এখনো রহিল আঁধার

চন্দন আনোয়ার

আমার এক পা, নইলে জারজ দুইটারে ঠিকই ধরে ফেলতাম… কেবল একবারই বজ্রগর্জনের মতো হঠাৎ গর্জে ওঠে রিটায়ার্ড হিসাবরক্ষক এরফান আলী। এখন চরম শান্ত! আঘাত খাওয়া নির্বিষ অসহায় প্রাণীর মতো মাথা ফেলে দিয়ে অথবা নিচের দিকে ঝুঁকে মিজানের রকমারি টি-স্টলের এক পা ভাঙা পঙ্গু বেঞ্চিটার ওপরে বসে আছে। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একঝলক জ্বলেই নিভে যাওয়ায় অথবা চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলায় অথবা বাস্তব মূল্য না থাকায় এরফান আলীর ক্রোধাগ্নির আঁচ বা উত্তাপ কাউকে স্পর্শ করেনি, অথবা গুরুত্বহীন ভেবে কেউ এদিকে মনোযোগ দেয়নি। পঙ্গুত্বের নিদারুণ অসহায়ত্বও ফুটে উঠেছে এরফান আলীর চোখে-মুখে। ভারী একটি দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর থেকে টেনে বের করার সময় বুকের খাঁচা উঠে আসে থুঁতনি পর্যন্ত। তখন মাথা উঁচু করে একবার দেখার চেষ্টা করে চা-স্টলের সামনে উপস্থিত যুবকদের চোখে-মুখে সকালের সোনালি রোদ পড়েছে। এর মধ্যে দুই যুবক চোখে-মুখে বিরক্ত আর অস্বস্তি নিয়ে সূর্যের দিকে তাকায়; রোদ থেকে বাঁচার জন্য মিজানের চা-স্টলের ছাউনির এক হাত ছায়ার মধ্যে শরীরে শরীরে ঠেকিয়ে সাপের মতো বাঁকা-ত্যাড়া হয়ে দাঁড়ায়; এবং নববর্ষের সকালে চাঁদ-তারাখচিত সবুজ ছায়ার জন্য প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। রোদকে উদ্দেশ করে পরপর দুবার লাথি মারে দুই যুবক। রোদে লাথি মারার সময় যুবকদের চোখে চোখ পড়লে স্বেচ্ছায় নুয়ে আসে এরফান আলীর মাথা। হা-ডু-ডু খেলার ডিস্ট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন এবং এককালের দাপুটে অ্যাথলেটিকস এরফান আলীর মন-শরীরে অবসাদ আর হতাশা ভর করে করে হঠাৎ জিন-ভূত আছর করানোর মতো। ছেলে দুটির চোখে-মুখে ভয়ানক বিরক্তি আর নববর্ষের সকালের সোনালি রোদে লাথি মারার দৃশ্য এরফান আলীর মন-শরীরে হঠাৎ অবসাদ আর নৈরাশ্য ডেকে আনে। এরকম হঠাৎ অবসাদ আর নৈরাশ্যের আক্রমণের ঘটনা খুব ঘনঘন ঘটছে। এখন এরফান আলীর মন-শরীর দুটিই পতনমুখী। বসলে বা হাঁটলে কেবলি নুয়ে আসে মাথাটা, এমন অনেকদিনই যাচ্ছে, মাথা উঁচু করে পূর্ণ আকাশটাকে দেখা হয় না। পঁয়ষট্টি বছর বয়স এখন। এ-বয়সে এভাবে খেলুড়ে শরীর ভেঙে পড়ার কারণ খুঁজে পায় না। সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা হারিয়েছে বাইশ বছর আগে, শরীরে একটি অঙ্গের কেবল অভাব, কিন্তু কখনোই দেহ-মনে শক্তির অভাব বোধ করেনি।

নববর্ষের দিন, ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে শহরটা চক্কর মেরে মিজানের রকমারি টি-স্টলে এক কাপ চা খেয়ে ঘরে ফিরবে বলে ছোট-বড় বহু মানুষ ভিড় করেছে, ফলে বেশ হট্টগোল। প্রাতঃভ্রমণ শেষে মিজানের রকমারি টি-স্টলে বসে বর্ষীয়ানরা। শরীরের ঘাম-ক্লান্তি দূর করে চিনিমুক্ত আদা চায়ের সঙ্গে নোনতা বিস্কুট খেয়ে এবং সকালের গল্প-আড্ডার উপসংহার টেনে নিজ নিজ বাড়ি ফেরার সময় বর্ষীয়ান মানুষগুলোর চোখে-মুখে চিরন্তন বিদায়ের একটি রেখাচিহ্ন ফুটে ওঠে। এখন সূর্যাসেত্মর কাল, কার জীবন-সূর্য কখন ডুববে কে জানে! কাল ভোরে প্রাতঃভ্রমণে দেখ হয় কিনা কে বলবে!

পঙ্গু বেঞ্চটাসহ মাত্র তিনটি বেঞ্চই আছে মিজানের রকমারি টি-স্টলের অভ্যন্তরে, সম্মুখে বিশ-পঁচিশজন দাঁড়ানোর মতো ফাঁকা জায়গা। চা-পিপাসু যুবকরা সচরাচর বসে না। এরফান আলীর মতো প্রবীণরাই বসে। এর মধ্যে দুই বা তিন বা চারজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রম্নপে জমে উঠেছে নববর্ষের আলাপ-বিতর্ক। এবারের নতুন বছরটা কেমন যাবে? আইপিএলে সাকিব-মুস্তাফিজরা কেমন খেলবে? পাকিস্তান টিম শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে খেলতে আসবে তো, খেলাবিষয়ক বিতর্কের মধ্যে মাশরাফিভক্ত এক তরুণ ক্রোধের কণ্ঠে বলে, ষড়যন্ত্র! বড় এক ষড়যন্ত্র! বিরাট এক মাফিয়াচক্র এর মধ্যে লুকিয়ে আছে! ইচ্ছা করে মাশরাফি টি-টুয়েন্টি খেলা ছেড়েছে! আমার বিশ্বাস হয় না। ফের ন্যাশনাল ইলেকশন সামনে, রাজনীতির মাঠে এখন গরম-ঠান্ডা হাওয়া, জোট জোট খেলা শুরু হয়ে গেছে, ঘুমিয়ে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো আড়মোড়া দিচ্ছে, জেগে ওঠার আভাস, নড়েচড়ে উঠছে সরকারি দল। রাজনীতিবিষয়ক শান্ত বিতর্কে অস্বস্তি প্রকাশ করে টাকমাথার মধ্যবয়সী এক স্কুলটিচার, ফাঁড়া! জাতির জন্য ফের আর একটি ফাঁড়া! একটা ইলেকশন আসে, আর একশ বছর করে পিছিয়ে পড়ছি আমরা! ডেমোক্রেসি, ইলেকশন এসব আমাদের রক্তেই নেই। স্বৈরতন্ত্র-সামরিকতন্ত্রের মুগুরেই আমরা ঠান্ডা! আমরা শান্ত-সন্তুষ্ট! রাজনীতি নিয়ে স্কুলটিচারের বিরক্তির প্রকাশের সুযোগকে ব্যবহার করে এতক্ষণ ধরে বুকের ভেতরে হাত-পা বেঁধে কোনো প্রকারে রাখা কথাটি বলে ফেলে একগাল হেসে ওঠে এক মধ্যবয়সী, শেষ পর্যন্ত ইলিশ একখান পেয়েছিলাম ভাই, ওজনে মাত্র ৬০০ গ্রাম, কিন্তু দাম নিল পাক্কা এক হাজার! স্বস্তির একটি লম্বা শ্বাস ফেলে বলে, কপালটা ভালো, নইলে বউ-সন্তানদের কাছে মুখ দেখাতে পারতাম না, ওদের মনটাও ছোট হয়ে যেত। এর মধ্যেও টাকমাথার স্কুলটিচার অস্বস্তি প্রকাশ করে, পহেলা বৈশাখে হাজার টাকা দাম দিয়ে পান্তা-ইলিশ খেতেই হবে! ইলিশ বিলাসিতা আর কি! এদেশে কত মানুষ… বাক্য শেষ করতে পারেনি, ইলিশপ্রিয় মধ্যবয়সী লাফিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, আপনার সবকিছুতেই অস্বস্তি! অসহ্য! আপনার মার্কসবাদী থিওরি বুকসেলফে সাজিয়ে রাখুন গিয়ে। এদেশে এসব চলবে না। ক্ষমতাই আসল। ক্ষমতার পায়ের কাছে লেজ গুটিয়ে বিড়াল হয়ে সবাই বসে থাকে কাঁটার লোভে। বিতর্কের উত্তাপে পানি ঢেলে দিলো সম্মিলিত সাংস্কৃতিক সংগঠনের ওয়ার্ড সেক্রেটারি সুশান্ত বাবু। দেখেন ভাই, এই মহীয়সী নারীকে দেখেন, চুরাশি বছর বয়সী এই মানুষটাকে দেখেন, এখনো কত শক্ত-সাবলীলভাবে কথা বলছেন, উনার চোখের দিকে তাকান, যেন অগ্নিশিখা জ্বলছে, সমগ্র বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেই আলো ছড়িয়ে পড়ছে। এবার টাকমাথার স্কুলটিচারের চোখে-মুখে উজ্জ্বল আলো, স্বস্তির কণ্ঠে বলে, ঠিকই বলেছেন, উনি আমাদের জাতির আলোকবর্তিকাই বটে!

মিজানের রকমারি টি-স্টলের এক কোণে ঘুণেধরা একটি কাঠের ওপরে ষোলো ইঞ্চির একটি রঙিন টেলিভিশন, বহু বছরের পুরনো টেলিভিশনটির ওপরে মাকড়সার অসংখ্য জাল এবং একটি মাকড়সা জাল দিয়ে পর্দার কিছু অংশ দখল করে ফেলেছে। মাকড়সাটা সন্তর্পণে পা ফেলে ধীরে ধীরে মহীয়সী নারীর দ্যুতিময় মুখের ওপরে পা ফেলছে দেখে টাকমাথার স্কুলটিচার শত্রম্নর মুখে পড়া বাঘের মতো গর্জন করে ওঠে, মিজান! মাকড়সাটাকে ঠেকাও, ওকে এখনি গলাটিপে হত্যা করো, তোমার টেলিভিশনের পর্দা দখল করে নিল! টি-স্টলের ভেতর-বাইরের সবাই হতভম্ব স্কুলটিচারের চিৎকারের আকস্মিক আক্রমণে, তুচ্ছ মাকড়সা দেখে স্কুলটিচারের মতো একজন শান্ত-জ্ঞানী মধ্যবয়সী পুরুষ মানুষ এভাবে সিংহের মতো গর্জন করে উঠবে!

রমনার বটমূলের ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব লাইভ দেখাচ্ছে চ্যানেল আই। শত শত যুবক-যুবতী-মধ্যবয়সী, এমনকি দু-তিনজন প্রবীণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সুর ধরে গাইছে, এসো হে বৈশাখ এসো এসো। লালপেড়ে সাদা শাড়ি এবং শাড়ির ওপরে ঢোল-তবলা, হারমোনিয়াম, বাঁশি, একতারা ইত্যাদি দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের বাহারি ছাপছবি, কারো গলায় ফুলের মালা, কারো মাথায় ফুলের টোপর, কোমল হাতভর্তি চুড়ি। মধ্যমণি মহীয়সী বসে আছেন সারির মধ্যবর্তী স্থানে একটি হাতলওয়ালা চেয়ারে। উপস্থিত লাখো মানুষের আলোপিপাসু চোখের দৃষ্টি এখন একদিকেই, মহীয়সী নারীর দিকে। কিন্তু তার চোখ ঘুরে চতুর্দিকে, জেগে ওঠে স্মৃতি, কোথায় সেই তেরোশো সত্তর, আর কোথায় চোদ্দোশো চবিবশ! সেই রমনা বটমূল…। এখানে উপস্থিত নববইভাগই জন্মায়নি তখন, কিন্তু এরা এখন ছায়ানটের ছায়াতলে, শান্তি-মুক্তি-প্রগতির ছায়াতলে…

জনারণ্যজুড়ে হঠাৎ হিরণ্ময় নিস্তব্ধতা, নিঃশব্দে ধীরপায়ে এক এক করে নিচে নেমে এলো মঞ্চ-গায়কেরা, ওদের মুখে মুক্তোর দানার মতো জ্বলজ্বল করছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘামের ফোঁটা। উপস্থিতগণের মধ্যে নিশ্বাসরুদ্ধ চাপা উত্তেজনা, তাদের চোখের পাতা একটি লক্ষ্যবিন্দুর ওপরে স্থির, কেবল মহীয়সী নারীর জ্যোতির্ময় দুটি চোখ ফড়িঙের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে উপস্থিতগণের চোখে চোখে।

মঞ্চের পূর্বকোণ থেকে এক তরুণী নিঃশব্দে মঞ্চে উঠে আসে মাউথপিস হাতে নিয়ে। তরুণীর পরনে সদ্য ভাঁজভাঙা কারুকাজময় বৈশাখি শাড়ি, দুই পায়ে আলতামাখা, গলায় গাঁদাফুলের মালা, মেহেদিপরা দুই হাতে রঙিন কাচের গুচ্ছচুড়ি, মাথায় ফুলের টোপর, কোমর পর্যন্ত সিল্কিচুলের বেণি, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের খাঁটি বাঙালি তরুণী ছন্দে ছন্দে পা ফেলে যখন মঞ্চে ওঠে, তখন উপস্থিতগণের শৈশবস্মৃতিতে জেগে ওঠে পরির গল্প। মাউথপিসটি মহীয়সী নারীর হাতে তুলে দেওয়ার সময় তরুণীর হাতের রঙিন কাচের চুড়িগুলো বেজে ওঠে ঝনাৎ করে।

এখানে, এই রমনা বটমূলে, বাঙালি সংস্কৃতির পুণ্যস্থানে সশরীরে উপস্থিত বাঙালিগণ, ভরাটকণ্ঠে এ-কথাগুলো বলেই মহীয়সী নারী মুখ ফেরালেন টিভি ক্যামেরার দিকে, চোখের লক্ষ্যভেদী তীব্র আলোর ছায়া দূরদিগন্তস্পর্শী, চৌষট্টি হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র বাংলাদেশ শুধু নয়, পৃথিবীর যেখানেই বাঙালির বসতি, সর্বত্র শান্তি-মুক্তি-প্রগতির ছায়াদৃষ্টি ফেলে মহীয়সী ফের মুখ খোলেন, বাঙালি যে যেখানে আছেন সবাই আরো নিবিড় হয়ে আসুন, আরো ঘনবদ্ধ হোন, যুদ্ধমাঠে শত্রম্নর মুখোমুখি সৈনিকের মতো তীক্ষন তীব্র সতর্ক হোন, প্রত্যেকেই নিজ নিজ পাশের জনের হাত ধরুন, ফুলের মালার মতো হাতের সুতোয় গাঁথা হোক একটি বাঙালিত্বের মালা, আজ আমাদের শপথ নেওয়ার দিন, আসুন আমরা আবার শপথ নিই, আজ আমাদের আত্ম-আবিষ্কারের দিন, বাঙালিত্বের বিজয়ের দিন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের গর্বের দিন, আজ আমাদের জাতীয় চেতনা জেগে ওঠার দিন, আসুন, আমরা শহরে-গ্রামে, হিন্দু-মুসমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, আর উপজাতি মিলে সবার হৃদয়ে রাখিবন্ধনের উদ্যোগ নেই।

হঠাৎ মহীয়সী নারী গেয়ে উঠলেন, ‘এখনো গেল না আঁধার, এখনো রহিল বাঁধা’… এবং সমবেত কণ্ঠে একটিই সুর ওঠে, ‘এখনো গেল না আঁধার, এখনো রহিল বাঁধা…। আশ্চর্য, মিজানের রকমারি টি-স্টলের বসা-দাঁড়ানো সবাই মহীয়সী নারীর কণ্ঠে কণ্ঠ মেলায়, ‘এখনো গেল না আঁধার, এখনো রহিল বাঁধা…।’ কেবল কণ্ঠ মেলায়নি রোদে রোদে পদাঘাতকারী দুই যুবক। মহীয়সী নারীর ওপরে চরম বিরক্তি এবং ক্রোধমিশ্রিত বিদ্বেষের চোখে তাকায়। হাতের গরম চা মাটিতে ফেলে দিয়ে ক্রোধ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। মানিব্যাগ থেকে দশ টাকার নতুন একটি নোট বের করে বোমার মতো ছুড়ে মারে মিজানের দিকে। মহীয়সী নারীর গানে কণ্ঠ মিলিয়ে মিজান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে, এদিকে খেয়াল নেই। উড়ন্ত সাপের মতো কিছুক্ষণ বাতাসে উড়ে চা-তৈরির টিনের ট্রের ওপরে পড়ল দশ টাকার নোটটি। ভিজে গেল মুহূর্তেই। এবার দুই যুবক হেলমেট মাথায় দিয়ে নিজেদের কালো রঙের হোন্ডায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল এবং নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে আলাপে মশগুল হলো।

এর মধ্যেই সকালের সোনালি রোদ বাইরের জগৎ দখলে নিয়ে মিজানের রকমারি টি-স্টলের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে। দাঁড়ানো-বসা সবার চোখ-মুখ এখন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে রোদে। রোদে রোদে পদাঘাতকারী দুই যুবকের মাথার ওপরেও রোদ, কিন্তু হেলমেট মাথায় থাকায় রোদ ওদের চোখ-মুখ স্পর্শ করতে পারেনি। মহীয়সী নারীর কণ্ঠজাদুর মুগ্ধতার রেশ কাটেনি এখনো, মাথার ওপরের শান্তি-মুক্তি-প্রগতির ছায়া কাঁপিয়ে, সোনালি রোদ নাড়িয়ে ভোঁ-ভোঁ শব্দের কুৎসিত আওয়াজ তুলে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে রোদে পদাঘাতকারী দুই যুবকের কালো রঙের হোন্ডাটি লাফিয়ে উঠল, কিন্তু দৌড়াল না, খাঁচাবন্দি গর্জে ওঠা সিংহের গলাটিপে ধরার মতো হোন্ডাটির কণ্ঠ টিপে ধরে চালক যুবক, কালো শরীর একটি ঝাঁকি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল হোন্ডাটি। প্রগাঢ় শান্ত ও নিবিড় নীরবতার অখ-তা কাচের ঘরের মতো মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙে বহুখ- হয়ে গেল। চালু হয় কিনা এজন্য স্রেফ পরীক্ষা, এ রকম একটি ভাব নিয়ে হোন্ডার ওপরে বসেই নিজেদের মধ্যে আলাপেই মশগুল দুই যুবক। পেছনে বসা যুবকের পা-দুটি খর্বাকৃতির, মাটি সামান্য ছুঁই ছুঁই, মোরগের কেঁচো খোঁজার মতো পেছনের যুবকের পা-দুটি মাটি খোঁজে, হঠাৎ দু-একবার আঁচড়ও কাটা হয়।

রোদে পদাঘাতকারী দুই যুবকের হোন্ডার বিকট কুৎসিত শব্দ এরফান আলীর মগজের ভাঁজ ভেঙে দিলো। সব হোন্ডার শব্দই তো এক। এ-বয়সের যুবকরা এভাবেই হোন্ডায় স্টার্ট দেয়, শরীরে অফুরন্ত শক্তির মজুদ, ব্যয় তো করতে হবে। মহীয়সী নারীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে এরফান আলী কিছুক্ষণ ভুলে ছিল প্রত্যুষের ঘটনা।

সদ্যসমাপ্ত আজানের সুরমূর্ছনার শব্দতরঙ্গ তখনো বাতাসে, মৃদু অন্ধকার, নামাজ এবং নামাজ শেষে প্রাতঃভ্রমণ, দুই কাজের যৌথ প্রস্ত্ততি সম্পূর্ণ করে ঘুম ঘুম শরীর নিয়ে লম্বা একটি হাই তুলে শরীর মুচড়ে শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলে টিনের গেট সশব্দে খুলে যেই না বাইরে কাঠের ঠ্যাংটি ফেলেছে, তখনি দাঁড়িয়ে থাকা একটি হোন্ডা এরফান আলীর ঘুম-শ্রান্ত হৃৎপি- কাঁপিয়ে সকালের নিস্তব্ধতাকে এক কোপে দু-ফালি করে দিয়ে বিকট শব্দে চিৎকার করে ওঠে ক্ষুধার্ত দানবের মতো। ভয়-আতংকে এরফান আলীর শরীর কেঁপে ওঠে, যেন হঠাৎ দুর্ঘটনার মুখে পড়ে অপ্রস্ত্তত বা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই কে, কে তোমরা! এখানে কী করছ! এরফান আলীর কণ্ঠনালিতে কে যেন আন্ধাগিঁট মেরে দিয়েছে। হোন্ডার আরোহী দুই যুবক। কালো জিন্সের প্যান্ট পরিহিত দুই যুবকের ছায়াটাই দেখা যায়, পেছনের সিটের যুবক বসেছে পা-দুটি ব্যাঙের মতো ভাঁজিয়ে। হোন্ডার চাকার ঘূর্ণন শুরু হলে পেছনের যুবকের ছায়া তার ভাঁজ করা এক পা বন্দুকের মতো তাক করে এরফান আলীর দিকে, কুয়াশামিশ্রিত ভোরের বাতাসে লাথি মেরে হাঁটুর ভাঁজ পরীক্ষা করে, এবং বাতাসের বেগেই উধাও হয়। কণ্ঠনালিতে অসংখ্য আন্ধাগিঁট নিয়ে কিছু বলার জন্য এরফান আলীর আপ্রাণ প্রচেষ্টা নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়। মিনিটপাঁচেক বজ্রাহতের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকার পরে তাঁর কণ্ঠনালির আন্ধাগিঁট খোলে এবং আটকে থাকা বাক্যটি বেরিয়ে আসে, এই, কে, কে তোমরা? গেট দিয়ে বেরিয়ে দুই পা ফেলতেই হোঁচট খেল একটি টিনের কৌটার সঙ্গে। খালি কৌটা হাতে তুলে নেওয়ার পরেই পোড়া পেট্রলের গন্ধ নাকে ঝাপটা মারে। এরফান আলী আঁতকে ওঠে, শরীর এবার ঘামতে শুরু করে, যুবকরা কি আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিতে এসেছিল নাকি! কিন্তু কেন! তখনি চোখ পড়ে দেয়ালটির ওপরে, নববর্ষ উপলক্ষে ফুল-পাখি-মানুষ-বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্র, পিঠা ইত্যাদির ছবি এঁকেছিল স্কুলপড়ুয়া নাতি ও বন্ধুরা মিলে। যুবকরা ছবিগুলোর ওপরেই পেট্রল ছুড়েছে! ঘুম থেকে ওঠার পর নাতির মুখের অবয়ব কী হবে একথা ভেবে বিষাদে ভরে ওঠে মন।

ভিড়-ব্যস্ততার তীব্র চাপের মধ্যেও রেগুলার কাস্টমার, বিশেষত বর্ষীয়ানদের জন্য মিজান ঠিকই সময় বের করে, প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করে, কে কী চা খাবেন? অন্যদিনে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয় না। বছরের পয়লা দিন, একটু-আধটু অনিয়মে কিচ্ছুই হবে না, ঝটপট কইয়া ফেলেন কে কী চা খাইবেন? আংকেল, আজ মালটা চা দিই? নাকি কমলালেবুর চা, মিক্সচার চা, হরলিক্স চা,… চায়ের কাপের টুং-টাং শব্দ সংগীতের সুরমূর্ছনা তৈরি করেছে।

গভীর মনোযোগ দিয়ে মিজানের চা তৈরির ক্ষেপ্রতা এবং দক্ষতা পর্যবেক্ষণরত এবং কাপ-চামচের টুং-টাং সুরমূর্ছনা উপভোগরত। চা-পিপাসুদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে মিজান ভাই বলে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে স্থানীয় ন্যাশনাল ক্লাবের ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ছেলেটি। কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স পড়ে ছেলেটি, মোটাতাজা,
কৃষ্ণবর্ণ, মাথায় শচিন টেন্ডুলকারের মতো কোঁকড়ানো চুল এবং শচিন টেন্ডুলকারের মতো উচ্চতাবিশিষ্ট। দাঁড়িয়ে থাকা সবাই ছেলেটির মুখের দিকে তাকায়, মিজান ভাই, তুমি এ কী করলা! এত সুন্দর মাইয়াডার মুখে কালি মাখলা! কাপ-চামচের টুং-টাং শব্দের সুরমূর্ছনা তাল হারিয়ে ফেলে, মিজানের হাত কেঁপে ওঠে, অবিশ্বাসের চোখে তাকায় ছেলেটির দিকে, কী কও তুমি, কীয়ের কালি, কার মুখে কালি মাখছি! এতক্ষণে সবারই দৃষ্টি চলে গেছে রকমারি টি-স্টলের সাইনবোর্ডটার ওপরে। সারিবদ্ধভাবে লেখা বারো রঙে বারো রকমের চায়ের নাম ও মূল্য এবং পাশেই টগবগে লাল চাভর্তি সাদা রঙের এক কাপ হাতে নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে টাঙ্গাইলের শাড়ি পরিহিতা শ্যামবর্ণের তিরিশোর্ধ্ব এই গার্হস্থ্য মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষটির হাস্যোজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মুখটির ওপরে গাঢ় কালো কালির প্রলেপ, শরীরের নানা জায়গায় কালির আঁচড়।

রোদে পদাঘাতকারী দুই যুবক নিজেদের আলাপের ফাঁকে বেশ তাচ্ছিল্যের চোখে সাইনবোর্ডটির দিকে তাকায় এক পলক। ওদের ঠোঁটে ফুটে ওঠে তাচ্ছিল্যের হাসি।

চা তৈরির ব্যস্ততা আর ক্ষেপ্রতাকে সচল রেখেই মিজান বলে, কী হইছে! তোমরা কী পাইছ সাইনবোর্ডে! এই সাইনবোর্ড নতুন লাগাইছি নি! ঘাড়মোটা কালো সুঠামদেহী রাগী-স্বভাবের যুবক বোধহয় মিজানের কথায় অপমানই বোধ করে, পেশিবহুল কালো হাত দিয়ে হেঁচকা টানে পস্নাস্টিকের দড়ির হালকা বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে। সাইনবোর্ডটি এখন ওর হাতে ঝুলছে।

রোদে পদাঘাতকারী দুই যুবকের অর্ডারমতো আরো কড়া লিকারের দুই কাপ লেবু-চা দিয়েছে মিজান। লেবু-চায়ের ধোঁয়া ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে নিবিড় শান্ত মেজাজে চায়ে ঠোঁট স্পর্শ করার পূর্বে ফের আর একবার তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে ওদের ঠোঁটে, দশ-বারো জন যুবক মিলে একটা ছবির পেছনে লেগেছে! আহাম্মকের দল!

তুমুল বিতর্কের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, মেয়েমানুষটির মুখে কালিমা লেপন করেছে মিজান-ই! ওর দোকানের সাইনবোর্ডে ও ছাড়া আর কে হাত দেবে! এবার রাগী-স্বভাবের যুবক ক্ষেপ্রগতিতে ছুটে আসে মিজানের দিকে, এই দেখ, হারামি! তোর রকমারি টি-স্টলে যদি আমি আগুন ধরিয়ে না দিই তাহলে আমি মুক্তিযোদ্ধা রহমান আলীর ছেলেই না! এই মেয়েমানুষটার কী দোষ! বল শুনি, এই মেয়েমানুষটা তোর কী ক্ষতি করেছিল যে, আমার মার মতন দেখতে মেয়েমানুষটার মুখে তুই কালি মেখেছিস!

মেয়েমানুষটার দিকে একনজর তাকিয়ে মিজান হতভম্ভ, ওর হাত কেঁপে ওঠায় লেবু-চাভর্তি কাপ নিচে পড়ে গেল এবং একটি কাপ রাগী-স্বভাবের যুবকের ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপরে পড়লে ব্যথা এবং উফ্ করে লাফিয়ে ওঠে।

রাগী যুবক এবং ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ছেলেটির ধমকে তালবেতাল হারিয়ে ফেলে মিজান, মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে ফাঁকা বেঞ্চির ওপরে, হায় হায়! এই খারাপ কাজটা কে করল! কখন করল! আমি তো রাইত দুইটা পর্যন্ত দোকানই খোলা রাখছিলাম!

স্থাণু হয়ে বসে আছে আত্মমগ্ন এরফান আলী, হট্টগোলে মন নেই। প্রত্যুষের ঘটনায় ফের মন ভারাক্রান্ত। এ-দেশে এ কী করে সম্ভব! মুক্তিযুদ্ধ করে যে দেশ স্বাধীন, এ কী করে হয়! এরা বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেবে কিনা, দ্বিধা হয়। এখন যা বাস্তবতা, মুখ খুলে বললে ফের নিজের জন্য বিপদ ডেকে আনা হয় কিনা, জটিল ব্যাপার! ওরা তো শুধু দুজন নয়, সাঙ্গপাঙ্গ-সংগঠন… উফ্! প্রত্যুষের আলো-আঁধারী, তবু চোখে এড়ায়নি, নেহায়েত ছেলেমানুষি নয়! বেশ হৃষ্টপুষ্ট, উঁচা-লম্বা দেহাকৃতির প্রায় তিরিশ বা কাছাকাছি বয়সের শিক্ষিত যুবক। কমান্ডো স্টাইলে হোন্ডায় চড়ে নির্ভয়ে সশব্দে হোন্ডা চালিয়ে গেল। সবকিছুই পূর্বপরিকল্পিত। যুবকরা প্রশিক্ষিত তো বটেই। বুকটা ভারী ভারী ঠেকে, ষাটোর্ধ্ব বয়সী হৃদযন্ত্রের নিরাপত্তায় শঙ্কিত এরফান আলী এবার হট্টগোলের দিকে মন ফেরাল, নববর্ষের দিনেই যত্তসব অশুভ সংকেত পাচ্ছি!

যুবকদের ধমকে মিজানের অসহায়ত্ব এখন চরমে। হাতজোড় করে ক্ষমা চাইবে, তাও পারছে না। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় বিভ্রান্ত মিজানের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয় এরফান আলীর, কী করেছে মিজান? তোমরা সবাই ওকে রিমান্ডের মতো জেরা করছ!

ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ছেলেটি এরফান আলীর দিকে ছুটে আসে এবং মুখ বরাবর উঁচু করে ধরে সাইনবোর্ডটি, দ্যাখেন আংকেল, মেয়েমানুষটার মুখটা দ্যাখেন! হারামি করছেটা কী! আমার টিম নিয়ে এসে ওর চায়ের দোকান যদি না পুড়িয়ে দিছি তো… ছেলেটির খেলুড়ে শরীর কাঁপছে ভয়ানক ক্রোধে।

অ্যা! সর্বনাশ… বলে লাফিয়ে সাইনবোর্ডটি ধরতে গিয়েছিল এরফান আলী, এক ঠ্যাঙের অনুপস্থিতি এবং বিস্ময়ের প্রবল ধাক্কায় শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বড়শিগাঁথা মাছের খাবি খাওয়ার মতো খাবি খেয়ে সমগ্র শরীর নিয়ে লুটিয়ে পড়ল নিচে। রাগী-স্বভাবের যুবক এরফান আলীকে তোলার জন্য ধনুকের মতো বাঁকা হয়েছে কেবল, তখনি এক ছেলে চিৎকার করে ওঠে, আগুন! আগুন! ছেলেটির চিৎকারে রাগী-স্বভাবের যুবক এরফান আলীকে না উঠিয়েই সবিস্ময়ে উঠে দাঁড়ায়, দেখে, সত্যিই, মিজানের রকমারি চা-স্টলের দক্ষিণ কোণের বাঁশটির গোড়ায় ছোট্ট একটি আগুন সবেমাত্র সাপের মতো জিভ বের করেছে। ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে পা তুলে দিলো আগুনের ওপরে, ছোবলোদ্যত সাপের মাথায় পা ফেলে থেঁতলে ফেলার মতো পিষে ফেলতে ফেলতে ছেলেটি বলে, কোন হারামি এখানে জ্বলন্ত সিগারেট ফেলেছে রে! ইতোমধ্যে রোদে পদাঘাতকারী দুই যুবক এবং আরো কিছু যুবক চলে গেছে। এদেরই একজন কিংবা পথ দিয়ে কতজনই যাচ্ছে, যে কেউ ইচ্ছা করে অথবা বদভ্যাসে এই অপকর্মটি করতে পারে। নববর্ষের নিরাপত্তায় তটস্থ-তৎপর বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর একটি পিকআপ শিকারমুখো সিংহের মতো গর্জন করে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল মিজানের রকমারি টি-স্টলের সামনে দিয়ে। শহরে হাঁটা-চলায় পিকআপ ভ্যানের গর্জন শুনে অভ্যস্ত সবাই। গতকালই, জগদীশ স্বর্ণকারের মা লক্ষ্মী জুয়েলার্সের বিয়ালিস্নশ ভরি স্বর্ণ লুট হওয়ার পর শহরটা কেঁপে উঠেছিল অসংখ্য ক্ষমতাবান পিকআপ ভ্যান ও ক্রুদ্ধ হোন্ডার গর্জনে। কিন্তু এ-মুহূর্তে উপস্থিত প্রত্যেকেই অন্য এক ভয় আর আতংকের ফাঁদে পড়ে গেল। ছোট্ট করে হলেও অগ্নিকাণ্ডর ঘটনা ঘটেছে, বড় দুষ্কৃতির আলামত। নববর্ষ-উৎসবের দিন, বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী দুষ্কৃতকারীরা ওত পেতে আছে, কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কঠিন ব্যূহ ভেঙে সরকারকে-দেশকে বেকায়দায় ফেলতে। এ সময় সামান্য দুর্ঘটনা, এবং দুর্ঘটনার তিলার্ধ সম্ভাবনাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই দিনেই, রমনার বটমূলের রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনরত শিল্পী ও উপস্থিত সংগীতপ্রিয় শান্ত-নিরীহ বাঙালিদের ওপরে বোমা ফেলে বিপুল মানুষের দেহ-প্রাণ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।

দু-বার ব্যর্থ হয়, তৃতীয়বার স্বচেষ্টায় এক ঠ্যাঙের ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারায় বিজয়ের গৌরব ফুটে ওঠে এরফান আলীর কালো ফ্রেমের চশমাআঁটা চোখে। এই বিজয়দীপ্ত চোখে প্রথম চোখ পড়ে টাকমাথার স্কুলটিচারের, এই পঙ্গু মানুষটা এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাহ! এমনিই চাই, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি চাই, অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে বেঁচে থেকে কী লাভ! দেশও তাই, নিজের সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্যের ওপরে শক্ত পায়ে না দাঁড়ালে পঙ্গু মানুষের মতো দেশও পঙ্গু…

এক ঠ্যাঙের ওপরে ভর দিয়ে আছে এরফান আলী। তার শরীরের কাঁপন এখনো থামেনি। ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ছেলেটি বিজয়োল্লাসে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে ওঠে, আর্মি আংকেল, আপনি এতক্ষণ ধরে এক ঠ্যাঙের ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন! এবার সবারই দৃষ্টি পড়ে এরফান আলীর ওপরে। মিজান লাফিয়ে ওঠে, তাই তো! আর্মি আংকেল এক ঠ্যাঙের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে!

এ এক বড় বিস্ময় এরফান আলীর জন্যও, বাইশ বছর আগে এক ঠ্যাং হারিয়ে কাঠের ঠ্যাং হাতে নেওয়ার পরে সে কখনোই বিশ্বাস করেনি যে, দীর্ঘ সময় এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। তার শরীরে এখনো শক্তি আছে। রকমারি টি-স্টলের সাইনবোর্ডের মেয়েমানুষটার কালিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে এরফান আলীর করোটিতে আগুন জ্বলে ওঠে, এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে থাকা শরীর কেঁপে ওঠে ভূমিকম্পের মতো এবং যুবকদের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলে, বুনো অন্ধকার ধেয়ে আসছে তোমাদের দিকে, যুবকরা তোমরা কী কিছুই ধরতে পারছ না! গাঙের অন্ধ-বধির ঢেউয়ের লাহান ভয়ংকর হাসির কলরব তুলে ছুটে আসছে তোমার দিকে! মহীয়সী নারীর গান ‘এখনো গেল না আঁধার, এখনো রহিল বাঁধা’ তোমরা কিছুই বুঝতে পারো না! ফুল-পাখি-মানুষ-বাদ্যযন্ত্র এমনকি ম্যুরাল-ভাস্কর্য সবকিছুর ওপরে কালি লেপে দিচ্ছে, পেট্রলে পুড়িয়ে দিচ্ছে, তোমরা নিজ নিজ মুখের দিকে তাকাও, দেখো, প্রত্যেকের মুখেই কালি পড়েছে।

এককালের তুমুল শক্তির অধিকারী বর্ষীয়ান মানুষটি কি কবি হয়ে গেল! কাব্যিক ভাষায় কী সব বলছে, যুবকরা তেমন কিছুই বুঝতে পারে না। মানুষটির ভেতরে কোনো কারণে ভয়ানক ক্রোধ জেগে উঠেছে, শারীরিক শক্তিতে কুলোচ্ছে না বলেই যুবকদের এভাবে আহবান করছে।

ভয়ানক ক্রোধ, অপমান, ঘৃণা, অক্ষমতার যন্ত্রণা স্বেচ্ছায় শরীরে মেখে প্রবীণ মানুষটি কাঠের ঠ্যাঙের ওপরে ভর দিয়ে মিজানের রকমারি টি-স্টল থেকে বেরিয়ে পড়ল। রাগী-স্বভাবের যুবক ও ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ছেলেটির বাড়ি একদিকে হওয়ায় এরফান আলীর পেছনে হাঁটা ধরে।

বৈশাখের প্রথম দিনের সূর্য ধীরে ধীরে স্বরূপে রূপ নিচ্ছে, বৈশাখি বাতাস গরম হয়ে উঠছে, রোদ তপ্ত হয়ে উঠছে, ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ছেলেটির ফর্সা ঘর্মাক্ত মুখের ওপর তপ্ত রোদ পড়েছে শক্তিশালীর টর্চের আলোর মতো। পরিচ্ছন্নতার বাণী লিখিত সিটি করপোরেশনের ময়লা জমার ট্রাকের সামনে পড়ায় দুর্গন্ধ থেকে সুরক্ষার জন্য রুমাল অথবা হাতে নাক চেপে ধরে, কিন্তু একটি অনাকাঙিক্ষত উৎকট দুর্গন্ধ রুমাল অথবা হাতের সুরক্ষা ভেদ করে নাক দিয়ে সুড়ুত করে সোজা মগজে ঢুকে পড়ছে। আকাশ কালো করে একঝাঁক শকুন নামছে ট্রাকটিকে লক্ষ করে, এবং এতটা কাছে নেমে এসেছে যে, লাঙলের ফলার মতো ভয়ঙ্কর ধারালো নখ দেখা গেল। ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ছেলেটি বলে, এত শকুন তো একসঙ্গে কোনোদিন দেখিনি! এরফান আলী বলে, শকুনরা দলবেঁধেই থাকে। ট্রাকে কী মরা পড়ে আছে একবার দেখে আসা দরকার, ক্রিকেট টিমের অধিনায়কের কৌতূহলে বাধা দিলো রাগী-স্বভাবের যুবক, দেখছ না, ক্ষুধার্ত শকুনরা নামছে! মরা গরু, মরা ছাগল-ভেড়া, বড়জোর মরা মানুষ, ট্রাকের মধ্যে একটা কিছু আছেই, নিশ্চিত খবর না পেলে শকুন নামে না। অধিনায়ক ছেলেটি মরা মানুষ শুনে চমকে উঠলে রাগী-স্বভাবের যুবক বলে, তোমার ডিপার্টমেন্টের এক প্রফেসরকে খুন করে ম্যানহোলের ভেতরে ফেলে রেখেছিল, মনে নেই তোমার?

উৎকট দুর্গন্ধ এবং শকুনের নামার সাঁই সাঁই শব্দকে টেক্কা দিয়ে এরফান আলীর দৃষ্টি কাড়ে দুই ময়লা-কুড়ানি বালিকার রক্ত হিম করা বিকট চিৎকার। বুল ফাইটের মতো মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত দুই বালিকা। ওরা দেখতে প্রায় শকুনের মতো বীভৎস কালো, এবং শকুনের দলে ভিড়ে গেলে চেনা কঠিন। বাতাসে জোরে ধাক্কা দিলে শেকড়হীন গাছের মতো আলগোছে পড়ে যাবে এমন রোগা কৃশকায়। উচ্চতায় দুই বালিকা প্রায় সমান, মাথায় বাবুইপাখির বাসার মতো জটাবাঁধা চুলের বাসা, পস্নাস্টিকের দড়ি দিয়ে কোমরে বাঁধা একটি করে পায়জামাও আছে, কিন্তু ওপরের অংশ কাপড়শূন্য; নারীত্বের প্রতীক স্তন দুটি বুকে স্থান নির্দিষ্ট করে বিষফোড়ার মতো কেবল মাথা উঁকি মারছে। নববর্ষের দিনে নগরীর সুখী-সমৃদ্ধ মানুষেরা পান্তাপ্রিয় হয়ে ওঠায় ঘরে ঘরে পান্তা-উৎসব, তাই উদ্বৃত্ত পান্তায় ট্রাকভর্তি, এই খাবার লুফে নেওয়ার সময় বালিকাদের শরীরের যত্রতত্র ময়লা আটকে শতটুকরো বাহারি রঙের কামিজের মতোই হয়ে আছে। বুকের বিষফোড়া দুটির ওপরে কিছু পান্তা লেপটে শুকিয়ে আছে। ময়লার ট্রাকে হেলান দিয়ে লুঙ্গি প্রায় কোমর পর্যন্ত চেতিয়ে পেশাব করার ফাঁকে ঊরুর একজিমা চুলকানোর প্রশান্তি উপভোগরত এক ভগ্নদেহী মধ্যবয়সী রিকশাচালক শিকারি শিয়ালের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বালিকা দুটির লড়াই। পেশাব শেষে লুঙ্গির ওপর দিয়ে একজিমা চুলকাতে চুলকাতে ছুটে আসে লড়াইরত বালিকাদের দিকে, এই ছেড়িরা, দেহি তোরা কী পাইছিস ট্রাকের মইধ্যে? রিকশাওয়ালাকে আসতে দেখে বালিকা দুটি রক্তহিম করা চিৎকার আরো বাড়িয়ে দিলো। উৎকট দুর্গন্ধ ও শকুন নামার বিপদের মধ্যেও এরফান আলী দাঁড়িয়ে পড়লে রাগী-স্বভাবের যুবক ও অধিনায়ক ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলো। ওদের কাছাকাছি পৌঁছেই চমকে উঠল এরফান আলী, বালিকা দুটির চোখে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, সাঁই সাঁই শব্দ করে শকুনেরা যেন ওদের চোখেই নামছে। ইচ্ছা করলে, যে-কোনো একটি শকুনই লাঙলের ফলার মতো নখ দিয়ে অনায়াসে একটি মেয়ে তুলে নিতে পারবে। বিরক্তির চোখে এরফান আলীর দিকে একনজর তাকিয়ে ঊরুর একজিমা চুলকাতে চুলকাতে বিদায় নিল রিকশাচালক। দুর্বল অপুষ্ট হাড়সর্বস্ব ক্ষীণতনুর এ-শরীরে এমন রক্তহিম করা বিকট চিৎকার কী করে সম্ভব! এক বালিকা দুই হাতের মুঠো একত্রে করে শক্তভাবে বন্দি করে রেখেছে অমূল্য সম্পদ, যা ওরা পেয়েছে ট্রাকের ময়লা-আবর্জনার মধ্যে। শক্তি ও শরীরে দুজন সমান, তাই অন্য বালিকাও নাছোড়, একবার নখ দিয়ে খামছে ধরছে তো একবার লালদাঁত দিয়ে কামড়ে ধরছে। একজন সম্পদ দখলে নিয়েছে এবং অন্যজন সেই সম্পদ কেড়ে নিতে মরিয়া। সম্পদ সংরক্ষণ ও আহরণের আদিম প্রক্রিয়া ও সংঘর্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এরফান আলী ভেবেছিল, সোনার আংটি বা কানের দুল ইত্যাদি মূল্যবান কিছু হবে। যার অঢেল আছে তার আঙুলের ফাঁক গলিয়ে এক-দুটা সোনার আংটি বা অজান্তে কানের একটা দুল ময়লা-আবর্জনার ঝুড়ির মধ্যে পড়তেই পারে। সম্পদ দখলকারী বালিকাটি এরফান আলীকে আস্থায় নিল না, কিছুতেই হাতের মুঠো আলগা করবে না। বড় একটি ধমক গলা পর্যন্ত উঠে এসেও থেমে গেল। মাথার মগজ পর্যন্ত নড়ে ওঠে এমন ভয়ানক উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা শরীরে মেখে এবং আবর্জনার কাছেই দাঁড়িয়ে দুই বালিকার সম্পদ সংরক্ষণ ও দখলের যে লড়াই, এই সম্পদের মালিক নিশ্চয় আশেপাশের অভিজাত বাড়িগুলোর কেউ একজন, টের পেলে নিশ্চয় ছুটে আসবে। এ-লড়াইয়ে একজন ভদ্রলোক জড়িয়ে পড়ছে, জটিল-পাঁক তৈরি হবে। কারেন্টের খাম্বার মতো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে এরফান আলী। বালিকা দুটির চিৎকার থেমে গেছে, কিন্তু লড়াই চলছে পূর্ণশক্তিতে। অধৈর্য হয়ে রাগী-স্বভাবের যুবক এগিয়ে গেল এবং কাছাকাছি পৌঁছেই ধমক মারল, ‘এই, কী নিয়া গ-গোল করছিস তোরা, দেখি?’ যেন শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটল, বালিকা দুটি একসঙ্গে কেঁপে উঠল। দখলকারী বালিকার হাতের মুঠো আলগা হয়ে গেলে মাটিতে যা পড়েছে তা দেখে এবার এরফান আলীর বুক কেঁপে ওঠে, কাঠের ঠ্যাঙের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না, এ-মুহূর্তে আরো দশটি কাঠের ঠ্যাং প্রয়োজন এরফান আলীর পঙ্গু শরীরের ভার বহনের জন্য।

রাগী-স্বভাবের যুবকের চোখে-মুখে বিস্ময়, ‘একটুকরো ইলিশ-ভাজা নিয়ে তোরা এমন ষাঁড়ের মতো লড়াই করছিস!’

মাথা ঝুঁকে দুর্গন্ধযুক্ত পান্তাভর্তি ময়লা পলিথিন দুটি মাটি থেকে তোলার মুহূর্তে বালিকা দুটি এরফান আলী ও যুবকের মুখের দিকে একপলক অশ্রম্নসিক্ত চোখে তাকিয়েছে কেবল, আর কিছুই বলেনি। দুজন একদিকেই হাঁটা ধরে।

ডোবা তেলে কড়কড়ে ভাজা একটুকরো ইলিশ এরফান আলী ও রাগী-স্বভাবের যুবকের পায়ের কাছেই পড়ে রইল। r