কবি আবুল হোসেনের সান্নিধ্যে

ইকবাল আজিজ

কবি আবুল হোসেনকে মনে হয় আমাদের সাহিত্যের বটবৃক্ষ। আমাদের সাহিত্যে এমন খ্যাতিমান কিংবদন্তি আরো কয়েকজন ছিলেন। আমার সৌভাগ্য, তাঁদের কারো কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। আবুল হোসেনের পাশাপাশি শওকত ওসমান, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান প্রমুখের সান্নিধ্যে নিজেকে বড় বেশি নিরাপদ মনে হতো; এসব প্রবীণ ও অভিজ্ঞ বটবৃক্ষের স্নেহছায়ায় বাস করে জীবন সম্পর্কে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, সুস্থির ও নির্মোহ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এঁদের ব্যক্তিত্ব ও স্বভাব অবশ্যই আলাদা; কিন্তু গভীর আন্তরিকতা ও সস্নেহ আচরণের দিক দিয়ে এঁরা ছিলেন অভিন্ন। ১৯৮০ সালে কেবল সাহিত্যের আকর্ষণে এ-যুগের বাঙালি সাহিত্যতীর্থ ঢাকায় এসে এক গভীর নিঃসঙ্গ ও বন্ধনহীন জীবন আমি বেছে নিয়েছিলাম। আমার সেই উন্মাতাল ছন্নছাড়া দিনগুলোতে, এসব প্রবীণ বটবৃক্ষ আমাকে গভীরভাবে স্নেহছায়া দিয়েছিলেন – বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। এঁদের কথা কি আমি ভুলতে পারি? এরই মধ্যে আহসান হাবীব, শওকত ওসমান ও শামসুর রাহমান এই পার্থিবজীবনের মায়া কাটিয়ে এক অদৃশ্য অনন্তলোকের যাত্রী হয়েছেন। কিন্তু প্রায় এক শতাব্দীর স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে আছেন কবি আবুল হোসেন। চল্লিশের দশকের এই গুরুত্বপূর্ণ কবি বর্তমানে ৯০ বছরে পা দিয়েছেন। ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর জন্ম হয়েছিল খুলনা জেলার এক গ্রামে। ঘটনাবহুল ও বর্ণাঢ্য জীবন পার করে তিনি জীবনের এই শেষবেলায় অনেকটাই গৃহবাসী। ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের কাছে ‘সাহানা’ নামে একটি চমৎকার রুচিশীল বাড়িতে তাঁর দিন ও রাত কাটে। এ-বাড়িটি তাঁর নিজস্ব বাড়ি। সাহানা তাঁর পরলোকগত স্ত্রীর নাম। কবি আবুল হোসেন এ-বাড়িতে আছেন ১৯৭১ সাল থেকে। কয়েক বছর আগে প্রিয়তমা স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন; এখন নানা ধরনের বার্ধক্যজনিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত কবি আছেন তাঁর দুই ছেলের সঙ্গে। দুই ছেলেই কৃতী ও সংসারী। বাবার প্রতি তাঁরা সর্বদাই দায়িত্বশীল। এদিক দিয়ে কবি আবুল হোসেন খুবই ভাগ্যবান; দুই ছেলের পরিবারের সান্নিধ্যে তাঁর জীবন হয়ে উঠেছে পরিপূর্ণ। তবে শরীর খুবই অশক্ত; প্রায় দু-তিন বছর পর এবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মনে হলো, শরীর-মন দুটোই তাঁর ক্লান্ত। ভালোভাবে চোখে দেখেন না ও কানে শোনেন না। স্মৃতিশক্তিও দুর্বল; অনেক কিছুই মনে করতে সময় লাগে। কিন্তু মনের ঋজুতা আগের মতোই তীব্র ও তীক্ষ্ণ। অনেক ভেবেচিন্তে ও সময় নিয়ে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিলেন; কিন্তু একটিও বেফাঁস কথা বলেননি। এদিক দিয়ে ৯০ বছর বয়স্ক কবি আবুল হোসেন বাস্তবিকই বিস্ময়কর। এ-ব্যাপারে কিছুদিন আগে পরলোকগত অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর আশ্চর্য মিল আছে।

Abul Hossain
Abul Hossain

একান্ত ব্যক্তিগত কৌতূহল নিয়ে এবার কয়েক মাসের ব্যবধানে দুবার কবি আবুল হোসেনের সঙ্গে কথা বলেছি। কবি ধীরে ধীরে সময় নিয়ে কথা বলেছেন বলে সাক্ষাৎকারের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ খাতায় লিখতে সুবিধা হয়েছে। একটি শব্দও বাদ পড়েনি। প্রশ্নোত্তর পর্বে কোনো কিছুই সম্পাদনা করিনি; কারণ আমার মনে হয়েছে, জীবনের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে তাঁর গভীর অভিজ্ঞতা থেকে উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যই মূল্যবান। এর মধ্যে আগামী প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় বা গ্রহণীয় অনেক কিছুই আছে। এছাড়া তিনি তাঁর নিজস্ব যুক্তিবোধ থেকে এতটুকু সরেননি। জীবনের প্রান্তসীমায় পৌঁছেও কবি আবুল হোসেনের মধ্যে আমি এতটুকু মৃত্যুভয়, আবেগ কিংবা ভাবালুতা লক্ষ করিনি। এ আমার কাছে গভীরভাবে বিস্ময়কর মনে হয়েছে।
আমি ২০১১ সালের ২৭ জুলাই ও পরবর্তীকালে প্রায় সাত মাস পর চলতি বছরের ৮ মার্চ ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে তাঁর সঙ্গে কথা বলি। হয়তো কিছু প্রশ্ন একই রকম। কিন্তু তিনি জবাব দিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাই দুদফার কথোপকথনের একটিও বাক্য কিংবা একটি শব্দও বাদ দিইনি। প্রথমবারের সাক্ষাৎকারের সময় তাঁর কোনো ছবি নিতে পারিনি। এ-বছরের মার্চ মাসে তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয়বার কথা বলার সময় ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম এবং তাঁর বেশ কিছু ছবি নিতে পেরেছি। এই প্রবীণ বটবৃক্ষের স্মৃতি হিসেবে আমাদের কিছু ছবি তুলে দিয়েছেন তাঁর সার্বক্ষণিক দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত এক তরুণ। কবি আবুল হোসেনের সঙ্গে দুদফার সাক্ষাৎকার পর্বটি গৃহীত হয়েছে কবির ধানমন্ডির বাসভবন ‘সাহানা’য়।

প্রথম সাক্ষাৎকার
১৭ জুলাই ২০১১, সময় সকাল ১১টা
ইকবাল আজিজ : আপনার শরীর আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়ে গেছে। এ কি ডায়াবেটিসের জন্য?
আবুল হোসেন : না, এটা বয়সের জন্য। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সবকিছু অচল হয়ে যাচ্ছে।
ইকবাল আজিজ : সময় কীভাবে কাটে? শুয়ে থেকে?
আবুল হোসেন : শুয়ে থাকি। পড়ার জন্য চেষ্টা করি। দৃষ্টিশক্তি অনেক কমে গেছে।
ইকবাল আজিজ : পুরনো দিনের কথা ভাবেন?
আবুল হোসেন : পুরনো দিনের স্মৃতি লিখে ফেলেছি। চার খন্ডে। সর্বশেষ লিখেছি স্বপ্নভঙ্গের পালা। এরপরের অংশ অপরাহ্ণের সৃষ্টি। প্রকাশকের নাম মনে পড়ছে না। হয়তো সময় প্রকাশনী।
ইকবাল আজিজ : প্রায় ৮০ বছর আগে আপনার শিশুবয়সে যে সমাজ ও জীবন দেখেছিলেন, সেটা কেমন?
আবুল হোসেন : মানুষের সম্পদ তখন বেশি ছিল না। দেশ পরাধীন ছিল। কিন্তু আমার মনে হয়, তখন মানুষ সুখে ছিল। তাদের স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। জীবন অনেক সহজ ছিল। মনে হয় মানুষ এখনকার তুলনায় অনেক সরল ছিল। এখন মনে হয় গত ৮০ বছরে সবই বদলে গেছে। মানুষের সম্পদ বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশ স্বাধীন হয়েছে। যদি বলতে পারতাম, মানুষ অনেক বেশি সুখে আছে তবে অনেক বেশি খুশি হতাম; কিন্তু মানুষ সুখে নেই। জীবনের জটিলতা বেড়েছে। পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ নেই। মানুষ ক্রমেই শহরকেন্দ্রিক ও যান্ত্রিক হয়ে গেছে।
ইকবাল আজিজ : শিল্প-সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী?
আবুল হোসেন : শিল্প-সাহিত্যের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেড়েছে। লেখকের সংখ্যা বেড়েছে। সে-অনুযায়ী লেখার মান বাড়েনি। আমরা যখন গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শুরুতে লেখা শুরু করি, তখন সারাদেশে বাঙালি মুসলমান সমাজে ৫০ জন লেখকও ছিল না। অথচ এখন দেশে শুধু কবিদের সংখ্যাই হবে এক হাজারের বেশি। আমি রাজধানী ও মফস্বলের নানান বয়সের কবিদের কথা বলছি। তবে লেখার মান বেড়েছে বলতে পারলে খুশি হতাম; কিন্তু তা বাড়েনি। এটাই কঠিন বাস্তবতা।
ইকবাল আজিজ : পাকিস্তান আন্দোলন সম্পর্কে বলুন।
আবুল হোসেন : পাকিস্তান আন্দোলন সম্পর্কে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাঙালি মুসলমানের অবদান সবচেয়ে বেশি। সেইসঙ্গে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সংখ্যালঘু মুসলমানরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিল; কিন্তু তারা অনেকেই পাকিস্তানে আসতে পারেনি। অপরদিকে ভারতের মুসলিমপ্রধান প্রদেশ পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অধিবাসীরা সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এগিয়ে আসেনি। পাকিস্তানে আমরা বাঙালি মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলাম। কিন্তু পাকিস্তানের শাসনভার মূলত সংখ্যালঘু পাকিস্তানিদের হাতে চলে যায়। তারা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক – সবদিক দিয়েই পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করেছে। পাকিস্তান আমলে আমরা ছিলাম ব্যাপক শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। এ কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো পথ ছিল না। পাকিস্তান আমরা ভাঙিনি; পাকিস্তান ভেঙেছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা।
ইকবাল আজিজ : আপনাদের খুলনার বাড়িতে এখন কে আছেন?
আবুল হোসেন : খুলনায় আমার দুই ছোট ভাই আছে। আমরা তিন ভাই তিন বোন। আমরা তিন ভাই-ই বেঁচে আছি।
ইকবাল আজিজ : আপনার নিজের জীবনকে কেমন মনে হয়?
আবুল হোসেন : ব্যক্তিগতভাবে আমি বলতে পারি, আমার সারা জীবনটাই খুব সুখে কেটেছে। সাংসারিক দিক দিয়ে আমি খুব সুখী।
ইকবাল আজিজ : আপনি সৌভাগ্যবান বলেই কি এমন হয়েছে বলে মনে করেন?
আবুল হোসেন : ভাগ্য তো আছেই। আমার নসিব নিয়ে আমি নিশ্চয়ই খুশি। কিন্তু কোনোদিনই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করিনি। সবসময় চেষ্টা করেছি নিজের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার। ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছি। সে-ব্যাপারে তাদের ভালোভাবে লেখাপড়া করানোর ওপর জোর দিয়েছি। তারা ভালোভাবে লেখাপড়া করেছে বলেই চাকরিজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। এখন বাংলাদেশের লোক বিদেশে যাওয়ার জন্য খুবই আগ্রহী। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েরা বিদেশে স্থায়ীভাবে যাওয়ার কথা কখনো ভাবেনি। আমার ছেলেমেয়েদের মধ্যে তিনজনই ঢাকায় থাকে। এক মেয়ে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকে চাকরি করে।
ইকবাল আজিজ : আপনার ছেলেমেয়েরা কেউ কি সাহিত্যচর্চার সঙ্গে জড়িত?
আবুল হোসেন : সরাসরি জড়িত নয়। তবে ওরা সবাই খুব পড়াশোনা করে।
ইকবাল আজিজ : আপনার নাতি-নাতনিরা কি বাংলা মাধ্যমে পড়ে?
আবুল হোসেন : ওরা সবাই ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশোনা করে। তবে বাংলা জানে।
ইকবাল আজিজ : আপনার সাহিত্যজীবনে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি? তাঁদের নাম বলুন।
আবুল হোসেন : আবু সয়ীদ আইয়ুবের প্রভাব খুব বেশি। তাঁর বাসায় আমি নিয়মিত যেতাম। আড্ডা দিতাম। তাঁর মেধা ও ব্যক্তিত্ব খুব ভালো লাগত। তাঁর সাহিত্যবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। যদিও তিনি দর্শনের ছাত্র ছিলেন; কিন্তু খুবই সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন। যদিও অনেকে বলতেন, আইয়ুব নাস্তিক ছিলেন; কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা বলে তাঁকে নাস্তিক বলে মনে হয়নি। এছাড়া সৈয়দ মুজতবা আলী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন। পরিচয় ছিল বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখের সঙ্গে। এঁদের সবার সান্নিধ্য আমি পেয়েছি।
ইকবাল আজিজ : তিরিশের কবিদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?
আবুল হোসেন : সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে। তাঁর বাসায় অনেকবার গিয়েছি। তাঁর সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে কথা হয়েছে। তিনি প্রায় সার্বক্ষণিকভাবে ইংরেজিতে কথা বলতেন। পরিচয়ের আড্ডায় সবাই ইংরেজিতে কথা বলতেন। অথচ পরিচয় পত্রিকা বের হতো বাংলায়। তবে পরিচয়ের আড্ডায় কেউ কেউ হয়তো বাংলা বলতেন। সুধীন দত্তের বাসায় আমি তাঁর স্ত্রী রাজেশ্বরী দত্তকে দেখেছি। তিনি একজন অসাধারণ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। রাজেশ্বরী দত্তকে বিয়ে করার জন্য সুধীন্দ্রনাথ তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে দেন। সেইসঙ্গে তাঁর প্রথম স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন। আমি যখন কলকাতায় ছিলাম, তখন জীবনানন্দ দাশ বরিশালে ছিলেন। সেখানকার বিএম কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তবে ছুটির সময় বা অন্য কারণে কলকাতায় আসতেন। সে-সময়ে জীবনানন্দের সঙ্গে দেখা হতো। তাঁর সঙ্গে বেশি দেখা হয়েছে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পূর্বাশা অফিসে। এছাড়া যুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতাভবনে’ দেখা হয়েছে। জীবনানন্দ যখন ১৯৪৬ সালে বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন, তখন আমি তাঁর ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে কয়েকবার গেছি।
ইকবাল আজিজ : জীবনানন্দকে কেমন লেগেছে?
আবুল হোসেন : জীবনানন্দ খুব কম কথা বলতেন। শুনতে চাইতেন বেশি। মাঝে মাঝে মুচকি হাসতেন। তেমন সামাজিক ছিলেন না। ঠিক লাজুক নয়। কিন্তু কম কথা বলতেন। ওঁর স্ত্রীকে একবারও দেখিনি। আমি আর আমার বন্ধু শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একবার জীবনানন্দের বাড়িতে গিয়েছিলাম; সেবার তিন ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। এই তিন ঘণ্টায় তাঁর পরিবারের কেউ একবারও সেখানে আসেনি। কেউ এক পেয়ালা চাও আমাদের খেতে দেয়নি। নিজের বাসায় জীবনানন্দ খুব সুখী ছিলেন বলে মনে হয় না।
ইকবাল আজিজ : কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে কিছু বলুন।
আবুল হোসেন : ১৯৩৯-৪০ সালে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠতা হয়। এ-সময় প্রায় প্রতি সপ্তাহে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। তবে কবির বাড়িতে নয়; কলকাতায় শ্যামবাজারে ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’ গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুমে। নজরুলকে যেভাবে তাঁর সাহিত্যপাঠের মধ্যে খুব উজ্জ্বলভাবে পেয়েছি; ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে যখন তাঁর আলাপ, তখন তাঁর মধ্যে সেই ঔজ্জ্বল্য ছিল না। তাঁর স্ত্রী তখন অসুস্থ, সংসারে সাচ্ছল্য নেই। পাওনাদাররা প্রায়ই তাঁকে বিব্রত করত। তিনি তখন যোগাভ্যাস করতেন। তখন আমরা কেউই বুঝতে পারিনি যে, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একদিনের কথা বলি, তখন কাজী নজরুল ইসলাম দৈনিক নবযুগ পত্রিকার সম্পাদক, আবুল মনসুর আহমদ পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক। নজরুল সাধারণত অফিসে আসতেন সন্ধের দিকে; আমরা কজন নবযুগ অফিসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতাম। আমি আর চতুরঙ্গ পত্রিকার আতাউর রহমান তাঁর কাছে যেতাম। একদিন সন্ধ্যায় কাজী নজরুল ইসলাম অফিসে ঢুকতে ঢুকতে চিৎকার করছিলেন, ‘মনসুর, জানো কাল রাতে একটা দারুণ ব্যাপার ঘটেছে। অরবিন্দ আমার কাছে এসেছিলেন।’ এসব কথা শুনে আমরা সবাই অবাক। অরবিন্দ তো পন্ডিচেরিতে থাকেন। তাঁর সঙ্গে গতরাতে নজরুলের কীভবে দেখা হতে পারে? কবি বললেন, ‘কালরাতে অরবিন্দ আমার কাছে এসেছিলেন। আমার যোগসাধনার সময় অরবিন্দকে দেখতে পেলাম, তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হলো। দেখলাম লোকটা ভ্রান্ত। মনে হলো তিনি একচক্ষু হরিণ। বাণ আসছে বিপরীত দিক থেকে; অথচ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। নির্ঘাত তিনি মারা পড়বেন।’ নজরুলের এসব কথাবার্তা শুনে আমরা আশ্চর্য হয়েছিলাম। পরে আমরা বুঝতে পেরেছি, যোগাসনে বসে নজরুল অনেক কিছু দেখতে পেতেন, যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। পরে আমাদের মনে হয়েছে, নজরুলের মধ্যে মানসিক বিকারের সূচনা হয়েছিল তখন থেকেই। কাজী নজরুল ইসলাম কবি ও সংগীতজ্ঞ হিসেবে অসাধারণ। আমি তাঁকে কবির চেয়ে সংগীতজ্ঞ হিসেবে বড় বলে মনে করি। নজরুল শুধু গান লিখতেন কিংবা সুর দিতেন না; সেইসঙ্গে তিনি অনেককেই গান শেখাতেন। শৈল দেবী হিজ মাস্টারস ভয়েস অফিসে নজরুলের কাছে অনেকদিন গান শিখেছেন। এছাড়া কাননবালা, আঙ্গুরবালা প্রমুখ নজরুলের কাছে গান শিখেছেন। সহকারী হিসেবে কমল দাশগুপ্ত নজরুলের নির্দেশ মানতেন, কবিকে নানাভাবে সহযোগিতা করতেন।
ইকবাল আজিজ : রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য স্মৃতি?
আবুল হোসেন : রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেখা হয়েছে শান্তিনিকেতনের উত্তরায়নে। দ্বিতীয়বার দেখা হয় কালিম্পংয়ে, গৌরীপুর ভবনে। গিয়ে দেখলাম রবীন্দ্রনাথ বিছানায় শুয়ে আছেন। আমার সঙ্গে ছিলেন হুমায়ূন কবীরের ছোটভাই আকবর কবীর। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, সেদিনই হিটলারের জার্মানির কাছে ফ্রান্সের পতন হয়েছে। রেডিওতে ফ্রান্সের পরাজয়ের খবর শুনে রবীন্দ্রনাথ একেবারে মুষড়ে পড়েছেন। তিনি আমাদের বললেন, ‘বিশ্বের শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ফ্রান্স এখন বর্বরদের দখলে। এখন আর বেঁচে থেকে কী লাভ?’
ইকবাল আজিজ : রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?
আবুল হোসেন : আমি জীবনে যত মানুষ দেখেছি, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে অসাধারণ। তাঁর চেয়ে বড় কাউকে দেখিনি।
ইকবাল আজিজ : বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী?
আবুল হোসেন : আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে। পশ্চিমবঙ্গের প্রভাব আমাদের সাহিত্য থেকে ক্রমেই কমতে থাকবে।
ইকবাল আজিজ : আধুনিক বাংলা কবিতায় কাদের কবিতা বেশি ভালো লাগে?
আবুল হোসেন : সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সমর সেনের কবিতা ভালো লাগে। এরপর যাঁরা লিখেছেন তাঁদের বিষয়ে বলা মুশকিল। তিরিশের পরবর্তীকালের কবিদের মধ্যে তেমন বড় প্রতিভা দেখতে পাইনি। চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিতা মানের দিক দিয়ে মোটেই তিরিশের কবিতার সমতুল্য নয়; বেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। এই সময়ের কবিদের মধ্যে নতুন কিছু পাইনি।
ইকবাল আজিজ : তবে পরের কবিতা?
আবুল হোসেন : এর পরের কবিতা আমার কাছে মোটেই উল্লেখযোগ্য মনে হয় না। শামসুর রাহমান প্রচুর লিখেছেন; কিন্তু আমি তাঁর কবিতায় এমন কিছু পাইনি যাতে মনে হতে পারে, তিনি তিরিশের কবিদের চাইতে আলাদা কিছু লিখেছেন।
ইকবাল আজিজ : সাহিত্যে কম্পিউটারের প্রভাব সম্পর্কে কিছু বলুন।
আবুল হোসেন : সাহিত্যের ওপর কম্পিউটারের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এখনকার বেশিরভাগ লেখক কম্পিউটারের সাহায্যে লিখছেন। তবে এতে সাহিত্যের গুণগত মানের কোনো পরিবর্তন হবে না। এছাড়া কম্পিউটার কখনই মানুষের বিচিত্র ও রহস্যময় সৃজনশীল ক্ষমতাকে অতিক্রম করতে পারবে না। বই লেখা, বই ছাপা, বাঁধাই ও প্রকাশ অব্যাহত থাকবে। কম্পিউটার কখনই বইয়ের স্থান দখল করতে পারবে না।
ইকবাল আজিজ : আপনার কি মনে হয় মৃত্যুর পরে জীবন আছে?
আবুল হোসেন : এ বড় কঠিন প্রশ্ন। আমাদের ধর্ম অনুসারে মৃত্যুর পরে জীবন আছে। আমি এতে বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি স্রষ্টা বলে একজন আছেন। স্রষ্টা বলে যদি কেউ না থাকেন, তবে এ বিশ্বজগৎ কীভাবে চলছে? বিধাতা আমাদের পাঠিয়েছেন। তা না হলে আমরা কীভাবে এলাম, কীভাবে বেঁচে আছি? আমার মনে হয়, আমরা যে জীবন যাপন করে গেলাম, তার একটা প্রভাব আমাদের পরবর্তী জীবনে পড়বে। মৃত্যুর পরবর্তী জীবন আমার মনে হয় আত্মিক। কীভাবে আমাদের পুনরুত্থান হবে, তা আমরা কেউই জানি না।
ইকবাল আজিজ : বাংলা সাহিত্যে কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে কাদের ভালো লাগে?
আবুল হোসেন : বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মানিক, তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণ – এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায় আমার প্রিয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ভালো; তবে এঁদের সমতুল্য নন।
দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার
৮ মার্চ ২০১২, সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে
ইকবাল আজিজ : ৯০ বছরে পা রেখেছেন। এখন জীবন কেমন মনে হচ্ছে?
আবুল হোসেন : হ্যাঁ, জীবনের ৯০ বছর পার হয়ে গেল। এখন এ-জীবন আর বেঁচে থাকাকে মনে হচ্ছে অসম্ভব ব্যাপার। অসম্ভব কারণ এখন চোখে দেখতে পাই না, কানে শুনি না। লিখতেও পারছি না।
ইকবাল আজিজ : ডিকটেশন দিয়ে লেখানো যায় না?
আবুল হোসেন : কাউকে দিয়েই লেখানো যায় না। সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছি না। মাথার মধ্যে কেমন যেন একটা স্থবিরতা।
ইকবাল আজিজ : ১৯৪০ সালে আপনার প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছিল। তখন কেমন লেগেছিল?
আবুল হোসেন : খুব উত্তেজিত বোধ করেছিলাম। হবীবুল্লাহ বাহার বইয়ের প্রকাশক ছিলেন। বইটির নাম নববসন্ত। তখন চল্লিশের দশক সবে শুরু হয়েছে।
ইকবাল আজিজ : তখনকার সমাজ কেমন ছিল?
আবুল হোসেন : বাঙালি মুসলমান সমাজ তখন গড়ে উঠছিল। ওদের প্রচুর সম্ভাবনা ছিল, সমস্যাও ছিল। প্রতিবেশী বাঙালি হিন্দু সমাজের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা অনেক পিছিয়ে ছিল। তবু বাঙালি মুসলমানরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। আমরা পাকিস্তান চেয়েছিলাম এই ভেবে যে, পাকিস্তানে আমাদের অনেক স্বাধীনতা থাকবে; কিন্তু আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি।
ইকবাল আজিজ : ১৯৪০ সালে আপনার প্রিয় কবি কারা ছিলেন?
আবুল হোসেন : তখন প্রিয় কবি ছিলেন সুধীন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু। মুসলমান কবিদের মধ্যে ফররুখ আহমদ।
ইকবাল আজিজ : বিশ্বকবিতায় আপনার সবচেয়ে প্রিয় কবি কে?
আবুল হোসেন : রবার্ট ফ্রস্ট আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি। এছাড়া ডব্লিউ বি ইয়েটস, টিএস এলিয়ট, অডেন – এঁরাও আমার খুব প্রিয় কবি। চল্লিশের দশকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদদী্ন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সর্বজনস্বীকৃত প্রধান কবি। তাই আলাদাভাবে এঁদের নাম করার দরকার পড়ে না।
ইকবাল আজিজ : পাকিস্তানি আমলের সাহিত্য সম্পর্কে কিছু বলুন।
আবুল হোসেন : পাকিস্তান আমলে বাঙালি মুসলমান কবিরা নতুনভাবে লিখতে শুরু করেন। আমি ঢাকার পঞ্চাশের কবিদের কথা বলছি। পশ্চিমবঙ্গের কবিতা থেকে আমাদের কবিতা তখন থেকেই কিছুটা আলাদা। পাকিস্তান আমলে ঢাকায় যে নতুন কবিদের আবির্ভাব হলো তার মধ্যে শামসুর রাহমান সর্বশ্রেষ্ঠ। এছাড়া আল মাহমুদের কিছু কবিতা উল্লেখযোগ্য। কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ও রশীদ করিমের উপন্যাস বেশ মননশীল।
ইকবাল আজিজ : পৃথিবীর অনেক জায়গায় গিয়েছেন? সবচেয়ে ভালো লেগেছে কোন দেশ?
আবুল হোসেন : ডেনমার্ক ও নরওয়ে খুব ভালো লেগেছে। ইবসেনের সুইডেনও ভালো লেগেছে।
ইকবাল আজিজ : কুষ্টিয়ায় আপনার স্কুলজীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে। কুষ্টিয়ার উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি?
আবুল হোসেন : কুষ্টিয়ায় আমার খুব আনন্দময় সময় কেটেছে। কুষ্টিয়া হাইস্কুল থেকে আমি ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করেছি। কুষ্টিয়ার লালন শাহের আখড়ার কথা মনে পড়ে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের কথাও মনে পড়ে। এসব জায়গায় অনেকবার গিয়েছি। সে-সময়ে অন্নদাশঙ্কর রায় ছিলেন কুষ্টিয়ার মহকুমা-প্রশাসক। তাঁর সঙ্গে টেনিস খেলেছি কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরি টেনিস কোর্টে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু এখন মনে পড়ছে না।
ইকবাল আজিজ : ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আপনি কলকাতায় ছিলেন। কলকাতা-জীবনের কথা কিছু মনে আছে?
আবুল হোসেন : কলকাতার তিরিশের কবিদের কথা মনে পড়ে। সেখানে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টচার্য, আবু সয়ীদ আইয়ুব, সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখের সঙ্গে। এঁদের সঙ্গে অনেক বিষয়ে আলাপ করতাম।
ইকবাল আজিজ : স্বাধীন বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে কিছু বলুন।
আবুল হোসেন : বাংলাদেশের নতুন কোনো প্রতিভাবান সাহিত্যিকের নাম মনে পড়ছে না। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কবিতা লেখা হয়নি।
ইকবাল আজিজ : পশ্চিমবঙ্গের সমকালীন কবিতা?
আবুল হোসেন : সমকালীন পশ্চিমবঙ্গে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কবি বা কবিতা লক্ষ করিনি।
ইকবাল আজিজ : তাহলে কি সেই পুরনো কবিতাই এখনো উল্লেখযোগ্য?
আবুল হোসেন : হ্যাঁ, এখনো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীন, সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যের সেরা কবি।
ইকবাল আজিজ : বাংলা সাহিত্যে ভালো কথাশিল্পী কারা?
আবুল হোসেন : অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মানিক, বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্কর – এঁদের উপন্যাস ও গল্প আমার ভালো লাগে।
ইকবাল আজিজ : আপনার বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যের সেরা উপন্যাস কোনটি?
আবুল হোসেন : রবীন্দ্রনাথের গোরা আমার পড়া বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে স্মরণীয় উপন্যাস।
ইকবাল আজিজ : আপনি কি ভাগ্যে বিশ্বাস করেন?
আবুল হোসেন : ভাগ্যের ওপর নির্ভর করি না। কর্মে বিশ্বাস করি।
ইকবাল আজিজ : ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?
আবুল হোসেন : আল্লাহকে স্রষ্টা হিসেবে মানি। কিন্তু তিনি কিছুই করে দেন না। নিজের ভাগ্য নিজেকেই গড়তে হয়। স্রষ্টা আছেন; কিন্তু তিনি সব করে দেন না। মানুষকেই সবকিছু গড়ে নিতে হয়। স্রষ্টা নিজেকে গড়ার কিংবা চারপাশকে বদলাবার সব শক্তিই মানুষকে দিয়েছেন।
ইকবাল আজিজ : ৯০ বছরে পদার্পণ করে জীবন সম্পর্কে আপনার কী উপলব্ধি?
আবুল হোসেন : এত দীর্ঘ সময় পার হয়ে মনে হচ্ছে, এ-জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি। এখন আমি নতুন করে কিছু পাবো – এমন আশা করি না। জীবনে যা পেয়েছি তাতেই আমি সন্তুষ্ট।
ইকবাল আজিজ : বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে আপনার প্রত্যাশা?
আবুল হোসেন : অনেকের আশা ছিল, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। কিন্তু তা হয়নি।
ইকবাল আজিজ : ধানমন্ডিতে ‘সাহানা’ নামের বাসায় কবে থেকে আছেন?
আবুল হোসেন : ১৯৭১ সাল থেকে আমার নিজের এ-বাসায় আছি। বাড়ির নাম ‘সাহানা’। আমার স্ত্রী সাহানার নামে এ-বাড়ির নাম। ১৯৯৬ সালে আমার স্ত্রী মারা গেছেন। দাম্পত্যজীবনে আমি খুবই সুখী ছিলাম। এখন আমার সন্তানেরা আমার দেখাশোনা করে। আমি একটুকু অবহেলার শিকার নই। বরং ওরা আমাকে খুবই যত্নে রেখেছে।
ইকবাল আজিজ : আপনার স্নেহভাজন সাহিত্যিক আবদুল মান্নান সৈয়দ মারা গেছেন। তাঁর কথা মনে হয়?
আবুল হোসেন : মান্নানের মৃত্যুতে খুব কষ্ট পেয়েছি। ও ছিল আমার ভীষণ অনুরাগী।
ইকবাল আজিজ : আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
আবুল হোসেন : আমি চারিদিকে আশাব্যঞ্জক কিছুই দেখছি না। চারিদিকে অন্ধকার।
ইকবাল আজিজ : বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের অবস্থা কেমন মনে হচ্ছে?
আবুল হোসেন : আমি আশাপ্রদ কিছু দেখছি না। সমাজ উন্নতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে হয় না। চারিদিকে কেবলই অন্ধকার। শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে সমাজ তেমন অগ্রসর হয়নি।
ইকবাল আজিজ : বাংলাদেশ কি কখনো একটি উন্নত রাষ্ট্র হতে পারবে?
আবুল হোসেন : উন্নতির কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না।
ইকবাল আজিজ : এর জন্যে দায়ী কারা?
আবুল হোসেন : এর জন্যে দায়ী আমাদের দেশের রাজনীতিকরা। তাঁদের মধ্যে সততা ও দেশপ্রেম নেই।
ইকবাল আজিজ : মৃত্যু সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?
আবুল হোসেন : আমি মৃত্যুর কথা ভাবি না। মৃত্যুভয় আমার নেই। আমি জানি মৃত্যু অবধারিত। যাওয়ার সময় হলে আমাকে যেতেই হবে চিরকালের জন্য।
ইকবাল আজিজ : মৃত্যুর পরবর্তী কোনো জীবন আছে বলে মনে হয়?
আবুল হোসেন : মৃত্যুর পরে কোনো জীবন আছে বলে মনে হয়, তবে মৃত্যুর পরে কিছু আছে কিনা জানি না।
ইকবাল আজিজ : আপনি কি আত্মায় বিশ্বাস করেন?
আবুল হোসেন : বিশ্বাস করি আত্মা আছে। সেটার একটা গতি আছে। কিন্তু কী আছে তা আমি জানি না।
ইকবাল আজিজ : স্ত্রীর কথা মনে পড়ে?
আবুল হোসেন : খুবই মনে পড়ে। ওর কবর আছে মিরপুর গোরস্তানে। ওর কবরের পাশে আমার কবরের জায়গা রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত আমার কবর কোথায় হবে আমি জানি না।
ইকবাল আজিজ : আপনার দীর্ঘ জীবনে শত্রুদের মোকাবেলা করতে হয়েছে কি? এখন আমাদের চারপাশে অনেক শত্রু, অনেক প্রতিকূলতা।
আবুল হোসেন : আমি কোনো শত্রুকে পাইনি। শত্রুদের কথা একবারও ভাববে না, তাদের এড়িয়ে চলবে – ভুলে যাবে। তাহলে আর এটা কোনো সমস্যা হবে না।
ইকবাল আজিজ : আমাদের প্রতি আপনার উপদেশ কী?
আবুল হোসেন : উপদেশ কাউকেই দিতে চাই না। তবে আশা করি মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উন্নতি হবে। মানুষ শান্তি ও কল্যাণের দিকে অগ্রসর হবে। 