কলকাতায় ফেসবুক-বন্ধুদের সম্মিলিত প্রদর্শনী

kolkatai-facebook-bandhu

জাহিদ মুস্তাফা

নতুন প্রযুক্তির নতুন-নতুন উদ্ভাবনের এ-যুগে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও গণমাধ্যমের শক্তি অতিক্রম করে ডিজিটাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে মানুষে-মানুষে যোগাযোগের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। ফেসবুক বিশ্বব্যাপী কতটা জনপ্রিয় তা বলা বাহুল্য। সৃজনশীল মানুষও এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের সৃজন ছড়িয়ে দিচ্ছেন মানুষের মধ্যে।

এমনই এক শিল্পীদলের আবির্ভাব ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে, যার মূল কেন্দ্রে আছেন বাংলাদেশের কয়েকজন নারীশিল্পী। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়, অতঃপর যোগাযোগ। নানা দেশের নারীশিল্পীরা তাঁদের চিত্রকর্ম নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কলকাতায়। তাঁদের কাজ নিয়ে প্রদর্শনী হলো কলকাতায় বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। ‘আন্তর্জাতিক মা দিবস’ উপলক্ষে ‘এক্সপ্রেশন্স-১৩’ নামে এ-প্রদর্শনী চলে ছয় দিনব্যাপী। এর যৌথ আয়োজক ছিল কলকাতার এক্সপ্রেশন্স। কিউরেটর ছিলেন শিল্পী জয়ন্ত খান।

বাংলাদেশের কয়েকজনসহ কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীশিল্পী এবং যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ প্রজাতন্ত্রের নারীশিল্পীদের অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল এ-আয়োজন। বিভিন্ন মাধ্যমে বিচিত্র রূপের মাধুরী মিশিয়ে শিল্পীরা তুলে ধরেছেন তাঁদের চিত্রকর্ম। শিল্পী ও দর্শকের ভিড়ে প্রদর্শনীর ছয় দিনে জমজমাট আয়োজনে মুখর ছিল বিড়লা অ্যাকাডেমি প্রাঙ্গণ।

প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া শিল্পীরা হলেন – নাসরীন বেগম, নাইমা হক, ফারেহা জেবা, কনক চাঁপা চাকমা, এলহাম হক খুকু, আফরোজা জামিল কঙ্কা, দিলরুবা লতিফ, ফারজানা রিপা, শামিম সুব্রানা, বিপাশা হায়াত, সামিনা এম করিম, মার্গি বেথ লাবাদি, জয়িতা মুখার্জি, আনা নেজভেৎনোভা, জুলিয়া স্মিরনোভা, নাতালিয়া বাহুসেভিচ, অর্পিতা রেড্ডি, জয়লক্ষ্মী, বিদুলানাথ বসু, চন্দনা খান, ডানা ঘোষ, দীপ্তি চক্রবর্তী, হেতাল শাহ্, জাসকানওয়ালজিৎ কাউর, ঝর্ণা সান্যাল, কাবেরী ব্যানার্জি, নির্মলা দত্ত, নিবেদিতা সেন, পুনম রানি, রাজনন্দিনী, রিনা রায়, শায়লা কাপুর, সোনালি চৌহান, শ্রাবমত্মী জুলুরি, শুভল ভার্মা, সুচিত্রা সিং, সুদত্তা রায়, সুলোচনা সারস্বত, স্বর্ণালী পাল, সঞ্চিতা পাল, শালিনী সনি মজুমদার, তমালিকা ঘোষ ও বাণী চাওলা।

শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন নানা মাধ্যমে। ক্যানভাসে, কাগজে তেলরং, অ্যাক্রিলিক, জলরং ও মিশ্র রঙে। কেউ-কেউ ভাস্কর্যও গড়েছেন। বেশিরভাগ শিল্পীর কাজ অবয়ব ও ফিগরকেন্দ্রিক। কয়েকজন শিল্পী বিমূর্ত ধরনের ছবি এঁকেছেন। সবমিলিয়ে কাজগুলো প্রদর্শনীকে বৈচিত্র্যময় করেছে।

ক্যানভাসে ডিজিটাল ইমেজে বিশ্বাসী সময়ের ছবি এঁকেছেন আমেরিকান শিল্পী মার্গি বেথ লাবাদি। অবয়বকে ফুল-পাতায় আড়াল করে মজাদার কম্পোজিশন রচনা করেছেন জয়িতা মুখার্জি। আনা নেজভেৎনোভা বাংলা শব্দ ‘আমার’ অবলম্বণে নির্মাণ করেছেন স্থাপনা। ক্যানভাসে তেলরঙে রুশশিল্পী জুলিয়া স্মিরনোভা নগরকেন্দ্র এঁকেছেন। বেশি রঙে স্পেচুলা চালিয়ে ছবি আঁকায় বেশ দৃষ্টিনন্দন হয়েছে তাঁর কাজ। নাতালিয়া বাহুসেভিচ গরুসহ এক বালকের অবয়ব এঁকেছেন। অনুরূপ বাংলাদেশের শিল্পী এলহাম হক খুকু গৃহকর্ম-সুনিপুণা বঙ্গললনারাও যে গৃহপালিত গরুর পরিচর্যায় অংশগ্রহণ করেন, সে-ছবি তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশের শিল্পী নাসরীন বেগম ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে মা ও শিশুর দৃষ্টিনন্দন ছবি এঁকেছেন। নাইমা হক ক্যানভাসে রং লেপে ম্যাচের কাঠি দিয়ে কম্পোজিশন রচনা করেছেন। ফারেহা জেবা লাতিন আমেরিকান শিল্পী ফ্রিদা কাহ্লোর অনুসারী নারীবাদী চিত্রকর। নারীকে পরির সাজে সাজিয়ে ফুলের সঙ্গে তুলনা করে এক ধরনের পণ্য বানানোর যে-প্রক্রিয়া দেশে-দেশে চলে, সে-চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি ‘মাঞ্চকিন’ শিরোনামের ছবিতে।

কনক চাঁপা চাকমা তাঁর স্বকীয় ধরনে এঁকেছেন এক বৌদ্ধভিক্ষুর উপাসনার ছবি। আফরোজা জামিল কঙ্কা ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে এঁকেছেন ফুলসহ অ্যাসিডদগ্ধ নারীর অবয়ব। সভ্যতার উন্নতি হয়েছে, তবে অমানবিকতা থেকে আমরা যে মুক্ত হতে পারিনি, সে-তথ্য আমরা পেয়ে যাই এই চিত্রে। দিলরুবা লতিফ এঁকেছেন ‘যন্ত্রণা’ শিরোনামে ফ্যান্টাসিনির্ভর ছবি। জাগতিক যন্ত্রণার ইঙ্গিত থেকে মধুর কল্পনার বাহনে চড়ে দূরযাত্রায় অসীমের সন্ধান করেছেন শিল্পী। শামিম সুব্রানা ও বিপাশা হায়াত বিমূর্তরীতিতে এঁকেছেন যথাক্রমে গঠন ও ধ্রম্নপদী প্রেমের কবিতার স্মৃতি। তাঁরা রঙের দ্যোতনায় চিত্রপটকে সাজিয়ে তোলেন নিজের ভাবনায় নিজের মতো করে। শৈশবস্মৃতি এঁকেছেন ফারজানা রিপা। পদ্মফুল, পাতা, কাগজের নৌকা, পাতলা কাগজের নিশান এসবের সঙ্গে বধূবেশী এক নারীর দূরাগত দৃষ্টি মিলিয়ে একটি গল্পের প্রেক্ষিত তৈরি করেছে এ-চিত্রকর্ম। সামিনা এম করিম প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন ‘নারী’ শিরোনামে মৃৎশিল্প মাধ্যমের ভাস্কর্য দিয়ে। এতেও যেন একটা নারীজীবনের গল্প বিদ্যমান।

ভারতীয় শিল্পীদের আঁকা বিষয়বস্ত্তর মধ্যে দেখা যাচ্ছে হিন্দুধর্মের দেবদেবী ও পুরাণকেন্দ্রিক চরিত্র বেশি জায়গাজুড়ে আছে এখনো। অর্পিতা রেড্ডি, বিদুলানাথ বসু, দীপ্তি চক্রবর্তী ও শালিনী মজুমদারের কাজে এ-বিষয়টি উঠে এসেছে। যেমন দীপ্তি চক্রবর্তী এঁকেছেন দেবী দুর্গার ছবি।

অবয়ব, পরিবার, সখী-পরিবৃতা হয়ে আড্ডা ও প্রকৃতি তাঁদের প্রিয় কয়েকটি বিষয়। যেমন টেম্পেরা মাধ্যমে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহে এক পরিবারের ছবি এঁকেছেন নিবেদিতা সেন। শিল্পী রিনা রায় প্রাচ্য ঘরানায় এঁকেছেন রূপসজ্জা-কক্ষ। পাঁচ নারীশিল্পীর রূপসজ্জার ঘরোয়া দৃশ্য ফুটে উঠেছে এতে। শিল্পী সুদত্তা রায়ের আঁকা চন্দ্রালোকে নারীবিন্যাস ও উপস্থাপনগুণে দর্শকের সমীহ আদায় করে নেওয়ার মতো কাজ। সাবেক মিস কলকাতা বাণী চাওলা ফুলবাগানের আবহে দীর্ঘগ্রীবা সারসের ছবি এঁকেছেন। ডানা ঘোষ এঁকেছেন পাহাড়ি জলাভূমির ছবি। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে চন্দনা খান এঁকেছেন বসন্তের বর্ণিলতা। লিনোকাট মাধ্যমের ছাপচিত্র এঁকেছেন পুনম রানি। পোস্টকার্ডে মিশ্রমাধ্যমে চারটি রেখাচিত্র এঁকে ‘ইউটোপিয়া’ শিরোনাম দিয়েছেন হেতাল শাহ্। প্রদর্শনীতে ডিজিটাল ফটোপ্রিন্ট নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন আলোকচিত্রী রাজনন্দিনী ও জাসকানওয়ালজিৎ কাউর।

এই শিল্পীদল দুদিনের ভ্রমণে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে। কলাভবনে শিল্পশিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁরা মতবিনিময় এবং বিভিন্ন শিল্পীর স্টুডিও পরিদর্শন করেছেন। সাফল্য এ-আয়োজনের সবচেয়ে বড় সাফল্য – নানা দেশের নারীশিল্পীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হওয়া, মতবিনিময় এবং পরস্পরের সঙ্গে সৃজনশীল যোগাযোগের জায়গা তৈরি করা। প্রাথমিক এ-পর্বটি তাঁরা সাফল্যের সঙ্গেই সমাপ্ত করেছেন। উদ্যোক্তাশিল্পীদের মাধ্যমে জানা গেল, এমন আয়োজন ভবিষ্যতেও হবে নানা দেশে।

কলকাতার বিড়লা অ্যাকাডেমিতে এ-প্রদর্শনী চলেছে গত ২৪ মে থেকে ২৯ মে পর্যন্ত। r