একজন কবির প্রেমের উপন্যাস

মাসুদ আহমেদ

 

রানী ও কেরানি

মারুফ রায়হান

চিত্রা প্রকাশনী

ঢাকা, ২০১৫

১৫০ টাকা

 

মানুষের জীবনে জীবিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তার মৌলিক চাহিদাগুলো ন্যূনতম পর্যায়ে মেটানোর জন্যও একটি পেশা বা জীবিকা অত্যাবশ্যক। আবার মর্যাদা অর্জনের লক্ষক্ষ্যও এর প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এই জীবিকার সৃষ্টি করে রাজনীতি ও প্রশাসন। শীর্ষ শাসক রাজনীতি করলেও সেটি আবার তাঁর পেশাও বটে। তা একসময় ছিল সম্রাট, রাজা বা রানী। পরে জনগণতন্ত্র অর্জিত হলে পদবিটি ক্রমে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, চ্যান্সেলর ইত্যাদিতে পরিণত হয়। সেটি সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে মানবসভ্যতার বিবর্তনের ধারা। রাজনীতি ও প্রশাসনের ইতিহাসের একপর্যায়ে ব্রিটিশরা আনুষ্ঠানিক আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। নিম্নতম পর্যায়ে তার একটি পদবি সেখানে তারা প্রতিষ্ঠা করে। তা হলো, করণিক বা কেরানি। ইংরেজিতে মূল শব্দটি ছিল clerk। কর্ম সম্পাদনের মেধাগত মানের দিকটি বিবেচনায় পদটি  তলে (bottom) নিবদ্ধ থাকায় সমাজে তা হেলার  বিষয় ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু England-এ Clerk রীতিমতো মর্যাদাপূর্ণ একটি পদবি এবং এই পদবিধারী সুশীল সেবার ক্ষেত্রে বেশ ক্ষমতা ধারণ ও প্রয়োগ করার অধিকারী। লেখক মারুফ রায়হান এই উপন্যাসে সামন্ততান্ত্রিক শীর্ষ এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক আমলের নিম্ন পর্যায়ের দুটি পদবি ব্যবহার করে এক অভিনব চমক সৃষ্টি করেছেন। একদিকে আছেন রানী, অন্যদিকে কেরানি। দ্বিতীয় শব্দটির ভেতরে আবার প্রচ্ছন্ন রয়েছে প্রথম শব্দটি। অর্থাৎ কেরানি শব্দটির অভ্যন্তরে আছে রানী শব্দটি। বাংলা ভাষায় এ এক মজার দ্যোতনা। রানী ও কেরানির কাহিনিতে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিবর্তনের ধারা বর্ণিত হওয়ার সময় লেখক সম্পদ বণ্টনে মারাত্মক অসাম্য, আইনের শাসনের অভাব ইত্যাদির কথা উলেস্নখ করেছেন। উলেস্নখ করেছেন কাব্যসৃষ্টির ক্ষেত্রেও এত বর্জ্য উৎপাদনের অযৌক্তিকতা, যা তাঁর চমৎকার পর্যবেক্ষণে নানা অসংগতি, বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা (যা কিনা অসুস্থ পুঁজিবাদ এবং শ্রেণিবিভক্ত সমাজের স্বাভাবিক উপাদান ও ফল) ইত্যাদির কথা গল্পচ্ছলে বললেও এই লেখা যে-প্রেমকাহিনি – সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। সেখানে আকাশ ছোঁয়ার কল্পনা, Down memory lane visit ইত্যাদি রয়েছে। রয়েছে অনতিক্রম্য শ্রেণিভেদের তীব্র দাহ, এই প্রেমের ক্ষেত্রেও।

চেনা যায় এমন শীর্ষ শাসকদ্বয় এবং ইমতিয়াজ ও খাদিজা এই কাহিনির মূল চরিত্রবৃন্দ। নামভূমিকার রানী এখানে তত গুরুত্বপূর্ণ নয় যত গুরুত্বপূর্ণ কেরানি নিজে। সে জীবনের পেশায় যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি আকাশচুম্বী প্রেম-কল্পনা বাস্তবায়নেও সমর্থ হয়নি। কিন্তু সে আদর্শবাদী ভালো মানুষ; লোভ, অবৈধ আকর্ষণ, অসূয়া ইত্যাদি প্রবৃত্তি দমনে সে সমর্থ। জীবনের সব বৃত্তি ও কীর্তির মধ্যে কাব্যরচনা যে সবচেয়ে মর্যাদাকর – এই শ্রেয় সাংস্কৃতিক বোধ তার মননে প্রোথিত রয়েছে। তা অর্থকরী না হোক তাতে কী? প্রেমের কল্পনাতেও তার এই শিল্পিত চেতনা তাকে সীমা অতিক্রম করতে দেয় না। তার নিজের শ্রেণিচরিত্র, বিশুদ্ধতাবাদ ইত্যাদি প্রশংসার যোগ্য। বাংলাভাষী অধিবাসে তদবির, তঞ্চকতা, পরশ্রীকাতরতা, সব রিপু, দুর্নীতি, আত্মপ্রচারণা, আশাভঙ্গ, বিশ্বাস হনন, ভান, প্রবঞ্চনা, স্তাবকতা, শঠতা, শোষণ, অহংকার ইত্যাদির চিত্র আঁকা দক্ষতার তেমন কোনো কাজ নয়। কারণ এগুলো স্বাভাবিক একজন লেখককে এই সমাজের চিত্র আঁকতে গিয়ে সেই কাজটি করতে হবেই। তাই এই লেখকের দক্ষতার বিষয়টির আলোচনায় বরং তাঁর ভাষা, উপমা ও উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারের দিকটি প্রশংসনীয়ভাবে উলেস্নখ করা প্রয়োজন এবং প্রাসঙ্গিক। যেমন –

‘বিচিত্র কষ্ট তার জীবনচিত্রের ওপর রংতুলি ঘষে চলেছে নিদারুণভাবে।’ (পৃ ১০)

‘সে প্রেমিক। এক গোপন প্রেমিক, গোপন ও গূঢ়।’ (পৃ ১১)

‘ঝাঁঝালো রোদ মনকে বিষাদময় করে তুলতে পারে, আবার কুয়াশাও বয়ে আনতে পারে ফুরফুরে ফুর্তি।’ (পৃ ১২)

মধ্যপ্রাচ্যকে লেখক দেখেছেন ‘পৃথিবীর উত্তপ্ত একটি অঞ্চল’ হিসেবে। (পৃ ৭৯) এমনি কুশলতাপূর্ণ শব্দপুঞ্জ এ-বইয়ে ছড়িয়ে আছে।

এরপর আসি মানবচরিত্র বিচারে এবং দার্শনিকতায় লেখকের মুন্শিয়ানার দিকটিতে।

‘যখনই মানুষ সুখের জন্য দৌড়াতে শুরু করে, সুখও আসেত্ম-আসেত্ম  নাগালের বাইরে সরে সরে যায়।’ (পৃ ১৯)

‘মাপামাপি, বস্তা ওঠানো নামানো, দরকষাকষি, হাঁকডাক… প্রতিটি  বাজারেই এক ধরনের বিশেষ ধ্বনিপ্রবাহ থাকে।’ (পৃ ২১)

‘মানুষ নিজের কথা অন্যের সামনে তুলে ধরার… যেমন চেহারা ফুটিয়ে তোলা দরকার – ততটুকুই রং ও রেখা সে ব্যবহার করে। সব বলে না।’ (পৃ ৩৩)

‘এত অল্পবয়সী মেয়েরা বিদগ্ধ স্ত্রীলোকের মত কথা বলে কী করে!’ (পৃ ৩৬) বিশেষ করে খাদিজার ভেতর দিয়ে লেখক শ্রেণি নির্বিশেষে নারীর চরিত্র সফলভাবে আঁকতে পেরেছেন। প্রকৃতিগতভাবে অন্তর্মুখী, ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ হলে কি হবে, প্রেমে পড়লে তাদের যে মনোবীক্ষা এবং বাহ্যিক আচরণ তা জীবন সংলগ্ন হয়েছে। তার প্রথম প্রেমিক নিয়ে সে ছিল লাজুক এবং উদ্বিগ্ন; ‘বাবা মা জানলে কি হয় না হয়’, একই সঙ্গে ‘আবার একটু একটু ভালোও লাগছিল তার কথা শুনতে’। ‘বাবা মার কথায় কান পেতে থাকতো, যদি কোন ইঙ্গিত মেলে’। ‘একদিকে লোকটি কলেজে আসুক তা সে চায় না  কিন্তু আবার গেট দিয়ে বেরোনোর সময় খুঁজেছেও  কিছুদিন’ (পৃ ৫০-৫১)। ‘জগৎসংসার অতটা নির্মম নয়’তে (পৃ ৫৫) লেখকের আশাবাদের প্রকাশ ঘটেছে। সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা এবং অনিয়ম পর্যবেক্ষণের পরও এই আশাবাদ বাঁচার জন্য অত্যাবশ্যক। এই আশাবাদের দৃঢ়রূপ পাই যখন লেখক বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সে সন্তান ও সন্তানের জননীর কাছে ফিরতে পারবে তত তাড়াতাড়ি সে নিস্তার পাবে সর্বগ্রাসী ঐ ভয় থেকে’। (পৃ ৮০) কাজেই এ গল্প গৃহীর ও গৃহের। অনেক না-পাওয়ার মধ্যেও সে-গৃহে আনন্দ আছে, আছে সন্তানের ও স্ত্রীর মধ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জীবন ও জীবিকার জন্য।

উপন্যাসটি যে মূলত একজন কবির তা নানাভাবে জানান দেয়। লেখকের নিজের কাব্যর উদ্ধৃতি চমৎকার। যাঁরা ভালো কবি তাঁদের উপন্যাসও যে একই দক্ষতার ছাপ থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। রবীন্দ্রনাথ তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এই বইয়ের মেদ পরিহার করার সুয়োগ রয়েছে। কেরানি শব্দটির বহুল ব্যবহার কিছুটা ছাঁটা যেত। দুটি পদবির সামাজিক পার্থক্য আঁকতে লেখককে বেশ অনায়াস মনে হয়েছে। প্রচ্ছদটি সুন্দর। ছাপা বা বানান ভুল নেই। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি। r