একটি কবিতার গল্প চন্দ্রিকা বালান

অনুবাদ : সম্পদ বড়ুয়া

সুষমা একটা কবিতা লিখছে। কাগজের পাতায় কবিতার প্রথম দুটো পঙ্ক্তি খুব সহজেই ধরা দিলো।

এক ফোঁটা অশ্রম্নবিন্দু নেচে ওঠে চোখের পাতায়

যখন তোমার কথা মনে পড়ে, এখনো তাই।

 

এগুলো খুবই সাদামাটা পঙ্ক্তি। যে-কোনো রোমান্টিক বা উত্তর-আধুনিক কবি তা লিখতে পারেন। তবে এখানে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে এজন্য যে, এ-পঙ্ক্তিদুটো একজন নারী কর্তৃক রচিত হয়েছে। আপনারা জানেন আমাদের সমাজে, যেখানে সুষমার স্বামী রঘুরমণও অমত্মর্ভুক্ত হয়ে আছে, মানুষ সবসময় ভিন্নপথে আত্মজৈবনিক উপাদান বের করে আনার চেষ্টা করে। রঘুরমণ যদি সুষমার কবিতার এ দুটো লাইন পড়ত তাহলে তার দিকে সন্দেহের চোখে দেখত। সে খুব সতর্কতার সঙ্গে ভাবে, সিজারের মতো তার স্ত্রীও সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকবে।

সুতরাং একটা বৈরী আর সন্দিগ্ধ জগতে সুষমার কবিতার জন্ম হয়েছে। তাকে ভালো করে দেখুন, সে কবিতা লিখছে রান্নাঘরের টেবিলে, যেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাগজের টুকরো, ভাঙা পেনসিল, ছুরি, বিবর্ণ শাকসবজি আর কিছু পেস্নট। গোলাকার করে কাটা ঢেঁড়স রয়েছে, যা ভাজা হবে কিংবা খিচুড়িতে দেওয়া হবে। কাঁচকলা, মুরগির রান আর টমেটোগুলো তাদের অসিত্মত্বের কথা জানান দিচ্ছে। সুষমাকে লক্ষ করুন, সে টেবিলের ওপর আধা-ফালি করে কাটা সবজিগুলো রেখে কবিতার প্রথম দু-লাইন লেখার জন্য উঠে গেল। দু-লাইন লিখে সে আবার সবজির কাছে ফিরে আসে। এবার সে ঢেঁড়সগুলো সুন্দর আংটির মতো কেটে নিল। তার ঠোঁট নড়ছে। সবজি দূরে সরিয়ে রেখে এবার কাঁচকলা নিয়ে বসে বিড়বিড় করে কী যে বলছে, ঠিক স্পষ্ট শোনা যায় না। দেখুন, দেখুন; কত সহজে সে ছুরির অগ্রভাগ দিয়ে কলার খোসা ছাড়িয়ে নিল। হঠাৎ সে থেমে যায়, পেনসিলটা হাতে তুলে নেয়। আমরা দেখি কত অনায়াসে কবিতার আরো পাঁচটি লাইনের জন্ম হলো –

আমার স্মরণে আসে –

আমরা ছাতার নিচে এলোমেলো কীভাবে হেঁটেছি

কীভাবে প্রবল বৃষ্টি ভিজিয়েছে নিঃসঙ্গ সড়ক

কীভাবে রেখেছো হাত অনায়াসে বাঁ কাঁধে আমার

শরীর আমার শুধু কাঁপিতেছে পরশে তোমার।

সুষমার চোখদুটোতে ধীরে ধীরে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ছে। হাতদুটোর নড়াচড়া ক্রমশ সিত্মমিত হয়ে আসছে, যেন সে ঘুমিয়ে পড়বে। সে যেন চলে গেছে অন্য এক জগতে, যেখানে বৃষ্টি আছে, বৃষ্টির ছন্দ আছে আর আছে বিদ্যুচ্চমক। আমরা এখানেই সুষমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। এবার দেখা করব রঘুরমণের সঙ্গে। ছেলেমেয়েদের স্কুলের কাছে একটা বাসস্টপে রঘুরমণ দাঁড়িয়ে আছে। অফিসে যাওয়ার জন্য সে বাসের অপেক্ষায়। সাধারণত সে বাইকে চলাফেরা করে। তবে আজ বাইকটা বিগড়ে গেছে, একেবারেই চলতে চাইছে না। তাই বাচ্চাদের একটা অটোরিকশা করে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে এখন বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। শিগগিরই বাস আসবে।

অফিসের হাজিরা রেজিস্টারে নামের পাশে লাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন পড়ার আগেই তাকে পৌঁছতে হবে। অফিসে রঘুরমণের টেবিলটা শ্রীরঞ্জিনীর টেবিলের পাশেই। এ-নারী সহকর্মীকে সে খুব পছন্দ করে। নারীর শরীরের বিভিন্ন স্থান নিয়ে সে উদ্ভট সব কল্পনা করে থাকে, যেন ভাবে সেসব তার স্ত্রী সুষমার। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে, সে শ্রীরঞ্জিনীকে কখনো নিজের স্ত্রী হিসেবে ভাবেনি। তবে স্ত্রী হিসেবে সে সুষমার মতো নারীকেই পছন্দ করে – যে শামত্ম, বেশি কথা বলে না, কোনোরূপ অভিযোগ ছাড়াই গৃহস্থালির সব কাজ করে ফেলে। তাছাড়া রন্ধনবিদ্যায়ও সে অসাধারণ। বন্ধু হিসেবেই শুধু শ্রীরঞ্জিনী ভালো। যখন মনটা শুষ্ক-রুক্ষ থাকে, তখন কথা বলার জন্য এমন বন্ধু হয় না। ভারতীয় ক্যাফে হাউসে সময় কাটানোর জন্য সত্যিই আনন্দদায়ক। এক কাপ চা আর মশলা দোসা খেতে খেতে বোর্জেস কিংবা অরবিন্দ বা ডি-কনস্ট্রাকশন বিষয়ে তর্ক জুড়ে দেওয়া যায়। যদি শ্রীরঞ্জিনীর আপত্তি না থাকে তাহলে সে আরো একটু বেশি অগ্রসর হতে পারে, তবে ততটুকু পর্যমত্ম, যেখান থেকে ফিরে আসা যায়। রঘুরমণ কখনো তাকে স্ত্রী হিসেবে আশা করে না, এ-ধরনের নারীবাদী নারীরা অন্যদের স্ত্রী হতে পারে।

শ্রীরঞ্জিনীকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই একটা বাস তার সামনে এসে দাঁড়ায়। স্কুলের পোশাকপরা ছেলেমেয়েরা হাত-পা ছুড়ে নেমে এলে বাসটা প্রায় খালি হয়ে যায়। রঘুরমণ জানালার পাশে একটা সিটে আরাম করে বসে পড়ে আর শ্রীরঞ্জিনীর কথা ভাবতে থাকে। তার ধারণা, আজ সে লাল সিল্কের শাড়ি পরে অফিসে আসবে। এসব সাধারণ চিমত্মা মাথায় খেলা করতে করতে তার সিটের পেছনে বসা দুজন স্বঘোষিত সমালোচকের আলাপচারিতা তার কানে এলো –

ক : তুমি কি ‘গ’র সর্বশেষ গল্প পড়েছ?

খ : হ্যাঁ, পড়েছি। আমার মনে হয়েছে গল্পে অতৃপ্ত স্ত্রী এ-গল্পের লেখিকা নিজে।

ক : আমারও তা মনে হয়েছে। তবে তুমি কীভাবে নিশ্চিত হলে?

খ : দেখো, আমার এক সহকর্মী ওই লেখিকার বাড়ির কাছেই থাকেন। সেই ভদ্রলোক আমাকে বলেছেন, নারীর বিয়েতে বেশ কিছু সমস্যা আছে। তুমি কি লক্ষ করোনি লেখিকার সব নায়িকা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে নিজেদের জড়িয়েছে, যদিও তারা বিবাহিত।

ক : তুমি একেবারে ঠিক কথা বলেছ। সুতরাং গল্পের মেয়েটার কাহিনি…

খ : অবশ্যই লেখিকার।

রঘুরমণ লেখিকা ‘গ’কে চেনে। সে তার সুখী বিবাহিত জীবন সম্পর্কে পরিচিত। তাকে নিয়ে এসব গল্প সে কৌতূহলভরে শোনে। স্বসিত্ম পায় এই ভেবে যে, সুষমা লেখিকা নয়। নতুবা এ-ধরনের কৌতূহলের পথ একইভাবে তার নিজের শয়নকক্ষির মধ্যে ঢুকে পড়ত। লেখিকার স্বামী হওয়ার আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে ভাগ্যের গ্রহনক্ষত্রকে ধন্যবাদ জানায়।

শ্রীরঞ্জিনী ইংরেজিতে কবিতা লেখে। লোকজন তার সম্পর্কে আলোচনা করে। এই নারীদের লেখার প্রতি এত আগ্রহ কেন? সে শ্রীরঞ্জিনীর কবিতা পড়েছে। কবিতাটি ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে একটা পুরস্কারও পেয়েছে। কবিতাটির শুরুটা এরকম –

আমার বসন খোলো, নগ্ন চোখে আসল      আমাকে

দেখো আর ভয় পাও, ধাক্কা খাও নৈতিক    পতনে।

শ্রীরঞ্জিনী ছাড়া এ-ধরনের সুন্দর পঙ্ক্তি আর কে লিখতে পারে? ‘আমার বসন খোলো’ কী চমৎকার বিনির্মাণ, যা পাঠককে কোথায় যে নিয়ে যাবে! রঘুরমণের জিহবা তার ঠোঁট দুটোকে ছুঁয়ে গেল।

সুষমার কবিতার আরো তিনটি লাইন যোগ হলো –

প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা একটি ফুল কীভাবে ফোটায়,

কীভাবে আগুন ধরে একে একে সব পাপড়িতে,

কীভাবে উষ্ণতা আর লাল আভা শরীরে ছড়ায়।

অসমাপ্ত কবিতাটি খাবারের টেবিলে বিশ্রাম নেয়। সুষমা ঘরের সব টুকিটাকি কাজ সেরে স্নানে যায়। তার শরীরের ওপর দিয়ে জল গড়িয়ে নামার সময় আমরা জানি তার মন এখনো অর্ধ-জন্মানো কবিতার ঘোরের মধ্যে আছে। বিকেলের রোদের উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা বাড়ির চারপাশে উষ্ণতা ছড়ায়। গরম সহ্য করতে না পেরে লতাগুল্ম দুর্বল হয়ে যায়, তাদের মাথা নুয়ে আসে। কিন্তু সুষমা যেখানে আছে, সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে। তার মনের ভেতর তুমুল বৃষ্টি। হঠাৎ তার ভেতর আর একটা পঙ্ক্তি জন্ম নেয় –

কীভাবে তোমার চোখ লুকিয়েছে আমার ছড়ানো                                  অলকগুচ্ছে।

অতঃপর আমরা দেখি সুষমা একবারে নগ্ন, জলে সিক্ত অবস্থায় খাবার টেবিলে দৌড়ে যায় তার কবিতায় এ-পঙ্ক্তিটি যোগ করার জন্য। তাড়াহুড়ো করছে পাছে তা স্মৃতি থেকে মিলিয়ে যায়। সে তাড়াতাড়ি পঙ্ক্তিটা লিখে নেয়। ঘরের পর্দাগুলো টাঙানো আছে কিনা কিংবা অলস প্রতিবেশীর শকুন চোখ শিকারের দিকে তাক করে আছে কিনা, এসব কিছুকেই আমলে নিল না। যখন সে লিখছে তার পায়ের নিচে পানির একটা প্রলেপ তৈরি হয়, সে আবার টপটপ করে ঝরেপড়া ভেজা চুল ঝাঁকিয়ে স্নানঘরে ঝরনার নিচে ছুটে যায়। এসব করার সময় সে ক্ষণিকের জন্য শোয়ার ঘরে আয়নায় নিজের ছবি একবার দেখে নেয়।

আর একবার সে স্নানঘরে ঝরনার নিচে দাঁড়ায়। এবার তার শরীর সম্পর্কে রঘুরমণের বাচাল মমত্মব্য মনে করার চেষ্টা করে। একবার তার সহকর্মীরা বাসায় চা খেতে এলে সে বলেছিল, ‘দেখো, মিস ইউনিভার্স, আর আমার স্ত্রীর মধ্যে পার্থক্য কেবল একটাই, মিস ইউনিভার্সের শরীরের বাঁকগুলো যথাস্থানে রয়েছে, আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রে সেগুলো ভুল জায়গায় আছে।’ রঘুরমণ হেসে ওঠে, নিজের কৌতুক নিজেই উপভোগ করে। তার সহকর্মীরা স্পষ্টত বিব্রতবোধ করে, তবু মুখে হাসি ধরে রাখে। শুধু একজন মহিলা – রঞ্জিনী বা অন্য কেউ তার এ-বক্তব্যে বিরূপ মমত্মব্য করল। মহিলা পরে সুষমার রান্নাঘরে এসে তাকে সামত্মবনা দিতে চেষ্টা করে। ‘সুষমা, আপনি এটাকে সহজভাবে নিন। রঘুরমণ সত্যিই আপনার জন্য গর্ববোধ করেন। তিনি অফিসে আপনাকে নিয়ে দিনে একশবার আলাপ করেন।’ সুষমা জানে স্বামী তার সম্পর্কে কোনো আলোচনা করলে সেখানে মূলত অন্য মহিলাদের সঙ্গে তার তুলনায় নেতিবাচক বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। এজন্য সে আর কথা বাড়ায়নি। সেদিন বিকেলের স্মৃতিটা তার কবিতা-বিহবল মনে জোর করে ঢুকে যাওয়াটা সে সত্যিই পছন্দ করেনি। ‘সরে যাও’, স্মৃতিকে সে বলে, ‘আমার কবিতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকো না, বিদেয় হও।’

রঘুরমণ অফিসের ক্যান্টিন থেকে ফিরে আসে, তার হাতে আর নিশ্বাসে মুরগির রোস্টের গন্ধ লেগে আছে। শ্রীরঞ্জিনীকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি খাননি? আজো কি উপবাসে আছেন?’

‘হ্যাঁ’, সে বলে, ‘আজ, বৃহস্পতিবার। এদিনে আমি ছেলেমেয়েদের মঙ্গলার্থে সনাতন গোপাল ব্রত পালন করি।’

‘আপনার মধ্যে পরস্পরবিরোধী বিষয়ের কী অপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছে!’ রঘুরমণ মমত্মব্য করে, ‘আপনি যেখানে মুক্ত-ভয়হীন মতবাদ পোষণ করেন, সেখানে মাঝে মাঝে পুরনো প্রথা অনুসরণ করেন।’ এর উত্তরে শ্রীরঞ্জিনী কোনো কথা বলতে না চাইলে রঘুরমণ বলে, ‘তবে আমি অবশ্যই বলব, এ-পরস্পরবিরোধী আচরণ আপনার সৌন্দর্যকেই দীপ্তিময় করে তোলে।’

এ-বিষয় থেকে তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শ্রীরঞ্জিনী প্রশ্ন করে, ‘আপনি বাড়ি থেকে কেন দুপুরের খাবার আনেন না? সুষমা খুব আনন্দের সঙ্গে আপনার জন্য তা তৈরি করতে পারেন।’

‘আমি ঠান্ডা খাবার পছন্দ করি না’ – সে বলে, ‘আমি ঝাল আর গরম খাবার খেতে চাই। এজন্য আমি বিয়ে করার বেলায় একজন চাকরিবিহীন উচ্চাকাঙক্ষা নেই এমন মেয়েকে ঠিক করেছি। আপনি জানেন আমার বাসায় কোনো ফ্রিজ নেই। সুষমা আমাকে দিয়ে একটা ফ্রিজ কেনার কতই না চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমি অনড়। এখন বুঝতে পারছেন আমার ভালো স্বাস্থ্যের গোপন রহস্য।’

শ্রীরঞ্জিনীর চোখ দুটো তার শক্ত হাত আর চওড়া বুকের ওপর গোপনে নিবদ্ধ হয়, অপরাধবোধের মানসিকতা থেকে দৃষ্টি প্রত্যাহার করে নেয়। একসময় দাঁড়িয়ে অস্পষ্টভাবে কিছু কৈফিয়ত খাড়া করে চলে যায়।

কবিতাটি এখন সুষমার কোলে শুয়ে আছে। সে এর সঙ্গে আরো কিছু পঙ্ক্তি যোগ করে –

 

কীভাবে আলাদা হয় আমাদের দুটি ভিন্ন পথ

কীভাবে অদৃশ্য হাতে মুছে যায় আমাদের স্মৃতি

এসব স্মরণে রাখি অবিরাম, চিরকাল।

 

সুষমা কবিতাটি বারবার পড়ে, কিছু কিছু পরিবর্তন আনে। বাড়ির বাইরে সূর্য তার তাপ হারাতে শুরু করেছে। সুষমার মন এখন ভালো। সকালে সূর্যের সঙ্গে সে জেগে ওঠে আর তার সঙ্গেই পথ চলা হলেও শরীরে কোনো ক্লামিত্মর ছাপ নেই। তার চেহারায় একটা স্বর্গীয় আনন্দের আভা; যেন সে একটা অপ্সরা যে গোপনে একটা শিশুর জন্ম দেওয়ার জন্য সবুজ বনে এসেছে। কবিতা থেকে তার চোখ দুটো উঠে আসে এবং ঘরের চারদিকে দেখে নেয়। টেবিলের ওপর রাখা হালকা খাবার আর চায়ের দিকে কিংবা ঘড়ির কাঁটার দিকে তার চোখ যায়নি।

‘আমি আজ তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি’ শ্রীরঞ্জিনীকে কথাগুলো বলে রঘুরমণ। ‘ছেলেমেয়েদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে বরাবরের মতোই আমি আজ আর ফিরে আসছি না। ওয়ার্কশপে আমার বাইকটার কী অবস্থা দেখতে যেতে হবে।’ একটা ফাইল থেকে শ্রীরঞ্জিনী মাথা তুলে তাকিয়ে মুচকি হাসি ছড়িয়ে দেয়।

‘কাল দেখা হবে’ বলে একটু থেমে রঘুরমণ তার টেবিলের কাছে এসে নিচুস্বরে ফিসফিসিয়ে বলে – ‘কাল লাল শাড়ি পরে আসবেন তো? এটা আমার অনুরোধ, পিস্নজ।’

কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে সে দ্রম্নত হেঁটে চলে যায়। চোখে আর মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে শ্রীরঞ্জিনী তার দিকে চেয়ে থাকে। তার চলে যাওয়ার দৃপ্ত পদক্ষিপ যেন তার হৃদয়কে মাড়িয়ে যাচ্ছে।

সুষমার কম্পমান হাত এখন একটা টেলিফোন নাম্বারে ফোন করতে ব্যস্ত। কবিতাটাকে সে শিশুর মতো নিজের কোলে প্রতিপালন করছে। ওটাতে আর কোনো নতুন পঙ্ক্তি যোগ করেনি। সুতরাং আমরা নিশ্চিমেত্ম উপসংহার টানতে পারি যে, কবিতাটি সম্পূর্ণ হয়েছে। কাঙিক্ষত নাম্বারে ফোন করে সুষমা অস্থিরচিত্তে নিজের আসনে বসে পড়ে।

দূরে অনেক দূরে আমরা একটা টেলিফোন বাজার ক্ষীণ শব্দ শুনতে পাচ্ছি। একসময় শব্দটা থেমে যায়। কেউ একজন রিসিভারটা তুলেছে। একটা পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেল। ‘হ্যালো?’ সুষমার মুখটা টানটান হয়ে এলো, যেন তার হৃদয়টা যে-কোনো সময় ভেঙে পড়বে। একটা ছোট বিরতি নিয়ে কণ্ঠটি আবার প্রশ্ন করে -­ ‘হ্যালো, দয়া করে বলবেন আপনি কে? আপনি কিছু না বললে আমি জানব কী করে?’

সুষমা হঠাৎ রিসিভার আগের জায়গায় রেখে দেয়। তার নাড়ির স্পন্দন ধীরে ধীরে নেমে স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে, মুখাবয়বে নেমে আসে স্বসিত্ম। সে তখন কবিতায় আরো কিছু পঙ্ক্তি সংযোজন করতে থাকে।

 

যদিও তোমার মনে আজ আর রাখো না তো ধরে

আমার চোখের কোণে এখনো যে তুমি অশ্রম্নবিন্দু

প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ে নীলাকাশ থেকে

ভরেছো আমার মন সাগরের ঢেউয়ের মতো।

 

রঘুরমণ আর ছেলেমেয়েরা একটা অটোরিকশায় বাসায় আসে। সুষমা তাদের আসার শব্দ শুনতে পায়, তাড়াতাড়ি ছুটে এসে কবিতাটিকে ছিঁড়ে ছোট ছোট টুকরো করে ফেলে। ছেঁড়া টুকরোগুলো জানালার বাইরে ছুড়ে মারে আর কলিংবেল বাজার আগেই দরজা খোলার জন্য ছুটে যায়। কারণ সে একজন আদর্শ স্ত্রী। আদর্শ মা!

সুষমা যেহেতু কবিতাটি নষ্ট করে ফেলেছে, তাই পাঠক, আপনারা যদি তার পুরোটা পড়তে চান তাহলে এ-গল্পে কবিতার যে ছড়ানো-ছিটানো অংশ রয়েছে সেসব একত্র করে পড়ার চেষ্টা করুন।

 

[চন্দ্রিকা বালান : চন্দ্রিকা বালান ১৯৫৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতের কেরালা রাজ্যের ত্রিভুবনানথাপুরাণে জন্মগ্রহণ করেন। চন্দ্রমাথি নামে ইংরেজি এবং মালয়ালম দুই ভাষাতেই তিনি সাহিত্য রচনা করেন। উপন্যাস, ছোটগল্প রচনা ও অনুবাদে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কেরালা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি অর্জনের পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ-ডি ডিগ্রি লাভ করেন। অধ্যাপনায় নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। মূলত মধ্যবিত্ত পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে নারীদের অবস্থান কেমন, সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা তাদের কীভাবে বিচার করে, একটা মেয়ের স্বাধীন সত্তা কীভাবে বিকশিত হতে চায় – এসব জেন্ডার বিষয় তাঁর রচনায় উঠে এসেছে। কেরালা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। উলেস্নখযোগ্য রচনা : Arya and other Stories (2014), The Private Garden : Family in the Post War British Drama (1993), Devigraman (village of the Goddess) 1997, Daivam Swargethi (God is in the Heaven) 2000। তাঁর গল্পের ওপর ভিত্তি করে মালয়ালম ভাষায় ছবিও নির্মিত হয়েছে। ‘একটি কবিতার গল্প’ গল্পটি Urvashi Butalia-সম্পাদিত Katha : Short Stories by Indian Women (2007) বইয়ে অমত্মর্ভুক্ত চন্দ্রিকা বালান-রচিত ‘The Story of A Poem’ গল্পের অনুবাদ।] r