এখানে কবিতা লেখা শেখানো হয়

মাহবুব তালুকদার

প্রায় দুবছর বেকার জীবনযাপনের পর সে যখন হতাশার শেষ প্রান্তে উপনীত, ঠিক তখনই ঘটল সে-ঘটনা। তবে শুধু ঘটনা বললে তা যথার্থ বলা হয় না, অলৌকিক ঘটনা বলাই যুক্তিসঙ্গত। তার এককালীন সহপাঠী মোল্যা জালালাবাদীর সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। পুরনো বন্ধুরা আজকাল সামনে পড়ে গেলে মুখ ব্যাজার করে যে যার পথে চলে যায়। কিন্তু মোল্যা বন্ধুত্বের মূল্য দিয়ে থাকে। সে তাকে সঙ্গে করে একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকল। বলল, তোমার কাছে কিছু পয়সা আছে তো?

পয়সা নেই। তবে গোটা বিশেক টাকা আছে।

ওতেই হবে। দুজনে মিলে চারটা পুরি আর দুকাপ চা, বিশ

টাকাতেই হয়ে যাবে, কী বলো? আমার পকেটে আছে পাঁচশো টাকার নোট, ওরা নিশ্চয়ই তার ভাংতি দিতে পারবে না।

ওদের জিজ্ঞাসা করব, পাঁচশো টাকার ভাংতি হবে কি-না!

না, না। বিশ টাকা খেয়ে পাঁচশো টাকা ভাঙানোর কী দরকার? তোমার কাছে না থাকলে অবশ্য কথা ছিল।

মোল্যার কথা শুনে সে চুপ করে রইল। বিশ টাকা তার কাছে অনেক টাকা। কোথাও যেতে হলে সে বাসে না চড়ে হেঁটে যায়। সেটা পয়সা বাঁচাবার জন্য। মোল্যা যে তার পকেট থেকে বিশ টাকা বের করে দিচ্ছে এই শোকে সে কাতর।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে মোল্যা জিজ্ঞাসা করল, কী করছ আজকাল?

কিছু না। স্রেফ ঘরে বসে আছি। চাকরি-বাকরি কিছুই জুটছে না।

একি কথা শোনালে তুমি? ঘরে বসে চাকরির ধ্যান করলে, চাকরি জোটে, এ-কথা তোমাকে কে বলল? চাকরি বাদ দিয়ে তুমি ব্যবসার পেছনে দৌড়াও। দৌড়ালে স্বাস্থ্য ভালো হয়।

ব্যবসায় পুঁজি লাগে। সোজাসুজি জানাল সে।

প্রথম পুরি সাবাড়ের পর দ্বিতীয় পুরিতে কামড় বসাতে বসাতে মোল্যা প্রশ্ন করল, তোমার যেন কী নাম?

কাজী জসিম ঠাকুর।

তোমার এ-নাম কে রেখেছে?

আমার দাদা।

বলতেই হবে যে, তিনি খুবই দূরদর্শী ছিলেন। অতুলনীয় তার দূরদৃষ্টি।

আমার দাদা জন্মান্ধ ছিলেন। তিনি দূরদর্শী হলেন কীভাবে?

অন্ধ হলেই যে মানুষ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয় না, তা নয়। তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দেখতে পায়। দূরদর্শিতা চোখ দিয়ে দেখা নয়, অন্তর দিয়ে দেখা।

কী কারণে তুমি দাদার প্রশংসা করছ, তা তো বললে না।

ভবিষ্যতে তুমি কবি হবে, এটা ভেবে দাদা তোমার নামকরণ করেছিলেন। বাংলা ভাষার তিনজন কবির নাম, তোমার নামের মধ্যে। আর তুমি কিনা চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছ!

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

আরে বোকা! কাজী নজরুল ইসলাম, জসিমউদ্দীন আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামের অংশবিশেষ নিয়ে তোমার দাদা তোমার নাম রেখেছিলেন। দারুণ ব্যাপার! দাদাকে আমার সালাম দেবে।

দাদা তো নেই।

নেই মানে? কোথায় গেলেন!

তিনি মারা গেছেন।

ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। কবে মারা গেছেন তোমার দাদা?

তিন বছর আগে।

যাক। মানুষের মৃত্যুর ওপরে তো কারো হাত নেই। কিন্তু জীবন তো আমাদের হাতের মুঠোয়। তুমি ভাই কবিতা লেখায় হাত লাগাও।

কিন্তু আমি যে কবিতার ক-ও লিখতে জানি না।

তাতে কী? তুমি যাদের নাম বয়ে বেড়াচ্ছ, তারা কি জন্মের পরই কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন? অনেক সাধনা করে তবেই না তারা কবি হয়েছেন। সাধ আর সাধ্য মিলিয়ে তবেই না সাধনা। তোমার উচিত, তোমার দাদা তোমাকে নিয়ে যে-স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাকে বাস্তবে রূপদান করা। অন্ধ হলে যে স্বপ্ন দেখা যাবে না, তা তো নয়।

কাজী জসিম ঠাকুর মোল্যা জালালাবাদীর কথাগুলো অনুধাবন করতে চেষ্টা করল। সত্যিই তো! কেউ জন্ম থেকে প্রতিভা নিয়ে কাব্যচর্চা করে না। প্রতিভা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। তার মধ্যে কবি হওয়ার যে-প্রতিভা আছে; তা তার মরহুম দাদা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তার নামের মধ্যেই কবিতার বীজ অঙ্কুরিত করে দিয়েছেন। কোথায় যেন সে পড়েছিল, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ কাজী জসিম ঠাকুর দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেল, কেউ কেউ কবির মধ্যে সে একজন।

কাল থেকে তুমি কবিতা লিখতে শুরু করে দাও। মোল্যা জালালাবাদী বলল, প্রতিভাকে অনাদরে-অবহেলায় ফেলে রাখলে তা পচে যায়।

আমার যে প্রতিভা আছে তা বুঝব কী করে?

তোমার দাদা তোমার শিশুকালেই তা বুঝতে পেরেছিলেন। আর এত বড় হয়ে তুমি বুঝতে পারবে না? একটু ঢোক গিলে সে আবার বলল, তোমার বোঝার দরকার নেই। দেশের মানুষই বুঝবে। তুমি শুধু কবিতা লিখতে লেগে যাও।

কিন্তু তাতে তো বেকারত্ব ঘুচবে না।

নির্ঘাত ঘুচবে। মোল্যা জালালাবাদী প্রায় ধমকে উঠল, বাঙালি জাতির এই এক দোষ। কর্ম করার আগেই কর্মফল ভোগ করতে চায়। তুমি গাছ লাগাবার আগেই ফল চাও কীভাবে? আগে তুমি কবিতা লেখ, সেই কবিতা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হোক। তারপর দেখো, দেশবাসী তোমাকে কীভাবে বরণ করে! তোমার নামের আগে তারা ‘বরেণ্য’ শব্দটা লাগাবে। ‘বরেণ্য’ অর্থ জানো? ডিকশনারিতে দেখে নিও।

কাজী জসিম ঠাকুরের মন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল এসব কথা শুনে। দুবছর ধরে সে বেকার আছে। আরো না-হয় এক বছর বেকার থেকে সে কাব্যচর্চা করে যাবে। প্রয়োজনে কোনো টিউশনি যোগাড় করে নেবে। অবসরে সে কবিতা লিখবে। না, না। অবসরে টিউশনি করবে। ফুলটাইম কবি, পার্টটাইম টিউটর।

সুন্দর দেখে দুটো বাঁধানো নোটবই, একদিস্তা কাগজ, দুটো কলম ও একটা বাজে কাগজের ঝুড়ি কিনে ফেলল সে। যদি কোনো কবিতা মনঃপুত না হয়, তাহলে বাজে কাগজের ঝুড়িতে জমা করে রাখবে। নোটবই দুটো ভালো কাগজে ‘ফেয়ার কপি’ করার জন্য। কবিতা লেখার উপকরণ যোগাড় করার পর লিখতে বসে গেল। কিন্তু প্রথম দুদিন কী বিষয় নিয়ে লিখবে, তা-ই ঠিক করতে পারল না। পরে অবশ্য কলসের মাথা থেকে, নাকি তার নিজেরই মাথা থেকে, কবিতার লাইন বেরোতে শুরু করল। অনবরত একের পর এক কবিতার লাইন সারিবদ্ধভাবে সাজাতে সাজাতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু কবিতার স্রোত কিছুতেই বন্ধ হয় না। কবিতা একবার আসতে শুরু করলে কীভাবে তা ঠেকানো যায়, তেমন কোনো বিদ্যা তার জানা নেই।

এরপর গোটা দশেক কবিতা সে পাঠিয়ে দিলো সম্পাদকদের নামে। পোস্টঅফিসে গিয়ে নিজেই রেজিস্ট্রি করে পাঠাল, যাতে কোনো কবিতা খোয়া না যায়। কিন্তু দুসপ্তাহ অপেক্ষা করেও কোনো কবিতা ছাপা হলো না। ভাবল, তার কবিতা হয়তো সারিবদ্ধ হয়ে সম্পাদকের টেবিল থেকে প্রেসে যেতে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী করণীয় আছে! কিন্তু তিনমাস পেরিয়ে গেলে যখন একটা কবিতাও প্রকাশিত হলো না, তখন সে একরকম হতাশ হয়ে পড়ল। তবে দীর্ঘকাল হতাশা মনে পুষে রাখার মানুষ সে নয়। এবার কবিতা লেখার একটা নতুন ফন্দি অাঁটল। বলা বাহুল্য, তা আধুনিক কবিতা। সে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জসিম উদ্দীনের কবিতার একেকটি লাইন নিয়ে পরপর সাজিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখে ফেলল। আর ডাকযোগে নয়। সশরীরে উপস্থিত হলো সম্পাদকের দফতরে। সম্পাদক সাহেব কবিতাটি পড়ে বললেন, একি!

এটা একটা নতুন ধরনের কবিতা। এমন কবিতার আসার কথা আগে কেউ চিন্তা করেনি।

তা তো বুঝলাম। কিন্তু এ-কবিতার অনেক লাইন আমার পড়া।

হতে পারে। কিন্তু পুরো কবিতাটি নিশ্চয়ই একত্রে পড়েননি।

এসব কী লিখেছেন আপনি? ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা, এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে। ফুল দেব না অশ্রু দেব ভেবে হই আকুল।’ – এর অর্থ কী?

অর্থ খুবই সোজা। বর্ষার দিনে ডালিম গাছের তলে দাদিকে কবর দেওয়া হয়েছে। তখন আকাশে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। কবি ভেবে পাচ্ছেন না, কবরে ফুল দেবেন না অশ্রু দেবেন। খুবই হাই থট।

থট যতই হাই হোক, আমি ভাই ছাপোষা মানুষ। আপনার কবিতা আমি ছাপতে পারব না। আপনি পথ দেখুন।

রাস্তায় বেরিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মোল্যা জালালাবাদীকে ফোন করল সে। শাহবাগের মোড়ে আসতে অনুরোধ করল। মোল্যা বলল, এখন দুপুর বেলা। কাছাকাছি কোথাও কি বিরিয়ানি পাওয়া যাবে? তোমার কাছে কত টাকা আছে?

শ’তিনেক হবে।

ভেরি গুড। তাতেই হয়ে যাবে। আমি এখনই আসছি।

রেস্তোরাঁয় বসে বিরিয়ানির অর্ডার দিয়ে মোল্যা জালালাবাদী বলল, কই? তোমার কবিতাটা দাও তো দেখি।

পকেট থেকে কবিতা বের করে দিলো কাজী জসিম ঠাকুর। মোল্যা কবিতাটা জোরে জোরে আবৃত্তি করতে থাকল। রেস্তোরাঁর বেয়ারার, এমনকি ম্যানেজারও ছুটে এলো কাছে। আবৃত্তি শেষ হলে মোল্যা বলল, চমৎকার হয়েছে। আইডিয়াটাও খুব নতুন। তবে তুমি একটা ভুল করেছ। বিখ্যাত কবিদের অখ্যাত লাইন নিয়ে কবিতা লিখলে তুমি এভাবে ধরা খেতে না। তাদের কবিতার এমন পঙ্ক্তি নেওয়া উচিত ছিল, যেগুলো কেউ কখনো পড়েনি।

কোনটা কেউ পড়েনি, বুঝব কী করে।

ওদের সবারই অপ্রকাশিত রচনাবলি আছে। সেগুলো থেকে নিলে আর কেউ বুঝতেই পারবে না।

আমার ব্যাপারটা আর ভালো লাগছে না। আসলে আমি বেকারত্ব মোচনের চেষ্টা করছি। কবিতা দিয়ে তা সম্ভব নয়।

কে বলল তা সম্ভব নয়! মোল্যা জালালাবাদী নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল, তুমি বরং একটা কবিতা-কেন্দ্র চালু করো।

কবিতা-কেন্দ্র মানে, কবিতার দোকান নাকি?

না। কবিতার দোকান নয়। কবিতা লেখা শেখাবার একটা প্রতিষ্ঠান। ওটার নাম দাও ‘কাজঠা কবিতা কেন্দ্র’।

‘কাজঠা’ মানে কী?

মোল্যা জালালাবাদী বিষণ্ণবদনে বলল, ‘কাজঠা’ তোমার নামের আদ্যাক্ষর। ওঠার নিচে লিখবে : ‘এখানে কবিতা লেখা শেখানো হয়’।

আমার কাছে কবিতা লেখা শিখতে আসবে কেন? আমি নিজেই তো কবিতা লিখতে জানি না।

তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। তুমি যে কবিতা লিখতে জানো না, এ-কথা কে জানতে যাচ্ছে বলো! যারা তোমার কাছে কবিতা লেখা শিখতে আসবে, তারা নিজেরা কবিতা লিখবে। শিক্ষকদেরকে কি কেউ পরীক্ষা দিতে বলে?

কাজী জসিম ঠাকুর আমতা-আমতা করে বলল, আমার কাছে লোকে কবিতা লেখা শিখতে আসবে তো?

অবশ্যই আসবে। মোল্যা জালালাবাদী ভরসা দিয়ে বলল, তোমার সবই আছে। কেবল আত্মবিশ্বাসের অভাব। তুমি কি জানো, বাংলাদেশের প্রায় তিন ভাগের একভাগ লোক কবিতা লিখতে চায়? উপযুক্ত পরিবেশের কারণে তারা কবি হতে পারছে না। সেই পরিবেশ তৈরি করে দেবে তুমি। তুমি তাদের কবিতা লেখায় উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জোগাবে।

এসব কাজে টাকা পাব কোথায়? শেষ কথাটি জানাল সে।

দেশে জমিজমা যা আছে সব বিক্রি করে দাও। জমিজমা দিয়ে কী হবে? একজন কবির কাছে কবিতাই হচ্ছে অমরত্বের চাবিকাঠি।

জমিজমা বিক্রির অবশ্য প্রয়োজন ছিল না। কারওয়ানবাজারে কাঠের আড়তের পাশে তার মামার একটা ভুষিমালের দোকান ছিল। মামা অনেকদিন ধরে প্যারালাইসিসে শয্যাশায়ী। দোকান নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ তার নেই। দোকানটা পড়ে আছে, পড়ে থাক, – এটাই তার মনোভাব। কাজী জসিম ঠাকুর প্রস্তাব দিলো দোকানটা সে ভাড়া নেবে। মামা একটু একটু কথা বলতে পারেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ভাড়া নেবে কেন?

ওখানে আমি কবিতার স্কুল করব।

কবিতার স্কুল! সেটা আবার কী?

কবিতা লেখা শেখানো হবে সেখানে।

ভুষিমালের দোকানে কবিতা? বরং তুমি কাঠের আড়ত দাও। চিটাগাং থেকে সেগুনকাঠ এনে –

বাধা দিয়ে সে বলল, ভুষিমাল বা কাঠের দোকান নয়, আমি কবিতারই দোকান দেবো।

তুমি তো দেখি কবিতার ব্যাপারে একেবারে উঠেপড়ে লেগেছ। জানো তো, এককালে আমিও কবিতা লিখতাম। তোমার মামিকে উৎসর্গ করে একটা কবিতার বইও লিখেছিলাম ‘সুখ তুমি কোথায়’? ব্যবসার ঝামেলায় পড়ে সেটা আর ছাপানো হয়নি।

তাহলে আপনার দোকানটা আমাকে ভাড়া দিচ্ছেন তো?

ভাড়া! তোমাকে ভাড়া দেবো কেন? তুমি আমার একমাত্র ভাগ্নে। একটা মহৎ কাজ করছ। আমাকে তোমার কোনো ভাড়া দিতে হবে না। কবি হিসেবে আমি আছি তোমার পাশে।

আপনাকে দিয়েই আমার প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন করব। কার্ডে নাম ছেপে দিচ্ছি।

আমাকে দিয়ে উদ্বোধন করাবার কথা কী বলছ? আমি যে চলাফেরা দূরের কথা, টয়লেটে যেতে পারি না। ওখানে যাব কীভাবে?

সেটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করব। দুজন বাহক স্ট্রেচারে করে আপনাকে নেবে-আনবে। আপনি শুয়ে শুয়ে ফিতা কাটবেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সত্যি অভিনব হলো। ভুষিমালের দোকানকে প্লাইউড দিয়ে সে নতুন করে সাজিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের কোনো নাম দিলো না সে। সাইনবোর্ডে লেখা হলো : ‘এখানে কবিতা লেখা শেখানো হয়’। এটাই প্রতিষ্ঠানের পরিচয়। নাম ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান পৃথিবীতে এই প্রথম। আইডিয়াটা তার নিজের। মোল্যা জালালাবাদী প্রথমে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখালেও পরে ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। কার্ডের অনুষ্ঠানসূচিতে ছাপা হয়েছে, উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি – কবি তালেবান জোয়ারদার, শুভেচ্ছা ভাষণ ও সাইনবোর্ড উত্তোলন – কবি ও ছড়াকার মোল্যা জালালাবাদী, ধন্যবাদ জ্ঞাপন – কবি কাজী জসিম ঠাকুর। কার্ডের নিচে লেখা আছে : ‘কার্ড সঙ্গে আনার প্রয়োজন নেই। অনুষ্ঠানে মিষ্টি দ্বারা আপ্যায়ন করা হবে।’ এর টাকা অবশ্য মামার কাছ থেকে পাওয়া গেল।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রীতিমতো হুলস্থুল ব্যাপার। বিকেল চারটায় সাইরেন বাজিয়ে মামাকে বহনকারী গাড়ি যখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো, তখন প্রতিষ্ঠানের সামনে শোরগোল আর থামানো যায় না। কেউ মারা গেছে মনে করে কারওয়ানবাজারের দোকানিরা ছুটে এলো। এর কারণ, সময়মতো অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করতে না পারায় মামাকে একটি লাশবাহী পিকআপে সেখানে আনা হয়েছে। ‘লাশবাহী গাড়ি’ কথাটা ওর গায়ে বড় করে লেখা আছে। আর সাইরেন তো আছেই। ড্রাইভার জানাল, আগে এটা অ্যাম্বুলেন্সই ছিল। এখন জীবিত বা মৃত সবার জন্যই এটা ভাড়া দেওয়া হয়।

কারওয়ানবাজারের দোকানিদের মধ্যে যে এতো কবি আছে, তা আগে জানা ছিল না। ওদের মধ্যে আটজন এসে নাম রেজিস্ট্রি করাল। বাইরে থেকে পাওয়া গেল আরো চারজন। প্রথম দিনই  কবি যশোপ্রার্থী বারোজনকে পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। সবারই নিবন্ধন ফি পাঁচশো টাকা এবং মাসিক বেতন দুশো টাকা। প্রথম দিন কামাই আট হাজার চারশো টাকা। মোল্যা জালালাবাদী অবশ্য দুই হাজার টাকা নিয়ে নিল কনসালট্যান্সি ফি হিসেবে। যাওয়ার সময় সে বলে গেল, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলে সদস্যসংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। কারওয়ানবাজারেই তো ঢাকার বড় বড় পত্রিকাগুলোর অফিস। প্রথম আলো, ইত্তেফাক, মানবজমিন আর আমার দেশ। কাজী জসিম ঠাকুর দুটো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দিলো।

বিজ্ঞাপনের ফল পাওয়া গেল হাতে হাতে। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে কবিতা লিখতে শেখার বাসনা নিয়ে হবু কবিরা এসে ভিড় জমাল ‘এখানে কবিতা লেখা শেখানো হয়’ প্রাঙ্গণে। তাদের নাম নিবন্ধন করতেই হিমশিম খেয়ে গেল কাজী জসিম ঠাকুর।

এবার কী করা? মোল্যা জালালাবাদীকে ফোনে জিজ্ঞাসা করল সে, কবিতা লেখা শেখাব কী করে?

সেজন্য কোনো পরোয়া নেই। মোল্যা বলল, প্রয়োজনে দুজন  নামকরা কবিকে ভাড়া করে নিয়ে আসব।

কিন্তু আমার এখানে যারা আসছে তারা কেউ কবিতা লেখা শিখতে চায় না, তারা অন্যদেরকে নিজেদের কবিতা পড়ে শোনাতে চায়।

তোমার সমস্যা কী?

কবিতা শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। গতকাল কানের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। উনি পরীক্ষা করে বলেছেন, দুটো কানই প্রায় আশি ভাগ বন্ধ হয়ে গেছে।

বাকি বিশ ভাগও বন্ধ করে দিতে বলো। আর কোনো সমস্যাই থাকবে না।

তাতে আমি চলব কী করে?

চলবে কী করে মানে? তুমি কি কান দিয়ে চলাফেরা করো নাকি। মানুষ তো পায়ে চলাফেরা করে।

সে-কথা নয়। আমি বোঝাতে চাইছি, আমি পুরো বয়রা হয়ে গেলে কথা শুনব কী করে? আমি শেষে প্রতিবন্ধী হয়ে যাবো।

কথাটা শুনে মোল্যা জালালাবাদী ধমকে উঠল, প্রতিবন্ধী হওয়া কি খারাপ? টমাস এডিসন কানে শুনতেন না বলেই এতবড় বিজ্ঞানী হয়েছিলেন। মাদাম কুরি প্রায় অন্ধ ছিলেন বলেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। হোমারের কথাই যদি ধরো, অন্ধ ছিলেন বলে তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হতে পেরেছিলেন। স্টিফেন হকিং প্রতিবন্ধী বলেই এতো নামকরা ও খ্যাতিমান বিজ্ঞানী। তুমিও তাঁদের মধ্যে নাম লেখাও।

মোল্যা জালাবাদীর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা তার আর হলো না। কবিতা লেখা শেখানোর একটা উপায় বের করল। শিক্ষার্থীদের সে বলে দিলো, কবিতা লিখতে শেখা একটা স্বনির্ভর প্রকল্প। কবিতা আমরা লিখতে শেখাব, তবে সত্যিকার কবিকে আত্মনির্ভর হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসিমউদ্দীন প্রত্যেকেই আত্মনির্ভর ছিলেন। যাদের প্রতিভা আছে তারা অবশ্যই কবি হবে। আমার কাজ হচ্ছে আপনাদের প্রতিভাকে উসকে দেওয়া।

তাহলে আমরা এখানে ভর্তি হলাম কেন? একজন প্রশ্ন করল।

আমরা আপনাদের সার্টিফিকেট দেবো। আপনারা যে কবি, তার স্বীকৃতিস্বরূপ এ-সার্টিফিকেট। ভবিষ্যতে আপনারা পত্রিকার সম্পাদক, বইয়ের প্রকাশককে আমাদের সার্টিফিকেটের ফটোকফিসহ আপনাদের পান্ডুলিপি বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারবেন। আপনারা কবিতা লেখা শেখার সার্টিফিকেট চান কি চান না?

সবাই হাত তুলে জানাল, তারা সার্টিফিকেট চায়।

এরপর আর কোনো অসুবিধা নেই। যারা কবিতা লেখা শিখতে এসেছে তারা আসলে সকলেই ক্ষুদে কবি। তারা শুধু নিজেদের প্রতিভা অন্যদের সামনে তুলে ধরতে চায়। কেউ কবিতা লেখা শেখার নামটি পর্যন্ত করে না। কাজী জসিম ঠাকুর এখন আর নিজে কবিতা শোনে না। কানের ভেতর তুলে এঁটে বসে থাকে। প্রত্যেকের কবিতা পাঠের পর সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে হাততালি দিতে হয়। হবু কবিরা এতে উৎসাহিত হয়। কবিদের উৎসাহ না দিলে তারা কবিতা লেখার প্রেরণা পাবে কোত্থেকে? কবিতা লেখা শেখানোর চেয়ে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এক সপ্তাহ না পেরোতেই ঘটল আরেকটি অলৌকিক ঘটনা। মঙ্গলবার বলে কারওয়ানবাজারের সেদিন সাপ্তাহিক বন্ধ। ‘এখানে কবিতা লেখা শেখানো হয়’ প্রতিষ্ঠানটিও বন্ধ থাকে সেদিন। কাজী জসিম ঠাকুর অবসরে বসে সেখানে কবিতা লেখার কোশেশ করছিল; কিন্তু একটা লাইনও লিখতে পারছিল না সে। কী বিষয় নিয়ে কবিতা লিখবে, তাও ঠিক করা সম্ভব হলো না। ঠিক এ-সময়ে ওদের প্রতিষ্ঠানের সামনে এসে দাঁড়াল একটা ঝকঝকে নতুন গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে এলো একজন সুবেশী তরুণী। শুধু সুবেশী তরুণী বললে বোধহয় সবটা বলা হয় না। তার রূপের ঝলক দেখে চোখ ঝলসে যাওয়ার অবস্থা। কাজী জসিম ঠাকুর তরুণীর আগমনবার্তা পেয়ে নিজে গিয়ে অভ্যর্থনা করল। ভেতরের সাজানো কক্ষে তাকে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি ম্যাডাম?

ওসব ম্যাডাম-ট্যাডাম শুনতে আমার ভালো লাগে না। আমার নাম নাতাশা। আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকবেন। ওকে?

ওকে! ওকে!

আমি আপনার কাছে এসেছি কবিতা লেখা শিখতে – বলে চোখের কালো চশমা খুলে সে টেবিলের ওপর রাখল।

কাজী জসিম ঠাকুর তাকাল তার চোখের দিকে। এতো সুন্দর চোখ আর কখনো দেখেনি। এই মায়াময় চোখ দুটি কালো চশমা দিয়ে ঢেকে রাখার প্রয়োজন কী? নাতাশার চোখের দিকে তাকিয়ে সে আনমনে বলে ফেলল, মাশাল্লা!

কী বললেন আপনি?

ও কিছু না।

একটা কিছু বলেছেন। সেটা লুকাচ্ছেন কেন? বলে ফেলুন।

মাশাল্লা!

এর অর্থ কী?

অর্থ আমি ঠিক জানি না। তবে কোনো কিছু সুন্দর দেখলে আমি কথাটা বলি।

আপনি কী সুন্দর দেখলেন?

আপনার চোখ।

শুধু চোখ?

না, মানে, আপনার সবকিছুই সুন্দর।

হুঁ। সত্য কথা বলার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। যাকগে। আপনি এই প্রতিষ্ঠানের মালিক তো?

হান্ড্রেড পার্সেন্ট। আর কারো এতে শেয়ার নেই।

এবার শুনুন। আমি যদিও এখানে কবিতা লিখতে শেখার কথা বলেছি, কিন্তু আমি কবিতা লিখতে শেখার জন্য আসিনি।

তাহলে?

আমি এসেছি এখান থেকে একজন কবিকে পছন্দ করতে।

পছন্দ করে কী করবেন?

সেটা আমার ব্যাপার। আপনার কি আপত্তি আছে তাতে?

না, না। আমার আপত্তি থাকবে কেন?

আমি মনের মতো একজন কবিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কেন বলতে পারেন?

আমি কীভাবে বলব?

কবিরা খুব রোমান্টিক হয়। তারা লম্বা চুল রাখে। সবসময় পাজামা-পাঞ্জাবি পরে থাকে। তারা বিষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসে, আকাশে চাঁদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে, একটা গাছের পাতা শুকিয়ে পড়ে গেলে ওরা তা নিয়ে দুঃখের কবিতা লেখে, কবিরা সাধারণত বেকার হয়।

ম্যাডাম! আমি নিজেও বেকার।

আবার ম্যাডাম। বলেছি না, আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকবেন। আমার নাম নাতাশা। ওকে?

ওকে! ওকে!

নাতাশা, একটা কথা বলব আপনাকে?

কথা একটা কেন, দশটা বলুন। আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি মানুষের বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কী বলবেন, বলে ফেলুন।

বলছিলাম কী, আপনার কবিতা লেখা শেখার দরকারই নেই। কবিরাই আপনাকে নিয়ে কবিতা লিখবে।

আমি তো তাই চাচ্ছি। উফ্! একজন রোমান্টিক কবি আমাকে নিয়ে কবিতা লিখবে, ভাবতেই মন কেমন করে উঠছে। শুনুন। আমার উদ্দেশ্যটা কিন্তু আপনি গোপন রাখবেন। ওকে?

ওকে! ওকে!

নাতাশা টেবিলের ওপর থেকে চশমা তুলে নিল। তবে এবার তা চোখে পড়ল না। চশমাটা হাতে দোলাতে দোলাতে চলে গেল। তার চলে যাওয়ার পর মনে হলো চারপাশে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে। এক অজানা শূন্যতা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কাজী জসিম ঠাকুরের চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে নাতাশার সেই মায়াময় চোখ। ভেসে উঠছে তার লাবণ্যভরা মুখ।

কাজী জসিম ঠাকুর নতুন উদ্যমে কাগজ-কলম নিয়ে আবার কবিতা লিখতে বসে গেল। কী আশ্চর্য! এবার আর বিষয়বস্ত্তর জন্য তাকে ভাবতে হলো না। মনের ভেতর থেকে কবিতা যেন আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উৎক্ষিপ্ত হয়ে বেরিয়ে আসছে। উপমাটা ঠিক হলো কি-না, কে জানে! গুল্লি মারো উপমায়! আগে তো কবিতাটা লেখা হোক। কাজী জসিম ঠাকুর লিখল : ‘নাতাশা/ মাশাল্লা, তোমার চেহারাটা খাসা/ তোমার চোখগুলো ভাসা ভাসা/ তোমার রূপের ঝলক/ দেখে পড়ে না আমার চোখের পলক। তোমার নাক কান গলা মুখ/ দেখলে জাগে অন্তরের সুখ/ তুমি খুব ধনী/ তোমার চুলগুলো যেন কদুর তেলের বিজ্ঞাপনী…।’

শুধু এই একটি কবিতা নয়, আরো কবিতা ভর করল তার মনের ভেতর। বলা বাহুল্য, এগুলো সব প্রেমের কবিতা। প্রেম না করেও প্রেমের কবিতার ঢল নামল তার কলমে। কিছুতেই তা ঠেকিয়ে রাখা যায় না। কয়েকদিনের মধ্যেই নিজেকে একজন দুর্দান্ত কবি হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করে বসল সে। জীবনের এরকম অকল্পনীয় ঘটনার কথা আগে স্বপ্নেও ভাবেনি।

পরের মঙ্গলবারে আবার এলো নাতাশা। গাড়ি থেকে নেমে কাজী জসিম ঠাকুরের চেম্বারে ঢুকে গেল। বলল, কী ব্যাপার! আপনার এখানে কবিরা কোথায়? সেদিনও কাউকে দেখলাম না।

মঙ্গলবার আমাদের ছুটি, মানে কারওয়ানবাজারের সাপ্তাহিক বন্ধ।

তাই বলুন। ভেবেছিলাম আজ কোনো কবির সঙ্গে দেখা হবে।

একজন কবি তো মজুত আছে আপনার সামনেই।

তাই নাকি! কী কবিতা লিখেছেন আপনি?

আমার কবিতার নাম ‘নাতাশা, তোমাকে’। কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনাল কাজী জসিম ঠাকুর।

চমৎকার! কবিতা শুনে উচ্ছ্বসিত হলো নাতাশা। জিজ্ঞাসা করল, আরো কবিতা লিখেছেন বুঝি?

লিখেছি। তবে সবই আপনাকে নিয়ে।

আমি তো তাই চাই। সারাজীবন তুমি শুধু আমাকে নিয়ে কবিতা লিখবে।

তুমি চাইলে তাই হবে।

এই প্রতিষ্ঠানটা তুমি বন্ধ করে দাও। অন্যদের কবিতা লেখা শেখাবার দরকার কী?

এটা বন্ধ করলে আমি যে বেকার হয়ে যাব।

বেকার পাত্রই আমার পছন্দ। কাজ থাকে না বলে তারা ফুলটাইম প্রেমিক হয়। নাতাশা মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বলল, কাল থেকে লম্বা চুল রাখবে। সবসময় পাজামা-পাঞ্জাবি পরে থাকবে। বৃষ্টি হলে পানিতে ভিজবে। আরো কী কী করতে হবে, আমি তোমাকে লিখে দেবো। ও কে?

ওকে! ওকে!