এই চরাচর

প্রশান্ত মৃধা

এইখানে চরাচর আসিয়া মিশিয়া গিয়াছে!

সত্যি! একেবারে সত্যি কথা! যে-লোকটি অথবা যে-ছেলেটি কবির ঢঙে এই কথা বলে পরের বাক্যটির জন্যে একটু থামল, সে সত্যি কথাই বলেছে। শহরের ভেতরে এইটুকু জায়গা, কিছুদিন আগে দেওয়া নাম স্বাধীনতা উদ্যান। কার কার স্বাধীনতা এখানে রচিত কিংবা খর্ব হয় সেই হিসেব তোলা থাক। কারণ, এইখানে চরাচর এসে মিশেছে, তাতে স্বাধীনতা অব্যাহত অথবা ব্যাহত হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।

শহরের ভেতরে এইটুকু জায়গায় তবু কিছু স্বাধীনতা সত্যি অব্যাহত আছে। স্বাধীনতা উদ্যান বলে কথা। একদা এখানে, ঢোকার পথে ডানদিকে একখানি মঞ্চ ছিল। চাইলেই যে-কেউ বেনিয়া ব্রিটিশরাজ কি স্বপ্নের পাকিস্তান সরকারকে গালমন্দ করতে পারত সুযোগ বুঝে। তারপর বাঁধানো পুকুর। বাঁয়ে এসডিওর বাড়ি। সেদিকটায় দেয়াল থাকলেও গাছগাছালি মিলে দিগন্ত বিস্তৃত। পুকুরের ওপারে মহিলা পার্ক, ভালো বাংলায় প্রমীলা উদ্যান! তারপর বড় রাস্তা। ফলে, এই চত্বরে ঢুকে দক্ষিণমুখী হয়ে দাঁড়ালে একেবারে যেন বঙ্গোপসাগরের আকাশ দেখা যায়। যে-বাতাস এসে গায়ে লাগে তাতে ওই সাগরের লোনাজলের ভাপ। পুকুর পাড়ে দাঁড়ালে চোখ একদম দক্ষিণের আকাশে যতখানি সম্ভব প্রসারিত করে দেওয়া যায়। পুকুরের বাঁধানো ঘাট, বড় আর প্রশস্ত। বসে থাকা যায় চাইলে সারাটা দিন। ডানের দিকে নিম্ন মাধ্যমিক ইস্কুল। সকালের দিকে শিশুদের কোলাহল, তাও বেশ সহনীয়। সেখানে একদিন ফাঁকা চত্বর ছিল। পুকুরের কোল-ঘেঁষে ছিল জলের পাম্প, উপরে তোলা বিশাল কালো রং ট্যাংকি। সকাল ও বিকেলে সেখান থেকে জলের সাপ্লাই হতো শহরজুড়ে। সেদিনের ছোট শহরের প্রয়োজনীয় চাহিদা এইটুকুতেই মিটে যেত। আজ সে-জলের কল ও পাম্প সবই সরে শহরের উপান্তে চলে গেছে। তবু, এই ফাঁকা জায়গাটুকু নিয়ে বিন্যস্ত মাঠে দাঁড়িয়ে যে-কেউ অমন কাব্য করে সত্যি বলতে পারে, এইখানে চরাচর আসিয়া মিশিয়া গিয়াছে!

কারণ, পাশে এসডিওর বাড়িতে প্রচুর গাছপালা, তার পাশে কোর্ট-চত্বরেও বড় বড় শতবর্ষী গাছ, সন্ধের আগে আগে গোটা এলাকা প্রচুর পাখির কলতানে মুখরিত হয়। রাস্তায় যেটুকু আলো জ্বলে তাতে সমস্ত অন্ধকার কোনোভাবেই ঘোচে না। ফলে, সন্ধে হওয়ামাত্র শুধুমাত্র দোকানপাটময় বাজার এলাকাটুকু বাদ দিলে সারা শহর আর কোনোভাবেই যেন শহর থাকে না, একখানি প্রায় আদর্শ গ্রামের দৈনন্দিন সাক্ষ্য বহন করে। তখন কোর্ট-চত্বরে আইন আদালতের মানুষজন আর কেউ নেই, আছে কিছু গৃহহীন। এই চত্বরেও তখন তাই। ইস্কুলের পাশ ঘেঁষে বেঞ্চিগুলোয় তেমন কিছু মানুষ। পুকুরের পাড়ে উত্তরমুখী নতুন বানানো মঞ্চের পেছনেও তেমন মানুষ, দুই একজন। ওদিকে এসডিওর বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে বানানো যুবকেন্দ্রের যুবকেরাও চলে গেছে। সেখানে বারান্দা নেই, তো নেই কোনো আশ্রয়প্রার্থী। কিন্তু একেবারে বাম কোনায় রেড ক্রিসেন্ট ভবনের বারান্দায় কেউ কেউ হয়তো রাত কাটিয়ে দিতে এসেছে। কেউ না আসলেও আসবে অবশ্যই পাগলা রহম। রাত্রিকালে এইখানে তার উপস্থিতি অবধারিত। তারও কারণ আছে। রেড ক্রিসেন্টের পেছনে রাস্তার পাশে ট্রাফিক পুলিশের রান্নাঘর। সেখানে রান্না করে এজিদের মা। এজিদের মাকে রহম পাগল বোন ডেকেছে। ফলে, কখনো কখনো রাত্রে এই দেয়ালের পাশে দাঁড়ালে রহমের থালায় (অথবা, থালাটা এজিদের মা-ই দেয়) এজিদের মা ভাত কি ডাল কি মাছ ও মাংসের টুকরো তুলে দিতে পারে।

তখন পুকুরপাড়ে মঞ্চের পেছনের বেঞ্চের নিচ থেকে চুলা বের করে বেঙ্গা, রান্নার কাঠ টুকিয়ে এনেছে বেঙ্গি। বেঞ্চটা এমন যে বৃষ্টিতে পুকুর না তলালে এই চুলা কখনোই ভিজবে না। বেঙ্গা চুলাটা বেঞ্চের ওপর রাখে। তখন কেউ বেঞ্চের ওপর বসে এই জীবন, এই জগৎ, এই বেঁচে থাকা নিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে পুকুরের জলে বাতাসের তরঙ্গ দেখতে দেখতে যদি নারকেল গাছের পাতায় বাতাসের আন্দোলনের সঙ্গে নিজের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎকে জড়িয়ে আনমনা হয় তো বেঙ্গা তার লুলো বাম হাত পাশে ঝুলিয়ে অস্ফুট স্বরে কিছু একটু বলার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকবে। বেঙ্গি একটু দূরে, পেছনে। পুকুরের ঘাটলার উপরের দিকে ইস্কুলের একদম গায়ে একটা বেঞ্চের নিচপাশে হাঁড়িতে চাল ধুয়েছে। হয়তো সন্ধের আগে আগে কেটেছে কোনো সবজি, বাজার থেকে টুকিয়ে চেয়েচিন্তে কাগজের ঠোঙায় ভরে এনেছে ছোট কুঁচোমাছ। হতে পারে চিংড়ির ঝাঁকাবাছা ছোট চিংড়ি, কুঁচো চিংড়িই, ঘুষো চিংড়িও তাকে বলে স্থানীয়রা। কিন্তু বেঙ্গির কাছে এই কুঁচোই গলদা, কুঁচোই বাগদা, কুঁচোই কাঁঠালি। তা বাগদা গলদা ভাগ্যে না জুটুক, কখনও কি এই ঝাঁকাবাছা চিংড়ির ভেতরে একটা দুটো ডিমভরা কাঁঠালি তার ভাগ্যে জোটে না? সারাদিন কোর্টের সামনে আর এর আশেপাশে বেঙ্গা আর বেঙ্গি ভিক্ষে করে চারটে পয়সা পায়, যা দিয়ে জাটকা বলো আর চন্দনা বলো ইলিশ কিনতে পারে। তাও কেনে। কোনো দিন পোয়াটেক মাংসও তো কেনে। পুকুরের পাড়ে, সিঁড়ির গোড়ায় বসে বেঙ্গি তাই কাটে বাছে ধোয়। রান্নার জন্যে প্রস্ত্তত হয়। তখন হয়তো এইদিকে মঞ্চের পেছনের বেঞ্চের নিচ থেকে আলগা চুলোটা নিতে এসেছে বেঙ্গা। কিন্তু এই উদাসী মানুষটা বসে আছে একা। বেঙ্গা তাকে সরতে বলতে পারছে না। একপাশ থেকে ঢুকে তারপর যে চুলাটা বের করে আনবে বেঙ্গার শরীরে সেই শক্তিও নেই। একখানা হাত কর্মক্ষম তার। বেঙ্গা লোকটার সামনে ঘোরে, পেছন পাশে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটা ভাবে, তার সিগারেটের শেষ টুকরোটা টানার জন্যে এই আধপাগল লুলো এখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেও এদিকে স্থির করেছে যেন সুখটান না দিয়ে সিগারেট ছুড়ে ফেলবে না। অথচ, বেঙ্গার কী ঠেকা পড়েছে মানষির টানা সিগারেটের গোয়ায় চুমা দেয়ার? বেঙ্গি তাকে মানা করেছে। তারা দুইজন একটা করে বিড়ি ধরায় আর টানে। সে চুক্তি এমনি এমনি হয়ে গেছে।

চুলোটা নেয়ার জন্যে অসহায় বেঙ্গা দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটা তা সত্যি বোঝে না। সে নারকেল মেঘনিশ কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে ডালে লেগে এদিকে বয়ে আসা নোনাবাতাস গায়ে মাখে। নিজের জীবনের কথা ভাবে। শেষ টান না দেওয়া পর্যন্ত সিগারেটটা ছুড়ে পুকুরের জলে ফেলবে না তা না ভাবলেও, তাই করে। ওদিকে বেঙ্গি দাঁড়িয়ে বেঙ্গার চালচরিত দেখে। তার রান্নার সময় যায়। এরপর রানবে কখন, খাবে কখন আর ঘুমাবে কখন? তাই বেঙ্গি নিচু গলায় খোঁচায়, ‘দাঁড়াইয়া দেহো কী? ছেড়ো কার বাল?’

এতে বেঙ্গা একবার ফিরে বেঙ্গিকে দেখতে চায়। কিন্তু অন্ধকার এখন গাঢ়! মানুষের অবয়ব ছাড়া আর কোনো কিছুই দেখা যায় না। যেমন, বেঙ্গা দাঁড়িয়ে থেকেও লোকটির মুখের ভাষা, চোখের ওঠানামা কোনোকিছুই পড়ে নিতে পারছে না। ওদিকে অমনভাবে বসে থাকা একজন মানুষকে সে সরতে বলতে পারছে না। সে-মুরোদ বেঙ্গার নেই। বেঙ্গা তা জানে না। বেঙ্গি জানে। কিন্তু তার আগে তাকে তো ঘটনাটা জানতে হবে, কেন বেঙ্গা ওইখানে কুদঘাটার ডাকঅলার মতো দাঁড়িয়ে আছে!

এই সময় লোকটা টোকা দিয়ে সিগারেটটা পুকুরে ফেলে। তারপর উঠে পেছন ঘুরে হাঁটতে থাকে। চত্বর থেকে হয়তো বেরিয়েই যাবে। বেঙ্গার তা দেখার সময় কই। দ্বিতীয়বার বেঙ্গি বলেছে, ‘বাতিও জ্বালাও নেই, দাঁড়াইয়ে বাল ছিড়িচো কার?’ হ্যাঁ, বাতি জ্বালাতে হবে। দেশলাই বেঙ্গার টেঁকে গোঁজা। বাতি না জ্বালালে চুলোও জ্বলবে না। বেঙ্গা নিচু হয়ে চুলোটা বেঞ্চের নিচ থেকে টেনে বের করে। ডান হাতে কোমরের সঙ্গে জড়িয়ে হেলেদুলে বেঙ্গির কাছে যায়। যেতে যেতে ডান দিকে অন্ধকারে লোকটার যাওয়া দেখে। লোকটাকে গালমন্দ করে না। কিন্তু টিটকিরি মারে। এতক্ষণ ঠোঁটে ঠোঁটে প্রায় আওড়েছিল, ‘দেখি সাহেব সরেন দি, চুলোডা,’ কিন্তু বলেনি; এখন সেটাই বলল, ‘লাটসাবের ছ’ল – জমিদারের মতন যাতিচে!’ বিড়বিড়ানিটা বেঙ্গি শুনল। কিছু বলল না। অন্ধকারে বেঙ্গার মুখের দিকে চাইল। তারপর গেটের দিকে। লোকটা রিভলভিং গেট ঠেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর বেঙ্গা দেখল রেড ক্রিসেন্টের পাশের ভাঙা দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ছেলে কোলে নিয়ে হেঁটে আসছে লতিফা। ওই কোনার রাস্তায় আলো আছে। লতিফাকে দেখে বেঙ্গার মুখে খুশির ভাঁজ। লতিফার হেঁটে আসা দেখে, বেঙ্গি ভাবছে অন্য কথা। খাইয়ে আসতিচে, নয়তো হাঁটায় এত জোর থাকত না! বারোভাতারি মাগি, কোথায় যে খাওয়া পায়? ঠেলা খায়, ঠেলা খালি ভাতের অভাব নেই! শেষটুকু বিড়বিড়ানি। লতিফা এখনই তাদের কাছে আসবে না, হয়তো। ইস্কুলের দেয়াল ঘেঁষে একটা বেঞ্চে ছেলেকে নিয়ে বসে থাকবে। ছেলেকে ঘুম পাড়াবে। কখন যুবকেন্দ্র বন্ধ হয় তাই ভাববে। রাস্তার দিকে তাকাবে। রাতে যদি কেউ আসে কোথায় যেতে বলবে তাই ভাববে। তারপর একবার হয়তো বেঙ্গির কাছে এসে জানতে চাইবে কী রান্ধে সে? যদি ততক্ষণে রান্না শেষ হয়ে যায়, তা হলে একটি বেঞ্চের নিচে কি ইস্কুলের টিনের চালার তলে যেখানে তার ঘুমানোর পোঁটলা-পুঁটলি রাখা তা বের করে ছেলেটাকে শুইয়ে আসবে বেঙ্গা-বেঙ্গির সঙ্গে পুকুরের ঘাটলায় বসে গল্প করতে। যদি ততক্ষণে তার কাছে কেউ আসে, তাই-বা তখন কেমন করে হবে? হয়তো বেঙ্গা-বেঙ্গিকে ঘুমে অচেতন ভেবে যে এসেছে তার সঙ্গে চলে গেছে নির্মীয়মাণ রেড ক্রিসেন্টের দোতলায়। অথবা, রাস্তার উলটো পাশে ক্লাবের বারান্দায়। অথবা, রাত্রির এমন নিশুতি যে কোথাও যাওয়ার দরকার পড়েনি একটু তফাতে অন্য একটি বেঞ্চিতে চলে গেলেই হবে। অথবা, এর কোনোটাই নয়, লতিফা বেঙ্গা-বেঙ্গি ঘুমিয়ে গেলে পুকুরের ঘাটে এসে একা একা বসে আছে। বইছে দখিনা বাতাস, সে গুনগুনিয়ে গান গাইছে… আগে যদি জানতাম রে বন্ধু… সেই গানে কারো ঘুম ভাঙবে না, একটা পাখিও জাগবে না, শুধু একদিন বেঙ্গা তার পাশে এসে বসেছিল বা বসবে।

এখন কিন্তু লতিফা পুকুরের দিকে এল না। রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় উঠে উলটো দিকের সিঁড়িতে বসে থাকল। সেই সিঁড়ির দিকে যুবকেন্দ্রের পুব কোনার আলো পড়েছে। লতিফার মুখে আলো, শরীরেও। কোলের ছেলেটা তাকে যে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে তাও বোঝা যায়। বেঙ্গি ফুঁ দিয়ে চুলো ধরায়, বেঙ্গা দাঁড়িয়ে লতিফাকে দেখে। দিনমানে তো প্রায় দেখতে পায় না। দুপুর গড়িয়ে গেলে এ ঘাটলায় গোসল করতে আসে লতিফা । ইস্কুলের টিনের চালের নিচে গোঁজা শাড়ি ব্লাউজ বের করে আনে। কোনোদিন আনে ছেলেটার পরনের হাফ প্যান্ট, কোনোদিন আনে না। হয়তো ছেলেটার পরনের প্যান্ট একটাই। তখন ছেলেটাকে চটকে কচলে নাইয়ে ঘাটলার ওপরে বসিয়ে রেখে লতিফা নিজে গোসল করে।

প্রতিদিনই লতিফাকে এ সময়ে ঘাটলায় আশা করে বেঙ্গা। এটা যেন তার নিজস্ব সময়। দুপুরের রান্নার পরপর বেঙ্গি গোসল করে। বেঙ্গা তখন গাছের ছায়ায় গড়াগড়ি খায়। বেঙ্গি চাইলে তার শাড়িটা এগিয়ে দেয়। বেঙ্গি বললে এক হাতে বেঙ্গা তার পিঠ ডলে দেয়। অাঁচলে সাবান ডলে দিলে সেই সাবানে বেঙ্গির পিঠ ডলতে ডলতে বেঙ্গা লতিফার প্রশস্ত ও ফরসা পিঠের কথা ভাবে। বেঙ্গির পিঠ শুকনো। অাঁচলের কোনায় সে পিঠ ডলতে ডলতে শাড়ির অাঁচলে বেঙ্গির বগল কি স্তনের উপর-নিচে যখন বেঙ্গা অনায়াসে হাত চালায় তখন তার লতিফার শরীর মনে করা খুব স্বাভাবিক! বেঙ্গির শুকনো স্তন, ঝুলে গেছে, সেখানে বেঙ্গার পরিচিত হাত, কোমরে মাংস নেই, মেদও না; তার বদলে লতিফার ভারী বুক ও মেদবহুল কোমর যদি বেঙ্গার কল্পনায় ভাসে, তখন তো সে মনে মনে এই মুহূর্তে একবার লতিফাকে ভেবে নিতেই পারে। কল্পনায় ভাবতে পারে এখন সে কোথায়, এখনো আসে না কেন স্নানের ঘাটে? কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, আসে না কেন এখনও নাইতে ধুতে।

নাইলে ধুলে বেঙ্গিকেও ভালো দেখায়। গায়ে লতিফার মতন ব্লাউজ থাকে না, কিন্তু চুলে তেল দিয়ে তা টানটান করে আঁচড়ালে, শাড়িখানা কোমরে গুঁজে পরলে তখন বেঙ্গিকেও খুব খারাপ লাগে কোথায়। কত পদের অসুখে মানুষ বেঙ্গি। একবার ব্যথার চোটে হাসপাতালে ছিল। কিছুদিন বাদে সেই মানুষ আবার সুস্থ হয়ে যে তার সঙ্গে সংসার পাতাবে সে-কথা বেঙ্গা ভাবেনি। তারপর থেকে বেঙ্গি যেন কোলে একটু কুঁজো দিয়ে গেছে। গেছে তো গেছে, সেই কোলকুঁজো ভাব বেঙ্গির আজো কোনোভাবেই ছাড়াল না। কী আর করা? তবু এই একটা মানুষ কোথায় কোন দেশ থেকে ভাসতে ভাসতে আজ তার কাছে এসে জুটেছে, সাথে আছে। বেঙ্গির সঙ্গে চারটে ভাত খেয়ে গাছের ছায়ায় ঘাড়ের গামছা পেতে পায়ের ভাঁজে পা তুলে দিয়ে এই কথা ভাবতে ভাবতে বেঙ্গা কিন্তু লতিফার জন্যে অপেক্ষা করে।

অথচ বেঙ্গি যখন নায় কি বেঙ্গির শরীর ডলে ডলে যখন নাইয়ে দিচ্ছিল বেঙ্গা তখনও কিন্তু বেঙ্গি কতবার বলেছে, সে কেন নাইচে না। না-নাইয়ে ভাত খায় না। সে-কথা শোনেনি বেঙ্গা। বেঙ্গির নাওয়া হলে, বেঙ্গির সঙ্গে খেয়ে পেটটা ভাসিয়ে দিয়ে গাছতলা পর্যন্ত এসেছে। এখন হাতে একখানা ভাঙা থালা নিয়ে বেঙ্গি বেরুবে। সন্ধ্যার আগে ফিরবে। বেঙ্গা পাহারা দেবে তাদের ঘরহীন সংসার। আর লতিফার জন্যে অপেক্ষা করবে।

কেন সে বিকেল পড়তে পড়তে নাইতে আসে তার একটা হিসেব লতিফার কাছে আছে। সে হিসেব কম করে হলে বেঙ্গা বোঝে, আর কেউ না বুঝুক। বেঙ্গি যখন নায়, তখন ভরদুপুর। গরমের দিন সূর্য সবে পশ্চিম দিকের বড় রাস্তার নারকেল গাছগুলোর পাতার ভাঁজে ভাঁজে আটকে যাচ্ছে। তাতে তাপ কিন্তু কমে না। অত বড় নারকেল গাছের মাথায় সূর্য – তার মানে বেলা সবে হেলল। জওয়ান সূর্যের তেজ এই সময় সবচেয়ে বেশি। মানুষ তখন বাইরে তিষ্টোয় এমন উপায় আছে? সবারই গলায় কারবালা, চোখের সামনেও কারবালা। পারলে নদীতে নামে। এই পুকুরের ওপারের ঘাটলায় তখন রাজ্যের মানষির ভিড়। এই পাশেও। তার ভেতরে এক কোণে বেঙ্গি, তারে নাইয়ে দিচ্ছে বেঙ্গা। বাকি মানুষের তো কোনো চ্যাটের দায় পড়েনি বেঙ্গির নাওয়া দেখে। দেখলে বরং ওপারে চেয়ে দেখতে পারে। আশেপাশের হিন্দুবাড়ির কাজের লোক মাইয়েরা বুড়িরা নায়, দেখপি যদি তাই দেখ। এক সময় এই দুটো ঘাটে নারী-পুরুষের একটা হিসেব বাঁধা ছিল। এই ঘাটে পুরুষরা, ওই ঘাটে মহিলা। সেই হিসেব খানিকটা এখনও আছে, কিন্তু বেঙ্গির জন্যে সেই হিসেব কেউ মনে করতে চায় না।

লতিফার হিসেবটাও এই : বিকেলের দিকে ঘাটে পুরুষ মানুষ বলতে গেলে প্রায় কেউ থাকেই না। থাকলেও কম। তবে সন্ধ্যার আগে আগে মানুষের সংখ্যা কিছু বাড়ে। লতিফা তখন নেয়েধুয়ে রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় বসে মাঠে এই পাড়ার ছেলেদের ফুটবল খেলা দেখে। বেঙ্গা তখন মঞ্চের পেছনে গড়াগড়ি খায়। সেদিকে বল যায় না। গেলে, অস্ফুট গালাগালি করে কিন্তু গলা উঁচু করে কিছু বলে না। ভাবে, জোর গলায় বললে যদি এই ছেলেরা তাদের বাপ-কাকাকে বলে তাদের এই পার্কে থাকা থেকে উঠিয়ে দেয়। তা হলে সে বেঙ্গিরে নিয়ে যাবে কোথায়? কোর্টের বারান্দায়? তা যাবে না, সেখানে হাজার পদের মানুষ রাত্রে ঘুমায়। কয়দিন আগে নাকি ওই ট্রাফিক পুলিশদের একজন কোর্টের বারান্দা থেকে একটা মেয়েকে তুলে প্রথমে তহসিল অফিসের বারান্দায় ফেলে করেছে তারপর পেছনের টেনিস কোর্টের পাশে নিয়ে আরও কয়েকজন নাকি লাগাইতে লাগাইতে মেয়েটাকে মেরেই ফেলেছে। এইসব এজিদের মা বেঙ্গিকে বলেছে। এজিদের মা ট্রাফিক পুলিশদের ওই রান্নাঘরে কতদিন ধরে রান্না করে, সে সব জানে। কিন্তু বেঙ্গার মনে হয়, এজিদের মা ট্রাফিক পুলিশদের পক্ষে বলেছে। বেঙ্গি বলেছে, মেয়েটা খারাপ মেয়ে ছিল। এমনিতেই ট্রাফিক পুলিশদের কাছে যেত। সেইদিন মনে হয় টাকা-পয়সা নিয়ে বনিবনা ঠিকঠাক না হওয়ায় এই কাজ করেছে তারা। কিন্তু এই কথা শুনে বেঙ্গা বেঙ্গিকে বলেছিল, ‘যতই খারাপ মাইয়ে হোক, সেই জন্যি মাইরে ফেলাতি হবে?’ শুনে বেঙ্গি মুখ-ঠোঁট মুচড়ে বলেছিল, ‘এত দেহি দরদ, যাইতা নাকি ওই মাইয়ের ধারে?’ বেঙ্গা কিছু বলেনি। মাইয়ে মানষির এই এক কথা, কথায় কোনো যুক্তি দিতে না পারলি মাইয়ে মানষির ধারে যাওয়া নিয়ে খোঁটা। বেঙ্গা জানে, বেঙ্গি এইরকম ভাবতেই পারে। তার একখান হাত লুলো, পেটটা উঁচু হয়ে গেছে, তারপরও শরীরে জোর কি কম! চাইলি এখন সে রোজ রোজ মাইয়ে মানষির কাছে যাতিই পারে। কিন্তু বেঙ্গির শরীরের কী দশা! প্রায় ভাইঙ্গে পড়ার জোগাড়। একদিন বেঙ্গির ধারে আসলি (এলে) দশদিন তফাতে থাকতি কয়। একদিন গায়ে একটু ছুঁলি পরদিন ছুঁতিও দেয় না। অথচ, বেঙ্গা কি বুড়ো হইয়ে গেইচে? তার শরীরে কি কোনো তাপ নেই! সেই তাপে, একদিন যদি একবার বেঙ্গির সামনে কোনো ফাঁকে লতিফার দিকে তাকায় তো যেন তেলের ওপরে বেগুন পড়ল। বেঙ্গা জানে, এখন বেঙ্গির ধান্ধা লতিফাকে এই জায়গা থেকে তাড়ানো। এই জন্যে রহম পাগলার সঙ্গে খাতির করতিচে। ঠারে ঠারে বেঙ্গা এই কথা বুঝতে পেরে আজকাল বেঙ্গি সামনে থাকতে লতিফার দিকে প্রায় চাইয়েই দেখে না।

কিন্তু লতিফা যখন গোসল করতে ঘাটে আসে, তখন? তখন চাইলেই মঞ্চের পেছন পাশের ছায়ায় কি গাছতলায় বেঙ্গা দুই চোখের পাতা বুজে থাকে কী করে? বরং, তখন তো তার মনে হয়, পারলে নাটকের ছেলেদের মতো মঞ্চে উঠে পুকুরের ঘাটলার দিকে চেয়ে ডায়লগ দেয়। কিন্তু নাটকে কীসমস্ত কঠিন কঠিন কথা কয়। শুধু খেপা পাগলা নামের এক পাগলের নাটকের প্রায় সব কথা সে বুঝেছিল। সেই নাটকের পাগল দেখতে প্রায় রহমেরই মতন, কিন্তু ওই ডায়লগ কি এখন লতিফার দিকে বলা যায়! মঞ্চের ওপরে রোদ্দুর। নাটক বক্তৃতা হয়। বক্সিং কুস্তিও। ফলে পায়ের ঘষায় ঘাস মরে দফারফা। সেখানে উঠে গড়াগড়ি দেয়ার উপায়ও নেই। উঠলে তারে মানুষ তয় রহম পাগলার চেয়েও বড় পাগল ঠাওড়াবে। কিন্তু বেঙ্গার ইচ্ছে করে মঞ্চের ওপরে উঠে একখানা হাত তুলে আর লুলো হাতখান নাড়িয়ে রাজ্জাকের মতো গান গায় : এ-আকাশকে সাক্ষী রেখে, এ-বাতাসকে সাক্ষী রেখে, তোমাকে বেসেছি ভালো… কিন্তু তারপর মনে হয়, আশেপাশে বেঙ্গি নেই তো। বেঙ্গির এখন কোনোভাবেই এইখানে থাকার কথা নয়। সে গেছে লঞ্চঘাট। দুপুরের পরপর মোরেলগঞ্জ, কচুয়া, রামপালের হেড়মা এইসব দিকের লঞ্চ ছাড়ে, লঞ্চঘাটে ভিড় বাড়ে… এখন থেকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত বেঙ্গি লঞ্চঘাটে থাকে, তারপর চলে যায় নাগেরবাজার, চালের আড়তগুলোর সামনে দাঁড়ায় নয়তো বাজার থেকে কিছু কিনে নিয়ে ফেরে। ফলে, বেঙ্গি আসবে না, বেঙ্গা জানে। অন্য মানুষও তেমন কেউ ঘাটে নেই। এই সময় লতিফাকে গোসল করতে দেখে বেঙ্গা উঠে মঞ্চের এক পাশে পা ঝুলিয়ে বসে না ঠিকই, কিন্তু শোয়া থেকে উঠে বসে। লতিফাও জানে সে-কথা। আড়চোখে তাকিয়ে দেখে বেঙ্গা কী করছে।

বেঙ্গাও এই সুযোগটা নেয়। চারধারে লোকজন নেই। এই পাড়ার ছেলেপুলেরা খেলতে আসবে বিকেলে। এখন পুকুরের এই কোনায় বেঙ্গা আর ঘাটলায় লতিফা। ছেলেটাকে এইমাত্র গা চটকে নাইয়ে মুছিয়ে উপরে তুলে রেখেছে। লক্ষ্মী আছে ছেলে। বসিয়ে রাখলে নড়ে না। ডান হাত চাবায়, বাম হাত চাবায়। আগে বেঞ্চের তলায় ছায়ায় শুইয়ে রেখে লতিফা নাইতে নামত। এখন একটা ঘাটলার দিকে আড়ে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেকে দেখে, আর গা মাজে। বেঙ্গা লক্ষ করেছে, ঘাটে কেউ থাকলে লতিফা পুব দিকে পিঠ দিয়ে বসে, তখন বেঙ্গা আর লতিফার মুখ দেখতে পারে না। আর কেউ না থাকলে লতিফা পশ্চিমে পিঠ দিয়ে বসে, বেঙ্গা চেয়ে চেয়ে লতিফার শরীর ডলা দেখে। লতিফার ভেজা শরীর! ছেলেকে নাইয়ে তুলতে তুলতে শাড়ির নিচের দিকে ভিজেছে। উপরেও খানিকটা। পুকুরের পানি শুকিয়ে নিচে নেমে গেছে তাই লতিফা কয়েক ঘাটলা নেমে পুরো শরীর একবার ভিজিয়ে উপরে উঠে বসে। সিঁড়ির শাড়িখানার ভাঁজে হয়তো একখানা সাবান রাখা ছিল, সেটা বের করে হাতে মাখে। তার আগে ব্লাউজের একটি দুটি হুক আলগা করলে, এই প্রায় হাত তিরিশের দূর থেকে বেঙ্গা যে তখন রুদ্ধশ্বাস লতিফার দিকে তাকিয়ে ছিল, লতিফা তা জানত। কিন্তু বেঙ্গা তখন এমন ভাব করে যে, এদিকে দেখছিল না। অথচ, বেঙ্গার চোখ যাই দেখুক কি নাই দেখুক মন চাইছিল যদি একবার লতিফা তাকে ডেকে বলত তার কাছে আসার জন্যে। বেঙ্গার তো ইচ্ছে করে লতিফার অমন ভরা শরীরে হাত চালিয়ে সাবান মেখে দেয়। কতকাল ধরে বেঙ্গির অমন ক্ষয়ে আসা শরীরে হাত চালাতে চালাতে এই ভালো থাকা ডাইন হাতখানা আর চলতে চায় না। তখন পারলে ডান হাতে ধরে বাম হাতখানা প্রয়োজনে তুলে দিত লতিফার ঘাড়ে। ওই হাত ওইখানে তোলাই থাকত, আর নামাত না। আর ডান হাতে সাবান ঘষে দিত লতিফার সারা গায়ে।

বেঙ্গা চমকায়। নিজের মন ফেরায়, কিন্তু চোখ লতিফার শরীর থেকে ফেরায় না। কয়েকদিন আগে যখন এমন দুপুরবেলার পরপর সে এই ঘাটলায় লতিফাকে বসা দেখে এগিয়ে গিয়েছিল, তখনই লতিফা জানত বেঙ্গা তাকে দেখে, কিন্তু বেঙ্গা জানত না লতিফা বিষয়টা জানে। কিন্তু বেঙ্গা এগিয়ে গিয়েছিল এইজন্যে, ছেলেটাকে নাইয়ে ঘাটলার ওপরে ইস্কুলের পাশে ছায়া জায়গায় রাখার পরও তার কান্না না থামলে লতিফা উঠে ছেলের পিঠে আরও দুটো কিল দিয়ে তাকে কাঁদিয়ে নিজেও ঘাটলার এক পাশে বসে চোখে হাত চেপে কাঁদছিল। তখন লতিফার ছেলেটা কাঁদছিল তারস্বরে। হেঁচকি তুলে খুব জোরে কাঁদে ছেলে। সেই কান্নায় আশেপাশে টেকা দায়। বেঙ্গার মনে হয়েছিল বহুদিন আগে, সে বহুদিন আগে নিজের ছোটভাইটাকে বাড়ির ছোট্ট উঠানে এইভাবে কাঁদতে দেখেছিল। তখন বাড়িঘর ছেড়ে সব মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে বাগানে দৌড়াচ্ছিল, বেঙ্গাও ছিল সেই দলে, কিন্তু গুজব শুনে ফিরে এসে ফাঁকা বাড়ির উঠানে তার ছোটভাইটাকে একটানা কাঁদতে দেখেছিল এমন গলা তুলে – সেদিন সবাই বাড়ি ছেড়ে গেলে ভাইটা ভয় পেয়েছিল, আতঙ্কের সেই কান্না সে আজো মনে করতে পারল। লতিফার ছেলের কান্না দেখে কিন্তু বেঙ্গা কোনোভাবেই এগিয়ে যেত না, যদি সেইদিনের সেই কান্নার কথা তার কোনোভাবে মনে না আসত। বেঙ্গা একদিকে লতিফার ছেলেকে কাঁদতে দেখে, অন্যদিকে লতিফা মুখে হাত চাপা দিয়ে ঘাটলায় বসে কাঁদে। বেঙ্গা ঘাটলার সামনে, মাঠের কোনায় বাঁধানো চত্বরে গিয়ে দাঁড়ায়। একবার ভাবে, ছেলেটাকে কোলে নেয়। আবার ভাবে, যদি লতিফা কিছু মনে করে। তখনও পর্যন্ত লতিফার সঙ্গে বেঙ্গার তেমন কথাবার্তা হয়নি। একদিন সন্ধ্যার মুখে রেড ক্রিসেন্টের সিঁড়িতে লতিফা ছেলে কোলে নিয়ে বসে থাকলে বেঙ্গি গিয়ে কথা বলেছিল। এসে বলেছিল, ‘আইচে নতুন আপোদ কোয়ানদে!’ বেঙ্গা জানতে চেয়েছিল, ‘কী হইচে রে?’ তখন সন্ধ্যা, তাই বেঙ্গির মুখের ভাব দেখতে পারেনি বেঙ্গা, কিন্তু যেভাবে ঝামটা মতন দিয়ে বলেছিল, ‘ও মাগি ঠেলা খাউয়ো, বারো ঘাটে ঠেলা খাইয়ে এহোন এইহানে জুটিচে!’ বেঙ্গা হঠাৎ বেঙ্গির অমন কথায় প্রায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে বেঙ্গি বসে, ‘যাও, ধারে যাইয়ে দেইহে আসো।’

আসলে বিষয়টা একেবারে অমন ছিল না তখন যে, বারোঘাটে ঠেলা খেয়ে এই মুহূর্তে লতিফা এইখানে এসে উপস্থিত। বেঙ্গার আজও মনে হয় বিষয়টা একদম না জেনে না বুঝে ওইভাবে বলা উচিত হয়নি। হলোই-বা লতিফা ঠেলা খাওয়া, কিন্তু সেদিন তো সে কূলকিনারা না পেয়ে বাঁচার কোনোমাত্র উপায় না থাকায় এখানে এসেছিল। যেমন এসেছে সে আর এই বেঙ্গি। তাদেরও তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, তাই আজ তারা এইখানে। ফলে, সেইদিনের পর দিন সকালেও যখন প্রায় একইভাবে রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় লতিফা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে একইভাবে বসে আছে, তখন সেই সদ্য আলো ফোটা ভোরে, ইস্কুলের উলটো পাশের দেয়ালে সাদা ফুলগাছে ফুল তুলতে আসা হিন্দু বিটিদের কথায় আধো শীতে আধো হাওয়ায় বেঙ্গা বেঙ্গিকে ঠেলে তুলে দেখিয়েছিল, ‘চাইয়ে দেখ, ওই বিটি এহোনো এই জাগায় বইসে রইচে।’ এতে ওই মুহূর্তে বেঙ্গির চোখমুখ একটুক্ষণে সহজ করুণায় কাতর হয়েছিল, হয়তো অমন সকালে তা সত্যি খুব স্পষ্ট বোঝা যায়নি; কেননা, বেঙ্গি কোনোকালেই খুব সহজে কোনো কিছুতে কাতর হওয়ার মতো মানুষ না। যদিও বেঙ্গা তখনও জানত না, ওই সারাটা রাত্রি লতিফা যতই বসে থাকুক, বেঙ্গি কিন্তু মনে মনে তখনই স্থির করে নিয়েছে যেভাবেই হোক বেঙ্গাকে জানানো দরকার যে, এই বিটি একটা নটী। হয়তো বিষয়টা তাই ছিল। বেঙ্গা মনে করতে পারে। কিন্তু ওই মুহূর্তে লতিফা আসলেই ছিল কূলকিনারাহারা একজন। যার কোলে একটা বাচ্চা। সেটাকে নিয়ে সে এখন কোথায় যায় সে জানে না।

এর একটু পরই বেঙ্গি উধাও। যাওয়ার সময় বেঙ্গাকে ‘হাগদি যাই’ বলে সামনের জেলখানার পুকুর বরাবর প্রথমে বাঁয়ে ও পরে ডানে ঘুরে অফিসার্স ক্লাবের ভেতরে পেছনে যে পোড়ো খাটা পায়খানা আছে, সেখানে চলে গেলে বেঙ্গা গুটিসুটি পায়ে লতিফার কাছে আসে। এই জায়গা থেকে অফিসার্স ক্লাবের সামনের জায়গাটা দেখা যায়। বেঙ্গা তাকিয়ে থাকে বেঙ্গি কখন আসে। বেঙ্গি আসতে লাগলে সে লতিফার সামনে থেকে সরে যাবে। তখন সে লতিফার কাছে জানতে চায় ‘কী হইচে? সারা রাত্তির এই জায়গায় বইসে রইচো কী জন্যি!’

তখন লতিফা তাকে জানায় : গত রাত্তিরও লঞ্চঘাটে বইসে ছেল। নদীর কূলে হাওয়া। ছওয়ালডার আইচে জ্বর। ওয়ার বাপ বসতি কইয়ে কোনদিক যে গেইচে তারপর এই দুইদিন কোনো খোঁজ নেই। লঞ্চঘাটে মানুষজন ভালো না। কীভাবে সব চাইয়ে থায়ে। তহোন এক পাগল তারে কইচে এই পার্কে এই জায়গায় আইসে থাকতি। যে-পাগল রাত্তিরে আসপে কইল, কিন্তু এহোনও তার দেখা নেই…

লতিফা এই পর্যন্ত জানানোর পরে বেঙ্গা দেখে অফিসার্স ক্লাবের সামনের কাঁঠালি ফুল গাছে বেঙ্গি ফুল তুলছে। মাঝখানে প্রায় আড়াআড়ি পুকুর। এত দূর থেকে এখনও বেঙ্গি তারে দেখতে পায়নি। কিন্তু দেখতে কতক্ষণ! তাই বেঙ্গা সরে যায়। সে লতিফাকে বলে, ‘পরে শোনবানে।’

এদিকে বেঙ্গি পার্কে ঢুকে বেঙ্গাকে খোঁজে। দেখে, বেঙ্গা পুকুরের ঘাটলার দিকে যাচ্ছে। তারপর সে লতিফার কাছাকাছি এগিয়ে আসে। তখন বেঙ্গা ডান হাত নাড়িয়ে অফিসার্স ক্লাবের দিকে দেখায়। অর্থাৎ, সেও হাগদি যায়। আর বেঙ্গি এসে তার খ্যাসখেসে গলায় লতিফার কাছে জানতে চায়, কাল রাত্তির থেকে সে এই জায়গায় এইভাবে বসে আছে, ঘটনা কী? তখন, এই সকালবেলা বেঙ্গির হাতে কাঁঠালিচাঁপা ফুল। গলা যতই খ্যাসখেসে হোক, বেঙ্গিকে বড় আপনার মানুষ মনে হয় লতিফার। সে বেঙ্গিকে জানায়, তার ক’তি গেলি তিন কূলে কেউ নেই। এক লোকের সাথে ভাইগে চইলে গেইল খুলনো। সেইহানে ওই বেটা রূপসায় গোলপাতার আড়তে কাজ করত। তারা থাকত লবণচরার কাছে নদীর কূলে একটা ঝুপড়িতে। কেউ সে জায়গায় কোনো দিনও জানতি চায়নি ওই বেটা আর সে কী হয়। থাকতি থাকতি একদিন এই ছওয়ালডা পেটে আসল। হলো। ভালোই ছেলো, ভাবদো ছওয়ালডা এট্টু বড় হ’লি তারপর সেও কোনো কাজ করবে। কয়দিন আগে ডাকাতি কেস দেল কারা যেন। ছওয়ালডার বাপও সেই কেসে বাঁধল। তারপর নৌকায় কইরে তারা গেল মংলা না রামপালের দিক। কাটাখালির ওই জায়গায় আইসে নৌকা দে উইঠে ফহিরহাট পর্যন্ত আসল হাইটে। কোলে এই দুধের বাচ্চা। তারপর ট্রেনে বাগেরহাট।…

লতিফা এইসমস্ত বলে আর বেঙ্গি তার শরীরের দিকে তাকায়। ছেলেটাকে দেখে। ফরসা আছে। তা তো হবেই। লতিফা গায়ে গতরে কালো নয়। তবে, যা বলছে তা কত দূর সত্যি, কে জানে? কিন্তু গায়ের ওপর দিয়ে ঝড় যে গেছে তা চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। বেঙ্গির কেন যেন লতিফার কথা কিছু বিশ্বাস হয়, কিছু বিশ্বাস হয় না। বেঙ্গি লতিফার মুখের দিকে তাকিয়ে এইসব ভাবে আর বাঁয়ের হাতায় তাকায় বেঙ্গা এহোনো আসে না কেন? কতক্ষণ ধইরে হাগে, কাইল রাত্তিরে খাইচে কী… হাতির মাংস খা’লিও তো মানুষের এতক্ষণ ধইরে হাগা লাগে না…

তখন লতিফা গলার স্বর নামিয়ে বিড়বিড় করে জানায়, সেই জায়গাদে গেলাম লঞ্চঘাট। লঞ্চঘাটে আমারে বসাইয়ে রাখল, ক’ল হয় মোরেলগঞ্জ না কোথায় যাবে, আর নয় যাবে ঢাকা… তারপর আর তো আসার নাম নেই… কাইলকের আগের রাইত কাইল সারাডা দিন বইসে রইচি… লঞ্চঘাটে কতক্ষণ বইসে থাকা যায়… কতপদের মানুষ; তখন একজন ক’ল এই পার্কে আইসে ঘুমতি… এই জন্যি চইলে আইলাম…

এ-কথা জানাতে জানাতে লতিফার চোখ ছলছল, গলা আটকে আসে। তবু কেন যেন বেঙ্গির একবারও মনে হয় না এই বিটি সত্যি কথা কয়। বলা নেই কওয়া নেই একজন মানুষের সাথে ভাগা মাইয়ে মানুষ। গুতোন খাইয়ে ছওয়ালও এট্টা বানাইচে… তা এমন মানুষের সাথে ভাগা লাগে কী জন্যি যে ছাইড়ে যাবে? সের সাথে শুইয়ে পেটই বা বাঁধান লাগে কী জন্যি? বেঙ্গি এইসব ভাবে আর লতিফাকে নিরিখ করে। তারপর জানতে চায়, ‘ছওয়ালডার বয়স কত?’ তহোন লতিফা জানায়, আট মাস! বেঙ্গি একবার ‘হুঁ’ করে লতিফার দিক চোখ সরিয়ে দেখে বেঙ্গা হেঁটে আসছে। সে বলে, ‘আসতিচে… হোটেলে যাব নদীর কূলে… নাস্তা খাব।’

লতিফা জানতে চায়, ‘সে তোমার কেডা?’

বেঙ্গি হাসে। এই প্রথম লতিফার সামনে দাঁত মেলল বেঙ্গি, ‘দেইহে বোঝনি?’ বেঙ্গি পকেট গেটের দিকে এগোয়।

লতিফা অবশ্য কিছু বোঝেনি। ভোরে সে এই প্রথম বেঙ্গা আর বেঙ্গিকে একসঙ্গে দেখল। তাদের সম্পর্ক অবশ্য সেই মুহূর্তে লতিফা বুঝে গেল।

এদিকে বেঙ্গা-বেঙ্গি লঞ্চঘাটের দিকে যায় চাপাতি রুটি আর গরুর পায়া দিয়ে সকালের নাস্তা করার জন্যে। নাস্তার টাকা সন্ধ্যায়ই তারা আলাদা করে রাখে। অবশ্য যেদিন মরিচ পুড়িয়ে পান্তা খায় সেদিন লঞ্চঘাট পর্যন্ত যেতে হয় না। পান্তা বেঙ্গার পছন্দ। খেয়ে পেট ভাসিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকতে পারে। সকালবেলাই তাতে চোখও বেশ জুড়িয়ে আসে। তারপর চোখ খুলে ওই ভরাপেট নিয়ে দড়াটানা ফেরিঘাটের মতন দূরে যাও কি কোর্টের মতন কাছের এলাকা – যেখানেই যাও বেশ লাগে। ওই চাপাতি দুইখান খাও আর চারখান খাও, তাতে পেট তো তেমন ভরে না। পেট না ভরলে মানুষ কাজ করে কীভাবে? কিন্তু বেঙ্গির ব্যাপারটা উলটো। মাংস খেতে খেতে তার ওই চিমসে পেটে প্রায় নদীর ওপারের চরপাড়ার মতন চর পড়ে গেছে। সেখানে এই সকালবেলা মাংস না হোক একটু মাংসের ঝোল গরুর পায়া দিয়ে দুইখানা চাপাতি রুটিতে সে বেশ চাঙা বোধ করে। কিন্তু বেঙ্গা কি তা বললেও বোঝে? কাল রাত্রে বেঙ্গি বেঙ্গাকে বলেছিল, আইজ পানিভাত হবে না। সন্ধ্যায় চাল কিনেছিল কম। সে চালে দুইদিন চালাতে হবে। পুরনো হাসপাতালের ডাক্তার যে ওষুধ লিখেছে, সেই ওষুধ কেনার পয়সা জোগাড় করতেই বেঙ্গার প্রায় জান যায়। ডাক্তার ভালোমন্দ খেতেও বলেছে। সেখানে রোজ সকালে পান্তা! বেঙ্গা কোনো কথা কয়নি। জানে কোনো লাভ নেই। বেঙ্গি আজ পান্তা খাবে না। ফলে, গত রাতের হিসেব মতন এখন দুইজনে লঞ্চঘাটের দিকে যাচ্ছে।

বেঙ্গা বেঙ্গির কাছে জানতে চায়, ‘ও বিটি কয় কী?’

কী কয় তা বেঙ্গা নিজেও জানে। কিন্তু লতিফার সঙ্গে যে তার কথা হয়েছে, এই কথা বেঙ্গির কাছে বলে কী করে?

কিন্তু বেঙ্গি বলে, ‘আইসে জুটিচে, আপদ!’

‘কেন হইচে কী?’

‘কইয়ো না, ঠেলা খাওয়া পদ!’

বেঙ্গার হিসেবের সঙ্গে মেলে না। বেঙ্গির মুখের দিকে চায়। নদীর পানিতে হাত-মুখ ধোবে তারা। তার আগে বেঙ্গি হাতের আঙুল দিয়ে যেভাবে দাঁত ঘষেছে, পাউডার ভিজে মুখের চারপাশে লেগে আছে। আগে জেলখানার পুকুরে নেমে মুখ ধুত। এখনো চাইলে ক্লাবের পাশ দিয়ে নামতে পারে, নামেও। কিন্তু জেল মসজিদের ইমাম একদিন বেঙ্গিকে এমন গালমন্দ করেছে যে ওই পুকুরে আজকাল দুজনের কেউই নামে না। পরে পার্কের পুকুরেই মুখ ধুত। কিন্তু লতিফার সঙ্গে কথা বলতে বলতে লঞ্চঘাটের দিকে রওনা দিয়ে ভেবে নিয়েছে নদীর জলে কাজ সারবে। বেঙ্গার মাজায় গামছা, চাইলে বেঙ্গা একটা ডুবও দিয়ে নিতে পারবে। গরমকালে কত সুবিধা!

বেঙ্গা বেঙ্গির দিকে চেয়ে বলে, ‘মুখ মোছ, গালসি বাইয়ে নাল নামতিচে – ’

বেঙ্গি বলে, ‘হুঁ। তুমি আর মানষিরে কইয়ো না, সারাবেলা নিজের গাল বাইয়ে ঝোল পড়ে! সে কয় মানষিরে!’

‘হইচে, সারাদিন আমার পাছায় আঙুল না দিলে তোর পেটের ভাত হজম হয় না?’

বেঙ্গি হাসে। গালের চারপাশে দাঁত মাজার পাউডার লাগানো, তারপরও সকালবেলা বেঙ্গির এই হাসি বড় মনোরম! কালো চামড়ার শরীরে ওই দাঁতগুলোই যা ফরসা – সেই বের হওয়া দাঁতে বেঙ্গির এই হাসি!

ফাঁকা কোর্ট চত্বর প্রায় শেষ। সোজা গেলে নদীর পাড়। সেখানে দুজনে হাতমুখ ধুতে নামবে। তার আগে বেঙ্গার মনে হয়, রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় বসা ওই বিটিকে নিয়ে বেঙ্গি কী যেন বলছিল। আবার ভাবে, তাতে ওই বিটির সাথে তার যে কথা হয়েছে তা যদি বেঙ্গি বুঝে যায়? তবু, বেঙ্গি কেন ‘আপদ’ বলেছিল সেটা বোঝার জন্যে সে বলে, ‘ওই বিটি রে আপদ ক’লি কী জন্যি? মানুষ ঠেকায় না-পড়লি এইরাম পার্কে বইসে থাহে?’

‘আপদ নয়তো ওইয়ে কী? তুমি কথা ক’লি বুইঝতে – গেইল এক বেটার সাথে বাইরোইয়ে, পেটে ওইডে বাদাইয়ে এহোন ফেলাইয়ে থুইয়ে চইলে গেইচে – যাইয়ে দেহো, বারো ভাতাই রে, ঠেলাখাওয়া পদ – ’

বেঙ্গার হিসেবে মেলে না। তবু সে বলে, ‘তুই কাঁঠালি ফুল আনতি গেলি আমারে ক’ল, রহম ভাইরে দেইচেন?’

বেঙ্গি বেঙ্গার দিকে তাকায়, ‘তোমার সাথে কথা হইচে ওই বিটির?’

‘না, আমারে জিগোল, রহমরে দেহিছি নিকি?’

‘আমি ক’লাম দেহিনি, কাইলকে তো রহম আসি নেই – ’

‘সেইয়ে কও। তুমি তো আবার বিটি মানুষ দেকলি – ’

‘তোর খালি ফাও কতা।’

‘ফাও কতা না, তোমারে চিনি না?’

‘বিয়ে হই নেই ওই বিটির?’

‘না।’ বলে বেঙ্গি হাসে। তারপর বেঙ্গার কাছে জানতে চায়, ‘তোমার হইচে?’

লতিফার সঙ্গে কথা হওয়ার সেই সকালের হিসেব তখন থেকে বেঙ্গার কাছে এক আর বেঙ্গির কাছে অন্য। বেঙ্গা বুঝে গেছে, তাকে যা বলেছে, সে-কথা বেঙ্গিকে বলেনি লতিফা। ফলে, লতিফা বেঙ্গার কাছে রহস্যময়। যত দেখে, যত কথা কয় এই রহস্য কোনোভাবে কাটে না। কোনো দিন হয়তো কাটবে না। মঞ্চের ওপর শুয়ে থেকে সে লতিফার গোসল করা দেখে। লতিফার শরীরে চোখ চালায়। ভাবে, যদি একদিন লতিফা তাকে ওই শরীর ডলে দেয়ার জন্যে ডাকত! কিন্তু লতিফা তাকে ডাকবে না সে যেমন জানে, একই সঙ্গে জানে, এই যে ব্লাউজ খুলে ফেলে শরীরের একপাশ প্রায় খুলে দিয়ে গোসল করে লতিফা, ধীরে ধীরে দুধভর্তি বাঁ মাইটা তার চোখে উন্মুক্ত হয় – এইসবই তারে দেখায়। লতিফা চায় বেঙ্গা দেখুক। বেঙ্গি না থাকলে এইটুকু সময়ে লতিফাকে যেমন তার, লতিফারও তারে বড় আপনার মনে হয়। বেঙ্গা ভাবে। নয়তো লতিফা এমন করে কেন?

বেঙ্গা মঞ্চে শোয়া থেকে উঠে বসে চারধারে চায়। মাঠের কোথাও কেউ নেই। রেড ক্রিসেন্টের সামনের পাশের সিঁড়িতে একজন মানুষ রাস্তার দিকে ফিরে একলা বসে। সে বেঙ্গাকে লক্ষ করছে না। তার চোখ জেলখানার দিকে। হয়তো কোনো আসামি আসবে, সেই জন্যে বসে আছে। এখন বেঙ্গির আসারও কোনো কারণ নেই। বেঙ্গা বসে মঞ্চের ওপর থেকে পা ঝুলিয়ে কয়েকবার পা দোলায়। লতিফাকে দেখে। ছেলেটা বসেই আছে। মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। জানে, মা এসে তাকে তুলে নিয়ে কোথাও খেতে যাবে। বেঙ্গা নেমে ঘাটলার দিকে যায়।

লতিফা উঠে ঘাটলার পশ্চিম পাশে বসে। বুঝেছে বেঙ্গা আসছে। বেঙ্গা ঘাটলার উপরে বাঁধানো ছোট্ট চত্বরে বসে। লতিফা জানে, বেঙ্গা তাকে আরো কাছ থেকে দেখার জন্যে এইখানে এসেছে। সে এমন ভাব করে, বেঙ্গা যে এসেছে এটা যেন জানেই না। এতক্ষণ বেঙ্গা যেমন মঞ্চের ওপরে বসে ছিল যেন একইভাবে ঘাটলায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে, এই ভঙ্গিতে লতিফাকে দেখে। এইমাত্র লতিফার ডান হাতের ঘষায় তার বড় ও ভারী বাঁ স্তনটা একটু বাইরের দিকে প্রায় ছলকে গেল দেখে বেঙ্গার গলা শুকায়। সে পেছনে ঘুরে পার্কের গেটের দিকে একবার দেখে নিয়ে লতিফার উদ্দেশে বলল, ‘এই সুন্দর পিঠ একলা ডললি হয়?’

লতিফা ঘাড় ঘুরে তাকাল। তাকানোয় অনুমোদন। যেন বলতে চাইচে, তুমি বইসে বইসে দেখো! কিন্তু মুখে বলল, ‘কি, পিঠ ডইলে দিতি মন চায়?’

একেবারে বেঙ্গার মনের কথা। বেঙ্গার সাধ। কিন্তু চাইলেই সে ‘হ্যাঁ’ বলে কী করে?

বেঙ্গার কতদিনের ইচ্ছা! লতিফা আবার ঘুরে বেঙ্গার দিকে চায়। একটু সময় নিয়ে বেঙ্গার চোখ দেখে। হাসে। মুখে যেন একবার হুঁ-ও করে। তারপর বাঁ হাতখানা ঘুরিয়ে নিজের পিঠ ডলে। শাড়ির আঁচলের যে-অংশ তার পিঠে ঘষেছে সেটি যেন ঠিকঠাক পিঠ পর্যন্ত এখন পৌঁছছে না। এইমাত্রও ডান হাতে পিঠের ডানদিক সে ঠিকই পিঠে দিতে পারছিল, কিন্তু বাঁহাত যেন পিঠের বাঁদিকে দিতে পারছে না। যেন লতিফা চায়, এখন বেঙ্গা ঘাটলার উপরের দিক থেকে নেমে এসে তার পিঠ ঘষে দিক। কিন্তু বেঙ্গার অত সাহস কোথায়? এই বেঙ্গা এই জীবনে বেঙ্গির পিঠ ছাড়া আর কোনো পিঠ ডলেছে কোনো দিন! একখানা হাত সচল তার। বেঙ্গি জানতে পারলে যদি সেখানাও মচকে এইরম লুলো করে দেয়? কিন্তু সে-কথা কি সে চাইলেই লতিফারে বলতে পারে? অন্তত এখন তা বলা উচিত?

বেঙ্গা পার্কের গেটের দিকে দেখে। কেউ নেই। রেড ক্রিসেন্টের সিঁড়িতে বসা লোকটা কখন উঠে গেছে। এখন সে একটুক্ষণের জন্যে বেঙ্গির পিঠে সাবান ঘষলে কার কী? কে দেখতে আসে? কিন্তু বেঙ্গার সাহস হয় না।

লতিফা জানতে চায়, ‘বাইরের দিকে দেহো কী?’

বেঙ্গা বলে, ‘কিছু না।’

‘তা’লি দেও আমার পিঠখান ডইলে – এই ক’লা এত সুন্দর পিঠ!’

বেঙ্গা দাঁড়ায়। সংকোচের চেয়ে বেশি সংকট। লতিফা একটু ঘুরে পিঠ তো পুরোটা উধলা করে দিয়েছেই, এমনকি ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে স্তনের একপাশও। কী বড় মাই লতিফার! বেঙ্গির চিমসে যাওয়া, প্রায় আমসত্ত্বর মতো দলামোচা দিয়ে একখানে হওয়া মাইয়ে হাত বোলাতে অভ্যস্ত বেঙ্গার ইচ্ছে করে লতিফার পিঠ ডলতে ডলতে ওই ভরা স্তনও ডান হাতে নাড়াচাড়া করে। কিন্তু ইচ্ছা করলেই কী? বরং সে চোখ দিয়ে সে কাজ সারে। চেয়ে দেখে। যেন ওইখানে তার হাত। কিন্তু এর ভেতরে লতিফা তাকে বলে, ‘কই আসো?’

কী বেলাজ মাগি রে বাবা! আইচে কোয়ানদে? মনে মনে ভাবে। কিন্তু তা কি মুখে বলা যায়! লতিফার চোখের দিকে তাকিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। যাবে না, বেঙ্গা জানে। লতিফা জানে না। বেঙ্গার উঠে দাঁড়ানোয় মনে হলো সে সিঁড়ি বেয়ে নামতে পারে। কিন্তু ইস্কুলের দেয়ালের বেঞ্চিতে বসা লতিফার ছেলেটার গালের একপাশে হাত ছুঁইয়ে বেঙ্গা লতিফার দিকে তাকাতে তাকাতে আবার মঞ্চের ওপর এসে বসে। বেঙ্গা দেখেছে, সে সিঁড়ি থেকে এদিকে হেঁটে আসতে আসতে লতিফা খোলা মাইটা ঢেকে ফেলেছে। আর তার দিকে চেয়ে একবার যেন হাসল। চোখ ছোট করে তাকাল। আর মুখটা তখন ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে।

বেঙ্গা মঞ্চে বসে আবার নটরাজ। এইখানে নাটক করা ছেলেদের মতন এখন আবার তার একমাত্র হাতখানা উঁচু করে সে রাজ্জাকের মতো গাইতে চায় : ‘এ আকাশকে সাক্ষী রেখে…’ কিন্তু, লতিফাকে দেখতে দেখতে তার গলা একদম শুকিয়ে আসায়, অনেকদিন বাদে উত্তেজনা টের পেয়ে বেঙ্গা পার্কের গেট থেকে বের হয়ে জেলখানা পুকুরের দিকে যায়। এই সময় দেখে, বেঙ্গি হেলেদুলে কোর্টের দিক থেকে হেঁটে আসছে। বেঙ্গিকে দেখেনি এমনভাবে বেঙ্গা অস্ফুটে বলে, ‘আল্লা বাঁচাইচে – ’

কিন্তু এই থেকে বেঙ্গার ভেতরের খেদ যায় না। লতিফাকে দেখলে তা বাড়ে। রাতে লতিফা ঘুমালে পারলে একবার সে রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় উঁকিও দেয়। আর লতিফার শাড়ির আঁচলও ধীরে ধীরে বেঙ্গার সামনে শিথিল হয়। বেঙ্গা তা বুঝতে পারে। কখনো লতিফার শরীরে তাকায়, কখনো তাকায় না। এমনকি বেঙ্গার সামনে ছেলেটাকে মাইও দেয়, শুধু বেঙ্গি সামনে থাকলে লতিফার আচরণ আলাদা।

বেঙ্গি যেন তা বুঝতে পারে। এইজন্যে তাকে আজকাল বলে, ‘কী ওই বাইরো মাগির ধারে যা’তি মন চায়?’ শুনে, বেঙ্গা একটু যেন ভ্যাবাচ্যাকা খায়। অসহায় বোধ করে। তার কেন যেন মনে হয়, বেঙ্গি তার মনের খবর পড়তে পারে। পারবেই তো, কতকাল দুইজন একসাথে আছে। এই বেঙ্গি যদি তার মনের খবর না বোঝে তা হলে বুঝবে কে? তাই বলে এইভাবে বলবে? লতিফা বারো ভাতাইরে বাইরো মাগি কিনা তা বেঙ্গা বলে কী করে। আর হলোই বা, তাতে কী? একদিন দুইদিন তো রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় রাত্তির গভীর হলে একজন দুইজন মানুষ লতিফার কাছে এসেছে। অথবা লতিফা বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে পাশের ক্লাবের বারান্দায় চলে গেছে। যাবেই তো। করবেডা কী? পার্কের বেঞ্চিতে বইসে দক্ষিণ দিকে চাইয়ে চাইয়ে হাওয়া খালি কেউ তো আইসে লতিফাকে ভাত খাইয়ে যাবে না। ছওয়ালডারে খাওয়াবে না। তাতে লতিফার যদি মাইনষের সাতে শুতি হয় তা নিয়ে খোটা দেওয়ার কী আছে? বেঙ্গার বোঝাবুঝির এই সহজ হিসেবটা বেঙ্গি কেন বুঝতে চায় না, তা বেঙ্গা বোঝে না। কিন্তু বেঙ্গির খোঁটা দেয়ার অন্য একটি কারণ সে বুঝতে পারে, বেঙ্গা জানে বেঙ্গি তারে কতদিন তার শরীরের কাছে যেতে দেয় না। ছুঁইলে ছ্যাঁৎ করে ওঠে। তাই, বেঙ্গা যদি কোনো সুযোগে ঠারে ঠোরে লতিফার দিকে তাকায় তাকি বেঙ্গি খেয়াল করবে না? বেঙ্গির চোখ সব দেখে। সারা গতরে ওই চোখ দুটোই যা সুন্দর! ওই কালো চোখ জোড়া দেখে না জগতের এমন কিছু আছে নাকি? কিন্তু যাই দেখুক তাই নিয়ে এইভাবে বলতে হবে? তবু, বেঙ্গির কথা শোনার চেয়ে সাবধান হওয়া ভালো।

এইদিন বিকেলে রিহার্সেলে ছেলেটি আবার বলে, ‘এইখানে চরাচর আসিয়া মিশিয়া গিয়াছে, – মানুষে মানুষে অনন্ত সম্মিলন’ ফলে, এতদিনের লতিফাকে যখন আজ বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ঘাটলায়ই বসে থাকতে দেখল, তারপর বিকেলে যখন ওই ছেলেরা এল তখন উঠে কোথায় গেল, তারপর সন্ধ্যার পর এলো। ছেলেটাকে রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসে লতিফা ঘাটলায় বসে আছে। বেঙ্গা আর বেঙ্গি চওড়া বেঞ্চির দুই দিকে শুয়েছে দুইজন। লতিফা পুকুরের ঘাটলায় বসেছে ইস্তক বেঙ্গার চোখে ঘুম নেই। বেঙ্গা আর বেঙ্গির মাঝখানে বেঞ্চির দেয়াল, সেখানে মানুষ হেলান দেয়। যদি কেউ দক্ষিণের বেঞ্চিতে বসে, বসে পুকরের দিকে, সামনে তাকিয়ে দেখতে পারে; যে উত্তরের বেঞ্চিতে বসবে সে মাঠের ভেতরে দেখতে পারে। বেঙ্গি ভেতরের বেঞ্চিতে ঘুমিয়েছে। বেঙ্গা পুকুরের দিকেরটায়। ওই পাশে শুলে শেষ রাতে বেঙ্গির ঠান্ডা লাগে। বেঙ্গা চোখ খুলে আকাশ দেখে, আকাশের তারা দেখে, তার চোখে ঘুম নেই, বেঙ্গির নিশ্বাসের শব্দ শোনে, দূরের রাস্তার আলোর দিকে তাকাতে তাকাতে লতিফাকে ঘাটলায় বসা দেখে। তার ইচ্ছে করে একবার লতিফার কাছে যায়।

বেঙ্গির নিশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে বেঙ্গা উঠে বসে। একটুক্ষণ বসে থাকে। নিশ্চয়ই আজও রহম পাগলা আসেনি। কয়দিন ধরে আসছে না। রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় পাগলার কথা মাঝরাত্তিরেও শোনেনি তারা। বেঙ্গি বলেছিল, ‘ওই বিটির সাতে কিছু হইচে নিকি রহম ভাইর! বেঙ্গা বলেছিল ‘কী জানি?’ বেঙ্গি বলেছিল, ‘দেহো না, ওই বিটি আসার পরদে আজকাল রহম ভাই কম আসে।’ বেঙ্গা ভেবেছে, কী জানি, হ’তিও পারে। তয় রহম ভাই যখন আসে তহোন তো রোজ আসে। রাত্তির হলি এই জায়গাই তার মাথা গোঁজার ঠাঁই। আর যখন আসে না, তখন দিন পাঁচ-দশে কোথায় কোথায় যায়। একবার তো সুন্দরবনের দিক চইলে গেইল। ওই মানষির কোনো ঠিক আছে?

বেঙ্গা তার সমস্ত সাহস এক জায়গায় জড়ো করে বসা থেকে দাঁড়ায়। অন্ধকারে আবারো বেঙ্গিকে দেখে। বেঙ্গি মাঠের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে উঠে বসে যেভাবে হাতিয়ে বেঙ্গাকে খোঁজে, সেভাবে খুঁজে না পেলে চিৎকার করলে বেঙ্গা ওই ঘাটলা থেকে পুকুরের পাড় ধরে আসবে। বলবে নিচে গেছিল পেচ্ছাব করতে। এখন পুকুরের জল অনেক নিচে। সেখান থেকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসলে বেঙ্গি বুঝতে পারবে না। কিন্তু যদি ডাইনে তাকিয়ে তখনও লতিফাকে ঘাটে বসা দেখে। দেখে দেখুক, লতিফা তো অমনভাবে ঘাটে বসেই থাকে রাত্তিরে।

বেঙ্গা পুকুরের পাড় ধরে হেঁটে ঘাটলার কাছে যেয়ে লতিফাকে বলে, ‘আমি আইচি! তুমি এই জায়গায় বইসে রইচো কেন?

‘এমনি। কেন বইসে থাহি না?’

‘থাহো।’

‘তা’লি?’ লতিফা বেঙ্গার হাত ধরে, ‘তোমার নাম মোশারফ?’

‘তুমি জানলা কোয়ানদে?’

‘জানি, ওই পাড়ার ছেলেরা খেইলে যাওয়ার সোমায় ক’চ্ছিল।’

বেঙ্গা বুঝল, লতিফা কীভাবে জেনেছে। যুবকেন্দ্র আর পুকুরের ফাঁকা জায়গায় বল পড়েছিল। বেঙ্গা তখন সেখানে বড়শি বায়। সন্ধ্যা তখন প্রায় হব হব। এর পেছনে ঝোপ ও কাঁটাগাছ। ছেলেরা পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘ও বেঙ্গা, আমাগো বলডা দাও –  বেঙ্গা, আমাগো বলডা দাও।’

বেঙ্গা এমনিতেই দিত। কিন্তু একটা বড় তেলাপিয়া তখন বেশ খোঁট দিচ্ছিল। বেঙ্গার মনোযোগ সেদিকে। বেঙ্গি পুকুরের ঘাটলার কাছে দাঁড়িয়ে ছেলেদের বলে, ‘ওই, তোমরা অত বেঙ্গা বেঙ্গা করতিচো কী জন্যি?’

একটা ছেলে বেঙ্গিরে বলে, ‘বেঙ্গারে বেঙ্গা কব না তো কী কব?’

বেঙ্গি বলে, ‘তোমাগো ক’ল কেডা ওয়ার নাম বেঙ্গা?’

আর একজন বলে, ‘বেঙ্গাই তো, তোমার নাম বেঙ্গি, ওনার নাম বেঙ্গা – ’

বেঙ্গি বলে, ‘কইচে তোমাগো, আমার নাম বেঙ্গি ঠিক আচে। ওর নাম মোশাররফ – ’

বেঙ্গা তখন বড়শি রেখে বল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা ছেলে তখন বলে, ‘ও মোশাররফভাই, বলডা দাও – ’

বেঙ্গা হাসে। এ সময় কাছের কোর্ট মসজিদের মাইকে আজান শুরু হয়। ছেলেরা মাঠ ছাড়ে। গেটের কাছে যেতে যেতে তারা বলে, বেঙ্গা আর বেঙ্গি তাই জানতাম, বেঙ্গার আসল নাম মোশাররফ, বেঙ্গির আসল নাম কী? একজন বলে, হবে মোশারফি। অন্য একজন বলে, বেঙ্গির জন্যি বেঙ্গা, মোশারফের জন্যি মোশারফি!’ হা হা হা হা হাসে তারা। তাদের কাছেই লতিফা দাঁড়িয়ে। সে শোনে, তারা ফুটবলটা মাটিতে ড্রপ দিতে দিতে বলছে, ‘বেঙ্গার নাম মোশাররফ।’

লতিফা শোনে।

বেঙ্গা অন্ধকারে লতিফার দিকে চেয়ে হাসল। লতিফা বলে, ‘ছওয়ালগুলোন হাইসে আর বাঁচে না, কয় বেঙ্গার নাম মোশাররফ…’

বেঙ্গা বলে, ‘তাই নাকি?’

লতিফা কথা বদলায়, ‘তুমি ঘুম ভাইঙ্গে উইঠে আইচো কী জন্যি?’

‘এমনি, আসলাম তোমার ধারে!’

‘হুঁ, এত সাহস! তোমার বউ উইঠে গেলি! যাও, আইচো কী জন্যি!’

‘ক’লাম তো এমনি আসলাম।’ মোশাররফ ওরফে বেঙ্গা লতিফার হাত ধরে।

লতিফার গলার স্বরে ভার। বাতাসেও একটু ঠান্ডা যেন, নিশ্চয়ই দক্ষিণে বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি কয়দিনে যে এখানে আসে। কিন্তু সেই বৃষ্টির এই ভেজা তাপের সঙ্গে লতিফার গলাও মিলে যায় যেন; তাতে বেঙ্গার মনে হয়, শক্ত করে লতিফাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু তার একখানা হাত, বাঁহাত লুলা, এক হাতে এই কাজ সে কীভাবে করে? তাই একটু বেঁকে লতিফাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে সে বেঙ্গাকে সরিয়ে দেয়। লতিফার মনে আছে, বেঙ্গার হাত লুলা। তবু সে বলে, ‘যাও তোমার বউ ওট্পে!’

‘যাই। আইজ বিকেলে ছেলা কোথায়? নাটকের লোকজন আইল, এইহেনে দাঁড়াইয়ে নাটক করিচে। কী সব কয় – সব শুনতি পারিনি, ছোট ছওয়ালগুলো মাঠে বল খেলছিল – ’

‘কী কয়?’

‘মনে নেই, থাকলি দেখতি পারতা। কয়দিন বাদে বাদে রাত্তিরে এই জায়গায় অনুষ্ঠান হয়, নাটক হয়। আমরা দেহি – ’

‘এত কথা শোনলা, কিছু মনে নেই?’

‘খালি মনে আছে, একজন কয় এই জায়গায় চরাচর আসিয়া মিলিয়া গিয়াছে… মানুষ পেয়েছে তার মানুষীকে… সম্মিলিত মানুষ তার নতুন…’ বেঙ্গা এই পর্যন্ত বলল ঠিকই, কয়েকদিন স্টেজ রিহার্সেলের খানিকটা শুনতে শুনতে তার অনেকখানিই মুখস্থ, কিন্তু সম্মিলিত কথাটা ঠিকঠাক বলতে পারল না… কথাটার অর্থ সে বোঝেই না।

এটা বলতে বলতে লতিফা তার কাছে জানতে চাইল, ‘সেইদিন রাত্তিরে তোমরা থাহো কোথায়?’

‘কেন এইহেনে, এ কি যাত্রা গান নিকি যে সারা রাত্তির হবে? এডা নাটোক – জেলখানার ঘড়িতে দশটা-এগারোটা পিটানোর মদ্যিই শেষ হইয়ে যায়…’

‘আচ্ছা। এহোন যাও, তোমার বউ ওট্পে।’

‘যাতি ইচ্ছে করতিচে না – ’

‘ধরা খাবানে!’

‘না, বেঙ্গি ওট্পে না মনে কয় – ’

‘কত সাহস!’

‘তোমার ধারে থাহি?’

বেঙ্গা ডান হাত দিয়ে যতটুকু পারে লতিফাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘কান্দো কী জন্যি?’

লতিফা চুপ করে থাকে। অস্ফুটে বলে, ‘সুহে – ’

বেঙ্গার গলা জড়িয়ে যেতে থাকে। কেমন যেন। গায়ে উত্তাপ টের পায়। লতিফাকে ওই একখানা হাতে যতটুকু পারে আঁকড়ে ধরে থাকে। লতিফার ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে ঘষতে থাকে। এখন কোনোভাবেই বেঙ্গার এর বেশি সাহস হয় না। লতিফার সাড়া বা অনুমোদন না পেলে বেঙ্গা তার মুখ লতিফার মুখের কাছে নেয় কী করে? বেঙ্গি তো কোনোদিনই তাকে সাড়া দেয় না, কখনো কখনো অনুমোদনও থাকে না প্রায়। সেই অভ্যাসে লতিফার সাড়া দেওয়ার জন্যে বেঙ্গা অপেক্ষা করে। ঘাড়ে মুখ ঘষতেই থাকে। এর ফাঁকে লতিফার অস্ফুট, ‘তোমার বউ ওট্পে’ বললে বেঙ্গা ‘না’ বলে বোঝে লতিফার অনুমোদন আছে, কিন্তু এখনো সাড়া দিচ্ছে না। সে আর অপেক্ষা করে না। লতিফার ঘাড়ের কাছ থেকে মুখ লতিফার মুখের কাছে নেয়। টের পায় লতিফা তাকে অাঁকড়ে ধরছে। বেঙ্গার বাঁদিকে লতিফা। বেঙ্গা লুলো বাঁহাত লতিফার শরীরের সঙ্গে, সেটা উঁচু করতে পারে না। কিন্তু ডান হাত সে লতিফার বুকে দেয়। ভারী বুক লতিফার। গোসলের সময় বেঙ্গা কতবার দেখেছেও। কিন্তু হাত দেয়নি। সেখানে হাত দেওয়ামাত্র, এতদিন এতটা কাল বেঙ্গির পাংশুটে স্তনে হাত দেওয়া বেঙ্গা এখন উত্তেজনায় কাঁপে। ঝুঁকে পড়ে। লতিফার বুকের সর্বত্র হাত চালায়। লতিফা বাধা দেয় না। বরং, বেঙ্গাকে আঁকড়ানো হাত ছেড়ে ব্লাউজের বোতাম খোলে, সে জানে বেঙ্গা তা পারবে না। ভাবে, এইজন্যে বেঙ্গিকে কখনো যেন ব্লাউজ পরতে দেখেনি। এ-কথা ভাবতে ভাবতে তার বুক খুলে আঁচল নামিয়ে বেঙ্গার মাথা সেখানে চেপে ধরে। বলে, ‘তোমার নামও মোশাররফ, কীভাবে হলো?’ বেঙ্গা কিছু বলে না। লতিফার অত বড় ভারী বুকে তার মাথা চেপে ধরায় সে যেন দম নিতে পারছে না। লতিফার বুকে ভারি অদ্ভুত গন্ধ! এমন গন্ধ সে কখনো বেঙ্গির বুকে পায়নি। যেন, ওই অদ্ভুত গন্ধটার জন্যে, এই গন্ধটা পেতে সে আরো বহুকাল লতিফার বুকে মুখ গুঁজে থাকতে পারে… বেঙ্গা তাই থাকে… মুখ সরায় না। লতিফা কিছু বলছে না। কিন্তু বেঙ্গা নাটকের ছেলেটার সংলাপ বলা শোনে। শোনে, কে যেন বলে, এইখানে চরাচর আসিয়া মিলিয়া গিয়াছে।

দক্ষিণ থেকে এক পশলা বাতাস আসে। বেঙ্গার মনে হয়, সে ওই নাটকের ডায়লগ বুঝুক কি না বুঝুক, এই মুহূর্তে এইখানে সত্যি চরাচর এসে মিলে গেছে। সে কোনোভাবেই লতিফার বুক থেকে মুখ তুলবে না।

এই চরাচরে বেঙ্গা ওরফে মোশাররফ লতিফার বুকে মুখ গুঁজে থাকে।

চরাচর সত্যি মিশে যাচ্ছিল।