একটি সূর্যের পতন

মো. মাহবুবুল হক

স্থপতি মাজহারুল ইসলামের কথা বলছি। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত বলব না, তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগও আমার হয়নি, তাই তাঁর সম্বন্ধে যা জেনেছি শুনেছি তা-ই বলে যাব। তাঁর কাজ, দর্শন, অবদান আর ব্যক্তিত্ব এসব।

বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর তিনি সরকারি কোনো পদে আসীন না থেকে স্থাপত্যজগতে সদা জ্বলজ্বল করতেন। আন্তর্জাতিক বিচারে গ্রহণযোগ্য স্থাপত্যের দিশারী তিনিই ছিলেন এদেশের। আসলে তাঁর চিন্তা-চেতনা আর প্রভাব দেশে স্বাধীনতা অর্জনের অনেক আগে থেকেই পড়তে শুরু করেছিল। তিনি যতগুলো পাবলিক কাজ করেছেন তার সবই সফলতার মুখ দেখছিল। জনসাধারণ কিংবা স্থাপত্যসমাজ – উভয়ই সেগুলোর দারুণ কদর করত। পুরনো পাবলিক লাইব্রেরি, আর্ট কলেজ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি আর ন্যাশনাল আর্কাইভস এর কয়েকটি। তাঁর কাজের পাশ দিয়ে পথ চলতে চলতে যে-কারো দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ হবে এজন্যে যে, তাঁর সৃষ্টি সত্য, অনন্য আর বড়ই নয়নাভিরাম।

যদিও তাঁর আদি প্রশিক্ষণ পুর প্রকৌশল শাস্ত্র, স্থপতি মাজহারুল  ইসলামের কাজ এর প্রাণহীনতামুক্তই ছিল না, বরং বিপরীতে চারুকলার হৃদয় হরণকারী প্রতিফলনে একাকার ছিল। ময়মনসিংহে অবস্থিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তাঁর গুরু স্থপতি পল রুডলফ করেছিলেন। এটি আর দশটি ক্যাম্পাস থেকে শুধু ভিন্নই নয়, অনেক সুন্দর দেখতে। তাঁর মত ছিল, বাক্স থেকে বের হয়ে এসে কাজে কলার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তিনি বাক্সের নাম দিয়েছিলেন ম্যাচবক্স। এতে যদি ফাংশন কিছুটা ব্যাহত হয় তাতেও তাঁর আপত্তি থাকবে না ­- তাঁর অবস্থান দিকপাল স্থপতি মিইস ভ্যান ডিয়ার রোর ‘লেস ইজ মোর’ অবস্থানের এতটাই বিপরীতে ছিল। তাঁর অধীনেই স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে স্থাপত্যশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম তাঁর দ্বারাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন বলা চলে। লক্ষ করুন, আর্ট কলেজ। এটি তাঁর একটি সার্থক কাজ। কলেজে সব সময় তরুণদের সমাগম আড্ডা চলছে। চলছে এজন্য যে, জায়গাটা তাঁদের ভালো লাগে বলে। এই ভালো লাগাটাই স্থাপত্যকর্মের প্রধান মাপকাঠি, যা কিনা অন্যসব কারিগরি মাপকাঠির ঊর্ধ্বে বলে মনে করি। আবার তাঁর করা ছবি মানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিন উঁচু-নিচু ছিল পাহাড়ি এলাকা বলে, সেই টপোগ্রাফির সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন ভবন আকর্ষণীয়ভাবে বিন্যস্ত করেছিলেন তিনি। একটি পরিবেশবান্ধব, নয়নাভিরাম বিদ্যাপীঠের জন্ম হয়েছে। এটিও একটি অনন্য কাজ।

ইউরোপে অন্ধকার মধ্যযুগের পর যেমন আলোকিত রেনেসাঁস আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তেমন বাংলাদেশে স্থাপত্যে তিনি রেনেসাঁসের সার্থক বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। তাঁর পরের প্রজন্ম পেশাজীবীকে তাঁর চিন্তা-চেতনা-দর্শন গভীর আগ্রহ সহকারে অনুসরণ করতে দেখেছি। তাঁরা প্রভাবান্বিত হতে চাইতেন। এ লক্ষ্যে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ‘চেতনা’ নামে একটি সংগঠন গড়েছিলেন, যেটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমকালীন স্থাপত্য পরিশীলন। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর প্রভাব এ-পর্যন্ত বয়ে এসেছে এবং আগামীতেও সমান গতিতে চলমান থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর অবদান কেবল দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁর সুনাম এতটা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, তিনি আন্তর্জাতিক স্থাপত্যকর্মে জুরির ভূমিকায় মনোনীত হতেন প্রায়ই। জাতীয় স্মৃতিসৌধ ডিজাইন প্রতিযোগিতায় তিনিই ছিলেন প্রধান জুরি। আর তিনি যথার্থই প্রথম স্থান নির্ণয় করেছিলেন, যার ফল জাতি পলকে পলকে উপভোগ করছে। মুসা, তাফসিয়া আর মুহিতের হিমালয় বিজয় যেভাবে বাংলাদেশের নাম পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, তাঁরা দেখিয়ে দিতে পেরেছেন বিশ্বকে যে – বাংলাদেশও পারে, তেমন স্থপতি ইসলাম বাংলাদেশ নামটি  আন্তর্জাতিক স্থাপত্যজগতে তুলে ধরেছিলেন যে, বাংলাদেশও পারে। সংসদ ভবনের স্থপতি লুই আই কান বা সুউচ্চ ভবন ডিজাইনে বিশ্ববিখ্যাত প্রকৌশলী এফ আর খান যখন বাংলাদেশে আসতেন, তখন তাঁকে দেখতাম তাঁদের সঙ্গে। হয়তো ভাবের আদান-প্রদান করতেন।

স্থপতি ইসলামের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। সূর্য সৌরজগতের তারা নক্ষত্রে আলো দিয়ে যাচ্ছে আর এরা নিজ নিজ কক্ষপথে তাঁকে প্রদক্ষিণ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের স্থাপত্যজগতের সূর্য স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। তাঁর চলে যাওয়াটা একটি সূর্যের পতন বলে মনে করছি।