কানার হাটবাজার

সৈয়দ শামসুল হকKanar Hat

কিছুদিন থেকে এক কিশোর আমাদের সাথ লয়েছে। পাছ ছাড়ালেও সে পাছ ছাড়ে না। আমরা যেখানে যাই, আমরাই তো যাই, সেও যে সাথে আছে ঠিকই ঠিক পাই, পাশ ঘুরলেই দেখি তাকে। মাথায় নারীর মতো লম্বা কেশ, লালিয়া তার রঙ, বুঝি তেল পড়ে নাই বহুদিন, সময়তে বটের ঝুরি ছিঁড়ে তাই দিয়ে বেঁধে কেশ পিঠের পরে গিঁট করে রাখে। কাছে যাও, মুখে বিড়ির তেজালো গন্ধ, গন্ধায় কী কটু, বজবজ করে বাতাসে ভাসে। কিন্তু কখন সে বিড়ি খায় বা খেলো, আমরা দেখি না, চোখে তো পড়ে না। বিড়ির গন্ধে আমাদের ওয়াক ওঠে। আবার চেহারাও দ্যাখো তার – কী চেকনাই! ফুটবল প্লেয়ারের মতো একখানা গোল গলার সবুজিয়া জামা যে তার গায়ে, তার হাতার বাইরে হাত দুখান দ্যাখো – সরু হলেও চামড়ায় রোদ্দুর পড়ে পিছল খায়। মাজা সরু এমন সুন্দর স্বাস্থ্য তার, কিন্তু আমরা দেখি না কখন সে খায়, জানি না কোথায় সে খায়, কে তাকে অন্ন দেয়, স্বাস্থ্য এমন চেকনাই। নামটাও জানা নাই, চ্যাংড়া  বলেই ডাকি আমরা। কোথা থেকে এই চ্যাংড়ার আগমন তারও কোনো নির্ণয় না পাই।

টাউনের লোকেরা তাকে দেখেই অনুমান করে, এই চ্যাংড়া আদতে কুষ্টিয়ার বাউল আখরার, অল্প বয়সে ভোগভাগ ত্যাগ করিয়া বাউলের জীবন! আহা বরদাস্ত হয় নাই। খাঁচা ভাঙি উড়াল দিয়া হেথা আসি বাসা নিছে! – আবার অনেকে চ্যাংড়ার ওই চিকনা শরীর, সরু মাজা, কান্তিভরা মুখ আর নারীর মতো ঝুঁটি বাঁধা কেশ লক্ষ করে বলে – ঘেটু যাত্রার ছোকরায় হইবে, বাড়ি হয়তো যমুনার ওপার ময়মনসিং, রাইত বিরাতে রসিয়াজনের দেহ অত্যাচার সইজ্জ কইরতে না পারিয়া পলায়া আইচ্চে হেথার দূরদ্যাশে! – তা হতেও পারে। আমাদের এলাকারও বদনাম আছে মরদে মরদে কায়কারবারের, কিন্তু আমরা এ- সকলের মধ্যে নাই। কিন্তু এ নিয়েই টাউনে কিছু মানুষ ফিসফাস করতে শুরু করে দেয়, আমাদের কানে আসে। আমরাও চ্যাংড়াকে খেদাবার চেষ্টা করি, কিন্তু সে পিছন লেগেই থাকে। অগত্যা আমরা হাল ছেড়ে দেই। কারণ সময় এখন বড় উতলা। শামসুদ্দিনভাই কয়, আবার বুঝি একাত্তরের মতন একখান যুদ্ধ করা খায়! খায় আমাদের অঞ্চলের মুখচলতি একটা ক্রিয়াপদ, অর্থাৎ কিনা আবার বুঝি একাত্তরের মতো একটা যুদ্ধ করতে হয়!

সেই যে একাত্তর সনে এদেশে যুদ্ধ হয়, তার বর্ণনা আমরা শামসুদ্দিনভাইয়ের কাছে শুনি, তার বাবা কলেজের প্রফেসর মহিউদ্দিন, মাজারে শোয়া বাবা হজরত কুতুবুদ্দিনের সাক্ষাৎ বংশধর মহিউদ্দিন, ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আর সেই যুদ্ধে রাজারহাটের কাছে পাকিস্তানের মিলিটারির সাথে সাক্ষাৎ লড়াইয়ে জীবন যায়, এই এতকাল বাদে সেই যুদ্ধের দালাল রাজাকার আলবদরের মাথা-মাথা কয়টাকে ধরে রাজধানীতে বিচার চলছে এখন। এই সেদিন একজনার ফাঁসির হুকুম পরে এখন ফাঁসির দড়ি রেডি, নগদেই যে-কোনো দিন তাকে ঝোলানো হবে – এই নিয়েই সময় এখন উতলা, কারণ রাজাকারের ঝাড় এতদিনেও বিনাশ হয় নাই, তাদের নতুন চেলারা সারা দেশে জ্বালাও পোড়াও শুরু করে দিয়েছে – এ ফাঁসি হওয়া নয়! – রাজাকার কোনো পাপী নয়! – পাকিস্তানই ছিলো হামার ভালো! – তার তাপ জলেশ্বরীতেও টের পাওয়া যাচ্ছে, এখানেও যে সেই রকমের কিছু খচ্চরের দল আছে।

সেদিন তারা শামসুদ্দিনভাইয়ের বাড়ি লক্ষ্য করে ককটেল মারে, বাজারে গোটা তিনেক মনোহারি দোকানে আগুন দেয়, আর হিন্দু মাঝিপাড়ায় গিয়ে ধমকি দেয় – হয় ইন্ডিয়া যাও কি হেথায় থাকিলে পুতুলপূজা ছাড়ো! দেবি দুর্গা মা কালী তারে কয় পুতুল! বাপোদাদা হামার কতকাল থেকে পুষ্প দিয়া ঘণ্টা বাজায়া ধূপ ধরিয়া পূজা দেয়, ভগমানের পরসাদ পায়, সেই পূজা কি অচল করিতে চান তোমরা! ইয়ারে জইন্যে কি বঙ্গবন্ধু দ্যাশ স্বাধীন করিছিলো? বঙ্গবন্ধু কয় নাই কি হেথায় যার যার ধর্ম তার তার কাছে? শামসুদ্দিনভাই বলে, আমরা মোছলমানও তো এই অপবাদের শিকার! জামাত-শিবিরের দুষ্টগুলা কয়, তোমরা ইন্ডিয়ার দালাল! তোমার বঙ্গবন্ধুর বেটি শ্যাখ হাছিনা ভোটে জিতিবার পর মন্দিরে পূজা দিছে কি দেয় নাই! কইছে কি কয় নাই যে এবার থেকে দ্যাশে আর আজান বাদ হয়া কাঁসর ঘণ্টা বাজিবে! এই ডাহা মিছা কথা আর দুষ্ট অপবাদের ঝড় বাতাস এখন জলেশ্বরীতেও।

অতএব সময় বড় থমথমা উতলা। ওই রাজাকারটার ফাঁসিটা বুঝি এই হয় কি ওই হয়। এ-সময় অচিন এই চ্যাংড়াকে নিয়ে আমাদের ভাবনা নাই যে অপবাদের ঘেটুর ছোকরা নিয়ে আমরা রসে আছি। ইস্টিশানের মিষ্টি দোকানের হানিফভাই বলেন, ভাবিয়া দ্যাখো হে, এও এক চাল চালিছে হামার লোকাল এলাকার দুষ্টগণ, শামসুদ্দিন মিয়া যে রাজাকারের শয়তানি আর জ্বালাও- পোড়াওর বিরুদ্ধে জলেশ্বরীতে রুখি দাঁড়াইতে চায়, তোমরায় তো তার হাতের বল, তোমাদের নিয়াই তো আন্দোলন করিবে তাঁই, এলা যদি তোমাদের কাবু করিতে হয়, টাউনের মানুষের কাছে তোমাদের সুনাম যদি নষ্ট করিতে হয়, তবে ঘেটু চ্যাংড়াকে নিয়া পুটকি মারার দুর্নামটা দিলেই কাম ফতে! বুঝিলেন কি বোঝেন নাই! – অতএব আমরাও আর এসব ফিসফাসে কান রাখি নাই।

তবে চ্যাংড়াকে নিয়ে আমাদের বিস্ময়টাও যায় নাই আজ তিন দিন পরও। কোথা থেকে সে এলো! দিনটা স্পষ্ট আমাদের মনে পড়ে। কিছুদিন থেকে আমরা আধকোশা নদীর পাড়ে বাঁধের ওপর চালার ঘরে কাশেমচাচার চায়ের দোকানে বসছি। জানা আছে কি জানা নাই যে, কাশেমচাচার চায়ের দোকানটা ছিলো ইস্টিশানের রাস্তায়? মনে নাই কি আমরা সেখানে তার নিজের হাতে বানানো ডালপুরিটা কী তোয়াজ করেই না খেতাম! হানিফভাইয়ের মিষ্টির দোকানে তো টেবিল জুড়ে আড্ডা করতাম, সন্ধের দিকে কাশেমচাচার ওখানে চট করে একবার উঠে যেতাম ডালপুরিটার লোভে। আরো স্মরণ করাই – কাশেমচাচার বড়ভাই আমাদের শহরের এক নম্বরের ধনী মানুষ, কিন্তু নিজের ছোটভাই তার গরিবের হদ্দ গরিব, কেন গরিব, কেন ভাই তাকে দেখে না, কেন এতবড় ধনীর ভাইকে চায়ের দোকান দিয়ে পেটের ভাতের জোগাড় করতে হয় – সে বৃত্তান্ত যদি সময় পাই তবে আরেকদিন, কথনের এ- যাত্রায় তার অবকাশ নাই। তবে এতটুকু বলে রাখি, তার সেই ধনীভাইটাও নির্দয়ার এমন নির্দয়া যে ইস্টিশানের দোকান থেকে একদিন তাকে উচ্ছেদ করে দেয় গুন্ডা দিয়ে। তখন কাশেমচাচা নদীর পাড়ে এসে এই চালাঘরটা তুলে চায়ের দোকান বসান।

কাশেমচাচা বলেন, নাহ্, টাউনে আর নয়! জনবিরল হেথায় আমার ভালো! জনের মানুষ তো বহু দেখিলোম! নির্দয়ে দুনিয়া ভরি গেইছে। বুকের রক্তে জমিন ভিজি গেইছে। নমাজ যে পড়েন, নমাজ বাদেই অকাজ করেন! এই আমলে এই তো সংসারের সমুদয় কথা! তাই টাউনে আর নয়, হেথায়! হেথায় আমার সাথি নদীর ঢেউ, নদীর অতলে পুঁটি বুকরঙি খইলসা টাটকিনি আরো আরো বা কত পর্কারের মাছ – তারায় হামার সাথি, আর সাথি খোদাতাল্লার নীল আসমান, আর ওই ওপারের ধু-ধু বালুর চর, কেবল যে নদীর উই বাঁক ঘোড়ার নালের মতন, উয়ার উপরে যে ঝাউয়ের বন – সুইয়ের মতন উয়ার পাতা, সেই পাতায় বাতাসে যখন ফোঁপায় শোসায়, তখন কান্দনটা আসি যায় যে আল্লার দুনিয়া আর আল্লার দুনিয়া নাই! শয়তানেই একালে তার দখল নিছে! তাই নদীর সাথে ঝাউয়ের পাতার সাথে মিতমিতালিতেই টাইম কাটি যায় হামার। নদীর এই বান্ধের উপর এই চালায় বসিয়া খেওয়া পারাপার দ্যাখোঁং, মানুষের কত আগমন পরস্থান দ্যাখোং, কেউ হাসিতে হাসিতে নামিচ্ছে, কাঁইওবা কান্দিতে কান্দিতে খেওয়া ধরি নদীর ওপার যাইচ্ছে। দেখিয়া দেখিয়া একেকখান গল্প ভাসি ওঠে মনে। এই নিয়া নদীর পাড়ে মুঁই ভালোই আছোঁ।

তার এই সজল কথা আমাদের ভিজিয়ে দেয় মায়ায়, আমরা হানিফভাইয়ের মিষ্টির দোকান ছেড়ে আসি, আমরা এখন রোজ বিকেলে কাশেমচাচার চালাঘরে এসে বসি। ডালপুরি খাই, চা খাই, নদীর দিকে তাকিয়ে খেয়া নৌকার পারাপার দেখি। নৌকার যাত্রী আসে-যায়। কাশেমচাচার মতো আমরাও তাকিয়ে দেখি, আনমনেই বা কখন আমরাও তাদের নিয়ে মনে মনে গল্পকথা রচনা করতে থাকি। আর এই মাত্র দিন তিনেক আগেই মনেমন এই গল্পকথার ভেতর থেকেই যেন অচিন চ্যাংড়াটা বেরিয়ে আসে। কিংবা সে-নদীর জল ছিঁড়েই ওঠে। অথবা ওই যে বাঁধের পেছনে ভূতের বাসা শ্যাওড়া গাছটা, তারই ছায়া যেন কায়া ধরে ওঠে চ্যাংড়ার। সে আমাদের সমুখে এসে দাঁড়ায়। দাঁড়ায় কি হঠাৎ তাকে দেখে উঠি, চমকে উঠি আমরা। এর আগে কখনো এই মুখ দেখেছি বলে আমাদের কারো মনে পড়ে না।

তবে শনি-মঙ্গলের হাটে, নিত্যদিনের বাজারে কি খেয়াঘাটে দূরদূরান্ত থেকে কত মানুষই তো আসে, চেনা ও অচেনা আসে, অচেনার ভাগই অধিক, অচেনা তারা অধিক হলেও অচেনা সঠিক নয়, গায়ে তাদের আধকোশা নদীর এপার-ওপার বিশাল মুল্লুক এই জলেশ্বরীরই দশ বিশ মাইলের ঘ্রাণ আমরা পাই, অঞ্চলের ভাষায় তাদের ঠাহর পাই যে অচেনা হয়েও অজানা তারা নয়! কিন্তু এই চ্যাংড়া? এই যে নদীর পাড়ে কাশেমচাচার চা-দোকানের সমুখে হঠাৎ মূর্তিমান খাড়া এইজন! এখনো বাক্য বলে নাই, তবু আন্দাজ হয় ভাষা তার জলেশ্বরীর মতো নয়, কারণ আমরা তার ঘ্রাণে জলেশ্বরীকে পাই নাই।

না, জলেশ্বরীর সে কেউ নয়।

আমরা ঈষৎ সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ি। আমাদের মুখভাবেই প্রশ্নটা ফুটে ওঠে কিনা কে জানে। যেন আমাদের মনেমন প্রশ্নটা আন্দাজ করে উত্তর দিতে সে গান ধরে ওঠে –

পরিচয় কিবা আমার ও ও ও কিবা পরিচয়,

মাটিতে জনমও আমার মাটিতেই লয়!

মানুষেরে জিগ্যাস করো মানুষ ছাড়া কী?

মানুষ বলে এ কী কারবার!

বাক্য নাই জবাব দিবার ­-

দানব দ্যাশে মানুষ বোবা জন্ম লয়াছি!

 

আহাহা কী কথা, কী ভাব। আসমান জমিন মুছে যায় মুহূর্তে, সরব নীরব হয়ে যায়, নদীর ঢেউ থেমে যায়, নদী কান পেতে শোনে। কী চিকন মিষ্টি গলা, নদীর ওপর দিয়ে বহে যায়, দূরদূরান্তে যায়, তবুও মিলায় না স্বর, তবু শোনা যায়। সুরের লহরী আর কথার রহস্যে আমরা আপ্লুত হয়ে যাই। জগৎ আমাদের চারদিকে ছলছল করে ওঠে।

এই ছলছল করা তো শুধু চ্যাংড়ার গানে নয়, আরো আছে, সেদিন আরো ছিলো। আমরা আমাদের প্রাণের বন্ধু উদ্ভ্রান্ত আবুল মনসুরকে ঘিরে বসেছিলাম কাশেমচাচার চায়ের দোকানে। নদীর দিক মুখ খোলা চালাঘর, নদীর দিকেই তো মুখ করে আমরা নিত্য বসি, নদীর হাওয়া খাই। কাশেমচাচার নিপুণ হাতে আটার লেচি পাতলা হয়ে বেলোনচাকিতে গড়ে ওঠে, পোড়া লাল লংকা ডলা সেদ্ধ ডালের পুর তাতে পড়ে, অচিরে শুকনো খোলায় হয়ে ওঠে  রাঙা মচমচে, আমরা খাই। কখনো বা খেয়ার যাত্রী কেউ নৌকার দেরি দেখে আমাদের পাশে বসে পড়ে, কখনোবা দু-একটা কথা হয়, সুখ-দুঃখেরই তো কথা, দুঃখের কথাই অধিক, এমন কথার বিরাম নাই। নদীর বুক থেকে উঠে আসা শীতল হাওয়ায় জগতের তাপ চাপ খানিক মুছে যায়, খানিক বুকে ধরেই মানুষ যে যার বাড়ি ফিরে যায়। শোক তাপ যদি মুছে যায়, তবে সেদিন নদীর শীতল বায়ের সাথে আমাদেরও নীরব হিম বুকের বাতাসও যুক্ত হয়েছিলো মনসুরকে জুড়োবার ইচ্ছায়, কেননা সেদিন বিকেলবেলাতেই সে এক ঘোর দুঃসংবাদ আমাদের দিয়েছিলো।

আহা, তার ছোট বোনটি আত্মহত্যা করেছে!

ঘণ্টাখানেক আগে খবর আসে। তার বাবা-চাচারা রওনা হয়ে গেছেন লাশ আনতে। মনসুর সাথে যায় নাই, মনসুর গেলে মায়ের রক্ষণ কে করবে? জননী যে সংবাদ পায়াই মূর্ছা গেইছে! পাড়ার পড়শি নারীরা এখন তার শিথান ঘিরে বসে আছে। বুকভাঙা মনসুর ছুটতে ছুটতে আমাদের কাছে চলে এসেছে। আমরা তাকে নিয়ে নদীর পাড়ে এসেছি। আহা, নদীর শীতল হাওয়া, নদীর ওপরে নীল আসমান, ওপার ধু-ধু জগৎ, আর মানুষের ওই আসা-যাওয়া, খেয়াঘাট কি মানব জীবনেরই জন্ম-মৃত্যুর ঘাট। মাঝখানে দুই দিনের এক সংসার রচনা করা।

আহা, তোমার বোনের বিয়ে হয়েছিলো না? মান্দারবাড়িতে না শ্বশুরবাড়ি? হাঁ, হাঁ, কাচভাঙা দর্পণের ছবির মতো আমাদের মনে পড়ে যায়। বছরখানেক আগে বিয়েটা হয়, আমরা সবাই বিয়েতে কত আমোদ করেছি, বরের সাথে কনেকে নিয়ে আমাদের কেউ কেউ মান্দারবাড়িতেও গিয়েছিলাম ফিরন যাত্রায় – সবই মনে পড়ে। আহা, কী হয়েছিলো হে? কিসের দুঃখ? কোন দুঃখ? এত দুঃখ যে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ পায় নাই আয়েশা? আহা, আয়েশার টলটলে মুখখানা যে এখনো ভাসে। বোবা হয়ে থাকা আমাদের চোখ যে নদীর দিকে, সেই আধকোশা নদীর বুকে আয়েশার মুখখানা পদ্মের মতো ভাসে এখন ভেসে যায়।

মনসুর বলে, সংসারের কথা তোমাদের বলি নাই। – আহা, ও মনসুর কেন বলো নাই! – সকল কথা তো কওয়া যায় না, বিশেষ যদি ফুলের বনে অগ্নি ধরি যায়! মনসুর বলতে থাকে আমাদের কাছে এতদিন না-বলা সকল কথা। যৌতুকের চাপ! – এই যৌতুকের জন্যে ভাইরে কত নিজ্জাতন করিছে হামার বইনটারে। হারামজাদা তার জামাই দিনের পর দিন কয়, ট্যাকা আনি দে! আরো কয়, তোর রূপ দেখিয়া যে ভুলিছিলোম, গু খাইছিলোম! হরিষালের সোনা মিয়া হামাকে জামাই করিতে চাইছিলো, ট্যাকাও বিস্তর দিবার কথা কইছিলো, ক্যাবল পাত্রী খানিক কালা বলিয়া যে রাজি হঁও নাই, হইলে আইজ হামার টাউনে যায়া বাজারে দোকান খুলিয়া বসিবার জো হইতো। দোকান দিতে দুই লক্ষ ট্যাকা! তুই বাপের বাড়ি হতে আনি দে!

মনসুরের কাছে তার ঘন ঘন ফুঁপিয়েওঠা ধরা গলায় বিবরণ শুনে আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই। জামাইয়ের আবদারের চাপে নাচার হয়ে মনসুরের বাবা জোত বিক্রি করে হাজার পঞ্চাশেক জোগাড় করতে পারেন, তাই নিয়ে  তিনি মেয়ের বাড়ি যান, আশা যে জামাই হয়তো হাজার পঞ্চাশেকেই তুষ্ট হবে। জামাই সে-টাকা নেয় না, রুমালে বাঁধা টাকার গোছ ছুড়ে ফেলে দেয়, বলে – এই ট্যাকায় কী হইবে! একখান বলদগাড়িও করা যাইবে না! এই ট্যাকা ফিরৎ নিয়া যান, আর সাথে সাথে আপনার বেটিকেও নিয়া যান, তাল্লাকের চিঠি পাছে পাছে পাঠেয়া দেমো! – এ-কথা শুনে জামাইয়ের পা ধরেছিলেন শ্বশুর – না বাবা, এমন কথা না কন, আল্লা-রসুলের দোহাই, পুষ্পের মতন বেটিকে হামার ছাড়ি না দেন!

তালাকের কথা শুনেই আয়েশা ক্রন্দন করে উঠেছিলো, শাশুড়ি তখন চুলের মুঠি ধরে তাকে উঠানে ফেলে দিয়েছিলো, আর ওদিকে শ্বশুরের গায়ে লাথি মেরেছিলো হারামজাদা জামাই। লাথির চোটে দাওয়ায় ফেলে দিয়ে শয়তানের বাচ্চা বলে ওঠে, পুষ্পের মতন! অ্যাতো যদি মায়া তবে পুষ্পের মতন তোমার বেটিকে নিয়া বেটির সাথে চোদন করো যায়া! – আহাহা, এ-বিবরণ শুনে আমাদের চোখের সমুখে যে জগৎ – ধসে পড়ে, বসে পড়ে, বনের বৃক্ষে পাখির বাসা ভেঙে যায়। সে-রাতেই ঘরের বাতায় শাড়ি পেঁচিয়ে আয়েশা তার জীবন দেয়।

এইকালে চ্যাংড়ার উদয় আমাদের সকাশে। আধকোশার জল কি চোখের পানির ঢল ফুড়ে সে ওঠে কি ভুতের বাসা শ্যাওড়া গাছের ছায়াটাই কায়া ধরে ওঠে, কায়া ধরে গান করে ওঠে –

মানুষ বলে এ কী কারবার!

বাক্য নাই জবাব দিবার –

দানব দ্যাশে মানুষ বোবা জন্ম লয়াছি!

 

গান থেমে যায়, গানের কথা নদীর জলে আর আসমানে আছড়ায়, থামে না তো থামেই না, চ্যাংড়ার চোখ থেকে চকচক আলোটাও মুছে যায় না, সে আমাদের দিকে রহস্যের হাসিভরা মুখখানা মেলে ধরে অপলক চেয়ে থাকে। দিনের আলো রাঙা হয়ে পড়ে, নদীর পানি মরা রক্তের মতো কালচে ধরে ওঠে, খোদার আসমানে ফেরেশতার চোখের পানির মতো এক ফোঁটা একটা তারা ওঠে। আমরা পুবের দূর গারো পাহাড়ের মতো চেপে ধরা বুক নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরি। চ্যাংড়াও আমাদের সাথ লয়।

এতকাল নদীর পাড় থেকে হাই ইশকুলের কাছ বরাবর এসে যে যার বাড়ির পথ নিতাম, আজ এক যোগে হাঁটতে থাকি সড়কে সড়কে, যেন আমাদের বাড়িঘর নাই, যেন মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে এমনই আমরা অন্ধকারের মাথায় ওই এক ফোঁটা টলটলে তারাটিকে নিয়ে হাঁটছি তো হেঁটেই চলেছি। আজ তিনদিন পার, আয়েশার লাশ আনতে যে তার বাপ-চাচা যায়, লাশ তারা পায় না, পুলিশ আটক করে রাখে – নাকি লাশ কাটা হবে, তবে পাবে পরিবার। কিন্তু ডোম এখনো পাওয়া যায় নাই, লাশকাটা ঘরে আয়েশা এখনো শুয়ে আছে, যে-ডোম ছিলো জামাত-শিবিরের তাড়া খাওয়ার আগেই সে নিরুদ্দেশে কি হরিষালের বর্ডার পার হয়ে চলে গেছে ইন্ডিয়ায়।

লাশ মান্দারবাড়ি থেকে আধকোশা পার হয়ে জলেশ্বরীর সদর হাসপাতালে আসে। পুলিশ পাহারায় গরুর গাড়ির মাচানের ওপর বাঁশের চাটাই মোড়া আয়েশা আসে তার বাপের বাড়ি জলেশ্বরী টাউনে। আজ তিনদিন লাশকাটা ঘরে আয়েশা শুয়ে আছে ডোমের অপেক্ষায়। ডোমের অপেক্ষায় নাকি মাটির মায়ায় সে পড়ে আছে আর ক্রমেই তার দেহ ফুলছে পচন লেগে। বুঝি আয়েশা এই মাটির মায়া, এই জলেশ্বরীর মায়া, বাপ মা ভাইয়ের মায়া, বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত নিজের হাতে যত্ন করা কাজলি গাইটার মায়া সে ছাড়তে পারে নাই, তাই এখনো শুয়ে আছে। – মুই যাঁও, কাজলিটার যতন করিও মাও গো, ভাইটাকে না বকিও বাপ গো, আর মোর গেন্দা ফুলের ঝাড়টা না কাটিও তোমার কাস্তের ধারে হে কিষান চাচা, পুষ্প হয়া রোজ বিহানে ফুটিবো আমি, হলুদে হলুদে চন্দন করি দেমো সব, যাই গো।

আজ তিনদিন, ডোম পাওয়া যায় নাই, শোনাশোন আরো কথা – ডোম কাটিয়া সারিলেও ডাক্তারের সিলমোহর পত্র পাইতে ট্যাকার খরচ আছে! ফির ট্যাকা? এই ট্যাকার জইন্যেই তো মোর বেটি! আহ! আহ! ট্যাকায় কি দুনিয়া সচল, মনসুর? ট্যাকা না থাকিলেই কি দুনিয়া অচল? ট্যাকা না খরচ করিলে কি মুর্দার মাটিও নাই মাটিতে? খোদা, হামাক কিছু ট্যাকা মরণকালে সাথে দিবেন গো, কাঁই জানে হাশরের মাঠেও বা ট্যাকা খরচ করা লাগে খোদা তোমার বেহেশতে যাইতে!

সড়কে সড়কে আজ তিন দিন আমরা হাঁটছি, বাড়ি থেকে বাবা কুতুবুদ্দিনের মাজার, মাজারে দাঁড়িয়ে বোবা কিছুক্ষণ, দোয়া- দরুদ আজান-নামাজ মিলাদের স্বর, কানে কিছু যায় না, মাথার ওপর দিয়ে কাক কা-কা করে ডেকে উড়ে যায়, লোবানের গন্ধ ভাসে, হাত আমাদের মোনাজাতে ওঠে না, নির্দয়া গো দুনিয়া – কাশেমচাচা বলেন, মাজার থেকে বাঁশবনের মধ্যে লাশকাটা ঘরের পাশ ঘুরে আমরা নদীর পাড়ে কাশেমচাচার চালায় আসি, আমাদের পেছন পেছন অচিন সেই চ্যাংড়াও আছে সে আসে। কিসের আশায় বা কোনো কারণে সে আমাদের পাছ ছাড়ে না, বুঝি না। বোঝার চেষ্টাও করি না। আয়েশার মৃত্যুর পর তেমন মন আর আমাদের নাই। আমরা ভাঙা মানুষ। আমরা হাঁটছি। কখন রাত হয়ে গেছে, ঘন অন্ধকারে মুখ ঢেকেছে আসমান জমিন, হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আমরা বিলাপ শুনে উঠি।

এ-বিলাপ আর কোথাও, না আমাদের বুকের ভেতরে? আমরা কান পাতি। কিছু লোকজনকে আমরা কুঞ্জবাবুর বাড়ির দিকে যেতে দেখি। আর দেখি কাঁধের ওপর বাঁশের বাঁকে ঘৃতের ভাঁড় ঝুলিয়ে ঘোষপাড়া থেকে পরপর তিনজন কুলি বাড়িতে ঢুকছে। ক্রমে স্পষ্ট হয়, বিলাপের কান্নাটা কুঞ্জবাবুর বাড়ি থেকেই। আহা, সে-বাড়ির বাংলাঘরের টিনের ছাদের সে যে কী শোভা – আমরা জন্মাবধি দেখে আসছি – ঢালু ছাদের সবটা জুড়ে সবুজ পাতা আর লাল টুকটুকে মরিচের মতো ফুল ফুটে থাকে বারো মাস। হাজারবার দেখার পরেও পথিক পথ চলতে চলতে একটিবার নয়ন তুলে একবার দেখে লয়। আজ সেই ফুলের বাড়ি থেকে বিলাপ কেন?

কুঞ্জবাবু মারা গেছেন! আজ বিকেলেই তিনি ভবপারে চলে গেছেন।

আমরা যে থমকে দাঁড়িয়েছি, আমাদের অবাক হবার কী আছে। বয়স তো তার নববই কি একশই! তবু আমরা সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ি ভিড় করা মানুষের মুখে সংবাদটা শুনে। টাউনের মানুষের মুখে কুঞ্জবাবু তো শুধু কুঞ্জবাবু নয় – কঞ্জুষ কুঞ্জবাবু! কী তাঁর নামের মাহাত্ম্য, নাম করলে হাঁড়ি ফাটে, কাজে বেরুবার মুখে কানে নাম পড়লে – দিন হয় অযাত্রার অযাত্রা। হাটের দিনে এক- দেড় মণ ধান নিয়ে কুঞ্জবাবুর কারবার শুরু সেই কোন বিস্মরণকালে, তারপর এখন তাঁর তিন তিনটে গুদাম, আরো আছে কাঠের ফার্নিচারের একচেটিয়া কারবার জলেশ্বরীতে, তদুপরি নম্বরী সিগারেটের সোল এজেন্ট এ-তল্লাটে, আরো বা কত কি! এইভাবে কারবার বাড়তে বাড়তে, টাকা উপায় করতে করতে. এখন কোটিপতিই বা! থুত্থুরে বুড়ো হয়েছেন, তবু টাকা করার খাঁই তাঁর মেটে নাই, এখনো কারবারের দিকে তাঁর খর চোখ, এখনো লাঠিভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গুদামে যান। তবে, অনেকদিন থেকেই কারবারের ভার তাঁর ছেলে নিতাই সাহার ওপর, নিতাইবাবুও প্রায় বুড়োই এখন কিন্তু শরীরের গঠনে ভারি মজবুত, সহজে তাঁর দিন ফুরাবে না, বাপের মতোই শতবর্ষী হবেন বলে তাঁর নিজেরও আশা।

তবে জোয়ান ছেলের বাপ হয়েও নিতাইবাবু এই বয়সেও বাপের কাছে ধমক খান। টাউনের সবাই কতবার এ-দৃশ্য দেখেছে – হাতের লাঠি তুলে কুঞ্জবাবু তার বুড়ো ছেলেকে তাড়া করছেন আর বলছেন, ট্যাকার কি মায়া নাই তোর? লক্ষ্মী! লক্ষ্মী! আর এক পাইসাও যদি বাজে খরচ দেখি তোর, লাঠি দিয়া তোর মাথা ভাঙিমো! – আর, একদিন তো এমন হলো বাপের নিত্যকার এ- কথা শুনে ব্যাটা খ্যালখ্যাল করে হাসছে আর বলছে, আচ্ছা আচ্ছা পরতিগ্যা করিলোম তোমার চিতার কাঠের বেলাতেও না এক পাইসা বাজে খরচ করিমো, বন হতে মাগনা কাঠ আনিয়া তোমাকে  পোড়ামো! – তাই শুনে বাপ বাড়িয়ে দেয় পা আর বলে, তবে চরণ ধরি পরতিগ্যা কর চিতাকালে এক পাইসাও না বাজে খরচ হইবে।

সারা টাউনে কুঞ্জবাবু আর তাঁর ছেলে নিতাইবাবুকে নিয়ে একটাই মজার ছবির প্রচার – লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হয়েও কুঞ্জবাবু এখনো পরেন শস্তা হলদেটে একখান ধুতি যার নামতি হাঁটু পর্যন্ত যায় কি যায় না, গায়েও ওই হলদেটেই শস্তা ফতুয়া, গলায় তামার মাদুলি; আর ওদিকে তাঁর ছেলে নিতাইবাবুর পরনে চওড়া সোনালি পাড়অলা ফিনফিনে পাতলা ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবি, গলায় সোনার মোটা চেন, আর দুই হাতের আঙুলে পাঁচ পাঁচটা ইয়া বড় আঙটি, সবুজ লাল পাথর তাতে ঝিলকায়। কুঞ্জবাবু নিজেই চেয়ে চেয়ে দেখেন আর লোক দেখলে শীর্ণ আঙুল তুলে বলেন – ওই দ্যাখো না কেনে, বাপে শাকভাত খায়া ট্যাকা করে, আর ব্যাটা ঘি ভাত খায়া উড়ায়। নিতাইবাবু বলেন, বাবা, তুমি এমন দরিদ্র সাজিয়া না থাকো, আমার বড় বদনাম করে মানুষ।

কিন্তু মুখে বললেও নিতাইবাবুও কঞ্জুষির ব্যাপারে কম যান না, নিজের দেহ সাজাতে বাবুগিরিটা করেন বটে, অন্য খাতে বাপের মতোই হাতের মুঠো তার গোটানোই থাকে। বাড়ির দুয়ারে হাত পেতে কেউ ভিক্ষা পেয়েছে নিতাইবাবুর কাছে, এমন কখনো দেখা যায় নাই, বরং ফকির ভিক্ষুক অভাবীজন তার সীমানা থেকে শত হাত দূরেই থাকে, কারণ লাঠি মেরে খেদাবার জন্যে তাঁর চাকরও খাড়া আছে। এক বেলা তার বাড়িতে নিমন্ত্রণের রন্ধন হয়েছে এমন সংবাদ বা ব্যঞ্জনের ঘ্রাণ জলেশ্বরীতে কোনোকালে পাওয়া যায় নাই। এমনকি নিজের বউ যে নিজের বউ বড়লোকের বউ, তার পরনেও শস্তার শাড়ি ভিন্ন তিনি ওঠান নাই, নিতাইগিন্নির হাতে সোনায় বাঁধা শাঁখা ভিন্ন আর কোনো অলংকার অন্তত আমরা দেখি নাই। অতএব ওই যে তিনি বলেছিলেন বাপের দেহ সৎকারে মাগনা কাঠ বন থেকে এনে দাহ করাবেন, তাঁর এ-কথা কেউ কথার কথা বলে মনে করে নাই।

কুঞ্জবাবুর বাড়ির ভেতর থেকে নারী-পুরুষের সেই কান্নার শব্দের সাথে আমাদের বিলাপ মিলে যায় না, যার যার শোক তার তার কাছে। সবার শোক যদি একসাথে মিলেছিলো তবে সেটা সেই তখন একাত্তরে যখন পাকিস্তান তার মিলিটারি নিয়ে এদেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আর নয় মাসে তিরিশ লক্ষ মানুষ খুন করেছিলো। শামসুদ্দিনভাই বলে, আইজ যদি কোটি মানুষের মনের আগুনও এক হইতো রে! তবে এই দ্যাশে রাজাকার একজনার ফাঁসির খবরে শয়তানের দল জ্বালাও-পোড়াও করিবার সাহস না পাইতো, কোটি মানুষের আগুনে তারাই দগ্ধ হয়া যাইতো!

কুঞ্জবাবুর বাড়ির সড়কে জমায়েত লোকজনের মধ্যে – কতকাল আর পরের বাড়ির মৃত্যু নিয়ে বোবা হয়ে থাকা যায়! – দেশের কথাও হয়, রাজাকারের ফাঁসির কথাও আলোচনায় আসে, কুঞ্জবাবুর কঞ্জুষতার গল্প নিয়ে হাসাহাসিও হয়, তাঁর ব্যাটা নিতাইবাবুরও মুঠিবন্ধ হাতেরও খোশগল্পে ভিড়ের মানুষ মেতে ওঠে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবই আমরা শুনি, কিন্তু যোগ দেই না। চ্যাংড়াও শোনে, তার চোখের মণি অন্ধকারে চকচকে থেকে আরো চকচকে হতে থাকে। আমরা তার দিকে অতটা লক্ষ করি না। এরই মধ্যে হঠাৎ মোটরসাইকেলের ভাঁ ভাঁ ঝাঁ ঝাঁ গর্জন শোনা যায়। কী? না, নিতাইবাবুর ছেলে অর্জুন সাহা বেরিয়েছে মোটরসাইকেল নিয়ে, স্টার্ট দিচ্ছে। কী? না, শোনা গেলো অর্জুন সাহা এখন রংপুর রওনা হচ্ছে। হঠাৎ রংপুর? ঠাকুরদার সৎকার নগদ, এর মধ্যে নাতির এখনই রংপুর যাওয়া কেন?

মানুষের কৌতূহল! আমরাও ঈষৎ কৌতূহলী হয়ে পড়ি। তাকিয়ে দেখি অর্জুন সাহা মোটরসাইকেলের ওপর চেপে বসে ওই বেরুলো। তারপর ধাঁ করে কয়েক পলকের জন্যে রাতের সড়ক হেডলাইটের তীব্র শাদা আলোয় ছিঁড়ে ফেলে অর্জুন সাহার মোটরসাইকেল তীরের বেগে ওই ছুটে মিলিয়ে গেলো। আহত রাতটা পলকেই তার অন্ধকারের কম্বলটা দ্রুত টেনে নেয়। আমরাও একটু একটু করে কুঞ্জবাবুর বাড়ির কাছে ঘেঁষে যাই। তৎক্ষণাৎ বাড়ির বাইরে ইলেকট্রিকের আলো আমাদের টের পেয়েই যেন ফটাফট জ্বলে উঠলো।

সমুখের মাঠ আলোয় ভেসে যায়। অচিরে দেখা যায় নিতাইবাবুকে। তিনি এসে বারান্দায় ওই দাঁড়ালেন। ওই তাঁর গলায় সোনার চেন, হাতে আঙটি, সোনার পাড়ের মিহি ধুতি, পায়ের পাম্পশুটাও ঝাঁ-চকচক করছে। মাঠ আর সড়কের ওপর ভিড় করা মানুষজনের দিকে লক্ষ করে ওই তিনি হাত জোড় করলেন।  তারপর খুব শান্ত গম্ভীর গলায় ভাষণ দেবার স্বরে বলতে লাগলেন, বাবার দেহান্ত হইছে, হরির নাম করিতে করিতে তাঁই ভগমানের কাছে চলি গেইছে, চন্দনের কাঠ রংপুরে পাওয়া যায়। অর্জুন রওনা হয়া গেইলো চন্দনের কাঠ জোগাড় করিতে। ঘৃতের ভাঁড় আসিবার ধরিছে, তাও আধমণই লাগিবে, দেখি কতকক্ষণে পুরা হয়। তোমরা এলা যাও। কাইল দুফরের আগে তো রংপুর হতে চন্দন আসিয়া পেঁছিবে না। তার বাদে চিতা। শ্মশানঘাটে তখন আসিও। এখন ভিড় করিয়া শোকের বাড়ি না ভার করেন তোমরা।

তাহলে বনের মাগনা কাঠ নয়, চন্দনের কাঠ! আর, মানুষজন যে বলাবলি করতো, কুঞ্জবাবুর দীনদরিদ্র ধুতি ফতুয়া তার ব্যাটার কারণেই, ব্যাটাও যে বাপের বেলাতেও হাত টান করিয়াই রাখিতো, বাহে! – এখন ঘৃত চন্দনের কথা শুনে একজন কেউ বলে ওঠে আমরা শুনতে পাই – বাঁচি থাইকতে দিছে তিতপুঁটি, আর মরি গেইলে দিবে গোস্তরুটি! – এই নিয়ে হাসির সে কী হুল্লোড় পড়ে যায় ভিড়ের মধ্যে। একজন কে তাড়া দিয়ে বলে, কন বাহে আর একবার শোলোকটা কন। – তারপর আস্তে আস্তে মানুষজন সরে যেতে থাকে, ভিড় পাতলা হয়ে আসতে থাকে, যেতে যেতে পথের বাজারি মানুষের জিহবা থেকে বিস্ময়ের আওয়াজ উড়তে থাকে – চন্দনের কাঠ! ঘৃতের ভাঁড়! কুঞ্জবাবু শুনিলে মরার খাট হতে ফাল দিয়া উঠিতো!

বিস্ময়ের আরো বাকি ছিলো, দুইদিন পরে পথে নিতাইবাবুকে দেখে আমরা চিনতেই পারি না। এই মানুষ! সেই মানুষ? এ কী বেশ তার? ময়লা কোড়া সাধারণ ধুতি হাঁটু পর্যন্ত, গলায় নাই সোনার চেন, হাতে নাই একটাও আঙটি, পায়ে নাই পাম্পশু, একেবারে খালি পা, বগলে গোটো করে ধরা চিটা বাঁশের বসার একখান আসন। নিতাইবাবু জলেশ্বরীর বাজার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন মাটির দিকে চোখ রেখে। পিতৃদশা চলছে তাঁর। আহা, বাপ বলে কথা, বাপ চলে গেছে, অনাথ এখন! দেখে লোকের উদাস হয়ে যাওয়ারই কথা, উদাস তারা হয়, কিন্তু নিতাইবাবুর কথা ভেবে নয়, কেন এ উদাস বাতাস তাদের মনটাকে ভারি করে তোলে তা নির্ণয় করার মতো মন এখন আমাদের নাই।

আয়েশার লাশ এখনো পড়ে আছে লাল ইটের লাশকাটা ঘরে। বাবা কুতুবুদ্দিনের মাজার ঘুরে আমরা আধকোশার পাড়ে কাশেমচাচার চালাঘরের চা দোকানে এসে যাই। ডোম পাওয়া যায় নাই, হাসপাতালের এক পুরুষ নার্স লাশ কাটতে রাজি হয়েছে, তবে তার আগাম টাকা আর ডাক্তারের খরচ এখনো জোগাড় করা যায় নাই। টাকা! টাকা! হা টাকা! আমরা রব শুনি। আমরা কাতর হয়ে বসে থাকি। এক সময় হঠাৎ আমরা জেগে উঠি। নদীর পাড়ে খেয়াঘাটে রব শুনে আমাদের ঘোর ভাঙে। ওপার থেকে খেয়া নৌকায় আসা এক দল হুজুরের আওয়াজ শুনি – বিচার আমরা মানি না! ফাঁসির রায় মানি না! – আমরা উঠে দাঁড়াই।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে সমস্বরে আওয়াজ দিতে দিতে ওই ওরা নৌকা থেকে লাফিয়ে নামছে, শহরে ঢুকে পড়বার জন্যে হুড়োহুড়ি করছে। আমরা অবাক হয়ে ভাবি, একাত্তর কি এরা ভুলে গেছে? একাত্তরে তো বাংলাদেশে এমন একটিও পরিবার ছিলো না যার কিছু না কিছু ক্ষতি হয়েছে পাকিস্তানের মিলিটারির তান্ডবে – আপনজন খুন হয়েছে, বাড়ি পুড়েছে, বাড়িছাড়া হতে হয়েছে, নারীর ইজ্জত গেছে, মায়ের কোল খালি হয়েছে – কিছুই কি এদের জানা নাই? কিছুই কি শোনে নাই? দেখে নাই?

ঠিক তখনই আরেক রব আমরা শুনতে পাই। আজ কয়দিন থেকে ছায়ার মতো সাথ লওয়া, কয়দিনের এত ঘটনার সাক্ষী থাকা সেই অচিন চ্যাংড়া গেয়ে উঠেছে – চমকে তাকাই তার দিকে, চোখে তার বিষণ্ণ করুণ বিদ্রূপের ছটা – গলা তার ছড়িয়ে পড়ছে আধকোশার এপার ওপার ব্যেপে –

এসব দেখি কানার হাটবাজার।

বারবার সে এই একটি পদই গাইতে থাকে, এই একটি পদই সে হাসপাতালের সমুখ দিয়ে গাইতে গাইতে যায়, কুঞ্জবাবুর বাড়ির পথ দিয়ে চলতে চলতে গায়, কাশেমচাচার বড়ভাইয়ের  পাকা বাড়ির সমুখের মাঠে গায়, গাইতে গাইতে কোথায় সে  একদিন উধাও হয়ে যায়, আর আমরা তাকে দেখি না, কিন্তু তখনো তার ওই একটিই পদ জলেশ্বরীর আকাশ বাতাসে ভাসতে থাকে।

বোধ করি সে কানার হাটবাজার থেকে বেরিয়ে যাবার ইচ্ছায় পৃথিবীর পথে আবার তার পা রাখে