এ-ঘরে কেউ নেই

মোবাশ্বির আলম মজুমদার

সুন্দরের হাত দুটি বেঁধে দাও, সময় হয়েছে।
সুন্দরের হাত পড়ে অগ্নি ও সমিধে
তার সবই চাই
সে হাত বাড়ায় চারিদিকে
লোলুপ অগ্নির মতো সে হাত বাড়ায় চারিদিকে।
– শক্তি চট্টোপাধ্যায়

বিশ্বশিল্পকলার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা অঞ্চলের শিল্পকর্মের সৃষ্টির ভাবনা কোনো অংশে কম নয়। তৈয়বা বেগম লিপি ইতোমধ্যে পৃথিবীব্যাপী তাঁর শিল্প-ভাবনা ছড়িয়ে দিয়েছেন। শিল্পকর্মের মাঝে প্রতীকবাদিতা, নতুন মাধ্যমের ব্যবহার, দৃশ্যশিল্পের দ্বিমাত্রিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে ত্রিমাত্রিক রূপদান করে বিষয়কে বাস্তবতার সঙ্গে সূত্রাবদ্ধ করেছেন।
তৈয়বা বেগম লিপির এ-প্রদর্শনীটি বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় বলা চলে। লিপির শিল্প-ভাবনার মূল উপজীব্য ‘নারী’। নারীকে সমাজে কীভাবে দেখা হয়। নারীর শরীর, শরীরকে ঘিরে প্রকৃতির পরিবর্তন, শরীরে ব্যবহৃত পরিচ্ছদ সবই যেন এক ধারালো বেস্নডের সাহায্যে গড়ে উঠেছে। সেফটিপিন, স্টেইনলেস বেস্নডের পুনঃপুন ব্যবহারের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন নারীর পরিচ্ছদ, অমত্মর্বাস, নারীর হাতে ব্যবহৃত সেলাই মেশিন, হাই হিল, ফ্লাট হিল, হ্যান্ডব্যাগ, বাথটাব।
তৈয়বা বেগম লিপির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামাজিক, পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতার মিশ্রণে একটি সত্য চিহ্নিত হয়েছে যে,
পৃথিবীব্যাপী নারী এখন পর্যমত্ম অনিরাপদ; সংস্কারের মধ্যেই তাদের দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। সমাজভাবনা ও সমাজব্যবস্থার মধ্যেই নারীকে হেয় করে তোলা হয়েছে। তৈয়বা বেগম লিপির নারীবিষয়ক গবেষণার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই এ-প্রদর্শনীর কাজে। নারীর রোজকার ব্যবহৃত ভ্যানিটি ব্যাগ, উঁচু জুতা, সেলাই মেশিন – এসব বিষয়কে তিনি তৈরি করেছেন সেফটিপিন ও স্টেইনলেস স্টিল রেজর বেস্নডের সাহায্যে। নারীর পথ বাধাগ্রস্ত, অমসৃণ ও ধারালো সূক্ষ্ম পিনের মতো, সেটিকে প্রকাশ করেন তিনি এভাবে।
তৈয়বা বেগম লিপির একক প্রদর্শনীগুলো থেকে তাঁর শিল্পকর্মের বিষয় ও ধরন সম্পর্কে আমরা ধারণা পাই।
২০০৭-এ বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসে ‘ফেমিনিন’,
২০১১-তে ভেনিস ইন্টারন্যাশনাল আর্ট বিয়েন্নালে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে ‘প্যারারাল’, ২০১১-তে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা আর্ট বিয়েন্নালে, ২০১২-তে শ্রীলংকায় কলম্বো আর্ট বিয়েন্নালে ও ২০১২-তে ঢাকা আর্ট সামিট বাংলাদেশে তাঁর নারীবাদী বিষয় নিয়ে উপস্থাপনা দেখা যায়। ২০১৫-তে নয়াদিলিস্নতে অ্যাম্পায়ার গ্যালারিতে ‘রিভার্সাল রিয়েলিটি’, ২০১৩-১৪ সালে লন্ডনের ইস্টানবুল গ্যালারিতে ‘নেভার বিন ইনটিমেট’ শিরোনামের কাজে নারীর ব্যক্তিগত বিপর্যয় থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বিষয় উপস্থাপন করা হয়।
এবারের প্রদর্শনীতে পেনসিলে রেখা ও আলো-ছায়ার সাহায্যে নিজের শরীরী কিছু পরিবর্তনের চিহ্ন উপস্থাপন করেছেন। ‘ট্রানজিশান’ শিরোনামের এ-কাজগুলোতে নারীর পোস্ট মেন্সট্রুয়েশন সময়ের শরীরের কোষগ্রন্থির অবস্থাকে প্রকাশ করেছেন। চুলের সঙ্গে চিরুনির সম্পর্ক উলেস্নখ করে নারীর সময় পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন ‘ট্রানজিশান’ ছবিগুলোতে।
এ-প্রদর্শনীর মোট কাজকে আমরা তিনটি ভাগে দেখতে পারি। এক ধরনের কাজ, যেটি পেনসিল মাধ্যমে হ্যান্ডমেড কাগজে করা। দ্বিতীয় মাধ্যমটি হলো স্টেইনলেস স্টিল রেজর বেস্নড ও সেফটিপিনের সাহায্যে গড়ে ওঠা ভ্যানিটি ব্যাগ, জুতা (হাইহিল, ফ্লাট শু), সেলাই মেশিন, বাথটাব ইত্যাদি, অন্য মাধ্যমটি হলো ভিডিও আর্ট।
‘সিক্রেট’-২ শিরোনামের কাজটিতে স্টেইনলেস বেস্নড পাশাপাশি জোড়া দিয়ে হাতব্যাগটি গড়ে তুলেছেন, যে-ব্যাগ নারীর গোপন কিছু কথা লুকিয়ে রাখে আবার সেইসঙ্গে কিছু সাজসরঞ্জাম আড়াল করে দেয়।
‘ওম্যানহুড’ শিরোনামে তৈরি করা চারটি বস্নাউসের আকৃতি তৈরি করা হয়েছে স্টেইনলেস স্টিল রেজর বেস্নডস দিয়ে। নারীদেহ আবৃত করার প্রাচ্যের এ-পোশাকটি ধারালো বেস্নডে তৈরি করে ঘোষণা দেন নারীর বন্দিদশাকে।
স্টেইনলেস স্টিল-নির্মিত রেজর বেস্নড ও সেফটিপিন ব্যবহার করে শিল্পকর্ম সৃষ্টি সম্পর্কে লিপি বলেন, ‘আমি সাধারণত এমন এক মাধ্যম নিয়ে শিল্প সৃষ্টি করি যে, প্রতিনিয়ত আমরা ব্যবহার করি। যেমন- মেয়েদের হাতব্যাগ, যার ভেতরে কী আছে সেটি আমরা কেউ জানতে পারি না। ব্যাগটি হয়ে যায় জীবনযাত্রার অগ্রণী মাধ্যম। এটি নারীর জীবনকে খানিক এগিয়ে দেয়। রেজর বেস্নডের ইমেজটি আমার ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দেয়। যখন আমি ছোট, ১২ বছর বয়স। আমার নিকটাত্মীয় সে-সময়ই সংসার শুরু করে। এ সময়ের মতো ম্যাটারনিটি হসপিটালে যাওয়ার প্রচলন শুরু হয়নি। তাই শিশু জন্মদানের সময় দাইমা বা ধাত্রীর কাছেই সবাই যেত। এটি এক গ্রামীণ নারীর জীবনের অভিজ্ঞতা। রেজর বেস্নডের সাহায্যে শিশুর জন্মগ্রহণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো। এটি আমার মনে গেঁথে থাকে সেই ছোটবেলা থেকেই।’
‘লেটস টেক অ্যা ব্রেক’ শিরোনামে তৈরি করা বাথটাবে স্টেইনলেস স্টিলের শিটের পাত ও স্টেইনলেস স্টিলের বেস্নড ব্যবহার করা হয়। এ প্রসঙ্গে শিল্পী জানান, বাথটাবে আমরা খানিক বিশ্রাম নিই। কিন্তু এ-শিল্পকর্ম আমাদের খানিক দূরত্ব তৈরি করে দেবে।
‘রিকলিং’ শিরোনামে তৈরি করা সেলাই মেশিন গড়ে উঠেছে স্টেইনলেস স্টিল রেজর বেস্নড দিয়ে। সেলাই মেশিনে নারী স্বপ্ন বুনে সেলাই করে পোশাক আর পরিচ্ছদ। সে-স্বপ্নের বুননের সঙ্গে ধারালো বেস্নডের বুনন মিশে আছে।
এ প্রদর্শনীর দুটি ভিডিও আর্টে দু-রকমের অভিজ্ঞতা বর্ণনা
করা হয়েছে। ‘লিটল লার্নার’ শিরোনামের ভিডিওতে দেখা যায়, শিল্পী নিজেই দুটি চরিত্রে অবস্থান করছেন। একটিতে বাংলা শিক্ষার বুলি আওড়াচ্ছেন, অন্যটিতে আরবি বর্ণমালা উচ্চৈঃস্বরে পাঠ
করতেন।
এক সময় বর্ণমালা পাঠরত মানুষটি সরে যায় ছবি থেকে। তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তিটিও সরে যায়। এক সময় শুধু পড়ে থাকে আরবি বর্ণমালার বইটি। ভাষাগত দ্বন্দ্বের এ-জাঁতাকলে মানুষ কতটা বিভ্রামত্ম আর ক্লামত্ম সেটি দেখানো হয়েছে এ-ছবিতে।
দ্বিতীয় ভিডিও আর্টের বিষয়ে রয়েছে একটি গোরস্তানের অভ্যমত্মরীণ চিত্র। কবরটি হাজি ভেটু মহম্মদ বেপারীর। ১৯৩০ সালে কবরটি নির্মাণ করা হয়। কবরের দেয়াল পরিষ্কার করছেন শিল্পী নিজেই। তিন মিনিটের এ-ভিডিওচিত্রের দ্বিতীয় চ্যানেলে দেখা যায় একটি জলের কুয়া। কুয়ার ভেতরে
থাকা অল্প পানির অবস্থা দেখা যায়। মানবজীবনের সর্বশেষ এ-পরিবর্তনের ভাবনা দেখা যায় ভিডিও আর্টে।
মানবজীবনের সঙ্গে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির যে-যোগসূত্র শিল্পীর কাছে আরাধ্য হয়ে ওঠে সেটি মূর্ত হয়ে ধরা দেয় শিল্পকর্মে। প্রকৃতপক্ষে একজন শিল্পী যা সৃষ্টি করেন তা সমাজবাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। তৈয়বা বেগম লিপির শিল্পকর্ম শুধু নারীজীবনকে ঘিরে। তার নারীবাদী প্রকাশ কখনো কখনো সমাজ সভ্যতার প্রকাশ হিসেবে মূর্ত হয়ে ওঠে। বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে গত ৫ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনীটি শেষ হয় ৯ জানুয়ারি।