এক মনীষার তথ্যসমগ্র

মাসুদ রহমান

 

কাজী আবদুল ওদুদ : জীবনদর্শন ও সাহিত্যসাধনা

 

সাইফুল আলম

 

কথাপ্রকাশ

ঢাকা, ২০১৪

 

৬০০ টাকা

 

 

অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কাজী আবদুল ওদুদ জাতিতে ভারতীয়, ভাষায় বাঙালি, ধর্মে মুসলমান, জীবনদর্শনে মানবিকবাদী, মতবাদে রামমোহনপন্থী, সাহিত্যে গ্যেটে ও রবীন্দ্রপন্থী, রাজনীতিতে গান্ধী ও নেহরুপন্থী, অর্থনৈতিক শ্রেণীবিভাগে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, সামাজিক ধ্যানধারণায় ভিক্টোরিয়ান লিবারল।’ এই বক্তব্য বিশাল ও অনন্য এক মনীষা সম্পর্কে ধারণা দেয়। অনন্যতা শনাক্ত করতে গেলে এভাবে ছাঁকনিতে ঢেলে ব্যক্তিত্বের পরিমাপ পূর্ণতা পায় না। তা সত্ত্বেও প্রতিতুলনার তাৎপর্য থাকে। তাই কাজী আবদুল ওদুদের (১৮৯৪-১৯৭০) চিন্তা ও কর্মকে আরো দু-একজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যেমন তিনি নিজে পারসিক কবি সাদি, কামাল আতাতুর্ক, রমাঁ রলাঁ, হজরত মোহাম্মদের (দ.) কথা বলেছেন; তাঁকে (দ.) যেভাবে অনুভব করেছেন, ‘ধর্মে মুসলমান’ বললে তার সবটুকু বলা হয় না। রামমোহন-রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এ-চারজনের নাম ও কর্মের উল্লেখ করেছিলেন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠার প্রেরণা-উৎসের তালিকা দিতে গিয়ে। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের মন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’, স্লোগান ছিল – ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। আমাদের মনে পড়ছে, এ-ধরনের জ্ঞান ও যুক্তির মন্ত্রবাণী এদেশে উদাত্তকণ্ঠে প্রথম উচ্চারণ করেন ডিরোজিও ও তাঁর শিষ্যরা। এঁদের সঙ্গেই ওদুদ ও তাঁর সহযাত্রীদের ঐক্য বেশি করে লক্ষ করা যায়। ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ গঠিত হয়েছিল ১৯২৬ সালে, ‘ডিরোজিয়ান’দের আবির্ভাব ঠিক তার একশ বছর আগে, মানে ডিরোজিও যে-বছর হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন। ডিরোজিওর অধ্যাপনার ইতিহাস বাদ দিলে    এ-অঞ্চলের প্রথম মহাবিদ্যালয় হওয়া ছাড়া হিন্দু কলেজের আর কী এমন ঐতিহাসিক অবদান চিহ্নিত হতো? ডিরোজিও সেখানে চাকরি করতে পেরেছিলেন মাত্র ছয় বছর; ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র হইচই ফেলে দেওয়া শিখা মুখপত্রটির প্রকাশনাকাল ছয় বছর – পরের বছরতিনেক ঘরোয়া কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ থাকে। তবে দুদলই সমাজে তাৎক্ষণিক আলোড়ন তুলেছিল ও দূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। ডিরোজিওকে সত্য ও যুক্তিপূর্ণ কথনের কারণে ধর্ম এবং সংস্কারের শত্রু হিসেবে অভিযুক্ত করে কলেজ থেকে বিতাড়ন করা হয়। একই অভিযোগে প্রায় একই পরিণতি ঘটে ‘সাহিত্য-সমাজে’র কোনো কোনো কুশীলবের ভাগ্যে। নামকরণ কাকতালীয়ই হবে – ওদিকে ‘হিন্দু’ কলেজ, এদিকে ‘মুসলিম’ সাহিত্য-সমাজ; ধর্ম ও সমাজকে পুরোপুরি ডিঙোতে পারেননি ওই কালেজি কিংবা এই সাহিত্যিকরা। পরবর্তীকালে তো দুই দলের কারো কারো মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে পশ্চাদপসরণ লক্ষ করা যায়। অবশ্য স্থান-কালের ভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে সে-পরিবর্তনে মাত্রাগত প্রভিন্নতা কিছু ছিলই।

ওদুদের মধ্যে পরিবর্তন বা বিবর্তনের ব্যাপারটি কেমন হয়েছে? আবারো একটু তুলনায় যাবো। উপমান বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।  যে-বছর বাংলা তথা ভারতীয় উপন্যাসের এই পথিকৃৎ মারা যান, সে-বছরই বাঙালি মুসলমানের উন্মেষপর্বের অন্যতম ঔপন্যাসিক ওদুদের জন্ম। সমকালে তো বটেই আজকের বাংলাদেশেও কোনো কোনো মুসলমানের মধ্যে বঙ্কিমবিদ্বেষ দেখা যাবে। ওদুদ               সর্বত্র-সর্বার্থে বঙ্কিমবিমুখ। উপন্যাসরচনার কারণে সাহিত্যসম্রাট উপাধিপ্রাপ্ত বঙ্কিম পরবর্তীকালে গীতার ভাষ্য রচনা করেন, শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রের সংগতিবিধান করে কালোপযোগিতা প্রচার করেন। ওদুদ এই শিল্পী ও সনাতনী বঙ্কিমের মধ্যে জীবনভাবনার, দেশচেতনার, স্বজাতিপ্রীতির ধারাবাহিকতা ও সমন্বয় আবিষ্কার করেছিলেন। ওদুদকেও কি আমরা সেভাবে দেখতে পারি? ওদুদ অবশ্য প্রথমত তিন মহান ব্যক্তির জীবনী রচনাকে নিজ জীবনের শেষ প্রার্থিত কর্ম হিসেবে মনস্থ করেছিলেন। তাঁরা হলেন গ্যেটে, রবীন্দ্রনাথ ও মোহাম্মদ (দ.)। তবে মহানবীর জীবনী লিখতে গিয়ে অতিরিক্ত হিসেবে কোরআনের অনুবাদ সম্পন্ন করলেন – এটাও ওদুদ-মানস বোঝার জন্যে অনুভববেদ্য বিষয়। উল্লেখ্য, রাসুলুল্লাহর (সা.) জীবনের কোনো কোনো বিষয় নিয়ে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে যে-প্রশ্ন আছে এবং বিরুদ্ধপরে প্রচারণা আছে, সেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়ার কাজটি ওদুদ আগেও করেছেন। তবে ডিরোজিয়ানদের মতো এখানেও বঙ্কিমের সঙ্গে ওদুদের মাত্রাগত প্রভেদ অবশ্যই আছে। সেসব দূরত্ব ও নৈকট্য মিলিয়েই ওদুদের যে-জীবন, ভাবনা ও কর্ম এবং তার সমকালীন প্রতিক্রিয়া ও উত্তরকালীন অনুভাব তা বাংলাদেশ ও বাঙালি মুসলমানের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, বিকৃতি ও বিবর্তনের ধারাকে ধারণ করেছে তাতে সন্দেহ নেই।

ভারতবর্ষ (চৈত্র ১৩২৩) পত্রিকায় শরৎচন্দ্রের বিরাজ-বৌ উপন্যাসের আলোচনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাহিত্যজগতে ওদুদের প্রবেশ। সমঝদার সাহিত্য-সমালোচকের আগমন দেখেছিল তখনকার পাঠকসমাজ। কিন্তু ওদুদের প্রথম ও দ্বিতীয় বই সৃজনশীল সাহিত্য – প্রথমটি গল্পগ্রন্থ মীর-পরিবার (১৯১৮), দ্বিতীয়টি উপন্যাস নদীবক্ষে (১৯১৯)। গল্পগ্রন্থ শরৎচন্দ্র ও উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা পেয়েছিল। অর্থাৎ সাহিত্যচর্চার প্রথমপর্বে সম্ভাবনাময় একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন। তাঁর সাহিত্য-সমালোচক-সত্তা তারপরও বিকশিত হয়েছে। ওদুদ-রচিত রবীন্দ্রকাব্যপাঠ (১৩৩৪ ব.) পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে চিঠিতে লেখেন, ‘আমার রচনা এমন সরস বিচারপূর্ণ সমাদর আরো কারো হাতে লাভ করেছে বলে মনে পড়ে না।’ সমাজ ও সাহিত্য (১৩৪১ ব.) গ্রন্থের ‘রবীন্দ্রনাথের গান’ শীর্ষক প্রবন্ধ পড়ে আরেকটি পত্রে লিখেছিলেন, ‘সমালোচকদের মধ্যে আপনিই প্রথম সাহিত্যে এই লিরিকগুলির যথার্থ স্থান নির্দেশ করে দিয়েছেন সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ।’ তবে রবীন্দ্রবিষয়ক ওদুদের শ্রেষ্ঠতম কাজটি বেরিয়েছে আরো পরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ (প্রথম খন্ড, ১৩৬৯ ব.) নামে। এর মাঝে নজরুল প্রতিভা (১৯৪৯) নামে যে ক্ষীণকায় গ্রন্থ রচনা করেন সেটিও নজরুল-চর্চায় বিশিষ্ট বই বলে স্বীকৃত। গালিব, ইকবাল, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, মীর মশাররফ প্রমুখ সাহিত্যিক ও তাঁদের শিল্পকর্ম নিয়ে বেশকিছু প্রবন্ধ লিখেছেন – সেগুলো আয়তনে হ্রস্ব হলেও ‘সরস ও বিচারপূর্ণ’।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৫ সালে আবদুল ওদুদকে যে  নিজাম-বক্তৃতা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান তার বিষয় ছিল  ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ’। কারণ এরই মধ্যে বাংলা-ভারতের যে-সমস্যা সবচেয়ে জটিল ও সংবেদনশীল অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সে-প্রসঙ্গে চিন্তা ও উপস্থাপনায় ওদুদ নিজেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। বাঙালি মুসলমানের পশ্চাৎপদতা তখন এতটাই নিদারুণ ছিল এবং এ-অঞ্চলের দুই বৃহৎ ধর্মসম্প্রদায় ক্রমাগত এতটাই পরস্পরবিদ্বেষী হয়ে উঠছিল যে, ওদুদের মতো সামাজিক দায়বোধসম্পনণ মানুষের পক্ষে শুধু সৃজনশীল সাহিত্যচর্চায় মগ্ন থাকা সম্ভব ছিল না। এবং ওদুদ নিজেই লক্ষ করেন (যেমন, আজাদ প্রসঙ্গে) তাঁর সৃজনসাহিত্য যথোচিত রস-সংস্থানের বিপরীতে তত্ত্বভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। সমাজ ও সম্প্রদায়ের নানা সমস্যার আশু ও স্থায়ী সমাধান খুঁজতে, মিলনের মনোভাব গড়ে তুলতে মননশীল সাহিত্যচর্চাকেই জরুরি বিবেচনা করেছিলেন তিনি। তাই আজ কাজী আবদুল ওদুদের প্রধান পরিচয় একজন প্রগতিশীল যুক্তিবাদী চিন্তক হিসেবে। ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র অন্যান্য লেখককেও, যেমন মোতাহের হোসেন চৌধুরী বা আবুল ফজল, এমনিভাবে সৃজনশীল সাহিত্যের অঙ্গন ছেড়ে প্রবন্ধের ক্ষেত্রে বিচরণ করতে দেখি। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতাকেন্দ্রিক রেনেসাঁসের কালেও এমনটি দেখেছি – রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ সৃষ্টিশীল সাহিত্যচর্চা ছেড়ে যুক্তি ও মননশীলতাকে পরিচর্যা করে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখায় আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তাই সৃজনশীল সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল খানিক পরে ওই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে।

ওদুদকে ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র ‘ভাবযোগী’ বলা হয়ে থাকে। সংগঠনের বাইরে বা ধর্মপরিচয় ছাড়িয়ে বাঙালির চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রগণ্য। সাম্প্রদায়িক-সংস্কারাচ্ছন্ন গোষ্ঠীর কাছে তিনি সেকালে কিংবা একালেও নেতিবাচকভাবে মূল্যায়িত হতে পারেন, কিন্তু মনোযোগ হারাননি কোনোকালেই। ইতিপূর্বে দুই বাংলা থেকে তাঁর একাধিক জীবনী ও মূল্যায়ন-সংকলন বেরিয়েছে। এখনো পত্রপত্রিকায় তাঁকে নিয়ে কমবেশি আলোচনা হতে দেখি। এ সবকিছুই যে একজন প্রাবন্ধিক ও চিন্তক হিসেবে, ব্যাপারটা কিছুটা বিস্ময়ানন্দেরই বটে। তাঁর সাহিত্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য বলেই যে এটা হচ্ছে এমনটা আমরা মনে করি না। প্রকৃত কারণ, আজকের দিনেও তাঁর চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিককালে গ্রন্থিত ওদুদ-সম্পর্কিত একটি বই আমাদের হাতে এসেছে। গ্রন্থটির নাম কাজী আবদুল ওদুদ : জীবনদর্শন ও সাহিত্যসাধনা। লেখক সাইফুল আলম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনায় যুক্ত। এটি মূলত তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভ যা প্রণয়ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ-ডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। চারটি অধ্যায়ে পর্যবেক্ষণসমূহ উপস্থাপিত। এগুলোর শিরোনাম : ‘জীবনকথা, মানসগঠন ও রচনা পরিচিতি’, ‘জীবনদর্শনের সূত্রসমূহ’, ‘কথাসাহিত্য ও নাটক’ এবং ‘প্রবন্ধ’। এরপর ‘উপসংহার’ টেনেছেন; দিয়েছেন ‘গ্রন্থপঞ্জি’। ‘পরিশিষ্ট’ অংশে রয়েছে ‘জীবনপঞ্জি’। প্রসঙ্গানুক্রমে অধ্যায়মধ্যে উপ-শিরোনাম দিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়েছেন, প্রয়োজনে পরিচ্ছেদ বিভাজন করেছেন।

প্রথম অধ্যায়ে নানা উপশিরোনামে লেখক ওদুদের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনচিত্র অঙ্কনের প্রয়াস পেয়েছেন। লেখকের দাবি, ‘বিজ্ঞানসম্মত মূল্যায়নের প্রয়োজনে কাজী আবদুল ওদুদের জীবনকথা, মানসগঠন ও রচনা পরিচিতি’ চারটি পর্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ওদুদ নিজে নজরুল-প্রতিভার পরিচয় দিতে গিয়ে চারটি স্তরে বিন্যস্ত করে আলোচনা করেছিলেন এবং সেই স্তরভেদের কারণ বা সীমানা শুরুতেই ব্যাখ্যা করেছিলেন। সাইফুল সেটা করেননি। তাই তাঁর পর্যায়-বিন্যাসের মানদন্ড নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। মনে হয় প্রথম পর্যায় প্রবেশিকা পাশ অবধি, দ্বিতীয় স্তর অবশিষ্ট শিক্ষাজীবন, তৃতীয় পর্যায় কর্মজীবনের শুরু থেকে; কিন্তু তাঁর শেষ বা চতুর্থ পর্যায়ের শুরু কেন ১৯৪১ সাল সে-সম্পর্কে আমরা কোনো সূত্র পেলাম না। অথচ এই পর্যায়টি ওদুদের ছিয়াত্তর বছরের জীবনের তিন দশকব্যাপী। ‘চতুর্থ পর্যায় : ১৯৪১-১৯৭০’ উপ-শিরোনামে আলোচনার প্রথম তিন বাক্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যর্থতা ও ভাষা-আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনেছেন, কিন্তু তার সঙ্গে ১৯৪১ সালের সম্পর্ক স্পষ্ট হলো না। ওদুদের আজকার কথা গ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯৪১ – এটাই কি সূত্র? কিন্তু তা যুক্তিপূর্ণ হয় না ওদুদের সমগ্র রচনা বিবেচনায়। পর্যায় নির্ধারণের কারণ নিয়ে আমরা প্রথমাবধিই বিভ্রান্ত। ‘প্রথম পর্যায় : ১৮৯৪-১৯১৩’ উপ-শিরোনামাঙ্কিত বিভাগে দেশ-কালের কথা নেই; শুরুতেই সাল-তারিখ অনুল্লেখ রেখেই জানিয়ে দিলেন – ‘কাজী আবদুল ওদুদের জন্ম হয় তৎকালীন নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার কুমারখালী থানার অন্তর্গত জগন্নাথপুর গ্রামে।’ এই জন্মস্থান সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন নুরুল আমিন-গৃহীত ওদুদের ছোটবোন সুফিয়া খাতুনের সাক্ষাৎকার থেকে। ওদুদের জন্মগ্রাম নিয়ে আরো দাবি আছে। গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী কাজী মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে জেনেছেন, ওদুদের জন্মস্থান কুমারখালীর হোগলা গ্রাম, যেটি জগন্নাথপুরের নিকটস্থ। ওদুদ নিজে অবশ্য লিখেছেন তাঁর জন্মস্থান ফরিদপুর। ওদুদের প্রথম জীবনীকার আবদুল কাদির ফরিদপুরের এ-জন্মস্থান বাগমারা গ্রাম বলে জানিয়েছেন। এ-অবস্থায় জগন্নাথপুরের দাবির সত্যতা সম্পর্কে নিঃসংশয় হওয়া গেল কীভাবে তা সাইফুল খোলাসা করেননি। আবার ওদুদের বিবাহের তারিখের ক্ষেত্রে তিনি মোহাম্মদ ইদ্রিস আলীর পরিবর্তে আবদুল কাদিরের তথ্য ‘গ্রহণযোগ্য বিবেচনা’ করেছেন সম্ভবত কাদির সাহেব ‘ওদুদের ভাবশিষ্য’ বলে। ওদুদচর্চার ধারাবাহিকতায় বিদ্যায়তনিক এই গবেষণাকর্মে এসব বিতর্কের অবসান কাঙ্ক্ষিত ছিল।

‘জীবনদর্শনের সূত্রসমূহ’ সংশ্লিষ্ট গবেষণার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং গবেষক এখানে তাঁর সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘সমাজচিন্তা’, ‘সংস্কৃতিচেতনা’, ‘রাজনীতিভাবনা’, ‘ধর্মচিন্তা’ ও ‘সাহিত্যাদর্শ’ শিরোনামে পাঁচটি পরিচ্ছেদে ওদুদের চিন্তাচেতনার স্বরূপ যুক্তি ও স্বচ্ছতার সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। তবে এখানে ওদুদের সৃজনশীল সাহিত্য থেকেও সাক্ষ্য নেওয়া যেত। প্রসঙ্গক্রমে লেখক কিন্তু কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ উপন্যাস থেকে সমকালীন সমাজমানসের তথ্য উদ্ধার করেছেন। ওদুদের পরবর্তীকালের নাটক-উপন্যাস তো একেবারেই জীবন-দার্শনিক ওদুদের কথামালা।

অবশ্য তৃতীয় অধ্যায়ে ‘ছোটগল্প’, ‘উপন্যাস’ ও ‘নাটক’ শিরোনামে পরিচ্ছেদ বিভাজন করে আলোচনা করার সময় লেখক সেগুলো থেকে সমকালীন সমাজচিত্র ও ওদুদমানস উন্মোচন করেছেন। এগুলোর শিল্পবিচারও নির্মোহভাবেই সম্পন্ন করেছেন। তবে ছোটগল্পের আলোচনার সমাপ্তিতে তিনি যে বলেছেন, ‘কাজী আবদুল ওদুদের গল্পে শৈল্পিক নিরাসক্তি না থাকলেও বিষয়ের গৌরবে তা স্বতন্ত্র’ (পৃ ১৭৮) – এখানে ‘শৈল্পিক নিরাসক্তি’ বিষয়টি বোধগম্য নয়, বাক্যশেষে অন্বয়ও রতি হলো না। এ-পর্যায়ে মনে পড়ছে, শিশিরকুমার দাশ বা আরো কারো কারো ছোটগল্পের ইতিহাসধর্মী রচনায় ওদুদ উল্লিখিত হয়েছেন গুরুত্বসহকারে, সেসব তথ্য এখানে উপস্থাপিত হলে ছোটগল্পকার হিসেবে ওদুদের যে একটি ঐতিহাসিক অবস্থান ছিল, তা শনাক্ত করা যেত। ঔপন্যাসিক ওদুদকে অবশ্য লেখক সেই পরিপ্রেক্ষিতে চিহ্নিত করে আলোচনাটি পূর্ণাঙ্গ করেছেন।

মননশীল লেখক ওদুদের প্রবন্ধ-সংকলন কুড়িটির কাছাকাছি। এগুলো থেকে গবেষক পাঁচটি গ্রন্থ নির্বাচন করে পাঁচ পরিচ্ছেদে ‘প্রবন্ধ’ অধ্যায়ের আলোচনা সেরেছেন। গ্রন্থগুলো একক বিষয়ের ওপর রচিত; নামেই প্রসঙ্গগুলো বিধৃত। যথা : কবিগুরু গ্যেটে, বাংলার জাগরণ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ও তারপর এবং নজরুল প্রতিভা। ওদুদের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধগ্রন্থরাজির তালিকায় হয়তো এ-কয়টি স্থান পাবে; কিন্তু সেক্ষেত্রে বাদ পড়ে গেল কয়েকটি আলোচিত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ। বিশেষ করে ‘নন-কো-অপারেশন, বা অসহযোগিতা’, ‘সম্মোহিত মুসলমান’, ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ’, ‘ইসলামে রাষ্ট্রের ভিত্তি’, ‘সংস্কৃতির কথা’ ইত্যাদির কথা বলা যায়। আমাদের মনে হয়, ওদুদ নিজে তাঁর শ্রেষ্ঠ খন্ডপ্রবন্ধ নিয়ে যে-সংকলন করেছিলেন শাশ্বত বঙ্গ নামে, সেটি এ-অধ্যায়ে আলোচিত হতে পারত। পরবর্তী সংস্করণকালে লেখক ব্যাপারটি ভেবে দেখবেন। সে-সময় কিছু কিছু বিষয়ের পুনর্বিবেচনা ও সংস্কার আশা করি। উদাহরণ হিসেবে একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করি। বাংলার জাগরণ গ্রন্থের আলোচনায় লেখক বলেছেন, ‘রামমোহনের ধর্মনিরপেক্ষ উদারমানবতাবাদী জীবন উপলব্ধির মন্ত্র তাঁর [ওদুদ] কাছে ছিল পাথেয় স্বরূপ।’ (পৃ ২৮৭) নিঃসন্দেহে রামমোহনের যুগোপযোগী ভাবাদর্শ ওদুদকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু রামমোহনের চিন্তাকে কি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলা যাবে? আজকের পারিভাষিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি রামমোহনের অনেক পরে উদ্গত বলে প্রশ্নটি উঠছে না। রামমোহনের প্রধান পরিচয়ই তো ধর্মসংস্কারক হিসেবে; সে-সংস্কারের লক্ষ্য ছিল ধর্মসমন্বয় আর ফলাফল হলো একটি ধর্মমত ও অনুসারীসমাজের প্রতিষ্ঠা। তিনি ধর্মসমন্বয়ের মধ্য দিয়েই সমাজে বা রাষ্ট্রে শান্তি ও সদ্ভাব আনয়নের পথসন্ধান করেছিলেন। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসী ওদুদ যে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাভাবনা অনেকটাই ধারণ করেছিলেন তার প্রমাণ আছে – শুধু ‘ইসলামে রাষ্ট্রের ভিত্তি’ প্রবন্ধটি পাঠ করলেই এ-দাবির সত্যতা মিলবে।

দু-একটি ছোটখাটো অনবধানতার নজির মেলে বইটিতে। যেমন, ওদুদচর্চার খতিয়ানে জানা গেল, ওদুদ-জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশের দুটি পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। লেখক বলছেন, দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার ২৯ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ দুটো হলো মুস্তাফা নূরউল ইসলাম-রচিত ‘মুক্তবুদ্ধির কণ্ঠস্বর কাজী আবদুল ওদুদ স্মরণে’ এবং আবুল কাসেম ফজলুল হক-রচিত ‘চিন্তানায়ক কাজী আবদুল ওদুদ’ (পৃ ১৩)। বস্ত্তত ওই সংখ্যায় প্রবন্ধ ছিল তিনটি – অপরটি ছিল মাসুদ রহমান-লিখিত, ‘নদীবক্ষে’ সম্পর্কিত। লেখক ও লেখার গুরুত্বববিচারে প্রবন্ধটির উল্লেখ গবেষক নাও করতে পারেন, কিন্তু তাঁর বক্তব্যে মনে হয় সংখ্যাটিতে শুধু দুটি লেখাই ছিল। অনিবার্যভাবে কিছু মুদ্রণপ্রমাদ আছে বৃহদাকার এ-গ্রন্থে। ব্যক্তিনাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথাযথভাবে মুদ্রিত হয়নি, যা গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন, ৪৯৬-৯৭ পৃষ্ঠায় অজিতকুমার ঘোষ, অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ নামে অসংলগ্নতা ও ত্রুটি দেখা গেছে – এমন অন্যত্রও রয়েছে।

কিন্তু এসব বিচ্যুতি হয়তো সামান্যই। সমগ্র গ্রন্থে সাইফুল আলম তথ্য-সংগ্রহে তাঁর শ্রমের, প্রাপ্ত তথ্যোপকরণ বিচার-বিন্যাসে তাঁর মেধার, সিদ্ধান্তগ্রহণে বিচারবুদ্ধির প্রমাণ রেখেছেন। লেখক ক্যাডেট কলেজের সার্বক্ষণিক দায়িত্বকর্মের মধ্যে এতবড়ো একটি কাজ সম্পন্ন করে আন্তরিকতা ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। এ-ধরনের গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশের জন্যে ‘কথাপ্রকাশে’র স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনকে অভিনন্দন।

বস্ত্তত প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণাকর্মের কিছু সহজাত সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা থাকে। সে-হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটির প্রণয়ন-প্রকাশকে আমরা এভাবে বিবেচনা করি যে, ওদুদের জীবন, চিন্তা ও কর্মের প্রায় পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন এতদিনে উপস্থাপিত হলো। শিক্ষার্থী, গবেষকের কাছে বইটি প্রামাণিক-প্রয়োজনীয় আকর হিসেবে বিবেচিত হবে। এখন এটিকে ভিত্তি ও ব্যবহার করে রচিত হতে পারে ওদুদের রসপূর্ণ জীবনী। ওদুদ নিজেই যার নমুনা দেখিয়েছেন কবিগুরু গ্যেটে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে। সাইফুল আলম ইতোমধ্যে ওদুদের কিশোরপাঠ্য জীবনী লিখেছেন। কাজেই আমরা এ-ব্যাপারে তাঁর ওপরই ভরসা রাখছি।