কামাল চৌধুরী : কাব্যপাঠের সূত্র

শহীদ ইকবাল

নান্দনিক ঐশ্বর্যে চকিত পড়ে নিই, কবি কামাল চৌধুরীকে। জন্ম ১৯৫৭। ‘Pure Experience’-এ ভরা তাঁর এনিকডৌট। সেই বেশ আগে, মিছিলের সমান বয়সী পড়ে তাঁকে জড়িয়ে ফেলি সিনেসথেসিক-প্রবাহে। বোধ, ইন্দ্রিয়জ কারুকর্ম যা প্রকৃতির পলাতকা ছায়ায় পালটায়, গড়ে ওঠে; কিংবা এক অনুরাগে সন্ত বশীভূত না হয়ে অন্যতে পৌঁছায়, দোলা লাগায় কিংবা অনুভব থেকে গন্ধানুরাগে স্ফটিকস্বচ্ছতা পায়, স্থির হয়। অধিকতর সমারোহে তিনি তখন বিপুল স্নেহ-সন্তপ্ততা অর্জন করেন – ফলে অপার শ্রেয়ো-শৃন্বন্তু রূপে তখন কালের শকট পাশ ফেরায়। কবি এলিয়ট এজন্য ওইরূপ কবিতাকে বলেছেন ‘বহিরাশ্রয়ী-সংশ্লেষ’ – যা ‘objective correlative’রূপে প্রতিশ্রম্নত। এ-সূত্রে কামাল চৌধুরী নাগরিক মনোজগতের বিচিত্র বিষয়, সূক্ষ্মতর সুকুমার অনুভূতি, মধ্যবিত্তের প্রেম-নৈরাশ্য-গস্নানি; রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের শর্ত, রাষ্ট্রীয় শাসন-অনুশাসন – যা ‘Accumulation of detail’ ও ‘By the sharpness of selected detail’ শব্দবন্ধে পরিগণন করেন। তাই তো বলি ‘The concentration and intensit’-এর কথা, যেখানে উদ্দেশ্যশীল ছন্দোময় ভাষার নিশ্চয়তা পুনর্গঠিত হয়। আর সে-অবকাশটুকুর বিস্তারণ নিয়ে নির্বাচিত কাব্যরূপ সম্মোহন-উৎসব অর্জন করে।

 

দুই

নির্বাচনটি কীভাবে হয়! কঠিন কাজ। ‘জন্মের প্রার্থনা’ থেকে ‘তোমার অক্ষর’ পর্যন্ত। এই যাত্রারথে বিপুল সমারোহ আছে, ছোট-বড়-তুচ্ছ-উচ্চ-অনুচ্চ অনেক। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, স্বদেশ-বিদেশও। করোটিতে পড়েছে জ্ঞান, আধুনিক পয়ারে, সৃজ্যমান চরণ – সাহসী জননীর স্বাদ, বসতি নজরুল ও রবিঠাকুরে – কখনোবা মুক্তিযুদ্ধে বা হাসান হাফিজুর রহমানের ছায়ায়; কিন্তু বীর তো কর্মোন্মাদ! সে হাঁটার পথেও ছুঁয়ে নেয় অঞ্জলি। অর্ঘ্য। লেপ্টে যায় তাই একুশ-মুক্তিযুদ্ধ-মুজিব-শহীদ জননী পর্যন্ত। আরো অধিক সত্তাতাত্ত্বিক স্থাপনা ‘পিতা’ অতঃপর দ্বিতীয় সত্তায় রূপায়িত ‘জাতির পিতা’। এসব একলব্যময় হলে টুঙ্গিপাড়া থেকে বত্রিশ নম্বর – এক অডিসি ভ্রমণ; ঠিক টেলেমেকাসের মতো। এতদুপলক্ষেই পড়ে নিই কবির ধ্রম্নপদী চরণগুচ্ছ :

আমি সেদিন বলব

সমস্ত প্রার্থনা আজ শেষ হয়েছে

জন্মের ঋণ আমি স্বীকার করছি।

কিংবা,

জীবনানন্দের কবিতার মতো

ধলেশ্বরী, তোমার স্পর্শের স্মৃতি

জলে ভেসে সমস্ত বাংলাদেশ হবে –

 

তিনটি যুবক যাবে জলে ভেসে সারা বাঙলায়।

এবং,

তখন রেসকোর্স মানে স্বাধীনতা

তখন রেসকোর্স মানে সার্বভৌম জাতির পতাকা

তখন রেসকোর্স মানে বিজয়ের উৎসব।

…   …   …

 

আমরা হারিনি। এই দৃশ্য বিজয়ী জাতির।

কবি কামাল চৌধুরীর ধ্রম্নববাক্য (refrain) রূপে চূড়ান্ত ইতিহাস লেখা নতুন না হলেও, নির্বাচিত কবিতা গ্রন্থটিতে একপ্রকার আবশ্যিকতা তৈরি হয়। সেটি অনেক কিছুর ভেতর দিয়ে। কুখ্যাত নিয়াজি পেরিয়ে আমাদের জয়োলস্নাসময় হর্ষস্বাদ করতলে বন্দিশ নীলাকাশের রাগ ছড়ায়। এজন্য প্রকরণে ‘Rhythmical language, figures of speech, stories and dramatic situations, and so on…’ এমন শর্তসমূহ প্রকোষ্ঠে গরিমা প্রকাশ করে, শৈলীতে বাধা পড়ে। চলতি সমাজ – ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ইমেজে পঙ্ক্তিমালার বিরচনে একধরনের টেক্সচার বা ফ্লেভার ছড়ায়; কবিতার কাব্যগুণে যা আনন্দদায়ী ও প্রসন্ন-বিহবলতায় উল্লাসপ্রবণ। কাতর বাংলাদেশ, শামসুর রাহমানের ‘বনপোড়া হরিণীর মতো যে কুঁকড়ে আছে’, বিপরীতে ঠিক অন্যটি সুন্দর দেশপ্রত্যাশী সংগ্রামী শহিদান। একছন্দে, একতালে রচিত এ-প্রত্যয় – কবিব্যক্তিত্ব সেখানে প্রবল। সময় ব্যবধানে কবির প্রত্যয়, দীপ্তদৃষ্টির রদবদল কম। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে কবির স্পর্শকাতরতাও প্রচ্ছন্ন। পুনরাবৃত্তি নয়, ভেতর-প্রণোদনায় অপ্রকাশিত ক্লান্তি হয়তো তাঁকে দগ্ধ করে; তবে দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্ব এতটুকু চ্যুত নয়। সময়ের ফারাকে কবিকে আলাদা করা যাবে না। যে-কবি স্বতঃপ্রণোদিত, প্রতিনিয়ত যিনি রচনার টানে তপ্ত – সেখানে ভালো-মন্দের চেয়ে wisdom-টাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো : ‘The poetry is never solely with the presentation of a picture of ‘the turning world’: the spiritual undertones are always present. But what most distinguishes the early from the later poetry is that in the former the streets, the houses, the music, the routine affairs of the people overlay the spiritual considerations and are essential to their communication।’ কবিপ্রসিদ্ধিটি ধরা পড়ে, ধারাবাহিক এ-চেতনা ক্রমশ সম্মুখপানে এগিয়ে গেলে। সমস্তরকম শব্দে বোধ আক্রান্ত হলে সেখানে পুনর্গঠিত চিত্রকল্প নিজের মতোন গড়ে ওঠে। বস্ত্তত তাতে ‘placing his picture of the turning world in the perspective of history and traditional faiths’ – এতে কামাল চৌধুরী ওই মাপে প্রতিষ্ঠা না পেলেও তাঁর উপলব্ধিতেই বলা যায় :

অনেক দূর অতীত চেনা পথ

অনেক দূরে বৃষ্টিভেজা গ্রাম

ছাতা মাথায় বাড়ি ফেরার মুখ

আজও শুধায়, ‘কী যেন তার নাম’।

তবে কবিতার এ-কাঠামোটি প্রায়শ বজায় থাকে না। মাঝে মাঝে প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় উৎকর্ণ হয়ে পড়েন কবি। পিছিয়ে যায় তাঁর ‘ঊর্ধ্বারোহণ’। আবার ঝলসে ওঠে ‘নস্টালজিক শোকগাথা’। বিস্তরতায় দানা বাঁধে দীপাবলি। চরিত্র গড়ে ওঠে। আশাবাদ প্রতিশ্রম্নত হয়। স্বদেশের ভালোবাসায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি। তাতেই তাঁর সমর্পণ, প্রতিষ্ঠা। এর ব্যত্যয়ের কারণ খোঁজেন, বিদ্রূপে আওড়ান, নস্টালজিক হয়ে ওঠেন, সভ্যতার গস্নানি নিয়ে বোঝাপড়ায় লিপ্ত হন। তাতে কবিতা ‘chief interest’-এ আটকায়। এ-লক্ষে মিশ্রবোধের কিছু চরণান্তিক উদ্ধৃতি স্মরণ করতে পারি :

ক) পাখি শিকারের আগে মনে রেখো

আমারও প্রয়োজন আছে ডানা

খ) বাতাসের গায়ে মিশে আছে প্রপিতামহের ঋণ

ভেতরে বৃষ্টির মতো জমা আছে শেকড়-বাকড়

অবশেষে মহাকাব্যের রাতে জন্ম নিয়েছে

আমারও নবীন পাতা

গ) বাংলা ভাষা পাখিদের, বাংলা ভাষা বৃক্ষ-জাতিময়

সবুজ পুসিত্মকা ছাড়া মহাকালে কেউ কবি নয়।

ঘ) চুম্বনে কঠিন সত্য – মাতৃভূমি, তবু ভালোবাসি…

ঙ) এ এক জীবনে যদিবা ব্যর্থ হই

এই তলোয়ার পুত্রকে দিয়ে যাব।

কবির এই বিচিত্র মধুরিমা আরো অভিপ্রেত নিশ্চিন্ততা পায় ভিন্ন আঙ্গিকের কিছু দীর্ঘ কবিতায়। দীর্ঘ কবিতা তো অবশ্যই প্রকরণপ্রবর; বিসত্মীর্ণ তার বেদনা, বহুব্যাপ্ত তার স্পর্শ-স্বাদ-অনুভব। কামাল চৌধুরী পূর্বোক্ত অনুভবের অভিপ্রায়সমূহে সুলভ ও যূথবদ্ধ – লক্ষ্যভ্রষ্টও নন তিনি। কারণ, কমিটমেন্টই তাঁর কেন্দ্র। স্বদেশ, জাতিসত্তার অহংকারে গড়ে ওঠা তাঁর অনুভবগ্রাহ্য প্রান্ত ও চিরন্তন চিন্তনসত্তা ‘রাশি রাশি ভারা ভারা’। সেখানে তাঁর রচনা দুর্মর, জঙ্গম-আদৃত। ‘চূড়া’, ‘হাড়ের গল্প’, ‘কবিতাংশ’, ‘বন্যা ১৯৮৮’ কবিতাগুলোতে ‘বিদূষক’প্রবণতা আছে। তাতে মননধর্মী রাশিগুচ্ছ পলে-পলে প্রকাশমানতা পায়, অকুণ্ঠিত নিবাস গড়ে তোলে। পাখি, চাঁদ, নদী, বৃক্ষ শ্রেয়োময় সত্তাজাত। টোটেম ধারণাও দুর্নিরীক্ষ্য নয়। এর ভেতর দিয়ে মানবজীবনের বিস্তার, বৃহৎ, অনেকান্ত অপরূপ সান্তবনা ধরা পড়ে। মানুষ তো নিছক প্রাণীমাত্র নয়! কিংবা তার চলৎশক্তি অন্য আর দশটার মতো নয়। সেজন্য প্রকৃতিজয়ী মানুষ কিংবা প্রকৃতিজীবী মানুষ – একপ্রকার সমতায়, সন্ধানে, সৃজনে অপরূপ, বলা যায়। কবির কাছে তা মহাবিকিরণে পর্যবসিত। পদার্থময়তায়ও পরিশুদ্ধ। কোলাজ চিন্তা তো আত্মার কিংবা আত্মার অবিসংবাদ আগুন-পানি-হাওয়ার পঞ্চভূতজাত – তা কে অস্বীকার করবে! চার পঙ্ক্তির আঠারোগুচ্ছে বর্ণনায়িত হয়েছে ‘কবিতাংশ’। প্রকৃতির আলো-স্বপ্নমাখা প্রজাপতি-রঙের সমুন্নতি। সুকণ্ঠপ্রবণও। ‘চূড়া’ বা ‘হাড়ের গল্প’ সমাজ-রাষ্ট্রের বাঞ্ছিত ইতিহাস। কামাল চৌধুরী রাষ্ট্রযন্ত্রকে মানুষের প্রতিপক্ষ করেন না, অতিপন্থা তাঁর আদর্শও নয়। এজন্যে ঠিক স্বাভাবিক ও সমান আনুগত্য পেয়েছে তাঁর সমস্ত বিষয়-অনুষঙ্গ। ‘চালাক’ রাষ্ট্র বা ‘চালাক’ মানুষ কী? কেন তাঁর এমন উপাচার! তিনি বলেন :

তাম্রলিপি আজ বহুদূর

জাহাজ ছেড়েছে ঘাটে, চতুর্দিকে উপচানো জল

মহামারী, ধ্বংস গৌড়, মৃত্যু আর জনপদ বিরান কাহিনি

হে অগ্রশ্রাবিকা, দ্যাখো আহার্যবিরত আমি

চমৎকার কবিতা। সমাজ-ইতিহাসের প্রত্নরূপ পরিস্রুত। এগুলো কবিতার প্রোটোটাইপ। কেন্দ্রও। ভিত্তি বা মৌলজাতও। দেশপ্রেম বা দেশাদর্শ হঠাৎ নয়, হয়ও না তা। সেটি ঠিক ইতিহাসের ধারায়, পঠন-পাঠনের কায়দায় উচ্চতায় ওঠে। পরিহাস, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপও মননের ধারায় সমানভাবে সম্মুখগামী। কামাল চৌধুরীর কবিতাবাসনার কেন্দ্রটি এতে চেনা যায়। তাঁর কবিতায় রহস্য বা পরোক্ষপ্রাণতা কম; কিন্তু ভিত্তিটি দৃঢ়। একাত্তর বা দশ জানুয়ারি নিছক সাল বা তারিখ নয়, এর ভেতরে প্রলুব্ধ আছে চেতন-শক্তি।
সে-শক্তি হর্ষবর্ধন থেকে, শশাঙ্ক হয়ে চলেছে। তার তাৎপর্য বা ইন্দ্রিয়জ অলোকরেখাও নিমীলিত। সে-কারণেই তাঁর প্যাশন, ক্রিয়াশীলতা বা জঙ্গমতার অভিমুখ নির্মাল্যে অনুরুদ্ধ হয়। তবে স্থানিক বিষয় বা চলতি দর্পণ তাঁর কবিসত্তায় প্রবহমান হলেও সেটি নিরাবেগ ও মননের তাপে চাঞ্চল্যপ্রবণ। কবিকে সেখানেই সংযম এবং সন্তরূপ নিতে হয়েছে। দীর্ঘ চর্চায় তা উত্তরিতও বটে। তবে, অভিজ্ঞতার জারণ-বিজারণের জন্য কিংবা বুদ্ধির প্রখরতা চিহ্নিতকরণের জন্য কিছু সময়-দূরত্ব দরকার। তাতে আবেগের স্ফটিকস্বচ্ছতা সার্বিক অনুমোদন পেতে সমর্থ বইকি! সেটি বহাল হলে নিশ্চয়ই এ-কবিকে আরো বৈচিত্র্য ও প্রখরতায় পাওয়া যাবে। ঘটবে পৌরাণিক-আধুনিক অক্ষয়তা, সন্দেহ নেই। 