এই আমি নই আমি

আফসানা বেগম

আজ তেত্রিশ দিন হলো আমি ফেসবুকে ‘ফারহা সিমি’ নামে একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছি। ‘ফারহা’ বা ‘সিমি’, কোনো নামেই আমি কাউকে চিনি না। তবে এটা জানি যে, এই নামগুলো শোনা যায় এর-ওর মুখে। তাই হয়তো কোনো কথোপকথনের স্মৃতি ফুঁড়ে নামদুটো আমার সামনে ভেসে উঠেছিল। দুটো নামকে কেবল সন্ধি করে আমি অ্যাকাউন্টটি খুলে ফেললাম। এরকম একটি ভুয়া আইডি কেন খুললাম, বলতে পারব না। ‘ওয়ান্ট টু ওপেন অ্যান অ্যাকাউন্ট?’ – লেখাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সম্ভবত আমি নিজে নই, আমার চলমান আঙুলগুলো একের পর এক কি-বোর্ডের বাটন টিপে টিপে যেন কারো সম্পর্কে কতকগুলো তথ্য ভরে দিচ্ছিল অনলাইন ফর্মটিতে। স্কুল – বনানী বিদ্যানিকেতন, কলেজ – ইডেন গার্লস কলেজ, এসব কোথা থেকে পেলাম, কেন লিখলাম, কোনো সদুত্তর নেই আমার কাছে। এখন ভাবতে অবাক লাগছে, এমন কেন করেছিলাম, আমি সত্যি জানি না। এ-ও জানতাম না যে, ওই অন্যমনস্ক মুহূর্তের আকস্মিক করা অর্থহীন কাজটি আমাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে। 

দেখতে দেখতে সমস্ত কাল্পনিক কথাবার্তা দিয়ে ফরম পূরণ শেষ হলো। আমি সেই ভরে-ওঠা ফরমের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে না থাকতেই অ্যাকাউন্ট ওপেন হয়ে গেল। এবারে প্রোফাইল পিকচার। নিজের ছবি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে কার ছবি দেব? অনেক আগে বান্ধবীদের সঙ্গে বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে গিয়ে তোলা একটি বিশাল সাদা গোলাপের ছবি নিজের অ্যালবাম থেকে নিয়ে আপলোড করে দিলাম। ওটা আমার তোলা সবচেয়ে প্রথম ক্লোজ শটের ছবি, যা একেবারে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার এসেছিল প্রিন্ট নেওয়ার পরে। দেখে অনেকে বলেছিল, ‘তুই তো ফটোগ্রাফার হয়ে গেলি রে, চালিয়ে যা।’ ওই ছবিটা তো দেওয়া যায়ই। কেউ প্রোফাইল পিকচারে ল্যান্ডস্কেপের ছবি দেয়, কেউ আদরের পোষা বেড়ালের; তবে আমি ফুলের ছবি দিতে পারি না? ঠিক আমি নই, মানে ফারহা সিমি তো তার পছন্দের কোনো ফুলের ছবি দিতেই পারে প্রোফাইলে। আর সাদা গোলাপ ফারহা সিমির পছন্দের লিস্টের সবচেয়ে ওপরে থাকতেই পারে। তবে হ্যাঁ, আমার নিজের হাতে তোলা ছবির অ্যালবামে, যেখানে সেই ছবিটা ছিল, সেটা ডিলিট করে দিলাম। বলা তো যায় না, আবার কার চোখে পড়ে যায়! ফারহা সিমি জাহান্নামে যাক, কিন্তু তার প্রোফাইল পিকচার দেখার পরে, আমার তোলা ছবির অ্যালবামে ছবিটা দেখে কেউ যেন আবার ভেবে না বসে যে এটা আসলে আমার নিজের ওঠানো ছবি নয়, ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা।

অ্যাকাউন্ট ওপেনের কাজ শেষ হলে ফেসবুক আমার জন্য র‌্যানডম স্টাইলে ফ্রেন্ড খোঁজা শুরু করল। আজব, অচেনা সব মানুষের মুখ ভেসে উঠল। কোনো বাছবিচার না করে আমি ক্রমাগত রিকোয়েস্ট পাঠাতে লাগলাম। কাকে পাঠাচ্ছি দেখার কী দরকার, আমি তো আর রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি না, পাঠাচ্ছে ফারহা সিমি। কয়েক মিনিটের মধ্যে ‘অ্যাড ফ্রেন্ডে’র ছোট্ট রেকট্যাঙ্গেলে মাউস টিপে টিপে কতজনকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি, জানি না। ক্লিক করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে গেলাম। অ্যাকাউন্ট লগআউট করে বেরিয়ে এলাম। তারপর তিনদিন আর অ্যাকাউন্টটা খুলিনি। ফারহা সিমির কথা যেন আমি বেমালুম ভুলে গেলাম।

ভুলে যাব না-ই বা কেন, সেই কদিন মাহির আমার নাকে দম তুলে রেখেছিল। মাহির আমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে থার্ড ইয়ারে পড়ে। আমাদের একগাদা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে প্রথম থেকেই তার সঙ্গে আমার ভাবটা ছিল অন্যরকম। তাই কোর্স শুরুর বছর ঘুরতেই আমাদের প্রেম আরম্ভ হয়ে যায়। এখন মাহিরকে ছাড়া আমার চলে না। সামান্য মাথাব্যথায় ফুঁ দেওয়ার জন্য হলেও মাহিরকে আমার লাগবে। ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফরমে আমি যখন ফারহা সিমির অতীত-বর্তমান রচনা করছিলাম, মাহির তখন ক্লাসের কিছু বন্ধুর সঙ্গে একটা মদের আড্ডায় চুটিয়ে হুইস্কি গিলছিল। আমাকেও বলেছিল যেতে। পরপর দুদিন টিউটোরিয়াল পরীক্ষার ব্যস্ততার পরে আমার ক্লান্ত লাগছিল। তাছাড়া আড্ডার আয়োজন বেশ রাতে, তাই আমি যাইনি। রাত সাড়ে এগারোটায় মাহির আমাকে ফোন করে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে বলিস আমি তোর সঙ্গে ছিলাম, তোর ঘরে ছিলাম, সারা সন্ধ্যা তোর সঙ্গে, বুঝলি তো? আমার উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন – ‘কেন?’ ‘কেন?’ শব্দগুলো কোনো পাত্তা না দিয়ে মাহির ফোন কেটে দেয়। তারপর এতবার ফোন করেছিলাম, কোনো লাভ হয়নি। আর তার চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ঘণ্টাখানেক পরে পুলিশ সত্যিই আমাকে ফোন করেছিল। গম্ভীর গলা আশা করেছিলাম, কিন্তু কেমন ক্যানকেনে গলায় হেলাফেলা ধরনের উচ্চারণে একজন বলছিলেন, ‘গুলশান থানা থেকে বলতেছি।’ আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি পুলিশ। ওপাশ থেকে মাহিরের কথা জানতে চাচ্ছেন দেখে বুঝলাম। আমি তাকে চিনি কি-না, সে এখন কোথায়, এসব। হঠাৎ মাহিরের কণ্ঠস্বর কানে বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি তোতা পাখিকে শেখানো বুলির মতো বলে চললাম, ‘মাহির? সে তো এখানেই ছিল, সেই বিকেল থেকে, ক্লাস শেষ করেই তো আমরা একসঙ্গে আমার বাসায় চলে এলাম’, মাহিরের শিখিয়ে দেওয়ার চেয়েও একটু বাড়িয়ে বলে ফেললাম, কী যায়-আসে? আরো নিশ্চিত করার জন্য বললাম, ‘এই তো এখনই চলে গেল; আজ ডিনার করতে আমাদের একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল তো, তাই।’ গলাটা, যতটা পারি রিল্যাক্স করে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম। জানতে তো চাইবই না কী হয়েছে, জানার কোনো আগ্রহও যেন ধরা না পড়ে। ছোট্ট হাই তোলার মতো শব্দ করলাম। ক্যানকেনে গলা বলল, ‘তাইলে তারে ফোনে পাই না কেন বলেন তো?’ আমি অবলীলায় বললাম, ‘ও – ওর ফোনে তো চার্জ ছিল না। স্যামসাং ইউজ করে তো, এখানে চার্জ করতে পারেনি। বাসায় পৌঁছলে পাবেন হয়তো – আর কিছু বলবেন?’ এবারে একটু জোরেই হাই তুললাম। ক্যানকেনে গলা স্যরি-টরি, এত রাতে ডিসটার্ব করলাম, এই জাতীয় কিছু বলে ফোন রেখে দিলো।

মাহির কী ঝামেলায় জড়িয়েছে বোঝার জন্য সে-রাতে যাকেই ফোন করি তার ফোনই সুইচড অফ আসে। প্রচন্ড টেনশনে সারারাত হারামজাদাকে গালাগালি করতে করতে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কাটালাম। পরদিন ক্লাসের আরেকজনের ফোনে জানলাম, গুলশানে কারো খালি বাসায় বসে মদ খেতে খেতে তাদের নিজেদের মধ্যে কী এক তুমুল তর্কাতর্কি বেঁধে গেছে। মারামারির একপর্যায়ে শিভার্স গোল্ডের খালি বোতল দিয়ে একজন আরেকজনের মাথায় মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছে। রক্তারক্তি ঘটনার পরে তার জ্ঞান ফেরানো দুঃসাধ্য মনে করে বাসা থেকে চ্যাংদোলা করে তাকে বের করতেই পড়েছে র‌্যাবের টহল গাড়ির সামনে। ব্যস! মাহির উলটোদিকে বাসার ভেতরে দৌড়ে গিয়ে পেছনের গেট দিয়ে ভেগে গেছে। বাকিরা ধরা পড়ায় জেরার সময়ে মাহিরের নামও বেরিয়ে এসেছে।

সে-রাতে পুলিশকে নিশ্চিন্ত মনে হলেও পরদিন আবার ফোন এসেছিল। আমাকে গুলশান থানায় তার পরের দুদিন হাজিরা দিতে হলো। একই কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে দুজনের সামনে দুবার বলতে হলো।

‘হ্যাঁ, মাহির আমার সঙ্গে ছিল, বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত। থানা থেকে ফোন আসার দশ মিনিট আগে বেরিয়ে গিয়েছিল।’

‘আপনার বাসায় আপনি ছাড়া আর কেউ তাকে দেখেছিল?’

‘দেখবে না কেন? আমার ছোট বোন দেখেছে, আমাদের মেইড সুমি দেখেছে, বুয়া টেবিলে খাবার দেওয়ার সময় দেখেছে।’

আমার ছোট বোন আর সুমিকে ‘মাহিরকে দেখেছে’ স্বীকার করার জন্য সামান্য চোখ রাঙিয়ে হালকা একটু ধমকে দেওয়াই যথেষ্ট। বাবা-মা তো আর নেই; চারদিন আগে ব্যাংকক গেছে।

‘আচ্ছা, তাহলে অ্যাপার্টমেন্টের গার্ডের খাতায় মাহিরের নাম, সই, এসব নেই কেন?’

‘আরে বাবা, মাহির তো আমার সঙ্গে ঢুকেছে বাড়িতে, খামোকা নাম লিখতে যাবে কেন?’

সবাই চুপ। দুবারই কিছুক্ষণ কথা শেষের পরে আমাকে বলা হয়েছে, আপনি এখন যেতে পারেন। শুধু দ্বিতীয়বারে, দরজার কাছে এসে শুনতে পেয়েছিলাম, পেছনে একজন আরেকজনকে ফিসফিস করে বলছে, ‘কঠিন জিনিস, স্যার!’ ব্যাপারটা সে-রাতেই মিটে যেত। আমার জন্য প্রমাণ করা কোনো ব্যাপার ছিল না যে, মাহির সেদিন ওই আড্ডায় ছিল না, ছিল আমার সঙ্গে। কিন্তু সেটা তিনদিন টানতে হয়েছিল, কারণ মাহির, তার মতো গাধা আমি আর একটাও দেখিনি। সে যখন এটাই বোঝাতে চায় যে সে সেখানে ছিল না, ছিল আমার সঙ্গে, তবে তারপরের সারাদিন ফোন বন্ধ রাখার কী দরকার ছিল? সে-কারণেই পরের দিন পুলিশ এসে বাসা থেকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে সেলে পুরে রেখেছিল। পরে সেটাও আমাকেই ম্যানেজ করতে হলো। পুলিশকে ন্যাকা গলায় বললাম, ‘ওর ফোন তো আমার বেডরুমে খাটের নিচে পড়ে ছিল। বেচারা দুদিন ধরে ফোন খুঁজতে খুঁজতে হয়রান আর চার্জ ছিল না তাই পাওয়াও যায়নি। আহা রে, আজ শেষ পর্যন্ত বুয়া ঝুল ঝাড়ার ঝাড়ু দিয়ে বের করে আনল। আপনারা অযথাই ওকে সন্দেহ করছেন।’ মাহিরের বাসা থেকে ফোন জোগাড় করে এনে গান শুনে শুনে চার্জ আগেই শেষ করে রেখেছিলাম। নিষ্পাপ চাহনি নিয়ে ফোনটা তাদের হাতে তুলে দিলাম। আমার ন্যাকামিতে কাজ হলো; থানা থেকে অন্য সবাইকে যখন কোর্টে পাঠানো হলো, শত্রুতাবশত মাহিরের নাম এসেছে ভেবে সেখান থেকে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিলো।

বাবা-মায়ের বকার ভয়ে মাহির থানা থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা আমার বাসায় এসে পিজা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। থানায় সারারাত নাকি স্যাঁতসেঁতে একটা মেঝেতে বসে ছিল। তাছাড়া খালি পেটে তার ঘুম আসে না। মাহির ঘুমানোর পরে কিছু করার না পেয়ে আমি ফেসবুক খুলে বসলাম। রোদের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো হঠাৎ ফারহা সিমির কথা কেন যেন আমার মনে এলো তখন। অ্যাকাউন্ট খুলে দেখি ঊননববই জন বন্ধু হয়ে গেছে তার এবং পঁয়ষট্টি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসে ঝুলে আছে। অবাক কান্ড! এত বোকা-বোকা মানুষ চারদিকে কিলবিল করছে ভাবতে আমার শরীর শিরশির করে উঠল। আমি পটাপট রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করে ফেললাম। কেউ কেউ অনলাইনে ‘থ্যাংকস’ বলতে লাগল। আমি কোনো রিপ্লাই করলাম না। আমার কেমন যেন লজ্জা লাগছিল। হাজার হলেও আমি তো আর ‘ফারহা সিমি’ নই। এখন তার হয়ে ‘ওয়েলকাম’ বলি কী করে!

সন্ধ্যার মুখে পড়ে যাওয়া আলোয় মাহিরের ঘুমন্ত মুখের ওপরে আমি ঝুঁকে তাকিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল মাহির কোনো স্বপ্ন দেখছে। এই মুহূর্তে সে যেন আর সে নেই। স্বপ্নে কোনো চরিত্রে অভিনয় করছে। কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত। আমার ভেতরেও হয়তো তখন তেমন কিছুই হচ্ছিল। আমি মাহিরের জন্য সবকিছু করতে পারি, তাকে আমি জানপ্রাণ দিয়ে চাই, আমি ‘সামিয়া’ যে কেবলই আমি, মাহির জানে, বিশ্বাস করে, কিন্তু আমি যেন ধীরে ধীরে আমার ভেতরে অন্য কাউকে দেখতে পাই। সেটা ঠিক আমি নই। আমার আরেকজন হতে ইচ্ছে করে, দেখতে ইচ্ছে করে আরেকটা জীবন কেমন হয়। কেমন হয় সেই জীবনের সুখ-দুঃখ, শান্তি অথবা অশান্তি? আমার ভেতরে যেন একটি অস্তিত্ব জন্মায় সদ্য-জন্মানো ভ্রূণের মতো, সেটা আমি-ই নাকি ফারহা সিমি? তার ফেসবুক বন্ধুদের কারো কারো বিভিন্ন ভঙ্গিতে তোলা প্রোফাইল পিকচারগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি শিউরে উঠি। আমি তাদের কেউ না কিন্তু এখন ইচ্ছে হলেই তাদের সঙ্গে যা খুশি বলতে পারি; আমি না, মানে ফারহা সিমি যা খুশি বলতে পারে। হয়তো আমার উত্তেজিত ঘন নিশ্বাস মাহিরের মুখের ওপরে পড়ছিল। মাহির সরু চোখ মেলে দুহাত বাড়িয়ে আমাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। আবছা আলোয় আমরা একজন আরেকজনের খেলনা হয়ে উঠি।

ফারহা সিমির ইনবক্সে অনেকে মেসেজ পাঠায়। ‘কেমন আছ?’ নিজের সম্পর্কে কিছু কথা লিখে কেউ কেউ প্রশ্ন করে, ‘আমাকেও তোমার কথা বলবে কি?’ বয়সে বড় কেউ কেউ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেলে অ্যাক্সেপ্ট করে আবার মেসেজে লিখে রাখে, ‘আমি কি তোমাকে চিনি?’ প্রথম প্রথম কারো কথার জবাব দিতাম না। থেকে থেকে একদিন মনে হলো, ফারহা সিমি মেসেজের উত্তর দিলেই পারে, দেয় না কেন? সবাইকে নানান কথা লিখতে লাগলাম। সব ভালো কথা, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কতটা সুবোধ হওয়া যায়, তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। কদিন বাদে একবার ফারহা সিমির প্রোফাইল পিকচার, সাদা গোলাপের নিচে দেখি কিছু মন্তব্য। একজন লিখেছে, ‘এবারে ফুলের ছবি সরিয়ে বেরিয়ে আসো সিমি!’ আরেকজন তার নিচে আগের মানুষটিকে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘তুমি কি ফারহা সিমিকে চেন?’ আগের মানুষটি ‘না’ বলেছে। তারপর তাদের মধ্যে বেশ একটি আলোচনা হয়েছে যে ফারহা সিমিকে তারা কেউ ব্যক্তিগতভাবে চেনে না অথচ সে তাদের সবার বন্ধু। এ নিয়ে কি তারা বিব্রত নাকি কৌতূহলী, ঠিক বোঝা গেল না। তবে মন্তব্যগুলো দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধু একদল মানুষের মাঝখানে আমি ঢুকে পড়েছি, মানে ফারহা সিমি ঢুকে পড়েছে। হয়তো তাদের একজন-দুজন ফারহা সিমির রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করেছিল এবং তারপর একে একে তারা সবাই ফারহা সিমিকে তাদের পরিচিত কেউ ভেবে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, পনেরো দিনের মাথায় বন্ধুসংখ্যা ছয়শো ছাড়িয়ে গেল। এটা আমার নিজস্ব আইডির বর্তমান বন্ধুসংখ্যার চেয়েও বেশি। অবশ্য ফেসবুক কমিটি অপরিচিত লোকদের হরেদরে রিকোয়েস্ট পাঠানোতে মাঝে একবার ধমক দিয়ে দুদিনের জন্য ব্লক করে না রাখলে আরো বেশি হতো, সন্দেহ নেই।

এর-ওর সঙ্গে যখন-তখন চ্যাট হচ্ছে তখন। কথা বলার সময়ে কোনো খেয়াল রাখতে হয় না কী বলছি, কেন বলছি। কেবল বলে গেলেই হলো। আমি তো আর বলছি না, বলছে ফারহা সিমি! তবে একটা জিনিস খেয়াল করি, নিজে কোনো বিষয়ে বলতে গেলে হয়তো কিছু বাধ্যবাধকতা কিংবা চক্ষুলজ্জা অগ্রাহ্য করতে পারি না, ফারহা সিমি কথা বলার সময়ে বিশেষ করে সেসব পাত্তাই দেয় না। এভাবে কদিনের মধ্যেই ফারহা সিমি হয়ে উঠল আমার মুক্তির ঠিকানা। আমি যা বিশ্বাস করি না কিন্তু করতে চাই, ফারহা সিমি তাই বিশ্বাস করে। আমি যা ভাবতে সাহস পাই না, ফারহা সিমি  তা-ই ভাবে। একসময় দেখলাম আমি যা করার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করি না, ফারহা সিমি সেসব অনায়াসে করতে পারছে। কারো সঙ্গে একটা হেঁয়ালি আর ন্যাকামিতে ভরা চ্যাট শেষ হওয়ার পরে কোনো কোনো দিন মাথার ওপরে ছাদ ধসে পড়ার মতো করে মাহিরের কথা মাথায় আসে। মাহির এই চ্যাট মেসেজ দেখলে কী ভাববে? পরমুহূর্তেই ভেবে স্বস্তি পাই, কিছু ভাবার কী আছে, চ্যাট মেসেজ তো আর আমার না, ফারহা সিমির।

এর মধ্যে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে চ্যাট হওয়াটা একেবারে নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। ভদ্রলোক ব্যবসায়ী। নাম ইশতিয়াক হোসেন। আমার চেয়ে অন্তত সতেরো বছরের বড়। আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা যেভাবে কথা বলে, তা ইশতিয়াক সাহেব বেশ ভালোই রপ্ত করেছেন। কথা বললে বোঝা যায়, আমার মতো আরো কিছু মেয়ের সঙ্গে হয়তো তিনি নিয়মিত কথা বলে থাকেন। চ্যাট করতে করতে এমন হলো যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে ফেসবুক খুলে আমি তার জন্য অপেক্ষা করি। খুব সতর্ক হয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, এটা কি আমি নিজের থেকেই করছি, নাকি নিজের অজান্তে? নিজের অজান্তেই হবে হয়তো, কারণ এটা করছে ফারহা সিমি। তা না হলে আমি, সামিয়া, অচেনা ইশতিয়াক হোসেনের সঙ্গে প্রতিদিন চ্যাট করব কেন?

‘আচ্ছা, সিমি, ক্লাসের পরে লাঞ্চ করো কোথায়?’

‘এই তো, ক্যাফে ম্যাংগো, নিউ ইয়র্কার, না-হলে কেএফসি, হোয়ার এলস?’

‘দ্যাটস গ্রেট। একদিন এখানে আসো, বনানীতেই তো আমার অফিস।’

‘ইন ফ্যাক্ট কোথাও যাওয়ার মতো অতটা সময় থাকে না লাঞ্চ ব্রেইকে।’

‘তাহলে আমিই একদিন চলে আসি তোমাকে দেখতে -’

‘আপনি আমাকে দেখতে চান?’

‘চাওয়াটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? তোমার সঙ্গে বেশ কদিন ধরে কথা হচ্ছে, আর তুমি তো একটা ছবিও রাখনি প্রোফাইলে, সব শুধু ফুল, পাখি, তুমি ন্যাচার লাভার, না? ভেরি গুড। এবারে নিজের একটা ছবি পাঠাও তো এখনই বেইবি -’

‘নিজের ছবি এখন আপলোড করতে ইচ্ছে করছে না।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে যখন খুশি করো। এখন শুধু বলো তো তোমার চুল কার্লি না স্ট্রেইট? ডাই করো? আমি গেস করি, মেহগিনি? না না, মনে হয় ব্রাউন হাইলাইটস, অ্যাম আই রাইট?’

‘স্যরি ঠিক হয়নি। নিচের দিকে লাইট ব্রাউন। আর আমার চুল স্ট্রেইট। কিন্তু কেন জানতে চাচ্ছেন বলেন তো? আপনি কার্লি হেয়ার লাইক করেন?’

‘না না, স্ট্রেইট চুলই আমার বেশি ভালো লাগে। আসলে ভাবতে চাচ্ছিলাম, তোমার চুলের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দিলে কেমন লাগতে পারে।’

‘ভাবলেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেমন?’

‘ভালো। তবে চুলে আঙুল ঢুকিয়ে তারপর তোমাকে টেনে কাছে আনতে ইচ্ছে করছে।’

‘আচ্ছা, ইচ্ছে যখন করছে, আনেন তাহলে… হা হা হা…’

এর মধ্যে কয়েকবার ইশতিয়াক হোসেনকে কাটাতে চেষ্টা করেছি। তিনি ঝুলে আছেন। নাছোড়বান্দা। কখনো তার আবেগ আর কখনো ভদ্রতার সামনে উলটো কিছু বলতেও পারি না। আবার তার সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে ভালোই লাগে। নিজের চেয়ে ফারহা সিমির অ্যাকাউন্ট খুলে বসে থাকি বেশিরভাগ সময়। একদিন ইশতিয়াক হোসেন তার বাসায় যেতে বললেন। এর মধ্যে তার সঙ্গে ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে, মানা করা যায় না। ভেবে দেখলাম, ফারহা সিমি আসলে জানার জন্য ভীষণ উদ্গ্রীব, এর পরে কী জানি কী হয়!

একদিন আবার হঠাৎ একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হলো। ভাবলাম, ফারহা সিমি হয়ে মাহিরকে রিকোয়েস্ট পাঠালে কেমন হয়? পাঠিয়ে দিলাম। দেখতে ইচ্ছে করে মাহির একজন অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে কীভাবে কথা বলে। সঙ্গে একটি ছোট্ট মেসেজ পাঠালাম, ‘লুকিং ফর অ্যান অনেস্ট ফ্রেন্ড’। ও মা, দেখি সে অ্যাক্সেপ্টও করেছে। বারবার তার ইনবক্সে এটা-ওটা লিখতে লাগলাম। একদিন সে ফারহা সিমির সঙ্গে কথা শুরু করল। আমিও জানতাম, আজ না হয় কাল, মচকাতে তাকে হবেই। খুব মজা লাগছিল প্রথম প্রথম। সে আমাকে, মানে ফারহা সিমিকে চেনে না, কিন্তু ফারহা সিমি তার সব জানে। তার ব্যাপারে যা জানি, সেসব কথাই খুব হেঁয়ালি করে জানতে চাই আর আলাপ এগোয়। সে যেভাবে পছন্দ করে, ফারহা সিমি হয়ে ঠিক সেভাবে কথা বলি তার সঙ্গে। অনেক বিষয়ে সে আমাকে, মানে সামিয়াকে বলেও শুধরাতে ব্যর্থ হয়েছে, ফারহা সিমি আগে থেকেই সেভাবে তৈরি। তার সঙ্গে ফারহা সিমির সব পছন্দ মিলে যায়, আগ্রহ মিলে যায়। আমি অ্যাকশন মুভি দেখতে চাই না, কিন্তু ফারহা সিমি তার সঙ্গে সিনেপ্লেক্সে যেতে চায়। আমি থ্রেস মেটাল গান পছন্দ করি যেখানে কিনা ফারহা সিমি ঠিক তারই মতো হাই ভলিউমে হেভি মেটাল গান শোনে। ফারহা সিমির এমন একটা কিছুও নেই যা তার সঙ্গে মেলে না। মাহির প্রতিদিন ফারহা সিমির সঙ্গে কথা বলতে চায়। অনেকক্ষণ ধরে কথাও হয় তাদের। মাহির ফারহা সিমিকে ‘তুমি’ করে বলে। মাহিরের মুখে ‘তুমি’ শুনতে নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগবে, আমি কল্পনা করি, আর এটা ফারহা সিমিকে বলছে, অন্যভাবে ভাবলে আমাকেই; আমার খুব অন্যরকম লাগে। সপ্তাহখানেক আগে সবচেয়ে মজার নাকি সবচেয়ে হতাশার এক সন্ধ্যা এলো, আমি আমার এবং ফারহা সিমির দুটো অ্যাকাউন্ট দুটো উইন্ডোতে খুলে রেখেছিলাম। ফারহা সিমির অ্যাকাউন্টে আমি হয়তো ইশতিয়াক হোসেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ইশতিয়াক হোসেন তার বাসায় যাবার দিন-তারিখ জানানোর কথা। নিজের অ্যাকাউন্টে মাহিরের সঙ্গে চ্যাট চলছিল। হঠাৎ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল, মাহির আমাকে বলল, ‘এখন উঠি রে, বাবার সঙ্গে বাইরে যেতে হবে।’ আমি বললাম, ‘তুই কবে থেকে এত লক্ষ্মী ছেলে হয়ে গেলি বল তো?’ মাহিরের চ্যাটলাইন অফ হয়ে গেল। ঘটনা ঘটল এর পরে। চোখ গোল গোল করে দেখি, মাহির পরমুহূর্তে ফারহা সিমিকে ‘কী করছ?’ মেসেজ পাঠিয়েছে। সেখানে মাহিরের চ্যাটলাইন অন। আমার কান্না পেল। চোখ মুছে আমি মাহিরের মেসেজের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, ফারহা সিমি হোক আর যে-ই হোক, সেভাবে বলতে গেলে, এ তো আমিই। আমার সঙ্গেই তো আছে মাহির। ছেড়ে যায়নি। তাই সেদিন পরের ঘণ্টা দুয়েক ফারহা সিমির অ্যাকাউন্ট থেকে ছোট ছোট মেসেজে অনিচ্ছাকৃতভাবে মাহিরের সঙ্গে কথা বলছিলাম। অবস্থা এমন হয়েছিল, যেন কি-বোর্ডে আঙুল চলছিল না। মাহির বারবার জানতে চাচ্ছিল, ‘সিমি, তোমার কি মন খারাপ? বলো তো আমি ভালো করে দিই।’ সে-কথাটা দেখে আমার আরো মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কেন মাহির অন্য কারো মনোরঞ্জন করবে? কেন আমাকে মিথ্যে বলে সে আরেকজনের সঙ্গে চ্যাটে বসে গেল? আমি তাকে কত ভয়ানক ভালোবাসি, সে তো তার অজানা নয়!

মাহির সত্যি ফারহা সিমির মন ভালো করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমার ভালো লাগেনি। সেদিন প্রথম ফারহা সিমি মাহিরের অপছন্দের কিছু কথা বলেছে। যেমন কোনো কিছুর ব্যাপারে ‘পরে বলব’ বা ‘এখন বাদ দে তো’ জাতীয় কথা মাহির একদম সহ্য করতে পারে না। মুখ শক্ত করে বলে, ‘কেন পরে বলবি? এখনই বল, না বললে মার খাবি।’ অথচ ফারহা সিমি সে ধরনের কথা বলায় সে মায়া করে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার যখন খুশি বোলো। আমি শোনার জন্য অপেক্ষা করব।’

বেশ রাতে বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছিলাম, কাঁদতে কাঁদতে আবার ভাবছিলাম, ‘সামিয়া কাঁদছে কেন?’ নিজেই উত্তর দিচ্ছিলাম, ‘সামিয়া মাহিরকে হারানোর ভয়ে কাঁদছে।’

‘মাহির কোথায় গেল?’

‘ফারহা সিমি মাহিরকে নিয়ে নিল।’

‘তাহলে তো মাহির সামিয়ার কাছেই আছে!’

‘আছে তো, আবার নেই-ও। সামিয়া কি আর ফারহা সিমি?’

একসময় কান্নার দমক কমে এলে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। তার মাঝখানে ফোন বেজে উঠল। ইশতিয়াক হোসেন ফোন করেছেন। কদিন ধরেই তার সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। প্রথমেই একটু হেসে বললেন, এত রাতে ফোন, কারণ তার বউ গেছেন কোনো দাওয়াতে। তিনি বাসায় একা, অন্ধকার বারান্দায় বসে বসে নাকি আমার কথা ভাবছেন। কাল সকাল এগারোটায় আমি যেন তার বাসায় যাই সেই অনুরোধ করতে লাগলেন ফোনে। আমি একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। হবো না কেন? মাহির যদি আমাকে মিথ্যে বলে ফারহা সিমির সঙ্গে বসে দুই ঘণ্টা প্রেমালাপ করতে পারে, তো আমি-ই বা কেন যাব না আরেকজনের সঙ্গে দেখা করতে? অবশ্যই যাব। ইশতিয়াক হোসেনের বাসায় সে-সময়ে অন্য কেউ থাকবেন কি-না সেটা জানতে চাওয়ারও প্রয়োজন মনে করলাম না। তার গলা শুনেই বোঝা গেল, আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেছি বলে তিনি খুব উত্তেজিত।

পরদিন মাহিরকে মিথ্যে করে বললাম, ‘জ্বরজ্বর লাগছে রে, ক্লাসে আসছি না।’ মাহির বলল, ‘ঘুমা, আমি সন্ধ্যায় ফোন দেব।’ ফোন রেখে একচোট সাজগোজ করলাম। ঠিক এগারোটায় ইশতিয়াক হোসেনের দেওয়া ঠিকানামতো চলে গেলাম তার বাসায়। ফোনে বলাতে তিনি নিজেই নেমে এলেন গেটের সামনে। ফেসবুকে আপলোড করা ছবিতে ভদ্রলোককে যেমন দেখায়, বাস্তবে তার চেয়েও তরুণ। হাসিখুশি, লম্বা-চওড়া, মাথাভরা কালো চুল। বয়স অনুযায়ী কোনো হাফসার্কেল ভুঁড়ি তার শরীরে বাসা বাঁধেনি। তাকে দেখেই আমার অস্বস্তি কেটে গেল। সৌজন্য কথাবার্তা বলতে বলতে পোর্চ পেরিয়ে গেলাম আমরা। লিফটে ঢোকার সময়ে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সিমি, এত সুন্দর তুমি, অথচ এতোদিনে একটা ছবিও আপলোড করলে না?’ হঠাৎ ‘সিমি’ নামটা কানে যেন কেমন খটকা লাগাল, সামনাসামনি কখনো এই নামে কেউ তো আর আমাকে ডাকেনি! যেন আনমনা হয়ে জবাব দিতেই ভুলে গেলাম। পাশের সোফায় বসতে বসতে ইশতিয়াক হোসেন বললেন, ‘যাই হোক, তোমাকে শেষ পর্যন্ত দেখতে পাব, ভাবিনি।’ আমি কথা ঘোরানোর জন্য বললাম, ‘আজ অফিসে যাননি?’ তিনি বললেন, ‘অফিস তো আমার নিজের, একদিন না গেলে কিছু হয় না।’ তারপর একটু কৌতূহলী হয়ে বললেন, ‘তোমার আজ ক্লাস নেই?’ আমি হেসে বললাম, ‘ক্লাস আমার নিজের।’ তিনি হাসতে হাসতে উঠে গিয়ে আমার জন্য গ্লাসে বরফ দিয়ে জুস ঢেলে নিয়ে এলেন। নিজের গ্লাসে একটু জিন মিশিয়ে নিতে নিতে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার গ্লাসে দেবো, সিমি?’ আবার ‘সিমি’ নাম শুনে চমকে উঠে বললাম, ‘নাহ্, আমি শুধু জুসই নেব।’ আমার দিকে গ্লাস বাড়িয়ে ধরায় জানতে চাইলাম, ‘বাসায় কেউ নেই?’

‘বউ স্কুলে গেছে, পড়ায়, বাচ্চারাও স্কুলে। আর কাকে চাও? তুমি তো আমার কাছেই এসেছ, তাই না?’

আমি হাসতে চেষ্টা করলাম। আমার সত্যিই তখন মনে হলো, আমি ফারহা সিমি, যে এতদিন ধরে ইশতিয়াক হোসেনের সঙ্গে হাজার লাইন চ্যাট করেছে, কাউকে না বলা অনেক কথা বলে ফেলেছে। অস্বীকার করতে পারব না, একসময় আমারও ইশতিয়াক হোসেনকে দেখতে ইচ্ছে হয়েছে আর সেজন্যেই আমি সেদিন তার বাসায় উপস্থিত হয়েছিলাম। আমি গেলে ইশতিয়াক হোসেন বাড়ি খালি করে রাখবেন, সেটা কি আমি আন্দাজ করিনি? করেছি নিশ্চয়ই। গ্লাস হাতে নিয়ে তিনি একই সোফায় আমার গা ঘেঁষে বসলেন। আমি সরে যাইনি। এতদূর এসে ভয় পাওয়ার ভান দেখানোর কোনো মানে হয় না। ইশতিয়াক হোসেনের এক হাতে ড্রিংক আর আরেক হাত আস্তে আস্তে আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরল। খুব ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে হাতটা আমার পিঠে ওঠানামা করতে লাগল। এর মধ্যে তিনি কথায়, হাসিতে এমন করে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন যেন তার হাতের অবস্থান আমার মনোযোগ এড়িয়ে যায়। আমি যেন একটা শিশু, জানিই না যে আমাকে জাগানো হচ্ছে। আমি মুচকি হেসে তার দিকে তাকালাম। তার আঙুলগুলো আমার ঘাড় বেয়ে নিচের দিক থেকে উঠে চুলের ভেতরে ঢুকে গেল। তার ঠোঁট ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, চোখ অনুমতি চায় যেন। এতই ধীরে মুখটা আমার মুখের কাছে এসে একটু থামল, যেন চাইলে মানা করতে পারি আমি। মানা করিনি। ড্রিংক শেষ হওয়ার পরে আমরা পরিপাটি বেডরুমটায় চলে গিয়েছিলাম যেখানে তার বউ হয়তো অফিসে যাওয়ার আগে, দেখলেই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে এমন কতকগুলো পেইস্টাল শেড্সের কুশন বালিশের সামনে পরমযত্নে সাজিয়ে রেখেছেন। টানটান করে বিছানো, জলছাপের ফাঁকে ফাঁকে ঘন এমব্রয়ডারি করা বেডকভারের ওপরে কোনো আগন্তুকের বিচরণের কথা মহিলা নিশ্চয় স্বপ্নেও ভাবেননি। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেসবকিছুর কোনোটাই নিজের জায়গায় ছিল না। তবে ঘণ্টাখানেক পরে এলোমেলো বালিশ-কুশন ইশতিয়াক হোসেন নিখুঁত হাতে গুছিয়ে রাখলেন। বালিশের পাশে একটি ম্যাগাজিন ঠিক যেভাবে বুক মার্ক রাখার জন্য নিজেকে দুই ভাগ করে বিছানার দিকে মুখ দিয়ে উলটে পড়েছিল, আবার ঠিক সেভাবেই রাখা হলো তাকে। ইশতিয়াক হোসেন টিভি ছেড়ে দিয়ে বাথরুমে গিয়েছিলেন, আমি ফাঁকে সেই কিছু চ্যানেল ব্রাউজ করেছিলাম। তিনি ফিরে এসে চ্যানেল ঘুরিয়ে আবার স্টার প্লাসে এসে থামলেন, হেসে বললেন, ‘এই টিভি শুধু লাবণী, মানে আমার বউ দেখে, আর স্টার প্লাসেই দেওয়া ছিল, আমি দেখেছি।’ চারদিকটা এমন করে গোছানো হলো যেন এইমাত্র সেখানে একটা ক্রাইম সিন হয়ে গেছে, খুন-টুন জাতীয় কিছু, খুনি চেষ্টা করছে তার উপস্থিতির সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলতে। আপ্রাণ চেষ্টা চলছিল, একটি ফিঙ্গারপ্রিন্টও থাকবে না কোথাও।

বাসায় ফিরে এসে সেদিন দেখি ফারহা সিমিকে মেসেজ পাঠিয়েছে মাহির, ‘তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। প্লিজ একদিন দেখা করো আমার সঙ্গে। আসবে তো?’ এই মেসেজ দেখে আমার মেজাজ এত খারাপ হলো যে কোনো উত্তরই দিলাম না, বরং ইশতিয়াক হোসেনকে ফোন করে আলাপ জুড়ে দিলাম। গত তিনদিন ক্লাসে যাইনি, ইশতিয়াক হোসেনের ওখানে গেছি। মাহির ফোনে মেসেজ রেখেছে, ‘তুই কই?’ আমি রিপ্লাই করেছি, ‘আমি মারা গেছি।’ মাহির বাসায় এসেও আমাকে পায়নি। আমার উদ্দেশ্য ছিল মাহিরকে কষ্ট দেওয়া। তার অপরাধ, সে ফারহা সিমির সঙ্গে দেখা করতে চায় কেন?

কিন্তু আজ ফারহা সিমির অ্যাকাউন্ট খুলতেই মাহির লিখল, ‘কী হলো সিমি? আমার সঙ্গে দেখা করবে না?’

‘কী করে? তুমি যে বলেছিলে তোমার একজন গার্লফ্রেন্ড আছে, নাম সামিয়া?’

‘সে আছে কি নেই বুঝতে পারছি না। সামিয়া আমাকে অ্যাভয়েড করছে। আর আমি নিজে থেকেও ভাবলাম ব্রেক-আপে যাবো। ইনস্টেড তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে সিমি। তোমার সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, তুমি শুধু আমার জন্যই তৈরি। প্লিজ আসো না কাল -’

মেসেজ দেখে হিংসায় আমি জ্বলেপুড়ে মরে গেলাম। বুঝলাম না কাকে হিংসা করছি। আমার চোখের পাশের শিরাগুলো দপদপ করে উঠল। একবার দেখেছিলাম এক মা দুষ্টুমি করে নিজের বাচ্চার আরো ছোটকালের ছবি দেখিয়ে বাচ্চাটিকে বলছে, ‘আমি ওই বাবুটাকে আদর করি, তোমাকে করি না, হি হি…’ বারবার একই কথা বলে মা হাসতে হাসতে ছবিটাকে বুকে চেপে ধরছিল। বাচ্চাটা পড়ি-মরি করে মায়ের হাত থেকে ছবিটা ছিনিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল। কাঁদতে শুরু করায় মা ছবি ফেলে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘তোমারই তো ছবি, সোনা, তোমাকেই আদর করি।’ বাচ্চাটা তবু শান্তি পাচ্ছিল না। মায়ের বুকের ভেতরে ছবিটাকে খুঁজছিল ধ্বংস করার জন্য। ছবিটাই তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী, হোক না সেটা সে নিজেই!

চেয়ারে এলিয়ে চোখ বন্ধ করে চিন্তার ভেতরে ডুবে গিয়েছিলাম আমি। চ্যাট মেসেজের শব্দে চোখ খুললাম। দেখি আবার মাহিরের একই মেসেজ, ‘কী ভাবছ, আসবে না সিমি?’

এবারে একটা উত্তর দিতেই হয়। আমার আঙুলগুলো অবশ  হয়ে এলো, যে-আঙুলগুলো আমার নয়, এই মুহূর্তে ফারহা সিমির। তবু।