একটি মহৎ জীবনের আলেখ্য

বেগম আকতার কামাল
বিশ শতকের রাশিয়ায় কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার পর দেশে দেশে গড়ে ওঠে অনেক কমিউনিস্ট ভাবাদর্শী দল। ভারতবর্ষেও কমিউনিজমের স্বপ্ন ও আন্দোলন দেখা দেয় দ্বিতীয় দশকেই। কলকাতার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এর পার্টি গড়ে উঠেছিল চতুর্থ দশক থেকে। তার আগেই রবীন্দ্রনাথ গুহ তাঁর রাজনৈতিক পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯২৩ সালে ঢাকার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে, বাবা অতুলচন্দ্র গুহ, মা প্রিয়তমা। তাঁর বাল্যকাল কেটেছে স্বাধীনতা-আন্দোলনের তরঙ্গসংকুল পরিবেশে। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তিনি ১৯৩৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।

এই আদর্শবাদ লড়াকু, সাংগঠনিক কর্মকুশল মানুষটির জীবনকথা নিয়েই রবি গুহ : স্মরণ-বিস্মরণ গ্রন্থটি সংকলিত। এতে গ্রন্থিত হয়েছে ‘তরুণ তুর্কী’ শিরোনামে পাঁচজন ব্যক্তির স্মৃতিকথা, ‘উদ্বাস্তু’ শিরোনামে সাক্ষাৎকারসহ ছাপা হয়েছে দশজন মানুষের লেখা রবি গুহের কর্মজীবন নিয়ে বৃত্তান্ত। পাঁচজন সহকর্মী লিখেছেন ‘সহকর্মী’দের দৃষ্টিতে রবি গুহের কথা। ১৯৯০ সালে কলকাতা থেকে ঢাকায় বেড়াতে আসার তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি নেওয়া হয়েছে স্ত্রী নিশা গুহের ডায়েরি থেকে। আছে কতগুলো মূল্যবান চিঠিপত্র। বিদ্বজ্জনের মধ্যে আছেন শওকত ওসমান, সন্জীদা খাতুন, সরদার ফজলুল করিম, রঙ্গলাল সেন। এছাড়া ‘হারানো চিঠি’র সংগ্রহ আছে অজিতকুমার সেন, শহীদুলস্না কায়সার, সরদার ফজলুল করিম ও মোজাফফর আহমেদের। আরো আছে রবি গুহের জীবনতথ্য এবং তাঁর লেখা দুটি রচনা – ‘আমার জানা নাজমুল’, নাজমুল করিমের দুটি চিঠি।

এসব রচনা থেকে জানা যায় তাঁর শিক্ষাগ্রহণের কথা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে বন্ধুতা ছিল কাজী মোতাহার হোসেন, সরদার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরীরও। প্রথমে তিনি ফেনী কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এরপর দাঙ্গার সময় কলকাতায় উদ্বাস্তু হন। বস্তুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন যে ছাত্র-নেতৃত্ব এবং পরবর্তী যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখেন তাঁদের একটা বড় অংশ রবি গুহ তৈরি করেছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনে কৃষি অর্থনীতি চর্চা এবং কাজেও যোগ দিয়েছিলেন।

ভূস্বামী ও রাষ্ট্রশক্তির মিলিত আক্রমণ ও সন্ত্রাস প্রতিহত করে যাদবপুর ও টালিগঞ্জ এলাকার কলোনিগুলো রক্ষা করে নতুন সমাজ গঠনে সামনের সারিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন রবি গুহ। নারীশিক্ষার দিকে তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। এক্ষেত্রে কাজও করেন, তাঁর সম্মিলিত উদ্বাস্তু বিদ্যালয় (১৯৫১ সালে) গঠন। তিনি ছিলেন এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। সর্বস্বান্ত ছিন্নমূল উদ্বাস্তুরা সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। এর জন্য তাঁকে প্রচ- পরিশ্রম করতে হয়েছিল। মানুষের কল্যাণের জন্য অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থত্যাগ করেন। রবি গুহের ‘জীবন একটা উত্তরণের জীবন’। একই সঙ্গে কমিউনিস্ট, আদর্শবাদী ও মানবতাবাদী এই মানুষটির জীবনাবসান ঘটে ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে।

রবি গুহ : স্মরণ-বিস্মরণ সংকলনগ্রন্থটি তাঁর যে-পরিচয় তুলে ধরে তা আমাদের ইতিহাসেরই গেŠরবময় অংশ। বন্ধুবৎসল, দরদি আর খোলামেলা মনের এই
মানুষটিকে স্মরণ করে, তাঁকে নিয়ে এই সংকলন প্রকাশ আমাদের একজন মহৎ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করায় এবং আমাদের দীক্ষিত করে আদর্শবাদে, স্বার্থত্যাগে, মানুষের কল্যাণের জন্য করে উদ্বুদ্ধ। রবি গুহ অবিস্মরণীয় একজন সত্যিকারের মানুষ বলেই গ্রন্থটি আমাদের মনে প্রতীতি জাগায়। r