কথাকোবিদ সৈয়দ শামসুল হক

আহমেদ মাওলা
থেমে গেছে সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) সোনালি কলম। স্বপ্নময় আরেকটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। আর তাঁকে দেখা যাবে না বইমেলা, কবিতা উৎসবে, আড্ডায়, কিংবা সংকটে-সংগ্রামে, সেই প্রিয় মুখ। খুব কাছে থেকেই অনেকে বুঝতে পারেননি তাঁর মহত্ত্ব কিংবা বৃহৎ আয়তনের গুরুত্ব। খুঁজে পাননি তাঁর সৃষ্টিশীল ভুবনের কূলকিনারা। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হকের মতো আরেকজন লেখকের জন্ম হবে কি-না জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, এই কৃতী লেখক বিভাগোত্তর সাহিত্যকে যেভাবে পালটে দিয়েছেন, আর কোনো একক লেখকের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কাব্যনাটক, প্রবন্ধ, অনুবাদ, গান, চলচ্চিত্রের কাহিনি – এক হাতে সৈয়দ হককে কত কিছুই না করতে হয়েছে! সব্যসাচী নামটা এভাবেই যুক্ত হয়ে যায় তাঁর নামের সঙ্গে। সাহিত্যের আগন্তুক ঋতুর মতোই সৈয়দ হকের সৃষ্টিসম্ভার সীমানা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে উজ্জ্বল, অমলিন, চিরায়ত উচ্চতায়।
আমি মনে করি, দেশভাগের পর ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক একটি মাইলফলক। যিনি ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যকে গ্রামনির্ভরতা থেকে প্রথম নাগরিকমনস্কতায় তুলে ধরেন। পঞ্চাশের দশকে, তখনো ঢাকায় নগরায়ণ, আধুনিক নাগরিকতার ছোঁয়া লাগেনি। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তখন সবেমাত্র গড়ে উঠছে। সৈয়দ শামসুল হক সেই গড়ে-ওঠা নগরজীবন ও নাগরিকদের জীবনচিত্র তুলে ধরেন তাস (১৯৫৪) গল্পগ্রন্থে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেমন এককালে চরিত্রহীন উপন্যাস লিখে বাংলা সাহিত্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন, তেমনি সৈয়দ শামসুল হক ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন খেলারাম খেলে যা (১৯৬২) উপন্যাস লিখে। আধুনিকতার প্রধান কথাটি হচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। আত্মসচেতনতা মানুষকে সমাজ-শরীর থেকে আলাদা করেছে, বিচ্ছিন্ন করেছে, স্বভাবের অবিকল অনুসারী করেছে। স্বভাবী-অস্বভাবী উপাদানাবলি, সেও জীবনেরই একটি বিশেষ এলাকা। উপন্যাস লিখতে বসে সৈয়দ শামসুল হক আত্মসচেতন, ব্যক্তিমানুষের জীবনকেই বেছে নিয়েছেন। সেই সময় ওরকম দুঃসাহসী, নিরীক্ষাপ্রবণ, উদ্ভাবনী শক্তির ওপর ভিত্তি করে উপন্যাস রচনার কথা কেউ চিন্তাই করেনি। খেলারাম খেলে যা – প্রথম প্রকাশেই বিতর্কের ঝড় উঠেছিল পাঠকমহলে। অভিযোগ উঠেছিল অশ্লীলতার। একই সঙ্গে নিন্দিত এবং অভিনন্দিত হয়েছেন সৈয়দ হক। তিনি লিখেছেন, ‘খেলারাম খেলে যা রচনার প্রায় কুড়ি বছর পরও এর জন্য আমাকে অন্যান্য রচনার চেয়ে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয়। খেলারাম খেলে যা এদেশে সবচেয়ে ভুলবোঝা উপন্যাস। না, এ-উপন্যাসের জন্য আমি লজ্জিত নই, বরং আমি লজ্জিত তাদের জন্য, যারা উপন্যাসের নেপথ্য একটি চরিত্র – বাবর আলীর বোনকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে কেবল বাবলী বা জাহেদার কথা মনে রাখে’ (ভূমিকা, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, ১৯৯০)। বাবর আলীর বোন হাসনু হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্যে বাবর আলীর উত্তরকালের জীবনযাপনের একটা সূক্ষ্মসূত্র
খুঁজে পাওয়া যায়। লাগামহীন মদ্যমাতাল বাবর আলী বলে – ‘হা-হা। আমার কেউ নেই। কেউ নেই। কোনো কিছু আমার নয়। না মাটি, না মন, না মানুষ।’ এয়ারপোর্টের বাথরুমের দেয়ালে লেখা – খেলারাম খেলে যা। যে লিখেছে সে জগৎ চেনে। যে লিখেছে সে নিজে প্রতারিত। পৃথিবী সম্পর্কে তার একটিমাত্র মন্তব্য বাথরুমের দেয়ালে সে উৎকীর্ণ রেখেছে – ‘আমরা নিমজ্জিত হই, সেই নক্ষত্র প্রতিফলিত নদীতে, গড়িয়ে পড়ে গাড়ি জাহেদাকে নিয়ে, বাবরকে নিয়ে।’ অর্থাৎ পতন, এই একটি বাক্যে দাঁড়িয়ে আছে পুরো উপন্যাস। সভ্যতার আবরণ খুলে যেন আমাদের সামনে এসে বলে – আমি হাসনু, আমি লতিফা, আমি বাবলী, আমি জাহেদা এবং আমি বাবর আলী। উন্মোচিত হয় আমাদের সামনে এক বিপন্ন বিস্ময়। ইস্ত্রি করা শার্টের নিচে ঢেকে রাখা ক্ষতের মতো যার কিছু অংশমাত্র উন্মোচন, দৃশ্যমান করে দেখিয়েছেন সৈয়দ হক। খেলারাম খেলে যা বাংলাদেশের একটি সাবালক উপন্যাস।
সৈয়দ শামসুল হকের অন্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে – এক মহিলার ছবি (১৯৫৯), অনুপম দিন (১৯৬২), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪), নীল দংশন (১৯৮১), স্মৃতিমেধ (১৯৮৬), মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬), স্তব্ধতার অনুবাদ (১৯৮৭), এক যুবকের ছায়াপথ (১৯৮৭), স্বপ্ন সংক্রান্ত (১৯৮৯), বারো দিনের শিশু (১৯৮৯), বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল (১৯৮৯), ত্রাহি (১৯৮৯), তুমি সেই তরবারী (১৯৮৯), কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন (১৯৮৯), বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (প্রথম খ- ১৯৮৯, দ্বিতীয় খ- ১৯৯০), শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (১৯৯০), নির্বাসিতা (১৯৯০), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০), দ্বিতীয় দিনের কাহিনী (১৯৯০), বালিকার চন্দ্রযান (১৯৯০), আয়না বিবির পালা (১৯৯০), মেঘ ও মেশিন (১৯৯১), ইহা মানুষ (১৯৯১), মহাশূন্যে পরান মাষ্টার (১৯৯২), জেসমিন রোড (১৯৯২), টান টান (১৯৯৪), চোখবাজি (১৯৯৪), অন্তর্গত (১৯৯৫), দূরত্ব (১৯৯৫), আমি বাসি, তুমি বাস তো (১৯৯৬), অন্য এক আলিঙ্গন (১৯৯৬), এক মুঠো জন্মভূমি (১৯৯৭), বাস্তবতার দাঁত ও করাত (১৯৯৯), বুকঝিম ভালোবাসা (২০০১), অচেনা (২০০৩), রাজার সুন্দরী (২০০৭), কেরানির দৌড় (২০১৫) অসমাপ্ত।
তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে রয়েছে প্রকরণ পরিচর্যা, শ্রমনিষ্ঠার স্বাক্ষর। ভাষার সৌকর্য ও কারুকার্য পাঠককে বিস্মিত করে। ঘনপিনদ্ধ এক ভাষাভঙ্গি ছিল তাঁর আয়ত্ত। ইংরেজি ভাষায়ও তাঁর সমান দক্ষতা থাকার কারণে সৈয়দ হক বাংলা ভাষাটাকে প্রবহমান স্রোতের মতো উপন্যাসে প্রয়োগ করেছেন। সৈয়দ হকের গদ্যভাষা আন্তর্জাতিক মাত্রায় উন্নীত। কবিতায় কিংবা কাব্যনাটকে তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেছেন আঞ্চলিক শব্দ, উচ্চারণ, কিন্তু উপন্যাসে তিনি একটি পরিশীলিত, পরিমার্জিত প্রবহমান গদ্যে কাহিনি বর্ণনা করেছেন। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে জীবনকে নতুন করে আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনার প্রচেষ্টা বিদ্যমান। বালিকার চন্দ্রযান, তুমি সেই তরবারী এবং অন্য এক আলিঙ্গন – এ তিনটি উপন্যাস লন্ডনের পটভূমিতে বাঙালিদের গল্প। পাশ্চাত্য সমাজ-সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়া বাঙালিদের শেকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণা, উল্লম্ফন, বাস্তবতা ও অস্তিত্বের টানাপড়েন, তৃষ্ণার্ত প্রেমের আত্মলীন, অনুতাপ, আর্তি প্রধান হয়ে উঠেছে ওই উপন্যাসগুলোতে। যেমন তুমি সেই তরবারী উপন্যাসে এক তরুণ দম্পতি এক বন্ধু দম্পতির বাসায় সাবলেট থাকে। তরুণী স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর বন্ধুর পরকীয়া গড়ে ওঠে। মোটেও অচেনা গল্প নয়, তবু প্রকাশের সৌকর্যে সেটি অভিনব হয়ে ওঠে।
বড় নিপুণ কৌশলে, জাদুকরের মতো তিনি ঘটনার বিন্যাস করেন উপন্যাসে। চেনা মানুষ, চেনা গল্প আর চেনা থাকে না, গভীর বিস্ময়ে এবং আমাদের ভেতরটি ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলে – সত্য! এরকমই হয়। সুখের আড়ালে মুখোশ, শঠতা, ভ-ামির পলেস্তারা খসে গিয়ে ভেতরের মানুষটিকে উন্মোচিত করেন সৈয়দ হক তাঁর উপন্যাসে। জীবনকে অন্বেষণ ও আবিষ্কার, জগৎকে জানা ও বোঝার প্রয়োজনে সৈয়দ হক উপন্যাস লেখেন। তাঁর ভাষায় – ‘মানুষ জন্ম নেয়, কিন্তু সে জন্ম তার ওপর চাপিয়ে দেয়া একটি ঘটনা। মানুষ জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে এবং অচিরেই সে আবিষ্কার করে সে হয় এক দুঃশীল দুর্বোধ্য পৃথিবীতে। কিছু প্রশ্ন ক্রমশ বিপুল, প্রবল ও বিনাশী হয়ে দেখা দেয় তার কাছে – আমি কে? আমি কেন? আমি কোথায়? এ প্রশ্নগুলো মানুষ বিবেচনা করেছে মহাকাব্যে, এখন বিশ শতকে করে উপন্যাসে। আমি কে? আমাকে ভাবায়, আমি কেন? আমাকে ভীত করে, আমি কোথায়? – আমাকে নিঃসঙ্গ করে দেয়।’ (ভূমিকা, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস) দেশভাগ, ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, উথাল-পাতাল, টালমাটাল, সময়, রক্ত ও অশ্রুর অভিজ্ঞতাকে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর সৃষ্টিকর্মে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। সর্বত্রই দেশ-জাতি-জনগণ-ইতিহাস-ঐতিহ্য তাঁর লেখার ভিত্তি ও বিষয় ছিল। মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমি করে লিখেছেন নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান, বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ উপন্যাস। নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাসের বিলকিস, যার আত্মীয়স্বজন, পিতামাতা, ভাইবোন, ঘরবাড়ি সর্বস্ব লুুণ্ঠিত হয় যুদ্ধের শুরুতে। এমনকি স্বামী আলতাফ পর্যন্ত নিখোঁজ হয়, সেই বিলকিস যুদ্ধের সময় অসম্ভব জেদ, আচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে পৌঁছে নবগ্রামে। সে-যাত্রায় তার সঙ্গে যুক্ত হয় সিরাজ (আসল নাম প্রদীপ কুমার বিশ্বাস)। সিরাজ বিলকিসের সাহায্যে এগিয়ে এসে জড়িয়ে পড়ে ঘটনার সঙ্গে। উপন্যাসে বিলকিস তার মৃত ভাইয়ের লাশ কবর দিতে গিয়ে দেখে সেখানে আরো অনেক লাশ পড়ে আছে। সিরাজ আর বিলকিস লাশগুলো কবর দিতে চায় গোপনে। কেননা হানাদারদের ঘোষণা ছিল, লাশগুলো কেউ সৎকার করতে পারবে না। বিলকিস আর সিরাজ লাশগুলো কবর দিতে গিয়ে মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে। বিলকিস তখন মশালের মতো সমস্ত শরীরকে প্রজ্বলিত করে অভাবনীয় প্রক্রিয়ায় প্রতিবাদ করে। নীল দংশন উপন্যাসে কাজী নজরুল ইসলাম চরিত্রটিও নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ উপন্যাসে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি যেদিন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, বন্দি থেকে স্বাধীনতায়, অন্ধকার থেকে আলোয়, বাংলার মাটিতে যখন পা রাখছিলেন তখনো ছিল বৃষ্টি, ঘাতকের হাতে যখন নিহত হলেন তখনো অবিরাম বৃষ্টি ছিল এবং শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে মা-মাটির কাছে ফিরে এলেন, সেদিনও ছিল বৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত অশ্রুও যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ‘জলেশ্বরী’ নামে তাঁর কল্পিত গ্রাম আসলে বাংলাদেশের প্রতীক। উপন্যাসে মহিউদ্দিনের পিতা সৈয়দ জালালউদ্দিন, তার বালিকাবধূ শামসি বেগম, পুত্রবধূ ফুলকি, যার পেটে মহির সন্তান। শামসি বেগম নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাতিটির নাম রেখেছেন শামসুদ্দিন। শামসুদ্দিন মানে দ্বীনের শামস্, ধর্মের সূর্য। ধর্ম তো আর কিছু নয়, ধর্ম হচ্ছে প্রকৃত অর্থে তাই – যা আমাদের ধারণ করে। (বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ, পৃ ৫০৮) উপন্যাসে সৈয়দ হকের ভাষা-কৌশল, প্রবহমান গদ্যভঙ্গি নিয়ে পৃথক গবেষণা হতে পারে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পর বাংলাদেশের সাহিত্যে উপন্যাসের ভাষা, আঙ্গিক, প্রকরণ নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ছাড়া এত নিরীক্ষা আর কেউ করেননি। তাঁর অনুজ শহিদুল জহির এ-বিবেচনায় তাঁরই উত্তরাধিকার। আমাদের অধিকাংশ ঔপন্যাসিকই ‘ট্র্যাডিশনাল স্টোরি টেলার’। চেনা জগৎ নিয়ে সাধারণ বুদ্ধির গল্প লেখেন অনেকে কিন্তু উপন্যাসের আঙ্গিক, প্রকরণ, ভাষাশৈলী সম্পর্কে উদাসীন। সৈয়দ শামসুল হকের গল্প ‘তাস’, ‘মানুষ’, ‘কবি’, ‘রক্তগোলাপ’ অবিস্মরণীয়। নিছক আখ্যান রচনা নয়, তাঁর অন্বেষণ মানুষ ও মানুষের জীবনযাপনের নিহিতার্থ। সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর সন্ধান। সৈয়দ হকের ‘হৃৎকলমের টানে’, ‘মার্জিনে মন্তব্য’, ‘গল্পের কলকব্জা’ গুরুর নির্দেশের মতো পড়ে শিখেছি অনেক কিছু – বাক্য, শৈলী, শব্দ ব্যবহার – এমনকি দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন কোথায়, কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে – সব।
আত্মপ্রকাশের জন্য সৈয়দ হক কত না পথ বেছে নিয়েছেন – কবিতা – এখানেও তাঁর নিরীক্ষা অসামান্য,
ছন্দ-শব্দ-উপমা-লোক-ঐতিহ্যের ব্যবহার ঈর্ষণীয়। খ- কবিতার দিন ফুরিয়ে এসেছে। সৈয়দ হক কবিতার ফর্মের পরিবর্তন ঘটালেন। লিরিকের বদলে লিখলেন আখ্যানমূলক কাব্য। মুক্তক অক্ষরবৃত্তের বদলে ঘনপিনদ্ধ পয়ার ছন্দ এবং অন্ত্যমিলের কবিতায় মেলে ধরলেন নিজেকে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে একদা এক রাজ্যে (১৯৬১), বিরতিহীন উৎসব (১৯৬৯), বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা (১৯৭০), প্রতিধ্বনিগণ (১৯৭৩), অপর পুরুষ (১৯৭৮), পরাণের গহীন ভিতর (১৯৮০), রজ্জুপথে চলেছি (১৯৮৮), বেজান শহরের জন্য কোরাস (১৯৮৯), এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি (১৯৮৯), অগ্নি ও জলের কবিতা (১৯৮৯), কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে (১৯৯০), আমি জন্মগ্রহণ করিনি (১৯৯০), তোরাপের ভাই (১৯৯০), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯০), নাভিমূলে ভস্মাধার (১৯৯০) ইত্যাদি। কবিতায় তাঁর বাকপটুতা, বাকপ্রতিমা নির্মাণ, লোক-ঐতিহ্য ব্যবহার, আঞ্চলিক উচ্চারণে ভিন্ন একটি মাত্রা লক্ষ করা যায়। প্রেমাবেগ তাঁর কণ্ঠের প্রধান স্বর হলেও প্রকাশভঙ্গিতে গভীর, গাঢ় উচ্চারণ তাঁর কবিতাকে পাঠকপ্রিয়তা দান করেছে। ‘তোমারে যে ভালোবাসে এর থিকা আরো পাঁচগুণ/ আল্লার কসম আমি দিমু তারে এই জামাখান,/ আমার কলম দিমু তারে, শরীলের খুন/ দোয়াত ভরায়া দিমু, অনুরোধ খালি একখান – / সে য্যান আমার থিকা আরো ভালো পদ্য লেখে আর/ যাদুমন্ত্রে রূপার শিকল হাতে দিতে পারে তার।/ তোমারে যে ভালোবাসে এর থিকা আরো দশগুণ/ আল্লার কসম আমি দিমু তারে এই বাড়িখান,/ আমার উঠান আমি দিমু তারে শীতের আগুন/ নিজেই সাজায়া দিমু, অনুরোধ খালি একখান – / সে য্যান আমার থিকা আরো নিদ্রা যায় আর/ তারেই নিকটে পায়। যার নিকটে থাকার।/ নচেৎ নষ্টামি জানি, যদি পাছ না ছাড়ে আমার/ গাঙেতে চুবান দিয়া তারে আমি শুকাবো আবার।’ (পরাণের গহীন ভিতর-১১)
‘আমার পরিচয়’ শিরোনামে সৈয়দ হক লিখেছেন – ‘আমি জন্মেছি বাংলায় আমি বাংলায় কথা বলি।/ আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।/ চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।/ তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?/ আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে/… একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস,/ আপোষ করিনি কখনোই আমি – এই হ’লো ইতিহাস।/ এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?/ যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;’ কবি-অস্মিতার আশ্চর্য এক প্রকাশ এখানে লক্ষ করা যায়। সৈয়দ শামসুল হকের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কাব্যনাটকে। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬) কাব্যনাটকে মুক্তিযুদ্ধের মর্মন্তুদ ঘটনার বিবরণ উঠে এসেছে। হানাদার বাহিনীর দোসর পিতা ধর্মের দোহাই দিয়ে আপন কন্যাকে তুলে দেয় পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে। আপন কন্যাও তখন পিতার বিরুদ্ধে চলে যায়। গ্রামবাসী মাতবরের অপকর্মের ঘটনা জানতে চায়। মাতবরের মুখোশ উন্মোচিত হয় – ‘আনাজ কুটতে আছি। একা পাকঘর সুনসান।/ হঠাৎ আছাড় দিয়া আসমানে দেখা দিল চান/ একফালি কদুর লাহান।/ কি জানি কিসের তরে ছ্যাঁৎ কইরা উঠল পরান/ একবার মনে হইল কার য্যান ছায়া/ কে য্যান খাড়ায়া/ পাকঘরের দুয়ারে, দেখি আপনে পটের লাহান।/ ‘কি লাগবো, কি দিমু বা’জান?’ -/ তার না দিয়া উত্তর/ ‘তর মা-য়ে কই?’ বইলা ঘরের ভিতর/ গিয়া কইলেন, পাকঘর থিকা শোনা যায়,/ ‘মেয়েটারে মেলেটারি চায়,’/ কইলেন ‘এতে কোনো দোষ নাই,/ রাজী করছি সে হইবো আমার জামাই।’ মাতবরের মুখোশ গ্রামবাসীর কাছে উন্মোচিত হয়। লজ্জায়, গ্লানিতে, অপমানে মাতবরের অবস্থা হয় রাজা ইডিপাসের মতো। কাব্য আঙ্গিকের মতো একটা সুউচ্চ শিল্পাঙ্গিকে সৈয়দ হক তা সফলভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। আঞ্চলিক ভাষাভঙ্গি প্রয়োগের ফলে নাটকের চরিত্রগুলো আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ‘দেখা দিল চান’, ‘একফালি কদুর লাহান’ এই লোকজ প্রতিমা-উপমা প্রয়োগ, সৈয়দ হকের আশ্চর্যময় প্রতিভাকেই স্বাক্ষরিত করে। নূরলদীনের সারাজীবন কাব্যনাটক কেবল রংপুরের আঞ্চলিক বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ১১৮৯ সনের নূরলদীন, মাটিবর্তী কৃষক নেতার জীবন ও সংগ্রাম চিরকালীন বাঙালির সংগ্রামী চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। ‘নূরলদীনের বাড়ি রংপুরে যে ছিল/ রংপুরে নূরলদীন একদিন ডাক দিয়েছিল ১১৮৯ সালের/ আবার বাংলার বুঝি পড়ে যায় মনে/ নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/ যখন শকুন নেমে আসে এই বাংলায়/ নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/ যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়/ নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/ যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়/… অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়/ যে, আবার নূরুলদীন একদিন আসিবে বাংলায়/ আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়/ দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’ (নূরলদীনের সারাজীবন) এই যে আহ্বান, জেগে ওঠার জন্য, সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য, এর একটি চিরায়ত তাৎপর্য রয়েছে। শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনার এই দার্ঢ্য উত্থান শৌর্য-বীর্যেরই প্রতীক। উত্তর-ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে এই ডিসকোর্সের নতুন এক নান্দনিক দরজা খুলে যায়।
রোঁলা বার্থ (১৯১৫-৮০) ‘লেখকের মৃত্যু’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘টেক্স্ট’ হলো মূলত ‘বহুমাত্রিক এক পরিসর’
যে-পরিসরে বহুরকম লিখন একত্রিত, জড়িত, পরস্পরিত, সম্পর্কিত। রোঁলা বার্থ যে ‘বহুমাত্রিক পরিসরের’ কথা বলেছেন, তা আছে সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্যে – বিপুলভাবে, অর্থপূর্ণভাবে আছে। কারণ সৈয়দ শামসুল হক হয়ে উঠেছিলেন এমন এক প্রতিভাবান উদ্ভাবক, যিনি অস্তিত্বকে বহুমাত্রিকতায় উপস্থাপন করেছেন। 