কবি সমর সেন ও তাঁর কবি-ব্যক্তিত্ব

সৌভিক রেজা

মানুষের ব্যক্তিত্বের গড়নটা ব্যক্তিভেদে নানারকমের। আবার সেই ব্যক্তিত্বের যে-জোরের কথা আমরা বলে থাকি, সেটিও সবার সমান নয়। সমর সেন ছিলেন সেই ধরনের একজন মানুষ, যাঁর বেলায় ওই জোরটুকু নানাভাবে অনুভব করা যেত। আর সে-কারণেই যখন তিনি কবিতা লিখেছেন, তাঁর প্রতি পাঠক-সমালোচক মহলে একটা আগ্রহ বজায় ছিল; যখন তিনি অনুবাদ করছেন, গদ্য লিখছেন কিংবা পত্রিকা সম্পাদনা করছেন – তখনো দেখি, আগ্রহের সেই জেরটা বজায় থেকেছে। এমনকি, যখন কিছুই লিখছেন না, সে-সময়েও তাঁর চারপাশের মানুষের মধ্যে তিনি একটা সম্ভ্রমবোধ জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন, ব্যক্তিত্বের সেই জোরের টানেই। আজকে, তাঁর জন্মের এই যে শতবর্ষ পালিত হচ্ছে যখন, তখনো আমরা সমর সেনের ব্যক্তিত্বের শক্তির কথাই বিশেষভাবে স্মরণ করতে পারি।

দুই
বলা যায়, বুদ্ধদেব বসুর হাত ধরেই কবিতার জগতে প্রবেশ করেছিলেন সমর সেন। আমার যৌবনে বুদ্ধদেব জানিয়েছেন, ‘এক গ্রীষ্মের সকালে আমার ঘরে একটি ক্ষীণাঙ্গ ছেলে-প্রায় বালক, সবে পা দিয়েছে যৌবনে – গায়ের রং হলদে-ঘেঁষা ফর্সা, ঠোঁটে গোঁফের ছায়া, চোখে চশমা, গালে একটি ব্রণের ওপর এক ফোঁটা চুন লাগানো। কিছুমাত্র ভূমিকা না করে বলল, আমি আপনার ‘শাপভ্রষ্ট’ কবিতার একটি ইংরেজি করেছি। – আপনি দেখবেন?’ এভাবেই দুজনের মধ্যে পরিচয়ের সূত্রপাত, যা পরবর্তীকালে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। অন্যদিকে সমর সেনও এই ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন – ‘১৯৩৪-এ গ্রীষ্মকালে দারুণ মর্মবেদনা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য একবার সাহস করে গেলাম বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে, ভবানীপুরে। ‘বন্দীর বন্দনা’র কয়েকটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমি কবিতা লিখি কিনা। কয়েকটা লেখা দিনকয়েক পরে দেখাতে, বললেন নিয়মিত ছন্দের চেষ্টা ছেড়ে গদ্যছন্দে যেতে।’ বুদ্ধদেবের কবিতা পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই (আশ্বিন ১৩৪২) সমর সেনের চারটি কবিতা ছাপা হয় – ‘অসড়ৎ ংঃধহফং ঁঢ়ড়হ ুড়ঁ’ (‘সমর সেনের কবিতা’য় যার শিরোনাম ‘তুমি যেখানেই যাও’), ‘মুক্তি’, ‘স্মৃতি’ ও ‘প্রেম’। এই কবিতাগুলোতে দেখি এমনসব পঙ্ক্তি, যা তখনকার দিনে একবারেই অভাবনীয়। ‘তুমি যেখানেই যাও,/ কোনো চকিত মুহূর্তের নিঃশব্দতায়/ হঠাৎ শুনতে পাবে/ মৃত্যুর গম্ভীর, অবিরাম প্রতিধ্বনি।’ কিংবা ‘হিংস্র পশুর মতো অন্ধকার এল – তখন পশ্চিমের আকাশ রক্তকরবীর মতো লাল : সে-অন্ধকার মাটিতে আনল কেতকীর গন্ধ,/ রাত্রের অলস স্বপ্ন।’ এর পাশাপাশি দেখতে পাওয়া গিয়েছিল ‘আমার রক্তে খালি তোমার সুর বাজে।/ রুদ্ধশ্বাস কত পথ পার হয়ে এলাম, পার হয়ে এলাম’ কিংবা ‘বিষাক্ত স্বপ্নের মতো আমার রক্তে/ তোমাকে পাবার বাসনা।’ সমর সেনের এই গদ্যকবিতাগুচ্ছের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু দেখতে পেয়েছিলেন ‘রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতার সেই শেষ মধুর সৌরভে-ভরা দীর্ঘশ্বাস’। অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসুকে লেখা চিঠিতে কবিতা পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রশংসা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তোমাদের ‘কবিতা পত্রিকা’ পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। এর প্রায় প্রত্যেক রচনার মধ্যেই বৈশিষ্ট্য আছে। সাহিত্য-বারোয়ারির দল-বাঁধা লেখার মতো হয়নি। ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে পাঠকদের সঙ্গে এরা নূতন পরিচয় স্থাপন করেছে।’ শুধু এইটুকুতেই থামেননি রবীন্দ্রনাথ। কবিতার প্রায় সব কবিকে ধরে-ধরে নিজের মতো করে মন্তব্য করেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে বন্ধুত্ব কিংবা অরুণ সেনের সঙ্গে স্নেহমাখা সম্পর্ক থাকলেও তখন পর্যন্ত তিনি কবি বা ব্যক্তি সমর সেনকে চিনতেন না। তাঁর কবিতা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘সমর সেনের কবিতা কয়টিতে গদ্যের রূঢ়তার ভিতর দিয়ে কাব্যের লাবণ্য প্রকাশ পেয়েছে। সাহিত্যে ওঁর লেখা ট্যাঁকসই হবে বলেই বোধ হচ্ছে।’ কী অসম্ভব রকমের ফলে-যাওয়া ভবিষ্যদ্বাণী! রবীন্দ্রনাথ কি তখন ভাবতে পেরেছিলেন, তরুণতর এই কবি এর একযুগ পরেই নিজেকে কবিতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে!

তিন
কবিতায় গদ্যছন্দেই সমর সেনের প্রকৃত বিহার, তাঁর কাব্যের প্রকৃত প্রকাশ। পরে অবশ্য ছন্দে লিখেছেন, অন্ত্যমিলেও লিখেছেন। কিন্তু তাঁর কাব্যপরিচয়ের সঙ্গে এই গদ্যছন্দ একেবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিলেমিশে রয়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বুদ্ধদেব বসুর পরামর্শের কথা জানালেও তাঁর নিজের ভেতরেও কি সেই ছন্দের অনুপ্রাণনা জেগে ওঠেনি? সমর সেনের নিজের ভাষ্যেই তো এরকম বিবরণ পাচ্ছি – ‘বেহালা থেকে সকালে বেরিয়ে ফিরতাম অনেক রাতে। বাবা কোন খবর রাখতেন না। এমনও হয়েছে যে কলকাতার বাইরে বেশ কিছুদিন ঘুরে এসেছি, বাবা জানতে পারেননি।… তখন যৌবনের নানা অভিজ্ঞতার ফলে কবিত্বশক্তি প্রখর হয়েছে। কলকাতায় যাতায়াতের সময় ট্র্যামের গতিছন্দ হয়তো গদ্যছন্দের মূলে ছিল।’ শঙ্খ ঘোষ মনে করেন, ‘গদ্যে… লেখকের চেতনা বইতে থাকে হাজার শাখা-প্রশাখায়, তার বিস্তার প্রধানত বাইরের দিকে। অন্তর্মুখী বিষয়কেও গদ্য ধরতে চায় তার বাইরের দিকে উদ্ঘাটন করে। কবিতায় আছে এর উলটো চলন। কবিতা বাইরের বিশ্বকেও আয়ত্ত করতে চায় ভিতরের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে। এক-একটা মুহূর্ত আসে যখন আমাদের বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা, আমাদের বোধি আর প্রেরণা সমবেতভাবে সংহত হয় চেতনার এক কম্পমান বিন্দুতে, তৈরি হয় যেন শিখার মতো দীপ্যমান একটি রেখা, এই রেখাটিকে বিন্যস্ত করতে পারার মধ্যেই কবিতারচনার করণকৌশল লুকোনো। তখন তার যে-অবয়ব তৈরি হয় – তার ছন্দ এবং ভাষা – তার মধ্যে প্রায় স্পষ্টতই যেন দেখতে পাওয়া যায় এই কম্পন।’ যে-বিন্যস্তের মধ্যে কবিতার করণকৌশল, সেদিকে খেয়াল রেখেই রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, ‘গদ্যছন্দের রাজত্বে আপাতদৃষ্টিতে যে স্বাধীনতা আছে, যথার্থভাবে তার মর্যাদা রক্ষা কঠিন। বস্তুত সকল ক্ষেত্রেই স্বাধীনতার দায়িত্বপালন দুরূহ। বাণীর নিপুণ-নিয়ন্ত্রিত ঝঙ্কারে যে মোহসৃষ্টি করে তার সহায়তা অস্বীকার করেও পাঠকের মনে কাব্যরস সঞ্চার করতে বিশেষ কলাবৈভবের প্রয়োজন লাগে। বস্তুত গদ্যে পদ্যছন্দের কারুশিল্প কৌশলের বেড়া নেই দেখে কলমকে অনায়াসে দৌঁড় করাবার সাহস অবারিত হবার আশঙ্কা আছে।’ সমর সেনের বেলায় সেই আশঙ্কা সত্যি যে হয়নি তার কারণ হচ্ছে, সমর সেনের কবিত্বের সংযম। মনন এবং কল্পনাশক্তিকে তিনি কখনোই লাগামহীন হতে দেননি। আর এর পাশাপাশি পদ্যছন্দের শিল্পকৌশলটি তাঁর আয়ত্তের মধ্যেই ছিল। আরো একটি ব্যাপারও এখানে কাজ করেছে। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মনে করতেন যে, টি.এস. এলিয়টের ‘ডধংঃব খধহফ’ বাংলা আধুনিক কবিতার জন্মস্থান। সেটি যে একেবারে অমূলক নয়, সমর সেনের কবিতায়, প্রবন্ধে, চিঠিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিষ্ণু দেসহ অন্যদের কথা আপাতত বাদ রাখছি। আর এলিয়টের সেই বিখ্যাত বাণী সমর সেনের কাব্যসত্তার গভীরে গিয়ে অনবরত ক্রিয়া করেছে যে, ‘চড়বঃৎু রং হড়ঃ ধ ঃঁৎহরহম ষড়ড়ংব ড়ভ বসড়ঃরড়হ, নঁঃ ধহ বংপধঢ়ব ভৎড়স বসড়ঃরড়হ; রঃ রং হড়ঃ ঃযব বীঢ়ৎবংংরড়হ ড়ভ ঢ়বৎংড়হধষরঃু, নঁঃ ধহ বংপধঢ়ব ভৎড়স ঢ়বৎংড়হধষরঃু.’ তাঁর কবিতায় আরো দেখতে পাওয়া যায়, বুদ্ধদেব বসু-কথিত ‘মুখের সহজ ভাষার পাশাপাশি প্রাণ-স্পন্দনের জোর’; সেই জোরেই সমর সেনের কবিতা এতটা প্রাণময় আর সেই সঙ্গে মনোময় হয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছিল। তার মানে দাঁড়ায়, সমর সেনের কবিতায় বক্তব্যের সঙ্গে-সঙ্গে ভঙ্গিরও একটা জোর ছিল। কোনটি তার আদল, কেমন তার পূর্ণতর রূপ সে-সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘অবক্ষয়, বাঁকা আর গদ্যছন্দের কবি হিসেবে যাঁর সাধারণ পরিচয়, সেই সমর সেনের কবিতাসংগ্রহটি শুরু হয়েছে ‘ছন্দ’ আর ‘সুর’ এই দুটি শব্দ দিয়ে। বইয়ে প্রথম কবিতার নাম ‘নিঃশব্দতার ছন্দ’ আর দ্বিতীয়টি হলো ‘একটি রাত্রের সুর’। দুটি ভিন্ন কবিতা; কিন্তু এক হিসেবে দুটিকে একত্র করে নিলে যেন তৈরি হয়ে ওঠে পূর্ণতর একটি লেখা।’ সমর সেনের কবিতায় এই ‘ছন্দ’ আর ‘সুর’ খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর একেই তিনি বলেছিলেন, ‘গদ্যের রূঢ়তার ভিতর দিয়ে কাব্যের লাবণ্য প্রকাশ’। সমর সেন নিজেও যেন ছিলেন লাবণ্যে পূর্ণ-এক-প্রাণ।

চার
জীবনের শুরু থেকেই পাঠক-সমালোচকের আনুকূল্য পেয়েছিলেন সমর সেন। তাঁর প্রথম কাব্যের কয়েকটি কবিতায় বুদ্ধদেব বসু দেখেছিলেন, ‘সমকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, এবং কবির ব্যক্তিগত জীবন।’ সেইসঙ্গে তিনি অকপটে ঘোষণা করার মতো করে বলেছিলেন, ‘যে যুগে বিশ্বাস করা সহজ নয়, কবির পক্ষে সেটা দুঃসময়। বর্তমান সময়ের সংশয়াচ্ছন্ন অন্ধকার যে-তরুণ চিত্তকে আবিষ্ট করেছে, সমর সেন তারই প্রতিনিধি।’ প্রতিনিধি বলেই ‘দূর সমুদ্র হতে ভেসে আসে বিষণœ নাবিকের গান’ তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। আবার বুদ্ধদেব সমর সেনের কবিতায় ‘একটি স্পর্শকাতর সুন্দর যৌবনকে’ও দেখতে পেয়েছিলেন। যে-যৌবন শুনতে পায় দুরন্ত বসন্তের গান। সমর সেনের কবিতায় ‘বাতাসে ফুলের গন্ধ আর কীসের হাহাকার’ শুনে বিষ্ণু দে-র মনে হয়েছিল – ‘সমর সেনের কাব্যলোকের জলবায়ুও একান্তই কবিতার, রবীন্দ্রনাথের কবিতার। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ কোনো কবিতার নয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অজস্র কবিতা, গান ও লিপিকা, শরৎ, আষাঢ় ইত্যাদি নানা লেখার মধ্যে দিয়ে দেশব্যাপী যে-আবহ সেই জলবায়ুই তাঁর সার্থক পটভূমি।’ নিজের বক্তব্যকে আরেকটু খোলাসা করতে গিয়ে বিষ্ণু দে বলেছেন, ‘সমর সেনের কবিতা যে কোনো লোকোত্তর শূন্যের জীব নয়, সেইটেই তাঁর কীর্তির সূচনা। তাই তাঁর কাব্যে রবীন্দ্রনাথ-লালিত ক্লান্ত করুণ বিষাদ মহুয়া-বনে, কৃষ্ণচূড়ার ডালে-ডালে, চাঁদের পা-ুর আলোয়, পাহাড়ের দূর নীলে, শহরের এলোমেলো গলিতে, দূর দিগন্তে স্থিতি পায়।’ বিষ্ণু দে-র মতে, ‘সেই স্থিতি স্বকীয় ভারসাম্য পায় কবির নিজের প্রথম যৌবনের স্বাভাবিক দেহবিতৃষ্ণা আর ফিলিস্টাইন শরীর-সর্বস্বতার দ্বন্দ্বে আতুর ক্লান্ত আবেশে এবং সমাজ-জীবনের মর্মান্তিক ব্যর্থতাবোধে।’ ভাবতে ভালো লাগে যে, বুদ্ধদেব বসু আর বিষ্ণু দে-র মধ্যে যতই কাব্যগত বিরোধ থাকুক না কেন, দুজনেই সমালোচক হিসেবে, সমর সেনের কাব্যে প্রকাশিত ব্যক্তিগত আর সমাজগত ব্যর্থতাবোধকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। এদিক দিয়ে ধূর্জটিপ্রসাদও পিছিয়ে ছিলেন না। সমর সেনের কাব্য বিশ্লেষণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, ‘ঝধসধৎ ঝবহ রং ধহ ঁঢ়-ঃড় ফধঃব ৎবঢ়ৎবংবহঃধঃরাব ঢ়ড়বঃ. ঐব হববফং ঃড় নব ঢ়ৎড়মৎবংংরাব নু রহভড়ৎসরহম যরসংবষভ রিঃয ধ ংবহংব ড়ভ যরংঃড়ৎু. ঐব যধং ধষংড় ুবঃ ঃড় নব ংুসনড়ষরপ. ঝঃরষষ ঃযবৎব রং হড় ফড়ঁনঃ ড়ভ যরং নবরহম ধ ঢ়ড়বঃ ড়ভ ধ ঢ়ধৎঃরপঁষধৎ মবহৎব.’ তবে এটিও স্বীকার করতেই হবে যে, একেবারে শুরু থেকে ‘নিষ্ক্রিয় সমাজের মুমূর্ষাকে’ সমর সেন ধরতে পেরেছিলেন। এর জন্যে নিজেকেও তিনি ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি। আত্মসচেতনতার জায়গা তাঁর মধ্যে নানাভাবে তৈরি হচ্ছিল। ঘনিষ্ঠজনদের কাছে লেখা চিঠিপত্রে এমন একটা আভাসও ক্রমাগতই দিচ্ছিলেন যে, লেখালেখিতে, বিশেষ করে কবিতায় তিনি আর উৎসাহ পাচ্ছেন না।

পাঁচ
সেই উৎসাহ না-পাওয়ার কারণ বিেেশ্লষণ করতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষ বলেন, ‘অল্পদিনই কবিতা লিখেছিলেন সমর সেন। কিন্তু সেই অল্প কয়েক বছরের লেখা ঠিক একই জায়গায় থেমে থাকেনি, একটি বই থেকে অন্য বইতে পৌঁছবার পথে তাঁর বদলাবার ধরণটাও আমরা টের পাই। প্রথম দিকের স্মৃতিবিধুর টান অল্পে অল্পে কেটে যায় পরে, তার বদলে জেগে উঠতে থাকে একটা ঝাঁজ। ক্ষয়ের ছবির মধ্য থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে থাকে ভাবীসমাজের ইশারা, মহুয়া ফলের আবেশ ছেড়ে দেখা দিতে শুরু করে ‘তামাটে প্রান্তরে’র মানুষেরা, আর চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের ক্লান্ত উর্বশী নৃত্যরতা হয়ে ওঠে ‘কালের তপোভঙ্গে’। সময়ের একটা চাপ ছিল, ছত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ সাল ছিল দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক এক টালমাটালের সময়, তাকে লক্ষ করা অনিবার্য ছিল সমর সেনের পক্ষে। কিন্তু ঠিক যে-অর্থে সরল প্রগতির ভাবনাকে কবিতায় প্রতিফলিত দেখতে চান অনেকে, সে-অর্থে কবিতা লিখবার রুচি হয়নি তাঁর, বরং মনে হয়েছিল সে-পথে আছে শুধু ভাবালুতা বা বাগাড়ম্বর।’ শঙ্খ ঘোষের এ-ও মনে হয়েছিল, ‘নিছক সাধারণের জীবনকে ধরবার যোগ্য কোনো ভাষাছন্দের দিকে এগোতে চেয়েছিলেন কবি সমর সেন, কিন্তু সেই ভাষাছন্দ ঠিকমতো তাঁর অধিকারে আসেনি, কেননা মধ্যশ্রেণীর গ-ির মধ্যে কাটছিল তাঁর জীবন। মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর ভাষায় তিনি লিখতে পারতেন আরো কবিতা, কিন্তু সেই সেই কবিতায় তাঁর রুচি ছিল না, কেননা কাজে-ভাবনায় সমন্বিত নতুন জীবনের আকাক্সক্ষা তাঁর মনে।’ শঙ্খ ঘোষের কথাগুলো মেনে নিয়েও বলা যায় যে, লেখা ছেড়ে দেওয়ার নেপথ্যে কবির ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপড়েনের ব্যাপারগুলো ভুলে যাওয়া অনুচিত। ‘গোষ্ঠী থেকে সমাজে বেরোবার তাগিদ’ সমর সেন বরাবরই অনুভব করতেন। আবার এই দুই জীবনের দ্বন্দ্বের কথাও প্রকাশ্যে স্বীকার করতেন। স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘১৯৪১-এর ২২ জুন হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করাতে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ রাতারাতি জনযুদ্ধে পরিণত হল। ব্যাপারটা ছকে ফেলতে বিশেষ বেগ পেতে হয়েছিল! ছক ঠিক হবার পর সব ঠিক। নবীন উদ্দীপনায় জনযুদ্ধের কবিতা লেখা চলল। দিল্লীতে কলেজে পড়াবার সময় সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ১৯৪৪-এর জুন মাসে মিত্রশক্তিরা পশ্চিম ইউরোপে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলাতে বিবেক হালকা হয়ে গেল, সরকারি চাকরি নিয়ে রেডিও-র সংবাদ বিভাগে ঢুকলাম। সংবাদের চাপে, দেশের দাঙ্গাহাঙ্গামায় আস্তে আস্তে কবিতা লেখা বন্ধ হয়ে এলো – ছক মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল।’ এটি তাঁর ব্যক্তিগত আর সামাজিক পরাজয় হিসেবেই সম্ভবত মেনে নিয়েছিলেন। নতুনবা পরিহাস করে কেন বলবেন, এখন দেখছি কবিতা লিখে বেশ দু-পয়সা হয়, পত্রিকাবিশেষে ছাপা হলে। ছাপা যে একেবারে হয়নি তাও নয়; এখন তো দেখা যাচ্ছে ১৯৬১ সালের শারদীয় দেশ পত্রিকার পাতায়ও সমর সেনের কবিতা ছাপা হয়েছে। কাজেই ‘জন্মদিনে’ শীর্ষক কবিতাটি যে সমর সেন রচিত শেষ-কবিতা নয়, এটিও বলে নেওয়া দরকার। ‘যৌবনের প্রেম শেষ প্রবীণের কামে।/ বছর দশেক পরে যাব কাশীধামে।’ কাশীধামে যাননি সমর সেন। সেইটি তাঁর স্বভাবের বাইরে ছিল। বলা যায়, স্বভাবের বাইরে গিয়ে তিনি কোনো কাজ করেননি। এটিও তাঁর ব্যক্তিত্বের একটি অসাধারণ প্রবণতা। একে ব্যক্তিত্বের অন্য ধরনের একটি জোরও বলতে পারা যায়। সমর সেনের পরবর্তী সময়ের রেখাচিত্রের বিষয়ে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘পুনর্নির্মীয়মাণ এক সত্তায় নিজেকে তিনি লিপ্ত করেছেন তাঁর স্বপ্নেদেখা সমাজসৃষ্টির কাজে, ‘ফ্রন্টিয়ার’-এর সম্পাদনায়। ঝড়ের যে নিঃশব্দ সঞ্চারণের কথা ছিল প্রথম কবিতার বইতে, শব্দের তীব্র আঘাতের যে প্রতীক্ষা ছিল, তার একটা সাময়িক আসন্নতা তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন তাঁর চারপাশে, সত্তরের দশকের উদ্বেলতায়। তিনি কবিতার জগৎ থেকে নিঃশব্দে সরে গিয়ে এই উদ্বেলতার সঙ্গে যেভাবে নিজেকে মিলিয়েছিলেন, তাকেও বলা যায় একটা সৃষ্টিরই জগৎ, সংঘাতের আন্দোলনের উদ্দীপনার সৃষ্টি।’ রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, ‘নিজের অনুভূতি ও সেই অনুভূতির বিষয়ের মাঝখানে কোনো মধ্যস্থ পদার্থের প্রয়োজন ও ব্যবধান না রাখিয়া কোনো কোনো মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, বিশ্বজগৎ ও মানবজীবনের রসকে তাঁহারা নিঃসংশয় ভরসার সহিত নিজের হৃদয়ের ভাষায় প্রকাশ করিতে পারেন; তাঁহারাই নিজের সমসাময়িক কাব্যসাহিত্যের সমস্ত কৃত্রিমতা সাহসের সঙ্গে অতিক্রম করিয়া থাকেন।’ সমর সেন সেই সাহসী মানুষদেরই একজন। আমাদের এবং তাঁর নিজেরও দুর্ভাগ্য এই যে, যে-পৃথিবীতে আমাদের বসবাস, সেইটি খুব অল্পদিনেই তাঁর কাছে পুরনো হয়ে গিয়েছিল। পুরনো পৃথিবীতে বসবাস করে আর যা-ই হোক নতুন কবিতা লেখা যায় না। যাঁরা লেখেন তাঁরা হয়তো কোনো-না-কোনোভাবে কপটতা করেন। তাঁদের দলে সমর সেন ছিলেন না। আর পুরনো পৃথিবীর ‘নিপীড়িত জনগণ পূর্ণ মুক্তি অর্জনের জন্যে সর্বপ্রথমে নির্ভর করেন তাঁদের নিজেদের সংগ্রামের উপর।’ এইটি জানা ছিল বলেই সমর সেন নিজের সঙ্গে অন্তত সেই কপটতা করেননি। তাঁকে শ্রদ্ধা না-জানিয়ে উপায় কী!