‘…কোন বাঁকে কোন ধন দেখাবে -’

শেফালী মৈত্র

ভূগোল, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং খানাপিনা সব তথ্যই  ভ্রমণ-অনুষঙ্গে যাঁর ভা-ারে মজুদ থাকত তিনি হলেন প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য (প্রদ্যুম্নদা)। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে বারবার কেন লাইব্রেরিতে যেতেন বুঝতাম না। প্রায়ই বলতেন, ‘অমুক সময়ের গেজেট পড়তে যাচ্ছি।’ পড়া তো কেবল বিশুদ্ধ পড়া নয়, বিস্তারিত নোট করাও। যারা গুজব রটাত ছোটবেলায় তাদের বলতাম গেজেট – ‘গেজেটে’ ঠিক কী থাকে তা জানা ছিল না, জানলাম প্রদ্যুম্নদার কাছে।

টুকরো টুকরো পরিসংখ্যান আর তথ্য জানা নয় – ঋতুর বৈশিষ্ট্য, হাওয়ার গতি, শুক্লপক্ষ আর কৃষ্ণপক্ষে নির্বাচিত স্থানের দৃশ্যপট-পরিবর্তন না জানা থাকলে ভ্রমণসূচির তথ্যভিত্তি যে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ক্যালেন্ডারের ছুটির দিনগুলোর সঙ্গে শনি-রবি এবং ক্যাজুয়াল লিভ জুড়ে পাঁচ-ছদিনের জন্য কোথাও একটা ঘুরে আসা, এহেন কেজো ‘অবকাশ’ যাপনে প্রদ্যুম্নদার বিশেষ আপত্তি। সেকালে স্কুল-কলেজের শিক্ষকতার অন্যতম আকর্ষণ ছিল দীর্ঘ গ্রীষ্মাবকাশ, আর একমাস পুজোর ছুটি। এই সুযোগ প্রদ্যুম্নদা ও তাঁর স্ত্রী সুতপাদি উভয়েরই ছিল। তাই কোথাও যেতে হলে পূর্ণিমা অথবা অমাবস্যার তিথি নির্বাচন করে সেই মোতাবেক পরিকল্পনা করাও সম্ভব ছিল।

ঋতু ও তিথি অনুযায়ী ভ্রমণের উপযুক্ত কালপর্ব নির্বাচন করলেও সে-তথ্য পর্যাপ্ত নয়, আরো অনুপুঙ্খ অনুসন্ধানের প্রয়োজন। নির্বাচিত স্থানটি দেখার উপযুক্ত মুহূর্তটি কী – সূর্যোদয় নাকি সূর্যাস্ত, অথবা চাঁদনি রাত? এমনও হতে পারে, স্থানটির বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ এবং সবগুলোই দর্শনীয়, যেমন খাজুরাহোর মন্দির। দিনভর দেখতে হয়। আবার ঊষাকালে কোনারকের মন্দির এক অন্য মাত্রা পায়। ভাদ্র মাসে লক্ষেনŠর সূর্যাস্ত, অসামান্য তার বৈভব। কথায় বলে, ‘শাম-এ-অবধ’। পূর্ণিমা রাতে তাজমহলের দৃশ্য সর্বজনবন্দিত।

কাঙিক্ষত লগ্নে কোথাও উপস্থিত থাকতে গেলে চাই বহুমাত্রিক আয়োজন। সকালে ঘুরে নিয়ে বিকেলেই ট্রেন ধরার পরিকল্পনা থাকলে চাঁদনি রাত আর দেখা হবে না। কোনো স্থানে রাত্রিবাস করলেও অকুস্থলে যাওয়ার ব্যবস্থা নাও থাকতে পারে – হতে পারে যানবাহন নেই বা থাকার আস্তানা দূরে, বা ওই পথটুকু যাওয়া অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। ফতেহপুর সিক্রি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। আগ্রার তাজমহল আর ফতেহপুর সিক্রি একই যাত্রায় দেখে আসাটাই রেওয়াজ। ফতেহপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজা, যোধাবাইয়ের বাসগৃহ, সেলিম চিশতির সমাধির শ্বেতপাথরের জাফরির কাজ – যাকেই প্রশ্ন করি, বলেন, ‘দিনের আলোয় দেখেছি, রাত্রে দেখিনি।’ প্রদ্যুম্নদা কিন্তু ওখানে সুতপাদিকে নিয়ে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে গল্প শুনে মনে হলো একটু বেশি ঝুঁকি হয়তো নেওয়া হয়েছিল – জায়গাটা রাতে খুব নিরাপদ নয়।

দিন-রাতের বিচিত্র স্বাদ পেতে গেলে বলা বাহুল্য, ভ্রমণগাইডে সূচিত রাত্রিবাসের ঠিকানার বাইরে বিকল্প ডেরা খুঁজতে হয় – কখনো আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের অতিথিশালা, কখনো বন দপ্তরের ব্যবস্থাপনা অথবা জল বিভাগের গেস্ট হাউস, সার্কিট হাউসও হতে পারে, হতে পারে আশ্রম। আমরা কৌশানী যাওয়ার আগে প্রদ্যুম্নদা পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘তোমরা গান্ধী আশ্রমে থাকতে পারো, ১৯২৯ সালে গান্ধী ওখানে দু-সপ্তাহ ছিলেন।’ গিয়ে দেখলাম আশ্রমটি ভারি চমৎকার জায়গায় অবস্থিত।

কোথা থেকে পেতেন এত খবর? কলেজে পড়ানোর দায়িত্ব সামলে কী করেই-বা এতগুলো শহরে থাকার ব্যবস্থা করে ছুটি কাটাতে যেতেন প্রদ্যুম্নদা? বর্তমান অনলাইন বুকিংয়ের যুগে অবিশ্বাস্য লাগবে ভাবতে – অনলাইন ব্যবস্থা যখন ছিল না মানুষ কী করত। বেড়ানোর তাগিদে এত পরিশ্রম কী করে সম্ভব ছিল? হয় চিঠি লিখে, নয় বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে ঘুরে ঘর বুক করা, কাউন্টার খোলার আগে রেলের রিজারভেশনের জন্য লাইন দেওয়া – কিছুদিন পরে আবার লাইনে দাঁড়িয়ে ফেরার টিকিট করা। টেলিফোনে কোনো কাজই হওয়ার উপায় ছিল না। অনেক বাড়িতে ফোন থাকলেও কার্যকর ফোন প্রায় ছিলই না – ওই যন্ত্রটা ঘরের শোভা হয়েই থাকত।

১৯৮৪ সালের ১৭ অক্টোবর কনখল থেকে প্রদ্যুম্নদা চিঠি লিখছেন, ৬ অক্টোবর দিলিস্ন পৌঁছেছেন। তারপর আগ্রা, ফতেহপুর সিক্রি, ভরতপুর, বৃন্দাবন ঘুরে কনখল এসেছেন। এখান থেকে আরো কিছুদিন ঘুরে ২২ অক্টোবর কলকাতায় ফিরবেন। এই দীর্ঘ ভ্রমণসূচির কথা শুনে লোকে বলবে, ‘শুনেই ক্লান্ত লাগছে।’ প্রদ্যুম্নদা কিন্তু কনখল পৌঁছে ক্লান্ত নন। এগারো দিন ঘোরাঘুরি করার পরও বিপুল উৎসাহে হরিদ্বার, ঋষিকেশের মন্দির দেখে বেড়াচ্ছেন আর মজা করে আমাকে চিঠিতে লিখছেন – ‘…একটা ব্যাপার বড়ো তাজ্জব : এখানকার মন্দিরে মন্দিরে যত কৃষ্ণমূর্তি দেখছি সবই ধবধবে ফর্সা। আজ সপ্তঋষিতে একটি শ্বেতাঙ্গ গোপালমূর্তি দেখে বুঝে নিয়েছি, এ-ও বিজ্ঞাপনের মাহাত্ম্য। কৃষ্ণ ঠাকুর, ফিল্মস্টারদের মতন, ছোটোবেলা থেকে লাক্স টয়লেট সাবান মেখে-মেখে দিব্যি ফর্সা হয়ে গেছেন।’ (‘পুরানো আখরগুলি, শেফালী মৈত্রকে লেখা প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের চিঠিপত্র’, এবং মুশায়েরা, কলকাতা, ২০১৭, পৃ ৮৮)

মন্দির-স্থাপত্য বিষয়ে প্রদ্যুম্নদার বিশেষ আগ্রহ ছিল। আমাদের দেশের দাক্ষিণাত্যের মন্দির সম্বন্ধে তাঁর প্রগাঢ় পা–ত্য ছিল, বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের পরিচয়ও অজানা নয়, বিশেষ করে বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলোর বৈশিষ্ট্য। তাঁর বিশেষ বন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন অমলেন্দু মুখোপাধ্যায়, যিনি পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগের উচ্চপদস্থ আধিকারিক হয়েছিলেন। বিষ্ণুপুরের ওপর যৌথভাবে একটা বড়মাপের গবেষণার কাজ হাতে নিয়ে তাঁরা ধারাবাহিকভাবে ক্ষেত্রসমীক্ষা করেন, যার ভিত্তিতে প্রদ্যুম্নদা এক সময় অনেকটা লিখেও ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত মুদ্রিত হওয়ার আগেই লেখাটি হারিয়ে যায়।

বিষ্ণুপুর যাওয়ার আগে প্রদ্যুম্নদা আমাকে বিষ্ণুপুর মন্দিরের ওপর লেখা অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইটি পড়তে বলেছিলেন। মন্দিরগুলোর গঠনশৈলীর সংক্ষেপ্ত পরিচয় দিয়ে জানিয়েছিলেন ট্যুরিস্ট লজ থেকে হেঁটে কোন কোনগুলো দেখা যাবে। চেয়েছিলেন ভোরে উঠে অবশ্যই যেন লালবাঁধের দিকে হাঁটতে যাই – ওদিকে গেলে প্রাচীন সব শালগাছ দেখা যাবে। সূর্যোদয় দেখারও প্রকৃষ্ট স্থান ওইটি। একবার কোনারক মন্দির গাত্রের ছবিসংবলিত পোস্টকার্ডের একটি প্যাকেট উপহার পেয়েছিলাম। ছবি দেখে প্রদ্যুম্নদা বলে দিতে পারলেন কোনটা মন্দিরের কোন দেয়ালের ছবি। মনে মনে ওঁর পা–ত্যকে কুর্নিশ জানালাম। কোনারকের সূর্যমন্দির ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়। বলতেন, ‘পুরী থেকে কোনারক একদিনে ঘুরে চলে এলে হবে না, ওখানে থেকে দিনের বিভিন্ন সময়ে মন্দির দেখতে হবে।’ মূর্তি দেখার চোখ কি বই পড়ে তৈরি হতে পারে? মনে হয় না। এটি গুরুমুখী বিদ্যাও নয়। সংবেদনশীল মনের অধিকারী না-হলে মূর্তির বিমূর্ত মাত্রা অধরা থেকে যায়। রোদ্যাঁর নটরাজ মূর্তি দেখার বিষয়ে প্রদ্যুম্নদা যা লিখেছেন সেই একই কথা প্রদ্যুম্নদার মূর্তি দেখার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি লিখছেন – ‘ব্রন্জের নটরাজকে তিনি শুধু চোখে দেখছেন না; সমস্ত চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দেখছেন; সমস্ত আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখছেন। এমনকি, নটরাজের নিশ্বাসের সুগন্ধও ধরা পড়ে রোদ্যাঁর তীক্ষ্ণ তীব্র সংবেদনে’ (রোদ্যাঁ : নটরাজ, তরজমা ও টীকা প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ২০০৫, পৃ ৪০)।

উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আলোচনাসভায় যাচ্ছি জেনে প্রদ্যুম্নদা বললেন, ‘ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির যাবে নিশ্চয়?’ আনাড়ির মত উত্তর দিলাম, ‘ওটা তো আমার দেখা।’ জানতে চাইলেন মন্দিরের গণেশমূর্তিটি খুঁটিয়ে দেখেছি কিনা। খুঁটিয়ে দেখা! আমি তো ওটা মনেই করতে পারছি না। পুজো দেওয়ার জন্য লোকে বারবার লিঙ্গরাজ মন্দিরে যায়। মন্দির ‘দেখার’ জন্য একাধিকবার কেন যেতে হবে? প্রদ্যুম্নদা ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের ওপর লেখা মোটা মোটা সচিত্র বই নামিয়ে একের পর এক ছবি দেখিয়ে মন্দির সম্বন্ধে বলতে লাগলেন – আকৃষ্ট না হয়ে পারলাম না। বলার ভঙ্গির মধ্যে একটা স্নিগ্ধতা ছিল – একজন প্রবীণ অধ্যাপক তাঁর অর্বাচীন ছাত্রীকে পাঠদান করছেন মনে হয়নি। মনে হলো তাঁর আস্বাদিত অভিজ্ঞতার রসে আমাকেও সিঞ্চিত করতে চাইছেন – এ-স্বাদ থেকে যেন বঞ্চিত না হই, এ-রসে যেন অবগাহন করতে পারি।

ভুবনেশ্বরের রাজারানি মন্দিরও যে অবশ্য দ্রষ্টব্য আগে জানতাম না। আমার মূঢ়তা আরো একবার প্রকাশ পেল, যখন জানতে চাইলাম, ‘দেব-দেবীর নয়, রাজা ও রানির মন্দির!’ জানলাম পুরনো ভুবনেশ্বরে টঙ্কপানি রোডে অবস্থিত এই মন্দিরে বর্তমানে কোনো বিগ্রহ নেই, পুজো হয় না। সে-কারণেই হয়তো দর্শনার্থী এতো কম।
আমরা গেছিলাম শীতের ভোরে, ফিরে এসে স্নান সেরে সেমিনারে উপস্থিত হতে হবে যে। মন্দিরটি খুব উঁচু নয় – বড় চত্বরে ছড়ানো। ইমারতটি তৈরি হয়েছে লালচে সোনালি পাথর দিয়ে। শীতের সোনারোদে তার বাহার যেন আরো খুলেছে। মন্দির গাত্রে নিখুঁত খোদাই করা সব মূর্তি। বলা হয় এটি কারুকার্যের দিক থেকে ওড়িশার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মন্দির। ওই লালচে সোনালি পাথরকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘রাজারানিয়া’। সেই থেকে মন্দিরের এই নামকরণ – রাজা ও রানির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই।

আমরা জানি পুরী গেলে মন্দিরের খাজা-গজা শুকনো প্রসাদ সবার জন্য আনতে হয়। অনেকে আমরা পোড়াপিঠার সন্ধান জানি না। এটি অনেকটা বেক্ড রসগোল্লার ঢঙে তৈরি বেক্ড মাখাসন্দেশের মতো। ইদানীং কলকাতার কয়েকটি দোকানে পাওয়া গেলেও আশির দশকে এ-মিষ্টির কথা আমার জানা ছিল না, অথচ প্রদ্যুম্নদা জানতেন। আরো অনেক স্থানীয় খাবারের খোঁজ রাখতেন। হাজারিবাগ রোডে পলাশের সবুজ পাতার পাত্রে পেড়া খাওয়ার বিবরণ শুনে প্রদ্যুম্নদা আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন, ‘আরে! এখনও ওভাবে পেড়া বিক্রি হয়?’ ছেলেবেলায় বিহারে থাকার কথা হয়তো মনে পড়ে গেল।

বাংলা-বিহার-ওড়িশার খাদ্যাখাদ্যের তালিকার মধ্যে প্রদ্যুম্নদার জ্ঞানভাণ্ডার সীমিত ছিল না। লক্ষেনৌর কাবাব, বিরিয়ানি, কুলফিরও যথেষ্ট সমঝদার ছিলেন। কন্টিনেন্টাল খানাপিনা পরখ করে দেখার আগ্রহও কম ছিল না। গল্প-উপন্যাসে পড়া নানা কিসিমের বিদেশি খাবারের রন্ধনপ্রণালি সম্বন্ধে ছিল বিশেষ কৌতূহল। একদিন জানতে চাইলেন ‘সিনামান টোস্ট’ জিনিসটা কী। যখন জানলেন ওটা ফ্রেঞ্চ টোস্টেরই রকমফের, তখন বললেন, ‘আমি ভেবেছিলাম না জানি কী – ডিম আর দুধ গোলার মধ্যে পাউরুটি ফেলে ভাজা, আর ওপরে চিনি আর দারুচিনির গুঁড়ো ছড়ানো – শুধু এই?’ দিলিস্নর সোহন হালুয়া এনে খাইয়েছিলেন। লক্ষেনৌর গজক আর পাতিসা খেতে ভালবাসতেন, আর অবশ্যই মালাইপান। মালাইপানটা দুধের মিষ্টি, তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ওটা আনা যায় না।

ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যখন আলমোড়া যাই, প্রদ্যুম্নদার ফরমায়েশ ছিল যেন ওখান থেকে বালমিঠাই আর শিংওড়ি নিয়ে আসি। বালমিঠাই হলো খোয়াক্ষীর আর চিনি দিয়ে পাক দেওয়া চকোলেট রঙের মিষ্টি, তার গায়ে চিনি আর রামদানার আবরণ। শিংওড়ি কলাকান্দ জাতীয় মিষ্টি, মালু পাতায় জড়িয়ে বিক্রি করে। মালু পাতাটা কাঞ্চনজাতীয় পাতা। কাঞ্চনের এই প্রজাতি জঙ্গলে আপনি হয়, এটা লতানে কাঞ্চন। স্থানীয় মানুষেরা এটাকে নানাভাবে ব্যবহার করে – পশুখাদ্য হিসেবে পাতাগুলো ব্যবহার হয়, মিষ্টির মোড়ক হিসেবেও ব্যবহার হয়। প্রদ্যুম্নদা খাদ্যরসিক হলেও স্বল্পাহারী। খোলামনে দেশ-বিদেশের রান্নার স্বাদ গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন। সুতপাদির রান্নার কদর করতে পারতেন। বিচিত্র উপাদানের অপ্রচলিত মিশ্রণে অভিনব পদ সৃষ্টিতে সুতপাদির জুড়ি নেই।

প্রদ্যুম্নদা খেতে ভালবাসলেও ওঁর পক্ষে হাত না-ধুয়ে খাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। আশির দশকের শেষে সুতপাদি আর প্রদ্যুম্নদার সঙ্গে হুগলি জেলার পা-ুয়া ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। সকাল দশটা তিরিশ নাগাদ হাওড়া পৌঁছলাম, আধ ঘণ্টা পরে ট্রেন। টিকিট কেটে পস্ন্যাটফর্মে বসে অপেক্ষা করছি, খানিক পরে, কাউকে কিছু না-বলে, প্রদ্যুম্নদা কোথায় চলে গেলেন। এদিক-ওদিক খোঁজার পর একটা সময় দূরে দেখা গেল ঝোলা কাঁধে, বড় ছাতা হাতে দুলিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এ-দোকান সে-দোকান ঘুরছেন। সমস্যাটা সুতপাদি ঠিক বুঝেছিলেন, বললেন, ‘সাবান ফেলে এসেছে, তাই উৎকণ্ঠা, সাবান খুঁজছে।’ ফিরে এলেন, মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। মার্গো সাবান পেয়েছেন – যে-কোনো সাবানে তো জীবাণু যাবে না। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের চল তখনো শুরু হয়নি, সাবান পাতাও পাওয়া যেত না। প্রদ্যুম্নদার ব্যাগে থাকত আস্ত একটা হাত-ধোয়ার সাবান।

পা-ুয়ায় দেখতে গেছিলাম বাংলায় খিলজি বংশের একটুকরো ইতিহাস, যার কিছু নিদর্শন এখনো ওখানে অবশিষ্ট আছে। পাঁচতলা মিনার আর বড়ি মসজিদ দেখতে গিয়ে দেখলাম, ‘চোরকাঁটাতে মাঠ গিয়েছে ঢেকে।’ চোরকাঁটার চোরা আক্রমণ বেশ পীড়াদায়ক। পস্ন্যাটফর্মে বসে, ফেরার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার সময়, মনোযোগ দিয়ে তিনজনেই চোরকাঁটা ছাড়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকলাম।

মাদ্রাজ (চেন্নাই) থেকে মহাবলিপুরমে গিয়ে এক রাত্তির বাস করিনি জেনে হতাশ হয়েছিলেন প্রদ্যুম্নদা। কলেজের একটা বড় দল নিয়ে সেটা সম্ভবও ছিল না। বাস থামিয়ে আধ ঘণ্টা বা বড়জোর পঁয়তালিস্নশ মিনিটে কয়েকটা ছবি তোলা ছাড়া আর কী-বা করা যায়? কিন্তু স্থাপত্যটির প্রতি এ-যে কত বড় অবিচার! ৬৪০ সালে খোদাই করা সহস্রাব্দ-প্রাচীন এই মাপের রিলিফ বা পাথরের প্যানেল পৃথিবীর কোথাও নেই – তার দৈর্ঘ্য নববই ফুট আর উচ্চতা চলিস্নশ ফুট। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকার অন্তর্ভুক্ত এই কাজ নিঃসন্দেহে আমাদের কাছ থেকে আরো অনেক মনোযোগ ও শ্রদ্ধার দাবি রাখে। প্যানেলটির একশ ছাবিবশটি মূর্তি দিয়ে গাঁথা গল্পের কেন্দ্রে আছে অর্জুন ও শিব – মতান্তরে ভগীরথ ও শিব। প্রদ্যুম্নদার মতে অবশ্য ওটি অর্জুনের রিলিফ। একপায়ে দাঁড়িয়ে অর্জুন পশুপতি অস্ত্রের জন্য তপস্যা করছেন, পাশে শিবের আশীর্বাদী হাত প্রসারিত।

বুড়ি ছুঁয়ে আসার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল মাদ্রাজ জাদুঘরের নটরাজ সংগ্রহশালা দেখতে গিয়ে। ওখানেও বড়জোর আধ ঘণ্টা ছিলাম। এমন গর্হিত আচরণের সংবাদ পেয়ে মুখ কালো করে নীরব থাকা ছাড়া প্রদ্যুম্নদার আর কীই-বা করার ছিল।

কোথাও যাওয়ার আগে প্রদ্যুম্নদা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভ্রমণসূচি জানতে চাইতেন – কোনো পরামর্শ সংযোজন করার হলে করতেন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন জানার জন্য যে, ভ্রমণ-পরিকল্পনা অনুযায়ী হল কিনা, পথে কোনো অসুবিধা হলো কিনা। কেউ কোথাও গেলে আনন্দিত হতেন, ফিরে না-আসা অবধি একটা চাপা উদ্বেগও
থাকত। মানুষটাই যে ছিলেন বড় দরদি। কলকাতায় ফিরে এলে বলতেন, ‘একদিন এসো, গল্প শুনব।’ অনেকটা সময় নিয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে, চলত গল্প শোনার পালা। বোঝা যেত বক্তার সঙ্গে একান্ত হয়ে তিনিও যেন মানসভ্রমণরত। ডিসেম্বর ১৯৮৯-এর একটা চিঠিতে আমাকে লিখছেন – ‘…প–চেরি থেকে ফিরে এত চুপচাপ কেন? – …মহাবলীপুরম কেমন লাগল? মাদ্রাজ মিউজিয়ামের নটরাজ? অমরাবতীর পাথরফলক? ঐ ভাস্কর্যে, ঐ স্থাপত্যে এমন কিছু আছে, যা শুধু সুষমা নয়; যা বাঁচার ভঙ্গি, রূপ।’

(পুরানো আখরগুলি, পৃ ১০৮)

যে মনঃসংযোগ আর পরিশ্রমের সঙ্গে নিজের ভ্রমণের পূর্বপরিকল্পনা করতেন, ভ্রমণবিষয়ে পরামর্শ চাইতে গেলে প্রদ্যুম্নদা অনুরূপ একাগ্রতার সঙ্গেই তথ্য সংকলন করে দিতেন। ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসের শেষে যাদবপুরের দর্শন বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নৈনিতাল যাওয়া স্থির হলে প্রদ্যম্নদার শরণাপন্ন হলাম। সাগ্রহে তথ্য সংগ্রহ করে দিলেন। সেবার পুরো বেড়ানোটাই তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী হয়েছিল।

ছাবিবশজন ছাত্রী, তিনজন ছাত্র, দুজন শিক্ষক (মাধবেন্দ্রনাথ মিত্র, অর্থাৎ মাধববাবু আর আমি) মালপত্র নিয়ে হাওড়া স্টেশনে বড় ঘড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছি, একজন অভিভাবক মাধববাবুকে এসে বললেন, ‘ইউ আর অ্যা ব্রেভ ম্যান’। ঠিক হলো ট্রেনে করে প্রথমে যাব লক্ষোনৌ হয়ে কাঠগুদাম, সেখান থেকে বাসে করে নৈনিতাল। ট্রেনে কে কোথায় শোবে, সে-বিষয়ে মাধববাবুর পরিকল্পনা মত দুদিকের দুটো দরজার কাছে স্থান পেল ছাত্ররা। মাধববাবুর কড়া হুকুম, রাতে একদিকের দরজা যেন খোলা না হয়, আর যেদিকের দরজা দিয়ে যাত্রীরা ওঠানামা করবে, সেদিকের নিচের দুটি মুখোমুখি বার্থে মাধববাবুর আর আমার শোয়ার ব্যবস্থা হলো। সবচেয়ে ক্ষীণজীবী ছাত্রীটিকে আমার দিকের মাঝের বার্থে দেওয়া হল। দ্বিতীয় দিন রাত্তির দুটো নাগাদ ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার আর মাধববাবুর বার্থের মাঝে দাঁড়িয়ে সাফারি স্যুট-পরা পঞ্চাশোর্ধ্ব একটি লোক আলোর সুইচ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। আর মাধববাবু নিজের বার্থে ঘাড় নিচু করে কোনোরকমে বসে জিজ্ঞেস করছেন, ‘হোয়াট ইজ দ্য প্রবলেম? হোয়াট ইজ দ্য প্রবলেম?’ ট্রেন তখন স্টেশনে ঢুকছে। লোকটি কোনো উত্তর না দিয়ে, ব্রিফকেস হাতে নিয়ে, ধীরপায়ে ট্রেন থেকে নেমে গেল। প্রসঙ্গত বলে রাখি, মাধববাবুর আরেকটি পরিচয়, তিনি সাইকোলজিক্যাল কাউনসেলিং করেন। সবিস্ময়ে জানতে চাইলাম, ‘কী হয়েছে?’ ‘আরে, লোকটা আগের স্টেশনে উঠেছে; উঠে দুটো বার্থের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তোমার উপরে যে-ছাত্রীটি শুয়েছে, তার গায়ে হাত বোলাচ্ছিল।’ বললাম, ‘আপনি ধমকও দিলেন না, তিরস্কারও করলেন না’, শুধু চেম্বারে ক্লায়েন্ট দেখার মতন শান্তভাবে জানতে চাইলেন, ‘হোয়াট ইজ দ্য প্রবলেম!’ কলকাতায় ফিরে যখন এই গল্পটা বললাম, হাসতে হাসতে প্রদ্যুম্নদার চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।

প্রদ্যুম্নদা বলে দিয়েছিলেন, ‘লক্ষনৌ থেকে কাঠগুদামের দূরত্ব দুশো একচলিস্নশ মাইল, কাঠগুদাম থেকে নৈনিতাল বাইশ মাইল। ট্রেন রাত্তির ন-টা পঞ্চান্ন মিনিটে লক্ষেনৌ থেকে ছাড়ে। মিটারগেজ লাইন। সকাল সাতটায় কাঠগুদাম পৌঁছায়। সকাল ছ-টা নাগাদ পথে একটা স্টেশন পড়ে, লালকুঁয়া। এখানকার জিলিপি সুস্বাদু, খাওয়া আবশ্যিক।’ সঙ্গে একটা খসড়া মানচিত্র এঁকে দিয়েছিলেন। তাতে সংযুক্ত করলেন নাতিদীর্ঘ একটি টীকা – সীতাপুরের চিনিকল বিখ্যাত। কাঠগুদামের পাউরুটি স্থানীয় ময়দা দিয়ে তৈরি, অতিসুস্বাদু।

বর্তমানে নৈনিতালের দিগন্তচিত্র যে আমূল বদল হয়েছে তা-ও জানলাম প্রদ্যুম্নদার করা নোট থেকে, মুরের হ্যান্ডবুকের ওপর খুবই নির্ভর করতেন তিনি – A Handbook  for Travellers in India, Burma and Ceylon, John Murray, Thacker, Spink & Company, Calcutta, 1911. হ্যান্ডবুকে লেখা আছে ১৮৪১ সালে নৈনিতাল শহরের পত্তন হয়, তাল মানে সরোবর। তার প্রায় চলিস্নশ বছর পরে ১৮৮০ সালে একটি ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। তিনদিনে অবিশ্রান্ত তেত্রিশ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। সরোবরের উত্তর দিকে ভিক্টোরিয়া হোটেলের পেছন দিকে বড় পাহাড়ে ধস নামে। কিছু লোক মাটিচাপা পড়ে। সকাল দশটা নাগাদ উদ্ধারকাজ শুরু হয়। বেলা এগারোটা নাগাদ দ্বিতীয় ধসটি নামে। এবার ভিক্টোরিয়া হোটেল, লাইব্রেরি এবং উদ্ধারকারী দলের সবাই মাটিচাপা পড়ে। এতো বড় ভূমিধস থেকে কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উত্তরের পাহাড়ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। নৈনিতালের আশপাশে ছোট-বড় অনেকগুলো তাল আছে। প্রতিটি তালের দৃশ্য অতি মনোরম – ঘুরে দেখার মত। প্রদ্যুম্নদা ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে কোন ক্রমানুসারে ঘুরলে সব তাল একদিনে দেখা যায় – ভীমতাল, নৌকুচিয়াতাল, মালওয়াতাল, সাততাল আর খুরপাতাল।

নৈনিতাল শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে হনুমানগড়ি। এখানে নিমকারোলি বাবার মন্দির। মন্দিরের প্রতি আকর্ষণ না থাকলেও সূর্যোদয় আর সূর্যাসেন্তর শোভা উপভোগ করার জন্য যাওয়া উচিত। শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে ল্যান্ডস এন্ড, সেটিও অবশ্য দ্রষ্টব্যস্থল – নিচের সমতলভূমির সুন্দর দৃশ্য এখান থেকে দেখা যায়, পাইন বনে বেষ্টিত খুরপাতালও ভালভাবে দেখা যায়।

প্রদ্যুম্নদা চেয়েছিলেন আমরা নৈনিতাল থেকে রামগড়ে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য স্নো ভিউ বাড়িটি, ও তার তিনশো বিঘের ফলের বাগান দেখে আসি। নৈনিতাল থেকে মাত্র একুশ মাইল দূরে রামগড়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরের বছর, ১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথ রামগড়ে এসেছিলেন। স্নো ভিউ বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন হৈমমত্মী। ওই শিরোনামে ওঁর ছোটগল্পটিও এখানেই লেখা (দ্রষ্টব্য ‘হৈমমত্মী’, গল্পগুচ্ছ, তৃতীয় খন্ড)। একটি বিলাসবহুল গেস্ট হাউসরূপে স্নো ভিউ আজো সুরক্ষেত। গীতিমাল্যের নয়টি কবিতা এই সময় রামগড়ে বসেই লেখা। রামগড় থেকে ফেরার পথে কবি লক্ষেনৌতে অতুলপ্রসাদ সেনের সঙ্গে দেখা করেন।

নৈনিতাল থেকে আমাদের পরের গন্তব্য আলমোড়া ও তারপর কৌশানী। ফেরার পথে রানিক্ষেত হয়ে আবার নৈনিতাল। উত্তরাখন্ড তখনো গঠিত হয়নি। এই জায়গাগুলো সবই ছিল উত্তরপ্রদেশের অংশ, যদিও কুমায়ুন আর গাড়ওয়ালের মধ্যে ভাগ ছিল। প্রদ্যুম্নদা বলে দিয়েছিলেন কুমায়ুনের তিনটি জেলা – নৈনিতাল, আলমোড়া ও পিথোরাগড়। গাড়ওয়ালের অন্তর্ভুক্ত তেহেরি গাড়ওয়াল, পাওড়ি, চামোলি আর উত্তরকাশী।

১৫৬০ সালে চাঁদ রাজবংশের ভীষ্মচাঁদ খাগমারা পাহাড়কে নির্বাচন করে আলমোড়া নামে তাঁর নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। ১৮১৫ সাল থেকে কুমায়ুন ব্রিটিশদের অধীনে আসে। আলমোড়া বহন করে চলেছে চারশো বছরের প্রাচীন ইতিহাস। শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় আলমোড়ার শিক্ষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধ। প্রদ্যুম্নদার তথ্য অনুযায়ী আলমোড়ার সাক্ষরতার হার কেরালা রাজ্যের পরেই।

প্রদ্যুম্নদা বলে দিয়েছিলেন, ‘আলমোড়ায় বৃষ্টি হয় কম। পাহাড় রুক্ষ – আলোছায়ার খেলা খুব স্পষ্ট – বিনোদবিহারীর আঁকা ছবি মনে পড়ে। এখানকার পুরনো বাড়ির কাঠের কারুকার্য দেখার মত। আলমোড়াতে একটা ছোট্ট সমতলভূমি আছে, ঠিক পাহাড়ের মাথায়, বাজার সেখানেই বসে। আলমোড়ার মিষ্টি বিখ্যাত, বিশেষ করে বালমিঠাই ও শিংওড়ি। এছাড়া বাসস্টপের কাছে পাঞ্জাবি হোটেলে ভাল মাংস পাওয়া যায়। ট্যুরিস্ট লজের খাবার দুর্মূল্য তবে রুটি আর ডাল সুস্বাদু।’

আলমোড়া থেকে দু-কিলোমিটার দূরে ব্রাইট এন্ড কর্নার – রামকৃষ্ণ কুটিরের কাছে বীক্ষণমঞ্চ। এখান থেকে শৈল শিখরগুল প্রায় সবগুলো দেখা যায়। আলমোড়া থেকে কোশী বাস যায়। কোশীতে নেমে কিছুটা পাহাড়ে উঠে একটা অনবদ্য সূর্যমন্দির আছে (কটরমল সূর্যমন্দির, নবম খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত)। প্রায় তিরিশ বছর আগে প্রদ্যুম্নদা এই মন্দিরে যাওয়ার সহজ উপায় বলে দিলেন কী করে? বর্তমানে ইন্টারনেট ঘাঁটলে দেখা যায় বস্নগাররা বলছে কটরমল মন্দিরের কথা কম লোকই জানে এবং ওখানে পৌঁছানো কঠিন।

আলমোড়া অঞ্চলটি বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির সঙ্গে এমন সম্পর্কিত যে, ওখানে যাওয়াটাই একটা রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। ১৮৯০ সালে বিবেকানন্দ নৈনিতাল থেকে আলমোড়ার ষাট কিলোমিটার পথ হেঁটে গিয়েছিলেন। এই যাত্রায় তিনি কাকোরিঘাটে রাতযাপন করেন। এখানেই তাঁর বিশেষ দিব্যজ্ঞান লাভ হয় – তিনি উপলব্ধি করলেন সমগ্র বিশ্ব অখ- এবং একই নিয়মে নিয়ন্ত্রিত। তাঁর এই অভিজ্ঞতাকে গৌতম বুদ্ধের বোধিলাভের সঙ্গে তুলনা করা হয়, বলা হয় কাকোরিঘাট হলো বিবেকানন্দের তপস্থলী – কোশী আর সুয়াল নদীর সঙ্গমস্থলে এই স্থান। প্রদ্যুম্নদা জানালেন, ‘কোশীকে আমরা বাংলায় বলি কুশী।’

আলমোড়া থেকে কসরদেবী মন্দির ছয় কিলোমিটার। প্রাচীন মন্দির ও মনোরম দৃশ্য – পুরনো ছাপ অবশ্য অধুনালুপ্ত। এখানে কোনো একটি গুহায় ১৮৯০ সালে বিবেকানন্দ কঠোর তপস্যা করেছিলেন। তুরীয় অবস্থায় পৌঁছানোর পর তাঁর মনে হল বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতা নয়, মানুষের কল্যাণসাধনই তাঁর অভীষ্ট।

দ্বিতীয়বার, ১৮৯৮ সালে একটি দীর্ঘ পরিব্রাজনের অংশ রূপে বিবেকানন্দ আলমোড়া যান – তাঁর যাত্রাসূচিতে ছিল দার্জিলিং, আলমোড়া ও কাশ্মীর। এবার অনেককে নিয়ে যাত্রা করেন – মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের ও বিদেশের শিষ্যদের প্রশিক্ষণ। বিবেকানন্দের সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা, শ্রীমতী ওলি বুল, শ্রীমতী জোসেফিন ম্যাকলাউড, ক্যাপ্টেন ও শ্রীমতী সেভিয়র এবং শ্রীমতী প্যাটারসন। এছাড়া ছিলেন নিরঞ্জনানন্দ, তুরীয়ানন্দ, সদানন্দ ও স্বরূপানন্দ। ভারতীয় সঙ্গীরা ছিলেন টমসন হাউসে, যার এখন ভগ্নদশা। বিদেশিরা ছিলেন ওকল্যান্ড হাউসে, যেটা এখন আলমোড়া ক্লাব। এসবই প্রদ্যুম্নদার দেওয়া তথ্য। এ-ও জানিয়েছিলেন যে, বশী (বশীশ্বর) সেনের বাড়ি আলমোড়ায়। তাঁর বিদেশিনী স্ত্রী গ্যেরট্রুড এমারসন সেন ছিলেন বিবেকানন্দের বিশেষ পরিচিত। সত্তরের দশকে অমৃত পত্রিকায় তাঁদের পত্রালাপ প্রকাশিত হয়।

বিবেকানন্দ ও আলমোড়ার কথা ব্যাখ্যানের পর প্রদ্যুম্নদা রবীন্দ্রনাথ ও আলমোড়ার কথা বললেন। বিবেকানন্দের মতো রবীন্দ্রনাথও দুবার আলমোড়া গিয়েছিলেন এবং তাঁকেও একবার কাঠগুদাম থেকে হেঁটে যেতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মেজমেয়ে রেণুকা (রানী) গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় প্রথমে তাকে হাজারিবাগ ও পরে আলমোড়া নিয়ে যাওয়া হয় ১৯০৩ সালে। বিশেষ জরুরি কাজ থাকায় আলমোড়ায় মেয়েকে রেখে রবীন্দ্রনাথকে কলকাতায় ফিরে আসতে হয়। কলকাতায় আসার পর খবর পান রানীর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। কবি আবার আলমোড়া রওনা হলেন। কাঠগুদামে কোনো যানবাহন পেলেন না। প্রায় সাতষট্টি কিলোমিটার পথ, কাঠগুদাম থেকে আলমোড়া, কবি হেঁটে চলে গেলেন। স্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি না হওয়ায় রানীকে কলকাতায় আনা হলো। ১৯০৩ সালে রানীর মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য, ১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী পরলোকগমন করেন।

আলমোড়ায় বসে কবি নৌকাডুবি উপন্যাস লিখেছিলেন, লিখেছিলেন উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা আর শিশুর কবিতাগুলো। নির্মলকুমারী মহলানবিশকে কবি লিখছেন – ‘আমার মেজ মেয়ে রানীর কথা অনেকবার তোমাকে বলেছি। তার মৃত্যুর সময় তার মা বেঁচে ছিলেন না। সমস্ত অসুখের মধ্যে আমিই তার সেবা করেছিলুম শেষ পর্যন্ত।… সর্বদা তার বাবাকে কাছে চাই। যদিও তার বিয়ে হয়েছিল, তবু তার সমস্ত মন জুড়ে বসে ছিল তার বাবা। আলমোড়াতে যখন তাকে চেঞ্জে নিয়ে যাই, তখন তার অসুখ খুব বেশী। তাকে খুশি রাখার জন্যে রোজ রোজ কবিতা লিখে বিছানার পাশে বসে শোনাতুম, যাতে কিছুক্ষণও অন্তত রোগের যন্ত্রণা ভুলে থাকে। এমনি করে আমার ‘শিশু’ বইখানা লেখা হয়েছে – ও কবিতাগুলো রানীর অসুখের সময় লিখেছিলুম’ (রবীন্দ্র-রচনাবলী, ষোড়শ খ-, গ্রন্থপরিচয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ ২০০)।

মৃণালিনীর মৃত্যুর পরের বছর আলমোড়াতে বসে লেখা উৎসর্গের কবিতা প্রদ্যুম্নদাকে বিশেষ নাড়া দিত। আমাকেও সেই মৃত্যুর পটভূমিকায় লিখিত কবিতাগুলো পড়তে বলেছিলেন, দেখতে বলেছিলেন কীভাবে এই শোককে আন্তস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন রবীন্দ্রনাথ, চাইছেন হিমালয়ের সান্নিধ্যে নিজের অনুভবকে প্রকৃতির মধ্যে মেশাতে, লিখছেন – ‘ওগো তোমার দরশ লাগি/ ওগো তোমার পরশ মাগি/ গুমরে মোর হিয়া।/ রহি রহি পরান ব্যেপে/ আগুন-রেখা কেঁপে কেঁপে/ যায় যে ঝলকিয়া।/ আমার চিত্ত-আকাশ জুড়ে/ বলাকা-দল যাচ্ছে উড়ে/ জানি নে কোন্ দূর-সমুদ্র-পাড়ে’ (‘উৎসর্গ’, রবীন্দ্র-রচনাবলী, দশম খ-, ৩৩ নং কবিতা, বিশ্বভারতী, পৃ ৪৯)।

১৯৩৭-এর আলমোড়া সফরে রবীন্দ্রনাথ কোন কোন কবিতা লিখেছিলেন তার একটা তালিকা করেছিলেন প্রদ্যুম্নদা। সেই তালিকায় ছিল, সানাইয়ের ‘হঠাৎ মিলন’, ‘নারী’, নবজাতকের ‘কা–য় নাচ’ এবং ‘ইস্টিশন’।

প্রদ্যুম্নদা জানাচ্ছেন, ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী ছিলেন প্রতিমা দেবী, নন্দিনী, নন্দিতা ও অনিল চন্দ। এবারে তিনি আলমোড়া ক্যান্টনমেন্টের শৈলশিখরে ‘সেন্ট মার্কস’ নামে বাড়িতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের সাতাত্তরতম জন্মদিনটি এখানেই কাটে। ছড়ার ছবির কিছু কবিতা এখানেই রচিত। বইটি প্রতিমা দেবীকে উৎসর্গ করেছিলেন কবি।

ভ্রমণসূচিতে সাহিত্য ও চিত্রাঙ্কনের অনুষঙ্গ গেঁথে এক সংবেদী নির্দেশিকা রচনা করতে পারতেন প্রদ্যুম্নদা। রাজস্থান যাওয়ার সময় খোঁজ দিয়েছিলেন দুর্লভ মিনিয়েচার পেন্টিংয়ের অপরিচিত ঠিকানার (পুরানো আখরগুলি, পৃ ৩২-৪)। আরো একবার না-জানা সংবাদ পেয়েছিলাম বদোদরা আর আহমেদাবাদ হয়ে সৌরাষ্ট্র যাওয়ার সময়। উনিশ শতকের ভারতীয় চিত্রশিল্পী রাজা রবি বর্মার স্টুডিয়ো এবং ছবির সমৃদ্ধ সম্ভার যে বদোদরার লক্ষ্মীবিলাস প্যালেসে রয়েছে, সে-তথ্য নিজের চেষ্টায় কখনো উদ্ধার করতে পারতাম না। মনে আসত না আহমেদাবাদ ঘোরার সময় সাবরমতী নদীর তীরে শাহিবাগ অঞ্চলটি দেখে আসার কথা, যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলেত যাত্রার পূর্বে ছিলেন ও যেখানে ক্ষুধিত পাষাণ লেখার শুরু।

আলমোড়ার পরের গন্তব্য কৌশানী – তার মনজয়ী নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কথা আগেই শুনেছিলাম। দেখে বুঝলাম এই সৌন্দর্য বর্ণনা করা যায় না। ফিরে আসার পর প্রদ্যুম্নদা জানতে চাইলেন ঠিক কোন জায়গা থেকে সূর্যাস্ত দেখেছি, সূর্যোদয় দেখার জন্য কটার সময় উঠেছি, আকাশ পরিষ্কার ছিল কিনা, সব তুষার শৃঙ্গ দেখা গেল কিনা। যাওয়ার আগে ছবি এঁকে সব শৃঙ্গের নাম লিখে দিয়েছিলেন। ফলে, চিনে নিতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

ফেরার পথে নৈনিতালে দুদিন ছিলাম। একদিন তুমুল ঝড়বৃষ্টি, বজ্রপাতের ফলে বিদ্যুৎবিহীন নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে রইলাম। সেই রাতে এক ছাত্রী হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে – লক্ষণ দেখে মনে হলো হার্টের সমস্যা। লজ থেকে জানানো হলো, ডাক্তারবাবু দূরের পাহাড়ের ওপর থাকেন, রাতে তাঁকে খবর দেওয়া যাবে না, খবর দিলে তিনি আসবেনও না, সকাল অবধি অপেক্ষা করতেই হবে। ছাত্রীটিকে ঘিরে সারারাত অন্ধকারে বসে ভোর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হলো। সকাল হতেই ডাক্তারের কাছে লোক গেল। অনেকক্ষণ পরে সে এসে জানাল, ডাক্তারবাবু এখন আসতে পারবেন না, বেলা দশটার পরে আসবেন। রোববার সকালে টিভিতে রামায়ণ না দেখে বাড়ি থেকে বেরোবেন না। একে কি নেশা বলব? ঠিক নেশা নয়, এ-যেন পবিত্র কর্তব্য। পরে মানালিতেও এ-জিনিস দেখেছি। রোটাংপাস যাওয়ার জন্য বাস যথাসময়ে ছাড়ল; তারপর মিনিট পনেরোর মধ্যে জানা গেল গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। বাস একটি গ্যারেজে ঢুকে পড়ল, সেখানে টিভি আছে। সরকারি বাসের চালক এবং কন্ডাক্টর রামায়ণ দেখে বাসে ফিরল। প্রদ্যুম্নদা এ-ঘটনাগুলো শুনে অবাক হতেন না; দুঃখ পেতেন, চুপ করে মেঝের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকতেন।

১৯৯২ সালে প্রদ্যুম্নদা আর সুতপাদির সঙ্গে আমরা দুজন – ড. রবীন গাঙ্গুলি আর আমি ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ বেড়াতে গিয়েছিলাম। রওনা হওয়ার আগেই প্রদ্যুম্নদা স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, সর্বত্র কুলির ব্যবস্থা যেন থাকে, কোনোরকম মালপত্র তিনি বইতে পারবেন না, বেশি হাঁটাহাঁটিও করতে পারবেন না। তখনই তাঁর শরীর ও মন বিকল হতে শুরু করেছিল। আগে তো এরকম ছিলেন না – সবাই বলত, প্রদ্যুম্নর পায়ের তলায় সর্ষে। আমরাও তাঁকে দেখেছি ক্লেশ স্বীকার করে বছরে দুবার দূর-দূরাস্তে পাড়ি দিতে। পাড়ি দেওয়াটা ছিল যেন দীর্ঘ পালার শেষ অঙ্ক। রওনা হওয়ার আগের প্রস্ত্ততি কোনো দিক দিয়ে কম উপভোগ্য বা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে তাঁর কী প্রগাঢ় কৌতূহল, কী পরিশ্রমী গবেষণা। সেই মানুষ ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ ভ্রমণে নিরুত্তাপ কেন? কোনো প্রস্ত্ততি ছাড়াই রওনা হলেন, এ কোন প্রদ্যুম্নদা!

হয়তো ভ্রমণের পক্ষে ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ স্থান নির্বাচনটাই ঠিক হয়নি। জরা এবং শারীরিক অসামর্থ্যের পটভূমিকায় ম্যাকক্লাসকিগঞ্জের আবহ যেন বেহাগ রাগে বেহালা বাদনের মতো। কবে সেই ১৯৩৩ সালে এখানে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কলোনি গড়ে উঠেছিল, আনুমানিক তিনশো ঘর নয়া বাসিন্দা নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল সারা ভারতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের জমি বিক্রি করে তাদের একটা স্বদেশভূমি পত্তন করার। যেটাকে তারা দাবি করতে পারে নিজস্ব মুলুক বলে, তাদের ভাষায় ‘হোম’। ঘটনাচক্রে বছর চোদ্দো পরে দেশ স্বাধীন হল। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বাসিন্দারা দলে দলে দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর কানাডায় নতুন করে ঘর বাঁধতে চলে গেল। ম্যাকক্লাসকিগঞ্জে তাদের উত্তরপুরুষ কেউ রইল না – হাতেগোনা বাইশ ঘর মতো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এখনো সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়।

মাঠে-ময়দানে ঝোপঝাড়ের মধ্যে পুরনো বাড়িগুলো কত স্মৃতি বুকে নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। ইটের দেয়ালটুকুই অবশিষ্ট রয়েছে – দরজা, জানালা, পাল্লা সব উধাও, জমির সীমা বোঝার উপায়ও নেই। ভগ্নাবশেষের মধ্যে চারপাশে ঘুরলে অদ্ভুত ভুতুড়ে লাগে। এখানে বাড়ি-জমি প্রমোটরের কবলে পড়বে, সে-আশঙ্কাটুকুও নেই – শহরটাই যে পরিত্যক্ত। মনে মনে প্রশ্ন করলাম, কই নালন্দা বা লোথালে ঘুরলে তো মনে হয় না ‘সব ঝুট হ্যায়’। পার্থক্য তাহলে কোথায়? নালন্দায় জড়িয়ে আছে একটা অতীত ঐতিহ্যের অস্মিতা। সেখানে গেলে মনে জাগে অতীতের প্রতি আনত শ্রদ্ধা। ম্যাকক্লাসকিগঞ্জে ঘোরার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বিপরীত। চলিস্নশের দশকে যাঁরা সেখানে গেছেন তাঁদের কাছে শুনেছি সেকালের জৌলুসের কাহিনি। রেলস্টেশন কেমন পরিপাটি সাজানো ছিল। পস্ন্যাটফর্মে ঝোলানো টবে কেমন ফুটে থাকত লাল জেরেনিয়াম। আর রঙিন চাদরে ঢাকা টেবিলে থাকত চা-বিস্কুট, ট্রেন থামলেই সাহেবদের মত ফর্সা ফুটফুটে ছোট মেয়েরা ছুটে আসত ‘টি? টি?’ বলে। সবুজ বনাঞ্চলে মোড়া পাহাড়। তারই কোলে স্টেশন। আজ আর কোনো স্মৃতিচিহ্নও নেই সেই প্রাচীন বৈভবের। হাওড়া থেকে ট্রেন আসে রাত দুটোয়, থামে মাত্র দু-মিনিট। পস্ন্যাটফর্ম এতোই ছোট যে, সিস্নপার কোচটি দাঁড়ায় পস্ন্যাটফর্ম ছাড়িয়ে অন্ধকার লাইনের ওপর, সেখানে কুলির দেখা নেই।

ম্যাকক্লাসকিগঞ্জের ইতিহাস শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের আশীর্বাদধন্য এক জনপদ হিসেবে। এখানকার স্থানীয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের দাপটও সে-কালে ছিল যথেষ্ট। ভাবখানা, ‘বাপ কা বেটা, সিপাহি কা ঘোড়া – কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া।’ ভারতীয় সমাজের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্তি তাদের কখনো ঘটেনি। এ-ব্যাপারে দুপক্ষেরই অবস্থান ছিল অনন্য অশ্রদ্ধার। স্বাভাবিকভাবেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তাদের মধ্যে যারাই সুযোগ পেয়েছিল তারা সব ভিনদেশে চলে গেল – ফেলে গেল ঘর, বাড়ি, বাগান, ক্লাব, নাচঘর আর প্রমোদের বিবিধ উপকরণ। যে-সম্পদ হেলায় ফেলে তারা চলে গেছে উজ্জ্বলতর কোনো বিকল্পের প্রলোভনে, সেই পরিত্যক্ত সম্পত্তির মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় এক অনিকেত সংকর জাতির উপেক্ষেত ইতিহাসের সাক্ষী আমরা। মনে আসছিল সিমন দ্য বোভোয়ার আন্তজীবনীর শেষ খ–র শিরোনামটি – ‘অল সেড অ্যান্ড ডান’।

এমন এক জায়গায় সুতপাদি আর প্রদ্যুম্নদাকে বেড়াতে নিয়ে আসাটা ততটা সুচিবেচনার কাজ হয়তো ছিল না। সুতপাদি তখন গুরুতর অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ করছিলেন আর প্রদ্যুম্নদা একের পর এক শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কাছে পরাজিত হচ্ছিলেন।

অবশ্য ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ বললেই যে শুধু একটা পরিত্যক্ত জনপদের কথা চোখে ভাসে তা নয় – তার আনকোরা নজরকাড়া প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য পথের প্রতি বাঁকেই মুগ্ধ করে। মনে হয়, ‘এলেম নতুন দেশে’। এই সফরে প্রদ্যুম্নদাকে প্রায়ই মনে হতো একটু আনমনা, হয়তো-বা কিছুটা নিস্পৃহ। আমরা যখন চেট্টি নদীর শোভা দেখে মোহিত, জলে পা দেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব, প্রদ্যুম্নদা তখন রাস্তার পাশে মাটিতে হাঁটু তুলে বসে দূরের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠাট্টা করে বলেছিলাম, ‘দেখে মনে হচ্ছে ওয়েটিং ফর গোডো’; মৃদু হাসলেন। প্রথমটা না চাইলেও আমাদের পীড়াপীড়িতে প্যান্ট গুটিয়ে চেট্টি নদীর জলে নামলেন। চোখের ওপর হাত দিয়ে সূর্যকে আড়াল করে চারদিক গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে দেখলেন।

ম্যাকক্লাসকিগঞ্জের সূর্যাসেন্তর বৈশিষ্ট্য হলো আকাশের নরম আগুন-লাল রং এমন করে দিকবলয়ে পড়ে যে, পশ্চিম দিক কোনটা আলাদা করে আর ঠাহর করা যায় না। সে-দৃশ্য প্রলম্বিত বিকেল পেরিয়ে সন্ধে অবধি থাকে। তারপর রাত্তিরের আঁধার ধীরে ধীরে নামে লালচে বেগুনি আকাশে, একটা-দুটো করে তারা দেখা যায়। ম্যাকক্লাসকিগঞ্জের পাথুরে মাটির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বুনো ফুলের গা ঘেঁষে, নদীর অচপল জল দেখে মনে হয় ওয়ার্ডসওয়ার্থ হয়তো এমনি এক অভিজ্ঞতা থেকে একদা লিখেছিলেন : ‘Now thanks to Heaven! that of its grace/ Hath led me to this lonely place.’

জনহীন নিসর্গের স্তব্ধতা প্রদ্যুম্নদাকে যেন আরো অন্তর্মুখী করে তুলেছিল। একদিন দুপুরে বাথরুমে গিয়ে সুতপাদি দেখেন বর্গার ওপরে প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা স্থূলকায় একটি সাপ। সুতপাদির আর্তনাদ শুনে আমরা ছুটে গেলাম, বাগানের মালিও ছুটে এলো। মালি আশ্বস্ত করল, ‘ও কিছু করবে না, নির্বিষ সাপ, এই বাড়ির আশপাশেই থাকে।’ চারপাশের যা পরিবেশ, ওখানে সাপ থাকাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। আশ্চর্যের হলো, প্রদ্যুম্নদা যেমন শুয়ে বিশ্রাম করছিলেন তেমনি শুয়ে থাকলেন। কেন উঠলেন না প্রশ্ন করলে উত্তর দিলেন, ‘বলল তো সাপটা বিষাক্ত নয়, কোনো ভয় নেই’ – অহেতুক লাফঝাঁপ করার লোক তিনি নন।

কিন্তু নিরুদ্বেগ হওয়া আর নিরুত্তাপ থাকা এক নয়। যথেষ্ট উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রদ্যুম্নদা সুতপাদিকে সামলাচ্ছেন এমনও দেখেছি। একদিন ঠিক হলো গাড়ি নিয়ে ম্যাকক্লাসকিগঞ্জের কাছেপিঠে দেখার জায়গা ঘুরে আসা হবে। দেখলাম একই চত্বরে মন্দির, গির্জা আর গুরুদ্বার রয়েছে। এই নির্মাণ নিঃসন্দেহে মহৎ উদ্দেশ্যেই করা, যদিও কোনোটাতেই ঈশ্বর উপাসনার লক্ষণ দেখলাম না। সেদিন দুপুরের খাবার সঙ্গেই ছিল। দামোদর নদের পাশে বসে চড়ুইভাতির উদ্দেশে উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের সময় যখন নদীর চরে হাঁটছি আর ইতিউতি দেখছি, তখন লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে দুই হাফপ্যান্ট পরা কনস্টেবল এসে হাজির, ‘আপলোগ তুরন্ত ইহাঁসে চলে যাইয়ে। ইধর অব ডাকাইতি হোনেওয়ালা হ্যায়।’ ‘হোনেওয়ালা ডাকাইতি’! মানে? অগ্রিম জানা যায় বুঝি? জানা গেল আজ শ্রমিকরা মাইনে পেয়ে নদী পেরিয়ে এ-পথ দিয়ে হাজারিবাগের দিকে বাড়ি যাবে। ডাকাতরা এখানেই ওদের টাকা-পয়সা কেড়ে নেবে। বেলা দুটোর সময় ডাকাতি! জায়গাটা নিরাপদ নয় শুনে কিছুটা দূরে গিয়ে ঢিপির ওপর একটা জায়গা নির্বাচন করে সবাই এগোচ্ছি দেখে প্রদ্যুম্নদা প্রবল আপত্তি করলেন। বললেন, ‘সুতপা পারবে না, ও পড়ে যাবে।’ সুতপাদি ততক্ষণে অনেকটাই উঠে পড়েছিলেন। প্রদ্যুম্নদার সে কি আর্তচিৎকার, ‘সুতপা যেও না, সুতপা পড়ে যাবে।’ অবশেষে পরস্পরের সাহায্য নিয়ে ঢিপির ওপর উঠে সবাই বুঝলাম, ‘গাছের চেয়ে গাছের ছায়া সব রকমেই ভাল।’

ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ ভ্রমণটাই ছিল প্রদ্যুম্নদার শেষ ভ্রমণ। তাঁর ছিল দেশ, দেশের মানুষের বিষয়ে একটি সামগ্রিক বোধ ও লগ্নতা। এই তীব্র উপলব্ধি ছিল বলেই তাঁর পক্ষে লেখা সম্ভব, ‘স্বদেশ তো কোনও নির্বস্ত্তক নিষ্প্রাণ ভৌগোলিক ম্যাপ নয়; বন্ধু-স্বজন নিয়েই দেশ – জীবন্ত প্রাণতপ্ত প্রত্যক্ষ দেশ’ (পুরানো আখরগুলি, পৃ ৫৭)।

বেড়িয়ে আসার পরে উপহার পেলাম উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মণিমহেশ বইটি। মলাট ওলটাতেই চোখে পড়ল প্রদ্যুম্নদার ঝকঝকে হস্তাক্ষরে উদ্ধৃত শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতার অংশ। পঙ্ক্তি কটি ছিল :

‘…যতদূর দেখা যায় সমস্ত বলয় জুড়ে পাষাণের পাপড়ি মেলে দেওয়া

দিগস্তে দিগস্তে ওই কুয়াশামথিত শিখরেরা

পরিধি আকুল করে আছে

তার কেন্দ্রে জেগে আছো তুমি

আর এই শিলামুখে বহুজনমুখরতা থেকে

আবেগের উপত্যকা থেকে

মুহূর্তের ঘূর্ণি থেকে চোখ তুলে মনে হয় তুমিই-বা পদ্মসম্ভব

তোমার নিরাশা নেই তোমার বিরাগ নেই তোমার শূন্যতা শুধু আছে।’

(‘পদ্মসম্ভব’, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে,

আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ ৬৪)

তার পরের পৃষ্ঠায় লেখা, ‘শেফালীকে : ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ যাত্রার ‘সেথো’ –  নিচে নিজ নিজ হস্তাক্ষরে লেখা, ‘প্রদ্যুম্নদা-সুতপাদি’। r

 

 

 

দ্য ডেথ অব ইভান ইলিচমেটামরফোসিস পাশাপাশি রেখে

 

মোজাফ্ফর হোসেন

 

বিশ্বসাহিত্যের সেরা দুটি বড়গল্প হলো দ্য ডেথ অব ইভান ইলিচমেটামরফোসিস। রচয়িতা বিশ^সাহিত্যের দুই প্রভাবশালী লেখক – লিও তলস্তয় এবং ফ্রানৎস কাফকা। রচনাকালের মধ্যবর্তী ব্যবধান প্রায় তিন দশক। গল্পদুটি ভিন্ন দুটি কাল, দেশ ও সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপটে (setting) রচিত হলেও গল্পের বিষয়বস্ত্ত, প্রধান দুটি চরিত্রের পরিণতি, নির্মাণশৈলী এবং সর্বোপরি লেখকের বয়ানস্বরের (tone) অমত্ম্যমিল গল্পদুটিকে তুলনামূলক পাঠের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। দুটি গল্পই নৈরাশ্যবাদী চেতনার; শুরু হয় এক ধরনের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। দ্য ডেথ অব ইভান ইলিচ শুরু হয় এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র (protagonist) ইভান ইলিচের মৃত্যু আর মেটামরফোসিস শুরু হয় এর মূল চরিত্র গ্রেগর সামসার দৈহিক পরিবর্তন অর্থাৎ মানুষ থেকে পোকা হওয়ার মধ্য দিয়ে। সেই অর্থে কাফকা শুরুটা করেছেন একটা ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে, তলস্তয়ের শুরুটা সেখানে চরম বাস্তবতার নিরিখে। এভাবেই দুটি গল্প শুরু হলো তাদের অমিন্তম (ultimate) বা চূড়ান্ত (climax) পরিণতি দিয়ে।

এখানে নাগরিক জীবনের মনস্তাত্ত্বিক ও নগরকেন্দ্রিক সমাজবাস্তবতার ভীষণ জটিল ও কুটিল বিষয় উপস্থাপন করা হলেও লেখকদ্বয়ের বলার স্বর খুবই সরল ও স্বাভাবিক। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা নামের এক ব্যক্তির পোকায় রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনাটি যেন সিঁড়ি থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পাওয়ার মতো অতি সাধারণ একটি ঘটনা! অন্তত কাফকা যেভাবে কোনো ভনিতা ছাড়া নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে ফেললেন – As Gregor Samsa awoke one morning from uneasy dreams, he found himself transformed in his bed into a gigantic insect – তাতে তেমনটিই মনে হয়। আধুনিক সাহিত্যে এর চেয়ে ভয়ংকর সূচনা আর নেই বলে স্বীকার করে নিয়েছেন অনেক সমালোচক। এই বাক্য পড়েই তরুণ বয়সে বিছানা থেকে উঠে বসেছিলেন কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস। তিনি বলেছিলেন, ‘One night a friend lent me a book of short stories by Franz Kafka. I went back to the pension where I was staying and began to read The Metamorphosis. The first line almost knocked me off the bed. I was so surprised… when I read the line I thought to myself that I didn’t know anyone was allowed to write things like that. If I had known, I would have started writing a long time ago. So I immediately started writing.’

অন্যদিকে দ্য ডেথ অব ইভান ইলিচেও আমরা দেখি শুরুতেই একটি দৈনিকে ইভান ইলিচের মৃত্যুসংবাদ পড়ছে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা। আর পাঁচটা খবর পড়ে আলোচনা করার মতোই তারা ইভান ইলিচের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে আলোচনা শুরু করে। কেউ কেউ ইভান ইলিচের মৃত্যুতে তার কর্মস্থলে সৃষ্টি হওয়া শূন্যপদে কাকে বসানো যায় সে-প্রসঙ্গও টেনে আনে। এই গল্পের শুরুতে মেটামরফোসিসের মতো চমক না থাকলেও মানুষের এমন বৈষয়িক অমানবিক চরিত্র আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়। কোনো কোনো সমালোচক এই সূচনাকে existential horror বলে উল্লেখ করেছেন।

এভাবেই দুটি গল্পে একটি সরল আখ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা ঢুকে পড়ি মানব জীবনের গাঢ় ও গূঢ় রহস্যের মধ্যে। এক্ষেত্রে দুটি গল্পেই কাঠামোগত আয়রনির প্রয়োগ হয়েছে। কেননা, আখ্যানভাগ অতিসরল বা ফ্ল্যাট মনে হলেও বিষয়বস্ত্ত মোটেও তা নয়। পরবর্তীকালে আইরিশ কথাসাহিত্যিক জোনাথন সুইফ্ট একই টেকনিক অবলম্বন করে রচনা করেন স্যাটেয়ার প্রবন্ধ ‘অ্যা মডেস্ট প্রোপোজাল’।

গল্পদুটির নামকরণ করা হয়েছে সরলভাবে। নাম থেকেই বিষয়বস্ত্ত আন্দাজ করা যায়। অর্থাৎ ‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’ নাম থেকেই বোঝা যায় কাহিনির কোথাও, বিশেষ করে শেষের দিকে, ইভান ইলিচের মৃত্যু ঘটবে এবং সত্যিকার অর্থেই গল্পটি শুরু এবং শেষ হয় ইভান ইলিচের মৃত্যু দিয়ে। মেটামরফোসিসে ও অনুরূপভাবে বোঝা যায় – গল্পের কোথাও রূপান্তরের ঘটনা আছে, এবং এটিই গল্পের কেন্দ্রস্থ বিষয়। এরপর পাঠক গল্পদুটির প্রারম্ভিক প্যারাতেই মৃত্যু ও রূপান্তরের ঘটনা জেনে যান এবং তখন গল্পের মূল চরিত্রের মৃত্যু কিংবা পোকায় রূপান্তর হওয়ার ঘটনাটি আর মুখ্য বিষয় হয়ে থাকে না। মুখ্য হয়ে ওঠে অন্যকিছু। তবে সেটি কী তা জানার জন্য গল্পদুটি শেষ পর্যন্ত পড়ে যেতে হয়। আপাত-অস্তের বিষয় প্রারম্ভিকে উন্মোচন করে এ দুই মাস্টার কথাশিল্পী জীবন সম্পর্কে তাঁদের যে ক্রিটিক্যাল ভিউ তা উপস্থাপন করেন। ইভান ইলিচের জীবদ্দশায় কিংবা গ্রেগর সামসার পোকায় রূপান্তরপূর্ব জীবন থেকে তাদের সামাজিক অবস্থানটা যতটা না বোঝা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি বোঝা যায় তাদের মৃত্যু কিংবা রূপান্তর-পরবর্তী সময়ে।

 

খ.

‘দ্য  অব ডেথ ইভান ইলিচ’ গল্পের ফ্ল্যাশব্যাকে তলস্তয় আমাদের ইভান ইলিচের অতীত জীবনে নিয়ে যান। এখানে তিনি একটা কথা দিয়েই ইভান ইলিচের জীবন সম্পর্কে তাঁর বোঝাপড়া বা স্টাডি অনেকখানি পরিষ্কার করে তোলেন – অতিসরল, অতিসাধারণ এবং সেই কারণেই ভীষণ ভয়ানক (most simple and most ordinary and therefore most terrible)। ইভান ইলিচ তার জীবনব্যাপী প্রচলিত সমাজব্যবস্থার মাপকাঠিতে সুখী হতে চেয়েছিল। সে তার বাবার তৃতীয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়জন – প্রথমজনের মতো অত ভদ্র-শান্ত নয়, আবার ছোটজনের মতো অত অভদ্র-অশান্তও নয়। তেরো বছর বয়সে সে আইনের স্কুলে ভর্তি হয়, একজন আদর্শ ছাত্র হিসেবে সেখানকার নিয়মকানুন মেনে চলে। সমাজের আরোপিত কোনো নিয়মের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা সে করেনি। পোশাক পরেছে, খাবার খেয়েছে – সবই প্রচলিত নিয়মে। বিয়ে করেছে প্রচলিত বিশ্বাসে। তার সন্তান হয়েছে, সংসার হয়েছে; কারণ সমাজে একজন সুখী মানুষের এসব থাকে। আরো যা থাকে তা হলো সুন্দর একটা বাড়ি। ইভান খুব সুন্দর একটা বাড়ি করার পেছনে যথেষ্ট শ্রম দিয়েছে। বিবাহের কিছু বছর পর ইভান বুঝতে পারে, বিবাহ সম্পর্কে তথাকথিত যে-ধারণা –  ‘conducive to the pleasures and amenities of life,’ তা সবসময় খাটে না। দাম্পত্য অশামিন্তর কারণে সে আরো বেশি কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করে। সমাজ-স্বীকৃত জীবনযাপন করার জন্য স্ত্রীর সঙ্গে একটা ঠান্ডা সম্পর্ক বজায় রাখে। এমনিভাবে তলস্তয় ইভান ইলিচকে খুব সাধারণভাবে একটি সমাজের সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ইভান হয়ে উঠেছে একটি সমাজের ‘everyman’। ইভান তৎকালীন রাশিয়ার পুঁজিবাদী সমাজের মস্ত হাতিয়ার হয়ে উঠেছে তার অজাস্তেই। সমাজের সুবিধাবাদী শ্রেণি (bourgeoisie) থেকে নির্ধারিত জীবনকে সত্য বলে মেনে চলেছে সারাটা জীবন। তলস্তয় এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে উচ্চবিত্ত শ্রেণির সম্পর্ককে মেটাফর হিসেবে দেখিয়েছেন – ‘that of a fly being drawn to a bright light’। একটি মাছি যেমন আলোর মায়ায় তার কাছে ছুটে যায় এবং সেখানে পৌঁছানো মাত্র মারা পড়ে, তেমনি ইভান ইলিচ জীবন ভেবে যে-জীবনের পেছনে ছুটে চলে, সে-জীবনই তাকে জীবিত থেকেও মৃতের স্বাদ এনে দেয়।

ইভানের মতো গ্রেগরও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। সেলসম্যানের চাকরি করে সে। যদিও চাকরিটা তার মোটেও ভালোলাগে না, তথাপি পরিবারের কথা ভেবে ছাড়তেও পারে না। প্রতিনিয়ত নিজের মনের সঙ্গে আপস করে বেঁচে থাকতে হয় তাকে। আপস করতে হয় অফিসের বস, পরিবার এবং সমাজের সঙ্গেও। আপস করতে করতে একসময় গ্রেগর হারিয়ে ফেলে তার মানবসত্তাকে। তার দৈহিক পরিবর্তনটা তারই চূড়ান্ত বা প্রতীকী প্রতিফলন। গ্রেগরের অফিসে যেতে এক ঘণ্টা দেরি হওয়ায় অফিসের বড়কর্তা গ্রেগরের খোঁজ নিতে বাড়ি আসে – অর্থকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় গ্রেগরের প্রতি ঘণ্টা বিক্রি হয়ে যায় টাকার কাছে। অতিরিক্ত এক ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়া মানেই বাণিজ্য থেকে এক ঘণ্টা দূরে থাকা। গ্রেগরের দরজা খুলতে দেরি হলে গ্রেগরের মা বড়কর্তাকে আশ্বস্ত করে – গ্রেগর সারাদিন কাজের মধ্যেই থাকে, এমনকি সন্ধ্যায়ও বাইরে যায় না। গ্রেগরের পোকা হয়ে যাওয়ার পর পরিবার কিংবা সমাজের আর কোনো কাজে লাগে না সে। ফলে সে পরিবার এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

আপাতদৃষ্টিতে ‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’ হচ্ছে ইভান ইলিচ ও ‘মেটামরফোসিস’ হচ্ছে গ্রেগর সামসা নামধারী খুব সাধারণ দুজন মানুষের গল্প। কিন্তু এঙ্গেলস এবং মার্ক্সের ‘ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ’ (Historical Dialectical Materialism)  পাঠসাপেক্ষে জানা যায়, গল্পদুটি আধুনিক পুঁজিকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থার মেটাফোরিক উপস্থাপন। ইভান আর গ্রেগর হচ্ছে এখানে শ্রমিক শ্রেণি (proletariat) আর অফিসের বড়কর্তারা হচ্ছে বুর্জোয়া শ্রেণির (bourgeoisie) প্রতিনিধি। পুঁজিকেন্দ্রিক সমাজে একটা মানুষের পরিচয় ও সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয় তার উৎপাদনক্ষমতার ভিত্তিতে। তাই কাজ করতে করতে তারা ভুলে যায় তাদের মানবিক অসিন্তত্বের কথা। তৎকালীন পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ও নীতিকে চরম সত্য জেনে পরম মমতায় লালন করেছে ইভান ইলিচ ও গ্রেগর সামসা। নিজের অসিন্তত্বকে বিলীন করে সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসে সমাজের চোখে সুখী হতে চেয়েছে তারা। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর তারা প্রচলিত সমাজে তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নিজ নিজ সত্তার কাছে। সমাজ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আবিষ্কার করেছে ওই সমাজকে, যে-সমাজে কাজ না থাকলে কাছের মানুষগুলো অচেনা হয়ে যায়; যেন খারিজ হয়ে যায় সমাজের সদস্যপদ।

 

গ.

ইভান ইলিচের মৃত্যুসংবাদ শুনে তার সহকারী বন্ধুদের মাথায় প্রথমেই যে-চিন্তাটি আসে তা হলো – ইভান ইলিচের মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট খালি পদে কাকে নিযুক্ত করা যায়। বন্ধু হারানোর শোক নয়, পদোন্নতি তাদের আলোচনার প্রাথমিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অন্য যে-বিষয়টি তাদের মধ্যে স্বসিন্ত এনে দেয়, তা হলো – যে মারা গেল সে আমি নই, অন্য কেউ (it is he who is dead and not I)। ইভান ইলিচের বন্ধুরা তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যায় যেতে হয় তাই। এটা তাদের কাছে কেবলই একটা সামাজিক রীতি (ritual)। ইভান ইলিচের স্ত্রী প্রাসকোভইয়া ফেদেরোভনা ইভানের মৃতদেহ এক ঘরে রেখে অন্যঘরে স্বামীর ঘনিষ্ট বন্ধু পিটার ইভানোভিচের সঙ্গে আলোচনা করে কী করে ইভান ইলিচের পেনসনের টাকার পরিমাণটা বাড়ানো যায় এবং কোনো কবরস্থানের জমির দাম অপেক্ষাকৃত কম হবে এসব বিষয় নিয়ে।

ফ্লাশব্যাকে দেখা যায়, ইভান যখন অসুস্থ ছিল তখন স্ত্রী ও কন্যা রুটিন করে তাকে দেখতে যেত। খুব দ্রুতই অসুস্থ ইভান ইলিচের বেঁচে থাকা তাদের জন্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ ও পরিবার থেকে উপেক্ষেত ইভান ইলিচের আন্তজিজ্ঞাসার জায়গাটা কেউই অনুভব করতে পারে না। এমনটি ডাক্তারও তাকে রোবটের মতো দেখে চলে যায়। ইভান ইলিচ বুঝতে পারে, তাকে কেউই বুঝতে পারছে না বা বুঝতে চাচ্ছে না। সবার কাছে তার অসুস্থতা এবং সুস্থ থাকা সমানভাবে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। পরিবারের সবার ধারণা, এই রোগের জন্য সে নিজেই দায়ী এবং নিয়মিত ওষুধ সেবনে সেরে উঠবে। ফলে ইভানের শারীরিক সমস্যার থেকেও ভয়ংকর হয়ে ওঠে তার মানসিক সমস্যা। স্ত্রী-কন্যা যখন তাকে অসুস্থ রেখে সাজসজ্জা করে থিয়েটারে যায়, তখন তার শেক্সপিয়রের অ্যাজ ইউ লাইক ইট নাটকের চরিত্র জ্যাকের মতো মনে হয়, জীবনটা একটা নাট্যমঞ্চ, এখানে চারপাশের সবাই অভিনয় করে চলেছে এবং তাদের জগৎটা হচ্ছে – ‘mesh of falsity’। আমরা পরবর্তীকালে দেখতে পাই, এই তথাকথিত অগ্রসর সভ্যতার মিথ্যা ও কৃত্রিমতা ইভান ইলিচের মৃত্যুর জন্য দায়ী। মানব জীবনের প্রকৃত সত্যটা ইভান ইলিচ যখন অনুভব করতে পারে, তখন তার উপলব্ধি হয়, ‘illness is not a question of health or sickness, but of life or death.’

অন্যদিকে, গ্রেগর সামসার পোকাতে রূপান্তর ঘটলে তার চারপাশের মানুষগুলোর স্বার্থপর চেহারা পরিষ্কার হয়ে ধরা দেয়। মা-বাবা-বোন – এই নিয়ে গ্রেগরের পরিবার। পোকা হওয়ার আগ পর্যন্ত আর পাঁচটা সুখী পরিবারের মতোই ছিল সব। গ্রেগরের দৈহিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিংবা আয়ক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটল পরিবারের অন্যদের আচরণের। বাবা আপেল ছুড়ে গ্রেগরকে ঘরের ভেতর বন্দি থাকার ঈঙ্গিত দেয়, মা গ্রেগরকে দেখলে ভয়ে মূর্ছা যায়, বোন প্রথমদিকে গ্রেগরের খাবার-দাবারের দিকে খেয়াল রাখলেও পরে আর রাখে না। গ্রেগরের ব্যবহার্য কোনোকিছু কেউ স্পর্শ করে না। আপাতদৃষ্টিতে গ্রেগর পোকা হয়ে যায় বটে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে মনুষ্যগুণাবলি হারায় না বরং আশেপাশের মানুষরাই আপাতদৃষ্টিতে ঠিক থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তারাই মানবিক গুণশূন্য হয়ে ওঠে। এটিই আপাতবাস্তবতার চরম আয়রনি। গ্রেগর যখন পশুর মতো খাটুনি খেটে সংসার চালাত, বাবার ঋণের টাকা পরিশোধ করত, তখন পরিবারের আর সবাই আয়েশ করে দিনযাপন করত। আর গ্রেগর যেইমাত্র কাজ হারাল তখনই তাকে ছুড়ে ফেলা হলো আবদ্ধ কক্ষে। পরিবারের সকলের কাছে গ্রেগরের মৃত্যু হয়ে উঠল একমাত্র কাম্য। আসেন্ত আসেন্ত গ্রেগরের রুম থেকে আসবাবপত্র সরিয়ে বানানো হলো স্টোররুম।

 

ঘ.

‘দ্য ডেথ অব ইভান ইলিচ’ গল্পে আফিমের ঘোরে যখন ইভানের শারীরিক যন্ত্রণা কিছু সময়ের জন্য থমকে থাকে, ইভান তখন স্বপ্ন দেখে, তাকে একটি গভীর কালো বস্তার ভেতর ঠেলে ঢুকানো হচ্ছে। সে ওই অন্ধকারে পতিত হওয়ার কামনা যেমন করে, তেমন ভয়ও করে। যেন সে সাহায্য ও সহযোগিতা দুটোই করে। ঘুম ভেঙে গেলে সে কাঁদতে কাঁদতে ঈশ্বরকে বলে, ‘Why hast Thou done all this? Why have Thou brought me here? Why, why dost Thou torment me so terribly?’ তারপর সে নীরব হয়ে যায়, তার ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে, ‘What is it you want?’ ইভান উত্তর দেয়, সে ভালোভাবে এবং শামিন্ততে বসবাস করতে চায়, যেমনটি সে সারাজীবন চেয়েছে। এরপর সে তার অতীত জীবনের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অনুভব করে, যতবেশি সে তার বাল্যকাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, ততবেশি হতাশ হয়ে পড়েছে। মূল্যহীন হয়ে উঠেছে তার জীবন।

ইভানের স্বপ্নের কালো বস্তাকে যদি কবর বা মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে সে মৃত্যুকে সাদরে গ্রহণ করছে আবার তীব্রভাবে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আবার বস্তাটিকে যদি মাতৃগর্ভের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, চিন্তাচেতনার জগতে ইভানের পুনর্জন্ম ঘটছে। বস্তায় প্রবেশমুহূর্তে যে-যন্ত্রণা সে অনুভব করছে তা হলো জন্মমুহূর্তের যন্ত্রণা। ফলে যেটাকে ইভান ইলিচের মৃত্যু বলে মনে হচ্ছে, সেটা আসলে তার আত্মার বা আধ্যান্তবোধের পুনর্জন্ম। আমরা জানি, তলস্তয় নিজেও অনুরূপ কনভারশনের ভেতর দিয়ে যান। এরপরই তিনি লেখেন এ-গল্পটি। ইভান তার নিজের জীবন দিয়ে যে অনুভব করে – ‘Life, a series of increasing sufferings, flies further and further towards its end – the most terrible suffering’ – তা তলস্তয়ের নিজের জীবনেরও অনুভূতি। ইভান খতিয়ে দেখতে চায় – ‘what it is all for.’ এবং জীবনের সমস্ত অধ্যায় ঘেঁটে মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তে বুঝতে পারে, তার সমস্ত জীবন ধরে সে যা সঠিক বলে গণ্য ও মান্য করেছে তা সবই ছিল ভুল। সে ছিল সুখী – সমাজের চোখে এবং সে সেটাই হতে চেয়েছিল। ইভানের অধ্যান্তবোধ যখন বস্ত্তবাদী জগৎকে অতিক্রম করে যায়, তখন সে মৃত্যুকে জয় করে নতুন জীবন অর্জন করে, এবং এই মুহূর্তে যখন সে নিজেকে প্রশ্ন করে – ‘What is the right thing?’ ঠিক তখনই তার একটি হাত তার ছেলে ভাস্য়ার মাথা স্পর্শ করে। ভাস্য়ার মধ্যে ইভান তার বাল্যকালের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়, সে তার জন্য দুঃখ অনুভব করে। এবং তার কাছে ক্ষমা চায়। মানুষের শারীরিক সংস্পর্শে এসে ইভান অনুভব করে, সমস্ত জীবনব্যাপী সে শুধু নিজের চারপাশে একটি দেয়াল স্থাপন করে এসেছে, সরে গেছে অর্থপূর্ণ মানবিক সম্পর্ক থেকে। যখন সে মানব জীবনের প্রকৃতি বা ‘the truth of life and death’ উদ্ঘাটন করতে সমর্থ হয়, তখনই তার পুনর্জন্ম ঘটে – সে মারা যায় শামিন্তপূর্ণভাবে।

অন্যদিকে ‘মেটামরফোসিস’ গল্পে প্রথম বাক্যেই গ্রেগর সামসার মৃত্যু ঘোষিত হয় এবং সমস্ত গল্প জুড়ে সে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। ইভান ইলিচের মতো গ্রেগর সামসাও মৃত্যুচিন্তার সঙ্গে লড়াই করে চলে প্রতিনিয়ত। সমালোচক মার্টিন গ্রিনবার্গের মতে, ‘… Tolstoy’s work is about death literally and existentially; Kafka’s is about death in life.’। যতক্ষণ না ইভান ইলিচ তার যাপিত জীবনকে মিথ্যা বলে মেনে নেয় এবং স্বীকার করে এটা যেমনটি হওয়ার কথা ছিল তেমনটি হয়নি, ততক্ষণ সে তার আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে সজাগ হতে পারে না। শেষ মুহূর্তে সে আবিষ্কার করে – জীবন এবং মৃত্যুর সত্য। তারপর তার মৃত্যু ঘটে। গ্রেগর সামসার ক্ষেত্রে, জীবিত থেকেও সে মৃত, কাজেই মুক্তি মেলে না সহজে। এক ভোরে গ্রেগর তার যে অসিন্তত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে, সেটাই হচ্ছে তার ক্ষেত্রে – ‘the truth of life and death’। এক্ষেত্রে, ‘the dream reveals the reality’ – কথাটি উভয়ের ক্ষেত্রে সত্য বলে খাটে।

 

ঙ.

একবিংশ শতকে আমরা দেখছি মানুষ আরো বেশি যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। শিল্পবিপস্নব ও প্রযুক্তিবিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্বে আমরা উপস্থিত – মানব প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির এক চরম বিপর্যয় টের পাচ্ছি। মানুষের পরিবর্তে যন্ত্রের সঙ্গে জমে উঠছে আমাদের সখ্য। আমরা প্রতিনিয়ত গ্রেগর সামসার মতো পোকা হয়ে যাচ্ছি আমাদের অজাস্তেই। ইভান ইলিচের মতো সমাজের প্রচলিত স্রোতে গা ভাসিয়ে ছিটকে পড়ছি আপন সত্তা থেকে। ব্যক্তির এই সংকটকালে ইভান ইলিচ ও গ্রেগর সামসার জীবনপাঠ আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। r