এক অর্থবিজ্ঞানীর স্মরণে

হারাধন গাঙ্গুলী

প্র

থিতযশ অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন, যিনি কৃষি অর্থনীতিবিদ হিসেবেও একটি পরিচয় বহন করেন, তাঁর জীবনীগ্রন্থ বেরিয়েছে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। লেখক আসাদুজ্জামান গ্রন্থটির নাম দিয়েছেন সংবর্তন। লেখকের দাবি, সংবর্তন শব্দটি বাংলায় নতুন। যার মানে হচ্ছে, লেখকের ভাষায়, মেঘায়নের প্রক্রিয়া। যার পরিণতি বৃষ্টি। আর এই বৃষ্টি থেকেই ফসল। ড. মাহবুব হোসেনের যাপিত জীবন সংবর্তনের উপাখ্যান। মানবিকতা, পরিশ্রম, সততা ও কর্মনিষ্ঠায় মানুষের জীবনে ভূমিকা রেখেছেন ড. মাহবুব। মাটি ও মানুষের এবং মৃত্তিকাসংলগ্ন থেকে উঠে এসে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রকৃষ্ট বিবেচনায় নজর কেড়েছিলেন। লেখকের মতে, তাই তিনি সংবর্তন।

গ্রন্থটি সম্পর্কে সবচেয়ে যে-বিষয়টি দৃষ্টি কাড়ে তা হলো এর রচনাশৈলী। বইটি স্মৃতিচারণা। তবে সাধারণ চল হচ্ছে, যাঁর আত্মস্মৃতি তিনিই লেখেন। শুধু তাঁর নিজের জবানিতে বলে যাওয়ার পাশাপাশি উত্তম পুরুষে নিজের সম্পর্কেই কেবল বর্ণনা রয়েছে এখানে। বিষয়বস্তু উপস্থাপনার ধরনে একে অনুস্মৃতি নয়, বরং বলা যায় এক জীবনোপন্যাস এবং যা কয়েক বছরের গবেষণার ফসল।

আমি বলব, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই বইখানি অভিনব এবং এ-ধরনের গবেষণামূলক কাজ আগে হয়েছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। বইটির ভাষা উপন্যাসের আর সারফল গবেষণার নির্যাসের।

গ্রন্থটি রচনার পুরো সময় জুড়েই প্রয়াত ড. মাহবুব হোসেন দিয়েছেন দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি গবেষক সহকর্মী আর স্বজনদের অনেকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ও পূরিত প্রশ্নসমূহের ভিত্তিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের উন্নয়ন গবেষণা আর অর্থনীতির নানা দিকের বিস্তীর্ণ এক পরিসর। সঙ্গে এসেছে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার পটভূমি আর ব্যক্তিজীবন, সঙ্গে সমাজ আর সমাজতত্ত্ব। শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো এশিয়ার কৃষাণ-কৃষাণী, কৃষি ও কৃষক, নারী ও সমাজ, বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র এবং যে-তিনটি প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেছেন তাতে তাঁর ভূমিকার পাশাপাশি একেবারে খোলনলচেসহ উঠে এসেছে সমকালীন সবকটি বিষয়। তাঁর অন্তর্গত জীবনের সঙ্গে সঙ্গে জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই বাংলাদেশ আর মুক্তিযুদ্ধ থেকে দেশটার গড়েপিঠে ওঠার পুরো ইতিহাস।

অদ্ভুত এক আকর্ষণে পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে গ্রন্থটি। ফলে ড. মাহবুব পরিপূর্ণভাবে পাঠকের কাছে ধরা দেবেন, যা তাঁর জীবদ্দশায় হয়ে ওঠেনি। এদিক থেকে লেখককে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। ড. মাহবুব সম্পর্কে অন্যের বয়ান নিতে তিনি লেখককে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। যে-কারণে তাঁকে বুঝতে এবং তাঁর আমৃত্যু পারিপার্শ্বিকতাকে বুঝতে পাঠককে কোনো শূন্যতার জটাজালে পড়তে হবে না।

সাধারণত দেখা গেছে, ড. মাহবুবের সমকালীন অথবা চল্লিশ ও পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে জন্মগ্রহণকারী মুসলিম অর্থনীতিবিদরা পারিবারিকভাবেই আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল ছিলেন। ব্যতিক্রম ড. মাহবুব। তিনি প্রান্তিক বর্গের মানুষ ছিলেন। বাবা স্কুলশিক্ষক। নিজে স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। প্রাইভেট টিউশনি করেছেন। সেখান থেকে উঠে তিনি ক্যামব্রিজে গেছেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান থেকে শুরু করে স্টিফেন সি জোনস থেকে স্ত্রী পারভীন হোসেনের তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য ড. মাহবুবের বৌদ্ধিক অবস্থান বুঝতে পাঠককে সাহায্য করবে। তিনি ছিলেন এক দুর্ধর্ষ মেধাবী অর্থনীতিবিদ।

কোনো সৃষ্টিই হারায় না। কালের প্রেক্ষায় ও পটে আরো উজ্জ্বল, শানিত ও ধারালো হয়। এই বইটি সে-সূত্রগুলো ধরিয়ে দেবে। আমি মনে করি, এই বইয়ের মাধ্যমে পাঠক জানতে পারবেন এবং অভিযোজিত করতে পারবেন। লেখকের সাফল্য এখানেই। তাঁর অসাধ্য পরিশ্রমের জন্যে তাঁকে আবারো ধন্যবাদ জানাই। প্রকৃত অর্থেই এটি একটি অভিনব গ্রন্থ। বইটি প্রকাশ করেছে ভাষাচিত্র।