ক্যামুর সাহিত্য ও সমাজ-রাজনীতি

আহমদ রফিক

 

খ্রিষ্টাব্দ ১৯৬০-এর ৪ জানুয়ারি। সাহিত্য অঙ্গন, বিশেষ ফরাসি সাহিত্যের জন্যে এ-দিনটি সত্যিই দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছিল। স্বনামখ্যাত ফরাসি কথাশিল্পী আলবের ক্যামুর জন্যে ঘটনাটি বুঝি তাঁর জীবননাট্যের এক অবাঞ্ছিত উপহাস। তা না হলে প্যারিসগামী ট্রেনের টিকিট কাটার পরও প্রকাশক-বন্ধুর আমন্ত্রণে তাঁর সঙ্গে মোটরযাত্রায় শরিক হলেন কেন ক্যামু? পরিণামে সড়ক দুর্ঘটনায় লেখক, প্রকাশক দুজনেরই মৃত্যু! যেন অদৃশ্য কারো ডাকে সাড়া দেওয়া,

বিশ্ববাসী মানুষ হয়তো বলবেন : এ হলো নিয়তির বিধান। তাকে এড়াবে কে? বিপরীত চিন্তার মানুষ বলতে চাইবেন : নিয়তি নয়, দৈবও নয়। ঘটনাই এক্ষেত্রে ঘটক যা আমাদের জানা ও নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে। ক্যামু কি এমনসব ঘটনাক্রমে বিশ্বাস করতেন? বলা কঠিন। তবে তাঁর একটি ছোটগল্পে তেমন ইঙ্গিত চোখে পড়ে। সে-কাহিনির প্রেক্ষাপট আলজিরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম (‘ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’) ও একজন স্বেতাঙ্গ ফরাসি শিক্ষকের সে-সম্পর্কে বিচিত্র প্রতিক্রিয়া। এক্ষেত্রে আমাদের বিচার্য সংগ্রামী আরব বন্দিটির উদ্ভট, অবিশ্বাস্য, যুক্তিহীন আচরণ যা ঘটেছে লেখকের কলমের রহস্যময় টানে।

ঘটনায় প্রকাশ, এক রাতে স্থানীয় পুলিশ একজন মুক্তিসংগ্রামী আরব বন্দিকে সেখানকার স্কুলশিক্ষকের হেফাজতে রেখে যায় পরবর্তী ব্যবস্থার জন্য। ওই বন্দিকে নিয়ে রাতভর নানা ভাবনার প্রতিক্রিয়া শেষে স্কুলশিক্ষক খুব ভোরে উঠে বন্দিকে ছেড়ে দেয় তার স্বজাতির আবাসনে চলে যেতে। সেইসঙ্গে তাকে সতর্ক করে যে, উল্টোদিকের পথটি গেছে ফরাসি সেনাক্যাম্পের দিকে। অতএব সাবধান। তাকে বিদায় দেওয়ার পর বিস্মিত স্কুলশিক্ষক লক্ষ করে যে, আরবযুবাটি টলতে টলতে সেনাক্যাম্পের পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে।

আরবযুবাটির উদ্ভট আচরণের মাধ্যমে কী প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন কথাশিল্পী ক্যামু? নিয়তির অপ্রতিরোধ্য রহস্যময় শক্তির কথা, নাকি অন্য কোনো সত্য। মানুষের ইচ্ছা ও বাস্তবতার মধ্যে দুর্নিবার প্রভেদের কথা, নাকি ঘটনাটি নিছক শৈল্পিক অভিনবত্বের প্রকাশ। এসব প্রশ্নের জবাব আমাদের জানা নেই, জবাব দিতে পারতেন লেখক আলবের ক্যামু। প্রসঙ্গত একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, আলজিরিয়ার (আলজিয়ার্সের) সন্তান এবং সেখানে বড় হয়ে-ওঠা ক্যামুর সাহিত্যকর্মে আলজিরিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী আরবদের জীবনসংগ্রামের প্রকাশ নেই বললে চলে। অথচ আলজিরিয়ায় বসবাসকালে বাম রাজনীতির সঙ্গে তার যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতাও তো অনস্বীকার্য।

 

দুই

আলবের ক্যামুর জন্ম ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসিশাসিত আলজিরিয়ায়। দরিদ্র, নিম্নবর্গীয়, শ্বেতাঙ্গ পরিবারে তাঁর জন্ম। শৈশব, কৈশোর কেটেছে চরম আর্থিক দুর্দশায়। সেইসঙ্গে বাড়তি উৎপাত অস্বাস্থ্য ও অসুস্থতা। সর্বোপরি ক্যামু অন্তমুর্খী প্রকৃতির একজন মানুষ। এসবের সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায়ই কি ক্যামু সূর্যালোকিত মুক্ত পরিবেশ, জীবনের আনন্দানুভূতির গভীর প্রবক্তা? কিন্তু সূর্যালোকিত জন্মভূমির প্রতি মৃত্তিকাঘনিষ্ঠ শিকড়ের টান ক্যামুর রচনায় বড় একটা দেখা যায় না।

কড়া রোদ ও উত্তাপের শৈল্পিক ব্যবহার তাঁর রচনায় দেখা গেলেও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর মুক্তিসংগ্রামের প্রতি ক্যামুর মমত্ববোধ লক্ষ করা যায় না, বরং বিপরীত চিন্তারই প্রকাশ ঘটে ব্যক্তিক বিদ্রোহ বনাম বিপ্লবের তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণে বা মন্তব্যে। সেখানে তিনি বিপ্লবের বিরোধী অর্থাৎ বিপ্লবী সহিংসতার বিরোধী। সে-কারণেই কি ক্যামু আলজিরিয়ার মুক্তিসংগ্রামের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন? এ-বিষয়ে সার্ত্রের ঠিক বিপরীত মেরুতে ক্যামুর চিন্তাভাবনা ও অবস্থান।

কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, যেহেতু দারিদ্র্যপীড়িত জীবন মানুষকে দারিদ্র্য তথা বৈষম্যবিরোধী সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়, সে হিসেবে ক্যামুর পক্ষে শ্রেণিসংগ্রামী হওয়া স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বাস্তবে এর বিপরীত পরিণতিই তাঁর জীবনে সত্য হতে দেখা যায়। দারিদ্রপীড়িত জীবনের অভিজ্ঞতা মানুষকে কখনো কখনো ভবিষ্যৎ জীবন সোনালি রেখায় চিহ্নিত করতে চায়। ক্যামুর ক্ষেত্রে কি শেষোক্ত দিকটাই সত্য ছিল, নাকি তাঁর বিপ্লব-বিরোধিতা নিছক তাঁর চিন্তাভাবনা ও প্রকৃতিবৈশিষ্ট্যের সমান্তরাল?

ক্যামু সম্বন্ধে এমন ধারণাও রয়েছে যে, স্বভাবগত কারণে তিনি চরমপন্থা তথা সহিংসতার বিরোধী, আর সে-সূত্রেই বিপ্লববিরোধী। তাঁর বিশ্বাস, সহিংসতার মাধ্যমে সহিংসতা দূর করা যায় না, বড়োজোর তা দমন করা যায়। এ ধরনের তাত্ত্বিক, দার্শনিক বিতর্কে ক্যামুকে মধ্যপন্থী বলেই মনে হয়। হয়তো সে-কারণেই বামপন্থার সঙ্গে সাময়িক সংশ্লিষ্টতার পর ক্যামু নিজস্ব চিন্তাভাবনার অবস্থানে স্থিত হন।

স্বাভাবিক কারণে ফরাসি বাম ঘরানার সঙ্গে ক্যামুর বিচ্ছিন্নতা। এমনকি সংবেদনসূত্র ছিন্ন নিজস্ব চিন্তায় নিঃসঙ্গ মার্কসবাদী জ্যঁ পল সার্ত্রের সঙ্গেও। তাই ১৯৫২ সালে এ-বিষয়ে ক্যামুকে লেখা সার্ত্রের চিঠির বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সে-চিঠিতে কিছু রাজনৈতিক সত্যের প্রকাশও ঘটেছে, বিশেষ করে সার্ত্রে যখন লেখেন :

‘Our friendship was not easy, but I shall regret it. If you break it now, then no doubt it had to be broken. A lot of things united us, a few divided us. But those few were already too many’. শেষ বাক্যটি সার্ত্রের অসাধারণ বাকভঙ্গির নিদর্শন। আসলে এ-কথাই সত্য যে, রাজনৈতিক দুঃসময়, ফ্যাসিসবিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম, হয়তোবা অস্তিত্ববাদী চিন্তার মিল ইত্যাদি এ দুই ফরাসি দিকপালকে এক মঞ্চে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল। আবার আদর্শিক ভিন্নতাই তাঁদের ঐক্যসূত্র ছিন্ন করে এবং তা আপাতবিচারে সামান্য মনে হলেও গুণগত বিচারে অসামান্য। এঁদের দুজনের মানসবৈশিষ্ট্যই প্রকৃতপক্ষে দুই বিপরীত মেরুর। সংগত কারণে দুই পিরের এক গালিচায় অবস্থান সম্ভব ছিল না।

 

তিন

ক্যামুর রাজনৈতিক-সামাজিক ও নৈতিক চিন্তার পরিচয় মেলে তাঁর কিছুসংখ্যক প্রবন্ধে, বিশেষ করে The Rebel (L’ Homme Re©volte©) গ্রন্থটিতে। সেইসঙ্গে অংশত The Myth of Sisyphus কিংবা Resistance, Rebellion and Death-এর মতো রচনাবলিতে। এসব গ্রন্থে ব্যক্ত ক্যামুর ভাবনার মর্মার্থ কিছুটা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্রসঙ্গত এমন উপলব্ধিও রয়েছে যে, এই মরণশীল পৃথিবীতে জীবনের পরম লক্ষ্য পরিপূর্ণ উপভোগ। জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে কিছু নেই।

এ-সম্বন্ধে জনৈক বিশ্লেষকের অভিমত : ‘The lesson of Le Mythe de Sisysphe’ (The Myth of Sisyphus) is that one should live intensely, drinking the cup of experience to the full’ and ‘life as such, has no ultimate purpose’। শুধু সিসিফাসের ক্ষেত্রেই নয়, The Outsider-এর নায়কের ক্ষেত্রেও জীবনের উপভোগ্যের বিষয়টি সত্য। আমাদেরও বিশ্বাস,               শৈশব-কৈশোরের দারিদ্র্য, তারুণ্যের-যৌবনের কঠোর জীবনসংগ্রাম হয়তো ক্যামুকে এমন উপলব্ধিতে পৌঁছে দিয়েছিল।

জীবনের পরিপূর্ণ উপভোগ এ-কালের ভোগবাদী পশ্চিমা বিত্তবান সমাজের জন্য এক পরম সত্য, এবং তা কাম্যুর সমকালেও কারো কারো জন্যে সত্যই ছিল। কিন্তু বস্ত্তবাদী বা প্রগতিবাদীরা এর বিপরীত সত্যে বিশ্বাসী। এবং বিশ্বাসী জীবনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে। সে-লক্ষ্য মানবিক বোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং জীবন মোটেই উদ্দেশ্যহীন নয়। ভাববাদী রবীন্দ্রনাথও এমন এক ইতিবাচক জীবনবোধে বিশ্বাসী ছিলেন।

জীবনকে সুন্দর, সচ্ছন্দ, সচ্ছল ও উপভোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়, বিশ্বের প্রগতিবাদী মাত্রেরই তা কাম্য এবং তা সর্বজনের পক্ষে নিশ্চিত করা তাদের লক্ষ্য। তবে তা যেন শুধু শ্রেণিবিশেষের অতিভোগের বিষয় হয়ে না ওঠে। কিন্তু ‘বিরূপ বিশ্বে’ শেষোক্ত বিষয়টিই সত্য। সত্য শ্রেণিবৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য। বৈষম্য উচ্চবর্গীয় বনাম নিম্নবর্গীয়। মধ্যিখানে নিরক্ষরেখায় মধ্যবিত্তশ্রেণি, যাদের এলিট অংশ দুই উপশ্রেণিতে বিভক্ত। ফরাসি সাহিত্যিক-চিন্তাবিদদের মধ্যে থেকে যদি উদাহরণ টানা যায়, তাহলে বলতে হয়, এর এক মেরুতে যেখানে ক্যামুর চিন্তাভাবনা, বিপরীত মেরুতে সার্ত্রের অবস্থান।

তাই সিসিফাসের প্রতীকী পুরাকাহিনিও হয়তো হয়ে ওঠে একাধিক ধারায় বিশ্লেষণের বিষয়। ক্যামুর সিসিফাস কাহিনির ব্যাখ্যার পাশাপাশি আমাদের বরং মনে হয়, জীবন যে সত্যই এক নিরন্তর সহিষ্ণু লড়াই – এ-সত্যটিও ওই প্রতীকে প্রতিফলিত। একে যে যেভাবে খুশি আমলে নিতে পারেন। এবং তা নির্ভর করে ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।

ধরা যাক ক্যামুর বিখ্যাত উপন্যাসিকার Le Etranger (The Outsider) কাহিনি ও নায়ক মার্সেলের আচরণ প্রসঙ্গ। মার্সেল আলজিয়ার্সের বাসিন্দা একজন সাধারণ নাগরিক, যে জীবনের উপভোগে বিশ্বাসী। কিন্তু একই সঙ্গে পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন একজন নিরাসক্ত মানুষ যে সমাজে প্রচলিত বিধিবিধানের বাইরে মুক্তচৈতন্যের অধিকারী। তাই মায়ের মৃত্যুসংবাদ তাকে বিচলিত করে না, বরং অভ্যস্তজীবনের ধারায় তার দিনটি শেষ হয় উপভোগের তৃপ্তিতে।

সে আলজিরীয় আরবদের স্বাধিকার আন্দোলনে সম্ভবত বিশ্বাসী নয়। তাই সহজেই একজন আরবযুবাকে হত্যা করে। কিন্তু হত্যার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে সদুত্তর দিতে পারে না। তার মনে হয় মরুবালিয়াড়ির তীব্র রোদের ঝলসানিতে বিভ্রান্ত হয়ে সে গুলি চালিয়েছে, তাতেই আরব যুবকের মৃত্যু। বিচারক এ-ধরনের অদ্ভুত ব্যাখ্যা মানতে রাজি নন। অন্যদিকে ক্যামুর এই নায়কের চরিত্রে একটি বড় গুণ তার সততা ও কর্মের দায়িত্ববোধ, যা অস্তিত্ববাদী চেতনার একটি বড় শর্ত। সে-কারণে মার্সেল তার কর্মের পক্ষে সাফাই বা আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনোপ্রকার চেষ্টা করে না। বরং পরিণামের ভয়ংকর বাস্তবতাকে সহজভাবে মেনে নেয়।

বিচারে মৃত্যুদন্ডাজ্ঞা শোনার পর তাকে বিচলিত হতে দেখা যায় না। বরং কারাগারে বসে সে রংফেরা পৃথিবীতে জীবনের উপভোগ্যের বিষয় নিয়েই ভাবে, এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী অপরাধীর স্বীকারোক্তি নিতে আসা পাদ্রিকে সে প্রত্যাখ্যান করে। কারণ পরলোক নয় এই সুন্দর, উপভোগ্য ইহলোকই তাঁর একমাত্র কাম্য, অন্য কিছু নয়। এ-পর্যায়ে এ-ঘাতক চরিত্রটির প্রতি পাঠকের মমত্ববোধ তৈরি হয়।

অনেকের ধারণা, এ চটি বইটিতে ক্যামুর আত্মজৈবনিক ছায়াপাত ঘটেছে। আমাদের বিচারে এতে কাম্যুর জীবনবোধ ও ন্যায়নীতিবোধেরও প্রকাশ ঘটেছে। দর্শনের ছাত্র ক্যামুর সমাজবোধের প্রতিফলন দেখা যায় নায়কের চরিত্র ঘিরে। সেইসঙ্গে সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ প্রত্যাখ্যানও, তা যে-কোনো মূল্যেই হোক। তাতেই পরিস্ফুট নায়কের সমাজ-বহির্ভূত সত্তার অস্তিত্ব ও অবস্থান। আর সে-কারণেই এই চটি উপন্যাসটি ফরাসি এলিট সমাজে সাড়া জাগায় যা পরে ছড়িয়ে যায় বিশ্বের সাহিত্য অঙ্গনে। বাঙালি এলিট সমাজও ব্যতিক্রম নয়, যে-কারণে বইটির বঙ্গানুবাদ সাহিত্যপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়।

এ-বইটি সম্পর্কে ক্যামুর অপত্যস্নেহ তাঁর একাধিক মন্তব্য বা বিবৃতিতে পরিস্ফুট। কিন্তু ‘আলজিরিয়ার সাধারণ মানুষ তাঁর এই নায়কের মতনই’ – কাম্যুর এমন মন্তব্য মনে হয় সর্বার্থে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আলজিরিয়ার সংখ্যাগুরু আরব জনগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ এমন অভিনব চিন্তার অংশীদার নয়। তাদের প্রাত্যহিক দুস্থ জীবনপীড়িত জীবন বা জীবনের জন্য সংগ্রাম এতে প্রতিফলিত নয়, বরং তাদের মুক্তিসংগ্রামের বিপরীতচিত্রই এখানে প্রতিফলিত। অন্যদিকে সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ আলজিরীয়দের জীবনবেদও এজাতীয় অভিনবত্বের সমান্তরাল নয়। উপন্যাসের পুরো বিষয়টাই বরং ক্যামুর অস্তিত্ববাদী ধ্যানধারণার প্রতীকী ফসল। বইটির প্রকাশ ১৯৪২ সালে ‘পারীর পতনে’র পর, যখন বিশ্বসংস্কৃতিভুবনের চিত্ত মথিত করে ফ্রান্স নাৎসি-জার্মানদের বুটের তলায় রক্তাক্ত।

এ-অবস্থায় ফ্রান্সের সচেতন বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে এক কাতারে ক্যামুও প্রতিরোধ আন্দোলনে শামিল। লেখক-সাংবাদিক ও দর্শনচিন্তায় নিবিষ্ট ক্যামু চিন্তার জগতে বরাবরই কিছুটা ভিন্ন। আর এ-ভিন্নতার প্রকাশ তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে। এদিক থেকে কিছুটা মিল সার্ত্রের সঙ্গে, তবে সর্বাংশে নয়। সার্ত্রের উপন্যাস চতুষ্টয় (রোডস টু ফ্রিডম) অস্তিত্ববাদের প্রতিফলন ঘটিয়েও বস্ত্তভিত্তিক, এবং এর চেয়ে জীবনবাদী ও রাজনীতিবিদ তাঁর নাটকগুলো। আবার কোনো কোনো নাটক নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক।

 

চার

আক্রান্ত দেশ, অবমানিত দেশ। স্বভাবতই বুদ্ধিজীবীর দায়বদ্ধতা থেকে প্রতিরোধ আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ (তুলনীয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ)। এই অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তীকালে রচিত ক্যামুর রাজনৈতিক, প্রতীকী উপন্যাস The Plague (La Peste 1947)। কারো কারো মতে দ্য প্লেগ তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। হয়তো শৈল্পিক ও মানবিক উভয়বিধ বিচারে। অথচ আশ্চর্য যে, ক্যাম্যু তাঁর নোটবইয়ে এটিকে ‘প্যাম্পলেট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নিঃসন্দেহে এতে রাজনীতি প্রাধান্য পাওয়ার কারণে, এবং তা প্লেগ প্রতীকে রচিত হওয়া সত্ত্বেও।

ছোট্ট এই এক শব্দের মন্তব্যে ক্যাম্যুর শিল্পচিন্তা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। নিজে একজন প্রতিরোধ-যোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর দার্শনিক ও সামাজিক ন্যায়নীতি তথা নৈতিকতার চিন্তা কখনো কখনো প্রাধান্য পেয়েছে। ক্যালিগুলা থেকে রেবেল কিংবা সিসিফাস এবং অনুরূপ রচনা থেকে তাঁর         সমাজ-রাজনৈতিক মানসপ্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লক্ষ্য করার বিষয় যে, তাঁর রচনার তুলনামূলক বিচারে উপন্যাসের সংখ্যা কম, ছোটগল্প সংকলন মাত্র একটি। বাকি সবই তাঁর পূর্বোক্ত ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাভাবনার প্রতিফলন, যা নিয়ে ফরাসি বোদ্ধামহলে ছিল যথেষ্ট বিতর্ক।

প্লেগ উপন্যাসটির অকুস্থল আলজিরিয়ার আরব সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘ওরান’ নামের শহর। প্লেগের প্রতীকী অর্থ নাৎসিজার্মান সেনাদের বর্বর জবরদখল। আরো স্পষ্ট অর্থে প্লেগ ফ্যাসিস্ট যুদ্ধের প্রতীক।  এ-উপন্যাসেও ক্যামুর আত্মজৈবনিক ছায়াপাত, এবং তা আদর্শিক বিচারে। কারো মতে প্লেগ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র ডাক্তার রিউ তার চরিত্রস্রষ্টা ক্যামুর প্রতিকৃতি। কথাটি আংশিক সত্য।

তবে তারু চরিত্রটির পূর্বাপর বিশ্লেষণে তাতেই বরং ক্যামুর চিন্তাভাবনার ছায়াপাত বেশি। এমনকি তারুর মানবিক বোধে পৌঁছানোর পূর্ববৃত্তান্ত তেমন আভাস দেয়। বিশেষ করে তার বাম রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতা, সেখানে উগ্রতার প্রকাশ দেখে তা বর্জন এবং মানবিক চেতনার প্রতি বিশ্বাস ইত্যাদি ঘটনা ক্যামুর ঘটনাবহুল জীবনেরই প্রতিভাস, সন্দেহ নেই। ‘ভায়োলেন্স’ তথা হিংসা বা সহিংসতা সম্পর্কে ক্যামুর বিশেষ চিন্তা, সেক্ষেত্রে নিরক্ষবিন্দুতে অবস্থান ইত্যাদি আদর্শিক বিবেচনায় ক্যামু মানবতাবাদী হয়েও রাজনৈতিক আদর্শ-বিবেচনায় মধ্যপন্থী। তাই গান্ধীর অহিংসনীতি এর পছন্দসই।

মনোযাগী বিচার-ব্যাখ্যায় তাই মানবিক চেতনার তারুকেই ক্যামুর চিন্তাভাবনার প্রতিনিধিস্থানীয় বলে মনে হয়। কারণ তারুর অবশেষ বিচারে দুটো কথা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, ‘মানুষ’ শব্দটি (তুলনীয় রবীন্দ্রনাথ), দ্বিতীয় অহিংসা (তুলনীয় গান্ধী)। ‘হিংসায় উন্মত্ত তৃপ্তি’তে অহিংসা তথা শান্তি নিঃসন্দেহে সবারই কাম্য। রলাঁ, আইনস্টাইন, বার্বুস বা কুরিদের মতো বিচিত্র চিন্তার মানুষমাত্রের কাছে শান্তি তথা বিশ্বশান্তি পরম কাম্য।

কিন্তু এখানে ক্যামুকে ঘিরে বহুবিতর্কিত প্রশ্নটি সবার সামনে এসে দাঁড়ায় : অহিংসা দিয়ে কি হিংসাকে জয় করা যায় বা এ-তাবৎ কখনো জয় করা গেছে? গান্ধীর ভারত কি তেমন উদাহরণ রাখতে পেরেছে? অন্যদিকে পালটা প্রশ্নটিও কম গুরুত্বের নয়। ‘ভায়োলেন্স’ তথা হিংসা দিয়ে কি হিংসার মূল উপড়ে ফেলা গেছে? ‘দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ’ তুলে নিয়ে কি সমাধান মিলেছে?

এ-বিতর্ক দীর্ঘদিনের, দেশকাল নির্বিশেষে। এর তাত্ত্বিক সমাধান সর্বজনীন মতৈক্যে কখনো মেলেনি, তেমন সম্ভাবনাও নেই। এমন এক তাত্ত্বিক, দার্শনিক সংকটের সম্মুখীন হয়ে ক্যামু মধ্যপন্থী, অহিংসাবাদী, সীমিত হিংসা যদিও সে-ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে, ঘটনাবিচারে প্রশ্রয় পেতে পারে। ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে ক্যামুর বিবেচনায় এ-পথই শ্রেয় বিবেচিত হয়েছে। যদিও গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি অস্বিত্ববাদী জ্যঁ পল সার্ত্রের বিচারে। আর বাম রাজনীতিকদের কাছে তো নয়ই।

তবে এই দার্শনিক নৈতিক বিচার-বিশ্লেষণে দু-একটি  বিষয়ে উল্লিখিত দুজনের মতৈক্য লক্ষ করার মতো : প্রথমত, সততা-আন্তরিকতা এবং কর্মের দায়বদ্ধতা। খ্রিষ্টীয় পাদ্রি, ধর্মযাজকদের ‘স্যালভেশন’ তথা প্রথাসিদ্ধ পাপমোচনের প্রক্রিয়ায় এ-দুজনের বিশ্বাস নেই। মানবকল্যাণে কর্তব্য সম্পাদনই মূল কথা, বড় কথা বা তত্ত্বকথা সেখানে অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয়। প্লেগ উপন্যাসটিতে এজাতীয় বক্তব্যের আভাস-ইঙ্গিতও রয়েছে, যা ক্যামুর মতের স্বধর্মজাত।

শৈল্পিক বিচারে তাই আউটসাইডার ও প্লেগ কিছু আদর্শিক মিল সত্ত্বেও পরস্পরবিরোধী দুই বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত। ব্যক্তিজীবনে, সমাজজীবনে এবং রাজনৈতিক জীবনে একই নৈতিকতা ন্যায়নীতির পক্ষপাতী ক্যামু। কিন্তু বাস্তবে তা মেলাতে পারেননি। তাই মধ্যপন্থার নিরক্ষবিন্দুতে অবস্থান শ্রেয় বিবেচনা করেছেন।

আদর্শিক বা দার্শনিক তত্ত্বের বিবেচনায় ক্যামু তাঁর বিশ্বাসের ভুবনে তাই এক নিঃসঙ্গ ব্যক্তিত্ব। কারো মতে ট্র্যাজিক ব্যক্তিত্ব। স্পেনীয় একনায়কত্বের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান যদি কাউকে অসন্তুষ্ট করে থাকে, সেক্ষেত্রে স্তালিনিস্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান বামপন্থীদের ক্ষুব্ধ করেছে। এমনকি সার্ত্রেকেও।

ক্যামু মূলত কথাশিল্পী। একই সঙ্গে তিনি সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, চিন্তাবিদ ও বিনোদনশিল্পে আগ্রহী। তা সত্ত্বেও জীবিকার টানে, স্বাদেশিকতার প্রয়োজনে, আরো নানা পরিস্থিতির মোকাবেলায় ক্যাম্যু রাজনীতিবিযুক্ত অবস্থায় জীবনযাপন করতে পারেননি। কিন্তু রাজনীতি এই কথাশিল্পীর জন্য নিরন্তর সমস্যাই তৈরি করেছে। সেক্ষেত্রে সমাধানের কোনো পথ তৈরি করা যায়নি। তাই আত্মদহনে দগ্ধ হয়েছেন ক্যামু।

কেউ কেউ বলেন, তার মধ্যে প্রবল স্বভাবগত অস্থিরতা ছিল। ছিল দোলাচলবৃত্তি, যেজন্য রাজনীতি প্রসঙ্গে নির্ধারিত বা নির্দিষ্ট বিন্দুতে স্থির হতে পারেননি। প্রয়াত শিল্পীর কন্যা ক্যাথেরিন ক্যামুর মতে (১৯৯৫) ক্যামু সোভিয়েট একনায়কত্ববাদ মেনে নিতে পারেননি। এক্ষেত্রে মানবিকবোধকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই বিরোধিতা। তাছাড়া বহুকথিত তাত্ত্বিক বিতর্ক ‘লক্ষ্যই উপায়ের নিয়ন্তা’ এমন ধারণার তিনি প্রবল বিরোধী। বরং পদ্ধতির প্রকৃতিই তাঁর চোখে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু বামচিন্তার শিল্পীও রাজনীতিক প্রথমোক্ত নীতিতে বিশ্বাসী।

আলজিরিয়া প্রশ্নেও তার মতামত অনেকটাই নিঃসঙ্গ। তিনি আরব মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে নন। বরং এক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর সমতায় গঠিত ফেডারেশনে বিশ্বাসী। এ মত ফরাসি বুদ্ধিজীবী – কি বাম কি ডান কোনো শিবিরেই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। এভাবে ফরাসি সমাজের দুপক্ষকেই বিরোধী করে তুলেছেন ক্যামু তাঁর অটল নৈতিক চিন্তায়। ফলে মৃত্যুর পূর্ববর্তী সময়ে ক্যামু একেবারেই নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন এবং নানা ফ্রন্ট থেকে আক্রমণের শিকার – এমনই অভিমত ক্যাথেরিন ক্যামুর (আলবের ক্যামুর বিচ্ছিন্ন আত্মজীবনী, The First Moon)।

বাস্তবিক উল্লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। বরং এর সঙ্গে যোগ করতে হয় এমন বক্তব্য যে, ক্যামু রাজনীতি অপছন্দ করলেও রাজনীতি থেকে তাঁকে বিযুক্ত করা যায় না, তার প্রমাণ তার রাজনৈতিক রচনাবলি এবং The Rebel-সহ একাধিক রচনায় রাজনীতিসংশ্লিষ্ট তাঁর তাত্ত্বিক বক্তব্য।

আসলে রাজনীতি আমাদের ব্যক্তিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এতটাই প্রভাব রাখে যে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত জীবন কল্পনা করা যায় না। সাধারণ মানুষ এ-বিষয়ে তত্ত্বগতভাবে সচেতন না হলেও এর প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে শিক্ষিত শ্রেণি, বিশেষত এলিট শ্রেণি রাজনীতির নানামাত্রিক সামাজিক প্রভাব নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ পছন্দ করে থাকে। ব্যতিক্রমী লেখকের সংখ্যা খুবই সামান্য। আর এই শিক্ষিত শ্রেণির একাংশ তো রাজনীতিতে নিমজ্জিত।

হাতে গোনা কয়েকটি উপন্যাসিকা ও উপন্যাস রচনার মাধ্যমে আলবের ক্যামুর আন্তর্জাতিক খ্যাতি, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ (১৯৫৭) এবং মোটর দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যু (১৯৬০)। জনম আলজিরিয়ায় ১৯১৩ সালে। সাংবাদিকতা তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা তাঁকে কথাসাহিত্যের জগতে টেনে আনে এবং সেক্ষেত্রে প্রতিভার প্রকাশ ঘটায়। তাঁর শেষ উপন্যাস (১৯৫৬) The Fall (La Chute), আউটসাইডারের মতো না হলেও এর পাঠকপ্রিয়তা অনস্বীকার্য।

উত্তমপুরুষে বর্ণিত এ-কাহিনির বক্তা স্বেচ্ছানির্বাসিত একজন চৌকস প্যারিসীয় আইনজীবী (ব্যারিস্টার)। উপন্যাসটির আঙ্গিক ও বাকভঙ্গি রীতিমতো ভিন্ন এবং আকর্ষণীয়। আমস্টারডামে বসে অনেকটা রাজকীয় ভঙ্গিতে আত্মসমালোচনা ও আত্মউন্মোচনের মধ্যে দিয়ে শুধু তাঁর ব্যক্তিজীবনেরই নয়, উঠে এসেছে ফ্রান্সের নাগরিক সমাজ, অভিজাত সমাজে নিহিত নৈতিক অবক্ষয়, শঠতা, নীচতা, ভন্ডামি, যৌনতা এবং লোভলালসার প্রতিফলন।

কিছুটা রোমান্টিক শব্দভাষ্যে অথচ পূর্বাপর তির্যক বাকভঙ্গিতে দূষিত নাগরিক সমাজচিত্র বর্ণনার পাশাপাশি স্বকৃতপাপের ও সরস বিবরণ পেশ করেছেন কল্পিত শ্রোতার সামনে। এমনকি তাঁর শাস্তির দৃশ্যটিও স্যাটায়ারিক ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন ক্যামুচিত্রিক নায়কের মতোই নির্ভীক বয়ানে। মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে (‘I’d have no more fear of death; I’d be saved’ ইত্যাদি) গিলোটিনে তাঁর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, তাও আবার নিরাপদ দূরত্বে বসে। এলিট শ্রেণির অন্তঃসারহীন ভন্ডামির চিত্র এঁকেছেন ক্যামু এ-উপন্যাসে আইনজীবী চরিত্রটির মাধ্যমে।

একটি স্ববিরোধিতায় বলা যায়, নৈতিক-শৈল্পিক স্ববিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে ঔপন্যাসিক ক্যামু এবং রাজনৈতিক ও দর্শনতাত্ত্বিক রচয়িতা ক্যামুর মধ্যে। তাঁর তিনটি উপন্যাসের মর্মার্থ বিবেচনায় যে-মিল পাঠকের নজরে আসে, তার সঙ্গে আদর্শিক বিচারে তিনটি ভিন্নধর্মী তাত্ত্বিক রচনায় তেমনই অমিল। কারণ স্পষ্ট। শেষোক্ত রচনাগুলোতে মতাদর্শগত বিচারে নীতিবাদী ক্যামুই প্রধান। অন্যদিকে উপন্যাসে শিল্পসৃষ্টা ক্যামু শিল্পকর্মকে প্রধান করে তুলেছেন, মতাদর্শগত বিতর্ক নয়। যদিও কখনো অস্তিত্ববাদের প্রতিফলন স্পষ্ট, যেমন দ্য আউটসাইডার।

ক্যামুর জীবন-জীবিকা-সাহিত্য সম্পর্কে আরো একটি বিষয় বিবেচ্য যে, জীবিকার প্রয়োজনে তাঁর সাংবাদিকতার পেশায় যোগদান এবং সাংবাদিকতা তাঁকে রাজনৈতিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে। অন্যদিকে সাংবাদিকতার লেখালেখি থেকে তাঁর সাহিত্যজগতে প্রবেশ এবং যশ, খ্যাতি অর্জন।

কিন্তু সাংবাদিকতার বাস্তবতা একজন সাংবাদিককে রাজনৈতিক চিন্তায় যে-সত্যের মুখোমুখী করে দেয়, তাতে ভাববাদের অবকাশ থাকে না। বস্ত্তসত্যই যেখানে প্রধান হয়ে ওঠার কথা। ভাবতে অবাক লাগে, তা সত্ত্বেও আলজিরিয়ার সমাজবাস্তবতার অভিজ্ঞতা এবং ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের নিপীড়ন-নির্যাতন সত্ত্বেও ক্যামু কেন সেক্ষেত্রে শ্রেণিবৈষম্যের সত্যকে প্রাধান্য দিতে পারেননি? তাত্ত্বিকতা কেন সেখানে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়? মার্কসবাদকে গ্রহণ না করেও সমাজপ্রগতির বিষয়টিকে গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সে-পথে হাঁটার আকর্ষণ বোধ করেননি ক্যামু।

কেন? এটা কি তাঁর স্বভাব-প্রকৃতি বৈশিষ্ট্যের কারণে? নাকি কোনো ব্যক্তিগত ঘটনা তাঁর চৈতন্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। অথচ Resistance শব্দটি তো তার অন্তত প্রিয়, এবং তা একাধিক অভিধায়। নাকি দর্শনের ছাত্র হওয়ার কারণে তাত্ত্বিক বিচার ও ভাববাদ তাঁর চেতনায় গভীর দাগ কাটে যেজন্য তাত্ত্বিক নৈরাজ্যে ডুবে গিয়ে বাস্তব সত্যকে হারিয়ে ফেলেন ক্যামু তাঁর নৈতিক ও রাজনৈতিক বিচারব্যাখ্যায়। এসব প্রশ্নের জবাব অনেকটাই অধরা থেকে গেল তার অকালমৃত্যুর কারণে। দীর্ঘায়ু জীবন হয়তো অনেক অস্পষ্টতার অবসান ঘটাতে পারত। এ অতৃপ্তি ক্যামুর পাঠকমাত্রেরই।