কাছের মানুষ সুনীতিকুমার

সুরজিৎ দাশগুপ্ত

সাল ১৯৪৮, স্থান জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল, জানালা দিয়ে দেখা যায় সবুজ ধানক্ষেতের ওপারে তিস্তার সাদা বালির চর, তার পরে রোদ্দুরে চিকচিক জলস্রোত। একদিন আমাদের ক্লাসে বাংলার শিক্ষকের বদলে ইংরেজির শিক্ষক রমেশ গুপ্ত ভায়া, রাগী বলে তাঁর নাম ছিল, থাকতেন স্কুল চৌহদ্দির লাগোয়া বাড়িতে। রমেশ-স্যার এসেই একটা বড়মাপের বই থেকে ডিকটেশন দিলেন। ক্লাস শেষ হলে ডিকটেশনের খাতাগুলো নিয়ে চলে গেলেন। পরের পিরিয়ড টিফিনের। রমেশ-স্যার টিফিনের সময় রোজ বাড়ি যেতেন। সেই সুযোগে আমি ধানক্ষেতের দিকের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে রমেশ-স্যারের রেখে যাওয়া বইখানি টেনে নিয়ে চলে গেলাম পাশের আম-লিচুর বাগানে। একটা গাছে চড়ে বইটি পড়তে পড়তে এমন জমে গেলাম যে সময়ের হুঁশ ছিল না। যখন খেয়াল হলো তখন ক্লাসঘরে গিয়ে দেখি দরজায় তালা পড়ে গেছে। অগত্যা গেলাম রমেশ-স্যারের বাড়িতে। প্রথমটাতে একচোট বেজায় বকুনি! তার পরে বইটি আমার হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, ‘নিয়ে যাও। পুরোটা পড়ে একটা রচনা লিখে এনে দেখাবে। এক সপ্তাহ টাইম দিলাম।’

বইটার নাম দ্বীপময় ভারত, লেখক শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। নিচের ক্লাসে তাঁর-সম্পাদিত বাংলা পাঠমালা আমাদের পাঠ্য ছিল। দ্বীপময় ভারত পড়ে তার ওপরে রচনা লিখে নিয়ে কয়েক দিন পরে দেখালাম রমেশ-স্যারকে। তিনি পড়ে বললেন, ‘তোমার মধ্যে দেখছি সাহিত্যিক হবার সম্ভাবনা আছে। একটা সাদা কাগজে নকল করে এটা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় পাঠিয়ে দাও প্রফেসর সুনীতি চাটুজ্জেকে।’ যেমন বললেন তেমনই করলাম।

কিছুদিন বাদে আমার নামে ব্রিটিশ রাজার মাথা ছাপা খামে একটা চিঠি এলো। সেই প্রথম আমার খামের চিঠি পাওয়া। কাগজটার মাথায় একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানা আর অন্যদিকে ‘সুধর্মা’ বাড়ির ঠিকানা ছাপা, মাঝখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্ন পদ্মফুল ও তার ওপরে বা নিচে ছাপা সুনীতিকুমারের নাম, সঙ্গে তাঁর খয়রা অধ্যাপক পদের ও আরো অনেক ডিগ্রির উল্লেখ আর সব কিছুর মাথায় গাঢ় নীল কালিতে হাতে লেখা ‘শ্রীঃ’। খাড়া-খাড়া কিন্তু টানা টানা, জড়ানো অথচ স্পষ্ট হাতে লেখা ছোট চিঠি। আমার চিঠির সঙ্গে দ্বীপময় ভারত সম্বন্ধে মতামত পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন। সেই সঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে, আমার চিঠিতে আমার পরিবারের কথা কিছু লিখিনি – পরিবার ছাড়া কারো পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। কলকাতায় এলে যেন দেখা করি।

তাঁর সেই চিঠিখানা রমেশ স্যারকে দেখাতে তিনি বললেন, ‘কত বড়মাপের মানুষ দেখেছ! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যাঁর গুণমুগ্ধ, বিশ্বজুড়ে যাঁর অত নাম, অত বড় পন্ডিত, অত ব্যস্ততা – মফস্বলের এক স্কুল স্টুডেন্টকে নিজে হাতে চিঠি দিলেন! এঁকে কী বলব? মানুষ, না মহামানুষ?’

এর কিছুদিন পরে খবরের কাগজে দেখলাম, সুনীতিকুমার নাকি হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছেন। আমার স্পর্ধা বেড়ে গিয়েছিল। আমি তাঁকে একটা চিঠি লিখলাম। যে-ভাষার কবি বিশ্বকবি সেই বাংলা ছেড়ে কেন হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলছেন? কয়েকদিন বাদে হালকা নীল রঙের ফিনফিনে পাতলা কাগজে লেখা তাঁর উত্তর এলো। যে-ভাষা হাওড়া স্টেশনের মুটে যেমন বুঝতে পারে তেমনই বম্বে স্টেশনের মুটেও বুঝতে পারে সেই ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হবার যোগ্য। সাহিত্যের গুণ নয়, মাথা গুনতির জোর দিয়েই বিচার করতে হবে কোন ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে, আর কোনটি হবে না।

অবশ্য পরবর্তীকালে ভারতীয় ভাষা কমিশনের সদস্য হিসেবে তিনি যে উপস্থাপন করেছিলেন, তাতে সংস্কৃতকে অন্যতম সরকারি ভাষা করার সুপারিশ করেছিলেন। ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্যে যেসব ভাষা  ঘরে-বাইরে ব্যবহৃত হয় মাতৃভাষা রূপে তেমন কোনো একটিকে রাষ্ট্রভাষা করলে সেই ভাষাটি যাদের মাতৃভাষা তারা একটি বিশেষ সুবিধে পাবে রাষ্ট্রীয় কাজেকর্মে, তাই যে-ভাষা কারো মাতৃভাষা নয় সেই সংস্কৃত ভাষাকে, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক ভাষা রূপে ইংরেজিকে আর বহুভাষার দেশ ভারতীয় ভাষারূপে বহু ভাষার মিশ্রণে বিকশিত হিন্দুস্তানি ভাষাকে (হিন্দি ভাষাকে নয়) ‘সরকারি ভাষা’ করার প্রস্তাব করেন এবং ভারতের মতো বহু-ভাষাভাষী দেশের জন্যে কোনো একটি ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার পক্ষে যে কোনো যুক্তি নেই সে-কথাও বিশদভাবে জ্ঞাপন করেন। এই প্রসঙ্গটাকে আরো একটু টেনে নিয়ে যাই ১৯৯০-৯১-এর সময়টাতে। তাঁর শতবর্ষ উপলক্ষে ভারত সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছিল সুনীতিকুমার স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশের জন্য। আবেদনকারীদের মধ্যে ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, সত্যজিৎ রায়, অম্লান দত্ত, নিমাইসাধন বসু প্রমুখ। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ও মালিনী ভট্টাচার্য। দুজনেই তখন সাংসদ। কিন্তু হিন্দিবাদীদের আপত্তিতে ভারত সরকার সে-আবেদন অগ্রাহ্য করে।

যা হোক, ফিরে আসি আগের কথাতে। ১৯৫০-এর ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে কলকাতাতে এসে একদিন ঠিকানা খুঁজে খুঁজে গিয়ে হাজির হলাম হিন্দুস্থান পার্কে তাঁর সুধর্মা বাড়িতে। তাঁর তখনকার বাড়িটা ছিল দোতলা। রাস্তার থেকে আলাদা করার জন্য বুকসমান উঁচু পাঁচিলের গায়ে দুটো ফটক – একটা পুব দিকে, তার থামের গায়ে লেখা ‘সুধর্মা’, আর একটু পশ্চিম দিকে, তার পাশে লেখা ‘চাটুর্জ্যে বাড়ি’। পুবের ফটক দিয়ে ঢুকে সামনে শান বাঁধানো চাতাল, ফটকের বিপরীতে চাতালটার উত্তরে গ্যারাজ, বাঁদিকে মানে পশ্চিম দিকে বাস্ত্তবাড়ি, তার দক্ষিণে গাড়িবারান্দা। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি কোন ফটক দিয়ে ঢুকব। এমন সময় একজন প্রৌঢ় পেছন থেকে এসে আমায় পাশ কাটিয়ে পুবের ফটকটা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন, তাঁর কাঁধে একটা বেতের ধামা, ধামার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে কিছু শাকসবজি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে চাই?’ আমি সুনীতিকুমারের নাম বলাতে বললেন, ‘আসুন।’ চাতাল থেকে বাঁ-দিকে তিন-চার ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা বন্ধ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। আমিও তাঁর পিছু সেই ঘরে ঢুকে দেখি, একটা টেবল ও কয়েকটা কাঠের চেয়ার এলোমেলোভাবে। আমার নাম জিজ্ঞেস করে ধামাকাঁধে ভদ্রলোক ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি বসে থাকলাম।

কিছুক্ষণ পরে চটি ফটফট করে বলিষ্ঠদেহী একজন প্রবীণ ব্যক্তি ঘরে এলেন। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, গায়ে পকেটওয়ালা ফতুয়া, পরনে লুঙ্গি করে জড়ানো ধুতি। উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই – ঘরে ঢুকেই হাত জোড় করে বললেন, ‘নমস্কার।’ তখন আমিও প্রত্যুনমস্কার করলাম। পরে জেনেছি, পা ছুঁয়ে প্রণাম করা, বিশেষত তাঁকে, তিনি পছন্দ করতেন না। নিজের পরিচয়-দ্যোতক একটা নাম-সই উদ্ভাবন করেছিলেন তাঁর নামের আদ্যাক্ষরগুলি দিয়ে – ‘সু-কু-চ’ – সংস্কৃতে যার মানে ‘ভালো এবং মন্দ’। পায়ে হাত দিয়ে কাকে প্রণাম করছ তা না জেনে, লোক-দেখানো প্রণাম করা ভক্তির ‘আদিখ্যেতা’। যা হোক সশব্দে একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে আমাকে বসার জন্যে হাতের ইঙ্গিত করলেন। বললেন, ‘জ্ঞান গিয়ে বলল, জলপাইগুড়ি থেকে সুরজিৎ বাবু এসেছেন। তুমিই সুরজিৎ? এরকম কাঁকলাসের মতো চেহারা নিয়ে তুমি সুরদের জয় করলে কীভাবে?’

ভেবেছিলাম, বেকুবের মতো চলে এসেছি ঝোঁকের মাথায়, এত বিখ্যাত রাশভারী মানুষের সঙ্গে কী কথা বলব? কিন্তু তিনি শুরুতেই আমার আড়ষ্টতা ভেঙে আমার বাড়ির খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলেন। তারপর আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানতে চাইলেন। ভেবেছিলাম ভালো হয়নি শোনার পরে কেন খারাপ হলো জানতে চাইবেন। কিন্তু তিনি বললেন, ‘ইউনিভার্সিটির আন্ডারে এটাই লাস্ট স্কুল পরীক্ষা, ভালো করে দিতে পারলে ভালো হতো। এবার থেকে জীবন শুরু করার পরীক্ষা, তারপর জীবনভর পরীক্ষা, সেগুলো যেন ভালো হয়। তবে তার জন্য শরীর মজবুত হওয়া চাই। রোজ সকালে ব্যায়াম করবে। আমি এখনো ফ্রি-হ্যান্ড করি।’

আমি ঘরের চারপাশটা দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করি, ‘ওই দরজার মাথায় সাদা পাথরে শিলালিপির মতো খোদাই করা ওটা কী?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘কাছে গিয়ে দেখো।’ আমি কাছে গিয়ে দেখি, অাঁকিবুকি কাটাকুটি কিছু চিহ্ন। এগুলো কী? আমার মনের কথা অাঁচ করে তিনি বললেন, ‘ওটা একজন গ্রিক কবির গ্রিক ভাষাতে কবিতাংশ।’ এই বলে তিনি দুর্বোধ্য ভাষাতে কিছু আবৃত্তি করলেন। তারপর তিনি মানেটি বললেন, ‘এই অপূর্ব শোভাময় বিশ্ব কে সৃষ্টি করেছে, কেন করেছে, কে সে, কিছুই জানি না। এই এক বিস্ময়। এই বিস্ময়কে প্রণাম করি।’ পরে জেনেছি, তাঁর সে-দোতলা বাড়ির প্রায় প্রত্যেক দরজার মাথায় সাদা মার্বেল পাথরে খোদাই করা আছে নানা ভাষার নানা লিপির নানা শাস্ত্র ও সাহিত্য থেকে নানা মূল্যবান উদ্ধৃতি বা স্মরণীয় বচন এবং নানা মাঙ্গলিক চিহ্ন। এরকম একটি ফলকে ছিল রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখাতে খোদাই করা রবীন্দ্রনাথেরই কবিতাংশ।

এখানে বলে রখি, সুনীতিকুমারের পৈতৃক বাড়ি ছিল উত্তর কলকাতার চালতা বাগানের সুকিয়াস স্ট্রিটে। বোধহয় ১৯৩৪-এর জানুয়ারিতে ভূমিকম্পের সময় চলে আসেন সদ্য পত্তন-পাতা হিন্দুস্থান পার্কে আর সুকিয়াস স্ট্রিটে থেকে যান পরিবারের অন্যরা, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছিলেন আজীবন। তবে উদ্বিগ্ন ছিলেন তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে। কারণ তাঁদের বাড়ির ওপরে মাঝেমধ্যেই ইটপাথর ইত্যাদি উড়ে আসত আশপাশ থেকে সম্ভবত তাঁদেরকে পাড়া-ছাড়া করার জন্য। এই প্রসঙ্গে তিনি একদিন বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের জন্যে সবাই মাথা ঘামাচ্ছে, কিন্তু এই কলকাতাতেই যে বাঙালিরা উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে, শহর ছেড়ে শরণার্থী হয়ে শহরতলিতে মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজছে, এই ব্যাপারটার দিকে কারো নজর নেই।

ফিরে আসি সেই প্রথম সাক্ষাতের প্রসঙ্গে। একসময় জিজ্ঞেস করলেন, চা বা কফি কিছু খাব কি না। আমি কী উত্তর দেব ভাবছি। তিনি বললেন, ‘খাওয়ার ব্যাপারে কখনো সংকোচ করবে না। যখন বিলেত যাই, প্রথম প্রথম আমিও সংকোচ করতাম। দুদিনেই বুঝতে পারি, সংকোচ করলে উপোস করে থাকতে হবে।’ আর একদিন তিনি প্রথমবার বিলেত থেকে ফেরার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। ‘যখন দেশে ফিরলুম, এনারা প্যাথেটিক অ্যাঙ্গেলে ঘাড় কাত করে জিজ্ঞেস করতেন, বিলেতে দুটি ভাত পেতে? ধ্যাত্! হু কেয়ার্স ফর রাইস! ওই যে, জলে সেদ্ধ করে দু’টুকরো মাংস – কীসের মাংস জিজ্ঞেস করো না – দু’টুকরো রুটি দিয়ে খেতুম, তার যা গুণ – এক হান্ডা ভাতেও সে গুণ নেই।’

প্রথম সাক্ষাতের আরো দুটি কথা মনে পড়ছে। আমাদের কথাবার্তার মধ্যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক এলেন। তাঁকে দেখে একটু অসন্তুষ্টভাবে সুনীতিকুমার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কেন এসেছেন?’ ভদ্রলোক কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘আপনি দেখা করার জন্য খবর পাঠিয়েছিলেন।’ তখন তিনি বললেন, ‘সে তো ইউনিভার্সিটিতে দেখা করতে বলেছিলুম। যাক গে এসেছেন যখন, শুনেই যান। আপনি যে প্রশ্নপত্রটা বানিয়েছেন সেটা দেখেছি, ও চলবে না। প্রশ্নকর্তা কতটা জানে সেটা জানাবার জন্যে নয়, পরীক্ষার্থী কতটা জানে সেটা জানবার জন্যই আমরা প্রশ্নপত্র বানাই। আপনাকে নতুন করে প্রশ্নপত্র বানাতে হবে।’ ভদ্রলোক ‘আচ্ছা স্যার’ বলে মাথা নিচু করে চলে গেলেন। সেই প্রথম সাক্ষাতেই ছাত্রদরদি স্পষ্টবক্তা সুনীতিকুমারের পরিচয় পেয়েছিলাম।

এর পরেও কয়েকবার তাঁর সে-রূপ দেখেছি। আর-একবারের কথা বলি। সেবার গেরুয়া পোশাকধারী একজন সাধুমহারাজ এসেছিলেন তাঁর লেখা একখানি বই উপহার দিতে। বইটির নাম মনে নেই এতদিন পরে। বোধহয় গীতাতত্ত্ব অথবা গীতারহস্য। সুনীতিকুমার বললেন, ‘ছোটোবেলা থেকে গীতা পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে গেছে। নতুন করে গীতা আর কী পড়ব!’ মহারাজ নাছোড়বান্দার মতো বললেন, ‘আমি গীতার একটা নতুন ভাষ্য লিখেছি আমার আপন উপলব্ধি থেকে প্রাপ্ত।’ তখন সুনীতিবাবু বললেন, ‘অনেকদিন আগে বাহাত্তর পেরিয়েছি। দেখুন, এই একটাই আমার মাথা, তার মধ্যে এই একটুখানি পাত্র, এতে আর নতুন তত্ত্ব ঢাললে সব উপচে বেরিয়ে আসবে। আপনি বরং আপনার বই নিয়ে যান, অল্পবয়সী কাউকে দিলে তাঁর তত্ত্বজ্ঞান বাড়বে, সমাজের উপকার হবে।’ মহারাজ গুম হয়ে বইখানি বগলদাবা করে বেরিয়ে গেলেন। তখন আমাকে উদ্দেশ করে সুনীতিকুমার বললেন, ‘এঁরা বোঝেন না, আমার আর বেশিদিন আয়ু নেই, এখন আর গীতাজ্ঞান অর্জনে আমার প্রয়োজন নেই।’

১৯৫০ থেকে ১৯৭৭-এ তাঁর দেহরক্ষা পর্যন্ত কতবার যে তাঁর কাছে গেছি তার হিসেব রাখিনি। এই সাতাশ বছর থেকে অবশ্য দার্জিলিংয়ে পাঁচ বছর বাদ। বাকি বাইশ বছরের মধ্যে একবার তো পুরো একদিনের জন্য তাঁর বাড়িতেই থেকেছি। সেই থাকাটার কথা বলি। আমার এই একাশি বছরের জীবনে আমি অন্তত চারবার বিনাটিকিটে রেল ভ্রমণ করেছি। প্রথমবার করি চোদ্দ বছর বয়সে। জলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে বেড়াতে গিয়ে সামনে ট্রেন দেখে উঠে পড়ি। তখনকার দিনে জলপাইগুড়ির আপ-ডাউন সব ট্রেনই যেত সদ্যোজাত পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে। সেবার পাকিস্তানের টিকিট চেকার আমাকে এক অজানা ছোট্ট স্টেশনে নামিয়ে দিয়েছিলেন। তৃতীয়বার এক টিকিট চেকার আমাকে পুরে দিয়েছিলেন ধানবাদ স্টেশনের হাজত-খাঁচাতে, পরদিন আমাকে হাজির করা হয় রেল-আদালতে। দ্বিতীয়বার অবশ্য ধরা-না পড়ে পৌঁছেছিলাম শেয়ালদা স্টেশনের চত্বরে, কিন্তু তারপর ট্রামের কনডাক্টর একবার নামিয়ে দিলেও শেষ পর্যন্ত পৌঁছাই ‘সুধর্মা’তে। আমাকে দেখে সুনীতিকুমার প্রথমে বললেন, ‘এ কী চেহারা!’ তারপরেই প্রশ্ন, ‘মাকে বলে এসেছ?’ পরের প্রশ্ন, ‘মায়ের গয়নাতে হাত দাওনি তো?’ আমার উত্তরে বোধহয় নিশ্চিন্ত হয়ে ডাক দিলেন, ‘বাদল!’ বাদলদা মানে তাঁর ছেলে এলে বললেন, ‘ওই ছোকরা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। আজ এখানেই আটকে রাখো, কাল জ্ঞান গিয়ে জলপাইগুড়ির টিকিট কেটে তুলে দিয়ে আসবে ট্রেনে।’ সেবারে দেখেছিলাম তাঁদের রান্নাঘরের দরজার মাথায় লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আর তার দুপাশে দুছড়া ধান।

আমি যখন তাঁকে আমার বিয়ের খবর দিলাম তখন তিনি খুব খুশি হলেন। যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি সে আমার সঙ্গেই এমএ পরীক্ষা দেবে শুনে বললেন, ‘এই এক নতুন চলন হয়েছে। কালের সঙ্গে চলন তো বদলাবে। আগে আমরা মলমূত্র ত্যাগের জন্য মাঠে জঙ্গলে যেতাম, শহরে এসে বাস্ত্তবাড়ির বাইরে, তারপর সিঁড়ির নিচে আধো-অন্ধকার ঘরে, এখন শোবার ঘরের মধ্যে চলে এসেছে। তা তোমার তো অসুখের জন্যে কয়েক বছর নষ্ট হয়েছে। মেয়েটি কি সমবয়সিনী?’ বললাম, ‘বছর চারেকের ছোট।’ তাতে হেসে বললেন, ‘তাহলে বুড়ো বয়সে তোমাকে দেখাশোনা করতে পারবে। ওর ইন্টারেস্ট কীসে?’ যেই বললাম ‘গ্রিক হিস্ট্রি’ অমনই টেবিলে চাপড় মেরে বললেন, ‘বাঃ, খুব ভালো। ওকে গ্রিক ভাষা শিখতে উৎসাহ দেবে।’ আমাদের বিয়ে হয় কলকাতায় আর বউভাত জলপাইগুড়িতে। বোধহয় বউভাতের পরদিন, ব্রাউন পেপারে মোড়া একটা প্যাকেট এলো রেজিস্ট্রি পোস্টে। খুলে দেখি, The Oxford Book of Greek Verse, ভেতরে ছবির মতো হাতের লেখা – ‘\ওঁ\ শ্রীঃ\ শ্রীমান সুরজিৎ, শ্রীমতী মঞ্জু পরম কল্যাণীয় ও প্রীতিভাজন করকমলেষু = শুভ বিবাহে আন্তরিক আশীর্বাদ। শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। কলিকাতা ২৭/২/১৯৬২।’

মঞ্জু আমার চেয়ে চার বছরের ছোট শুনে আশ্বাস দেওয়ার সুরে বলেছিলেন, আমাকে বুড়ো বয়সে দেখাশুনো করতে পারবে। নিজে বিয়ে করেছিলেন তাঁর চেয়ে দশ বছরের ছোট কমলা মুখোপাধ্যায়কে। নিজে কিন্তু তাঁর ‘দেখাশুনো’ নিতে পারেননি, পঞ্চাশ বছর বিবাহিত জীবন যাপন করার পরে পতির তেরো বছর আগেই গুরুপত্নী চলে যান। সুনীতিকুমারের শেষ তেরো বছর  পুত্রবধূ ছায়া চট্টোপাধ্যায়ই তাঁর দেখাশোনা করেন। যখন ১৯৬৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বর সুনীতিকুমার বিদেশে ছিলেন তখন গুরুপত্নীর শরীর খারাপ হয়, বাদলদার জরুরি তার পেয়ে তিনি বাকি ভ্রমণসূচি বাতিল করে বাড়ি ফেরেন, তার দিন দশ-বারো পরেই গুরুপত্নী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমরা তখন যাযাবরের মতো দক্ষিণ কলকাতার এ-পাড়া থেকে ও-পাড়ায় বাসাবদল করে বেড়াচ্ছি, অবশেষে কলকাতা ছেড়ে চলে যাই দার্জিলিংয়ে। দুবছর বাদে ১৯৬৬-র শীতে কলকাতায় এলে তিনি একটি বই দেন – In Memoriam Kamala Deir 1900-1964 A Husband’s Offering of Love and Respect. পত্নীর প্রতি পতির প্রেম ও শ্রদ্ধার এমন নিদর্শন আমি আগে দেখিনি, আজো দেখিনি। সুনীতিকুমার বহু বিখ্যাত গ্রন্থ লিখেছেন, সেসবের যে-তালিকা পাওয়া যায় তাতে এই ছোট বইটির উল্লেখ নেই। কিন্তু আমি মনে করি, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রচনা – অন্তত বাংলার নব-জাগরণের ইতিহাসে তথা আধুনিক ভারতীয় দাম্পত্যের ব্যঞ্জনা অন্বেষণে। তাছাড়া সুনীতিকুমারের ব্যক্তি-চরিত্র ও মানসিকতা বোঝার পক্ষেও এই ছোটো বইটির মূল্য অসীম।

দার্জিলিংয়ের প্রসঙ্গে মনে পড়ল, দার্জিলিংয়ে থাকাকালে আমার হাতে আসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে একটি উপন্যাস, তাতে ছিল জার্মানদের সিগফ্রিড লাইন সম্বন্ধে কিছু কথা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাহিনিতে জার্মান পুরাণের বীরকে কেন টেনে আনা হলো এ-প্রশ্ন তুলে চিঠি লিখি সুনীতিকুমারকে। জবাবে তিনি জানালেন, প্রাচীন জার্মান সাহিত্যে Nibelungenlied নামে এক মহাকাব্য আছে যার রচয়িতার নাম পাওয়া যায় না, কিন্তু এই কাব্যে সিগফ্রিড-ব্রুনহিল্ডের যে-প্রেমকাহিনি আছে তা আধুনিক জার্মানিতে আজো খুব জনপ্রিয়। এক ড্রাগনের রক্তে স্নান করে সিগফ্রিডের দেহ অভেদ্য হয়ে যায়। নিবেলুঙ্গেনলিড যেন সংগ্রহ করে পড়ি – তা বিশ্ব-ক্লাসিকসের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রসঙ্গটা আনলাম ওটা জানাতে যে, তাঁকে চিঠি লিখলেই উত্তর পাওয়া যেত, কাজের বাহানা দিয়ে নিরুত্তর থাকতেন না। খুব ব্যস্ত থাকলে বা নিজে হাতে জবাব দিতে না পারলে সহকারীকে মুখে বলে যেতেন আর তাঁর সহকারী টাইপ করে লিখে দিতেন উত্তরটা। দেশ-বিদেশ ভ্রমণের সময় পিকচার পোস্টকার্ড লিখে পাঠাতেও তিনি ভালোবাসতেন।

পৃথিবীর বহু দেশ তিনি ঘুরেছেন এবং সেসব দেশ থেকে নানা রকম শিল্পকর্ম, নানারকম পোশাক-পরিচ্ছদ, ধর্মানুষ্ঠানের সামগ্রী, মূর্তি বা মুখোশ গেরস্থালি জিনিসপত্র, গয়নাগাটি, স্থানীয় সংস্কৃতির নানা নিদর্শন সংগ্রহ করে আনতেন। বাড়িতে কেউ এলে সেসব সংগৃহীত বস্ত্ত সগর্বে দেখাতেন, সেসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাহিনি সোৎসাহে বলতেন। বিশ্বজুড়ে নানা মানুষের নানা সংস্কৃতি সম্বন্ধে তাঁর ছিল অপরিসীম কৌতূহল। সংস্কৃতির এমন অঙ্গ বা দিকের কথা কল্পনা করা কঠিন যা সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ বা ধারণা কিংবা জ্ঞান ছিল না। কাকে সংস্কৃতি বলে সে বিষয়ে অনেকে অনেক গবেষণা ও গ্রন্থরচনা করেছেন। একদিন সংস্কৃতি নিয়ে বলতে বলতে তিনি বললেন, ‘অনেক রকম জটিল ও পন্ডিতি লেখা হয়েছে, কিন্তু আমাদের রোজকার জীবন থেকে সংস্কৃতির একটা সহজ ব্যাখ্যা হয় – এককালে পশুপাখির মতো মানুষও কাঁচা পাতা ফলমূল, কাঁচা মাছ-মাংস খেত, আস্তে আস্তে আগুনে ঝলসে পুড়িয়ে খেতে শিখল, তারপরে তেল-নুন ঘি-মাখন হলুদ-মশলা ইত্যাদি দিয়ে সুস্বাদু করে সুন্দর করে রেঁধে খেতে শিখল – এই যে কাঁচা জিনিসকে উন্নত করে তোলা, উঁচু মানের জিনিস করে তোলা – পশুর স্তর থেকে মানুষের স্তরে টেনে তোলা – এইভাবে বাঁচার অভ্যেসটাই সংস্কৃতি, ভালোকে আরো ভালো করার সাধনাই সংস্কৃতি।’

রাঁধা ও খাওয়ার ব্যাপার দুটোকে তিনি মানুষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটো ব্যাপার বলে বিশ্বাস করতেন। নিজে ছিলেন একান্ত খাদ্যরসিক। খাদ্যরসিক ও ভোজনবীর এ দুটোর মধ্যে তিনি গভীর ভেদরেখা টানতেন। কোথাকার কোন খাবার বিখ্যাত, জনাইয়ের মনোহরা, পেনেটির গুঁফো, মুর্শিদাবাদের ছানাবড়া, নদীয়ার সরভাজা, দিল্লির ঘণ্টেওয়ালার জিলিপি ও ঝুরিভাজা, লখনৌর খাসির মাংস, ইস্তান্বুল ও এথেন্সের কাবাব ও তার গুণাগুণ, জার্মান ও ইতালিয়ান ও মেক্সিকোর কফির ও কাপুচিনোর পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্য – এসব বিষয়ে তাঁর ছিল যেমন অভিজ্ঞতা তেমনই আপন মতামত। যখন যেখানে যেতেন তখন সেখানের বিশেষ খাবার নিজে খেয়ে পরখ করতেন। খাওয়া নিয়ে আলোচনাতেও ছিল তাঁর বিপুল আগ্রহ। তিনি শুধু খাদ্যরসিক ছিলেন না, সংগীত-রসিকও ছিলেন। বরাবরই তাঁর দৃষ্টিশক্তি দুর্বল ছিল। বার্ধক্যে চোখের সমস্যা বেড়ে যায়, ফলে সন্ধের দিকে লেখাপড়া করতে পারতেন না, প্রাচ্য শাস্ত্রীয়, পাশ্চাত্য ক্লাসিকল, নতুবা রবীন্দ্রসংগীত শুনতেন। রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে প্রিয় ছিল ধ্রুপদাঙ্গ সংগীত। ধ্রুপদের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলাতে কলকাতায় একবার প্লেগের মহামারী হয়, তখন তাঁরা কলকাতা ছেড়ে হাওড়াতে মামাবাড়িতে যান আর মামাবাড়িতে উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রায়ই আসর বসত, বড় বড় ওস্তাদ এসে আসর জমাতেন। সেই যে ধ্রুপদে কান অভ্যস্ত হয়ে গেল তার ফলে পরিণত বয়সেও তিনি ধ্রুপদের ‘কেনা গোলাম’ হয়ে যান। পরবর্তীকালে তানসেনের ওপরে যে-প্রবন্ধটি লেখেন তাতে তাঁর সংগীত সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান ও পরম রসগ্রাহিতার পরিচয় পাওয়া যায়।

সুনীতিকুমার ছিলেন উদার ও মুক্তমনের মানুষ। নির্দ্বিধায় বলতেন, বিশ্বাস-ভক্তি নয়, মানুষের আসল পরিচয় তার বিচারশক্তিতে। বিদ্বানের চাইতে জিজ্ঞাসকের বেশি খাতির ছিল তাঁর কাছে। যে-কোনো বিষয় নিয়েই তাঁকে প্রশ্ন করা যেত। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘একটা সময় আপনি হিন্দু মহাসভাতে যোগ দিয়েছিলেন কেন?’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘আশুতোষ ও শ্যামাপ্রসাদ আমাকে অনেক-অনেক দিয়েছেন, শ্যামাপ্রসাদ যখন আমাকে হিন্দু মহাসভার জন্য কাজ করতে বললেন তখন তাঁকে না বলার ক্ষমতা ছিল না, উচিতও হতো না।’ তাঁর দুটি প্রিয় কথা ছিল। একটি ছিল শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের উক্তি, – ‘গুহ্যং ব্রহ্ম যদিদং তে ব্রবীমি, ন মানুষাচ্ছ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চি?।’ অর্থাৎ তোমাকে একটা গুহ্য কথা জানাই, মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কিছু নেই। অপর প্রিয় কথা ছিল, – ‘বসতে পারলে শোবে না, হাঁটতে পারলে বসবে না, ছুটতে পারলে হাঁটবে না।’ বাদলদার দৌলতে তাঁর দোতলা বাড়ি চারতলা হয়েছিল। শোবার ঘর উঠে গিয়েছিল ওপর তলায়, দোতলার ঘর রূপান্তরিত হয়েছিল বিশাল বসবার ঘরে। মস্ত কার্পেট পেতে সে-ঘরে প্রতি ২৬ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন পালিত হতো। সবার সঙ্গে সুনীতিকুমার মাটিতেই বসতেন এবং যখনই নতুন কোনো অতিথি ঘরে প্রবেশ করতেন তখনই তিনি কিছু না-ধরে বা কিছুতে ভর না-দিয়ে সোজা উঠে দাঁড়াতেন অভ্যাগতকে স্বাগত জানাতে।

আমরা দার্জিলিং থেকে ফেরার পরে আমি পুরোপুরি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে জুটে যাই কলাকুশলী হিসেবে। তখন ইন্ডাস্ট্রির একজন আমাকে বলেন, তিনি সুনীতিকুমারের ওপর একটা বায়োপিক ছবি করতে চান, কাজের জন্য কলাকুশলী হিসেবে আমাকে তো নেবেনই আর সুনীতিকুমারকে রাজি করানোর জন্য আলাদা টাকা দেবেন। আমি যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দিয়েছিলাম এটা সুনীতিকুমারের পছন্দ ছিল না। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁরও কিছু অবদান ছিল। নিউ থিয়েটার্সের ছবি শুরু হতো হাতির মাথার ছবির ওপরে সংস্কৃতে একটি পদ দিয়ে, যার অর্থ ছিল, চলচ্চিত্র জীবিত থাকুক, চলচ্চিত্রের জয় হোক – এই সংস্কৃত পদটি তাঁরই রচনা আর পর্দাতে হাতির মাথার ওপরে পদটি সুরে উচ্চারণ বা আবৃত্তি করতেন পঙ্কজ মল্লিক। সাহস করে একদিন সুনীতিকুমারকে বললাম যে, তাঁর ওপর ছবি করতে চাই।  শুনে তিনি বললেন, ‘আমার ওপর ছবি করে কী হবে?’ যখন বললাম ‘একজন বলেছেন আপনাকে রাজি করাতে পারলে তিনি আলাদা টাকা দেবেন আমাকে’ তখন তিনি হেসে ফেলে, খাটের বাজু চেপে ধরে, হাসতে হাসতে বললেন, ‘আচ্ছা, করো।’ তারপরে আমরা রেকর্ডিংয়ের যন্ত্র এনে (তখনকার দিনে যে-যন্ত্র যথেষ্ট ভারী হতো) তাঁর সাক্ষাৎকার নিলাম। কিন্তু যিনি কথাটা বলেছিলেন তিনি একটা বড় কাজে লেগে যান। এদিকে একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে সুনীতিকুমার চলে গেলেন। তখন আমার বড় শ্যালক শান্তিপ্রসাদ চৌধুরীর সাহায্যে আমি আঠারো মিনিটের যে-ছবি করি তা বহু প্রশংসা পায়, তার দৌলতেই আমি ফিল্ম ডিভিশনের প্যানেলভুক্ত প্রডিউসার হই।

যা হোক, জীবন্ত মানুষ সুনীতিকুমারের কথায় আসি। সেদিন আমি ও আমার স্ত্রী মঞ্জু দুজনে গেছি তাঁর কাছে। কিছুদিন আগে দিল্লিতে গিয়ে রামায়ণ সম্পর্কে তাঁর মৌলিক মতামত পেশ করে এসেছেন। তাঁর প্রদত্ত তত্ত্বে দেশের পন্ডিতসমাজের এক বৃহৎ অংশ প্রচন্ড বিক্ষুব্ধ। অথচ কিছুদিন আগেই ইতালিতে গিয়েছিলেন সংস্কৃত ভাষার ওপর এক আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রে। সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা অনেক সংস্কৃত পন্ডিতের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় এবং তাঁদের কারো কারো সঙ্গে রামায়ণের প্রসঙ্গে কথাও হয় এবং যাঁদের সঙ্গে কথা হয় তাঁদের প্রত্যেকই তাঁকে এ ব্যাপারে আরো গবেষণার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন, কিন্তু ভারতের পন্ডিত সমাজের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের। আমরা গল্প করছি দেখে ছায়াবউদি, তাঁর পুত্রবধূ, ‘বাবা, আমি একটু বেরোচ্ছি’ বলে বাইরে কোথাও গেলেন। অমনই ক্ষুব্ধ ভারতীয় পন্ডিতরা কোথায় হাওয়া! চিরতরুণ সুনীতিকুমার একটা খবরের কাগজ বিছানার ওপর পাততে পাততে দুষ্টু হেসে বলতেন, ‘দাঁড়াও, তোমাদের একটা ভালো জিনিস খাওয়াব, কিন্তু বউমাকে কিছু বলবে না।’ তারপর ঘরের দেয়াল-ঘেঁষা বইয়ের তাক থেকে কয়েকটা বই সরিয়ে আড়াল থেকে বের করলেন একটা বড় মুখের বোতল বা বয়ম, এবার সেটা থেকে বিছানায় পাতা খবরের কাগজের ওপরে ঢাললেন বেশ কিছুটা ডালমুট বা চানাচুর, তাতে মেশানো কাজু বাদাম ও আখরোটের টুকরো আর বেশ কিছু কিসমিস। বললেন, ‘বউমা দেখলেই ডাক্তার দেখাবেন আর ডাক্তার সিগারেট খেতে খেতে কী কী খাওয়া বারণ তার ফিরিস্তি দেবেন। আমিই বা কেন অত ফিরিস্তি শুনব? গুজরাট থেকে একজন আমাকে ওই মিক্সচারটা এনে দিয়েছেন। বউমার নজর থেকে লুকিয়ে রেখেছি।’

রামায়ণ বিতর্ক কিন্তু চলতেই থাকে। দিল্লিতে যে-আলোচনার সূচনা তা পরের বছর হয় কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে। রামচরিতমানসে যাঁদের বিদ্যা সীমাবদ্ধ তাঁরাও তাঁদের কটূক্তির ভান্ডার উজাড় করে দিতে থাকেন সুনীতিকুমারের ওপর। এ-বিষয়ে যুবকের মতো উদ্যম নিয়ে আরো পড়াশোনা আরো গবেষণা করতে গিয়ে তিনি বোঝেন যে, তাঁর দৃষ্টিশক্তি তাঁর সঙ্গে অসহযোগিতা করছে, চোখের ছানি অবিলম্বে কাটানো দরকার। শুনলাম শিগগিরই চোখে অস্ত্রোপচার হবে। সেদিন একাই গেছি। গিয়ে দেখি খাটের পাশে একটা চেয়ারে বসে দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন মগ্নভাবে। আমার সাড়া পেয়ে বললেন, ‘দ্যাখো একবার এখান থেকে বাইরে কী কান্ড হয়েছে।’ তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, জানালাজুড়ে রাশি রাশি লাল কৃষ্ণচূড়া ফুলের সমারোহ আর ফুলে ফুলে কালো ভোমরার ওড়াউড়ি। বললেন, ‘এই আশ্চর্য ঐশ্বর্য কার সৃষ্টি, কেন সৃষ্টি, এই এত বছরেও জানতে পারলাম না, তবু বিস্ময়ে জাগে আমার গান। গানের গলা নেই, তবু বিশ্বের এরকম কান্ড দেখলে বিস্ময়ে গান গাইতেই ইচ্ছে করে।’ কয়েকদিন পরেই অপারেশনের জন্য ভর্তি হলেন বেলভিউ নার্সিং হোমে।

রোজই ফোন করে খবর নিতাম। একদিন বাদলদা জানালেন, বাবা বাড়ি এসেছেন, এবার তিনি নিশ্চিন্তে ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছেন নিজের কাজে। পরদিন সকালে গেলাম সুধর্মাতে। তাঁর প্রিয় খাটে তিনি তখন শুয়েই ছিলেন খোলা জানালা দিয়ে কৃষ্ণচূড়ার শেষবেলার দিকে। একটা বালিশ টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসলেন, কোলের ওপর রাখা বালিশটাতে কনুইয়ে ভর দিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘দাদুভাই কেমন আছে?’ প্রথমেই আমার ছেলের খবর নিয়ে দু-একটা কথার পরে তাঁর ফুর্তি ফিরে এলো। নার্সিংহোমটা সম্বন্ধে বললেন, ‘হাসপাতাল তো নয়, যেন         ফাইভ-স্টার হোটেল – কত দূর পর্যন্ত দেখা যায় ওপরের জানালা দিয়ে। সব পরিষ্কার। এবার অনেক কাজ করতে পারব। চোখের জন্য অনেক বকেয়া কাজ জমে গিয়েছিল, সেগুলো এবার সারতে হবে।’ তাঁকে বেশ উৎফুল্ল দেখলাম।

দু-তিনদিন পরের কথা। সন্ধে আটটা নাগাদ হবে। তখন আমি ফিল্মের দপ্তরে। এডিটিং রুমের ছেলে এসে জানাল, আমার ফোন এসেছে। পাশের ঘরে গিয়ে ফোন ধরলাম। ওপার থেকে ধরা গলায় আমার স্ত্রী জানালেন, ‘মেসোমশায় ফোন করেছিলেন – সুনীতিকুমার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। একটু আগে নাকি রেডিওতে শুনেছেন।’ অন্নদাশঙ্কর রায়কে আমরা মেসোমশায় বলতাম। তিনি তো এমন ঠাট্টা করার মানুষ নন। ঠাট্টাটা ভাগ্যই করেছে। এই সেদিন এবার অনেক কাজ করবেন বলে যাঁকে খুশিতে ভরপুর দেখে এলাম, তিনি এমন আকস্মিকভাবে কী করে চলে গেলেন! মানুষ ভাবে এক, কিন্তু অন্য কিছু হয়। এ-ও এক বিস্ময়!