কিস্সা বলেন শেহ্রজাদে

\ ১০ \

 

বা ড়ির ভেতরে বাড়ি, না, ‘বাসা’। সিন্দবাদের কিস্সামহলে ঢুকে কালীঘাটে তাদের পুরনো বাড়িটাই দেখতে পেল রঘুপতি। কিন্তু কোথা থেকে এল টিনের সেই ঘর, যেন রাস্তায় রাস্তায় সিনেমার দৃশ্য দেখিয়ে বেড়ানো লোকটির মাথায় গোল সিনেমা হল – ওপেনটি বায়োস্কোপ? সেই ঘর তো ধীরে-ধীরে সময়ের গ্রাসে, ঝড়-বৃষ্টিতে-উইপোকার আক্রমণে মাটির গভীরে চলে যাচ্ছে। মাকড়সার জাল ছড়াতে থাকে, প্রাচীন ধুলো উড়তে থাকে, টিকটিকি এবং আরো কতসব পোকার ঘরগেরস্তালি হয়ে গেছে। সেই ঘর সিন্দবাদের ভাঙাচোরা কিস্সামহলে এল কী করে?

তার মনে পড়ল, কম্ব্রেও তো হারিয়ে গিয়েছিল মার্সেলের জীবন থেকে। মধ্যবয়সী মার্সেলের মনে হত, তার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে, যৌবন এবং আরো অতীতের আনন্দের দিনগুলো – যখন সে শৈশবে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মায়ের চুম্বনের জন্য অপেক্ষা করত – সেই দিনগুলো আর কখনো ফিরবে না, তখনই একদিন…। মা তাকে চা আর একখ- মাদলেইন কেক খেতে দিয়েছিল। চায়ে কেক ডুবিয়ে খেতে গিয়েই সেই আক্রমণ… এপিফ্যানি… স্মৃতির পর স্মৃতি ভেসে আসছে আর শৈশবের কম্ব্রে জীবন্ত হয়ে উঠছে। যেন জাপানিদের সেই খেলা। পোর্সেলিনের বাটিতে জল ভরে তারা কাগজের ছোট-ছোট টুকরো ছড়িয়ে দেয়। সেসব কাগজের বিশেষত্ব কিছু নেই। কিন্তু জলে ভেজার পরেই তারা যেন ডানা মেলে দেয়, ফুটে ওঠে রং ও আকার, কেউ বাড়ি, কেউ মানুষ, কেউ ফুল… বাটির ভেতরে যেন একটা বাগান…। কম্ব্রেও সেভাবে জেগে উঠছিল তার পথঘাট, গির্জা, বাগান – সবকিছু নিয়ে – মার্সেলের চায়ের কাপ থেকে উঠে আসছে শৈশবের কম্ব্রে।

মার্সেল জানত, সেল্টিক বিশ্বাস অনুযায়ী, যেসব আত্মা আমরা হারিয়ে ফেলেছি, তারা কোনো প্রাণী, গাছ, টেবিল বা চেয়ারের মতো জিনিসে বন্দি হয়ে থাকে। তারপর একদিন আসে – সবার জীবনে আসে না – যখন কোনো গাছের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে তাকে আমরা খুঁজে পাই। সে আমাদের ডাকে, কিন্তু যখনই তাকে চিনতে পারি, আচ্ছন্নতা ভেঙে যায়। আমরা তাকে মুক্তি দিই এভাবে। এরকম সময়ে জীবনের ছোটখাটো বিষয় আমাদের স্পর্শ করে না; মনে হয় না, আমি একটা মিডিওকার, নশ্বর প্রাণী। কোথা থেকে এমন আনন্দ আসে? যে-আনন্দ মার্সেলের জীবনে মাদলেইন কেকের স্বাদ এনেছিল। কিন্তু এমন আনন্দ সেই স্বাদকে ছাপিয়ে চলে যায়। কিন্তু কীভাবে আমরা খুঁজে পাব এই আনন্দ? অপেক্ষা, শুধু অপেক্ষা করে যেতে হবে। রঘুপতি ভাবল, হয়তো মার্সেলের মতোই একটা দিন আমাদের জীবনেও আসবে।

এখন সেই বৃদ্ধা পুরনো আরামকেদারায় বসে আছে। তার মাথার পেছনে ঝুলছে মাকড়সার জাল আর একটি মাকড়সা তার লালা দিয়ে জাল বুনেই চলেছে। বৃদ্ধা মাড়ি বার করে হাসে, মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে, ‘কখন আইলি দাদা? মেলায় যাবি না?’

– চিনতে পারছেন, হুজুর? সিন্দবাদ তার দিকে তাকিয়ে বলে।

রঘুপতি অভিনিবেশে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকে। ধূলিমলিন, পোকায় কাটা, উদ্ভ্রান্ত মানচিত্র দেখে কিছুই মনে পড়ে না। তখন সে হাতদুটি দেখতে পায়, শীর্ণ আঙুল, হ্যাঁ ওই করতল তো তার চেনা, শৈশবে কতদিন জ্বরাক্রান্ত কপালে, মাথায় এক হাতে জল ঢালতে-ঢালতে অন্য হাতে মুছিয়ে দিত তার গাল, চোখ, জল আর আঙুলের ছোঁয়ায় চুলের ভেতরে বেজে উঠত জলতরঙ্গ। রঘুপতি সেই জলতরঙ্গের শব্দ শুনতে পেল, অস্ফুটে ডাকল, ‘মা – ।’

সিন্দবাদের মুখ হাসিতে ভরে গেল, ‘এই তো চিনতে পেরেছেন। তাই তো ভাবি, চিনতে পারবেন না, তা কখনো হয়?’

– মা তো কত বছর আগে মারা গেছে। বিবৃতির মত শব্দগুলো বলে গেল রঘুপতি।

– ও-কথা বলবেন না, হুজুর। সিন্দবাদ বলে।

সিঙ্গম খেঁকিয়ে ওঠে, ‘তার মানে? কী বলতে চাও?’

– মায়ের মৃত্যু হয় না।

সিঙ্গম হেসে ফেলে। – ও বাবা, তুমি যে আবার দর্শন আউড়াতে লেগেছ! বলে হাসতেই থাকে সিঙ্গম।

– ওসব তোমরা ভাব গিয়ে। সিন্দবাদ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘আমি বলি মায়ের মৃত্যু হয় না।’

– তোমার মা-টি কে বাপু?

– কেন? সুলতানা শেহ্রজাদে। সিন্দবাদ বলে চোখ নাচিয়ে।

সিঙ্গম আবার হাসতে শুরম্ন করে। – শেহ্রজাদে তোমার মা?

আর তুমি শালা ভিখিরিরও অধম! দুটি খেতে পাবে বলে নাবিক সিন্দবাদের বাড়ির দোরগোড়ায় বসে থাকো!

– সুলতানা শেহ্রজাদে আমার মা নয় তো কী? আমার গল্প কে শুনিয়েছিল দুনিয়াকে? তাঁর কিস্সাতেই তো আমার জন্ম।

সিঙ্গম আর উত্তর দিতে পারে না। মনে-মনে ভাবে, সিন্দবাদের কথাটা মোক্ষম। সে মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বোকার মতো হাসে। – তা বটে

– তা বটে – রঘুপতি দেখল, তার মা ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে চলেছে। শুনতে শুনতে রঘুপতি বুঝতে পারল মা ঘুমের মধ্যে কাকে যেন গল্প বলে চলেছে : সোনার খাটে গা, রুপার খাটে পা রেখে রাজপুরীর মধ্যে, পাঁচ রানিতে বসে সিঁথিপাটি করতে ছিলেন। এক দাসী এসে খবর দিল, নদীর ঘাটে যে শুকপঙ্খী নৌকা এসেছে, তার রুপোর বৈঠা, হিরার হাল। নায়ের মধ্যে মেঘবরণ চুল কুঁচবরণ কন্যা বসে সোনার শুকের সঙ্গে কথা বলছে। রানীরা চললেন শুকপঙ্খী নায়ে কুঁচবরণ কন্যা দেখতে। তখন নায়ে পাল উড়েছে, শুকপঙ্খী তরতর করে ছুটছে। রানিরা বললেন। কী বললেন?

কুঁচবরণ কন্যা মেঘবরণ ফুল

নিয়া যাও কন্যা মোতির ফুল।

তখন কন্যা বললেন। কী বললেন?

মোতির ফুল মোতির ফুল সে বড় দূর,

তোমার পুত্র পাঠাইও কলাবতীর পুর।

হাটের সওদা ঢোল-ডগরে, গাছের পাতে ফল।

তিন বুড়ির রাজ্য ছেড়ে রসঙ্গা নদীর জল।

শুকপঙ্খী নৌকা অনেক দূর চলে গেল। রানীরা সবাই বললেন। কী বললেন?

কোন্ দেশের রাজকন্যা কোন্ দেশে ঘর?

সোনার চাঁদ ছেলে আমার তোমার বর।

শুকপঙ্খী আরো দূরে চলে গেল। কুঁচবরণ কন্যা বললেন। কী বললেন?

কলাবতী রাজকন্যা মেঘবরণ কেশ,

তোমার পুত্র পাঠাইও কলাবতীর দেশ।

আনতে পারে মোতির ফুল ঢো-ল-ডগর

সেই পুত্রের বাঁদী হয়ে আসব তোমার ঘর।

তার মায়ের গলা বুজে আসে, হাঁ করে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে। রঘুপতি বলে ওঠে, ‘তারপর?’

মা ঘোলাটে চোখ মেলে তাকায়। সেই দৃষ্টি শূন্য। অথই সমুদ্রে লাট খাওয়া খড়কুটোর মতো। রঘুপতির মনে পড়ে, ওই দৃষ্টির সামনে সে দাঁড়াতে পারত না। কেউ সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই মা দুহাত বাড়িয়ে তার মুখ প্রথমে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখত, তারপর নোংরা নখ দিয়ে মুখের চামড়া ছিঁড়ে ফেলতে চাইত, যেন চামড়ার নিচে কী খুঁজত আর শূন্য দৃষ্টি মেলে হাসত।

– মেলায় নিয়া যাবি না, দাদা? কফজড়ানো, ঘড়ঘড়ে গলায় বলে মা।

– আপনাকে দাদা ভাবত, হুজুর? সিন্দবাদ বলে।

– হ্যাঁ, একদিন দেখলাম, আমাকে আর ছেলে বলে চেনে না। আমি গেলেই বলে উঠত, দাদা আইছিস? আর ওই মেলায় নিয়ে যাওয়ার কথা।

– মেলা খুব ভালোবাসত বুঝি?

– জানি না। মায়ের অনেক ছোটবেলায় বড়মামা একবার মেলায় নিয়ে গেছিল। অনেক পুতুল কিনে দিয়েছিল। তারপর তো বড়মামা কেমন হয়ে গেছিল। একেবারে কথা বলত না, নিজের খেয়ালে ঘুরে বেড়াত। পাগল না, বুঝলে। নিজের ভেতর ঢুকে যাওয়া একটা মানুষ।

– কেন এমন হলো? সিঙ্গম বলে।

– দিদিমা বলত, বড়মামাকে নাকি এক আত্মীয় গাছের শিকড়-বাটা খাইয়েছিল। পাগল করে দেওয়ার জন্য।

– কেমন গাছ? সিন্দবাদ ও সিঙ্গম একসঙ্গে বলে ওঠে।

– কে জানে! রঘুপতি হাসে, ‘ওসবে আমার বিশ্বাস নেই।’

মা আবার ঘুমিয়ে বিড়বিড় করতে-করতে কলাবতী রাজকন্যার গল্প শোনাচ্ছে কাউকে। ঘরের চারদিক দেখতে-দেখতে এক কোণে খুঁটিতে ঝোলানো ময়নার জংধরা দাঁড়টা দেখতে পেল সে। জ্ঞান হওয়া থেকে সে দাঁড়টিই দেখেছে। তার জন্মের কিছুদিন পরে মরে গিয়েছিল ময়না। মা-বাবার কাছে রঘুপতি শুনেছিল, ময়না নাকি তার নাম ধরে ডাকত…রঘুপতি… ও রঘুপতি…।

সে মাঝে-মাঝে ভেবেছে, তার নাম রঘুপতি রাখা হয়েছিল কেন? কখনো জিগ্যেস করা হয়নি। আজ আর এমন কেউ বেঁচে নেই, যার কাছ থেকে জানা যায়। শুধু ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম…’ ভজনটা শুনলে তার বুকের ভেতরে কুয়াশা ছড়িয়ে যেতে থাকে… সেই স্বগতোক্তিও যেন শোনা যায়, ‘হায় রাম!’ আর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিন সে আবার গুলিবিদ্ধ বৃদ্ধটিকে লুটিয়ে পড়তে দেখেছিল।

ওই ঘরে আর কিছু নেই। বাবা মারা গেল, মা ধীরে-ধীরে বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে গেল আর একে একে সবকিছু লোপাট হয়ে গেল। রোজ মায়ের কাছে এসে রঘুপতি দেখত, দিনে-দিনে ঘরটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যাদি মায়ের দেখাশোনা করত, সে-ও কিছু বলতে পারত না। রঘুপতি মেনে নিয়েছিল। জিনিসপত্ররাও তো পরিচিত হাতে স্পর্শ চায়। সেই স্পর্শ না পেয়ে তারাও কি হারিয়ে যাওয়ার নিয়তি বেছে নিয়েছিল?

মা একটা অসমাপ্ত আত্মজীবনী লিখেছিল। নাম দিয়েছিল দিনের শেষে। সাধু-চলিত ভাষায় লেখা। প্রথম বাক্যটি : ‘সব যদি ভুলিয়া যাইতে পারিতাম।’ যতবার রঘুপতি এই বাক্য পড়েছে, মির্জা গালিবের গজলের একটি শের মৌমাছির গুনগুনের মতো ছড়িয়ে গেছে –

সীনহ্কা দাগ হ্যায় ওহ্ নালহ্কে লব্তক্ নহ্ গয়া।

খাক্কা রিজক হ্যায় ওহ্ কতরহ্ জো দরিয়া নহ্ হুয়া \

সত্যিই তো, যে-আর্তনাদ মুখ দিয়ে বেরোতে পারে না, তা বুকে দাগ কেটে বসে। যে-জলকণা সমুদ্রে পৌঁছতে পারে না, মাটি তাকে শোষে।

 

মানুষ তো এজন্যই ভুলে যেতে চায়। কিন্তু তার জন্য চেষ্টা করতে হয় না। মুখের বলিরেখায় যখন ক্লান্তি ফুটে উঠতে থাকে, মাথার ভেতরটাও পোড়ো জমি হয়ে যায়। ডিমেনশিয়ার রোগীর ক্ষেত্রে তা পুরনো কবরখানায় পরিণত হয়, যেখানে মৃতদেরও আর প্রবেশাধিকার থাকে না। শুধু হাওয়া বয় আর কঙ্কালেরা পাশ ফিরে শোয়।

মা সব ভুলে যেতে চেয়েছিল। চাইবারই তো কথা। স্বাধীনতা তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছিল শিয়ালদহ স্টেশনে, কুকুর-বেড়ালের মতো মানুষের বেঁচে থাকা, দালালরা ঘুরে বেড়ায়, মেয়েরা নিরুদ্দেশ বা বিক্রি হয়ে যায়। তারপর ধুবুলিয়া ক্যাম্পে খোঁয়াড়ে বেঁচে থাকা শুয়োরের মতো, একে অপরের দিকে শিকারের দাঁত বের করে আছে। সেখান থেকে সোদপুরে পুনর্বাসনের জমি পাওয়া, টালি-ছাওয়া একটা ঘর ওঠে, কিন্তু দারিদ্রে্যর মালিন্য লেপ্টে থাকে শরীরে-মনে। বিয়ে হওয়ার পরে কালীঘাটে টিনের বাড়িতে উঠে আসা আর-একটা জীবন এভাবেই কেটে যায় – এক অন্ধকার থেকে আরেক অন্ধকারের ভেতরে। মা তা-ই সব ভুলে যেতে চেয়েছিল। এমন কোনো আকাশ তো ছিল না, যেখানে উড়ে যাওয়া যায়।

অনেকদিন ধরেই মাথার যন্ত্রণার কথা বলত মা, টাইট করে কাপড় বেঁধে রাখত মাথায়। আর মুখের ভেতরে নাকি শুধু নোনাজল। শুয়ে থাকত সারাদিন, স্নান করতে চাইত না, খাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। তারপর সেই দিনটা এল। রঘুপতির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মা বলে উঠল, ‘দাদা! কোথায় গেছিলি?’

বাবা তখনো বেঁচে, হেসে বলেছিল, ‘ও তো রাঘব। তোমার ছেলে।’

– আমার ছেলে?

– চিনতে পারো না?

মা তার দিকে তাকিয়ে থাকে, আপনমনে হাসে।

বাবা বলে, ‘আজ সারাদিন বারেবারে আমারে জিজ্ঞাসা করছে, আপনি কে? মাথাটা একেবারে নষ্ট হইয়া গ্যাছে রাঘব।’ বাবা তার দিকে অসহায় চোখে তাকায়।

ডাক্তার সেনশর্মা বলেছিল, ‘ডিমেনশিয়া আসলে ধীরগতিতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। কোনো কিছুই আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না। মানুষটার সত্তাই শুধু ভেঙেচুরে যায় না, তার চেনা পৃথিবী বিস্মৃতিতে চলে যায়। প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে তার ভেতরের কিছু অংশ মুছে যায়। চিরদিনের জন্য। মানুষের নাম, মুখ, ঘটনা – সব হারিয়ে যেতে থাকে। আপনি যাকে চিনতেন, জানতেন, এখনকার মানুষটা আর সে নয়। মাকে হয়তো আপনি খুব ভালবাসেন, কিন্তু এই রোগ যত তাকে গ্রাস করবে, আপনার ভালোবাসাও উবে যাবে।’

– কোনোভাবে সুস্থ করে তোলা যায় না?

– ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় বা রোগী ঝিমিয়ে থাকবে। এর বেশি আমাদের কিছু করার নেই। আপনাকে মেনে নিতে হবে। রোগীর অবস্থা দিন-দিন খারাপ হবে। তবে কি জানেন, কোনো কিছু নিয়ে জোর করবেন না। খাওয়ার জন্য নয়, জামাকাপড় পরার জন্য নয়। কিছু বোঝানোর চেষ্টা করবেন না। তিনি আমাদের লজিকের বাইরে চলে গেছেন। যা করতে চান, করতে দেবেন। অনর্গল কথা বললে থামিয়ে দেবেন না। আমাদের মতো স্বাভাবিক হওয়ার জন্য ওনার ওপর জোর খাটাবেন না। একদিন আপনার মা এ-ও ভুলে যাবেন, তিনি কে, কোথায় আছেন – সব, সব ভুলে যাবেন। তখন ওনার সব কাজ আপনাদের করে দিতে হবে; এমনকি পায়খানা-পেচ্ছাপ পরিষ্কারও।

সে বলেছিল, ‘একেকদিন খুব ভায়োলেন্ট হয়ে যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। তখন দেখাশোনার মেয়েটা বিছানার সঙ্গে হাত বেঁধে রাখে।’

– বারণ করবেন। এভাবে বেঁধে রাখলে আপনার মা মনে করবেন, তাঁর নিজের কেউ নেই। বন্দি মানুষ আরও ভায়োলেন্ট হয়ে যায়।

এর পরেও দুবছরের বেশি বেঁচে ছিল মা। তার মধ্যে বাবা মারা গেছে। মা কিছু অনুভব করতেই পারেনি। হয়তো পেরেছিল, আমরা জানি না, কিন্তু কখনো বাবার কথা জিগ্যেস করেনি। দিনে-দিনে আরো কালো আর শীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। শেষের তিন মাস শুয়েই থাকত। তারপর একদিন সামান্য খাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল; জলও খেতে চাইত না, ঘুমের ভেতরে – কোমায় চলে গেল মা। আর একদিন দুপুরে সন্ধ্যাদি ফোন করে বলল, ‘দাদাবাবু, মা চলে গেল।’

তার আত্মজীবনী দিনের শেষে সম্পূর্ণ করে যেতে পারেনি মা। মাঝে-মাঝেই রঘুপতির মনে হয়, মায়ের জন্য তেমনভাবে সময় দিতে পারেনি সে। প্রথমদিকে গিয়ে গল্প করত, তারপর বিরক্ত হতো, একসময় মায়ের মুখোমুখি হতে আর ইচ্ছা করত না। সন্ধ্যাদির ওপরেই সব ভার চাপিয়ে দিয়েছিল। মৃত্তিকা মাঝে-মাঝে গিয়ে মায়ের সঙ্গে পুরনো গল্প করত। শক্ত হয়ে আসা হাত-পায়ের ব্যায়াম করাত, মা একটু পরেই বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়ত। সন্ধ্যাদির পরেই মৃত্তিকা মায়ের অনেক শুশ্রূষা করেছিল। কিন্তু মা তো তখন এক বস্ন্যাকহোলের দিকে এগিয়ে চলেছে।

বৃদ্ধের জীবন সবচেয়ে অসহায়। তখন তোমার হাতে অঢেল সময়, কিন্তু তোমার জন্য অন্যদের হাতে সময় নেই। তুমি বাতিলের খাতায়। সবাই বিরক্ত হয়। আর দিনে-দিনে তোমার মন মরে যেতে থাকে। ডিমেনশিয়ার রোগী এই বাস্তবের বাইরে বহুদূর অতীতে চলে যায়। ছেলের ভেতরে দাদাকে খোঁজে, মেলায় যাওয়ার জন্য আবদার করে। তারপর একদিন ভাঙা মেলার এক কোণে অপরিচিতের মতো পড়ে থাকে।

সিরিয়ার সারাকেবে বোমাবর্ষণ থামেনি। সারাকেব সামরিক স্ট্র্যাটেজির দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শহর; তাই এখানে অস্থিরতা জিইয়ে রাখা জরুরি। সূর্য ওঠার আগেই এখানকার মানুষ শহিদদের – তাদের প্রিয়জনদের – কবর দেয়; একবার রোদ উঠলে দেহ পচে যায়। শহিদদের কবরখানা একদা বাগান ছিল; প্রতিটি কবরে পুঁতে দেওয়া হয় গোলাপের চারা।

তাফতানাজ বিমানবন্দরে লড়াইয়ে মারা গিয়েছিল আমজাদ হুসেন, যে উগ্রপন্থী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আমজাদের মুখেচোখে ফুটে উঠত সিরিয়ার মানুষের বিপস্নবের অঙ্গীকার, সম্মান ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই। অনেকে বলত, আমজাদের মুখ বড় রহস্যময়, সে যেন মৃত্যুর জন্য প্রস্ত্তত হয়েই আছে। নির্ভীক মানুষটি এখন কবরের নিচে শুয়ে আছে।

মাঝে-মাঝে এক তরুণীকে আমজাদের কবরের পাশে বসে থাকতে দেখা যায়। সে ফিসফিস করে বলে, ‘আমজাদ, শুনতে পাচ্ছো?’ তারপর আপনমনে কথা বলে যায়, যেন আমজাদের সঙ্গেই কথা বলছে সে।

এসব কি স্বপ্নে দেখা দৃশ্য? বাস্তবেও সিরিয়ায় ঘটে গেছে, ঘটে চলেছে। মেয়েটির পাশে কারা যেন দুটি কবরের গর্ত খুঁড়ে চলেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে বোমাবর্ষণের শব্দ। সারাকেব শহর শেষ হলেই দীর্ঘ কবরখানা। সিরিয়ার ভূখ- পরিণত হয়েছে শহিদদের গণকবরে। কবর দেওয়ার জায়গাও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির উঠোনে, পার্কে-পার্কে তৈরি হয়েছে কবরখানা। গাছের নিচে কবর। লম্বা পরিখা খুঁড়ে একের পর এক শহিদদের শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারো-কারো বাড়ির পেছনেই তৈরি হয়েছে পরিবারের মৃত শিশুদের জন্য সমাধিক্ষেত্র। দোকান ও রাস্তাঘাটের মতোই একের পর এক কবরখানা মানুষের মধ্যেই বেঁচে থাকছে।

একজন কবরখনক চিৎকার করে ওঠে, ‘ইয়া আলস্নাহ! আমাকে নাও না কেন? কোন তরতাজা ছেলে এই গর্তে এসে শোবে!’

মেয়েটি এখন কবরের পাশ দিয়ে ভেজা পথ পেরিয়ে হেঁটে যায়। সারা সকাল, দুপুর সে কবরখানাতেই ঘুরে বেড়ায়, হাসে, কথা বলে। একসময় সমাধিফলকের পেছনে সূর্য পাটে বসে থাকতে থাকে, শহর অন্ধকারে মুছে যেতে থাকে, শুধু ছায়ামূর্তিরা ঘুরে বেড়ায়।

মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে রঘুপতি। এও তো এক মৃত শহর। আর আমরাও তো মরে গেছি, পচে যাচ্ছি দিনে-দিনে। এই যুদ্ধপরিস্থিতি আর তার মায়ের বিস্মৃতিকে একইরকম মনে হয় রঘুপতির। মৃত্যু একেবারে সরাসরি, ছুটন্ত তীরের মতো আসে।

সকাল থেকে কালো বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে থাকে বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ। সবাই দৌড়ছে, নিঃশ্বাস-হাঁপানোর শব্দের ঢেউ উঠছে। কে যেন বলতে-বলতে দৌড়য়, ‘এই মাটি, এই ধুলো – সব আমাদের শিশুদের মাংস থেকে তৈরি হয়েছে।’

কোথাও নক্ষত্র নেই আকাশে। চাপ-চাপ অন্ধকার ভাসছে। যেন অন্ধকারের নদী। আর সেই নদীতে তার মাকে ভেসে যেতে দেখল রঘুপতি। মায়ের মাথার ভেতরে কিলবিল করে ঢুকে যাচ্ছে অচেনা সব সরীসৃপ।

দমবন্ধ অবস্থায় ঘুম ভেঙে গেল তার। (চলবে) r

* অনুবাদ : শক্তি চট্টোপাধ্যায়