একজন স্বশিক্ষেত ব্যতিক্রমী স্থাপনাশিল্পী

রবিউল হুসাইন

স্বশিক্ষেত বা নাঈভ শিল্পী বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও সৃষ্টিশীল হন, মিথুন আহমেদ তেমন একজন কবি, গদ্যশিল্পী, আবৃত্তিশিল্পী, অভিনেতা, ব্যতিক্রমী স্থাপনা ও উপস্থাপনা শিল্পী। নববইয়ের দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক রাজধানী নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। কিন্তু শিল্পচর্চার বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশিত করার অদম্য প্রচেষ্টা তাঁর কখনো থেমে থাকেনি। শিল্পসৃষ্টির নিরমত্মর তাগিদ তাঁর মন ও মননে সবসময় তাঁকে অস্থির করে রাখে এবং সেইমতো শিল্পক্ষুধায় তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে সৃষ্টিশীলতার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। অস্থির মানসিকতার একজন নিরীক্ষাধর্মী শিল্পী মিথুন। তিনি সমাজসচেতন ও প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত। কম্বাইন্ড কালচারাল অ্যালায়েন্স অব নর্থ আমেরিকার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন ছাড়াও বং কন্যার পালা শীর্ষক নাটকের নাট্যকার ও পরিচালক এবং সংগীতালেখ্য আলিবি লুলাবাই বা অনুপস্থিত অপরাধীর ঘুমপাড়ানি গান রচনা ও পরিচালনা করে নিজের কর্মকুশলী প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এই সঙ্গে মিথুন দুটি ভাবনাপ্রসূত স্থাপনাশিল্প সৃষ্টি করেছেন। একটি হচ্ছে ‘মার্চিং উইথ ল্যাম্প্স’ বা ‘প্রদীপ যাত্রা’ আর একটি হচ্ছে, ১৯৪০ থেকে সাংস্কৃতিক ইতিহাসনামা, যা বাংলাদেশ ও বাঙালির কথা বলে ‘মেমোরি অ্যাগেইনস্ট অবলিভিয়’ বা ‘বিস্মরণের বিরম্নদ্ধে মনে রাখা’। এ ছাড়া পকেট ভর্তি কবিতা বা পকেটফুল পোয়েম্স্ নামে কফি টেবিলসুলভ একটি কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছেন। চর্যাপদে উলিস্নখিত বিভিন্ন নারীকেন্দ্রিক চিত্রাবলিও সৃষ্টি করেছেন একটি ধারাবাহিকতায়, নাম দিয়েছেন ‘এবনাযাবন’। ‘ভাবনার ভাস্কর্য’ বা ‘স্কাল্পটিং থটস’ নামে এক স্থাপনাশিল্প এবং পরে ‘বাক্সচিত্র’ বা ‘বক্স পেইন্টিং’ সৃষ্টি করেছেন। এর মাঝে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রামাণ্য-চলচ্চিত্র ট্রাইব্যুনাল ফর ওয়ার ক্রিমিনালস্ বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সভা শীর্ষক একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ ও লক্ষক্ষ্য বর্তমানে কাজ করছেন। এসবে দেখা যাচ্ছে যে, মিথুন বিভিন্ন সৃষ্টিমুখর। কর্মকা– নিজেকে নিরমত্মর নিয়োজিত রেখেছেন। এবারে দেশে এসে গত ২২ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর মোট চোদ্দো দিনব্যাপী ধানম–র গ্যালারি টোয়েন্টি ওয়ানে মিথুন আহমেদ একটি যৌগিক স্থাপনাশিল্পসহ একক প্রায়োগিক চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এতে তাঁর অাঁকা বিভিন্ন ধরন ও কৌশলে অ্যাক্রিলিক, কালি-কলম, কোলাজ, রৈখিক বিন্যাস, অ্যাসিড, প্যাস্টেল ইত্যাদির সাহায্যে নানা বিষয় তাঁর মতো করে নানা বর্ণে প্রকাশিত হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে কবিতার আবৃত্তি – একক ও দলীয়ভাবে নৃত্য, সংগীত এবং ঢাকের সুউচ্চ নিনাদলহরী। মিথুন তখন এসবের মধ্যে মেঝের ওপর প্রজ্বলিত মোমবাতি ও প্রদীপ ঘিরে বেশ কয়েকটি টাঙানো ইজেল বা চিত্রপটের পাশে রাখা রঙের ডিববা থেকে তুলি বা ব্রাশ নিয়ে ত্বরিতগতির চিত্রসৃষ্টি বা অ্যাকশন পেইন্টিং শুরম্ন করেন, একটি থেকে আর একটিতে বিভিন্ন প্রকারের বর্ণচ্ছটায়। মাঝে-মাঝে তাঁর মতো করে তাৎক্ষণিক চিমত্মায় ব্রাশের চ্যাপ্টা অাঁচড়, রৈখিক স্বতঃস্ফূর্ত টান, গুঁড়ো-গুঁড়ো রং-ছিটানো, অস্থির ঘর্মাক্ত এক শ্রমজীবী শিল্পী হয়ে এদিক-ওদিক ছুটে সৃষ্টিশীলতায় নিজেকে ব্যতিব্যসত্ম করে সব দর্শকের সামনে অভিনয়সুলভ উপস্থাপিত হলেন। ছবির বিষয়ের চেয়ে ছবি সৃষ্টি-প্রক্রিয়া বা কৌশল সবার কাছে স্পষ্টও হলো। এসব চিত্র-কর্মকা- একটি স্থানে আর তাঁর অাঁকা অন্যান্য চিত্র অন্য আর একটি জায়গায়, অর্থাৎ একটিতে মিশ্র-প্রক্রিয়ায় নানা শিল্পমাধ্যমে ত্বরিতগতির চিত্রাবলি সৃষ্টি পরিক্রমা আর একটিতে আগে থেকে শিল্পীর অাঁকা নানা আঙ্গিকে রূপায়িত চিত্রমালা ও রেখার নিদর্শন। তাঁর এই ছবিগুলো দৃষ্টিনন্দন তবে বহুরকম চরিত্রের। ড্রইং যেগুলো একক কালো অাঁচড়ে বিম্বিত সেগুলো মূর্ত কোনো মুখের ছবি সুকৌশলে উপস্থাপিত ও প্রশংসার যোগ্য। বাকিগুলো প্রায়ই বিমূর্ততায় একক ও মিশ্ররীতির অনেক বর্ণে বর্ণিত। কিছু সংবাদপত্র লাগিয়ে তার ওপর রঙের বর্ণালি প্রলেপ এবং সবগুলো মানুষের অবচেতন মনের নানা চিমত্মা, দুর্ভাবনা, সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, কামনা ও বাসনার চিত্রছাপ – সামগ্রিকভাবে মিথুনের ছবি দেখতে ভালো লাগে ও দেখে বিভিন্ন ভাবনার উদ্রেক করে, যা শিল্পীর এক সার্থকতা, এটা বলতেই হয়। এই উত্তরাধুনিক ও বিনির্মাণ যুগে অভাবনীয় প্রযুক্তির উন্নতিতে শিল্পের সনাতনী উপস্থাপনের প্রভূত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র, বিভিন্ন আলোর প্রক্ষেপণ, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের ব্যবহার, শব্দ ও সংগীত, তুলির বদলে শরীরের অংশ

হাত-পায়ের রং ভরা লেপন, রং ছিটিয়ে বিশাল বৈদ্যুতিক পাখার বিপরীতে রং রেখে চিত্রপটে তাৎক্ষণিক বিচ্ছুরণ – এসবই দেয়ালে ঝোলানো নামিদামি ছবির প্রতিষ্ঠিত প্রথার বিরম্নদ্ধে নতুন সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ। পৃথিবী জুড়ে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা অন্যকরম কিছু করতে চান। এই মনোময়তায় বর্তমানে নানা ধরনের স্থাপনাশিল্প সৃষ্টি হচ্ছে নতুন সৃষ্টিশীল চেতনা-সমৃদ্ধ ভাবনায়। হয়তো সেগুলো দেয়ালে টাঙানো চিত্রাবলির মতো স্থায়ী নয়, অস্থায়ী সব। তাতে স্থাপনাশিল্পীরা চিমিত্মত নন, তাঁরা সেগুলো ভিডিও করে সংরক্ষণ করে থাকেন। কিন্তু নতুন সৃষ্টিশীল কিছু তৈরি করলেন, যা অভিনব, অনন্য, অন্যদের মতো গতানুগতিক নয়, সেটাই তাদের কাছে সবচেয়ে প্রধান বিবেচ্য ও গ্রহণীয় বিষয়। সময় সবসময় পরিবর্তনশীল, সময়ের চাহিদা এই পরিবর্তন ঘটায়, যা নতুন সৃষ্টিশীলতায় নিমগ্ন। সব শিল্প এখন একই জায়গায় একীভূত হচ্ছে। এখন একজন সৃষ্টিশীল শিল্পী তাঁর সৃষ্টিকর্মে দৃষ্টি, শব্দ, ঘ্রাণ, স্পর্শ, স্বাদ, বোধ, অনুভব, হাসি, কান্না, স্বপ্ন, নিদ্রা – সবকিছুকেই প্রকাশ করতে চান; এটাই সময়ের চিরমত্মন প্রয়োগ ও ভারসাম্যতায় মিথুনের যাত্রা হয়েছে বহুপথ ধরে। সংগীত, কবিতা, বাদ্য, আলোর প্রক্ষেপণ – এসব কী এক চমক সৃষ্টির জন্যে বহুলালোচিত হওয়া? তিনি কোন দিকে যাবেন? তিনি এসব যৌগিক প্রায়োগিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সবার সামনে ছবি নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে কী, কেন, কেমন করে ও কোথায় বলতে চেয়েছেন। সব দিক সামলে তিনি কী সামনের দিকে এগোতে পারবেন? এসব জিজ্ঞাসিত

বিষয় তাঁকে ভাবতে হবে ভবিষ্যতের চিত্র-স্থাপনা রচনা করতে, হয়তো সেজন্য প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘সেলফ ডিসটরশন’ বা ‘স্বীয় বিকৃতকরণ’। সবকিছু বিবেচনা করে বলতে হয়, মিথুনের সাম্প্রতিক এই দলছুট চিত্রপ্রদর্শনী দ্বারা তিনি সবাইকে অন্যরকম এক অন্য কিছু যুক্ত শিল্পচিমত্মার জগৎ প্রসারিত করেছেন নিঃসন্দেহে। তাঁকে আমত্মরিক অভিনন্দন।