ক্যালকাটা স্কাল্পচার্সের প্রদর্শনী

দেবব্রত চক্রবর্তী
শিল্পে অনুভব ও উপলব্ধি যেমন আছে, সেরকম আছে আলোচনা ও সমালোচনা। শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে একটা সেতু গড়ে ওঠে শিল্পীর সৃজনকে ঘিরে। যখন একজন চিত্রী ছবি আঁকেন বা একজন ভাস্কর ভাস্কর্য-সন্ধানে নিজেকে সংযুক্ত করেন, তখনই অনুভব ও উপলব্ধির সন্নিবেশ ঘটে। এই আলোচনায় কয়েকজন ভাস্করের ভাস্কর্য-সন্ধান নিয়ে। কলকাতায় কেন, সারা ভারতবর্ষ ঘুরলেও একটা সম্পূর্ণ ভাস্করদের দলের ঠিকানা মেলা দুরূহ। আজকের আলোচনায় ‘ক্যালকাটা স্কাল্পচার্স’ শিল্পী দলের। এই দলের বিভিন্ন ভাস্করের কাজ নিয়ে একটি বড় মাপের প্রদর্শনী হয়ে গেল কলকাতার আকাদেমি অব ফাইন আর্টসের নর্থ গ্যালারিতে, যার সময়কালের বিসত্মৃতি ছিল ১ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ পর্যমত্ম। এগারোজন ভাস্করের ভাস্কর্যের অনির্বাণ প্রদর্শনী। এঁদের মধ্যে কেউ-কেউ সুপরিচিত এবং বিশিষ্ট ভাস্কর। শুধু ভাস্করদের নিয়ে পৃথক এই সংগঠন ‘ক্যালকাটা স্কাল্পচার্স’। এই দলের পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ থেকে। সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল নবীন প্রতিভাধর ভাস্করদের কারিগরি শিক্ষা, বৃত্তি এবং স্বীকৃতি পাইয়ে দেওয়া। সেদিকে লক্ষ্য রেখে এই দলের প্রথম প্রদর্শনী ১৯৯৪-তে। প্রবীণদের সম্মান জানানো এবং নবীনদের উৎসাহ-জাগানো এই ব্রত নিয়ে এই দলের এগিয়ে চলা। কেমোল্ড গ্যালারির কেকো গান্ধী, চিত্রকুট আর্টস গ্যালারির প্রকাশ কেজরিওয়াল এবং বিশিষ্ট ভাস্কররা যেমন সুনীল পাল, বিপিন গোস্বামী, অজিত চক্রবর্তীরা সংবর্ধিত হয়েছেন। এই সংস্থায় প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল কলকাতার বিড়লা আকাদেমিতে। এবারের প্রদর্শনী ২১তম প্রদর্শনী। প্রবীণ ভাস্কর শঙ্কর ঘোষ থেকে শুরু করে এই দলের প্রতিষ্ঠাতা ভাস্কর অনিল সেন হয়ে নবীনতম ভাস্করদের নিয়ে এই প্রদর্শনীর সমুজ্জ্বলতা। শঙ্কর ঘোষের একগুচ্ছ ভাস্কর্য-সন্ধানে নিজস্ব শৈলীর সম্পৃক্ত শিল্পভাষা। ইতোমধ্যে দশটি একক এবং বহু সম্মেলক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। প্রথম প্রদর্শনী ১৯৬৩-তে কলকাতায়। নানা বিষয় সন্ধানের এবং বিভিন্ন মাধ্যমের ভাস্কর্যের সমারোহ। অনিল সেনের শিল্প-শিক্ষণের পাঠ কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে। বহু সম্মেলক প্রদর্শনী ও শিল্প কর্মশালায় অংশগ্রহণ। ইতোমধ্যে পাঁচটি একক প্রদর্শনী করেছেন। ভাস্কর হিসেবে যেমন বিশিষ্টতা লাভ করেছেন, তেমনি একজন ভালো সংগঠক হিসেবে সুপরিচিত অনিল। এই প্রদর্শনীর ‘ওয়েটিং’ শিরোনামায় কাজটি নজর কাড়ে। সুব্রত পাল সুপরিচিত ভাস্কর। পুরস্কারপ্রাপ্তি এবং বহু প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। প্রদর্শনীতে অন্যমাত্রার ভাস্কর্য-সন্ধান মিশ্রমাধ্যমে। কিঙ্কর সাহার শিল্প-শিক্ষণের পাঠ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য-সন্ধানের যথার্থতার সৃজনবাহার এই প্রদর্শনীতে। চন্দন রায়ের নিজস্ব শৈলীর কাজ এই প্রদর্শনীতে। তাপস সরকারের শিল্প-শিক্ষণের পাঠ কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে। বহু একক, সম্মেলক ও শিল্প-কর্মশালায় অংশগ্রহণ। এই প্রদর্শনীর ‘বোষ্টম বোষ্টমি’ শিরোনামায় কাজটি নজর কাড়ে। প্রবীর কুমার রায়ের বহু প্রদর্শনী ও শিল্প-কর্মশালায় অংশগ্রহণ। এই প্রদর্শনীতে এই ভাস্করের সম্পৃক্ত শিল্প-ভাষায় সৃজন উপস্থাপনা। সোমনাথ চক্রবর্তীর শিল্প-শিক্ষণের পাঠ কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে। বহু একক ও সম্মেলক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। এই প্রদর্শনীতে নিজস্ব আঙ্গিকের কাজ। আর এক ভাস্কর তন্ময় ব্যানার্জির শিল্প-শিক্ষণের পাঠ শামিত্মনিকেতনের কলাভবনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দেশে ও বিদেশে বহু প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। প্রদর্শনীর নিজস্ব শৈলীর ভাস্কর্য-সন্ধানে এক অন্য মাত্রা আছে। ব্রোঞ্জকৃত সারমেয়টি অনবদ্য।
সুব্রত বিশ্বাসের টেরাকোটাসমৃদ্ধ কাজে এক অন্য মাত্রা।
শিল্প-শিক্ষণের পাঠ কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বহু প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ এবং সৃজনমহিমা প্রশংসার দাবি রাখে। এই ভাস্করের একটি কাজের শিরোনাম ‘পেস্ন উইথ ফিশ’। এক অন্য মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত এই কাজ। প্রভাত মাঝির শিল্প-শিক্ষণের পাঠ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একক ও সম্মেলক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। এই প্রদর্শনীতে একগুচ্ছ নিজস্ব শৈলীর শিল্পভাষায় সম্পৃক্ত কাজ।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ভাস্কর অনিল সেনের কথায় – ‘নবীন প্রজন্মের যেসব ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন আর্টস কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম বর্ষের ভাস্কর বিভাগের তাঁদের মধ্য থেকে আমরা প্রতিবছর দুজনকে ক্যালকাটা স্কাল্পচার্সের স্কলারশিপ প্রদান করি। এই স্কলারশিপের অর্থমূল্য নিমণতম পাঁচ হাজার টাকা এবং ঊর্ধ্বসীমা আরো খানিকটা ওপরে। আমাদের দলের ফান্ড অনুযায়ী এই অর্থমূল্য নির্ধারিত হয়।’
জীবন ও প্রকৃতি। পরিবেশ বা প্রকৃতি জীবনকে জড়িয়ে থাকে। এই জীবনই শিল্পীর সৃজনের উৎস-সন্ধান। এই প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে চিত্রী ও ভাস্কররা তাঁদের রসদ জোগাড় করেন। প্রত্যেক কারিগরই একজন শিল্পী, আর প্রত্যেক শিল্পীই একজন কারিগর। বাস্তবের বিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে মননের পরিম-লও বিবর্তিত হয়। এরই নাম আধুনিকতা। আর উত্তর-আধুনিকতা হলো ওই আধুনিকতারই প্রসারণ।
এই সময়ের ভাস্করদের মধ্যে এখন উত্তর-আধুনিকতা উপস্থিত। সেখানে ইন্সটলেশনের একটা ভূমিকা এসে পড়ে। এই ক্যালকাটা স্কাল্পচার্সের প্রদর্শনীতে এসে আধুনিকতার নানা রূপামত্মর,
শিল্প-ভাবনার বিভিন্ন বিকাশ প্রকরণ এবং বিভিন্ন ভাস্করের বিভিন্নতার সৃজন। এই বিভিন্নতা অর্থাৎ গঠনশৈলীর, বিষয়-সন্ধানের এবং মাধ্যমের। এই বিবিধের মাঝে এক মহামিলন। এই দলের এই এগিয়ে চলাকে স্বাগত জানাতেই হয়। আগামীতে শুভেচ্ছা।