কবিতায় স্থান, কাল ও দেহ

হাসান ফেরদৌস

‘ফাইনাল পোয়েম ফর দি বডি’ – এই নামে একটি কবিতার পাদটীকা হিসেবে রিকি লরেন্টিস একটি আশ্চর্য মন্তব্য করেছিলেন, ‘তেমন দিন দূরে নয় যখন ভাষা আর যথেষ্ট বলে মনে হবে না।’ ২০০৫ সালে লুইজিয়ানার লিউ অরলিন্সে এক ভয়াবহ বন্যায় পুরো শহর ডুবে যায়, হাজার-হাজার মানুষ গৃহহারা হয়, হতাহত এমন মানুষের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায়। সেই ভয়াবহ দুর্যোগের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে রিকি তাঁর কবিতাটি লিখেছিলেন। পাদটীকায় তাঁর মন্তব্য ছিল, এই যে প্রাকৃতিক অথবা অস্বাভাবিক দুর্যোগ, তার জন্য আমরা সবাই কমবেশি দায়ী। ‘একসময় আমার কাছে যা ছিল সবচেয়ে স্থিতিশীল জিনিস, যেমন যে জল আমরা পান করি ও যা আমাকে ধৌত করে, যে বাতাস আমি নিশ্বাসে ভরে নিই, যে মাটিতে আমি হাঁটি এবং যা আমার জন্য শস্য ফলায়, তা আর স্থিতিশীল নয়।’ এই রূপান্তরকে নিজের দেহের সঙ্গে তুলনা করে রিকি লিখেছিলেন, ‘যে দেহকে আমি চিনি, কিন্তু সে এখন পীড়াগ্রস্ত।’ তিনি পাঠকদের কাছে অনুরোধ রেখেছিলেন, কবিতাগুলো পড়া শেষ হলে দয়া করে যার-যার নিজের হাতিয়ার তুলে নিন, বেরিয়ে পড়ুন, যুদ্ধে নামুন।

মানুষের দুর্ভোগ ও বেদনা বর্ণনায় ভাষা কখনোই যথেষ্ট নয়। শুধু ভাষায় সে-অভিজ্ঞতার পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়, সে-কারণে কবিকে আশ্রয় নিতে হয় প্রতীকের শক্তিতে। তার সঙ্গে যুক্ত করতে হয় কল্পনার স্বাধীনতাকে। যেহেতু বেদনার এই প্রকাশ অতি ব্যক্তিগত, পাঠকের কাছে তা পৌঁছায় ভিন্ন-ভিন্ন আবক্রপথে, যার-যার নিজস্ব গবাক্ষ অনুসরণ করে। এর ফলে আধুনিক কবিতার আবেদন হয়তো সংকীর্ণ হয়ে এসেছে, কমে এসেছে পাঠকের সংখ্যা, কিন্তু কবিতা নিজে হয়েছে দুর্দান্ত ক্ষমতাবান। গ্রানাইট পাথরের মতো অবিনাশী, ধাবমান জলোচ্ছ্বাসের মতো তীব্র, অথচ সন্ধ্যার আকাশে সদ্য জেগেওঠা জ্যোৎস্নার মতো কোমল। সে-কারণেই, কিছুটা ক্লিশে শোনালেও, ‘ব্যক্তিগত’র মতো পবিত্র আর কিছু নেই।

ভাষা কেন যথেষ্ট নয় সে-কথা বোঝার জন্য রিকির ‘ফাইনাল পোয়েম ফর দি বডি’ কবিতাটির খাংশ ‘এ টাইম ইন আগস্ট’কে অনুসরণ করা যাক :

না, জলোচ্ছ্বাস নয়, তাঁর নির্মম ঝড় অথবা বন্যাও নয় –

আমি বলছি সে জলোচ্ছ্বাসের স্মৃতির কথা;

সেই কথা যখন জল অনুধাবন করল

গ্রহম-লে কোথায় তার স্থান

যখন সে গ্রাস করল আমাদের সড়ক, বাসভবন

ও উদ্যান। যখন সে জানালো

একসময় এইসবই তার ছিল,

এ ছিল তারই যাত্রাপথ

তারপর জলভূমি পুনর্নির্মিত হলো, যেমন একজন রমণী

ত্রস্ত সরে যায় তার চেনাপথ থেকে। এই রমণী

একজন মাতা। তার পুত্র ভীত, মায়ের দেওয়া ফুলটি তার হাতে

শক্ত করে ধরা। মা বলে, বাছা, এই ফুল যখন ভেসে যাবে, তুমিও ভাসবে

তার হাতে শক্ত করে ধরা মায়ের দেওয়া ভালুক-পুতুল।

মা বলে, এই পুতুল…।

তারপর ঘটল সেই ঘটনা। ফুল ঝরে গেল, তার ভালুক-পুতুল

শান্তভাবে ঘুমিয়ে থাকল (সে জীবন্ত, একথা কখনো জানার প্রয়োজনই ছিল না)

ছেলেটির চোখ চেটে দেওয়া মার্বেল পাথরের মতো

সেখানেই তার দেহ।

এভাবেই তো স্মৃতির আগমন ঘটে,

যেভাবে ঘটেছিল সেই মায়ের গলার স্বরে :

ত্রস্ত অথচ গভীর অনুসন্ধানী

তার গলার স্বরে

অসহনীয় এক আলো,

সানুনয় প্রশ্নে উদ্বিগ্ন সে : তোমরা কেউ দেখেছ

আমার সন্তানকে

কেউ কি দেখেছ?

এই প্রশ্নের উত্তরের কোনো ভাষা

তোমার জানা নেই, তবুও উত্তর তোমাকে দিতেই হবে।

রিকির এই কবিতা ছিল কবিতাকে সাক্ষ্যভাষ্য হিসেবে ব্যবহারের প্রতিবাদ হিসেবে। ক্যাট্রিনার মহাদুর্যোগের পর সবাইকে ‘ভিকটিম’ হিসেবে চিহ্নিত করে কবিতা লেখার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল, অধিকাংশ ব্যক্তিগত গস্নানিবোধ থেকে লেখা, তাতে ছিল না কোনো প্রকৃত সংহতি বোধ। এই দুর্যোগের পেছনে যে সবার কোনো না কোনো ভূমিকা ছিল, তারও কোনো স্বীকৃতি ছিল না। কোনো দুর্যোগের বর্ণনায় সে ঘটনার দেহ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে কবিতা রচনায় বাহাদুরি থাকতে পারে; কিন্তু তাতে সততা নেই। রিকি লিখেছেন, ক্যাট্রিনার পর কবিতা লেখা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল, কারণ এমন কোনো ভাষা ছিল না যার সাহায্যে সেই দুর্যোগে তার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করা সম্ভব।

রিকি লরেন্টিসের বয়স মাত্র ২৭, লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্সে তাঁর জন্ম, সে-মাটির আর্দ্র, নোনতা ও কৃষ্ণ শোনিত তাঁর কবিতাকে একটি সম্পূর্ণ নিজস্বতা দেয়। স্থান ও কালের এই নিজস্বতা বোধের ভেতর স্থাপিত না হলে রিকির কবিতার স্বাদ পুরোপুরি পাওয়া কার্যত অসম্ভব। তাঁর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ বয় উইথ থর্ন পড়তে এসে আমাকে প্রথমেই সে-অসুবিধার মোকাবিলা করতে হলো। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষার সঙ্গে সমভার অর্জন, তাকে অনুপ্রবেশযোগ্য একটি মাধ্যম হিসেবে আবিষ্কার। এই কাজটি বিশেষভাবে কঠিন, কারণ এই কবির কবিতায় তাঁর নিজের শরীর একটি পুনরাবৃত্ত উপাদান, ফলে তা অতি ব্যক্তিগত ও সাংকেতিকতায় আবৃত। যখন আমাদের এই তথ্যটির সঙ্গে পরিচয় হয় যে, রিকি একই সঙ্গে একজন আফ্রিকান-আমেরিকান ও সমকামী এবং তিনি নিউ অরলিন্সের সন্তান, তখন কবিতায় দেহের উপস্থিতি ও তার পুনরাবৃত্তি আমাদের কাছে সহজগম্য হয়ে ওঠে। তার স্থান ও কাল আর রহস্যময় থাকে না।

এরই মধ্যে কবি হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হলেও বয় উইথ থর্ন রিকি লরেন্টিসের প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এক সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় মার্কিন কবি টেরেন্স হোয়াইট আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন রিকির কবিতার নিজস্বতা কোথায়। ‘তাঁর কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় বিখ্যাত স্থপতি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইটের প্রবহমান জলের ওপর পাথরে নির্মিত ফলিং ওয়াটার নামের সেই বাড়িটির কথা। সেই স্থাপত্যকর্মের মতো এই কবিতা একদিকে দ্রব অথচ নিজ শক্তিতে আস্থাবান। সে পারে ভেতর ও বাহিরের জগৎকে সমন্বিত করতে, কারণ সে একই সঙ্গে লৌকিক ও ভিন্নকেন্দ্রী বাগধারায় সমৃদ্ধ, সে উদ্ধত ও বিনয়ী।’ হেইস মনে করেন, রিকির কবিতায় নিগ্রো সমকামী কবি জেমস বল্ডউইন ও ব্রিটিশ কবি ডবিস্নউ এইচ অডেনের প্রভাব রয়েছে, যদিও তাঁদের প্রভাব প্রচ্ছন্ন নয় – অলক্ষ্য। বল্ডউইনের কবিতা তাঁর তীক্ষ্ণধী বক্তব্য ও অডেনের কবিতা কারিগরি শৈলীর জন্য সুপরিচিত। অনুমান করি, হেইস রিকির কবিতায় এই দুই বৈশিষ্ট্যের আভাস দেখেছেন। এই দুই কবি পরিচিত ছিলেন তাঁদের প্রবল রাজনীতিমনস্কতার জন্য, রিকি তাই এক অর্থে তাঁদের – বিশেষত বল্ডউইনের – যোগ্য উত্তরসূরি। তাঁর মতো রিকিও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যে নিজস্ব সাক্ষ্যভাষ্য নির্মাণ করেন, তা একদিকে সমকালীন ও সর্বকালীন। একই সঙ্গে যৌনতা, বর্ণ ও অতীন্দ্রিয় বোধ তাঁর কবিতার কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়ায় যে বহুমুখী মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত জটিলতা সৃষ্টি হয়, তা প্রকাশে যে-ভাষা তিনি ব্যবহার করেন তা প্রবল প্রতীকধর্মী, সেই কারণে দুরূহ। হেইস লিখেছেন, পরিবর্তমান যে-জীবনসমূহ রিকির কবিতায় তিনি আবিষ্কার করেন, ‘তা একই সঙ্গে স্ত্ততি ও আশ্রয়ের জন্য পুনর্নির্মিত।’ অনুমান করি, এই দুই বিপরীতমুখী উপাদান প্রকৃতপক্ষে রিকির আত্মরক্ষার হাতিয়ার, তাঁর ডিফেন্স মেকানিজম। একজন কালো মানুষ স্বভাবতই এই হাতিয়ারের সঙ্গে পরিচিত ও তার ব্যবহারে অভ্যস্ত। হেইসের কথা অনুসরণ করে বলতে পারি, রিকির কবিতায় এই জীবনসমূহের প্রকাশ ঘটে গানের নিমগ্ন মন্দ্রতায় ও স্মৃতির মেখলা বিষণ্ণতায়।

এবার রিকির কবিতার দিকে নজর দেওয়া যাক, কারণ কবিকে বুঝতে হলে এছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই। ‘অফ দি লিভস দ্যাট হ্যাভ ফলেন’ এই নামের একটি কবিতায় রিকি মডার্নিস্ট মার্কিন কবি ওয়ালেস স্টিভেন্সের একটি কবিতার শিরোনাম ব্যবহার করেছেন সূচনা-উদ্ধৃতি হিসেবে : লাইক ডেকোরেশনস ইন অ্যা নিগ্রোসেমেটারি।’ যেন কোনো নিগ্রোসমাধিক্ষেত্রের অলংকরণ। স্টিভেন্সের এই বিখ্যাত কবিতাটি মৃত্যু ও মরণ বিষয়ে একটি অসাধারণ আধ্যান বা মেডিটেশন। মৃত্যু অনিবার্য এবং মৃত্যুর পর আর কিছু নেই – শূন্যতা ছাড়া, এই অনুভূতির ভাবাবেগবিহীন নির্লিপ্ত অনুধাবন এই আধ্যানের বিষয়। নিগ্রোসমাধিক্ষেত্রের কথা শিরোনামে থাকলেও কোনো কৃষ্ণকায়ের কথা এই কবিতায় নেই। দক্ষিণের পটভূমিতে রচিত এই কবিতায় নিগ্রো অভিজ্ঞতা উচ্চারিত হলেও স্টিভেন্স কীভাবে কৃষ্ণ-জীবনের প্রতি এতটা অবজ্ঞা দেখাতে পারেন, লরেন্টিসের কবিতা সেই প্রশ্নের বিকল্প আধ্যান।

কল্পনার কোনো রোদমাখা দিন নেই,

স্টিভেন্স ওয়ালেসের মতো আমিও জানি, কৃষ্ণ আঁধার বড় নিষ্ঠুর

আমি গান গাই। আমি কাঁদি। প্রতি রাতে ভীতস্বপ্নে আমি দেখি

সেইসব দেহ, উন্মত্ত জনতার হাতে যারা নিহত, তারা এখনো ভাবতে জানে

কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়, সে-কথা আমিও শুনেছি। শেষ কেউই দেখতে পাবে না

কিন্তু তাদের, আমার জনকদের, জিহবার মতো

তুলে নিয়ে ফেলা হয় আগুনে।

কৃষ্ণ আঁধারে পথ খুঁজে পেতে হলে

তোমাকে কান পেতে শুনতে হবে, অবশ্যই শুনতে হবে

কৃষ্ণ বাতাস, গাছে আঘাত লাগা বাতাস,

গাছের সবুজ ব্যস্ততায় ধ্বনিতোলা পাখি

 

ডুবে যেতে-যেতে

প্রবল উত্তাপে আটকে থেকে, তার চোখ ও শিরা

যখন ফেটে পড়ে

যখন সে ঈশ্বরের কৃপা প্রার্থনা করে বলে

হা, ঈশ্বর, আমাকে ঊর্ধ্বে কোথাও নিয়ে চলো

শুধু তখন আমি সঠিক উপলব্ধি করি

এই নিশার আয়োজন বিচিত্র নানা বাসনার জন্য।

বস্ত্তত শুধু ‘ডার্ক’ – এই শব্দ ব্যবহার করে লরেন্টিস একজন নিগ্রোর জীবন ও তার মৃত্যুকে অন্ধকার ও নিশীথের সঙ্গে তুলনা করেছেন। স্টিভেন্স কী করে সে-জীবন – অথবা মৃত্যুর – কথা বুঝবেন যার সঙ্গে তাঁর কোনো পরিচয় নেই, যে-জীবনাভিজ্ঞতার তিনি অংশীদার নন!

এই কাব্যগ্রন্থের কোথাও লরেন্টিস একথা গোপন করেন না যে, তিনি দুর্দশাগ্রস্ত দক্ষিণ থেকে এসেছেন, এবং তিনি একজন কৃষ্ণকায় ও সমকামী। সাধারণভাবে এই প্রতিটি শারীরিক অভিজ্ঞতা যে-কোনো কালো মানুষের জন্য বৈষম্য ও দুর্ভোগের কারণ হতে পারে, কিন্তু এই গ্রন্থে লরেন্টিস সেই প্রতিটি পরিচয়কে উদ্যাপনের উৎস হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সম্ভবত সে-কারণে তিনি নিজেকে বল্ডউইনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেই নিগ্রো কবিও সমকামী ও আফ্রিকান-আমেরিকান পরিচয়কে লুকানোর বদলে তাদের ‘সেলিব্রেট’ করার কথা বলেছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে লরেন্টিস যুক্তি দেখিয়েছেন, এইসব ভিন্ন-ভিন্ন আত্মপরিচয় কারো কারো জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তা আবার একই সঙ্গে প্রবল রকম উল্লাসময় মুক্তির খোঁজ দিতে পারে। লরেন্টিসের কথায়, ব্যাপারটা অনেকটা সনেট লেখার মতো। নানা নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ সনেট, কিন্তু সেই নিয়মবদ্ধতার ভেতর দিয়ে গমনশেষে যে-কবিতার জন্ম হয়, তা বিস্ময়কর সুন্দর।

গ্রন্থের নাম কবিতা ‘বয় উইথ থর্ন’-এ লরেন্টিস একজন আফ্রিকান-আমেরিকান সমকামী ব্যক্তির এই সংকট ও উদ্ধারের বিরুদ্ধ চেতনার প্রশ্নটি খোলাচোখে দেখেছেন। ‘কণ্টক ও বালক’ কবিতাটির সূত্র খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর একটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য, ঘন কৃষ্ণ একটি বালক এখানে তার পায়ের পাতা থেকে শান্তভাবে কাঁটা তুলছে।  লরেন্টিস পাদটীকায় মনে করিয়ে দিয়েছেন, কোনো কোনো শ্বেতকায়ের চোখে ভাস্কর্যটি কালো মানুষের ব্যথা সহ্যের অপরিসীম শক্তির প্রতীক। লরেন্টিসের প্রশ্ন, সত্যি কি কালো মানুষের বেদনা সহ্যের ক্ষমতা অপরিসীম, অথবা সে বেদনা-ঊর্ধ্ব? সে-কথা এত নিশ্চিত হয়ে কেউ বলে কীভাবে? তারা কেউ কি সে-বেদনার সঙ্গে আদৌ পরিচিত?

এ-প্রশ্নের উত্তর হিসেবেই ‘কণ্টক ও বালক’ কবিতাটি লিখিত। মোট ২৯টি এক থেকে চার বাক্যের স্তবকে বিভক্ত কবিতাটি কালো মানুষের ওপর শত-শত বর্ষ ধরে যে-উৎপীড়ন হয়েছে, লরেন্টিসের নিজের কথায়, তারই একটি আধ্যান। তার অংশবিশেষের প্রতি মনোযোগ দেওয়া যাক।

৬। সে কি দেখতে খুবই কুৎসিত ছিল? তবুও তার দিকে নির্দেশিত ছিল দৃষ্টি।

৭। তার খোদিতমুখে ছিল সতর্কতা। সে-মুখ যেন একটি উত্তরবিহীন প্রশ্ন।

১০। তার দেহে কি আগে থেকেই কোনো কাঁটা ঢুকে ছিল? তার চোখের দৃষ্টি। ছায়া যখন সরে যায় ও ছড়িয়ে পড়ে, সে কেন তখন সবচেয়ে তীব্র?

১১। আমি বারবার ফিরে যাই সেই কাঁটাটিতে, সে যেন একটি বিভাগচিহ্ন, একটি আঁকিবুকি, যার কারণে তার দেহের জলাভূমিসমূহ ক্ষমা পায় ও নিষিদ্ধ হয়ে ওঠে।

১। হিংস্রতা তোমার চাই। হিংস্রতা তুমি হরণ করে লুকাবে নিজ দেহের অভ্যন্তরে।

লরেন্টিস এই প্রাচীন ভাস্কর্যের আধারে খুঁজে নিয়েছেন হাজার বছর ধরে এক সভ্যতা থেকে আরেক সভ্যতায় কালো মানুষের ওপর শ্বেত সন্ত্রাসবাদীরা যে-সহিংসতা চাপিয়ে দিয়েছে, তাদের। এখানে তারা সবাই এক অদৃশ্য বিচারের কাঠগড়ায় দ-ায়মান। অনুমান করি, সহস্র বছরে সেই শ্বেত হিংস্রতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ লরেন্টিসের লক্ষ্য নয়, বস্ত্তত সে-প্রতিশোধের প্রয়োজন তার নেই। কারণ তিনি জানেন বেদনাকে ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়েছে যে-কৃষ্ণবালক, সকল শ্বেত মানুষের চেয়ে অনেক বৃহৎ সে। শ্বেত মানুষের হিংস্রতাকে সে হরণ করে নিজ দেহে ধারণ করে, কিন্তু বশ্যতা স্বীকার করে না।

বেদনার কোনো মানচিত্র নেই, এমন কোনো ভাষাও নেই যে বেদনাকে কণ্ঠ দিতে পারে। রিকি লরেন্টিসের এই শীর্ণকায় অথচ অসাধারণ কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করে আমি এ-কথায় নিশ্চিত যে, একমাত্র কবিতাই পারে সে-বেদনার সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী প্রকাশ নির্মাণ করতে।

বয় উইথ থর্ন, রিকি লরেন্টিস, ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ প্রেস, ২০১৫। r