একাত্তরের স্মৃতিকথা

নার্গিস জাফর

স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর বছর। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা একুশ বছর চাপা পড়েছিল। যে-অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই নীতি ও প্রেরণার অভাবে যা ঘটেছিল এই একুশ বছর ধরে তা হলো দুষ্টাচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অবক্ষয়। চাপাপড়া পাথর এখন সরেছে।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে আমার জীবনের কিছু ঘটনা এখানে তুলে ধরছি। ডায়েরি লেখা আমার অভ্যাস না থাকাতে দিন-তারিখ ঠিকমতো দিতে পারছি না।

৭ মার্চের জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সারাদেশে প্রবল উদ্দীপনা।

মার্চের ৭ তারিখে আমার স্বামী মরহুম কবি সিকান্দার আবু জাফরের কবিতা ‘বাংলা ছাড়ো’ দৈনিক পাকিস্তানে ছাপা হলো। ইত্তেফাক এবং সংবাদ এই কবিতা ছাপতে অস্বীকার করলে জাফর সাহেব কবি হাসান হাফিজুর রহমানকে বাধ্য করেন কবিতাটি ছাপাতে। হাসান হাফিজুর রহমান তখন দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদক ছিলেন।

পরদিন বহু অবাঙালির কাছ থেকে অনেক টেলিফোন আমি পাই, এ-ধরনের কবিতা আমার স্বামী কেন লিখলেন? আমি তখন USIS-এ লাইব্রেরিতে কর্মরত ছিলাম। আমার স্বামীকে এ-কথা বলা চলবে না। তাই নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে দিনগুলো কাটছিল।

২৫ মার্চ সকাল থেকে মনটা অস্থির। কী হবে কী হতে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দুপুরে Voice of America-র দিল্লির সাংবাদিক পরিচালক Don Weaver আমার অফিসে এলেন। এসেই উনি বললেন, ‘নার্গিস, বাড়ি যাও। তোমাদের প্রেসিডেন্ট মিথ্যাবাদী। কী হবে, কী হতে যাচ্ছে, কিছুই বলা যায় না।’

আমি তক্ষুনি টেলিফোন করলাম কবি সুফিয়া কামাল খালাম্মাকে। আমার সবকিছু খালাম্মাকে না বলে পারি না। খালাম্মা বললেন, ‘বউমা আমার মনটা অস্থির। তুমি এক্ষুনি চলে এসো। আমরা নিয়োগীর ওখানে যাব।’ নিয়োগীদার কথার ওপর আমার আস্থা আছে। অজিতকুমার নিয়োগী একজন কবি ও সাংবাদিক, এছাড়া তিনি হাত দেখেন ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলেন। আমাদের তাঁর কথার ওপর বিশ্বাস আছে।

আমি খালাম্মার ওখানে চলে এলাম। খালাম্মার সঙ্গে চা-নাশতা খেয়ে নিয়োগীর বাড়ি রওনা হলাম। নিয়োগীদা তখন এলিফ্যান্ট রোডে থাকতেন। আমরা নিয়োগীদার বাড়ি যেতেই তাঁর চাকর এসে আমাদের বসতে দিলেন এবং বললেন, তিনি স্নান করছেন।

নিয়োগীদা বেরিয়ে এসেই আমাদের দেখে চমকে উঠে বললেন, ‘আপনারা কেন এসেছেন? এক্ষুনি বাড়ি চলে যান। আমি শুধু রক্ত দেখছি। বারবার স্নান করছি কিন্তু শুধু রক্ত দেখছি। আজ এ-শহরে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। আপনারা এক্ষুনি বাড়ি যান।’ খালাম্মা বললেন, ‘আমরা কিছু বলতে চাই।’ কিন্তু তিনি একপ্রকার ঠেলে আমাদের পাঠিয়ে দিলেন – ‘এক্ষুনি চলে যান।’ খালাম্মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কখন শেষ হবে এই রক্তগঙ্গা?’ তিনি বললেন, ‘ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি।’

নিয়োগীদার এলিফ্যান্ট রোডের বাসা থেকে আমরা ধানমন্ডি ৮নং রোড দিয়ে ফিরছি। দেখলাম, আমেরিকান কনসাল জেনারেলের বাড়িতে পার্টি চলছে। খালাম্মাকে বললাম, ‘খালাম্মা, নিয়োগীদা ঠিক বলেনি তাহলে, আমেরিকানরা জানবে না দেশে কী হতে যাচ্ছে?’ আমি খালাম্মাকে বললাম, ‘খালাম্মা আমাদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে রোজ রাতে আর্মির গাড়ি যাতায়াত করে। ওদের গাড়ি ইপিআর থেকে ধানমন্ডি স্কুলে যায়। ওখানে ওরা ক্যাম্প করেছে। আমার বাড়ির উলটো দিকে খালি জায়গা। ওখানে একটা ছোট ঘর ছিল। আমি দেখেছি ওই ঘরে আর্মি থাকে। আমার স্বামীকে বললাম ওখানে আর্মি থাকে। তিনি বললেন, তুমি শুধু আর্মি দেখ। এত ভয় পাচ্ছ কেন?’

আমি খালাম্মাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। আমার স্বামী তখনো বাড়ি আসেননি। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে খাবার খেয়ে নিলাম। আমার ছেলে শুতে চলে গেল।

রাত সাড়ে এগারোটায় আমার স্বামী বাড়ি এসে বললেন, ‘শেখ সাহেব বলছিলেন, ‘যে যা পারো, হাতে নিয়ে যুদ্ধ করতে নেমে পড়ো’, রাস্তায় এখন ট্যাংক বের হয়েছে, কী হবে জানি না।’

জাফর সাহেব খেতে বসেছেন, তক্ষুনি চট্টগ্রাম থেকে একটি ফোন এলো। কথা বলার শুরুতেই লাইন কেটে গেল। লাইন একদম ডেড হয়ে গেল।

একটু পরই শুরু হলো গুলির শব্দ। সমানে গুলি চলছে। আমরা মা বলে চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। ধানমন্ডিতে তখন বেশি বাড়িঘর ছিল না। গুলির শব্দ আসতে লাগল, যেন আমার পাশের বাড়ি থেকে গুলি আসছে। শুধু গুলি আর গুলি এবং ট্যাংকের শব্দ পাচ্ছিলাম। ভয় পেয়ে আমার ছেলেকে আমাদের খাটে নিয়ে এলাম।

পরদিন কারফিউ চলছে এবং আমাদের টেলিফোন ডেড। সুতরাং কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো না। আমাদের রাস্তা দিয়ে আর্মির গাড়ি চলাচল করছে। আমাদের বাড়িতে কালো পতাকা উড়ছিল। আর্মিরা সেই পতাকায় গুলি করল।

দুদিন পর কারফিউ উঠে গেল। আমার স্বামী সিকান্দার আবু জাফর একটা রিকশা নিয়ে তাঁর সমকাল  অফিসে গেলেন। রাস্তায় লোকজন পালাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। আমি খালাম্মার সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাসায় গেলাম। খালাম্মাও খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। তাঁর পেছনের বাড়িতে রাশিয়ানরা থাকেন। তাঁরা খালাম্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন। খালাম্মা বললেন, ‘শুনেছি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে প্রচন্ড গন্ডগোল হয়েছে, তবে সঠিক খবর পাইনি।’ মনটা খুবই খারাপ লাগছিল। শুধু বললেন, ‘শুনেছি হত্যাযজ্ঞ চলছে।’

পরদিন আমার ছেলের বন্ধু আজাদ স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছে, তাই গামছা-লুঙ্গি পরে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আমাদের বাসায় এলো। আমি অবশ্য আমার ছেলেকে যেতে বারণ করলাম। পরদিন আজাদ চলে গেল। আমার বাসার সামনে দিয়ে আর্মির গাড়ি যাতায়াত করছে। তিনদিন পর টেলিফোন আবার চালু হলো।

চারদিন পর আমার অফিসের গাড়ি এলো। আমি অফিসে গেলাম। শুনলাম নানা ঘটনা। নানা অত্যাচারের কাহিনি – রাস্তা দিয়ে লোকজন পালাচ্ছে। কিন্তু জানি না কে কোথায় যাচ্ছে।

আমার অফিসে হঠাৎ এক বিদেশি সাংবাদিক এলেন। তিনি কলকাতা থেকে এসেছেন এবং বললেন, কীভাবে তিনি কলকাতা থেকে এসেছেন এবং তিনি আবার ফিরে যাবেন। তিনি আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে রাজি হলেন। কিন্তু আমার স্বামী রাজি হলেন না তাঁর সঙ্গে পাঠাতে।

নিতুন কুন্ডু তখন আমাদের অফিসে কাজ করতেন। যেহেতু পাকিস্তানিরা হিন্দুদের মারার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল তাই নিতুন কুন্ডুরা – তাঁর বাবা, মা এবং বোন – কীভাবে যাবে তাই নিয়ে অস্থির ছিলেন। কয়েকদিন পর বাবা-মাকে নিয়ে নিতুন কুন্ডু এবং আমার ছেলে রওনা হলো। কিন্তু নানা ঝামেলায় তাদের ফিরে আসতে হলো। হঠাৎ দেখি আমাদের বাড়ির চারদিক আর্মি ঘিরে ফেলেছে। আমার স্বামীও পালানোর ব্যবস্থা করছিলেন। বেশ মানসিক অশান্তিতে পড়লাম।

রাত বারোটায় দেখি আর্মির গাড়িতে করে ছেলেমেয়ে এবং মহিলারা পাশের বাড়িতে নামছে। পর্দা সরিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। মনে হলো আমাদের আত্মীয়স্বজন এসেছে।

পরদিন যথারীতি অফিসে গেলাম। কিন্তু খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। ছেলে বাইরে আছে। বিকেলে অফিস থেকে আসতেই আমার স্বামী বললেন, ‘ও-বাড়িতে যারা এসেছেন তারা বাঙালি – তাদের বাংলাতে কথা বলতে শুনেছি।’ আমাদের পাশের বাড়িটা ছিল একেএম আহসান সাহেবের বাড়ি। তাঁরা করাচিতে চাকরির জন্য বদলি হয়েছিলেন। তাই বাড়িটা খালি পড়ে ছিল।

তার পরদিন ছিল ছুটির দিন। আমি বাগানে ঘুরে ঘুরে বুঝতে চেষ্টা করলাম কারা এসেছে ও-বাড়িতে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার ছেলেসহ আরো ছেলেমেয়ে কুমিল্লা দিয়ে কলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা করছে।

দুপুরে এক সৈনিক আমার বাড়িতে এলো, সঙ্গে এক বাঙালি ছেলে। আর্মির লোকটা জানতে চাইল, আমাদের বাড়িতে ঘাস কাটা মেশিন আছে কিনা? আমি বললাম, ‘আছে।’ কিছুক্ষণের জন্য একটু দিতে বলল। আর্মির লোকটাকে দাঁড়াতে বলে আমি ছেলেটাকে নিয়ে সারভেন্ট কোয়ার্টারে গেলাম।

ছেলেটাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও-বাড়িতে কারা এসেছে? সে বলল, ‘আমাদের বেগম সাহেব।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে তোদের বেগম সাহেব?’ সে বলল, ‘বেগম সাহেব হচ্ছে শেখ সাহেবের স্ত্রী বেগম মুজিব।’ আমি তাড়াতাড়ি তাকে মেশিনটা দিয়ে ঘরে চলে এলাম। আমার স্বামী তখন বাড়ি ফেরেনি। আমি অস্থির এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

জাফর সাহেব বাড়ি ফিরতেই আমি বললাম, ‘পাশের বাড়িতে বেগম মুজিবকে এনে রেখেছে এবং সঙ্গে তার ছেলেমেয়েরা।’ জাফর সাহেব বললেন, ‘আমরা তাহলে এখান থেকে যাব না। তাদের বিপদে-আপদে আমরা হয়তো কিছু করতে পারব। এখন থেকে চলে যাওয়ার কথা ভাববে না।’

পরদিন শেখ সাহেবের ড্রাইভার আমার বাসায় এলো একটা ফোন করতে। অবশ্য সঙ্গে আর্মির একজন ছিল। তার কাছে জানলাম, তাদের গৃহবন্দি করে রেখেছে। শুধু শেখ কামাল পালিয়ে বেঁচেছে আর সবাই আছে ওখানে।

জাফর সাহেবকে বলাতে তিনি আবারো বললেন, ‘আমাদের কোথাও যাওয়া হবে না। তাঁদের প্রয়োজনে আমরা হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারব।’

পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে একজন সাদা পোশাকে ছিল। তার কথাবার্তা অন্যরকম ছিল। জাফর সাহেব পাঞ্জাবি ভাষা বলতে এবং বুঝতে পারতেন। আমি অবশ্য কিছুই বুঝতাম না। আমি শুধু ইংরেজি এবং বাংলা জানি।

শেখ হাসিনার এক চাচাতো ভাই যাকে আর্মির লোকে ড্রাইভার ভাবত, সে আমার বাসায় এসে প্রায়ই ফোন করত এবং খবরাখবর নিত ও দিত। আমিও তাঁর কাছ থেকে জানতাম, তাঁরা কেমন আছেন ইত্যাদি।

সাধারণ পোশাক পরা আর্মির লোকটা দেখতে অনেকটা বাঙালির মতো। সে প্রায় সময় আসত ফোন করতে এবং বাইরের খবর নিত। টেলিফোনে জানত কত লোক মরেছে ইত্যাদি। খতম হয়েছে মানে বাঙালি মরেছে আর শহীদ হয়েছে মানে পাকিস্তানি লোক মরেছে। অবশ্য সব কথা বুঝতে পারতাম না।

আমাদের বলা হয়, কেউ যেন সন্ধের পর আপনাদের বাড়িতে না আসে। যদি আসে তাহলে গুলি করতে বাধ্য হবে তারা। সেই মতো আমরাও সবাইকে বলে দিলাম আমাদের বাড়ি না আসতে।

একদিন ছুটির দিনে আমার স্বামী এবং আমি একসঙ্গে বেরোচ্ছি। হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে একজন আর্মি গাড়িতে যেতে চাইল। জাফর সাহেব দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে দিলেন। আমি ভয় পেলাম এবং বাংলায় বললাম, ‘ওকে ওঠালে?’ তিনি বললেন, ‘চুপ করো।’ আমরা Science Laboratory-র কাছে পৌঁছাতেই জাফর সাহেব তাকে নেমে যেতে বললেন। লোকটা তাড়াতাড়ি নেমে গেল। অবশ্য কথা হচ্ছিল পাঞ্জাবি ভাষায়। আমি শান্তি পেলাম।

তখন ধানমন্ডিতে কোনো রিকশা চলাচল করছিল না। বিশেষ করে আমাদের বাসার কাছাকাছি। আমার অফিসের গাড়ি এসে আমাকে নিয়ে যেত এবং বিকেলে ফেরত দিয়ে যেত।

আমি হেঁটে হেঁটে খালাম্মার বাসায় যেতাম। ফিরতে একটু রাত হতো। কিন্তু আমি ভয় পেতাম না।

আমার ছেলে এবং ওর বন্ধুবান্ধব সবাই কলকাতার পথে চলে গেছে। অবশ্য তাদের কোনো খবর জানতাম না। কোথায় আছে কেমন আছে জানি না। লুলু ও টুলুও চলে গেছে।

একদিন মাঠে ঘুরছি তখন ওপাশ থেকে শেখ রাসেল ওদের কাজের ছেলেটাকে বলছে, ‘বল আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।’ কিন্তু ছেলেটা বলছে না। শেখ রাসেল বলেই চলেছে, ‘বল, আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।’ তখন ছেলেটা মিনমিন করে বলছে। আমি খুব ভয় পেলাম যদি আর্মি গুলি করে।

প্রত্যেকদিনই খবর আসছে ওকে ধরে নিয়ে গেছে, ওকে মেরে ফেলেছে। মনটা অস্থির।

একদিন খবর পেলাম জাফর সাহেবের বন্ধু আইনজীবী আহাদ সাহেবকে আর্মি নিয়ে গেছে। তিনদিন পর তিনি বাসায় এসে জাফর সাহেবকে ফোন করলেন এবং কথা বললেন। যাক তিনি ফিরে এসেছেন শুনে ভালো লাগল। জাফর সাহেব এবং শেখ সাহেব তাঁর বাসায় মাঝে মাঝে যেতেন। তাঁরা গান শুনতেন। তাঁর প্রচুর গানের রেকর্ড ছিল। কিন্তু পরদিন তাঁকে  নিয়ে আর্মি হত্যা করে। খুবই খারাপ লাগছিল।

জাফর সাহেব অভিযোগ নামে একটি প্যামফ্লেট ছাপালেন। সেই কাগজটা তাঁকে পাঠানোর সময় আর্মির কাছে ধরা পড়ে। সমকাল অফিসে একজন ফোন করে জানাল, ‘জাফর ভাই, আপনি পালান। আপনাকে আর্মিরা ধরতে যাচ্ছে।’ তিনি আমাকে অন্য অফিস থেকে ফোন করে জানালেন, ‘আমি চলে যাচ্ছি, গাড়ির চাবি দিয়ে যাচ্ছি, যা হয় ব্যবস্থা করবে। তুমিও পালিয়ে যাবে।’

একদম একা হয়ে পড়লাম, মনটা অস্থির। কাজের ছেলেটাকে বললাম, ‘সাহেব আজ বাসায় ফিরবে না, অন্য বাসায় গেছেন।’

পরদিন সমকাল অফিসে গিয়ে কিছু কাগজপত্র নিয়ে এলাম। গাড়িটা আমার অফিসে নিয়ে রাখলাম। শুনলাম, আর্মি সমকাল অফিসে গিয়েছিল।

দুদিন পর ছিল রোববার। দুপুরে দেখি হঠাৎ আর্মি আমার বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে। এক কর্নেল সাহেব এসে লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে আমার ড্রইংরুমে ঢুকল। আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার স্বামী কোথায় আছে?’ আমি বললাম, ‘আমার স্বামী কোথায় আছে সেটা তোমরা ভালো জানো। আমার স্বামীর খবরের জন্য আমি অস্থির, তুমি আমাকে বিরক্ত করবে না।’ ‘Look lady, আমি দুদিন পর আবার আসব তোমার স্বামীর খবর নিতে।’ আমি বললাম, ‘যদি আমার স্বামীর খবর নিয়ে আসো তাহলে আসবে, তা না হলে আসবে না।’

কর্নেল যাওয়ার পর হঠাৎ দেখলাম আমাদের ড্রেসিংরুমে তিনটা বন্দুক ঝুলছে। ভাগ্যিস আমাদের বেডরুমে আসেনি। পরদিন বন্দুক সব আমার অফিসের টেবিলের নিচে রেখে দিলাম।

এখন বাড়িতে একা। নানান চিন্তায় অস্থির। অফিস থেকে ফিরে কিছুক্ষণের মধ্যেই আর্মির দুটো লোক এসে সোফায় বসে টিভি দেখতে থাকে, হাতে তাদের স্টেনগান। তারা আমার টেলিফোন ব্যবহার করত। যেহেতু ওরা পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলত তাই আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না। আর্মি অন্য পাশের খালি বাড়িতে জিনিসপত্র নিয়ে যেত।

আর্মি আমার সবজি বাগান থেকে তরকারি চুরি করে নিয়ে যেত। আমার কাজের ছেলেটা আমাকে বলাতে তাদের আমি বললাম, ‘কেন তোমরা আমার বাগান থেকে তরকারি নিয়ে যাও।’  ওরা শুধু বলল, ‘মাপ কিজিয়ে বেগম সাহেব।’

একদিন হঠাৎ রাত দশটায় আলতাফ মাহমুদ বেল বাজাচ্ছে। আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি তালা খুলে আলতাফ মাহমুদকে ঘরে নিয়ে এলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার? আর্মি বারণ করেছে সন্ধের পর যেন কেউ না আসে। এলে গুলি করবে।’ আলতাফ ভাই রেগে গিয়ে বললেন, ‘কিছু খাবার থাকলে দেন, তা নাহলে আমি এক্ষুনি গেস্টরুমে শুয়ে পড়ব।’

আমি তাড়াতাড়ি ঘরে যা ছিল তা-ই দিয়ে খেতে দিলাম। তিনি খেয়ে শুতে গেলেন এবং বললেন, ‘কাউকে বলবেন না যে আমি এখানে এসেছি।’

যথারীতি আমি ভোরে অফিসে চলে গেলাম তখনো তার ঘর বন্ধ ছিল। আমার বাসার কাজের লোকের কাছে শুনেছি, আলতাফ ভাই চা খেয়ে চলে গেছেন। কয়েকদিন পর আলতাফ ভাইয়ের সঙ্গে সেগুনবাগিচার মোড়ে দেখা। আমি বললাম, ‘আলতাফ ভাই, এখনো ওপারে যাননি?’ আলতাফ ভাই আমাকে একটা ধমক দিয়ে বললেন, ‘শুধু ওপারে যাও আর ওপারে যাও। এখানে কোনো কাজ নেই?’ সেটাই ছিল আলতাফ ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আর দেখা হয়নি। আলতাফ ভাই আমার বাসায় বসে কত গানের সুর দিয়েছেন। জাফর সাহেব বলতেন কেমন হয়েছে কী হবে ইত্যাদি।

কিছুদিন পর শুনলাম আলতাফ ভাইকে আর্মি ধরে নিয়ে গেছে। মনটা অস্থির। খালাম্মা আর আমি ভাবি আর আলোচনা করি।

খালাম্মার বাড়িতে চাল, ডাল, টাকা-পয়সা জমা হতো। এসব সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন প্রফেসর গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। ভদ্রলোক লুঙ্গি পরে গামছা মাথায় দিয়ে আসতেন। আমিও অনেক টাকা-পয়সা জোগাড় করে দিয়েছি। সব ওপারের লোকজনের জন্য পাঠানো হতো। পরে অবশ্য সেই ভদ্রলোককে আল বদর মেরে ফেলে।

আমি রোজই ভাবতাম আজ আমার শেষ দিন। আমাকে একটা গুলি করে মেরে শেষ করে দেবে। কিন্তু ওরা তা করছে না। একদিন রাত তিনটায় পাক আর্মি আমার বেল বাজাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন এতো রাতে বেল বাজাচ্ছ?’ ওরা বলল, ‘বেগম সাহেব এক জরুরি টেলিফোন।’ ভাবলাম হয়তো বেগম মুজিবের কোনো দরকারি খবর আছে। আমি দরজা খুলে আসতে দিলাম। ওরা ওদের খবর লেনদেন করল। ফোন করে মাফ চাইতে চাইতে ওরা চলে গেল।

কিছুদিন পর শেখ জামালও বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। আর্মি এসে আমাকে বলতে লাগল, শেখ জামাল তোমার বাড়ির এদিক দিয়ে গেছে, তোমার বাড়ির ওদিক দিয়ে গেছে ইত্যাদি। আমি অসহ্য হয়ে বললাম, ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ, তোমরা বলছ না যে, শেখ জামালকে পালিয়ে যেতে আমি সাহায্য করেছি।’ তারা বলল, ‘বেগম সাহেব অ্যাইছা মাত বলিয়ে।’ আমি পরে অবশ্য খবর পেয়েছিলাম, শেখ জামাল ভালোভাবেই ওপারে চলে গেছে।

এর মধ্যে আমার ছেলের নামে একটা চিঠি এলো আমেরিকাতে এক কলেজে তার ভর্তি হয়েছে। তাকে এখন আমেরিকা যেতে হবে। আমি কী করব ভেবে আমেরিকান কনস্যুলেটে গেলাম কাগজটা নিয়ে কী করা যায় এবং কী করতে হবে। এ-কাজের জন্য নিয়োজিত এক আমেরিকান ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করলাম।

তিনি বললেন, ‘তোমার ছেলে কোথায়?’ আমি বললাম, ‘আমার ছেলে কলকাতায় গেছে।’ তিনি বললেন, ‘এখন এ ব্যাপারে আমার কিছু করণীয় নেই, তুমি যেতে পার।’

আমি বাইরে এসে সোফায় বসে কাঁদছিলাম। এ সময় Consulate General-এর সেক্রেটারি ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে তোমার?’ আমি তাঁকে ঘটনাটা বললাম। আমাকে নিয়ে তিনি সেই অফিসারের কাছে গেলেন এবং বললেন, ‘শুনুন আমি কিছুই জানতে চাই না, শুধু জানব তাঁর ছেলে আমেরিকা চলে গেছে।’ ভদ্রলোক তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘কলকাতার ফোন-ঠিকানা থাকলে আমাকে বলুন, আমি চেষ্টা করব।’ আমি আমার বাড়ির ঠিকানা দিলাম। যদিও তখন আমি কোনো খবর পাইনি ছেলের। মহিলা আমেরিকার কলেজে ডলার পাঠাতে বললেন এবং তিনি ডলার দিয়ে দিলেন। যাক আমেরিকা থেকে ছেলের ফোন পেয়ে আমি নিশ্চিন্ত হলাম।

একদিন আমার কাজের ছেলেকে পাঠালাম একটা ঝুড়িতে বোতল নিয়ে কোক আনতে। মাঠে কাজ করছিল মালি, তাকে বললাম, ‘কাজের ছেলেটা এলে তুমি বাড়ি যেও।’ এই বলে আমি খালাম্মার বাসায় গেলাম। ফিরে এসে দেখি মালিটা বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার তুমি এখনো যাওনি।’ সে বলল, ‘কাজের ছেলেটা ফেরেনি তাই বসে আছি।’ আমি ঘরে ঢুকে তাকে বললাম, ‘তুমি বাড়ি যাও।’ খুবই চিন্তা হচ্ছিল।

যথারীতি আর্মির লোকরা এলো। ওদেরকে কিছু বললাম না। সাদা পোশাক পরা লোকটা জিজ্ঞেস করল, ‘নকর কোই হায়?’ আমি বললাম, ‘দোকানে গেছে, এক্ষুনি ফিরবে।’

সেই রাতে প্রায় ১২টায় ফোন এলো। আমি ধরতেই লোকটা বলল, ‘আপনার স্বামীকে ফোন দিন। আমি পাকিস্তানি পুলিশ বলছি।’ আমি বললাম, ‘আমার স্বামী এখন বাথরুমে, আপনি আমাকে বলতে পারেন।’ কথা হচ্ছিল ইংরেজিতেই। তখন সে বলল, ‘আপনার চাকর আবদুল এখন কোথায়?’ আমি বললাম, ‘আবদুল কোক আনতে গিয়ে এখনো ফিরে আসেনি।’ সে বলল, ‘আমার এখানেই আবদুল আছে, তুমি এসে নিয়ে যাও। আমি বাড্ডা পুলিশ ক্যাম্পে আছি।’ আমি বললাম, ‘তুমি জানো না এখন কারফিউ চলছে? বাইরে যাওয়া যাবে না।’ সে বলল, ‘ঠিক আছে, কাল সকালে এসে নিয়ে যেও।’ আমি বললাম, ‘তুমি এসে ওকে দিয়ে যেও, কারণ সকালে আমার অফিস, আমি যেতে পারব না। একটু সকাল সকাল আসবে।’

পরদিন খুব ভোরে সেই পুলিশ ভদ্রলোক এলো, কিন্তু একা। কোকের বোতল এবং ঝুড়িটা ছিল সঙ্গে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আবদুল কোথায়?’ পুলিশটা বলল, ‘ছেলেটা ভালো ছিল না তাই তাকে খতম করে দিয়েছি।’ মনটা খারাপ হয়ে গেল। পুলিশকে আসতে দেখে পাশের বাড়ি থেকে আর্মি চলে এলো। ওরা পাঞ্জাবিতে কথা বলছিল, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

শেখ সাহেবের লোক এসে ফোন করত, ভালো লাগত। অবশ্য ড. ওয়াজেদ প্রায়ই খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু আর্মি লোকেরা এসে বসে যখন টেলিভিশন দেখতে থাকত তখন খুবই অসহ্য লাগত। তাই একদিন টেলিভিশন বিক্রি করে দিলাম। আর্মির ভয়ে কাজের লোকও আসতে চায় না। কী করব বুঝতে পারছি না।

এর মধ্যে একদিন দেখি আর্মির গাড়ি এসে বেগম মুজিবকে নিয়ে গেল। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন বেগম মুজিবকে গাড়িতে নিয়ে গেল?’ তারা বলল, ‘বেগম মুজিবের শ্বশুর অসুস্থ, হাসপাতালে আছেন। তাই তাঁকে দেখতে নিয়ে গেল।’ আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ম্যাডাম, আপনি যাবেন?’ আমি বললাম, ‘না, আমি যাব না।’

একদিন আমার বাসায় ফোন এলো শেখ হাসিনাকে লেবার রুমে নিয়ে গেছে। আমি খবরটা পাঠালাম। শেখ সাহেবের লোক এসে নানা জায়গায় ফোন করল; কিন্তু বেগম মুজিব যাওয়ার অনুমতি পেলেন না। এরপর খবর এলো, শেখ হাসিনার ছেলে হয়েছে। আমি সেই খবরটা পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু তারপরও যাওয়ার অনুমতি পেল না। অনেক জায়গায় ফোন করা হলো। কিন্তু যাওয়ার অনুমতি পেল না।

বেগম মুজিব সারারাত কাঁদলেন। তাঁর কান্না শুনে আমার মন খারাপ লাগছিল। ঘুম এলো না। ইচ্ছা হচ্ছিল দৌড়ে তাঁর কাছে যাই। কিন্তু উপায় নেই।

পরদিন ভোরে, নাশতা খেয়েই খালাম্মার কাছে গিয়ে বললাম বেগম মুজিবের সারারাত কান্নার কথা। খালাম্মা বললেন, ‘বউমা, আমি রেডি হয়ে আসছি, তুমি আর আমি যাব হাসপাতালে।’

আমরা দুজনে রওনা হলাম হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। পথে রুপার চামচ কিনে নিলাম হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে।

হাসপাতালে শেখ হাসিনার রুমে আর্মি পাহারা দিচ্ছিল। আমাদের যেতে বাধা দিচ্ছিল। খালাম্মা তাদের এক ধাক্কা দিয়ে ঢুকে গেলেন। আমাকে যেতে দিলো না। বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলাম শেখ হাসিনা এবং খালাম্মা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।

খালাম্মা ছেলেকে দেখে বললেন, ‘বউমা, দেখ কী সুন্দর ছেলে হয়েছে!’ আমি দরজার কাছ থেকেই দেখলাম।

ফেরার পথে খালাম্মা বললেন, ‘বউমা, তুমি বেগম মুজিবকে বলে পাঠাও তারা ভালো আছে, আমরা দেখে এসেছি।’

পরদিন বেগম মুজিব আমাদের জন্য মিষ্টি পাঠালেন।

নভেম্বর মাসে বাঙালিরা যুদ্ধ আরম্ভ করে দিয়েছে। আর্মি টেলিফোনে বলতে থাকে, ‘এতনা শহীদ হুয়া’, তখন বুঝি তারা মরেছে আর যখন বলতে থাকে, ‘এতনা খতম হুয়া’, তখন মনটা খারাপ লাগে। অবশ্য তাদের শহীদ হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। আমার ভালো লাগে।

এর মধ্যে একজন ফোন করে বললেন, ‘বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে হলি ফ্যামিলি আর রাখতে চাইছে না। আপনি আপনার বাসায় নিয়ে যান।’ তারাও জানে না আমি কী অবস্থায় আছি। আমার বাড়িতে কাউকে আনার প্রশ্নই ওঠে না। আমি বললাম, ‘আমি দেখছি কী ব্যবস্থা করতে পারি।’

তখন বিজনেস অ্যান্ড প্রফেশনাল ক্লাবের হোস্টেল তৈরি হয়েছে; কিন্তু দেশের এই আন্দোলনের জন্য শুরু হয়নি। আমি ভাবলাম, ওই হোস্টেলে রাখা যেতে পারে। আমি চিন্তা করে একবার হোস্টেল দেখে এলাম। দারোয়ান পালিয়ে গেছে; কিন্তু একটা পিয়ন আছে। তবে তাদের ওখানে রাখা যেতে পারে। আমি ভাবলাম, যদি আমি যাই তাদের সঙ্গে তাহলে অসুবিধা হবে না। আমিও অবশ্য একা বাসায় থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। তাই আমি হোস্টেলে চলে এলাম এবং বাসন্তীদিও তাঁর মেয়ে মেঘনা গুহঠাকুরতাকে নিয়ে হোস্টেলে এলেন। তখন মেঘনা অল্পবয়সী। আমার কিছু জিনিসপত্র, চেয়ার-টেবিল ইত্যাদি নিয়ে এলাম।

এক আর্মি আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’ আমি বললাম, ‘আমার আত্মীয়দের বাড়ি।’ আমি তাকে বললাম, ‘এখন যুদ্ধ লাগে না?’ সে বলল, ‘আমি যেদিন এখান থেকে চলে যাব, সেদিন যুদ্ধ লাগবে।’

আমি হোস্টেলে চলে এলাম। বাসন্তীদিকেও নিয়ে এলাম। হোস্টেলে এসে একজন কাজের মেয়ে পেলাম যে রান্নাসহ সবই করবে।

তখন বেইলি রোডে তেমন দোকানপাট ছিল না। একটামাত্র দোকান ছিল। রাস্তাঘাট খালি। আর্মি চলাচল করছে। পাশের বাড়িতে গাইড হাউস; কিন্তু গন্ডগোলের জন্য কেউ ছিল না। প্রায়ই কারফিউ চলছিল। তাই খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা হচ্ছিল।

যথারীতি অফিসে যেতাম এবং অফিস থেকে খালাম্মার বাড়ি। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য দেখা করেই হোস্টেলে চলে আসতাম।

এর মধ্যে খালাম্মার বড় জামাইকে (জনাব কাহার) কারা গুলি করে মেরেছে। তাই খালাম্মা খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। মেয়ে থাকে চট্টগ্রামে, খালাম্মা যেতেও পারছেন না। আমিও নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।

যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বাঙালিরা যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে আসছে। হোস্টেলের পিয়ন তারা মিয়া এবং নতুন একজন দারোয়ান আমাদের দেখাশোনা করছে।

এর মধ্যে এক শনিবার আমার অফিসে TOEFL এবং GRE পরীক্ষা নেওয়ার কথা। এই পরীক্ষা আমাকে conduct করতে হয়। যেহেতু প্লেন চলাচল বন্ধ তাই পরীক্ষার কাগজপত্র আসা সম্ভব হলো না। অনেকেই পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন। আমি বললাম, ‘পরীক্ষা হবে না।’ সবাই আমাকে খুব বকাবকি করছিলেন। তারা সবাই বলছিলেন, ‘আপনি আমাদের সমস্যা বুঝতে পারছেন না। আমাদের পরীক্ষা না হলে আমরা ভর্তি হতে পারব না। আমাদের এখন চলে যাওয়া বিশেষ প্রয়োজন।’

আমি রুম থেকে চলে আসছিলাম, তখন আমার রুমে বোমা ফাটল। শব্দ শুনে দেখতে গেলাম। আমার বস হেনরি বলছেন, ‘নার্গিস, আর ইউ দেয়ার?’ আমি পেছন থেকে বললাম, ‘আই এম  হেয়ার।’ সঙ্গে সঙ্গে মি. হেনরি আমাকে দেখে খুশিতে হেসে উঠলেন। ‘গড হেলপ করেছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’ আমরা খুব হাসলাম।

যুদ্ধ চলছে। আমরা ঘরে আটকা পড়ে আছি। শুধু প্লেন চলাচল দেখছি। ভাবছি, কী হবে?

তিনদিনেই যুদ্ধ শেষ। আমরা জিতে গেছি। বাঙালিরা জয় করে নিয়েছে। আমরা আনন্দে আত্মহারা। যদিও যাঁদের হারিয়েছি  চোখে তাঁদের ছবি ভেসে উঠল। আনন্দ এবং কান্নাভরা দিন। বাসন্তীদি তাঁর স্বামীর কথা ভাবছেন।

আজ পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডার করবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তাই আমি ও বাসন্তীদি তাঁর মেয়েকে নিয়ে রওনা হলাম সারেন্ডার দেখব বলে। দেখতে হবে এই উৎসব। সারারাত আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে ঢাকা শহরের সমস্ত রাস্তায়। শুধু আনন্দ আর আনন্দ।

আমরা হেঁটেই রওনা হলাম। যখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে পৌঁছলাম তখন দেখলাম পাকিস্তান আর্মি মার্চ করে বন্দুক হাতে নিয়ে ময়দানের দিকে যাচ্ছে। আমাদের দেশের ছেলেরা তখন তাদেরকে নানারকম কথা বলছে, ‘কেমন হলো, কী জবাব’ ইত্যাদি। হঠাৎ পাকিস্তান আর্মির কয়েকজন তাদের দিকে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করল। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই ইন্ডিয়ান আর্মি সব কন্ট্রোল করল। আমরা ভয়ে হোটেলে ঢুকে পড়লাম। এক আমেরিকান ভদ্রলোকের গায়ে বন্দুকের গুলি লাগে। ভদ্রলোককে আমিও চিনি এবং বাসন্তীদির খুব পরিচিত। আমরা তাঁকে হোটেলের ফার্স্ট এইড দিতে নিয়ে গেলাম। শান্ত হলো অবস্থা; কিন্তু আমাদের সারেন্ডার দেখা হলো না। আমেরিকান ভদ্রলোক বাসন্তীদির সঙ্গে তার দিনগুলো নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ভদ্রলোক বাসন্তীদিতে বললেন, ‘আপনি আমার বাড়ি চলুন। আপনি এবং আপনার মেয়ে ভালো থাকবেন।’

অবস্থা শান্ত হলে ভদ্রলোক বাসন্তীদিকে এবং তাঁর মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি একটা রিকশা নিয়ে আমার বাড়ির দিকে রওনা হলাম দেখতে সেখানের অবস্থা কেমন। ভাবলাম, আজ বেগম মুজিবকে দেখব ভালো করে। রাস্তায় বেশ কয়েকটা মৃতদেহ দেখতে পেলাম।

আমার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই কিছু লোক চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওদিকে যাবেন না, আপনাকে গুলি করবে।’ দূর থেকে দেখলাম আর্মি ওখানে পাহারা দিচ্ছে। আমি রিকশাকে  বললাম ৩২নং রোডে যেতে। আমি খালাম্মার বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

আমি ৩২নং রোডের ব্রিজের কাছে পৌঁছতেই ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও-বাড়ির খবর কী?’ আমি বললাম, ‘এখনও পাকিস্তানি আর্মি ওখানে আছে। যে কেউ ওখান দিয়ে গেলেই তাকে গুলি করছে। মনে হচ্ছে এখনো সারেন্ডারের খবর পায়নি।’ তিনিও খুব দুশ্চিন্তায় পড়লেন। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান আর্মির একটা গাড়ি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। ডা. ওয়াজেদ গাড়িটাকে থামিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বললেন। আমাকে অনুরোধ করলেন, ‘আপনি আমার দাদাশ্বশুর এবং শাশুড়িকে একটু বলে আসুন বেগম মুজিব এবং তার ছেলেমেয়েরা ভালো আছেন। তাঁরা খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন। আমি আর্মিদের সঙ্গে দেখা করতে বেগম মুজিবের কাছে যাচ্ছি।’

আমি তাঁদের সঙ্গে দেখা করে খালাম্মার ওখানে এলাম। খালাম্মা শুধু কাঁদছেন। আমি বললাম, ‘খালাম্মা, পাকিস্তান আর্মি আজ সারেন্ডার করছে, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।’

খালাম্মা বললেন, ‘জানো বউমা আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ভাবতে পারো কত প্রাণ গেছে। আলতাফ মাহমুদকে আর্মি অনেক যন্ত্রণা দিয়ে মেরেছে।’ সব কথা শুনে অবশ্য কষ্ট হচ্ছে তবু আমরা বাংলাদেশ পেলাম। অবশ্য আমার শ্বশুরবাড়ি সাতক্ষীরাতে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।

দুদিন পর বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম; কিন্তু মানুষের ভিড়ে বেগম মুজিবের দেখা পেলাম না। এত ভিড় বলা যায় না। দেখা হলো না।

আজ ১০ জানুয়ারি, শেখ মুজিব দেশে ফিরে আসছেন। ঢাকা শহর লোকে লোকারণ্য। আমি বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। দেখি তিনি বসে সুপারি কাটছেন এবং পান বানানোর সরঞ্জাম নিয়ে বসে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাবি, কেমন আছেন, কেমন লাগছে?’ তিনি মুচকি হাসলেন, কিছুই বললেন না।

আমাদের হোস্টেলের পাশের বাড়িটা ছিল ‘অল পাকিস্তান ও উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনে’র বাড়ি। দুদিন পর হঠাৎ দেখলাম কিছু দুষ্টলোক ওদের গাড়ির জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। আমি তারা মিয়াকে দিয়ে একটা গাড়ি আমাদের হোস্টেলে নিয়ে এলাম। আমি আর তারা মিয়া দুজনে মিলে লিখলাম ‘বাংলাদেশ মহিলা সমিতি’। এই লেখাটা টানিয়ে দিলাম।