কবিতায় আল মাহমুদের মিথভাবনা

কমরুদ্দিন আহমদ

 

বাংলা অভিধানে ‘পুরাণ’ শব্দটি ইংরেজি ‘myth’ অর্থে ব্যবহৃত। পুরাণ বা মিথ হলো -প্রাচীনকাল থেকে পুরম্নষানুক্রমে প্রবহমান কাহিনি। বিশেষ কোনো জাতির আদি ইতিহাস-সম্পৃক্ত বিশ্বাস, ধারণা ও নৈসর্গিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা, অতিকথা, কল্পকথাকেই মিথ বা পুরাণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পাশ্চাত্যে গ্রিক সাহিত্যে এবং প্রাচ্যের সংস্কৃত সাহিত্যে মিথের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। গ্রিক ও হিন্দু পুরাণ মিথের সমৃদ্ধ ক্ষেত্র। লৌকিক ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও নৈতিক কল্পকাহিনি মিথের অমত্মর্ভুক্ত। ইসলাম ধর্মে মিথের কোনো স্থান নেই। ইসলাম ধর্মের মৌলিক ভিত্তি পবিত্রমহাগ্রন্থ আল কোরান ও মহানবীর (দ.) হাদিস। পবিত্র কোরানে বর্ণিত নবী-রসুলের ঐতিহাসিক কাহিনি ও নৈতিকতার উদ্বোধক ঘটনার বর্ণনা মুসলমানদের পুরাণ ও মিথের অভাব পূর্ণ করেছে। আল মাহমুদের কাব্যে প্রাচীন ইতিহাস, গ্রিক ও হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনি, শ্রমজীবী কৌমসমাজের আদিম বিশ্বাস এবং পবিত্র কোরান-হাদিসের নৈতিক শিক্ষাবিষয়ক বর্ণনা মিথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে গ্রিক পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, বাংলা সাহিত্যের লৌকিক দেব-দেবীর কাহিনি এবং কোরান-হাদিসের নানা প্রসঙ্গ মিথ হিসেবে ব্যবহার করে আল মাহমুদ কাব্যবোধে নতুনত্ব আনয়ন করতে সমর্থ হয়েছেন।

বাঙালি শ্রমজীবী কৌমজীবনের প্রতীক হিসেবে মিথ আল মাহমুদের প্রথম পর্বের কাব্যগ্রন্থগুলোতে স্থান পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পু-্র, পুরীর গৌরব, গৌতম বুদ্ধ, শ্রীজ্ঞান, নচিকেতা, ঋত্বিক, মহাস্থানগড়, মহালিঙ্গ শীলভদ্র ইত্যাদির উত্তরাধিকার নিয়ে বহমান ইতিহাসের অস্তিত্বে তিনি কবিতাকে স্থাপিত করেছেন। কৌমজীবনের সমষ্টিবাচকতার মধ্যে জনচেতনার যথার্থ সৌন্দর্যকে প্রকট রূপে দেখেছেন আল মাহমুদ। যূথবদ্ধ জীবনচারিতা, নারীর অলংকার ও দেহনিঃসৃত বৈভবসত্তা তাঁর মিথিক্যাল উপজীব্য গড়ে তুলেছে। মিথের তাবৎ বিষয়কে কবি আধুনিক জীবনচৈতন্যে গ্রহণ করেছেন। নুহ নবীর কালে মহাপস্নাবনে সমসত্ম পৃথিবী জলের উৎসবে তলিয়ে গেলে মহাপস্নাবনের শেষে নুহ নবী একটি কপোত উড়িয়ে দিলেন পৃথিবীর বাসযোগ্যতা পরীক্ষা করার জন্য। তখন পুণ্যবান পুরম্নষের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো –

পৃথিবীর চিহ্ন নিয়ে যদি ফেরে আশার কপোত

গভীর আদরে আমি তুলে নেবো ফসলের বীজ,

আলস্নাহর আক্রোশ থেকে যা এনেছি বাঁচিয়ে যতনে

আবার বুনবো তা-ই পুণ্যসিক্ত নতুন মাটিতে।

(লোক লোকামত্মর, ‘নুহের প্রার্থনা’)

এখানে জীবনজগতের আশাবাদী আধুনিক জীবনচৈতন্য অসাধারণ দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন কবি।

আল মাহমুদ ঐতিহ্যশাসিত বৃহত্তর গ্রামীণ জীবন-সংস্কৃতির আধুনিক রূপকার। তিনি কবিতায় মিথ ব্যবহারে একদিকে বৃহত্তর জীবনের শাশ্বত অংশের মুখের ভাষাকে মান ভাষার সঙ্গে ব্যাপক মুন্শিয়ানায় ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে সাহিত্যিক ঐতিহ্য পরিগ্রহণ করে অগ্রসর হয়েছেন, যা লোক লোকামত্মর থেকে সোনালী কাবিন পর্যমত্ম বিসত্মৃত।

আল মাহমুদ সোনালী কাবিনের পর কবিতায় দার্শনিকতার ক্ষেত্রে নিজস্ব জীবন ও ধর্মসংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। সব মহৎ কবিই তা করেছেন। মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, একচক্ষু হরিণ, মিথ্যাবাদী রাখাল সেই নতুন জীবন-চেতনার কাব্য। পরবর্তীকালে যা আরো সম্প্রসারিত হয়ে তাঁর কাব্যজীবনকে পরিপূর্ণতা দান করেছে। এ-দেশ ও জনপদের হাজার বছরের ভারসাম্যের ইসলাম ও মুসলিম জীবনধারা, বিশ্বাস ও ঐতিহ্য পরম্পরাবোধ এবং বিশ্বশিল্প রীতির সন্নিপাত ঘটেছে তার সোনালী কাবিন-পরবর্তী কাব্যধারায়। এ-পর্বে এসে কবি অনেক পরিমাণ ইসলামি মূল্যবোধ ও লোকপ্রতীক কথকতায় মগ্ন হয়ে পড়েছেন। অথচ তাঁর কাব্য আবহ এ-পর্বে অধিক পরিমাণে দেশমৃত্তিকা-সংলগ্ন হয়ে উঠেছে। এসব সত্ত্বেও গ্রিক, রোমান পুরাণ থেকে শুরম্ন করে ‘ইশপের গল্প’ এবং ‘কত ধানে কত চাল’ ইত্যাদি লোকগল্প ও লোকশ্রম্নতি অকপট ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে প্রচুর সাহিত্যিক উপাদানও তিনি ব্যবহার করেছেন। মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো কাব্যগ্রন্থের ‘সক্রেটিসের মোরগ সোনা’ এর উজ্জ্বল উদাহরণ।

ইহুদীরা হাসুক,

তবু সম্পদের সুষম বণ্টন অনিবার্য।

ইহুদীরা নাচুক, তবু

ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন। আর

মানুষ মানুষের ভাই।

(ইহুদিরা, অ.বা.রা.বা)

সম্পদের সুষম বণ্টন এখানে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নয়। এ-ব্যবস্থা ইসলাম ধর্মের সুষম বণ্টন, যা জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। এ-প্রসঙ্গে ‘গিফারীর শেষ দিন’ কবিতাটি উলেস্নখযোগ্য :

আমি কৃষণ ছায়া সঙ্গিনী তোমার, হে গিফারী। সেই কালো খাপ, যাতে প্রবিষ্ট ছিলে ঈমানের তীক্ষন তরবারি তুমি। সোনা ও চাঁদির পাহাড় নির্মাণকারীদের বিরম্নদ্ধে তুমি ছিলে পবিত্র কোরআনের তুফান। আমি বাতাসের বেগ নিয়ে তোমার ঝড়কে চুম্বন করি প্রিয়তম।

উমাইয়াদের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরম্নদ্ধে প্রচ- প্রতিবাদকারী আবুজর গিফারীর অমত্মরের ঘৃণা নিয়ে কবি দাঁড়াতে চান ইহুদি পুঁজির বিরম্নদ্ধে।

আল মাহমুদের ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘নীল মসজিদের ইমাম’, ‘গিফারীর শেষ দিন’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘ইশপের কাছিম’, ‘জুলেখার আহবান,’ ‘ইউসুফের উত্তর’, ‘কদর রাত্রির প্রার্থনা’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’, ‘খনার বর্ণনা-সনেট পঞ্চক’, ‘তোমার জন্য দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী’ ইত্যাদি কবিতা কবিদের নতুন করে বিশ্বাস, মিথ ও ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে ভাবার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। উলেস্নখ্য, কবিতাসমূহে কবি আল মাহমুদ পুরনো মূল্যবোধকে নতুন করে গড়ার চিমত্মায় শৈল্পিক প্রপঞ্চ তৈরি করতে চেয়েছেন। ‘ইউসুফের উত্তর’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ ইত্যাদি কবিতায় পুরনো লেজেন্ড ভেঙে নতুন লেজেন্ড তৈরি করেছেন, যা সমসাময়িক কবিদের চিমত্মার জগতে নতুন মাত্রা যোগ করে দিয়েছে। মিথ্যাবাদী রাখালের বাঘ-বাঘ বলে চিৎকারে ‘মৃত্যু এসেছে, হে গ্রামবাসী – হুঁশিয়ার’। – এমন মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার অসাধারণ দর্শন এবং জুলেখার আহবানের বিপরীতে ইউসুফের উত্তরে : ‘কাম যুক্তিহীন বটে কিন্তু জেনো পুণ্যের সাধনা কারো, সেও যুক্তিহীন। কোনদিন মানেনি নিয়ম – আমিও মানব না।’ – ইউসুফের এমনি চারিত্রিক দৃঢ়তার পর ইউসুফ যখন বলেন – ‘সিন্দুকের তালা কি কোনদিন খেয়ে ফেলে সংরক্ষেত সোনার দিনার?’ তখন ইউসুফের চরিত্র ও আমানতদারির যুক্তির কাছে পৃথিবীর সকল রূপ ও লালসার আগুন নিভে যায়।

কবি কোরান-হাদিস ও ইসলামি আদর্শের কথা বললেও তা কখনো মানবজীবনের বাসত্মবতা এবং লোকজীবনের আদর্শবাদিতাকে অস্বীকার করেনি, বরং বাসত্মববাদিতা ও লোকজীবনকে অবলম্বন করেছে। সোনালী কাবিন-পরবর্তী কবির মিথিক্যাল চিমত্মা এভাবে নিজস্ব ও দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর শ্রেয় বিশ্বাস ও নৈতিকতাকে ধারণ করেছে।

আল মাহমুদ জীবনের ও প্রকৃতির উপত্যকা পরিভ্রমণ শেষে বস্ত্তভারপীড়িত প্রতিকারসম্ভব প্রকল্পনায় নিঃসঙ্গের অভিযাত্রিক কবিসত্তার শেষ গমত্মব্য নির্ধারণ করেছেন আধ্যাত্মিকতায়। সোনালী কাবিনের পর পরিবর্তিত চৈতন্যে তিনি এই আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে কাব্যামত্মর্গত করেছেন। এতে পূর্বতন সমষ্টিবাচকতা নতুন মাত্রায় পূর্ণতা পেয়েছে। তাঁর আধ্যাত্মিকতার মিথ অ্যালিগরির বৈশিষ্ট্য নিয়েও একামত্ম প্রাতিস্বিক নিজস্ব দৃষ্টিকোণের মাত্রা দ্বারা উদ্বোধিত হলেও বিশাল এক জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের মুগ্ধতার চারপাশে সকল মানুষের ঐকতাকে প্রকাশ করেছে।

মিথ বা পৌরাণিক প্রসঙ্গ এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের সামগ্রী কবিতার শিল্পগুণকে বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ইতিহাস-ঐতিহ্য, লোকপুরাণ, ধর্মীয় পুরাণ, ধর্মীয় নৈতিক কাহিনি, পুরনো মূল্যবোধ ভেঙে নতুন মূল্যবোধ তৈরিতে কবি আল মাহমুদ অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

আমরা ‘আবহমান বাংলাকাব্যে আল মাহমুদ’ প্রবন্ধে কবির কাব্যগ্রন্থগুলোর একটি দীর্ঘ বিস্তারিত আলোচনা করতে চেষ্টা করেছি। তিনি সেই কবি যিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে কবিতায় উন্মুখ করে তুলেছেন। কৌমসমাজের আধি সাম্যবাদী চেতনা ও নারীর মাহাত্ম্য দিয়ে শুরম্ন করলেও ধীরে-ধীরে তিনি পরিপূর্ণ ও মহৎ কবি হয়ে উঠেছেন। একজন মহৎ কবি হতে কবিতায় যে ধরনের মেধা, শ্রম ও প্রকরণের নতুনত্ব দিয়ে নিজেকে অপরিহার্য কবি হিসেবে উপস্থাপন করতে হয় – তা তিনি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

 

সহায়কগ্রন্থ

১.   সাহিত্য সন্দর্শন, শ্রী শ্রীশচন্দ্র দাশ।

২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, মুহাম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান।

৩. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম।

৪.   কবিতা সমগ্র, আল মাহমুদ, অনন্যা প্রকাশন।

৫. শ্রেষ্ঠ গল্প, আল মাহমুদ, আদর্শ প্রকাশন।

৬. শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, আল মাহমুদ, অনন্যা প্রকাশন।

৭. প্রবন্ধ সমগ্র, আল মাহমুদ, নিউ শিখা প্রকাশনী।

৮. কবির আত্মবিশ্বাস, আল মাহমুদ, অনন্যা প্রকাশন।

৯. উপমা, আল মাহমুদ সংখ্যা, সম্পাদনায়  মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন ।

১০. পুবাকাশ, পয়োটিক্স, চট্টগ্রাম, সম্পাদনায় মীজান রহমান ও মাঈন উদ্দিন জাহেদ।

১১. বাংলাদেশের কবিতা : লোকসংস্কৃতি ও নন্দনতত্ত্ব, অনু হোসেন।

১২. বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব, মাসুদুল হক।

১৩. বাংলাদেশের কবিতায় চিত্রকল্প, সরকার আমিন।

১৪. আধুনিক কবিতা : প্রাসঙ্গিক বিবেচনা, কমরম্নদ্দিন আহমদ।

১৫. আল মাহমুদের কবিতা : বিষয় ও শিল্পরূপ, ড. ফজলুল হক তুহিন।