যেই ভরে দেন তাঁর ভাবনাকে।
গল্পের কাঠামো ও গতিপ্রবাহ সঞ্চরণশীল থেকে পরিণামের দিকে এমনভাবে এগিয়ে যায় যে,
ভাবনার এই আরোপন তাত্ত্বিক হয়ে পড়ে না। নূরালিও জসিমের মতো ষোড়শী মইরমের শরীর
মন্থন করে, কিন্তু মইরম তখনো বোঝে না ধর্ষণ কী। পুরুষ নারীকে শুধু যে সন্তান
জন্মদানের যন্ত্র মনে করে, নিজেই শারীরিক আনন্দ পেয়ে তৃপ্ত হয়, নারী আনন্দ পেল কী
পেল না লক্ষ করে না – এইসব মনোশারীরিক বিষয়কে উপজীব্য করেই লেখা হয়েছে এ-গল্পটি।
নিম্নবর্গের মধ্যে নারীর অবস্থান যে আরো নিম্নে, জসিম সে-কথা মইরমকে বুঝিয়ে দেয়।
সেই সঙ্গে উচ্চবর্গের মানুষের কাছেও নারীর কোনো গুরুত্ব নেই।

মন ও শরীরের সম্পর্কের যৌথ অনুভবই হচ্ছে
মনোশরীরের বিষয়। এই একই বিষয় নিয়ে লেখা আরেকটি গল্প ‘লিপিকার বিয়ে এবং অতঃপর’। এই
গল্পেও ‘ভালো ছাত্রী’ লিপিকার বিয়ে হয় এমন এক ‘ভালো ছেলে’র সঙ্গে যে তার শরীরটাই
পেতে চেয়েছে, মন নয়। তবে স্থূল অর্থে মন নয়, মনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে যে ব্যক্তিক
ইচ্ছা-অনিচ্ছা, লিপিকা সেসবই জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছে। গল্পটি পড়লে
বোঝা যায়, লিপিকা চেয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতা। লেখাপড়া করে সে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে
চায়। কিন্তু তার স্বামী আফসারের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই বিপরীত। সে বলে, সংসারের যা
কিছু ঘটবে তা তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই ঘটবে। লেখাপড়া করেই বা কী হবে, তার তো অনেক
টাকা। লিপিকা, বলা বাহুল্য, আফসারের এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। লিপিকা আর
আফসারের কথা চালাচালি হয় এইভাবে :

তুমি কি ভেবেছো বিয়ে করে তুমি আমার আমিত্বটুকু
দখল করে নিয়েছো?

হ্যাঁ, তা তো নিয়েছি। এখন থেকে তোমার সবকিছু
আমার। তোমার মেধা, সৌন্দর্য, নারীত্ব, সবকিছু। তোমার কোনোকিছুই তোমার না।

তাহলে তোমার মেধা, সৌন্দর্য, পুরুষত্বের ওপর কার
অধিকার?

আমার জিনিস তো আমারই।

তাহলে আমারটা আমার নয় কেন? তোমার জিনিস দিয়ে তুমি
ইচ্ছেমাফিক চলবে, আর আমারগুলো তোমার পায়ের তলায় পিষ্ট হবে?

তুমি ভুলে যেও না লিপিকা যে তুমি মেয়ে।

আমি মেয়ে সেটাই তো আমার অহংকার।

পুরুষতন্ত্রের চেহারা এর চেয়ে আর কতটা আগ্রাসী
হতে পারে? না, এখানেই শেষ নয়। পুরুষতন্ত্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় নারীর
শরীর, শুধুই নারীর শরীর। এজন্যেই লিপিকা বলে, ‘আমার শরীর বিক্রি করবো তোমার কাছে।’
বিস্মিত আফসারকে বুঝিয়ে দেয়, ‘সংসারের ভিতে যদি পরস্পরের ভালোবাসা না থাকে তাহলে
সেটাই তো কেনাবেচা – আমি দেবো তুমি কিনবে, তুমি দেবে আমি কিনবো।’ সন্তান জন্ম নিলে
তাও একা পুরুষের নয়, প্রধানত নারীর। নারীর দাবিই তাতে প্রধান। লিপিকা বলে, ‘কারণ
যে স্থানে ভ্রূণটি বড়ো হবে সে অঙ্গটি আমার। তুমি চাইলেই তোমার দেহে শিশুটিকে বড়ো
করতে পারবে না।’ এখানে এসেই লিপিকা আফসারের অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে তার মধ্যে
‘একজন পরাজিত মানুষের চেহারা দেখতে পায় ওর আয়নায়’।

সেলিনা হোসেনের গল্পগুলো মূলত এরকমই। পুরুষেরা
সেইসব গল্পে নারীর আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখতে পাবে। নারীও গল্পগুলো পড়লে বুঝতে
পারবে কোথায় কীভাবে কিসের মধ্যে লুকিয়ে আছে নারীমুক্তির মূলসূত্র। পুরুষতন্ত্রের
কাছে নারীর পরাজয় নয়, পরাভব নয়, পুরুষতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করেই নারীমুক্তি পেতে হবে।
সেলিনা হোসেন এই নারীমুক্তির গল্পই বলেছেন পাঠককে।

জাতিরাষ্ট্র আর শরীরী-রাজনীতির প্রকাশ পারিবারিক
পরিমন্ডলে রচিত তৃতীয় বিশ্বের লেখালেখিতে সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় – কথাটা
বলেছিলেন প্রখ্যাত উত্তর-আধুনিক ভাবুক ফ্রেডেরিক জেমিসন (জেমিসন ১৯৮৬)। সেলিনা
হোসেন মূলত এই উত্তর-ঔপনিবেশিক কালের পারিবারিক আখ্যানের মধ্যে পুরুষতন্ত্র কীভাবে
শিকড়িত হয়ে আছে, গল্পের পর গল্প (উপন্যাসসহ) রচনা করে পাঠককে তিনি তা চোখে আঙুল
দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের কোনো কথাসাহিত্যিকের রচনায় পুরুষতন্ত্রের এরকম
বহুমাত্রিক প্রকাশ আমরা লক্ষ করি না। শুধু গল্পের জন্যে গল্প লেখা নয়, পরোক্ষভাবে
তিনি যেন সমাজ-সংস্কারের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছেন। সৃষ্টিশীল লেখকের এই দায়বোধ
সত্যি উল্লেখযোগ্য।

 

তিন

নারীমুক্তি না ঘটলে যে বাংলাদেশের মানুষের
সার্বিক মুক্তি সম্ভব নয়, সে-কথাই প্রকারান্তরে বোঝাতে চেয়েছেন সেলিনা হোসেন। তাঁর
গল্পের তাৎপর্য মূলত এইখানেই। উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলাদেশে নারীর জীবন কেমন
দাঁড়িয়েছে, নারী-পুরুষের সামাজিক অবস্থান কী, প্রতিটি গল্পের মধ্যে দিয়ে সে-কথাই
পাঠকের আবেগ আর বোধের সীমায় নিয়ে এসেছেন তিনি। তবে আগেই বলেছি, সাধারণ লেখক নন
সেলিনা হোসেন, নারী-পুরুষের সম্পর্কের সরল গল্প বলেন না তিনি। দু-তিনটি প্রবণতা
খুব প্রবলভাবে উপস্থিত তাঁর গল্পে :

এক. শরীরের কারণে নারী পুরুষতন্ত্রের শিকার

দুই. শরীরই নারীর অহংকার

তিন. পুরুষতন্ত্রের দ্বারা নারী পিষ্ট হলেও
পুরুষতন্ত্রের কাছে নারী পরাজিত হয় না।

বাংলাদেশের সমাজে ও সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষের
সম্পর্ক ক্রমশ রূপান্তরিত হচ্ছে। সেলিনা হোসেনের গল্পে ধরা পড়েছে রূপান্তরের সেই
চমকপ্রদ ছবি। নারীর চোখ দিয়ে দেখা হলেও সেই চোখটি সাদামাটাভাবে ঘটনার উপরিতল দিয়ে
দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় না, ঘটনার অতলে যেতে চায়। তাঁর গল্পে গল্প আছে ঠিকই; কিন্তু
পরিণামে তা থিতু হয় বৌদ্ধিক স্তরে এসে, যা সার্বিকভাবে নারীমুক্তির সূত্র হয়ে ওঠে।

তথ্যনির্দেশ

সেলিনা হোসেন, নারীর রূপকথা, ঢাকা, ২০০৭।


গল্পসমগ্র, সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০০২।

Eleke
Boehmer, Stories of Women : Gender and
Narrative in the Postcolonial Nation
, Manchester and New York, 2005.

Frederick
Jameson, Social Text, No. 15 (Autumn,
1986), pp 65-88.

Imre Szeman, Zones
of Instability
, Baltimore and London, 2003.