কবি আল মাহমুদ : আধুনিকতায় লোকজ উপাদান

আবিদ আনোয়ার

পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ। বোদলেয়ারীয় আধুনিকতায় জারিত আমাদের প্রায় সব কবির রচনায় যখন স্বকালের বন্ধ্যত্ব, নৈরাশ্যবাদিতা, পাশ্চাত্যের অনুকরণে মেকি নগর-যন্ত্রণা এবং এক সর্বগ্রাসী বিনষ্টি ও বিমানবিকীকরণের আগ্রাসন ঘটেছিল, তখন আল মাহমুদ তাঁর প্রবেশলগ্নের দেশজতা, মানবিকতা, সাম্যবাদ ও এতে লগ্ন থাকার আকুতি দিয়েই আকৃষ্ট করেছিলেন পাঠককে। কিন্তু এসবের পরিণতিপ্রাপ্তির আগেই তিনি ‘মানবিক নির্মাণের প্রতি’ আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন বলে ঘোষণা দিয়ে কিছু ‘ইসলামি’ কবিতা লেখার প্রয়াস পান, যা কাব্যরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ এই নয় যে, এগুলোর বিষয়বস্ত্ত ইসলাম ধর্ম এবং আল্লাহ-রাসূলের স্ত্ততি। এর মূল কারণ তাঁর প্রবেশলগ্নের কবিতার শিল্প-সফলতা এগুলোতে প্রতিফলিত হয়নি। শেষোক্ত কবিতাগুলো তাঁর মধ্যবয়স থেকে শুরু করে শেষ-বয়সে লেখা এবং সম্ভবত বয়স বাড়ার কারণেই কবিত্বশক্তিও হ্রাস পেয়েছে, যেমনটি ঘটে থাকে প্রায় সব কবির ক্ষেত্রেই। অবশ্য প্রবেশলগ্ন থেকেই আল মাহমুদের অনেক ভালো কবিতাও নির্মাণকলার বিবেচনায় নানারূপ স্খলন-পতনের শিকার হয়েছে। এসব সীমাবদ্ধতা নিয়েও তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন তাঁর কবিতার প্রসাদগুণের কারণে। সব ছন্দেই তিনি পারদর্শী হলেও বিশেষত পয়ারনির্ভর তাঁর কবিতা পাঠককে মুগ্ধ করে সহজ-সচ্ছল ডিকশনের (উচ্চারণের) কারণে। কিন্তু অত্যন্ত বড়মাপের কবি হয়েও ছন্দ ও মিল রক্ষার্থে স্বভাবকবিদের মতো তিনি অনেক স্থানে অর্থবিপত্তি তৈরি করেছেন, যা এ-লেখার শেষাংশে আলেচিত হলো।

আল মাহমুদের প্রবেশলগ্নের কবিতা লোকজ ঐতিহ্যে সিক্ত হলেও জসীমউদ্দীনের মতো লোকায়ত জীবনের রূপকার নন তিনি। তিরিশি কাব্যতত্ত্বের নিরিখে আল মাহমুদও ‘আধুনিক’ কবি। আধুনিকতায় লোকজ উপাদানের ব্যবহার সূচিত হয়েছিল চল্লি­শের দশকে কবি আহসান হাবীবের হাতে। আল মাহমুদ একে ব্যাপকতা দান করেছেন এবং এ-বিষয়টিও তাঁর নিজস্বতা অর্জনের অন্যতম উপাদান।

তিরিশি আন্দোলন থেকে উদ্ভূত নাগরিক চেতনাসমৃদ্ধ আধুনিকতার যখন জোয়ার এসেছে বাংলাদেশের কবিতায়, জসীমউদ্দীনের রচনায় তখনো লালিত হচ্ছিল আবহমান  লোক-ঐতিহ্যের ক্ষীণ ধারাটি, যা এই অনগ্রসরমান দরিদ্র ভূখন্ডের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু আঙ্গিক ও ভাষার পশ্চাৎপদতা এবং জীবনদর্শনের ভিন্নতার কারণে নবীন কবিরা জসীমউদ্দীনকে চিহ্নিত করলেন ‘পল্লিকবি’ হিসেবে। মধ্যপঞ্চাশে আধুনিকতার মিছিলে শরিক হন কবি আল মাহমুদ এবং আধুনিকতায় লোকজ উপাদান ব্যাপকভাবে যুক্ত করে হয়ে ওঠেন বহুল আলোচিত। কিন্তু তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ সোনালি কাবিনের পর থেকে তাঁর কবিতায় এই বৈশিষ্ট্য ম্লান হয়ে পড়ে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তরের ‘অরণ্যে ক্লান্তির দিন’, ‘তিতাস’, ‘এমন তৃপ্তির’, ‘নৌকোয়’ ইত্যাদি কবিতায় গ্রামীণ ঐতিহ্যলগ্নতার যে-আভাস ঝলকে উঠেছিল, তা দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কালের কলস এবং বিশেষ করে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ সোনালি কাবিনে এসে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। সমগ্র আল মাহমুদকে শনাক্ত করার আগে লোক-ঐতিহ্যসংলগ্ন আল মাহমুদ বিশেষ আলোচনার দাবি রাখেন, কেননা তাঁর কবি-পরিচয়ের সঙ্গে সম্পৃৃক্ত হয়ে আছে এ-বিষয়টি।

কালের কলস ও সোনালি কাবিনের বহু কবিতার বিষয়বস্ত্তও এই গ্রামীণ জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হঠাৎ ‘নাগরিক’ বনে-যাওয়ার, বিশেষ করে এলিয়টীয় বিরানবিশ্বে প্রবেশের টানাপড়েন ও আক্ষেপ। কালের কলসে ‘জল দেখে ভয় লাগে’, ‘ফেরার পিপাসা’, ‘হে আচ্ছন্ন নগরী’, ‘প্রত্যাবর্তন’ ইত্যাদি কবিতায় এ-আক্ষেপের শুরু :

আমরা যেখানে যাবো শুনেছি সেখানে নাকি নেই

বাঁচার মতন জল, জলস্রোত, বর্ষণ হবে না

নি-পাখি ভীষণ নীল দগ্ধদেশে উদ্ভিদহীনতা

হা হা করে দিনমান। বাতাসের বিলাসী বিরোধে

বিহঙ্গ বিব্রত হয়…

(‘জল দেখে ভয় লাগে’, কালের কলস)

 

বত্রিশ সায়েদাবাদ ঢাকা – এই বিষণ্ণ দালানে

তেমন জানালা কই যাতে বাঁকা নদী দেখা যায়

ধবল পালের বুক যেন মা’র বক্ষেণর উপমা…

(‘ফেরার পিপাসা’, কালের কলস)

 

আমিও যখন এসেছি নগরে এ কি!

তোমার শরীরে আভরণ নেই কোনো

পশুর থাবায় বিঁধে আছে চেয়ে দেখি

নাভিমূল আর কামনার অঙ্গনও…

(‘হে আচ্ছন্ন নগরী’, কালের কলস)

 

দ্যাখো, জয়নুলের ছবির মত ঘরবাড়ি, নারী

উঠোনে ঝাড়ছে ধান, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ি;

গতর উদোম ক’রে হাতে-লেপা মাটির চত্বরে

লাঞ্ছিত নিশেন হয়ে পড়ে আছে যেন অনাদরে

(‘প্রত্যাবর্তন’, কালের কলস)

 

সোনালি কাবিনের ‘প্রকৃতি’, ‘দায়ভাগ’, ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’, ‘স্বপ্নের সানুদেশে’, ‘তোমার হাতে’, ‘নতুন অব্দে’, ‘পালক ভাঙার প্রতিবাদে’, ‘খড়ের গম্বুজ’, ‘এক নদী’ ইত্যাদি কবিতায় এই আক্ষেপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো একটি মাত্রা। তা হলো, এই গ্রামীণ ঐতিহের সঙ্গে লগ্ন থাকার প্রবল আকুতি ও সগর্ব স্বীকারোক্তি :

কতদূর এগোলো মানুষ!

কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে

আজও উবু হয়ে আছি। ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে

কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে

ভাবলাম, এ-মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষাণী আমার…

(‘প্রকৃতি’, সোনালি কাবিন)

 

কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে

ফিরবো

 

আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের

লজ্জাকে

ঘষে ঘষে

তুলে ফেলবো

(‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’, সোনালি কাবিন)

. . . . .

চিৎকার, কান্না ও হতাশার গোলকধাঁধা ছেড়ে

আমরা বেরিয়ে যাবো…

(‘স্বপ্নের সানুদেশে’, সোনালি কাবিন)

আল মাহমুদের তখনকার কাব্যভাবনা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে ‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতাটিতে। এ-কবিতায় দেখি : গ্রামের একদল মানুষ (কবির ভাষায় ‘শস্যের শিল্পীরা’) ক্ষেতের আলের ওপর বসে তামাক সাজাচ্ছে। স্বনির্মিত হতাশার দেয়ালঘেরা এক দুঃস্বপ্নময় ভুবনে বন্দি নাগরিক অপসংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী শহর-প্রত্যাগত এক বালকের উদ্দেশে ‘একগাদা বিচালি বিছিয়ে দিতে দিতে’ তাদের সঙ্গে বসে যাওয়ার আহবান জানাচ্ছে তারা। কিন্তু সে-বালকের পরনে ‘নগরের নিভাঁজ পোশাক খামছে ধরেচে হাঁটু’ এমনভাবে যে, সে কিছুতেই তার ‘দেশের মাটির বুকে আনায়াসে’ বসতেই পারছে না; অথচ এই বালকের মৌলিক পরিচয় : তার ‘বাপের মারফতি টান শুনে বাতাস বেহুঁশ হয়ে যেতো’। আল মাহমুদ এ-কবিতার অভ্যন্তরে একস্থানে সুদৃঢ় প্রত্যয়ের সুরে সেই বালকের উদ্দেশে বলে উঠেছেন : ‘তোমাকে বসতে হবে এখানেই/ আদরে এগিয়ে দেয়া হুঁকোটাতে সুখটান মেরে/ তাদের জানাতে হবে কুহলি পাখির পিছুপিছু/ কতদূর গিয়েছিলে পার হয়ে পানের বরুজ।’

কিন্তু না, আল মাহমুদ নিজেই বসলেন না সেখানে। সেই ‘কুহলি পাখি’র পিছু ধাওয়া করতে-করতে এক অলীক মায়াবী জগতে প্রবেশ করার প্রয়াস পেলেন তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ মায়াবী পর্দা দুলে ওঠোতে। এর পরবর্তীকালে ধর্মচেতনা এবং পারস্য ও আরবীয় মুসলমান সভ্যতার ঐতিহ্য ব্যবহারের নামে আরো অলীক এক জগতে প্রবেশ করলেন তিনি। তবে, এরই মধ্যে প্রথমোক্ত কাব্যবিশ্বাসের সঙ্গে লগ্ন বহু উজ্জ্বল কবিতা তিনি উপহার দিয়েছেন পাঠককে। বিশেষ করে তাঁর সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ বাংলা কবিতার ভান্ডারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

‘সোনালি কাবিন’ – এই অভিন্ন শিরোনামের ১৪টি সনেটের বিষয়বস্ত্ত অভিন্ন নয়। এক নারীকে উদ্দেশ করে উচ্চারিত এই সনেটগুচ্ছে কবির নিজস্ব প্রেমানুভূতির প্রাধান্য থাকলেও বহু বিচিত্র বিষয়ের অবতারণা রয়েছে। আবহমান বাঙালি সমাজের নানা অনুষঙ্গ, মিথ ও সাহিত্য-ঐতিহ্য, প্রাচীন বঙ্গভূমির সমাজব্যবস্থার ও তাঁর কালের বাঙালি-সমাজের নানা বিসংগতি থেকে ফসলের সুষম বণ্টন অর্থাৎ সাম্যবাদের মতো রাজনৈতিক ভাবনা পর্যন্ত স্থান পেয়েছে সনেটগুলোতে। অবশ্য ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩ ও ১৮ নম্বর সনেটে কেবলই রয়েছে এক নারীর প্রতি কবির ব্যক্তিগত প্রেমানুভূতির প্রকাশ। রোমান্টিক যুগের কবিদের মতো এই প্রেমানুভূতি নিষ্কলুষ নয়। আল মাহমুদের অন্যান্য প্রেমের কবিতার মতোই ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছেও প্রেম প্রকাশিত হয়েছে নরনারীর সংসার-জীবনের বাস্তবতার আলোকে। শরীরী প্রেমের এমন খোলামেলা প্রকাশ বাংলা কবিতায় তেমন চোখে পড়ে না :

বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল

পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;

তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল

জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে হবো চিরচেনা…

 

চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ

উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়…

 

বাঙালি কৌমের কেলি কল্লো­লিত কর কলাবতী

জানে না যা বাৎসায়ন আর যত আর্যের যুবতী…

৪, ৯ ও ১১ নম্বর সনেটে কবির দয়িতার প্রতি তাঁর প্রেম প্রকাশের ভঙ্গিতেই মিথ ও সাহিত্য-ঐতিহ্যের ব্যবহারে কবি           যে-দক্ষতা দেখিয়েছেন তা লক্ষণীয় :

মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়,

ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি

কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়…

 

পূর্বপুরুষেরা ছিলো পাট্টিকেরা পুরীর গৌরব,

রাক্ষসী গুল্মের ঢেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে

ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব…

 

কী করে মানবো বলো, শ্রীজ্ঞানের জন্মভূমি এই

শীলভদ্র নিয়েছিলো নিঃশ্বাসের প্রথম বাতাস…

সাম্যবাদের মতো রাজনৈতিক ভাবনাও অত্যন্ত শিল্পিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে ৬, ৭, ৯, ১০ ও ১২ নম্বর সনেটে। কাজী নজরুল ইসলাম ও সুকান্ত ভট্টাচার্য বাদে অন্যদের হাতে রচিত যেসব সাম্যবাদী কবিতা আমাদের সাহিত্য-ভান্ডারে রয়েছে তার অধিকাংশই স্লে­াগানসর্বস্ব পদ্যস্তরের রচনা। সে-বিবেচনায় আল মাহমুদের এই কবিতাগুলোয় অত্যন্ত শিল্পিত প্রকাশভঙ্গি লক্ষযোগ্য হয়ে উঠেছে। এসব কবিতায় উদ্দিষ্ট নারী হয়ে উঠেছে অনেকটা দেশমাতৃকার অনুরূপ :

ধ্রুপদের আলাপনে অকস্মাৎ ধরেছি খেউড়

ক্ষমা করো হে অবলা, ক্ষিপ্ত এই কোকিলের গলা;

তোমার দুধের বাটি খেয়ে যাবে সোনার মেকুর

না-দেখার ভান করে কতকাল দেখবে চঞ্চলা…

 

লুলিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বারবার

বর্গিরা লুটেছে ধান, নিম খুনে ভরে জনপদ

তোমার চেয়েও বড়ো, হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ…

 

শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত

হিয়েন সাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,

এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত

তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা…

৬ ও ১১ নম্বর সনেটে প্রকাশ পেয়েছে যথাক্রমে আমাদের মধ্যযুগ ও বর্তমান কালের কবি-সাহিত্যিক তথা পন্ডিতসমাজের ভন্ডামি ও রাজনৈতিক চাপের মুখে তাদের মেরুদন্ডহীনতার কথা, যা কবির ভাষায় ‘ফসলের সুষম বণ্টনে’ ও ‘লোকধর্মে ভেদাভেদ’ দূর করতে প্রবল বাধা হয়ে আছে :

পূর্বপুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস

বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড়,

সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।

মুখ ঢাকে আলাওল – রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার…

 

জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো, ঝুলে আছে বিষণ্ণ বাদুড়,

অতীতে বিশ্বাস রাখা হে সুশীলা, কেমন দুরূহ?

…            …         …

বিদ্যালয়ে কেশে ওঠে গুটিকয় সিনানথ্রোপাস,

…            …         …

আমাদের কলাকেন্দ্রে, আমাদের সর্ব কারুকাজে

অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা…

আল মাহমুদের সমগ্র রচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ শুধু নয়, এই কাব্যগ্রন্থের অন্যান্য কবিতায়ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম ফসল ফলিয়েছেন তিনি।

বলেছি : মায়াবী পর্দা দুলে ওঠোর পর্ব পার হয়ে আল মাহমুদ যে ইসলামি চেতনাসমৃদ্ধ কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন তা পাঠকের তেমন দৃষ্টি কাড়েনি। এক্ষণে এর কারণ চিহ্নিত করার চেষ্টা করা যাক।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর প্রকাশের পরপরই তিনি কবি হিসেবে নন্দিত হয়ে ওঠেন। প্রবেশলগ্নে কিছুটা আত্মজৈবনিকতায় আক্রান্ত আল মাহমুদ এক দেশকালহীন ‘আমি’র অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন সে-গ্রন্থের ‘আমি’ শিরোনামের কবিতায়। লোক লোকান্তর গ্রন্থভুক্ত ‘বিষয়ে দর্পণে আমি’ কবিতায় নিজের ভেতরে যে ‘শিশু আর পশুর বিরোধ’ দেখে আল মাহমুদের কাব্য-অভিযাত্রার শুরু, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো পর্যন্ত তাঁর সমগ্র রচনায়ও লেগে ছিল সেই বিরোধের সুর। এই বিরোধ নাগরিক আল মাহমুদের সঙ্গে তিতাস-পারের আল মাহমুদের, কবিতার স্বধর্মে বিশ্বাসী আল মাহমুদের সঙ্গে ধার্মিক আল মাহমুদের এবং সর্বোপরি ছিন্নমূল আধুনিকতায় বিশ্বাসী আল মাহমুদের সঙ্গে শিকড়-সন্ধানী আল মাহমুদের। মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো পর্যন্ত তাঁর নান্দনিক চেতনায় জীবন ও জগৎ, ধর্ম ও কবিতার স্বধর্ম ঘিরে এক দোদুল্যমানতাই তাঁর কবিতাকে এক দ্বান্দ্বিক দ্যোতনায় শিল্পিত করে তুলেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই দ্বন্দ্ব অবসিত হয়ে তাঁর একরৈখিক ‘বিশ্বাসের চর’ ভেসে ওঠায় শিল্পও অন্তর্হিত। এ-পর্যায়ে প্রকাশিত একটি কাব্যসংগ্রহের ভূমিকায় এবং ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’র অনেক কবিতায় তিনি ‘মানবিক নির্মাণের প্রতি আস্থা’ হারিয়ে ফেলেছেন বলে পাঠকদের জানিয়েছেন। এ-গ্রন্থের ‘বিশ্বাসের চর’ কবিতায় তিনি আবিষ্কার করেছেন অন্য এক ‘আমি’র অস্তিত্ব, যে মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন ও কাতর এবং ঈশ্বর-স্ত্ততি ও ধর্মে নিবেদিতপ্রাণ। লোক লোকান্তরের ‘আমি’ আর শেষোক্ত ‘আমি’ দুই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। শেষোক্ত ‘আমি’ বলছে ‘ভুলে গেছি নিজের কী নাম/ কী নামে ডাকতো লোকে, কোন গ্রামে ছিলো বাড়িঘর’ (‘বিশ্বাসের চর’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)। প্রথমোক্ত ‘আমি’ ছিল আত্মজৈবনিক সৃজনশালায় প্রবেশের ‘আমি’, যে টের পেত হরিণের কস্ত্তরীর মতো এক ‘গন্ধের ফুল’ লুকিয়ে আছে তার নিজের ভেতরে (‘নেশার সুরভি যেন’, লোক লোকান্তর), যে ‘আমি’ অনুভব করতো ‘পৃথিবীর সবেচেয়ে দামী ছিলো বুঝি আমাদের কয়েকটি কবির হৃদয়’ (‘অধ্যয়ন’, লোক লোকান্তর) এবং সগৌরবে ঘোষণা করত ‘কবিতার আসন্ন বিজয়’ (লোক লোকান্তর গ্রন্থের নাম-কবিতা)। কিন্তু শেষোক্ত ‘আমি’ ঈশ্বর, ধর্মীয় অনু্শাসন ও মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পিত ‘আমি’ যে মানবিক সৃষ্টিকর্মকেই অস্বীকার করে, যে ‘আমি’ টের পায় ঈশ্বর ও মৃত্যুচিন্তার ঘুণ ‘চোরের মতো’ কেটে ফেলছে তার এতদিনকার লালিত মূল্যবোধের শিকড়। প্রথমোক্ত ‘আমি’র চোখ ছিল ‘অতিরিক্ত অবলোকনশক্তির অধিকারী’ যাতে ‘প্রতিটি বস্ত্তর বর্ণচ্ছটা বিকীর্ণ’ হতো (‘চোখ’, সোনালি কাবিন) আর শেষোক্ত ‘আমি’র চোখ ‘ঘোলাজলের গর্তে হারিয়ে-যাওয়া’ শিশুর মার্বেলের মতো নিখোঁজ (‘আমার উদ্যোগ’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)। প্রথমোক্ত সৃষ্টিশীল ‘আমি’ মায়ের হারিয়ে-যাওয়া ‘নাকের নোলক’ ছাড়া ‘ঘরকে যাবো না’ বলে প্রতিজ্ঞা করত (‘নোলক’, পাখির কাছে ফুলের কাছে) আর শেষোক্ত ‘আমি’ অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখছে ‘বানের জল এতো ঘোলা যে হারিয়ে-যাওয়া নাকফুলের হদিস করতে আজ আর কেউ নদীতে নামবে না’ (‘আদি সত্যের পাশে’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)।

আল মাহমুদের অহং একদিন হতে চেয়েছিল ‘জীবনের জলাধারে তুমুল রোহিত’ আর এক-পর্যায়ে এসে জীবনমুখী শিল্পচর্চাকেই অস্বীকার করে হয়ে ওঠেন ঈশ্বর ও মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন, যা তাঁকে ঠেলে দিয়েছে এক বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিক ভুবনে, যেখানে মানবিক সৃষ্টি একান্তই অসার ও মূল্যহীন। অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্নায় জীবন নয়, মৃত্যুরই জয়জয়কার। জীবনানন্দের  মতো মৃত্যু এ-পর্যায়ে আল মাহমুদের কাছেও প্রেয়সীর মতোই মোহময় ও মাধুরীমন্ডিত। অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্নায় কবির মৃত্যুচিন্তার সাক্ষ্য বহন করে তাঁর ‘হৃদয়ের একদিকে’, ‘শ্রাবণ’, ‘বিশ্বাসের চর’, ‘ধমনীর ধ্বনি’, ‘সহনশীলতা’, ‘অন্ধলগ্ন’, ‘মানুষের স্মৃতিস্তম্ভে’ এবং আরো অনেক কবিতা :

নিরাসক্ত ব্যথা ও বিস্বাদ

ফোঁটা ফোঁটা ঝরে যাক। দেখা যাক কেমনে সে চায়

আমাকে আরাম দিতে, নিয়ে যেতে আমার স্পন্দন…

(‘হৃদয়ের একদিকে’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)

 

শাদা শাড়ি ঘোমটার আড়ালে মুখ

সামনে বেহারাহীন পর্দায় ঢাকা কালো পালকি…

(‘শ্রাবণ’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)

 

কোয়াক কোয়াক করে ডাকছে

একটি যাযাবর হাঁস। এক মাঝি

পালের দড়িদড়া ঠিক করতে করতে

গাইলো ‘মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে

আমি আর বাইতে পারলাম না।’

(‘আদি সত্যের পাশে’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)

জীবনানন্দীয় মৃত্যুভাবনা থেকে আল মাহমুদীয় মৃত্যুভাবনার পার্থক্য বিস্তর। আল মাহমুদ তাঁর মৃত্যুভাবনার সঙ্গে ঈশ্বর ও ধর্মের অনুষঙ্গ যুক্ত করেছেন, যা জীবনানন্দ করেননি।

 

আমাদের আধুনিক কবিতার দুই দশক : বরেণ্য কবিদের নির্মাণকলা

আল মাহমুদের কবিতা শীর্ষক একটি গ্রন্থের ভূমিকায় কবি লিখেছেন, ‘জাগতিক সব সৌন্দর্যবোধই শেষপর্যন্ত ক্লান্তিকর, যেমন নদীর সাথে নারীর তুলনা… এখন আর প্রাণের সাথে প্রকৃতির তুলনা আমাকে তৃপ্তি দেয় না, বরং ছেলেখেলা মনে হয়… পবিত্র কোরান পাঠ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে আমার অতীতের সর্বপ্রকার ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধকেই পালটে দেয়।’ কিন্তু আমরা দেখতে পাই, আল মাহমুদের ধ্যান-ধারণায় ও  মূল্যবোধে প্রথম থেকেই এই বিশ্বাস অঙ্কুরিত ছিল। এর প্রমাণ মেলে প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কালের কলসের কিছু কবিতায় :

মানুষের শিল্প সে তো নির্বোধের নিত্য কারিগরি

রুমালের অাঁকা দাগে রঙিন সুতোয় ফুল তোলা

সাপের অলীক চিত্রে নির্বিষ সাজানো কালো দড়ি

কাদার মূর্তিতে কারো সাধ্যমতো অাঁটা পরচুলা…

(‘আমরা পারি না’, লোক লোকান্তর)

 

কুটিল কৌশলে শুধু শিল্পী থাকে পটের আড়ালে

অর্থাৎ সমস্ত বুঝি গরিমার গোপনে গর্হিত

প্রবল ইচ্ছায় শুধু ধরে রাখা কদর্য দুষ্কৃতি…

(‘জলছবি’, কালের কলস)

 

স্বর্গহারা, ঈশ্বরতাড়িত ও অভিশপ্ত আদম-হাওয়া তথা মনুষ্য প্রজাতির এই ‘গর্হিত’ ‘কদর্য দুষ্কৃতি’ই মূলত তার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের যোগফল এবং মানবজন্মের গরিমা। ঈশ্বর ও দেবদেবীর স্তোত্রপাঠে নিবেদিত সাহিত্যের ভেতর থেকে মানুষ একসময় উপলব্ধি করলো (অক্ষয়কুমার বড়ালের ভাষায়) : ‘সেই আদি যুগে যবে অসহায় নর নেত্র মেলি’ ভবে/ চাহিয়া আকাশপানে কারে ডেকেছিলো – দেবে না মানবে?/ কাতর আহবান সেই মেঘে মেঘে উঠি’ লুটি’ গ্রহে গ্রহে/ ফিরিয়া কি আসে নাই না-পেয়ে উত্তর ধরায় আগ্রহে/ সেই ক্ষুব্ধ অন্ধকারে মরূৎ গর্জনে কার অন্বেষণ?/ সে নহে বন্দনাগীতি, ভয়ার্ত ক্ষুধার্ত খুঁজিছে স্বজন।’ সেই আকাশমুখিনতার ব্যর্থতা নিয়ে স্বজনের কাছে ফিরে-আসা মানুষই ‘শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান’কে অস্বীকার করে খুলে দিয়েছিল জীবনমুখিনতার এক বিশাল দরোজা; রাধার স্থান দখল করে নিল মানুষের দেশের নারী, এমনকি ধীরে ধীরে শয্যাসঙ্গিনী পতিতাও। নিজেকেই ক্ষুদে স্রষ্টা বলে ঘোষণা করল মানুষ, আর বিগত শতাব্দীর মধ্যপঞ্চাশে আল মাহমুদ নিজেও উপলব্ধি করলেন : ‘পৃথিবীর  সবচেয়ে দামী ছিল বুঝি আমাদের কয়েকটি কবির হৃদয়।’ নিজেরই সৃষ্টির গৌরবে তিনি বলে উঠতে পেরেছিলেন, ‘মনে হয় কেটে যাবে, ছিঁড়ে যাবে সমস্ত বাঁধুনি/ সংসার সমাজ ধর্ম তুচ্ছ হয়ে যাবে লোকালয়/ লোক থেকে লোকান্তরে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে শুনি/ আহত কবির গান, কবিতার আসন্ন বিজয়;’। এমনকি এই বিজয়ের গর্বে আল মাহমুদ অনুভব করেছিলেন ‘হুড়মুড় শব্দে’ ভেঙে পড়ছে তাঁর ‘পাড়ার মসজিদ’। কিন্তু শেষমেশ তিনিই বললেন : ‘নদীর সাথে নারীর তুলনা’, ‘প্রাণের সাথে প্রকৃতির তুলনা’ এখন আর তাঁকে তৃপ্তি দেয় না… ছেলেখেলা মনে হয়। কবিতার পাঠক সংগত কারণেই প্রশ্ন করতে পারেন : তাহলে কবিতার আর অবশিষ্ট রইলো কী? পার্থিব নারী-নদী-প্রকৃতি আর মানুষকে নিয়ে যে স্বসৃষ্ট আনন্দলোক সৃষ্টি করেন কবিরা, আল মাহমুদও তাঁর বাসিন্দা হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে-ভুল তার ভেঙে গেছে বলে ঘোষণা দিলেন চারটি কাব্যগ্রন্থের পরই। যে বৈকুণ্ঠবিলাসী বৈষ্ণবীয় লীলাবাদ অনেক আগেই পরিত্যক্ত, তাকেই আলিঙ্গন করবেন বলে এক জীবনবাদী কবি তাঁর যাবতীয় ‘প্রশ্নমালাকে ঘুরিয়ে’ ধরলেন ‘আকাশের দিকে’। ধর্ম ভিন্ন হলেও প্রার্থনার স্বরূপ এক এবং জীবনবিচ্ছিন্নতার কারণে অনাধুনিক। এরপরও আমি চেষ্টা করেছি এসব কবিতায় শিল্পমূল্য আবিষ্কার করতে। কিন্তু মৃত্যুচিন্তায় কাতর একজন কবি মানবিক নির্মাণের প্রতি আস্থা হারিয়ে নিজের কাব্যপ্রতিভাকেই যেন মেরে ফেললেন। আল মাহমুদের প্রথম দিককার কবিতার তুলনায় এগুলো অত্যন্ত ম্ল­ান। তাঁর শেষ পর্যায়ের অধিকাংশ ‘আধ্যাত্মিক’ কবিতা এতটাই  বক্তব্যধর্মী যে, কেবল প্রাবন্ধিক সিদ্ধিলাভ করেই নিঃশেষিত হয়েছে; কয়েকটি উদাহরণ :

কোনো উদ্যোগই আর প্রস্ফুটিত হয় না।

বীজ বপনের ক্ষেত্রগুলোও আমি ভুলে গেছি

যেমন চাঁদে-পাওয়া চাষী ভুলে যায় নিজের কর্ষিত ভূমি

অনেকটা তেমনি…

(‘আমার উদ্যোগ’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)

 

লবিদ ছিলেন আলোর পথে পদচারণাকারী

একজন সত্যিকার মানুষ। একজন কবি।

তিনি আল্লার সত্যবাণী ও মানুষের কণ্ঠস্বরের

পার্থক্য নির্মাণ করেছিলেন…

(‘লবিদের কথা’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, কবিতার নির্মাণকলায় আল মাহমুদের শক্তিমত্তাকে বুঝতে হলে আমাদেরকে অনিবার্যভাবেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে তাঁর মাত্র প্রথম চারটি কাব্যগ্রন্থের ওপর। কোনো কবির রচনায় যে শক্তিমত্তা ও শিল্পমূল্য অভিনিবেশী পাঠক খুঁজে বেড়ান, তা আল মাহমুদের মধ্য থেকে শেষ পর্যায়ের রচনায় অনুপস্থিত। এগুলোর আলোচনায় এমন কোনো তথ্য বেরিয়ে আসবে না, যা নতুন এবং পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরার যোগ্য।

 

আল মাহমুদের কবিতায় ছন্দ-প্রকরণ

এ-বিষয়ে আলোচনা শুরুর আগে কবিতায় ছন্দ-প্রকরণের গুরুত্ব বিষয়ে আল মাহমুদের নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা যাক। কিছু নবীন কবির এক প্রশ্নের উত্তরে কবি আল মাহমুদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যে কবি ছন্দ জানে না, সে কিছুই জানে না’ (‘ইনকিলাব সাহিত্য’, ৩ অক্টোবর ১৯৯৭)। যদিও শেষ বয়সে অজস্র গদ্যকবিতা লিখেছেন তিনি, ছন্দের প্রতি তাঁর পক্ষপাত প্রকাশিত হয়েছে কিছু কবিতার ভাষাতেও। কালের কলস কাব্যের ‘ত্যাগে দুঃখ’ কবিতায় আল মাহমুদ লিখেছেন :

সুন্দর ফ্লাওয়ার ভাস, জ্যান্ত পাখির ডানা, কবিতার ছন্দ ইত্যাদি

কেন জানি বহু চেষ্টা সত্ত্বেও আমি

কিছুতেই ভাঙতে পারি না…

(‘ত্যাগে দুঃখে’, কালের কলস)

 

লক্ষণীয় যে, এই কবিতার মধ্যে রয়েছে অক্ষরবৃত্ত ও গদ্যরীতির টানাপড়েন। এটি বিষয়ের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ এজন্য যে, কবি ছন্দকে ভাঙতে চাইছেন, কিন্তু পুরোপুরি পারছেন না, যদিও আল মাহমুদ বরেণ্য তাঁর ছন্দোবদ্ধ কবিতার জন্যই।

আল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তরের কবিতাগুলোর ছন্দ-প্রকরণ বিস্তৃতভাবে তুলে ধরে অগ্রসর হতে চাই, কারণ এতে প্রায় সমগ্র আল মাহমুদের রচনাকৌশলই পরিস্ফুট হবে। প্রথম কাব্যগ্রন্থে তিনি যে রীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন মূলত তা-ই পরবর্তী ছন্দোবদ্ধ কবিতার ভিত্তি। লক্ষ করা গেছে, বৃহত্তর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করার সময় একক গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত বইগুলো থেকে কিছু কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো এ-আলোচনায়ও অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

লোক লোকান্তরের একটিমাত্র কবিতা ‘তিমির তীর্থে’ অক্ষরবৃত্তের আদি রূপ ৮/৬-মাত্রার পর্বে বিন্যস্ত। অধিকাংশ কবিতা, যেমন – ‘প্রত্ন’, ‘প্রতিকৃতি’, ‘তৃষ্ণার ঋতুতে’, ‘সিম্ফনি’, ‘আমরা পারি না’, ‘অরণ্যে ক্লান্তির দিন’, ‘অরণ্যে অসুখী’, ‘তার স্মৃতি’, ‘বৃষ্টির অভাবে’, ‘নগ্ন পটভূমিকা’, ‘তিতাস’, ‘অহোরাত্র’, ‘ড্রেজার বালেশ্বর’, ‘ব্রে’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘এমন তৃপ্তির’, ‘আশ্রয়’, ‘লোকালয়’, ‘নেশার সুরভি যেন’, ‘এমন আশায়’, ‘দুরূহ আভাস’, ‘আমি’, ‘নৌকোয়’ ও ‘রুপোর রেকাবি’ ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তে রচিত। এর কোনো কোনোটি চতুর্দশপদী এবং সমিলও বটে, যেগুলোকে সনেট নামে অভিহিত করা যায়। এই ১৮-মাত্রার পঙ্ক্তি কোথাও ৮/৪/৬ আবার কোথাও ৮/৬/৪ মাত্রার পর্বে বিভক্ত। এ-আঙ্গিক আল মাহমুদের বরাবরের প্রিয়। ‘বিষয়ী দর্পণে আমি’, ‘রাত’, ‘অন্ধকারে একজন’, ‘অধ্যয়ন’, ‘কঠিন সংসারে’, ‘নূহের প্রার্থনা’ (নূহের জবানিটুকু), ‘অকথ্য অলীক’, ‘শিল্পের ফলক’, ‘রক্তিম প্রস্তাব’, ‘শোকের লোবান’ ও ‘রাক্ষসোপাচার’ কবিতাগুলো মুক্তক অক্ষরবৃত্তের রচনা। আল মাহমুদের এ-পর্যায়ে রচিত মুক্তক অক্ষরবৃত্তকে সুবিন্যস্ত অক্ষরবৃত্তেরই সম্প্রসারিত রূপ বলা যায়, কেননা আধুনিক কালের অধিকাংশ মুক্তকে যে-গদ্যময়তার ঢংটি শ্রুত হয় তা আল মাহমুদের এসব মুক্তকে শোনা যায় না। এর কারণ পঙ্ক্তিবিন্যাস অসমমাত্রিক হলেও ১৪ বা ১৮-মাত্রার কেন্দ্রে ফিরে যাওয়ার, অর্থাৎ মূল চাল অক্ষুণ্ণ রাখার প্রবণতা এগুলোর ভেতরে কাজ করেছে। এগুলোকে আমি বলে থাকি ‘১৪-মাত্রা বা ১৮-মাত্রা অভিমুখী মুক্তক’। একটি উদাহরণ :

(ক). বলে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে মুখ দেখ, এই স্বচ্ছ

সজল স্ফটিকে

একটি নৌকো তোর দে ভাসিয়ে

অপার তরলে

পবন পালের নায়ে ভেসে যাও

যাও রে প্রেমিক…

(‘শিল্পের ফলক’, লোক লোকান্তর)

এ-কবিতার বাকি অংশের প্রায় সকল পঙ্ক্তি সুবিন্যস্ত ১৮-মাত্রা কিংবা ১৪-মাত্রায় রচিত। উদ্ধৃতাংশ মুক্তকের নিয়মে সাজানো হলেও প্রকৃত অর্থে পঙ্ক্তিগুলো ১৮-মাত্রা অভিমুখী। যেহেতু অক্ষরবৃত্তে ‘অতিপর্ব’ বলে কিছু নেই, তাই ‘বলে’ শব্দটিকে তার পরবর্তী যতির কারণে প্রথমই ২-মাত্রার পঙ্ক্তি হিসেবে স্থাপন করে বাকি পঙ্ক্তিগুলোকে নতুন করে সাজিয়ে দেখা যাক :

২৭ (খ). বলে,

ঢেউয়ে ঢেউয়ে মুখ দেখ, এই স্বচ্ছ সজল স্ফটিকে

একটি নৌকো তোর দে ভাসিয়ে অপার তরলে

পবন পালের নায়ে ভেসে যাও, যাও রে প্রেমিক…

পাঠক লক্ষ করবেন পুনর্বিন্যস্ত পঙ্ক্তিগুলো নিটোল ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তেই পড়া যাচ্ছে এবং এর মতোই ধ্বনি সৃষ্টি হচ্ছে।            এ-কারণে আল মাহমুদের অধিকাংশ অক্ষরবৃত্তীয় মুক্তকেও অনেকটাই ১৮-মাত্রার ধ্বনিবিন্যাস শ্রুত হয়।

লোক লোকান্তরের অনেক অক্ষরবৃত্তীয় রচনায় আল মাহমুদ মাত্রাগণনায় কিছু প্রচলিত স্বাধীনতাও ভোগ করেছেন : ‘শব্জি’, ‘দর্গা’, ‘চাকমা’, ‘ইশকা’, ‘হিংস্র’, ‘উসকে’, ‘নৌকো’, ‘কিম্বা’, ইত্যাদিকে তিনি তিন-মাত্রার শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং প্রয়োগ-কৌশলে নিখুঁত ধ্বনি সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ‘প্রবোধ’ নামের একটি কবিতায় (যার একটি পঙ্ক্তি বাদ দিলে সেটি  ৮/৬-মাত্রার পর্বে সুবিন্যস্ত পয়ার হতে পারতো) ‘সন্ধ্যায়’ শব্দটিকে তিনি ৪-মাত্রায় এবং ‘ক্ষতবিক্ষত’কে ৬ মাত্রায় প্রয়োগ করেছেন। এ-কবিতার প্রথম তিন পঙ্ক্তিতে ৪-মাত্রার একটি  মাত্রাবৃত্তীয় দোলাও অনুভূত হয়।

অদ্যাবধি ছন্দশাস্ত্রে এমনতর প্রয়োগের লিখিত স্বীকৃতি           না-থাকলেও বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, এমনকি রবীন্দ্রনাথের রচনায়ও শাস্ত্রীয়ভাবে চিহ্নিত কিছু ২ ও ৩-মাত্রার শব্দকে যথাক্রমে ৩ ও ৪-মাত্রা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

লোক লোকান্তর গ্রন্থে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতার বেলায় আল মাহমুদের বহুরূপিতা লক্ষণীয়। ‘সমুদ্র-নিষাদ’, ‘কাক ও কোকিল’ এবং ‘কাক’ এই তিনটি কবিতা ৬/৬/২ পর্বে বিন্যস্ত; ‘ভেদাভেদ’, ‘ফেরার সঙ্গী’ ৬/৬/৩-মাত্রার পর্বে বিন্যস্ত। তবে, এর একটিমাত্র পঙ্ক্তি ৬/৩-মাত্রার পর্বে বিন্যস্ত। ‘মায়াবৃক্ষ’ ৬/৫-মাত্রার পর্বে বিন্যস্ত; ‘চারজনের প্রেমে’র মূল চাল ৫/৫/৫/২ কিন্তু ২, ৬, ১০, ১৪, ১৮ ও ২২ নম্বর পঙ্ক্তি ৫/৫/৫/৫ চালে বিন্যস্ত যা, অন্য কারো রচনায় আমার চোখে পড়েনি এবং কথিত পঙ্ক্তিগুলোতে মধ্যমিলের কারণে মনে হতে পারে ত্রিপদীর ধরনে দুটি পঙ্ক্তিকে একত্রে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে।

মুক্তক মাত্রাবৃত্তে রচিত একটিমাত্র কবিতা আছে লোক লোকান্তরে। সেটি ‘স্বীকারোক্তি’ যার প্রবহমানতা অত্যন্ত আকর্ষণীয়; ‘নালন্দার সে প্রকোষ্ঠে বসে মৃত দর্শন হাতড়ে ফিরেছি’ প্রায় গদ্যসুলভ ধ্বনিব্যঞ্জনা দান করে পাঠকের কানে এবং এজন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমান কালে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সংগীতময়তা দূরীকরণের চেষ্টা চলছে। ‘স্মরণ’ কবিতাটি মূলত ৬/৬/৫-মাত্রার পর্বে বিন্যস্ত হয়েছে বলেই মনে করব, যদিও কবি ৫-মাত্রার অপূর্ণ পর্বটিকে একটি ভিন্ন পঙ্ক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আমার এমন সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে বলব, অনেক পঙ্ক্তির শেষে বাক্যের অর্থ পরিপূর্ণতা না-পাওয়ায়               যে-প্রবহমানতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে পরবর্তী লাইনকে নিয়েই একটি পঙ্ক্তি তৈরি হয়েছে; এমনটি ভাবার মধ্যে যুক্তি আছে, তবে, কবির বিন্যাসে কিছুটা হলেও মুক্তকের ঢং শ্রুত হয়।

মনে আছে নাকি নিষিদ্ধ সেই

রাতের গূঢ়

আকাশের দিকে ইঙ্গিত তুলে

মেঘের ফাঁকে

বলেছিলে ঐ ঈশ্বর দেখো

অশ্বারূঢ়…

(‘স্মরণ’, লোক লোকান্তর)

স্বরবৃত্তীয় রচনা সমগ্র আল মাহমুদেই বিরল (শিশুতোষ ছড়াগুলো বাদে)। তাঁর স্বরবৃত্তীয় রচনার প্রায় সবই মূলত ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্তের মিশেলে স্বরমাত্রিক লয়সম্পন্নণ। লোক লোকান্তরের ‘করতলে’ কবিতাটির সবটাই ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্তে রচিত কিন্তু কেবল দুটি পঙ্ক্তির দুটি পর্বে ‘হাতের মধ্যে’, ‘চোখের মধ্যে’ বাদ সাধে। ফলে, চূড়ান্ত বিবেচনায একে স্বরবৃত্তীয় রচনা বলে ধরে নিতে হয় :

কী আছে এই হাতের মধ্যে

কী আছে কও ঢাকা?

বললে হেসে, কী আর হবে

মিথ্যে ঢেকে রাখা…

(‘করতলে’, লোক লোকান্তর)

কবিতায় স্বরবৃত্তীয় রীতিতে (কিংবা ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় রীতিতেও) ‘বর্ণালী মা/ কড়’, ‘শঙ্খিনী তি/ তাস’, ‘শঙ্খের বো/তাম’ এবং ‘আল্লার মু/ কুট’ এই মধ্যখন্ডনগলো লক্ষযোগ্য।

‘রাস্তা’ কবিতাটির ছন্দবিচার বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুরু হয়েছে বৃত্তীয় ঢঙে ‘যদি যান,/ কাউতলী রেলব্রিজ পেরুলেই দেখবেন/ (৪-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় দোলা), মানুষের সাধ্যমতো/ ঘরবাড়ি’ (অক্ষরবৃত্তীয়), আবার শেষ হয়েছে গদ্যে : ‘দেখবেন ভাদুগড়ের শেষপ্রান্তে/ এক নির্জন বাড়ির উঠোনে ফুটে আছে/ আমার মিথ্যা আশ্বাসে বিশ^াসবতী একটি ম্লান দুঃখের করবী।’  সমগ্র কবিতাটিকে গদ্যরীতির বলা যাচ্ছে না, আবার ছন্দেরও নয়, কারণ গদ্যরীতিতে রচিত কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিতেই গদ্যময়তা স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। ‘নিজের দিকে’ কবিতায়ও রয়েছে এ-ধরনের মিশ্রণ, কারণ প্রথম তিনটি স্তবকে ৪-মাত্রার মাত্রাবৃত্তের দোলা, চতুর্থ স্তবকের শুরুতে ‘আত্মাকেই বাজাতে বাজাতে’ অক্ষরবৃত্তীয় এবং একইভাবে, ‘যন্ত্রণার পাখিটি’, ‘আত্মাকে বাজাও’, ‘উদ্যত রেখেছে’, ‘ঈশ্বরের বুকে’ বাক্যবন্ধে এসে একে অক্ষরবৃত্তীয় রচনা ভাবতে পাঠক প্ররোচিত হবেন; কিন্তু বাকি অংশ সবটাই ৪-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় পর্বে বিন্যস্ত। কষ্টের তি/ তির, নিজের দি/ কেই, তেমনি ই/ তর, আঙুল তো/ মার, রাজার মু/ কুট এগুলোকে মধ্যখন্ডন গণ্য করতে হবে।

এর মানে দাঁড়াল লোক লোকান্তরে একটিও নির্ভেজাল গদ্যকবিতা নেই।

কালের কলস কাব্যগ্রন্থে এসে আল মাহমুদের অক্ষরবৃত্তে একটি ক্ষীণ পরিবর্তন সূচিত হয়। যদিও তাঁর বরাবরের প্রিয় ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তীয় রচনার এবং ১৮-মাত্রা-অভিমুখী মুক্তকেরই প্রাধান্য লক্ষ করি কালের কলস কাব্যে। কয়েকটি মুক্তকে অপ্রচলিত ২৪-মাত্রার এবং প্রচলিত ২২, ২৬, এমনকি ৩০-মাত্রার দীর্ঘ পঙ্ক্তি ব্যবহার করেছেন কবি, যা জীবনানন্দীয় চাল বলে খ্যাত। কিন্তু আল মাহমুদের কণ্ঠস্বরে জীবনানন্দের কোনো প্রভাব নেই :

কেমন নিবদ্ধ হয়ে থাকে তারা মৃত্তিকা, সন্তান আর শস্যের ওপরে ২৬

পুরুষের কটিবন্ধ ধরে থাকে কত কোটি ভয়ার্ত যুবতী                                                              ২২

ঢাউস উদরে তারা কেবলই কি পেতে চায় অনির্বাণ জন্মের আঘাত ২৬

মাংসের খোড়ল থেকে একে একে উড়ে আসে আত্মার চড়ুই ২২

… …

কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ          ২৬

কালের কলস কাব্যে দুটিমাত্র কবিতা ‘সাহসে আঘাতে স্পর্শে’ ও ‘কলস ভাসিয়ে’ অক্ষরবৃত্তের আদি রূপ ৮/৬-মাত্রার পর্বে         বিন্যস্ত। ‘সত্যের আঙুল’, ‘সরল ধিক্কার’, ‘কালের কলস’, ‘অসুখে একজন’, ‘নির্ভুল নামে’, ‘ঈক্ষণ’ – এই কটি কবিতা মুক্তক অক্ষরবৃত্তে রচিত। (আমাদের আধুনিক কবিতার দুই  দশক : বরেণ্য কবিদের নির্মাণকলা, পৃ ৮৪)

কালের কলস গ্রন্থে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতার মধ্যে রয়েছে ‘সবুজ পাতার’ (৬/৬/৬ মাত্রার), ‘হে আচ্ছন্ন নগরী’ (৬/৬/২), ‘গ্রামে’ (৫/৫/২), ‘মন্ত্র’ (৫/৫/৫/৩), ‘শূন্য হাওয়া’ (৫/৫/২), ‘ধৈর্য্য’ (৫/৫/২), ‘মাংসের গোলাপ’ (৫/৫/২), ‘শরীর থেকে মা’র’ (৫/৫/২ এবং কয়েকটি পঙ্ক্তিতে ৫/৫/১ যার পরও ধ্বনিবিন্যাসে বিপত্তি তৈরি হয়নি), ‘বুকের কাছে’ (৫/৫/২ এবং কয়েকটি পঙ্ক্তিতে ৫/৫/১; এতেও ধ্বনিবিন্যাসে কোনো বিপত্তি তৈরি হয়নি)। এসব মাত্রাবৃত্তীয় রচনার কয়েকটিতে লোক-ছড়ার ধ্বনি শ্রুত হয় :

আলো নামবে উড়াল দেবে পাখি

হাটের নাও লাগবে এসে ঘাটে

একটি মুখ উদাস চোখ রাখি

ভাববে তার আরেকদিন কাটে…

(‘গ্রামে’, কালের কলস)

রক্ত দিতে চেয়েছিলাম বলে

মোহিনী তোর এমনি ছল যে,

সোনার থালে চাইলে টুকটুকে

টুকরো করা আমার কল্জে…

(‘বুকের কাছে’, কালের কলস)

‘ত্যাগে দুঃখে’ এবং ‘নিদ্রিতা মায়ের নাম’, ‘কেবল আমার পদতলে’, ‘সত্যের আঙুল’ – এই চারটি কবিতা গদ্যধর্মী হলেও ধ্বনিবিন্যাসের বিবেচনায় এতে অক্ষরবৃত্তের মূল রীতি বজায় রাখার সচেতন প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এ-ধরনের ছন্দ-প্রকরণকে আমি বলে থাকি ‘শিথিল অক্ষরবৃত্ত’ বা গদ্যছন্দ। অন্য দুটি উদাহরণ :

শুনেছি দুঃখ দাহ প্রেম পাপ প্রার্থনার চেয়ে শান্ত শব্দ করে ওঠে

.. .. ..

তন্ময় পাদ্রি সে-ও সিগ্রেটে পুড়িয়ে ফেলে নিজের আঙুল…

তবলে অদৃশ্য টোকা রেখে কেউ বলে আস্তে, অতদূর পারি না ওস্তাদ…

(‘সত্যের আঙুল’, কালের কলস)

 

কে নিদ্রামগণ আমার মায়ের নাম উচ্চারণ করো?

… …

রক্তাভ ফুলের মতো আমার সঙ্গীতজ্ঞ ভাইদের মুখাবয়ব

বাঙলা…বাঙলা…

আমার নিদ্রিতা মায়ের নাম ইতস্তত উচ্চারিত হলো…

(‘নিদ্রিতা মায়ের নাম’, কালের কলস)

কালের কলস গ্রন্থে একটিমাত্র কবিতা ‘আমার সমস্ত গন্তব্যে’ নির্ভেজাল গদ্যরীতির।

সোনালি কাবিন গ্রন্থে কেবল ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ এবং ‘তরঙ্গিত প্রলোভন’, ‘নদী তুমি’ এই দুটি কবিতা ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তে রচিত। এই কবির অন্য গ্রন্থের তুলনায় এ-গ্রন্থে সর্বাধিক মুক্তক অক্ষরবৃত্ত আঙ্গিকের কবিতা রয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর গদ্যরীতিতে কবিতা রচনার প্রবণতা বৃদ্ধির সপক্ষে দাঁড়ায় এই মুক্তক অক্ষরবৃত্তীয় রচনা, কেননা মুক্তক অক্ষরবৃত্তকে বলা যায় গদ্যরীতির বীজতলা। সোনালি কাবিন গ্রন্থে ‘প্রকৃতি’, ‘বাতাসের ফেনা’, ‘কবিতা এমন’, ‘অবগাহনের শব্দ’, ‘পলাতক’, ‘আমিও রাস্তায়’, ‘পালক ভাঙার প্রতিবাদে’, ‘খড়ের গম্বুজ’,  ‘আত্মীয়ের মুখ’, ‘তোমার আড়ালে’, ‘সাহসের সমাচার’, ‘আভূমি আনত হয়ে’, ‘ক্যামোফ্লেজ’, ‘কেবল আমার পদতলে’, ‘সত্যের দাপট’, ‘আমি আর আসবো না বলে’, ‘আঘ্রাণ’, ‘বোধের উৎস’, ‘কই কোনদিকে’ কবিতাগুলো মুক্তক অক্ষরবৃত্তের রচনা। ‘জাতিস্মর’, ‘আমার অনুপস্থিতি’ এবং ‘আমার প্রাতরাশে’ কবিতাগুলোও তা-ই, কিন্তু এগুলোতে রয়েছে শিথিল অক্ষরবৃত্তের বৈশিষ্ট্য, যার ব্যাখ্যা আগেই দিয়েছি। আল মাহমুদের মতো শাস্ত্রীয় ছন্দে নিবেদিত কবির হাতে এসব শিথিল অক্ষরবৃত্ত রচনাও পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর গদ্যরীতিকে প্রাধান্য দানের পূর্বাভাস। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে এই স্বাধীনতা ভোগের উদাহরণ হিসেবে ৩৩ ও ৩৪ নম্বর উদ্ধৃতির সঙ্গে আরো কিছু যোগ করতে চাই : ‘যেমন সংবাদপত্রের মত অস্থায়ী কচুর পাতায়/ খেতে চায় স্ফটিকশুভ্র স্বচ্ছ স্বাদ, আজ সেই পাত্রে টলমল’, ‘অসংখ্য চক্ষু যেন ঘিরে ফেলবে এখনি আমাকে’, ‘চায়ের সরঞ্জাম তুমি তুলে নাও’, ‘নগর কম্পনের জের চলতে থাকে আমার শিরায়’, ‘তোমার আড়ালে পড়ে থাকে মৃত্যুভয়/ কালজ্ঞ কবির বৈভব’, ‘তাকে কি জাগাতে চাও মহত্তম সত্য সংবাদে?’, ‘গুল্মের স্তবকে স্তবকে বইছে নারীর ঘ্রাণ’, ‘এ কেমন শিহরণ গ্রীষ্মকে শীত আর শীতকেও গ্রীষ্ম করে দেয়’।

পর্বনির্মাণের ক্ষেত্রেও আল মাহমুদ এ-পর্যায়ে ভিন্ন প্রবণতা দেখিয়েছেন। অক্ষরবৃত্তীয় রচনায় আগে তিনি ৮-মাত্রার পর্ব নির্মাণ করেছেন অতিপ্রচল ৩+৩+২, ৪+৪, ৬+২ কিংবা ২+৪+২-মাত্রার শব্দসহযোগে কিন্তু সোনালি কাবিন পর্যায়ে এসে প্রায়শ অপ্রচলিত ২+৩+৩ বা ৩+২+৩ মাত্রার শব্দসহযোগে           ৮-মাত্রার পর্ব নির্মাণ করেছেন। এই বিন্যাস অক্ষরবৃত্তের গুরুগম্ভীর উচ্চারণ থেকে উত্তরিত হয়ে গদ্যময়তা সৃষ্টির সহায়ক হয়। আল মাহমুদের সোনালি কাবিন গ্রন্থভুক্ত কবিতা থেকে কয়েকটি উদাহরণ : ‘প্রজাতিরা যেমন’, ‘যাবে নিঃসঙ্গ এমন’, ‘আমার অনুপস্থিতি’।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দে উপরোক্ত শৈথিল্যের আশ্রয় নিয়ে গদ্যময়তা বৃদ্ধির ঝোঁকই শুধু নয়, সোনালি কাবিন গ্রন্থে গদ্যরীতিতে বেশকিছু কবিতা রচনার দৃষ্টান্তও দেখিয়েছেন কবি। ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’, স্বপ্নের সানুদেশে’, ‘অন্তরভেদী অবলোকন’, ‘চোখ’, ‘উল্টানো চোখ’, ‘চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়’, ‘আমার চোখের তলদেশে’, ‘স্তব্ধতার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে’ – এই কটি কবিতা নির্ভেজাল গদ্যরীতিতে রচিত।

মাত্রাবৃত্তীয় রচনায় সোনালি কাবিন গ্রন্থভুক্ত কবিতায় কোনো মোড় পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না;  পূর্বতন রীতিরই প্রয়োগ ঘটেছে। তবে, আল মাহমুদের হাতে প্রথমবারের মতো ৭-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহারের দৃষ্টান্ত মেলে। ‘শোনিতে সৌরভ’ কবিতাটিতে আনুপূর্ব ৭/৭-মাত্রার বিন্যাস অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে :

তোমার মুখ-আঁকা একটি দস্তায়

লুটিয়ে দিতে পারি পিতার তরবারি

বাগান জোত জমি সহজে, সস্তায়…

(‘শোণিতে সৌরভ’, সোনালি কাবিন)

কালের কলসের মতোই সোনালি কাবিন গ্রন্থেও মাত্রাবৃত্তীয় অধিকাংশ কবিতায় লোক-ছড়ার দুলুনিবিশিষ্ট ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা রয়েছে বেশ কয়েকটি :

সামনে দেখি গর্ত এক রয়েছে বড়ো হা করে                  ৫/৫/৫/৩

আমার দিকে, দেখি নিগূঢ় আঘাতে          ৫/৫৩

জীবন যেন জালের মাছি টানছে কালো মাকড়ে       ৫/৫/৫/৩

কোনোকিছুই পাবে না তারে জাগাতে                    ৫/৫/৩

(‘ভাগ্যরেখা’, সোনালি কাবিন)

কবিতাটির পরের স্তবকেই ৩-মাত্রার সঙ্গে ৪-মাত্রার অপূর্ণ পর্বও ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এতেও কোনো ধ্বনি বিপর্যয় ঘটেনি, কারণ ৩ ও ৪-মাত্রার শব্দগুলোর উচ্চারণকালের ব্যাপ্তি সমান :

তাহলে আমি জেনেছি এই আমার প্রাণ ঝলকের            ৫/৫/৫/৪

যা কিছু ছোঁয় দেখেছি সবই ঝালিয়ে;              ৫/৫/৩

বয়স করে তাড়া ভীষণ জীবন নাকি পলকের              ৫/৫/৫/৪

শহর থেকে শহরে আসি পালিয়ে                    ৫/৫/৩

সোনালি কাবিন গ্রন্থে এটিই কেবল মাত্রাবৃত্তীয় মুক্তক রচনা। মাত্রাবৃত্তে রচিত অন্যগুলোর মধ্যে ‘দায়ভাগ’ ৫/৫/২-মাত্রার, ‘তোমার হাতে’ ৫/৫/৩ এবং ৫/৫/২-এর মিশ্রণে, ‘নতুন অব্দে’ ৬/৬/৬, ‘এক নদী’ ৫/৫/২-মাত্রার পর্বে বিন্যস্ত।

‘আসে না আর’ এবং ‘যার স্মরণে’ কবিতা দুটি মূলত ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় ধ্বনিবিশিষ্ট হলেও প্রথমটির একটিমাত্র পর্বে ‘পাহাড়পুরের’ এবং দ্বিতীয়টির বেশকিছু পর্ব, যেমন ‘ডাকলো হুতোম’, ‘বন্য বাতাস’, ‘রাত্রি যখন’, ‘হাওয়ার আঘাত’, ‘ভাঙলো যখন’ এবং ‘আমার সকলে’র জন্য কবিতা দুটি চূড়ান্ত বিচারে স্বরবৃত্তীয় পর্বের মিশ্রণে স্বরমাত্রিক হয়ে উঠেছে  বলেছি : ৫-মাত্রার মাত্তাবৃত্ত চালে বিন্যস্ত কবিতাগুলোতে লোক-ছড়ার ধ্বনি শ্রুত হয়। এসব কবিতার কয়েকটিতে গ্রামে ফেলে-আসা এক দয়িতার প্রতি নগরবাসী প্রেমিকের কাতরোক্তি প্রকাশ পেয়েছে :

স্মরণে যার বুকে আমার জলবিছুটি

আমার ঘরে রাখলো না সে চরণ দুটি…

(‘যার স্মরণে’, সোনালি কাবিন)

 

তোমার হাতে ইচ্ছে করে খাওয়ার

কুরুলিয়ার পুরনো কই ভাজা

কাউয়ার মত মুন্সীবাড়ির দাওয়ায়

দেখবো বসে তোমার ঘষামাজা…

(‘তোমার হাতে’, সোনালি কাবিন)

সোনালি কাবিনের পর মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো এবং অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্নায় প্রচুর গদ্য কবিতা লিখেছেন আল মাহমুদ। আগের গদ্যকবিতায় যে শিথিল অক্ষরবৃত্তের ঢংটি শ্রুত হতো তা এ-পর্যায়ের গদ্যরীতির কবিতায় তিরোহিত। এগুলো নিরেট টানা গদ্য :

কাল আমি এক দুঃস্বপ্নের উপত্যকা পার হয়ে এসেছি। প্রথম মনে হয়েছিলো আমি কোনো উপত্যকা ভূমির ঘাস মাড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু হাঁটাপথের

চারপাশে ইতস্তত ইট আর কোনো প্রাসাদোপম অট্টালিকার

ধ্বংসাবশেষ দেখে আমার ভুল ভাঙলো…

(‘চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি’, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো)

 

অনিষ্টকর অন্ধকারে যখন পৃথিবী

আচ্ছন্ন হয়ে যায়, চারদিকে ডাইনীদের

ফুৎকারের মতো হাওয়ার ফিসফাস,

আর পাখিরা গুপ্ত সাপের আতঙ্কে

আশ্রয় ছেড়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়

ঠিক তখুনি, ইহুদিরা হেসে ওঠে…

(‘ইহুদিরা’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)

 

আজকাল এমন হয় যে, আমার মাথা আমি আর

নামাতেই পারি না…

(‘আমার মাথা’, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো)

আল মাহমুদের এ-ধরনের নির্ভেজাল গদ্যের দৃষ্টান্ত তাঁর মায়াবী পর্দা দুলে ওঠোর ‘চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি’, ‘আমার মাথা’, ‘বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার’, ‘জেলগেটে দেখা’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘ফররুখের কবরে কালো শেয়াল’। ‘প্রাচীর থেকে কথা’, ‘ধাতুর ওলান থেকে’, ‘দেয়াল’, ‘সক্রেটিসের মোরগ’, ‘কৃষ্ণের জীব’, ‘একবার ডাকতেই’, ‘শোনো শব্দচোর ভাবের তস্কর’, ‘ক্ষমতা যখন কাঁদে’, ‘সবুজ ঈমান’, ‘প্রকৃতি ও পুরুষ’, ‘চাঁদের দিকে’ মুক্তক অক্ষরবৃত্তের রচনা। মাত্রা কেবল হাতেগোনা অক্ষর নয়, শব্দের উচ্চারণকালের ওপর নির্ভর করে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘চাঁদের দিকে’ কবিতাটি। প্রথম পঙ্ক্তি ‘কেবলই স্বপ্নের চেয়ে দ্রুতগতি হয়ে ওঠে আমাদের পা’তে ‘আমাদের পা’ পর্বটি  আপাতদৃষ্টিতে ৫-মাত্রার যা অক্ষরবৃত্তীয় রীতিতে ত্রুটিপূর্ণ কিন্তু ‘পা’-এর উচ্চারণকাল দীর্ঘ বলে দুই মাত্রার সমান এবং এর ব্যবহারও সিদ্ধ।

মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো কাব্যগ্রন্থের ‘কবি ও কালো বিড়ালিনী’ সিরিজের তিনটি কবিতা, ‘ফুলের অভয়’, ‘ম্যাক্সিম গর্কি স্মরণে’, ‘কৃষ্ণকীর্তন’ নিটোল ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তীয় রচনা।

একটি বিষয় লক্ষণীয়, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠোতে মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দের একটিও কবিতা নেই।

আল মাহমুদের পরবর্তী (পঞ্চম) কাব্যগ্রন্থ অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্নায় ‘নীলের সিথানে’ ৭/৬-মাত্রা ও ‘ধমনির ধ্বনি’  ৬/৬/২-মাত্রা, ৫/১-মাত্রায় বিন্যস্ত; শেষ পঙ্ক্তি বাদে ‘সজলমুখী’ ৫/৫/২-মাত্রার এবং ‘অলীক অসতী মায়া’ ৬/৬/২-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। এই কাব্যগ্রন্থে আবারো গদ্যরীতির দিকে ঝুঁকেছেন কবি। ‘আমার উদ্যোগ’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘কিছু মনে নেই’, ‘দ্বিধা’, ‘ইহুদিরা’, ‘শ্রাবণ’, ‘লবিদের কথা’, ‘সত্যরক্ষার তাগাদা’, ‘ভারসাম্যহীন মানুষ’, ‘আদি সত্যের পাশে’, ‘এমন একটা সময়’, অবলোকন’, ‘অনন্তকাল’, ‘মানুষের আদি অভ্যাস’, ‘সহনশীলতা’, ‘প্রতিতুলনা’, ‘সব ইমারতের বাইরে’ এবং ‘স্তব্ধতা’ গদ্যরীতিতে রচিত। ‘হযরত মোহাম্মদ’, ‘হৃদয়ের একদিকে’, ‘আরোহণ’, ‘প্রেম’, ‘অন্ধলগ্ন’, ‘মাংসের ফল’, নিটোল ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তীয় রচনা এবং ‘বিশ্বাসের চর’, ‘বন্দুক থেকে সরিয়ে হৃদয়’, মানুষের স্মৃতিস্তম্ভে’, ‘প্রেয়সী তোমাকে’, ‘কবিরা’, ‘বাঁচাও’, ‘কবির বিষয়’, ‘যন্ত্রণা’ –  মুক্তক অক্ষরবৃত্তের রচনা।

এরপর আল মাহমুদের আরো কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ বখতিয়ারের ঘোড়া, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, প্রহরান্তের পাশফেরা, একচক্ষু হরিণ, মিথ্যাবাদী রাখাল, আমি, দূরগামী, দোয়েল ও দয়িতা বেরিয়েছে। এসব গ্রন্থে এমন কোনো দৃষ্টান্ত মেলেনি যাতে এ-পর্যন্ত আলোচিত হয়েছে এমন ছন্দ-প্রকরণের বাইরে কিছু করেছেন তিনি। অতএব, ছন্দ-প্রকরণ নিয়ে আরো আলোচনা একঘেয়ে উঠবে বলে মনে করি। তাই, তাঁর কবিতার নির্মাণকলার অন্য উপাদানগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। এ-কবির কবিতার ছন্দ-আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, কাব্যবিশ্বাস পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গিকেরও ক্রমবিবর্তন ঘটেছে। তবে, তিনি নিজে অগ্রণী হয়ে কোনো নিরীক্ষার ঝুঁকি নেননি, শাস্ত্রীয় অনুশাসন মেনে চলে যতটুকু গর্হিত প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তা তাঁর অগ্রজদের অনুসরণে। আবদুল মান্নান সৈয়দ এ-কারণে আল মাহমুদের কাব্যকৃতি নিয়ে বলেছেন : ‘এক-ধরনের সহজ-সচ্ছল অনায়াস মোচড়হীন কবিত্বশক্তির অধিকারী… তাঁর প্রকরণেও সেই মোচড়হীন অনায়াস সহজ-সচ্ছলতা (করতলে মহাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ ১৭২)। এ-বিষয়ে আল মাহমুদের নিজের বক্তব্য এরকম :

আপনারা যাকে গালভরা নাম দিয়েছেন ‘নিরীক্ষা’ আমি এসবে বিশ্বাস করি না। সাহিত্যে অসার্থকতার নামই হলো নিরীক্ষাধর্মী রচনা। সাহিত্যে নিরীক্ষা জিনিসটা কী তা আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ বুঝিয়ে দিতে পারেনি…’ (সাহিত্যপত্র উপমা, আল মাহমুদ সংখ্যা, ২৬ মার্চ ১৯৯৪)।

আল মাহমুদের এই বক্তব্য সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ নিরীক্ষার ফলেই মধ্যযুগীয় একঘেয়েমি থেকে কবিতা মুক্তি পেয়েছে প্রথম দফায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে, আরো  কয়েক দফায় বিহারীলাল চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও তিরিশি কবিদের হাতে; নিরীক্ষার ফলেই মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রবীন্দ্রনাথের হাতে তৈরি হয়েছে ৪, ৫ ও ৭-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, যা মধ্যযুগে অনেকের কবিতায় এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি কবিতায় কেবল ৬-মাত্রার চালের ছন্দ বলেই পরিচিত ছিল।

 

শব্দ চয়নে আল মাহমুদের প্রবণতা

আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় শব্দ-ব্যবহারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ  শুচিবায়ুমুক্ত। লোকজ গ্রামীণ শব্দ থেকে শুরু করে ইংরেজি, আরবি-ফারসি, এমনকি অন্য অনেক আধুনিক কবির সযত্নে এড়িয়ে-চলা প্রাচীন সংস্কৃত ও সাধুভাষার শব্দ নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন এবং প্রয়োগকৌশলে জুতসই করে তুলেছেন। লোকজ শব্দভান্ডার থেকে ‘আওলানো’, ‘নায়রী’, ‘খোয়াব’, ‘বাজু’, ‘গতর’, ‘হাইওয়ান’, ‘উদাম’, ‘কাউয়া’, ‘গাঁওয়ার’, ‘বাদাম’ (নৌকার পাল), ‘পাইলা’ (পাতিল), ‘টুম’ (কলার), ‘হগল’ (সকল), ‘আজকা’ (আজ), ‘লও’ (রক্ত), ‘উরত’ (ঊরু), ‘সুখটান’ (বিড়ি বা সিগারেটের শেষ টান), ‘ঠিল­া’ (কলসি), ‘জেয়র’ (অলঙ্কার), ‘শরমিন্দা’, ‘দেনমোহর’, ‘কাবিন’, ‘খোরাকী’, ‘ছেদুর’ (অলঙ্কার পরার জন্য করা কানের ছিদ্র), ‘ইটা’, ‘বান্দির পুত’, ‘বাইন্ধা’ (বেঁধে), ‘আহে’ (আসে), ‘জবর’, ‘মিছাখোর’, ‘তাজ্জব’, ‘বাংড়ি’, ‘নাদান’, ‘ছতর’ (লজ্জাস্থান), ‘পানিউড়ি’ (পানকৌড়ি), ‘লানৎ’, ‘লাত-মানত’, ‘কিসিম’, ‘সবক’, ‘কসুর’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে তাঁর কবিতার ভাষায় নতুনত্ব আরোপ করেছেন। আধুনিক কবিদের পরিত্যক্ত সাধু ভাষার ও কেতাবি শব্দ ও ক্রিয়াপদ ব্যবহারেও তিনি শুচিবায়ুমুক্ত, যেমন ‘নারি’ (পারি না অর্থে), ‘ছলবে’ (ছলনা করবে), ‘পশে’, ‘দোঁহে’, ‘’পরে’ (উপরে), ‘লক্ষি’ (লক্ষ করিয়া অর্থে), ‘রাখি’ (রাখিয়া অর্থে), ‘বৃষ’, ‘স্কন্ধ’, ‘লোচন’, ‘বৃষভ’, ‘দেহলি’, ‘সলিল’ ‘বাখান’, ‘এতেক’, ‘যতেক’, ‘কতেক’, ‘উষ্ট্র’, ‘ধৈবত’, ‘বিহঙ্গ’ ‘শায়ক’, ‘পয়োধি’ ইত্যাদি শব্দের দ্বিধাহীন ব্যবহার তাঁর কবিতার ভাষাকে ভিন্নতা দান করেছে এবং আধুনিকতাকেও আবহমানতার সঙ্গে অন্বিত করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই শব্দের দুই ভিন্নরূপ পাশাপাশি ব্যবহারের দৃষ্টান্ত মেলে, যেমন ‘ধবল পালের বুক যেন মা’র বক্ষের উপমা’।

 

রূপকল্পের প্রয়োগ-কৌশল

প্রতিতুলনাজাত রূপকল্পের মধ্যে আল মাহমুদের কবিতায় রয়েছে উপমা ও উৎপ্রেক্ষার প্রাধান্য। প্রতীক ও রূপকের ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। উপমা ও উৎপ্রেক্ষাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই চিত্রবাহী হওয়ায় এগুলো মনোগ্রাহী হয়ে উঠেছে। কয়েকটি উদাহরণ :

জিয়ল মাছের ভরা বিশাল ভান্ডের মতো নড়ে ওঠে বুক

 

কখন যে চাঁদ ওঠে আড়াআড়ি পাহাড়ের ফাঁকে

যেন কার পাথুরে স্তনের কাছে ঝুলে আছে শাদা চাঁদির লকেট

 

তোমদের মন যেন নতুন পাখির দুই ডানা

দিনরাত ঝাপটায় আর শুধু ইচ্ছে জেগে থাকে

 

হযরত আলীর খঞ্জরের মতো ঝলসে উঠলো

আমার ঈদের চাঁদ

 

এমন তারার কণা যেন কোনো স্থির বিশ্বাসীর

তসবিহ-ছেঁড়া স্ফটিকের দানা

উপমা-উৎপ্রেক্ষার ওপর আল মাহমুদের সমকালীন কবিগণ এতটা জোর দেননি, যতটা দিয়েছেন প্রতীক, সমান্তরাল রূপক ও সমাসোক্তি, এমনকি অন্যাসক্তের ওপর। এই কবির অধিকাংশ উপমা-উৎপ্রেক্ষা অতিপ্রচল ‘মতো’ বা ‘যেন’ যুক্ত হলেও উপমান ও উপমেয়র সাদৃশ্যগত চমৎকারিত্ব এবং চিত্রময়তা পাঠককে আকর্ষণ করে। প্রথম পর্যায়ের অধিকাংশ উপমা-উৎপ্রেক্ষাই লোকজীবনের চিত্রবাহী; নগরজীবনের চিত্রও পাওয়া যায়, তবে সেগুলো সংখ্যায় অল্প :

কাউয়ার মতো মুন্সীবাড়ির দাওয়ায়

দেখবো বসে তোমার ঘষামাজা

 

পিঠার মতো হলুদমাখা চাঁদ

যেন নরম কলাপাতায় মোড়া

 

কালো বাউশী যেন কলমি-বনে (বিলে স্নানরত কালো বালিকা)

 

তার চোখে বিবমিষা। যেন মেঘনাপারের রসিক জেলে যুবতীরা

ঠাট্টা করে সিদলের ঝালভর্তা খাইয়ে দিয়েছে

 

পানিফলের মতো অপরূপ দাঁত

 

বুবুর স্নেহের মতো ফুলতোলা পুরানো বালিশ

 

দুটি চোখ যেন জোড়া যমজ ভ্রমর পাশাপাশি

বসে আছে ইষদুষ্ণ মাংসের উপর

 

ধূমায়িত থালার পাশ দিয়ে কখন বাড়ির

চেনা বেড়ালের মতো সুদিন আসবে

 

তারপর নষ্ট এক গণিকার মতো

অন্ধকার ডাক দেয় নিবিড় প্রবোধে :

‘আসুন বাবুজী’

জীবনানন্দের কবিতায় ‘মতো’ এবং ‘যেন’যুক্ত উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রাধান্য দেখে, কবিতাবোদ্ধাগণ এক-পর্যায়ে তা থেকে মুক্ত ‘অভিন্নার্থক’ উপমান ও উপমেয়বিশিষ্ট উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেন। আল মাহমুদের কবিতায় এ-ধরনের উপমা-উৎপ্রেক্ষার কিছু উদাহরণ :

তোমার টিকলি হয়ে হৃদপিন্ড নড়ে দুরুদুরু

বিবি’র ধাতব বগা নিজেরই পালক ঠুকরে

ডুকরে ওঠে উত্তর আকাশে (বাংলাদেশ বিমানের বিকট শব্দ বুঝাতে)

তবে কি এই মহালিঙ্গ নিরীহ নগরবাসীর উপর

অগ্নিময় রেতপাত করলো (কামানের গোলাবর্ষণ বুঝাতে)

জীবনের জলাধারে হতে চাই তুমুল রোহিত (জীবনমুখিনতা বোঝাতে)

উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায় (লিঙ্গ-যোনির সংযোগে যৌনমিলন বোঝাতে)

প্রত্যেকের চোখে চোখে দাবার ঘুঁটি চালাচালি হচ্ছে  (চোখ চাওয়া-চাওয়ির মাধ্যমে ভাব বিনিময় বোঝাতে)

এই মৃগনয়নার দুটি গাঙচিল

আমার বাসনার সমুদ্রে উড়াল দিয়ে থাকলো (চোখের সৌন্দর্যে মুগ্ধতা বোঝাতে)

 

দু’টি বর্তুল শঙ্খের মাঝে নাক ডুবিয়ে

আমি প্রাণপণ শুঁকতে লাগলাম

(স্তনযুগল বোঝাতে)

 

দু’চোখে তোমার সাগরের ফেনামাখা

গাঙচিল মন বন্ধ করো না পাখা

(সুদূরের পিয়াসী মন বোঝাতে)

আল মাহমুদের কোনো কোনো উপমা-উৎপ্রেক্ষা একাই একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা পাঠের আনন্দ দেয়। এসব উপমা-উৎপ্রেক্ষায় উপমান ও উপমেয়র একটি দৃশ্যমান ও স্পর্শগ্রাহ্য বস্ত্ত এবং আরেকটি বিমূর্ত কিংবা দুটোই বিমূর্ত :

কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম

ম্নানমুখ বউটির দড়ি-ছেঁড়া হারানো বাছুর

 

জীবন যেন জালের মাছি টানছে কালো মাকড়ে

 

পৃথিবী আমার কাছে বেদুইনের হাসির মত ঠাঠা করতে

লাগলো

 

এক ধারাবর্ষণের সন্ধেবেলা

ভাবনা একটি ভেজা পাতার মত দুলতে লাগলো

 

চুড়ির শব্দ যেন অন্ধকার গেলাফের ওপর রুপোর

কারুকাজ

এই কবির কিছুকিছু উপমা-উৎপ্রেক্ষা অবচেতন থেকে উৎসারিত বলে এগুলো কিছুটা পরাবাস্তব আবহ তৈরি করে :

কাল রাতে চাঁদ যখন উল্টে গিয়ে নৌকোর মত নিজের জোছনার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে

 

আমার চুল বাতাসের ঝাপটে এখন নিশানের মত উড়ছে

 

ঐ তো নক্ষত্র পরির চোখের মত ইশারায় আমাকে জানায় : শেষ নেই

 

লাঞ্ছিতের আসমানে তিনি যেন সোনালি ঈগল

(রসুলকে বোঝাতে)

 

এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমার খাটটাকে মনে হলো নূহের নৌকো

 

আল মাহমুদের হাতে নির্মিত এইসব উপমা-উৎপ্রেক্ষার বহুমাত্রিকতা ও চিত্রময়তা তাঁর কবিতায় আধুনিকতার অন্য এক শিল্প-উপাদান প্রতীকী চিত্রকল্পের অভাব অনেকটা পূরণ করে দিয়েছে। তাঁর কবিতায় চিত্রকল্পের চেয়ে চিত্রের পরিমাণ বেশি। কবিতায় ব্যবহৃত চিত্র তখনই চিত্রকল্পত্ব অর্জন করে যখন তা এমন কোনো প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কারকে ধারণ করে যা চৈতন্যের ব্যাপক প্রসারণ ঘটায় এবং একটি প্রতীক কিংবা সমান্তরাল রূপকের আশ্রয় নিয়ে গড়ে ওঠে। অনেক সময় উপমা-উৎপ্রেক্ষা কিংবা সমাসোক্তিনির্ভর চিত্রও চিত্রকল্পত্ব অর্জন করতে পারে প্রয়োগ-কৌশলের দক্ষতায়। কিন্তু জীবন-জগতের কোনো বিশ্বস্ত চিত্রকে চিত্রকল্প বলা হয় না। আল মাহমুদের কবিতা থেকেই উদাহরণ নিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক।

ভোলায় এক ভয়াবহ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের সচিত্র প্রতিবেদন কোনো এক সকালের পত্রিকায় পড়ে কবির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রচিত একটি কবিতা আছে সোনালি কাবিন গ্রন্থে। কবিতাটির শিরোনাম ‘আমার প্রাতরাশে’। কবিতাটির শেষে একটি ব্যাপক চৈতন্য-প্রসারী চিত্রকল্প রয়েছে এরকম :

বুঝিবা এখনি

লাখো লাখো মড়া গাই

বিশাল গোয়াল ভেবে

ঢুকে যাবে আমার কামরায়।

কিম্বা দেবতা বেল-এনবিল তার

আজ্ঞাবহ জলের পীড়নে

প্রাণহীন একপাল তাগড়া গরুকে

ঢেউয়ে ঢেউয়ে তাড়িয়ে ফিরিয়ে

আমার বুকের মধ্যে ঠুকলেন

খড়কে-অলা বিশাল পাজন।

(‘আমার প্রাতরাশে’, সোনালি কাবিন)

জলোচ্ছ্বাসের সচিত্র প্রতিবেদন পত্রিকায় দেখে কবির মনে যে বেদনা-মিশ্রিত প্রতিক্রিয়ার জন্ম নিয়েছিল তার সবটুকুই ব্যক্ত হয়েছে এই একটিমাত্র চিত্রকল্পেই। দেবতা বেল-এনবিলের খড়কে-অলা পাজন গরুর বদলে এসে লেগেছে কবির মনে। সমগ্র কবিতার প্রাণটিকেই ধরে রেখেছে এই কল্পিত চিত্রটি এবং কবির বেদনাবোধ প্রকাশের জন্যই কবিতাটি রচিত। ফলে এই চিত্রটি কেবল চিত্রেই  সীমাবদ্ধ থাকেনি, চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে। কিন্তু কবিতায় ব্যবহৃত সব চিত্রই চিত্রকল্পত্ব অর্জন করে না, যেমন :

গভীর অরণ্য ছেড়ে উড়ে আসে বনমুরগীরা

বানরের চেঁচানিতে ভরে যায় সেগুনের শাখা

ঝুড়িতে শব্জি নিয়ে হেঁটে আসে চাকমা কিশোরী…

(‘অরণ্যে ক্লান্তির দিন’, লোক লোকান্তর)

 

জমির কিনার ঘেঁষে পলাতক মাছের পেছনে

জলডোরা সাপের চলন নিঃশব্দে দেখছি চেয়ে

(‘প্রকৃতি’, সোনালি কাবিন)

এগুলো থেকে যে-চিত্রময়তা ফুটে ওঠে তা কেবল পরিবেশের বর্ণনা, যাকে আমি বলি বিস্রস্ত জীবনচিত্র। ৭৭ নন্বর উদ্ধৃতির চিত্রটি ধারণ করছে চট্টগ্রামের উপজাতি-অধ্যুষিত এলাকার বর্ণনা এবং ৭৮ নম্বর উদ্ধৃতির চিত্রটি ধারণ করছে গ্রামবাংলায় জলমগ্ন জমিতে একটি সাপের তাড়া খেয়ে মাছের পলায়নের দৃশ্য। এগুলো কেবলই চিত্র, চিত্রকল্প নয়। চিত্রের সঙ্গে বাড়তি ভাবনা যুক্ত হলেই কেবল তা চিত্রকল্প হয়ে ওঠে এবং কবিতা-পাঠকের চৈতন্যকে আলোড়িত করে, যেমনটি করছে ৭৬ নম্বর উদ্ধৃতির চিত্রকল্পটি।

 

আল মাহমুদের কবিতায় কিছু স্খলন-পতন

আল মাহমুদ অত্যন্ত বড়মাপের একজন কবি বলেই তাঁর কবিতায় কিছু স্খলন-পতনও আমাদের কাছে গুরুত্ববহ। তাঁর কবিতায় স্থানে স্থানে প্রচুর বাক্যনির্মাণজনিত ত্রুটি, চিত্রবিন্যাসে বিসংগতি, রূপকল্প ব্যবহারে অসাবধানতা ইত্যাদি রয়েছে, যা আলোচনার যোগ্য। সব শ্রেণির পাঠকের কাছে স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে এমন দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণের অজস্র উদাহরণ থেকে কেবল কয়েকটি তুলে ধরছি :

 

বাক্যনির্মাণজনিত সমস্যা

লোক লোকান্তর গ্রন্থের ‘মায়াবৃক্ষ’ কবিতার একটি অংশ এরকম : ‘পোকায় কেটেছে শিকড় সব;/ অকালে শাখার পাতার স্তব/ শুকাবে, এখন ভেবেই তল/ পাইনে, বিফল করেছি কি/ কোথায় ঢেলেছি পরম জল..।’ উদ্ধৃত প্রথম পঙ্ক্তির শেষ শব্দ ‘সব’-এর সঙ্গে মিলের প্রয়োজনে দ্বিতীয় পঙ্ক্তির ‘স্তব’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু ‘স্তবক’কে সংক্ষিপ্ত করে ‘স্তব’ লেখা যায় না, কারণ ‘স্তব’ বাংলা ভাষায় একটি অতিপ্রচলিত শব্দ যার নির্ধারিত অর্থ ‘স্ত্ততি’ বা ‘স্তাবকতা’। এছাড়া, ‘করেছি কি’-তে বিস্ময়সূচকতা প্রকাশের জন্য এটি হবে ‘করেছি কী’। না-হলে ৬/৫-মাত্রার পর্ববিন্যাসেও বিপত্তি দেখা দেবে। কবিতাটির সব পঙ্ক্তি ৬-মাত্রার পূর্ণপর্ব ও ৫-মাত্রার অপূর্ণ পর্বে বিন্যস্ত। ‘করেছি কি’ চার মাত্রার, কিন্তু দীর্ঘ-ইকারযুক্ত ‘কী’ প্রলম্বিত হয়ে কোনোরকমে পাঁচ মাত্রা পূরণ করে।

কালের কলস গ্রন্থে ‘ত্যাগে দুঃখে’ কবিতার একটি পঙ্ক্তি ‘পদচারণার স্মৃতি সারাদিন দুঃখবোধ ঐকান্তিক সখ্যতা ভেঙেছে’তে শুদ্ধ শব্দটি হবে ‘সখ্য’, ‘সখ্যতা’ একটি ভুল শব্দ, ‘দারিদ্র্যতা’, ‘উৎকর্ষতা’র মতো। তিনমাত্রা পূরণের জন্য ভুল শব্দ ‘সখ্যতা’ লেখার প্রয়োজন ছিল না। ক্ষেত্রবিশেষে ‘সখ্য’ নিজেই আজকাল অক্ষরবৃত্তেও তিনমাত্রার শব্দ হিসেবে গ্রহণযোগ্য।

লোক লোকান্তর গ্রন্থে ‘প্রত্ন’ শিরোনামের কবিতাটির প্রথম কয়েক পঙ্ক্তি এরকম : ‘পাথর পাহাড় খুঁড়ে মিলেছে যে করোটি ও হাড়/ বিম্ফারিত চোখে দেখি আত্মীয়ের জংধরা খুলি,/ কেমন মমতা বাড়ে, হাতে নিই ঝেড়েমুছে ধূলি, কালোত্তীর্ণ রক্ত যেন কেঁপে ওঠে তোমার আমার।’ এ-বাক্যে ‘দেখি’ ক্রিয়াপদের সঙ্গে ‘কর্ম’ হিসেবে যুক্ত হয়েছে ‘আত্মীয়ের জংধরা খুলি’, কিন্তু ‘পাথর পাহাড় খুঁড়ে মিলেছে যে করোটি ও হাড়’ তার সঙ্গে সংযুক্ত কোনো বাক্যাংশ (প্রেডিকেট) নেই। অথচ ‘যে’ শব্দটি ব্যবহার করার ফলেই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি বাক্যাংশ যোগ করা জরুরি ছিল। এ-কারণে এটি রয়ে গেছে একটি অপূর্ণ বাক্য।  শব্দবিন্যাসে ত্রুটির কারণে ‘করোটি ও হাড়’ ক্রিয়াপদের সঙ্গে যুক্ত হয়নি, যদিও একটি ক্রিয়াপদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে একাধিক কর্মপদ। একই কবিতাংশে প্রথম সংকলনে ছাপা হয়েছিল ‘বিস্ফুরিত চোখে দেখি আত্মীয়ের জংধরা খুলি’। আমার একটি আলোচনায় লিখেছিলাম ‘চোখ কারো ‘বিস্ফুরিত’ হয় না, আর হলেও ‘বিস্ফুরিত চোখে’ কেউ কিছু দেখতে পাবে না। অবাক বিস্ময়ে প্রত্ন-নিদর্শন হিসেবে পুরাকালের মানুষের হাড়গোড় দেখার সময় আমাদের দৃষ্টিতে যে-অবস্থার সৃষ্টি হয় তা ‘বিস্ফারিত চোখ’ ‘বিস্ফুরিত চোখ’ নয়।’ পরবর্তী সংকলনে শব্দটি ঠিকমতো ‘বিম্ফারিত’ ছাপা হয়েছে।

কালের কলস গ্রন্থভুক্ত ‘জাপানী আড্ডা’ শিরোনামের কবিতাটিতে এক জাপানি বুড়ো নাবিকের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি লিখেছেন : ‘মদ-মাংসে সমান তাপস। তরুণ তিমির মতো সাগরের এ-উচ্ছ্বলতাকে কীভাবে আয়ত্ত হলো নেই যার তেমন বয়স।’ এই বাক্যটি শুদ্ধ হওয়ার জন্য দাগাঙ্কিত শব্দটি হবে ‘উচ্ছলতা’, ‘উচ্ছ্বলতাকে’ নয়, কারণ ‘আয়ত্ত হলো’ ক্রিয়াপদের সঙ্গে যুক্ত কর্মপদে ‘কে’ প্রত্যয় যুক্ত করা সিদ্ধ নয়। ৬-মাত্রার ‘এ-উচ্ছ্বলতাকে’ না-লিখে ৪-মাত্রার ‘উচ্ছলতা’ লিখলে এই ভুলটি হতো না, ছন্দও ঠিক থাকতো শুধু ‘এ’ বাদ দিলে, ধ্বনিবিন্যাস আরো সাবলীল হতো।

কালের কলস গ্রন্থেই ‘জলছবি’ কবিতায় ‘আমরা যা ধরে রাখি সোজা করে রাখি যে সুষমা/ রেশমী ফিতেয় বেঁধে, দৃঢ় হস্তে, স্পঞ্জে, কর্সেটে/ বাঁধন না থাকলে যা একটুখানি দাঁড়াতে জানে না/ সারি সারি ঠেঁস দেয়া কাঠামোর অর্পিত আদল/ যতই কোমল ভাবো, আসলে ভাস্কর জানে তার/ চিহ্নের আড়ালে আছে একখন্ড গরিব পাথর’ পঙ্ক্তিগুলো মন কেড়ে নেওয়ার মতো হলেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাক্যনির্মাণে একটি বড় রকমের ত্রুটি। দাগাঙ্কিত দুটি ‘যা’ ব্যবহারের পর যে বাক্যাংশ (clause) তৈরি হলো তা অপূর্ণ রয়ে গেল, আগের বাক্যাংশের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। পরের ‘যা’ শব্দটি ‘তা’ হলেই বাক্যটি পূর্ণতা পেতো। এটি মুদ্রণপ্রমাদও নয়, কারণ বহু সংকলনে একইভাবে ছাপা হয়েছে।

লোক লোকান্তর গ্রন্থের ‘কাক’ কবিতাটিতে কাককে সর্বত্র ‘তুমি’ সম্বোধন করা হয়েছে : ‘শব্দ তোমার নটীদের ঘুঙ্গুরে/ যেন নৃত্যের মুদ্রায় তাল রাখা’, ‘তুমি দুপুরের, তুমি ধূসরের জয়’ এবং ‘তুমি’র সাথে সংলগ্ন ক্রিয়াপদ, যেমন ‘ঘুমাও’, ‘শোনাও’, ‘খেলো’, ‘বেঁচে থাকো’, ‘ডাকো’ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু একই কবিতায় দুই জায়গায় কাককে উদ্দেশ করে ‘তুই’, ‘তোর’-এর ব্যবহার পীড়াদায়ক ঠেকে : ‘আহা প্রেয়সীর ভুরুর মতন তুই’, কিংবা ‘তোর কণ্ঠেই শুনি সত্যের সুর’। ছন্দরক্ষার প্রয়োজনে এটি করা হলেও কবির দুর্বলতাই প্রকাশ পায়।

কবিতায় বাক্যনির্মাণে অনেক স্বাধীনতা আছে – এর অর্থ এই নয় যে, ইচ্ছেমতো শব্দের পর শব্দ বসালেই বাক্যনির্মাণ গ্রহণযোগ্য হবে। কবিতায় ব্যাকরণদ্রোহিতারও ব্যাকরণ আছে।

 

চিত্রবিন্যাসে বিসংগতি

কালের কলস গ্রন্থে ‘জল দেখে ভয় লাগে’ নামের একটি কবিতায় বর্ণনা করা হয়েছে বাঙালি কবিদের এলিয়টীয় বিরান বিশ্বে প্রবেশের একটি চিত্র এভাবে : ‘আমরা যেখানে যাবো শুনেছি সেখানে নাকি নেই/ বাঁচার মতন জল, জলস্রোত বর্ষণ হবে না/ নি-পাখি ভীষণ নীল দগ্ধদেশে উদ্ভিদহীনতা/ হাহা করে দিনমান। বাতাসের বিলাসী বিরোধে/ বিহঙ্গ বিব্রত হয়…।’ একই দৃশ্যকল্পে ‘নি-পাখি’ অর্থাৎ ‘পাখিহীন’ পরিবেশ কল্পনা করার পর একজন পাঠক ‘বাতাসের বিলাসী বিরোধে’ ‘বিহঙ্গ’ অর্থাৎ পাখিকে বিব্রত হওয়ার দৃশ্য কল্পনা করতে পারেন না। ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তীয় মাত্রা মেলাতে গিয়ে চিত্রনির্মাণে এই বিসংগতি কবির বোধ এড়িয়ে গেছে, কিন্তু অভিনিবেশী পাঠকের দৃষ্টি এড়াবে না।

‘কালের কলস’ কবিতায় নির্মাণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল আরো একটি ভালো চিত্রকল্প যেখানে রাতের আকাশকে দেখা হয়েছে কালো এক ষাঁড়ের ‘স্কন্ধের’ (কাঁধের) আদলে, আর ধারালো বর্ষার ঘায়ে আহত ষাঁড়ের ‘গায়ের’ ক্ষতের আদলে দেখা হয়েছে নক্ষত্রপুঞ্জকে। চিত্রকল্পটি উপমাবাহী, কেননা এর নির্মাণ শুরু হয়েছে ‘বৃষের স্কন্ধের মতো নুয়ে আসে রাত্রির আকাশ’ এই বলে। রাতের আকাশকে নিয়ে নির্মিত এই চিত্রকল্প কেবল একটু অসাবধানতার কারণে মারাত্মক বিসংগতির জন্ম দিয়েছে। রাতের ‘সমস্ত’ আকাশকেই কবি দেখেছিলেন বৃষের ‘স্কন্ধ’ অর্থাৎ ষাঁড়ের কাঁধের মতো – আকাশের ‘একাংশ’কে নয়। তাই পরবর্তী বাক্যে যখন বলা হয় : ‘কে ধারাল বর্ষা হেনে অসংখ্য ক্ষতের সৃষ্টি করে সেই কৃষ্ণকায় ষাঁড়ের শরীরে’ তখন চমকে উঠে বলতে হয় : ষাঁড়ের শরীর এলো কোত্থেকে? কারণ ইতোমধ্যে নক্ষত্রখচিত ‘সমস্ত আকাশ’টাই পাঠকের চৈতন্যে ঢুকে পড়েছে ষাঁড়ের কাঁধের রূপ নিয়ে – ষাঁড়ের শরীর অদৃশ্য রেখেছেন কবি নিজেই – রাতের ‘সমস্ত’ আকাশের উপমান হিসেবে কেবল ‘বৃষের স্কন্ধ’কে ব্যবহার করে, সমগ্র ষাঁড়টিকে নয়।

আধুনিককালের একটি প্রধান শিল্প-উপকরণ প্রতীকবাহী পরাবাস্তব চিত্রকল্প ব্যবহার করতে গিয়ে আল মাহমুদ সংকটাপন্ন হয়েছেন বারবার। ‘চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি’ কবিতায় কবির মনোনীত রমণী জীবনের প্রাপ্তির প্রতীক ও সম্রাট নিয়তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত, কিন্তু ‘কাল আমি এক দুঃস্বপ্নের উপত্যকা পার হয়ে এসেছি’ কিংবা ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কবিতায় ‘পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থটি বুকের ওপর রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম… মায়াবী পর্দা দুলে উঠলো, যার ফাঁক দিয়ে যে দৃশ্যই চোখে পড়ে তোমরা বলো স্বপ্ন’ এরকম পঙ্ক্তি যোজনার ফলে স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন দেখার যে মানসিক প্রস্ত্ততির ইঙ্গিত দেয়, তাতেই এসব কবিতা অবচৈতন্যজাত স্বপ্নকল্পনা হয়েও প্রকৃত পরাবাস্তবিক হয়ে ওঠেনি, কেননা পরাবাস্তব চিত্রকল্প সৃষ্টি হয় সচেতন মনের ওপর অবচেতন মনের অসতর্ক স্বতঃস্ফূর্ততায়। আমি স্বপ্ন দেখলাম – এই বলে যা দেখা হয় তা হয়ে ওঠে নিছক বর্ণনা, হোক সে স্বপ্নরাজ্যের ফিরিস্তি। যে-কারণে রূপকথা ও কল্পকাহিনি পরাবাস্তবিক নয়, সে-কারণেই সচেতন মানসিক প্রস্ত্ততির ইঙ্গিত দিয়ে অবচেতনে প্রবেশ করলে পরাবাস্তব চিত্রকল্প তৈরি হয় না, তৈরি হয় কিছু অলীক দৃশ্যের বর্ণনা যা শিল্পরহিত রূপকথার বর্ণনার মতো।

একই গ্রন্থে ‘কবি ও কালো বিড়ালিনী’ কবিতায় ‘দেয়াল ডিঙিয়ে আসে কৃষ্ণবর্ণ অশ্বের আরোহী/ চাবুকের শিস তুলে সাহসী সে অদৃশ্য সোয়ার/ নামেন এ কারাকক্ষে…’ এমন পঙ্ক্তির সঙ্গে এ-কবিতার একটি স্তবকে যখন ব্যাখ্যা করে বলা হয়, জেলপ্রবাসী কবির কাছে এক বাস্তবের কালো  বিড়ালিনী রোজ দেয়াল টপকিয়ে দেখা দিতো তখন এ-চিত্রটিও চিত্রকল্প হয়ে-ওঠার গৌরব ও পরাবাস্তবিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। এই বিশেষ বিবেচনার অভাবে আল মাহমুদের প্রতীকী ও পরাবাস্তব প্রকৃতির কবিতাগুলোয় মারাত্মক শিল্পবিপর্যয় ঘটেছে।