কেন তিনি মাজহারুল ইসলাম

মুনতাসীর মামুন

আমি তখনো বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র অথবা ছাত্রত্ব পেরিয়েছি। সময়টা ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪-এর মধ্যে। আমার বড় চাচা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর আমাকে বললেন, ‘চলো, তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই।’

আমাকে নিয়ে চললেন ধানমন্ডির দিকে। ধানমন্ডি তখন সত্যিই আদর্শ একটি আবাসিক এলাকা, নিরিবিলি। পুরনো ২৫ নম্বর সড়কের উলটোদিকে একটি বাড়ির ফটকে এসে পৌঁছলাম। ভেতরে ঢুকে একটু অবাক হলাম। চৌকোনা লাল ইটের একটি বাড়ি। ছিমছাম। সামনে সবুজ লন। ড্রইংরুমে বসে অবাক হলাম। নিচ থেকে দোতলার সিলিং দেখা যাচ্ছে। চারদিকে আলো। কোনো বসতবাড়ি এরকম হতে পারে তা আমার অভিজ্ঞতায় ছিল না। বলা যেতে পারে, আধুনিক কোনো বসতবাড়ি দেখার সেই অভিজ্ঞতা আমার প্রথম। নবেন্দু ঘোষের একটি উপন্যাসের নাম ছিল বোধহয় অভিভূত ঢাকা। আমার নিজেকে ঠিক তাই মনে হয়েছিল।

বাড়ির মালিক এলেন। তাঁকে দেখেও আমি মুগ্ধ। এরকম বাড়ির মালিক এরকম হওয়াই বোধহয় উচিত। ছিমছাম গৌরবর্ণ, চুল তখনো সাদা, তবে তা বিরল হচ্ছে, উন্নতনাসা। ইতিহাসে আমরা যেমন আর্যদের বিবরণ পড়েছি, ঠিক সেরকম দেখতে। পরিপাটি পোশাক। প্রথম দৃষ্টিতে একটু রুক্ষ ভাব আছে। কিন্তু কথা বলছেন মৃদুস্বরে। মাঝে মাঝে কুঁচকে যাচ্ছে ভ্রু। পরিচয় করিয়ে দিলেন চাচা। তিনি সৌজন্যের হাসি হাসলেন। স্বাভাবিকভাবেই আমার দিকে দৃকপাত না করে চাচার সঙ্গে আলাপ করতে লাগলেন। আর আমি ঘরের ভেতর থেকেই দেখতে লাগলাম রোদমাখা ঘাসের সবুজ চত্বর, ঘরের ভেতর এদিক-সেদিক ছিটকেপড়া রোদ।

বিদায় নিয়ে গেট থেকে বেরোবার পর আমার চাচা বললেন, ‘বাড়িটার নকশা ওনারই করা। এখানকার সবচেয়ে নামকরা স্থপতি তিনি, মাজহারুল ইসলাম।’ অবশ্য, আসার আগে তিনি বলছিলেন, মজুভাইয়ের বাসায় যাব। তাঁর সমসাময়িক কিন্তু বয়সে খানিকটা ছোট তাঁরা তাঁকে ডাকতেন মজুভাই বলে। সমসাময়িক রাজনৈতিক সহকর্মীরাও ওই নামে ডাকতেন। স্থপতি বা আমাদের মতো বয়োকনিষ্ঠদের ছিলেন তিনি ‘স্যার’ বা ইসলাম সাহেব।

স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নকশা করা সেই বসতবাড়িটা এখনো ঠিক সেরকম আছে, যা অনেকে হয়তো জানেন না। মালিকানা বদলেছে। বর্তমান মালিকের নিশ্চয়ই ঐতিহ্যপ্রীতি এবং রুচিবোধ আছে, কারণ বাড়িটা ভেঙে তিনি মাল্টিস্টোরিড করেননি। সেই বাড়ির উলটোদিকে পুরনো ২৫নং সড়কে আমি এখন থাকি। প্রতিদিন আসা-যাওয়ার পথে বাড়িটি চোখে পড়ে। আর মনে পড়ে তাঁকে দেখার প্রথম স্মৃতির কথা।

বেশ কিছুদিন পর। আমার খালু আহমদ ফজলুর রহমানের সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, গুলশানে তিনি বাড়ি করছেন, আমি দেখতে যাবো কি না? গুলশানে তাঁর বাড়ির কাজ প্রায় শেষ। সেই লাল ইটের। ভেতরে লবির মতো জায়গা। সেখানে বসে দোতলার সিলিং দেখা যায়। মনে হলো, কোথায় যেন এরকম একটি বাড়ি দেখেছি। মনে পড়ল ধানমন্ডির সেই বাড়ির কথা। আমার খালু জানালেন, এই বাড়ির নকশা মাজহারুল ইসলামের করা।

আমাকে কে একজন বলেছিলেন, ধানমন্ডিতে, মাজহারুল ইসলাম প্রথম বসতবাড়ির যে-নকশাটি করেন তা রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খানের। সে-বাসাটি এখন ভেঙে বোধহয় ডেভেলপারকে দেওয়া হয়েছে। এরকম আরো কিছু বসতবাড়ির নকশা তিনি করেছেন নিশ্চয়। যেমন, ধানমন্ডিতে কবি সানাউল হকের বাড়ির ডিজাইনটি ভিন্ন রকমের, লাল ইটের, অনেকটা মাজহারুল ইসলামের নকশার মতো।

মাজহারুল ইসলামের অন্যান্য অনেক নকশার কথা আলোচনা করা হয় কিন্তু বসতবাড়ির নকশার আলোচনা করা হয়নি। এখন সময় এসেছে কোনো স্থপতির সে-বিষয়ে একটি জরিপ করে দেখা।

স্থাপত্য অবিশেষজ্ঞ হিসেবে আমার মনে হয়েছে, পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত তিনি বসতবাড়ির যে-নকশা করেছেন, তা প্রচলিত ধারার বসতবাড়ির নকশা থেকে ছিল ভিন্নতর। এর বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল স্পেসের ব্যবহার, নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার, ভেতরে আলো-হাওয়ার খেলা। বৈঠকখানায় বসলে চারদিকে স্পেসের সমারোহ এবং একই সঙ্গে পারিপার্শ্বিকতায় তুচ্ছ মনে হওয়া। নকশায় তিনি সব রকমের আড়ম্বর বাদ দিয়েছেন। চৌখুপি এক জ্যামিতিক নকশা তৈরি করেছেন। ইটের লাল রং, যা স্বাভাবিক, তা-ই ব্যবহার করেছেন। তার সঙ্গে চারদিকে ঘাসের সবুজ। ভেতরে বসে কাচ দিয়ে দেখা আকাশের নীল। আবাসগৃহের বাইরে চুন-সিমেন্টের পলেস্তারা পরিহার ভিন্ন আবহের সৃষ্টি করেছিল। এভাবে আমরা দেখি তাঁর নিজস্ব একটি শৈলী নির্মিত হয়েছে।

প্রথম জীবনে সাংবাদিকতার এবং তারপর শিক্ষকতার সূত্রে তৎকালীন আর্ট কলেজে (চারুকলা অনুষদ) নিত্য ছিল আসা-যাওয়া। একদিন শিল্পী হাশেম খান বললেন, ‘এই আর্ট কলেজের নকশা কিন্তু মাজহারুল ইসলামের করা।’ তখন মাজহারুল ইসলাম নামটি পরিচিত। জেনেছি, তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। স্থপতি তো বটেই। তাঁর এক পুত্র তখন পরিচিত ক্রিকেটার, মেয়ে ডালিয়া সংস্কৃতি মহলে পরিচিত। তাঁর ছোট ভাই চট্টগ্রাম বন্দরে প্রধান প্রকৌশলী। আমার আববাও সেখানে কাজ করেন। পাশাপাশি আমাদের বাসা। তাঁর ছোট বোন বন্দরের ডাক্তার। আমাদের ফুপু। তাঁর ছেলে আমাদের বন্ধু। সবমিলিয়ে আমাদের কাছে তখন তিনি অতিপরিচিত নাম।

আর্ট কলেজের নকশা করেন তিনি গত শতকের পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি, সরকারি স্থপতি হিসেবে। ওই সময়ের নিসর্গের কথাটি চিন্তা করি। চারপাশে খালি, সবুজ বৃক্ষ, লাল কৃষ্ণচূড়া। এ-পটভূমিতে উচ্চকিত কিছু মানাতো না। চিত্রকলার নমনীয় রেখার মতো, এ-স্থাপত্য বিজ্ঞানেও সেই নমনীয় ভঙ্গিটা থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল এবং তিনি তা রেখেছিলেনও। হাশেম খান লিখেছেন, ‘মুঘল স্থাপত্য ঢাকা নগরীর শাহবাগে আর্ট ইনস্টিটিউট ভবনই প্রথম আধুনিক সুরম্য ভবন।’

বিশেষ করে দোতলার সিঁড়ি, পাশে একটি কাঠগোলাপের গাছ এর নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। প্রধান ফটক পেরিয়ে ঢুকলেই তা চোখে পড়ে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রস্তাব ছিল না। তিনি সেই প্রস্তাব রেখেছিলেন। এখানে একটি সূত্র পাওয়া যায়, শিল্পকলার কোনো শাখাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। দেখলে, তার সামগ্রিকতা নষ্ট হয়।

আমি আরো পরে আর্ট কলেজের শেষ সীমানায় (নবাবদের বাগানের শেষ মাথায়) কয়েকটি বিভাগের জন্য নির্মিত ইমারতটি দেখি। অনেকের আলোচনায় এ-প্রসঙ্গটি বাদ যায়। কিন্তু এই ইমারতগুচ্ছও আলোচনায় আসা দরকার। আসলে পুরো কমপ্লেক্সটি মূল ভবনের পাশে নবাব বাগিচার শুকিয়ে যাওয়া তালাও, তার চারদিকে বাঁধানো পায়ে চলার পথ, শেষ মাথায় আবার একগুচ্ছ ইমারত, আর চারদিকে সবুজের অবগাহন, চিত্রকলার জন্য ওই রকম পরিবেশ আর কোথায় পাওয়া যাবে। এ কারণেই বোধহয় কাইয়ুম চৌধুরী লিখেছেন – ‘সরেজমিনে আধুনিক স্থাপত্যের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের মারফত। পঞ্চাশের দশকে আর্ট কলেজের এই চৌহদ্দির পরিকল্পনাসহ আর্টস্কুল ভবনের নকশা আমরা অবলোকন করি অবাক বিস্ময়ে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের স্বপ্নকে সার্থকভাবে বাস্তবায়িত করেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম তাঁর অসাধারণ সৃজনশৈলীর মাধ্যমে। সে-সময়ে আর্ট কলেজ ছিল একটি দর্শনীয় স্থান, যার নাম ছাপা হতো পর্যটনের স্যুভেনিরে। আজো যারা বাইরে থেকে আসেন, আর্ট কলেজ ভবন ও তার পরিবেশ তাদের বিস্ময় জাগায়। আরো অনেক সৃষ্টির মাঝে আর্ট কলেজ তাঁর সেরা সৃষ্টির অন্যতম।’

আর্ট কলেজের ঠিক পাশেই ছিল গণগ্রন্থাগার ভবন। বর্তমান সুফিয়া কামাল গণগ্রন্থাগারের ছবি ছেপে বলা হচ্ছে, এটি মাজহারুল ইসলামের করা। অনেক কৌতূহলী ছাত্রও তাঁর মৃত্যুর পর সেটি দেখতে গেছেন। আসলে, বর্তমানের নয়, আগের গণগ্রন্থাগার ছিল তাঁর করা। আমাদের ছাত্রাবস্থায়ও তা ছিল। আর্ট কলেজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তা নির্মিত হয়েছিল। এরও একটি র‌্যাস ছিল যা দিয়ে সরাসরি দোতলায় ঢোকা যেত। সে-সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটি ছিল বেশ অভিনব। সেই গ্রন্থাগারে ঢোকার মুখে (আগে একটি কাউন্টার ছিল পাশে) দেয়ালে হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমদের পাথরে (না সিমেন্টের) ম্যুরাল এখনো অক্ষত। অধিকাংশ কলারসিকেরই তা অজানা। একসময় এর চত্বরে নভেরা আহমদের অনেক ভাস্কর্য ছিল; যাতে গরু-ছাগল বাঁধা হতো। একসময় উদ্যোগ নিয়ে সেগুলো জমা দেওয়ার বন্দোবস্ত করি জাতীয় জাদুঘরে।

উল্লেখ্য, এ দুটি কাজ করেছিলেন খুবসম্ভব ১৯৫৩-৫৪ সালের দিকে, তখন তিনি সরকারের কনিষ্ঠ স্থপতি। ওই সময়ে স্থাপত্য যে আলাদা বিষয় সে-ধারণা বিকশিত হয়নি। তবু সরকার যে এ-প্রকল্প কার্যকর করেছিল সেটি আশ্চর্য ব্যাপার।

মাজহারুল ইসলামের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তা সরকারি দফতরের সঙ্গে খাপ খায় না। খাপ খায়ওনি। তিনি ষাটের দশকের মাঝামাঝি চাকরি ছেড়ে দেন। তবে ইতোমধ্যে আরেকটি বড় ইমারতের নকশা তিনি করেছিলেন সেটি সায়েন্স ল্যাবরেটরির, যেটিতে সরকারি পূর্ত বিভাগের ছাপ বেশি।

১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাস্ত্তকলাবিদ’, পেশাভিত্তিক স্থাপত্যিক প্রতিষ্ঠান। তাঁর সহযোগী ছিলেন প্রকৌশলী শেখ শহীদুল্লাহ। খুব সম্ভব তার কাছাকাছি সময়ে বা একটু আগে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য অনুষদ চালু করা হয়েছিল। সেখান থেকে ছাত্ররা পাশ করে পরবর্তীকালে ‘বাস্ত্তকলাবিদে’ কাজ দেখার সুযোগ পান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ আছে, তা হলো নিপা ভবন, যা এখন বাণিজ্য অনুষদের অন্তর্গত। এ-ভবনের নকশা করা হয়েছিল আর্ট কলেজের নকশার এক দশক পর। ফলে সেখানে খানিকটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ করি। উল্লম্ব রেখার প্রতি আকর্ষণ, উপাদানে লাল ইট ছাড়াও অচর্চিত সিমেন্টের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এই ধারার পরবর্তীকালে বিস্তৃতি দেখি চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ষাট দশকে এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। চট্টগ্রামে কাজ করতে হয়েছে উঁচু-নিচু পাহাড় নিয়ে, জাহাঙ্গীরনগরে সমতল ভূমি নিয়ে। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের সময় অনেকবার গিয়েছি। বিভিন্ন পাহাড় ব্যবহার করে ইমারত নির্মাণ আমাদের চোখে নতুন ঠেকেছিল। আসলে আমরা পিডব্লিউডি ধরনের কাজ দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। মাজহারুল ইসলামের কাজ তার বিপরীত। সুতরাং চোখে নতুন ঠেকছিল। ইতোমধ্যে স্থাপত্যবিদ্যার বিভিন্ন বই দেখে, স্থাপত্যের নির্মাণশৈলীর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ প্রথম গড়ে উঠেছিল পাহাড়ের গা ঘেঁষে। তার করিডোরে হাঁটলে পাহাড়ের গা ছোঁয়া যেত। পাহাড়ের উচ্চতা মেনে ইমারত তৈরি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, কতগুলো উল্লম্ব রেখার সমাবেশ। একদম উঁচু পাহাড়ে উপাচার্য ভবনটিও চমৎকার। আর্ট কলেজে যেমন ছাদের বিস্তৃতি আনন্দ দিয়েছিল, উপাচার্য ভবনেও তেমনি ছাদের ব্যবহারিক দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগরের নকশায় খুব বেশি ব্যতিক্রম এনেছেন, তা নয়। তবে চট্টগ্রামে নিসর্গ মেনে কাজ করলেও আবহাওয়ার ব্যাপারটা তিনি খেয়াল করেননি। পাহাড়ে বৃষ্টি করিডোর সব ধুইয়ে দেয়। ফলে বর্ষাকালে তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

মাজহারুল ইসলাম এরপর আরো কাজ করেছেন। তার ফিরিস্তি এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। আমি তাঁর যেসব কাজ দেখেছি তাতে আমার মতো স্থাপত্য-অনভিক্ত ব্যক্তির কাছেও ধরা পড়ে, মাজহারুল ইসলাম একটি আলাদা স্থাপত্যশৈলী নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর কাজে এটি সুষ্ঠুভাবে ধরা পড়ে, তাঁর পরের প্রজন্মের অনেকে তাঁর চেয়েও হয়তো ভালো নকশা করেছেন; কিন্তু এমনভাবে স্পষ্ট শৈলী নির্মাণ করতে পারেননি। এর একটা কারণ বোধহয়, ওই সময়, স্থাপত্যহীন সময়ে তিনি বড় বড় কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন, বড় বড় স্পেসের পটভূমিতে। এখন সে-সুযোগ আর নেই।

মাজহারুল ইসলাম একজন বড়মাপের স্থপতি ছিলেন – এটি নতুন করে বলার কিছু নেই। তাঁর অবদান, বাংলাদেশে তিনি স্থাপত্য আবহ তৈরি করেছিলেন এবং বেশ কিছু বড় কাজ সরকারকে দিয়ে করাতে পেরেছিলেন, যা এখন আমাদের স্থাপত্যের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে কাজ করছে। যেমন, লুই কানকে দিয়ে শেরেবাংলা নগর, পল রুডলফকে দিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তিনি করিয়েছিলেন। স্থপতি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমি যতদিন তাঁকে সজীব ও সচল দেখেছি ততোদিন দেখেছি স্থাপত্য নিয়ে চিন্তাভাবনায় একটি সময় সবসময় রেখেছেন। তাঁর অন্য প্যাশন ছিল রাজনীতি।

মাজহারুল ইসলামের সান্নিধ্যে আসা সম্ভব হয় স্থপতি রবিউল হুসাইনের কারণে। রবিউল হুসাইনের মতো মাজহারুল ইসলাম ভক্ত, অনুরাগী আর কাউকে আমি দেখিনি। যে-কারণে দেখা যায়, রবিউল হুসাইনের কাজেও বিশেষ করে উপাদানের স্বকীয়তা আনয়নে মাজহারুল ইসলামের প্রভাব আছে। রবিউল হুসাইন আমাদের কাছে রবিউলভাই, তাঁর কবিতার কারণে। আশির দশকের মধ্যভাগে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমরা কমবেশি সবাই সম্পৃক্ত ছিলাম। সেই সূত্রেই তাঁর সান্নিধ্যে আসা।

ন্যাপ, বাকশাল হয়ে মাজহারুল ইসলাম বোধহয় তখন আওয়ামী লীগে থিতু হয়েছেন। স্বৈরাচার নিপাতের আন্দোলনে অর্থকড়ি জোগাড় করা ছিল তাঁর অনেক কাজের একটি কাজ। বক্তৃতা-বিবৃতি তৈরি করার কাজও ছিল আমাদের। ওই সময় মাজহারুল ইসলামকে মনে হতো, রাজনীতিতেই বোধহয় তাঁর আগ্রহ বেশি।

রাজনীতি আলোচনার সময় স্থাপত্য এসে যেত। আমি তখন ঢাকা নিয়ে কিছু লেখালেখি করছি, সেটিও বোধহয় তাঁর নজরে এসেছিল। তখন তিনি ‘চেতনা’ নামে একটি পাঠচক্র করেছিলেন। ‘চেতনা’র পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। কিন্তু, কাজকর্ম মূলত পরিচালনা করতেন কিছু নবীন স্থপতি। এর বয়সী সদস্য ছিলেন রবিউলভাই। আমি যুক্ত ছিলাম ইতিহাস পড়ার কারণে। সাধারণত স্থপতিরা নিজ বিদ্যার বাইরে খুব একটা যেতে চান না।

আমরা যে-কথা বলছিলাম, মাজহারুল ইসলামও তাই বলছিলেন এবং সেটির ব্যবহারিক দিক সম্পূর্ণ করার জন্যই ‘চেতনা’র সৃষ্টি করেছিলেন। অর্থাৎ স্থাপত্য আলাদা বিচ্ছিন্ন কোনো শিল্প নয়, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভূগোল স্থপতিকে আত্মস্থ করতে হবে, যা তাঁর কাজে প্রতিফলিত হবে। রবিউল হুসাইন লিখেছিলেন – ‘স্থাপত্য শিল্প ক্রমান্তর ও জটিল ও পরিবর্তনশীল। সাম্প্রতিক স্থাপত্যবিশ্বে কী পরিবর্তন উন্নয়ন এবং পরিবর্তন ঘটছে বিষয়, দর্শন ও উপকরণ নিয়ে, নিজের দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য সম্বন্ধে জানা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভের উদ্দেশ্যেই এই পাঠচক্র।’ এই পাঠচক্রের বেশকিছু আসর পরীবাগে তাঁর বাসায় বসত। তিনি উপস্থিত থাকতেন। যদ্দুর মনে পড়ে চেতনা কিছু প্রদর্শনীও করেছিল। আমি নিয়মিত না হলেও মাঝেমাঝে যেতাম, দু’একটি আসরে বক্তব্যও রেখেছি। চেতনা যারা চালাতেন কর্মজীবনে তাঁরা প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলে পাঠচক্রটি লুপ্ত হয়।

এই পাঠচক্রে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপের সময় একটি বিষয়ে তিনি জোর দিতেন, তা হলো পরিকল্পনা। তাঁর মতে, আলাদাভাবে ঢাকার নগর পরিকল্পনা করে লাভ নেই। সারাদেশকে নিয়ে, ঢাকাকে মাঝে রেখে একটি অবিচ্ছিন্ন বা ইন্টিগ্রেটেড পরিকল্পনা করতে হবে। নীতিনির্ধারকদের অনেককে বিষয়টি বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। কেউ বুঝতে চাননি। এখন মনে হয়, চিন্তাটি অত্যন্ত যৌক্তিক ছিল। এখন আরেকটি বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। তাহলো ক্ষমতার কালে বন্ধুও বন্ধু থাকে না। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যেসব বিষয়ে অভিন্ন মতামত পোষণ করতাম, ক্ষমতায় গেলে দেখা যায় অভিন্ন মতামত আর থাকছে না। শুধু তাই নয়, তাঁরা ভিশনহীন, অপরিণামদর্শী, অর্ধশিক্ষিততে পরিণত হন।

শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হলে আমরা যারপরনাই আশান্বিত হয়েছিলাম। তিনি সংস্কৃতিমনা। তাঁর উদ্যোগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে মহাযজ্ঞ শুরু হয়। আমাদের বড় আকাঙ্ক্ষার প্রকল্প ছিল স্বাধীনতাস্তম্ভ। এর জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এর জুরি বোর্ডে মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে আমারও থাকার সৌভাগ্য হয়। মনমতো নকশা আমরা পাচ্ছিলাম না। একটি নকশার কনসেপ্ট হাশেম খানের পছন্দ হয়। তিনি মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে বিষয়টি আলাপ করেন। এই কনসেপ্টটিকে স্থিতকরণে সাহায্য করলে সুন্দর একটি বিষয় হতে পারে। মাজহারুল ইসলামও রাজি হলেন। সেই নকশায় বিভিন্ন সময় সংযোজন-বিয়োজনে প্রস্তাব রেখেছেন রবিউল হুসাইন, হাশেম খান প্রমুখ। সবশেষে মাজহারুল ইসলামের মতই সবাই মেনে নিতাম। ওই স্থাপত্যের সঙ্গে নিসর্গ কী হবে সেসব চিন্তাভাবনাও তিনি করছিলেন। ওই সময় বিভিন্ন সভায় দেখতাম, তাত্ত্বিকভাবে তিনি যা বিশ্বাস করেন, কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময় তা গ্রহণ করতে চাইতেন না। এই সময় হাশেম খানের সঙ্গে তাঁর অনেক বিষয়ে মতের মিল হতো না। তিনি তখন এমন এক স্থপতিতে পরিণত হতেন, যেখানে তাঁর মতামত ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণযোগ্য ছিল না। আবার এটিও দেখেছি, অনেক তর্কাতর্কি,  উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পর অন্তিমে সর্বগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিরুক্তি করতেন না।

স্থপতিরা রাজনীতি নিয়ে উৎসুক নন। আগ্রহীও নন। মাজহারুল ইসলাম এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। ন্যাপের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর ন্যাপ ও বাকশাল করার কারণ, গণমানুষের ভাগ্যটা তিনি বদলে দিতে আগ্রহী ছিলেন। জীবনযাপনে রুচিতে খাঁটি বুর্জোয়া হলেও গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তনটা অন্তর থেকেই চাইতেন। বাংলাদেশ আন্দোলনে যে-কারণে সক্রিয় ভূমিকাও রেখেছিলেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগে যোগদানের কারণ তখন বাম দলগুলো খন্ড-বিখন্ড। তাদের দ্বারা বড় ধরনের কাজ সম্ভব ছিল না। আওয়ামী লীগকে তাঁর গণমানুষের দল, গণতান্ত্রিক দল মনে হয়েছিল। শেখ হাসিনা তাঁকে উপদেষ্টা পরিষদেও রেখেছিলেন। তবে আমি নিশ্চিত, উপদেষ্টামন্ডলীকে কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখনো হয় না।

মাজহারুল ইসলামের কৃতিত্ব এককভাবে তিনি আমাদের দেশে স্থাপত্য ঐতিহ্য সৃষ্টিতে অবদান রেখেছেন। স্থাপত্যকলার এবং পেশাগত বিকাশে অবদান রেখেছেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে গণমানুষের কথাও ভেবেছেন, তাদের জন্য কাজ করেছেন। গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছেন। এখনো এসব বিষয়ে স্থপতিরা সম্পৃক্ত নন। দেশের সমস্যা তাঁদের আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু মাজহারুল ইসলামের কাছে সেটি ছিল প্রধান আলোচ্য। এজন্য মাজহারুল ইসলাম অন্যান্য স্থপতি থেকে আলাদা। এ-কারণেই তিনি মাজহারুল ইসলাম। আমাদের কাছে প্রণম্য একটি নাম।