কাঁটাতার

শচীন দাশ

হাতের মুঠোয় আগুনটা রেখে বিড়ি একটা ধরাবার চেষ্টা করেছিল নাজিবুল। এই সময়েই কে ওকে ডাকল। আড়চোখে তাকাতেই নাজিবুলের চোখে পড়ল রহিমুদ্দি।

নাজিবুল বিরক্ত হয়।

আজ হাওয়া মারছে খুব। তার ওপর বর্ষার বিড়ি। ভেতরের মাল-মশলায় কখন যে হাওয়া ঢুকে গিয়েছে ধরালেও তাই ধরে না। তিন-চারটে কাঠি নষ্ট হওয়ার পর আবারও যখন ধরাতে যাবে ওই তখনই পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় রহিমুদ্দি।

কী রে, কই গেছিলি? সগাল থিকাই তরে বিচরাইতে আছি। ল কথা আছে –

নাজিবুল টের পেল পার্টি একটা হাতিয়েছে রহিমুদ্দি। এবারে তার সঙ্গে চুক্তিতে বসবে।

বিড়ি না ধরাতে পেরে প্রাণটা আনচান করছিল। এপাশে-ওপাশে তাকিয়ে অদূরের টিনের চালাটার নিচে গিয়ে ফস করে বিড়িটা ধরিয়ে ফেলল নাজিবুল। এরপর বারকয়েক ভালো করে টেনে বিড়ির মাথায় আগুনটা ধরে রাখল। নাকমুখ দিয়ে আলগা একটা ধোঁয়া বেরিয়েছে ততক্ষণে নাজিবুলের।

নাজিবুল জিজ্ঞেস করল, কী কথা কও –

আহা আয় না। যাবি তো আগে … তারপর তো কথা।

কুনখানে যাইবা? নাজিবুল দেশলাইটা পকেটে ঢোকায়।

চল না আক্কাসের দোকানে। দুইডা চা নিমু। চা খাইতে খাইতে চাচা-ভাতিজায় না-হয় কথা কই –

নাজিবুল এগোয়। এবার আর সে আপত্তি করে না। রহিমুদ্দি ওকে লক্ষ করে যাচ্ছিল বলল, কাইল কী করবি। হাতে কুনো কাম আছে নিকি!

ক্যান?

একটা পার্টি আইব। ডেলিভারি কেস। তিন হাজার কইছি। তর দুই আমার এক। হাসপাতালের খরচ অবিশ্যি ভিন্ন –

হেইয়্যা তো বুঝলাম। কিন্তু কাইল আইব আগে কওনাই তো?

কই নাই … আসলে আসরাফরে আগে কইয়্যা রাখছিলাম। কিন্তু কাইল থিকা হেরে জ্বরে ধরছে। আইতে পারব না … তাই অহনে…

অহনে তাই হাতের পাঁচ আমারে বিচরাইতে আছ। একটু বিরক্ত হয়েই বলে যেন নাজিবুল।

আহা, রাগ করস ক্যান। রহিম বোঝাতে থাকে, ডেলিভারি কেস… হ্যাশে বর্ডারে আইয়্যা ফির‌্যা গেলে কেলেঙ্কারি…

ক্যান, তুমি তো আছ… তুমি চালাইয়া দিবা –

ইনশাল্লা, আমি কখনো এইয়্যা করছি… না করবেন বয়স আছে?

বয়স দিয়া কী হইব। করলেই হইল। সাত-দশদিনের লাইগ্যা ছিটমহলের এউগ্যা পোয়াতির নওশা হইবা এইয়্যাতে আর অসুবিধার কী? পুরা ট্যাহাটাই তাইলে নিজের জেবে…

ধুস! উল্টাপাল্টা কথা কইস না তো নাজিবু। যারে-তারে দিয়া হেইসব হয় না। এই কামে ঝামেলা বিস্তর। তুই না করিস না –

ঝামেলাই যদি মানো তয় এই ট্যাহায় রাজি হও ক্যান। ওই ট্যাহায় আমি কাম করি না। দুই হাজার ট্যাহায় কাম হয়?

চায়ের অর্ডার দিয়েছিল। কাচের গেলাসে চা দুটো দিতেই রহিমুদ্দি তা ছোঁ মেরে তুলে নিল। তারপর একটা নাজিবুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, কিন্তু আমি যে কথা দিয়া ফালাইছি নাজিবু –

তুমি দিছ দিছ, তা আমি কী করুম! ওই ট্যাহায় কাম করন যায় না। চায়ের গেলাসে চুমুক একটা দিয়ে নাজিবুল জানায়। বাজার দেখছে? হেয়্যাপর ঝামেলা দিন দিন বাড়ত্যাছে না।…

হ, হেইয়্যা তো বাড়েই…

তয়! তোমার কী… তুমি তো পার্টি ফিট কইর‌্যা ট্যাহা লইয়্যা হাওয়া। যত ঝামেলা তো আমার। দুইবেলা হাসপাতালে হাজির হওয়া ডাক্তারগো লগে যোগাযোগ… ওষুধ-বিষুদ আইন্যা দেওয়া… হেয়্যার পর প্রসূতির দেখভাল…

প্রসূতির দেখভাল তুই আর কী করবি –

ক্যান, খাতায়-কলমে হের হ্যাজব্যান্ড না আমি! এইয়্যা কি সোজা কাম… এই কামে পুরা তিন হাজার না হইলে চলে না… ওই আসরাফের লাখান কাম আমি করি না। পোয়াতিরে হাসপাতালে ঢুকাইয়্যা হের সংবাদও রাখে না… যাউক গা, ওই পুরা তিন হইলে করতে পারি –

পুরা তিন! তাইলে আমার থাকব কী?

হেইয়ার তুমি বুঝবা –

বলতে বলতেই নাজিবুল চায়ের কাপটা রাখে। সে বড়ো হুসহাস করে চা-টা খেয়ে নেয়। খেয়েই পা বাড়াচ্ছিল, আচমকা তার হাতটা চেপে ধরল রহিমুদ্দি।

এই দেহ, যাস কই!

নাজিবুলের মেজাজ তখনো ঠিক হয়নি। রহিমের দিকে তাকিয়ে বলল, যামু আর কই… ক্যামের ধান্দা করতে হইব না… দুই দিন কাম পাই নাই। বাজারে ধারদেনা বিস্তর…

তা কাম তো পাইছসই এখান! কর না –

হ, এই ট্যাহায় কইর‌্যা লড়ি আর কী!

হাতটা তখনো বুঝি ছাড়েনি রহিমুদ্দি। জড়িয়ে ধরেই বলল, না না, হোন না… এই কামডা তরে এই ট্যাহায়ই কইর‌্যা দিতেই হইব নাজিবু। বড়ো বিপদে পড়ছি। না করিস না! দে বাই। এইয়্যার পর থিকা আর এই ট্যাহায় তরে করতে কমু না…

রহিম তবু ছাড়ে না নাজিবুলকে। শেষ চেষ্টায় এবারে সে বলে, তাবাদে মাইয়্যাডা বড়ো অসহায় বুঝলি…

ক্যান! নাজিবুল বুজি পা বাড়িয়েছিল, ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল। রহিমুদ্দি জানায়, আসলে ঘরের মানুষটা আইজ কয় মাস হইল উধাও… কই যে গেছে হেয় জানে না –

কী কাম করত!

কী আবার করব? ছিটের মানুষ খেতখামারের কাম ছাড়া আর আছেটা কী?

তাইলে! গেলটা কই –

কে জানে! হঠাৎ একদিন সগালে উইঠ্যা বউডা দেহে ঘরের মানুষটা নাই। মাঠে গেছে ভাইব্যা সগাল তরি অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সগাল গড়াইয়্যা দুপুর কাইট্যা বৈকাল পড়লেও যহন ফিরল না তখনই ভাইঙ্গা পড়ল। আছরাইয়্যা-পিছরাইয়্যা হুদু কান্দে। কান্দব না… একে ঘরের মানুষডা নাই হেরপর প্যাডে আবার তিনমাসের বাচ্চা।…

ঘরে আর কেউ নাই?

কে আর থাকব! ভাইগো সংসারে মানুষ। ওই ভাইরাই বিয়া দিছিল ছিটেরই এক পোলার লগে। তা হেই পোলাই উধাও। মাইয়্যাডা আর কী করে! ভাইগো গিয়া কয়। কইলে হেরাও অবাক। নিজেরাই তহন নিজেগো মতোন বিচরায়। কিন্তু না পাইয়্যা হতাশ।

থানায় যায় নাই?

থানা? থানা কই হেইখানে! তুই দেখি সব ভুইল্যা মারছস –

তাইলে?

তাইলে আর কী! পাইল না হ্যাশতরি। এইদিকে প্যাডের বাচ্চাও বাড়ে। ভাইবউরা নষ্ট করনের কথা কইছিল। কিন্তু মাইয়্যা তাতে রাজি নয়। কেমনে রাজি হয় ক! পরথম পোয়াতি। প্যাডের বাচ্চারে লইয়্যা যে স্বপ্ন তহন চোক্ষে! ভাইরা আর কী করে? একদিকে যেমন হেই পোলার খোঁজ করে, তেমনি আবার বুইনের বিয়ানের লাইগ্যাও যোগাযোগ করে আমার লগে…

ক্যান, দাই নাই পাড়ায়?

কে জানে! আছে হয়তো! কিন্তু ভাইরা বোধায় ভরসা পায় নাই। যাই হোক, তুই আমার এই কামডা কইর‌্যা দে বাই –

এ-কথায় বুঝি এতক্ষণে এই একটু নরম নাজিবুল। সত্যিই তো! সে জানে, কাঁটাতারের বেড়ার ওপারের ওই ছিটমহলে কোনো হাসপাতাল নেই। শুধু হাসপাতাল কেন, নেই কোনো হেল্থ সেন্টারও। এছাড়া স্কুল নেই, কলেজ নেই। পড়তে হলে আসতে হবে ওদেরই এই গ্রামের স্কুলে। তাও কী, পরিচয় বদলে ঠিকানা পাল্টে। স্কুলের খাতায় নাম উঠবে তখন অন্য কোনো বাপের সন্তান হিসেবে। যে-বাবারা নাজিবুলের মতো ইন্ডিয়ার ভোটার। ইন্ডিয়ার নাগরিক। এবং সেখানেই থাকে। সেখানেই বসবাস করে। অথচ ওরা? ছিটের ওই মানুষগুলো! ওদের কোনো পরিচয় নেই। ওদের কোনো দেশ নেই। নজিবুল জানে, তারও জন্মের বহু বছর আগে থেকেই ওই ছিটকে থাকা জায়গাগুলো নাকি একসময় কোচবিহারের মহারাজার ছিল। কিন্তু কী করে তা হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে দেশ স্বাধীন হয়ে যখন অখন্ড দেশটা ভাগাভাগি করে দিলো ওই ইংরেজরা, তখন থেকেই ছিটকে থাকা টুকরো-টাকরা এই জায়গাগুলোর আর কোনো ব্যবস্থা হয়নি। কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গেই এই টুকরো জায়গাগুলোকে আর যুক্ত করা হয়নি। সে-কারণেই তখন থেকে এগুলি ভিন্ন। ফলে কোনো দেশই এসব জায়গার দায়িত্ব আর নিতে চায় না। কী করেই বা নেবে। নিজের অঙ্গ না হলে তার  কী আর পরিচর্যা চলে। কাজেই শিক্ষার পাঠ এখানে চলে লুকিয়ে-চুকিয়ে। গোপনে বিএসএফের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। আবার বাচ্চাও জন্ম নেয়। বুঝি এভাবে। অন্যের পরিচয়ে। টাকার বিনিময়ে। এতে অবশ্য নাজিবুলের মতো ছেলেছোকরারা করেকম্মে খাচ্ছে বর্ডার এলাকায়। যা পায় বর্ডারে দিয়ে হাসপাতালে লাগিয়েও মন্দ থাকে না। কিন্তু…

চুপচাপই ছিল রহিমুদ্দি জিজ্ঞেস করল, কী রে, কথা কস না যে। কী ভাবস! করবি তো কামটা?

হাতের আঙুলের ফাঁকে বিড়িটা অনেকক্ষণ নিভে গেলেও সেটা ফেলেনি এখনো নাজিবুল। খেয়াল হতেই সেটা ফেলে দিয়েই সে উঠল।

ঠিক আছে। কইর‌্যা দিমু। কিন্তু আজই শ্যাষ। এর পর থিক্যা এমন ট্যাহায় করতে কইও না চাচা –

চা খেয়ে বিড়ি টেনে মেজাজটা একটু থিতিয়ে এসেছিল। রহিমুদ্দি লাফিয়ে উঠল। না না, আর তিনের নিচে তরে কই। দেইখ্যা লইস।

হাত ছেড়ে দিয়েছিল। ফের হাতদুটো জড়িয়ে ধরে রহিমুদ্দি জানাল, তুই আমারে বাঁচাইলি নাজিবু। না হইলে যে কী করতাম। বেদনা উঠতাছে আইজ তিন-চাইরদিন ধইর‌্যা… কাইলই তাই আইয়্যা পড়ব –

কখন আইব?

কাইল ভোরসুম –

তুমি থাকবা তো?

রহিমুদ্দি অবাক, কী কস তুই! আমি না থাকলে হয়! বর্ডার পার হইব কেমনে? হের বড়োবাই তো আর ঢুকতে পারব না! আমার হাতে ছাইড়্যা দিয়া যাইব… হের পর? আমিই তো তারে নিয়া এইহানে ঢুকুম –

হাত ছেড়ে দিয়েছিল রহিমুদ্দি। নাজিবুল মুখ নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, তয় ট্যাহাটা কবে দিবা?

কাইলই দিমু। তুই থাকিস –

কই থাকুম?

রহিমুদ্দি বুঝিয়ে বলে। বলতেই নাজিবুল ঘাড় কাত করে ঠিক আছে জানিয়েই বেরিয়ে যায়।

 

পরের দিন। সকাল হয়েছে কী হয়নি ভালো করে এই সময়েই নাজিবুল এসে হাজির। আকাশ মেঘলা ছিল। শ্রাবণের আকাশ। বৃষ্টিটা নামি-নামি করেও শেষ পর্যন্ত আর নেমে এলো না। তবে গুমোট গরম। গাছের পাতাও বুঝি নড়ে না।

সকালে এসে আক্কাসের চায়ের দোকানের অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল নাজিবুল। সেই রকমই কথা ছিল। এই সময়েই সেখানে এসে হাজির রহিমুদ্দি। সঙ্গে একটি বউ। মাথায়  ঘোমটা হাতে ছোট একটা কাপড়ের ব্যাগ।

রহিমুদ্দি আগেই দেখেছিল। জানে, কথা যখন দিয়েছে নাজিবুল, সে আসবেই ঠিক। তবু এখন চোখে পড়ায় যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সে!

সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। সময় আর নষ্ট করল না রহিমুদ্দি। নাজিবুলের দিকে চোখ রেখে বলল, এই যে, এই মাইয়্যা –

মাথায় ঘোমটা থাকলেও নাজিবুলের চোখে পড়ে গিয়েছিল। ঘোমটার ফাঁক-ফোকর দিয়ে দেখতে গিয়েই সে চমকে উঠল।  কী সুন্দর! ফুলের মতোন চেহারা। যেমন রং, তেমনি দেখতে। নাক-চোখও যেন টানা-টানা। ভুরু যেন স্লেটের ওপরে চকখড়ি দিয়ে টেনে এঁকেছে কেউ? কিন্তু ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। বোধহয় কষ্ট হচ্ছে একটা শরীরে। দিনরাত এখন বাচ্চাটা পা দিয়ে ঠেলে গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে। মায়েরও তাই যন্ত্রণা শরীরে। রাতবিরেতে ব্যথা উঠছে। মুখও তাই যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট। তবু সেই বিষণ্ণ ও যন্ত্রণাকাতর শুকনো মুখটাই বড়ো ভালো লেগে গেল এখন নাজিবুলের।

জীবনে এ-পর্যন্ত ছিটের অনেক পোয়াতি মেয়েরই ভাড়াটে স্বামী হয়েছে সে। কিন্তু এমন রূপবতী মেয়ে বুঝি আসেনি! কী যে লাবণ্য তার শরীরে! নাজিবু মুগ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু এ-লাইনে মুগ্ধতার কোনো জায়গা নেই। আছে কেবল এক ধরনের গোপন দায়িত্ব! নাজিবুল চটপট তার হাতটা বাড়িয়ে ধরল।

দাও, থইল্যাখান দাও আমার হাতে –

প্রায় কেড়েই নিচ্ছিল, মেয়েটি লজ্জা পেল। অনুচ্চ গলায় জানাল, থাউক না। আমি পারুম।

পারা না-পারার কথা নয়! মেয়েটির কথায় রহিমুদ্দি লাফিয়ে উঠল। সে জানাল, অহন থিকা বাচ্চা না বিয়ানো অবধি খাতায়-কলমে হেয় কিন্তু তোমার স্বামী। হাসপাতালে হের নামই রেকর্ড হইব… তোমার বাচ্চার আববাও হইব সে! না হইলে তুমি বাচ্চা বিয়াইবা কেমনে? কোন পরিচয়ে। হাসপাতাল তো তোমারে ভর্তি নিব না –

একনাগাড়ে অনেক কথা! কিন্তু কথাগুলো জানে আম্বিয়া। জেনেই সে এসেছে। তবু পাখি পড়ার মতো আরো একবার ব্যাপারটা জানিয়ে দিলো ওকে রুহিমুদ্দি। জানাল, এই দেহ। হোনো। হুইন্যা লও ভালো কইর‌্যা। এরই নাম নাজিবুল। নাজিবুল ইসলাম। তোমার ভাড়াইটা স্বামী। অহনে এরই লগে তোমারে যাইতে হইব হাসপাতালে। বাচ্চা বিয়ানের লাইগ্যা। নাজিবু তোমারে ভরতি করাইব। ব্যবস্থা করাই আছে। আর বাচ্চা বিয়ানের পর যতদিন না হাসপাতালে তোমারে ছাড়ে, ততদিন হেই নাজিবুই তোমার দেখাশোনা করব। হেয়্যার পর ছুটির খবর হইলে তোমার ভাইয়্যারে সংবাদ পাঠামু। বাচ্চাসহ হের লগেই তখন যাইবা গিয়া। ভয় নাই নাজিবু খুবই ভালো পোলা। ব্যবহারও চমৎকার। দেইখ অনে… আমি তোমার লাইগ্যা ভালো পোলারই ব্যবস্থা করছি –

আম্বিয়া কাঁদছিল নীরবে। রহিমুদ্দি তা টের পেল। এবং পেতেই একটু সান্ত্বনা দিলো, এই দেহ… কান্দ ক্যা… কান্দনের কী হইল? বাচ্চা হইলে হেই টানে বাচ্চার বাপেও দেইখ্য অনে আইয়্যা পড়ব।

রহিমুদ্দি সান্ত্বনা দিচ্ছিল তাকে। সে জানে, এখন মেয়েটির এসবই মনে পড়ে যাচ্ছে। তাই সে বলল কিছু কথা তাকে গুছিয়ে।

বেলা বেড়ে যাচ্ছিল। রোদ না উঠলেও ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস করছিল চারপাশ। রহিমুদ্দিরা আর দেরি করল না। মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের দিকেই এগিয়ে গেল।

ব্যবস্থা করাই ছিল। রহিমুদ্দি ও নাজিবুলের সঙ্গে মেয়েটি হাসপাতালে যেতেই ভর্তিটা হয়ে গেল। এমনিতে কোনো অসুবিধে হলো না, তবে ভর্তি করাবার সময় কী লিখতে গিয়ে হাসপাতালের ভর্তিবাবুটির ঠোঁটে একটু মুচকি হাসি খেলে যায়। আর খেলতেই সে নাজিবুলের দিকে তার অনুচ্চ গলাটি তুলল।

হারামজাদা নাম কী রে তর বিবির –

নাজিবুল জবাব দেয়, আম্বিয়া খাতুন।

বয়স?

আন্দাজেই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, রহিমুদ্দি পাশ থেকেই জানাল, উনিশ পার কইর‌্যা এই তো বিশে পড়ছে –

ভর্তিবাবুর চোখ উঠেছিল, রহিমুদ্দিকে নজর করেই বলল, কে, চাচা নিকি! আপনে আছেন অখনো… আমি তো ভাবলাম নাজিবুলরে পৌঁছাইয়্যা দিয়া গেছেন গিয়া –

না না, যামু কুনখানে… ভর্তিটা না করাইয়া…

যাউক গিয়া, অহনে কন দেহি বয়সডা? কোনডা লিখুম। উনিশ না বিশ।

বিশই লেখেন –

ভর্তিবাবু কী লিখতে লিখতেই জানায়, ঠিকানা?

নাজিবুল নিজের ঠিকানা জানায়।

ঠিকানা লিখে ভর্তিবাবু একবার এপাশে-ওপাশে কী নজর করতেই রহিমুদ্দি তার হাতে কী একটা গুঁজে দেয়। লোকটি ততক্ষণে আবার চোখ তুলেছে নাজিবুলের দিকে। তা বিবি কই তর?

হেই যে –

নাজিবুল পেছনে ফিরতেই লোকটি উঠে একবার আম্বিয়াকে দেখে নেয়। দেখেই পরে ভেতরে তাকিয়ে কাকে কী নির্দেশ দেয়। দিতেই এক মহিলা এসে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। নাজিবুল পা বাড়াচ্ছিল। লোকটি বাধা দেয়।

হেই তুই যাবি না কিলাম অহনে। ফিমেল ওয়ার্ড। এক্কারে হেই বৈকালে ভিজিটিং আওয়ারে দেখা করতে যাবি –

কার্ড দিবেন না?

হ, দিমু না ক্যান! এই লইয়্যা যা –

আম্বিয়া যাওয়ার আগে একবার রহিমুদ্দিনের দিকে চোখ তুলেছিল ঘোমটার ফাঁক দিয়ে। রুহিমুদ্দি জানাল, যাও কুনো  চিন্তা নাই। বৈকালে নাজিবু আইব…

আইব ম্যানে! ভর্তিবাবু বলে তখন, নাজিবুরে অহনে থাকতে অইব এইহানে। ব্যাদনা উঠছিল?

হ। কয়দিন ধইর‌্যা তো সমানে লাফাইতে আছে –

ডেট কবে?

পরশু!

কিন্তু আইজই হইয়্যা যাইব মনে লয় –

বলে আবারও একটা হাসি খেলে যায় তার ঠোঁটে। নাজিবু জানে, জহুরির চোখ। ভর্তিবাবু একবার পোয়াতির পেট দেখলেই ডেলিভারির সময়টা বলে দিতে পারে। দেখছে তো ক-বছর ধরে। তাবাদে বয়সটাও অল্প আম্বিয়ার। কী জানি হলেও হয়ে যেতে পারে আজ।

টাকা-পয়সার লেনদেন করে হাসপাতালের খরচ বুজিয়ে দিয়ে রহিমুদ্দি চলে গিয়েছিল। নাজিবুল সামনের একটা হোটেলে গিয়ে ভাতমাংস খেয়ে এসে হাসপাতালের বেঞ্চিতেই বসে রইল। আম্বিয়ার হাতের ব্যাগটা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। টেনে নেওয়ার সময়ই নাজিবুল টের পেয়েছিল, তাতে কিছু শাড়ি-ব্লাউজ ও চিরনি-আয়নাসহ চুল বাঁধার ফিতে আছে। আর ছিল বোধহয় ভেতরের ছোটো একটা জামা। লাল রঙের একটা বক্ষবন্ধনী। ব্যাগটা পাঠাবার সময় নাজিবুল লক্ষ করেছিল, নিপুণ হাতে সেটাই সুন্দর ভাঁজ করে রাখা নিচের দিকে। হয়তো সেটা পরে লাগতে পারে ভেবে নিয়ে এসেছে।

কিন্তু বাচ্চাটা হয়ে গেলে এরপর! বাচ্চার টানে সত্যিই কী ওর স্বামীটা ফিরে আসবে। এলে তো ভালোই। স্বামী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে মেয়েটি। কিন্তু ছেলেটি গেল কেন? এমন সুন্দরী ও রূপসী বউ ফেলে সে কেন পালাল? পালাল না অন্যকিছু! অন্য কোনো মেয়ে নিয়ে আবার ভেগে পড়েনি তো! নাকি বর্ডারে এসে কোনো স্মাগলিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। পরে বিএসএফের গুলিতে মরে গিয়েছে। কিন্তু কোন আন্দারে বডি পড়েছে তার খোঁজ আর কেউ জানে না।

অনেককাল পরে খাসির মাংস পড়েছে পেটে। খাসির মাংস দিয়ে ভাত। বসে থাকতে থাকতে একসময় একটু ভাতঘুমই পেয়ে গেল নাজিবুলের। বেঞ্চির ওপরে পা তুলে হাঁটু মুড়ে হাঁটুর ওপরে হাত দুটো রেখে মাথা নামিয়ে দিলো নাজিবুল। এরপর ঘুমিয়ে পড়ল।

তা ঘুমের আর দোষ কী! ঘার গুঁজে থাকা হুমড়ি খেয়ে পড়া একটা চালার নিচে এক কামরার একটা ঘর। বর্ষায় তাতে ঝরঝর করে পানি ঝরে। শীতে জববর ঠান্ডা। আর গরম এলো তো গরমে শুলেও ঘুম বুঝি ভেঙে যায়! এখানে সাপ, ওখানে ইঁদুর। সকালে উঠেই তাই চোখ লাল। করকর করে জ্বলে। আর জ্বললেই হু-হু করে ঘুম। ঘুম নেমে আসে দুচোখ জুড়ে। কিন্তু শুধু ঘুমে তো পেট ভরবে না। অতএব কাজ দেখ। কিন্তু কাজটা করবে কী সে! দু-পা বাড়ালেই বিশাল এক চেকপোস্ট। তাতে নানা ধরনের কাজ। চেষ্টা করলে হয়তো দালালিটা করা যেত। ভিসা নিয়ে আসা লোকজনদের কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য  ফরম-টরম লিখে দিতে পারত। তবে তার জন্য পেটে কিছু বিদ্যে থাকা চাই। কিন্তু লিখতে-পড়তে জানে না যে নাজিবুল, অক্ষরজ্ঞান তার একেবারেই শূন্য। সইটইও করতে পারে না। ফলে যেখানে দরকার সেখানেই ওই আঙুলে কালি লাগিয়েই ধপ করে মেরে দেয়। তা এমন ছেলের দালালিটা জোটে কী করে। তবু হয়তো জুটত। কিন্তু বাপটা মরে যেতেই সব ঝাপসা। মা গিয়েছিল আগেই। এখন বাপ যেতেই পথে নামল সে।

চেহারাটা ছিল সুন্দর। কন্দর্পকান্তি। অতঃপর এদিকে-ওদিকে ঘুরতে ঘুরতে এই লাইনেই নেমে পড়া। বছর পঁচিশের নাজিবুল তাই ফেরেনি আর কোথায়ও। নানান ধান্দায় জীবন কাটিয়েছে। কখনো চেকপোস্টে টুরিস্টদের ব্যাগ টানা, কখনো বা ছিটের পোয়াতিদের ভাড়াটে স্বামী খাটা। তাও কী হতো নাকি। সেবারে ভোটের সময়েই তো ভোটার কার্ডটা হয়ে গেল।   এখন ওই কার্ডটাই তার মস্ত ভরসা। ভোটের সময় যে পার্টি টাকা দেয় তার হয়েই খাটে। আবার ভোট ফুরোলে এটা-ওটা-সেটা। এভাবেই তো গোটা আট-দশটা পোয়াতির স্বামী হলো সে। কিন্তু হলেও টাকা নিয়েই সে পালাতে পারেনি। যতক্ষণ না বাচ্চা হয়েছে ও বাচ্চা হয়ে ছুটি হয়েছে প্রসূতির, ততক্ষণ সে তার পাশেপাশেই। এজন্য এ-লাইনে তার একটা সুনামও ছড়িয়ে পড়েছে। সবাইই তাকে খোঁজে। ভাড়াটে স্বামী হিসেবে তাকে পেতে চায়।

ঘুমিয়েই পড়েছিল। সন্ধের পরেই কে তাকে ডাকল : নাজিবুল ইসলাম… নাজিবুল ইসলাম…

ধড়মড়িয়েই উঠে পড়েছিল। উঠতেই টের পেল তার নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। উঠে গিয়ে হাসপাতালের অফিসে যোগাযোগ করতেই তারা জানাল, তার ছেলে হয়েছে।

ছেলে! ছেলে হয়েছে! ছেলে? নাজিবুল আপ্লুত। যাক, ছেলেটাকে নিয়ে এবারে অন্তত মেয়েটা বাঁচপে।

অপেক্ষা করছিল। একসময় রাতের দিকে একটু সময়ের জন্য নাজিবুলকে দেখতে দিলো। কিন্তু তখন মা ও ছেলে দুজনেই ঘুমোচ্ছে। নাজিবুল নেমে এসেছিল।

কিন্তু পরের দিন সকালেই তাকে একবার ওপরে উঠতে হলো। কী কী সব দরকার। তার মদ্যে একটা হরলিক্সও আছে। নিচে নেমে ফের ওপরে উঠে জিনিসগুলো দিতে গিয়েই চোখে পড়ল এবারে মেয়েটির কোলে বাচ্চাটাকে দিয়েছে। কেমন সুন্দর মানিয়েছে মেয়েটিকে! আর বাচ্চাটিও কেমন ফুটফুটে। রাজপুত্রের মতো ধবধবে চেহারা।

বাহ্, কী সোন্দর! ঠিক তোমার মুখ পাইছে। তুমি যেমন সোন্দর –

মেয়েটি লজ্জা পেয়ে যায়। বুকের অাঁচলটা টেনেটুনে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। একবার নাজিবুলের দিকে তাকায়ও বুঝি। তাকিয়েই ফের চোখ নামিয়ে নেয়। তার মুখে এতক্ষণে একটা প্রশান্তির ছায়া।

অহনে ওর বাপে দেখলে কী খুশিই যে হইব…

বলতে গিয়েই আচমকা চুপসে যায় নাজিবুল। থমকে তাকায় একবার চারপাশে। এ আবার কী বলে ফেলল সে! কেউ শুনল না তো! এমন ভুল তো সে করে না কোনোবার।

চারপাশে তাকিয়ে কী লক্ষ করছিল, মেয়েটির দিকে নজর ফেরাতেই আবার চমকে উঠল। মেয়েটির চোখ ভরে উঠেছে জলে। পরে যেন বাচ্চাটার কচি হাতেও এক ফোঁটা পড়ল।

না না, কাইন্দো না। অনুচ্চ গলায়ই হা-হা করে ওঠে নাজিবুল, তুমি কান্দলে বাচ্চারই অহনে অমঙ্গল… কী সোন্দর পোলা হইছে তোমার। কী নাম দিবা কও তো?

মেয়েটিকে ভোলাবার চেষ্টা করে নাজিবুল। আইচ্ছা আমি একখান নাম দিমু তোমার পোলার –

মেয়েটি আলগোছে চোখ মোছে অাঁচলের খুঁট দিয়ে।

নাজিবুল তখন নানাভাবে মেয়েটিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করে। একবার যে-ভুল করেছে, সে-ভুল আর করতে চায় না সে।

মেয়েটাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিকেলে ফের আসবে জানিয়ে সে নেমে আসে।

 

রহিমুদ্দিকে খবর দেওয়া হয়েছিল। সে এসে আম্বিয়ার দাদাকে খবর পাঠাল। কিন্তু পাঠালেও যে-খবর এলো তা খুবই খারাপ। আম্বিয়ার দাদা জানিয়েছে, বাচ্চা হওয়ার কথা। হয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে তারা তা করিয়েছে। টাকা-পয়সাও যা দেওয়ার দিয়েছে। কিন্তু এখন আর তারা এসব দায়িত্ব নিতে পারবে না। ফজলুল যদি ফিরে আসে তো সে-ই এসে বুঝবে। ফজজুল আম্বিয়ার স্বামী। কিন্তু তার কোনো খবর পাওয়া গেল না এরপরেও।

তিনদিনের মাথায় হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চাটাকে নিয়ে নাজিবুলের সঙ্গে নিচে নামতেই আম্বিয়ার চোখে অন্ধকার। শুনল সে সবই। শুনেই তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করল। এখন সে কোথায় যাবে। কে নিয়ে যাবে তাকে বর্ডার পার করে। দাদারা তো আসবে না জানিয়েছে। এক হতে পারে রহিমুদ্দি চাচা যদি তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসে। কিন্তু দিয়ে এলে তারপর? সে যে এখন কী করে!

নাজিবুল টের পেয়েছিল। পেয়েই বলল, চাচা তাইলে তুমি আরে লইয়্যা যাও না। বর্ডারে তো তোমার চিনাজানা আছে। তোমারে যাইতে দিব হেইপারে…

হেইয়্যা না হয় আছে… কিন্তু আইজ কইলে আইজই তো যাইতে দিব না? হের দাদায় আইলে না হয় ব্যবস্থা কইর‌্যা হের দাদার লগে পাঠাইয়া দিতাম। তেমনই তো কথা ছিল। কিন্তু…

তাহলে অহন?

রহিমুদ্দি জানায়, দেহি তাইলে… তুই খাড়া… আমি খোঁজ লইয়্যা আহি একবার…

তা সেই খোঁজ নিতে গিয়েই দুপুর কাটল। বিকেল গেল। সন্ধেও হয়ে আসে বুঝি। হাসপাতালের একপাশেই বেঞ্চির ওপরে বসে ছিল আম্বিয়া। অাঁচলে ঢেকে বাচ্চাকে স্তন দিচ্ছিল। এই সময়েই নাজিবুল এসে জানাল, সইন্ধ্যা লাইগ্যা গেল চাচায় তো অহনও আইল না… কী করবা?

কী করুম কন? আমার তো এইহানে কুনো চিনাজানা নাই…

এক কাম করো… লও আমার লগে…

কই যামু? নরম গলায়ই জিজ্ঞেস করতে করতে চোখ তুলেছিল একসময় আম্বিয়া। নাজিবু জানাল, কই আর যাইবা? আমার লগেই চলো। আছে তো একখানা ভাঙা বাড়ি। একটু দূরে। না-হয় হেয়ানেই থাকবা। হারারাত তো আর বাচ্চা লইয়্যা এইহানে বইয়্যা থাকতে পারো না?

কিন্তু চাচা?

হেরে সংবাদ একখান পাঠামু নে। হেইয়্যা ছাড়া বর্ডার বন্ধ হইয়্যা গেছে আইজের মতো। যাইবা কেমনে?

আম্বিয়ার অস্বস্তি হচ্ছিল। আবার ভয়ও করছিল। অচেনা-অজানা এক যুবক। যতই সে তার ভাড়াটে স্বামী হোক। আর সে তো হাসপাতালের ভেতরে। খাতায়-কলমে। কিন্তু বাইরে এসে এখন তার বাড়িতেই রাত কাটানো… আবার এদিকে না গেলেও বুঝি চলে না! দুধের এই কচি বাচ্চাটাকে নিয়ে এখন কোথায় যাবে সে? কী ভেবে অগত্যা উঠল আম্বিয়া। পায়ে পায়ে নাজিবুলের সঙ্গে বাইরেও বেরিয়ে এলো একসময়। আরো পরে একটা রিকশা ঠিক করে তাতেই উঠে মেয়েটিকে নিয়ে নিজের বাড়িতে তুলল নাজিবুল। রহিমুদ্দির তবু কোনো খবর নেই। খবর অবশ্য পাঠাল একটা নাজিবুল।

দিন গেল। সন্ধে হলো, রাত কাটল।

সে-রাতটা কোনো রকমে কেটে গেল আম্বিয়ার। ভয় ও অস্বস্তি নিয়ে। পরের দিনও প্রায়। প্রায় জেগেই একরকম কাটিয়ে দিলো সে। কিন্তু পরের সকালে রোদ না চড়া হতেই দেখা গেল, লোকজন নিয়ে এসেছে নাজিবুল। ঘর সারাবে সে। নতুন টিন নিয়ে এসেছে। টিন বসাবে চালায়। দেয়ালের বেড়াও বদলাবে। তাবাদে উঠোনের জঙ্গলও পরিষ্কার করাবে বুঝি।

পাড়া-প্রতিবেশীদের চোখে পড়েছিল। তারা এসেই লাফিয়ে উঠল, ও নাজিবু করছ কী… অ্যাঁ। এক্কারে বউ-বাচ্চা লাইয়া হাজির হইলি। বেশ পোলা তো তুই! জানাইলি না একবারও। কুনহানে বিয়া করছস। আর বউরে থুইয়্যা একা একা এইহানে… দেহি তর বউ…

তা বউ দেখে প্রতিবেশীরা মুগ্ধ। এবং বলা বাহুল্য, বাচ্চাকে দেখেও।

ও মা, কী সোন্দর! কী সোন্দর হইছে গো… এক্কারে নাজিবুর লাখান…

বলতে বলতে তাদের কেউ কেউ যেন মেয়েটিকে নিয়েই পড়ল, ও বউমা তা নাজিবুর লগে দেখা হইল কুনখানে? ভাগ্য কইর‌্যা এমুন একখান পোলা পাইছ। নাজিবু আমগো হীরের টুকরো পোলা। দেখত্যাছি তো ছেলেবেলা থিকা…

আম্বিয়া চোখ নামিয়ে নেয় লজ্জায়।

ও মা, লজ্জার কী… বরের কথা কইবা তাইতে কেমুন লজ্জা…

লজ্জায় সরেও গিয়েছিল নাজিবুল। প্রতিবেশীরা চলে গেলে সে আবার পায়ে পায়ে আসে আম্বিয়ার সামনে।

কিছু মনে কইরো না। সব কথা তো বুঝাইতে পারি না হেগো। কইতেও পারি না… কী কমু কও!

কী আবার বলবে। চোখ নামিয়ে নিয়েছিল আম্বিয়া। আবারো তুলতে গেল। কাঁটাতারের ওপারের জীবন! বরাবরই ছিটমহলের খাঁচায় বন্দি। খাঁচা ভেঙে কাঁটাতার পেরিয়ে যে এদিকে আসা যায় সে-ধারণাও ছিল না কোনোদিন। এবারে হয়েছে। আর হয়েছে শুধু নয়, জানতেও পেরেছে ওকে আর ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না ওর দাদারা। রহিমুদ্দি-চাচা এসেছিল ফিসফিস করে যা বলে গেল, তাতেই বুঝেছে ফেরা আর হবে না আম্বিয়ার! স্বামী ওকে ফেলে পালিয়েছে, এখন দাদারাও আর দায়িত্ব নিতে চায় না। ফলে সুযোগ বুঝেই পাচার করেছে। তবে পাচার হলেও দুঃখ নেই। ভেঙেও পড়বে না। আর পড়বেই বা কেন! নাজিবুল না জানলেও সে তো জানে, কচি একটা বাচ্চা নিয়ে নিজের অজান্তেই সে যে কখন নাজিবুলকেই অাঁকড়ে ধরেছে।

কিন্তু এখন নাজিবুল যদি ওকে ফিরিয়ে দেয়!