ওয়ে আউট

ওয়াসি আহমেদ

প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রীর কথাগুলো এলোমেলো শোনাচ্ছিল, যেমন – প্রায়ই শোনায় প্রসঙ্গ থেকে অপ্রসঙ্গে তার খেইহারা ছোটাছুটিতে। তবে গত তিন বছরে ইংরেজি-বাংলার জগাখিচুড়িতে ভদ্রলোক কথা বলার যে-প্যাটার্নটা জনসমক্ষে মোটামুটি দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন, তা ফলো করতে গিয়ে তারেকের মনে হলো, মন্ত্রী একের পর এক জটিল বিষয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করলেও সারকথাটা বেশ সোজাসাপ্টা। ইন্ফ্লেশন, স্টক মার্কেট, লিকুইডিটি ক্রাইসিস, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে দ্রুত চক্কর কেটে করাপশন-টরাপশনে আলতো ঢুঁ মেরে সবকিছুর মোক্ষম সমাধান বাতলাতে উই আর কন্ফিডেন্ট বলে, ভারী কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঘিরে ধরা মিডিয়া বাহিনীকে আশ্বস্ত করতে এবং নিজেকেও মুক্ত-নির্ভার করতে লাফটা দিলেন – উই উইল হ্যাভ আওয়ার ওয়ে আউট।
তারেক শুনল সারকথা। অব্যর্থ ওয়ান লাইনার। মন্ত্রীকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সংসদের বাজেট অধিবেশনে টানা পৌনে চার ঘণ্টার বাজেট বক্তৃতা। শেষদিকে রীতিমতো হাঁপাচ্ছিলেন, গলা ধরে এসেছিল, পানি খাচ্ছিলেন ঘনঘন। সংসদ থেকে বেরিয়ে অল্প বিরতিতে প্রেস ব্রিফিং। গাদাগাদি ভিড় থেকে তারেক পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল, ক্লান্তিতে ভদ্রলোকের চোখ-মুখ বসে যাচ্ছে। এ অবস্থায় লাফটা দেশের অর্থনীতির হাল ফেরানোর চেয়ে ক্লান্তি দূর করার জন্যই হয়তো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছিল।
রাতে ঘরে ফিরে টেলিভিশনে মন্ত্রীর হাসিমুখ দেখে তারেক ভাবল, তখন কী দেখলাম! ক্লান্তি-টলান্তি কোথায়? মন্ত্রী তড়বড় করে এক বিষয়ে থেকে অন্য বিষয়ে ছুটছেন। বোঁচা মুখে অন্তত একডজন টিভি ক্যামেরার কামান দাগানো আলো, ফর্সা টাকটাকে দেখাচ্ছে গোলগাল আলোকস্তম্ভের মতো। কাঁধ নাচানোর তালে আলোটা বারবার ঝাঁকি খাচ্ছে। প্রেস ব্রিফিংয়ে সে পরিষ্কার দেখেছিল, ক্লান্তিতে-অবসাদে চোখ-মুখ বসে যাচ্ছে। এখন? তাকিয়ে থেকে তার মনে হলো, ভুল তো হতে পারে না, আলোর ফোকাসটাই নিশ্চয় কারণ। এত আলোতে বসে যাওয়া চোখ-মুখ ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। তারেক দেখল, খুঁটিয়ে দেখল, ভদ্রলোকের থুঁতনিতে-গলায় চিকচিক ঘাম, মেরুন টাইটা হতে পারে নতুন (বাজেট বক্তৃতা উপলক্ষে হতে পারে ছোট মেয়ের উপহার বা ছেলে যদি থেকে থাকে, ছেলের বউয়ের বা তাঁর স্ত্রীর হওয়াও বিচিত্র নয় বা জগতে কিছুই অসম্ভব নয় – ষাট বছর ধরে তাঁকে হৃদয়ে লালন করা নিঃস্বার্থ প্রেমিকার), গাঢ় ছাই রঙের স্যুটটা নতুন না হলেও ফ্রেশলি লন্ডারড, ল্যাপেলে ভাঁজ-টাজ নেই, শাদা শার্টের অাঁটো কলার বেশি বেশি শাদা। তারেক দেখল, মন্ত্রী ছুটছেন। একটু আগে ছিলেন ডমেস্টিক রিসোর্স মবিলাইজেশনে, পরপরই ইন্ফ্লেশনে, এ মুহূর্তে ইন্টারেস্ট রেটে। সারা দুনিয়ায় পারসোনাল সেভিংস ডিসকারেজ করতে যেখানে ব্যাংক ইন্টারেস্ট রেট তিন থেকে পাঁচ পার্সেন্ট, আমরা সেখানে কী করছি – সেভিং প্রমোট করে যাচ্ছি অ্যাজ আ ডিস্ইনসেনটিভ টু ইনভেস্টমেন্ট। পাশের দেশ ভারতে খোঁজ নিলে দেখবেন, ওরা কত অ্যালাও করছে – নট মোর দ্যান ফাইভ টু সিক্স পার্সেন্ট অ্যাজ অ্যাগেইনস্ট মোর দ্যান টুয়েলভ ইন আওয়ার সিস্টেম। দিস ইজ সুইসাইডাল। দেশে ইনভেস্টমেন্ট বাড়বে কী করে! আর লিকুইডিটি! ইভেন পাঁচ-ছয় মাস আগেও নো বডি বদারড অ্যাবাউট লিকুইডিটি, এখন শুনি ব্যাংক খালি। গেল কোথায়? স্টক মার্কেট ক্রাশ করার সঙ্গে সঙ্গে টাকার কি পাখা আছে যে থাউজেন্ডস অব ক্রোরস ভ্যানিশ হয়ে গেল। হুম ডু আই ব্লেম? মুখের ভঙ্গিতে কিন্তু তেমন ভাঙচুর হলো না, হাসির রেখাটা অটুট। এডিপি ইমপ্লিমেন্টেশন নট আপ টু স্যাটিসফেকশন, যে-কারণে পাওয়ার সেক্টরে, কমিউনিকেশন সেক্টরে, কোনো প্রগ্রেসই নোটিশেবল নয়। পাওয়ার শর্টেজে মিল-ফ্যাক্টরি আপ টু ক্যাপাসিটি রান করতে পারছে না। ইরিগেশনেও সিরিয়াস প্রবলেম।
তারেকের চোখ একদৃষ্টিতে স্থির, হাসিটা দেখতে পাচ্ছে এখনো। সে সাবধান হলো, এখনই কি সময় লাফ দেওয়ার, নাকি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে তিনি আরো ছোটাছুটি করবেন? মন্ত্রী পোভার্টিতে গেলেন, আনএমপ্লয়মেন্টে গেলেন; তারপর তারেক যখন ভাবছে, যাওয়ার জায়গার তো অভাব নেই, কত অলিগলি, আরো হয়তো এদিক-ওদিক ঘুরবেন, তখনই সে পরিষ্কার দেখল, এত আলো-টালোর মধ্যেও মন্ত্রীর চোখজোড়া হঠাৎ করেই ফ্যাকাসে, চোয়াল ঝুলে পড়ছে, সঙ্গে কাঁধও, আর মুখে সেই ওয়ে আউটের বুলি। তারেক নিশ্চিত হলো, লাফ ছাড়া কী! ওয়ে আউট। এক লাফে পগারপার। গোড়াতে হাসিটা তারেককে বিভ্রান্ত করছিল। আসলে হাসি না। কথা বলার সময় নিচের ঠোঁট ডানদিকে এলিয়ে হাসির মতো ছড়িয়ে পড়াই কারণ।
দিন-তিনেক পর মহাখালী ফ্লাইওভারে ঘণ্টাখানেক জ্যামে আটকে সিএনজিতে হাঁসফাঁস করতে করতে বেখেয়ালে আঙুল মটকানোর মতো বা উটকো একটা হাই তোলার মতো তারেক ভাবল, লাফিয়ে যদি পড়তে পারত! ভাবামাত্র গরমে দমবন্ধ অবস্থায়ও হাসি পেল; আর আশ্চর্য, চেষ্টা করেও সে হাসিটাকে সামলাতে পারল না। গলায় খিইক আওয়াজ তুলে মুখ ফুটে হাসিটা বেরিয়ে পড়তে সিএনজি ড্রাইভার – মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে মনে হচ্ছিল – ঘাড় ঘুড়িয়ে কটমট চোখে ধমকালো, হাসেন কেন? তারেক ভাবল, লাফানোর কথাটা বলে। কিন্তু তাতে হাসির কী, লোকটাকে কেমন করে বোঝাবে! কটমট চোখের কারণেই হবে, তারেক চোখে-মুখে স্বাভাবিক, মানে ত্যক্তবিরক্ত ভাব এনে বলল, শালার জ্যাম। ড্রাইভার ঘাড় সোজা করে শরীর ঝাঁকিয়ে বসল। টিনের ড্যাশবোর্ডের গর্ত থেকে ময়লা গামছার টুকরা বের করে হাতে-ধরা ছোট স্ক্রু ড্রাইভার ঘষে ঘষে মুছল। গামছার টুকরাটা পুঁটলি পাকিয়ে গর্তে ভরতে ভরতে নিজেকে শোনানোর তুলনায় জোর গলায় টেনে টেনে বলল, এ্যাই ফেলাইওভার হওনের আগে ব্যাকতে কইছিল, টাইনা আরো দূর নেওন লাগব। মাংগির পুতেরা হুনে নাই। লোকটা নিজেকে নিজে বললেও শ্রোতা হিসেবে তারেকের একটা প্রতিক্রিয়া হলো। আরো বানাচ্ছে তো – ফ্লাইওভার, সে বলল। একটু থেমে, লম্বা লম্বা। ভেবেছিল, লোকটা সাড়া দেবে। দিলো না, স্ক্রু ড্রাইভার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডান কানটা ধীরে-শান্তিতে খোঁচাতে লাগল। কাজটা চালাতে চালাতে তার হয়তো আরামে চোখ বুজে এসেছিল, বুজে আসারই কথা। কারণ, খুব আরামের ভেতর থেকে আরামের আমেজে আধো জড়ানো গলায় মাংগির পুতটা সে আবার বলল।
তারেক বুঝতে পারল না, তাঁকে কী করে ফ্লাইওভার পেয়ে বসল। লক্ষ করল, লোকজন যেখানে-সেখানে ফ্লাইওভার নিয়ে কথা বলছে। শহরে বেশ কটা ফ্লাইওভার – এখনো ওঠেনি – হইহই করে উঠব উঠব করছে। পত্রপত্রিকায় ছিল এতদিন। লেজে-মাথায় কোনটা কত লম্বা, কোথায় শুরু কোথায় শেষ, কোনটা ছাড়িয়ে কোনটা – এসব গণ-হিসাবনিকাশের বাইরে নকশা-টকশার ওপরও খবরাখবর থাকত। পত্রিকার পাতা ছেড়ে এবার মানুষের মুখে, খাচ্ছে যে যার মতো। মালিবাগ সোহাগ বাস কাউন্টারের সামনে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে তারেক বাসে উঠবে, এক বুড়ি ভিক্ষা চাইতে এসে নতুন চাল চালল, দ্যান বাবা, আর তো নিচে ঘুরাফিরা করবেন না, উরপে উরপেই থাকবেন। নতুন কথায় কি না, তারেক পাঁচটা টাকা দিলো। বুড়ি বলল, ফেলাইউবারে ভিক্ষা করতে দিব?
তারেক তাঁর পত্রিকার অর্থনীতি পাতায় যেসব স্টোরি করে, সেখানে দ্রব্যমূল্য, ব্যালেন্স অব ট্রেড, ট্রানজিটের বাইরে ইদানীং পা ফেলার সুযোগ মেলে না। কদাচিৎ শেয়ারমার্কেট, ইনভেস্টমেন্ট বা অন্য কিছু। মাথায় ফ্লাইওভার গেড়ে বসার পর তক্কে-তক্কে আছে, কোথায় কীভাবে একে পাঞ্চ করা যায়। পোস্টবাজেট প্রেস ব্রিফিংয়ে মেরুন টাই পরে মন্ত্রী ওয়ে আউটের পথ করে নেওয়ার কথা বলেছিলেন। তারেক যার মানে করেছিল – লাফ। পথ করে নেওয়া চাট্টিখানি কথা! এত জঞ্জাল পথে পথে। লাফানো ছাড়া উপায় কী! ফ্লাইওভারের সঙ্গে কোথায় যেন দুর্দান্ত মিল। চারদিকে এত যে লোকজন কথা বলছে, ফ্লাই করবে বলে দিন গুনছে, জঞ্জালগুলো লাফিয়ে পেরোতে চায় বলেই তো। ভাবতে গিয়ে মন্ত্রীর লাফটা খাপছাড়া, নাটকীয় কিছু মনে হয় না। নিজের উপলব্ধি তারেককে চমকে দেয়। মন্ত্রীর লাফানোটা তাহলে বিসদৃশ নয়, কার্যকারণময় স্বাভাবিক। এত্তা জঞ্জাল, লাফানো ছাড়া…
কাগজে বা মানুষের মুখে মুখে ফ্লাইওভারের পাখা গজালেও তারেক মনে করতে পারে না কোনটা কোনদিকে উঠছে, সংখ্যায়ই-বা কতটা। অফিসে পাশের কিউবিকলে ‘এই নগর এই জনপদ’ পাতার সহ-সম্পাদক জামশেদকে প্রশ্নটা করবে, কি করবে না ভেবে করেই ফেলে। জামশেদ চোখ টিপে গলা নামিয়ে বলে, লাগবে নাকি, ফ্লাইওভার? তারেক থতমত খেয়ে বলে, মানে? জামশেদ ল্যাপটপের মনিটরে চোখ নামিয়ে তেমনি নিচু গলায় বলে, ভণিতা করছেন কেন? লাগলে বলবেন – কটা লাগবে? রহস্য ধরতে না পেরে তারেক বলে, যে-কটা আছে। চোখ-টেপা হাসিটাকে ভালোমতো ছড়িয়ে জামশেদ বলে, বাহ্, সব কটা কী করবেন? বলতে বলতে ল্যাপটপের মুখটা তারেকের দিকে ঘুরিয়ে বলে, দ্যাখেন।
তারেক একনজর তাকিয়ে আশপাশে চোখ ঘোরায়, কেউ নেই, কিউবিকলে দেয়ালগুলোও উঁচু।
জামশেদ বলে, কী হলো?
এভাবে অফিসে বসে বসে!
আরে, ভার্চুয়াল সেক্সের মতো আছে নাকি আর কিছু! সারা দুনিয়ার মানুষ অফিসে বসেই দেখে। দেখতে দেখতে কাজের উদ্দীপনা জাগায় আর দিনে দিনে মেপে মেপে পোটেন্সি খোয়ায়। আমি বাদ যাই কেন? ও হ্যাঁ, ফ্লাইওভার। এক মিনিট।
জামশেদ ল্যাপটপে একটা ফোল্ডার খোলে। ঢাকা ফ্লাইওভার প্রজেক্টস। তারেক দেখে, গোছগাছ করে রাখা একের পর এক ফ্লাইওভার বৃত্তান্ত। যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান, কুড়িল-পূর্বাচল, মগবাজার-মৌচাক, মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোড। ম্যাপ ও ডিজাইনের নানা কারিগরি খুঁটিনাটিসহ বিস্তারিত তথ্যভান্ডার। কী, ইমপ্রেসড? তারেক ভুরু কুঁচকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। জামশেদ বলে, ইমপ্রেসড না হয়ে উপায় নেই, অন্তত অন পেপার, থুক্কু মনিটর। কত কত জায়গা কাভার করবে দেখেছেন? যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তানের একটা ঠ্যাং কোথায় এসে ঠেকবে জানেন – এই পলাশীতে। ভাবতে পারেন, মাত্র কুড়ি-পঁচিশ মিনিটে পলাশী বা এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ে – এখনকার আড়াই-তিন ঘণ্টার পথ! স্টিল নট ইমপ্রেসড? তাহলে শোনেন, সব কটা ফ্লাইওভারেই স্টেট অব দি আর্ট টেক্নোলজি – প্রিকাস্ট, প্রিস্ট্রেস সেগমেন্টেড বক্স… ধুর, এসব আপনাকে কেন বলছি, বুঝবেন? ঠিক আছে, বলেই যখন ফেলেছি, ফ্লাইওভারের সঙ্গে কানেকটেভ থাকছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, এমআরটি। এমআরটির এবরিভিয়েশন জানেন? আর যেন কী… মনোরেল। এই মনোরেল চিজটা আজো মাথায় ঢুকল না। যোগাযোগমন্ত্রী বেশ কয়েকবারই খুব ইলোকোয়েন্টলি ব্যাপারটা সংবাদ সম্মেলনে বোঝাতে চেয়েছেন, শুনতে শুনতে মনে হয়েছে, মনোরেলে চড়ে মেরিলিন মনরোর ফাঁপানো স্কার্টের ঝাঁপিতে ঢুকে পড়ছি। শুধু আমি না, যারা ছিল সবাই। এবার নিশ্চয়ই আপনি কনভিন্সড? ট্রাফিক জ্যাম-ট্যাম চোখেও দেখবেন না; উড়ালে উড়ালে জ্যাম পার। পারফেক্ট এলিভেশন।
নিজের জায়গায় ফিরতে ফিরতে তারেক ভাবে, মুখে জামশেদকে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে সে সত্যিই ইমপ্রেসড। এত কান্ড হচ্ছে, সে এত দিন খাপছাড়াভাবে পড়েছে বা শুনেছে। গুছিয়ে মাথায় রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। এবার রাখা যাবে ভেবে সে তার ডেস্কটপের ইন্টারনেট ব্রাউজারে মন দেয়। অনেকটা কারুকাজখচিত সাইট – ফ্লাইওভারের। একটু আগে জামশেদের ল্যাপটপের ছোট মনিটরে ভুরু-চোখ কুঁচকে দেখতে হয়েছিল, এবার টানটান ভুরু-চোখ মেলে দেখে। এলিভেশন কথাটা কানে রয়ে গেছে। থাকুক, লাফ-টাফের চেয়ে শুনতে ডিগনিফাইড।
এত করেও পাঞ্চ করার সুযোগ তারেক পায় না। মানে, ফ্লাইওভারকে অর্থনীতি পাতায়। তাই বলে মন খারাপ করে না। মনে মনে সে আরো ফ্লাইওভারের কথা ভাবে। দিনের বেলা একটা নিয়ে ভাবে তো রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাথায় আরেকটা গজায়। পরদিন দেখা যায়, আগেরগুলো ফেলে-ছুড়ে নতুন একটা নিয়ে মেতে আছে। শেষমেশ মাথা ঠান্ডা করে একটা-দুটো নয়, কাগজ-পেনসিল নিয়ে বসে টানা লম্বা অনেক কটার নকশা করে। এ পর্যায়ে বেশ স্বস্তিবোধ করে। হ্যাঁ, এবার পারফেক্ট এলিভেশন, মাটিতে পা পড়বেই না। এর মধ্যে একটা বেশ বৈশিষ্ট্যময়; তার লালমাটিয়া ডি-ব্লকের ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে শুরু হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে কোথায় যে চলে গেছে, তাকিয়ে যতদূর চোখ যায়, তারেক শুধু রংধনুর মতো তার নিজস্ব ফ্লাইওভারের উজ্জ্বল মসৃণ ঢেউখেলানো পিঠটাকেই দেখতে পায়। দেখে আর ভাবে, এতে চড়ে চাইলে সবকিছু ছাড়িয়ে-মাড়িয়ে কোথায় না যাওয়া সম্ভব! পথঘাটের জ্যাম তো জ্যাম, নিচে তাকানোর দুর্ভোগ পর্যন্ত পোহাতে হবে না। তার মনে পড়ে, কবে যেন ভেবেছিল এক লাফে পগারপার। কী নিয়ে যেন? ওহ্, বাজেট-পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে অর্থমন্ত্রীর ওয়ে আউট নিয়ে। ঠিক, ওয়ে আউট। এ হলো সত্যিকার পথ করে নেওয়া। শুধু ট্রাফিক জ্যাম থেকে তো নয়।
অল্পদিনে তারেক বোঝে, মুখে মুখে যত্রতত্র ট্রাফিক জ্যাম ট্রাফিক জ্যাম করলেও ফ্লাইওভারের পেছনে মূল প্রেরণাটা অন্য। প্রেরণাটা সাবধানে সযত্নে বুকে আগলে গোপন করে আছে সবাই। কেউ কাউকে জানতে দিচ্ছে না, বুঝতে দিচ্ছে না। বেচারা মন্ত্রী ইন্ফ্লেশন, শেয়ারমার্কেট, দ্রব্যমূল্য, লিকুইডিটি ক্রাইসিসে জেরবার হয়ে মুখ ফস্কে বা হাসির মতো ডানদিকে এলিয়ে পড়া নিচের ঠোঁটকে কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হয়ে বলেই ফেলেছেন। মন্ত্রী-টন্ত্রীদের সাবধান হওয়া দরকার। যারা বোঝার, তারা ঠিক বুঝে গেছে। আর কেই-বা না বুঝবে, বুকে আগলে গোপন করে আছে সবাই।
তো, সেই বুড়ি ভিক্ষুকের সঙ্গে আবার তারেকের দেখা। নতুন কী শোনাবে ভেবে সে কৌতূহলী হলো। বাবা একখান কতা – বলে বুড়ি কাছ ঘেঁষতে তারেক কান খাড়া করল। ফেলাইউবারে হাগতে দিব?