গগনশিরিষ

ফয়জুল ইসলাম

সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম মহল্লার হাজি সাহেবের হলুদ দোতলা বাসাটা যখন ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ভাঙা শুরু হয় তখনই সামাদ বুঝতে পারে, পুরনো গগনশিরীষ গাছটাকে মেরে ফেলা হবে। আর তখনই বেশি বেশি করে মনে পড়ে মৃত তপনের কথা। ওই গগনশিরীষের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে বিয়াল্লিশ বছর আগে তপন বলত – ‘এই গাছটা দেখলেই না রুনুর কথা খুব কইরা মনে পড়তে থাকে! আচ্ছা দোস্ত, রুনু গগনশিরীষের মতন লম্বা না?

আর মাইয়াডার চেহারা কী সুন্দর! কাজইল্যার মতন যদি কবিতা লেখতে পারতাম, তা হইলে ভালো হইত জানোস!’ এই একই কথা তপন কতবার যে সামাদকে বলেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আর সামাদও বারবার খুঁচিয়েছে তাকে একই কথা বলে – ‘এত প্যাচাল না-দিয়া কালীবাড়ি মন্দিরের সামনে যাও গিয়া, ‘রায়পুর হাউসে’র বারিন্দায় যদি রুনু আইসা খাড়ায়!’ কিন্তু রুনু তো আর যখন-তখন ৪৩ সিদ্ধেশ্বরী লেনের বারিন্দায় দাঁড়াত না। তারপরও রুনুদের বাসার সামনে দিয়ে সময়-নেই অসময়-নেই হাঁটাহাঁটি করত তপন। রুনুকে কেবল তাদের দোতলার বারান্দায় নিয়ম করে দেখা যেত মাগরিবের ওয়াক্তের পরপর মাত্র মিনিট পাঁচেকের জন্য। আর তখন মন্দিরের দেয়ালের সঙ্গের ছোট চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে চা-সিগারেট খাচ্ছে তপন আর সামাদ। কখনো-কখনো তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে মহল্লার অন্য বন্ধুরা – মতিন, সাদেক অথবা বাসুদেব। যেহেতু রুনু বারান্দায় বেশিক্ষণ থাকবে না, কাজেই বন্ধুদের মশকরা উপেক্ষা করে রুনুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তপন। অন্ধকারের ভেতর তখন রুনুর উজ্জ্বল দুচোখ মোটেই দেখা যায় না, দেখা যায় না তার এলোমেলো চুল অথবা সালোয়ার-কামিজের রং। তখন পাতলা-সাতলা আর লম্বা করে মেয়েটাকে দেখে তপনের মনে হয়, যেন অন্ধকারের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর, উদ্বাহু গগনশিরীষ।

হাজি সাহেবের দোতলা বাড়িটা ভেঙে ফেলার পর ১১ এপ্রিল ২০১৩ বৃহস্পতিবার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডার কেটে ফেলে বাড়িটার সীমানার ভেতরের সমস্ত গাছ। আম, কাঁঠাল অথবা মেহগনির সার মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ার পর তেমন একটা কষ্ট পায়নি সামাদ। কিন্তু মহল্লার একমাত্র গগনশিরীষ – যেটার দিকে তাকিয়ে একদা রুনুকে নিয়ে কবিতা লেখার কথা ভাবত তপন – সেই গাছটাকে যখন কেটে ফেলে করাতিরা, তখন আরো বেশি করে মনে পড়তে থাকে তপনের কথা। আহারে তপইন্যা! কতদিনই দেখি না তরে – বিয়াল্লিশ বচ্ছর হইব! তুই জিন্দা নাই, তর পেয়ারের গগনশিরীষও ভ্যানিশ হয়া গেল গা!

সেদিনই সন্ধ্যায় মৌচাক মার্কেটে তার শাড়ির দোকান জলদি-জলদি বন্ধ করে দেয় সামাদ। বাসায় ফিরে তার স্ত্রী লুনাকে বলে, ‘লও, রুনুরে দেইখা আসি গিয়া।’ তারপর সামাদ আর তার স্ত্রী লুনা দিলু রোডে রুনুর শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যায়। সেই বাড়িতে বসার ঘরের সোফায় বসে টিভিতে সন্ধ্যার খবর দেখে রুনুর সুদর্শন জামাই আর গল্প করে সামাদ ও লুনার সঙ্গে। তখন তপনের কথা মনে পড়ে যায় সামাদের। তপনের উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি মতো, গায়ের রংটা শ্যামলা আর গায়ে-গতরে যেন কোনো মাংসই নেই! চেহারাসুরত দেখে মোটেই তাকে আকর্ষণীয় বলা যেত না। কিন্তু তপনের হাসিটা খুব সুন্দর ছিল। ও হাসলে মনে হতো যেন তার হৃদয়ের সমস্ত ঔজ্জ্বল্য ঝকঝকে দাঁতের ফাঁক গলে ঠিকরে পড়ছে চারদিকে! আর রুনুর জামাইটা কেমন যেন দাঁত ক্যালায়া দিয়া হাসতে থাকে সকল সময়! এটা ভালো লাগে না সামাদের।

আর সেই বাড়িতে তখন বিশ-বাইশ বছরের দুটো মেয়েকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। মেয়ে দুটো যমজ – একেবারে রুনুর কপি! রুনুর মেয়ে দুটোকে দেখলে তপনের কথা আরো বেশি করে মনে পড়ে সামাদের। ১৯৭১ সালে তার সহযোদ্ধা তপন প্রায়ই বলত – ‘মুক্তিযুদ্ধ যে কবে শেষ হইব দোস্ত! যুদ্ধ শেষ হইলে রুনুরে আমি বিয়া করুম।’ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই কোনো একরাতে কমলাপুর রেলস্টেশনে হামলা করার সময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মরে গেল তপইন্যা। হয়তো তপন আর রুনুরও যমজ মেয়ে হতে পারত! কেমন দেখতে হতো তারা? সামাদের মনে হয়, তপন আর রুনুর মেয়েরা রুনুর মতোই দেখতে সুন্দর হতো – কোনো সন্দেহ নাই তাতে। এসব ভাবনা বেশিক্ষণ চলে না, কেননা রুনু আর লুনা কোনো একটা কিছু নিয়ে খুব হাসছে তখন। আর তাতে ভেঙে যায় সামাদের তপন-বিষয়ক ভাবনা। হাজি সাহেবের বাসার গগনশিরীষ কেটে ফেলার কারণে সারাদিনই মনখারাপ ছিল তার। সে-কথা তাই সে একফাঁকে অকপটে বলে ফেলে রুনুকে : ‘বুঝলা রুনু! গগনশিরীষের গাছটা কিন্তু আইজকা কাইটা ফেলছে! হাজি সাহেবের বাসা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডাররে দিয়া দিছে – জানো তো?’

তখন থমকে গিয়ে সামাদের চোখে অল্পক্ষণ তাকিয়ে থাকে হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে যাওয়া রুনু। তারপর রুনু বলে : ‘আপনের বন্ধুই যখন বাঁইচা নাই, তার প্রিয় গাছের দিকে তাকায়া থাইকা কী পাইতেন আপনে?’ রুনুর সে-প্রশ্নের কোনো উত্তর করে না সামাদ। কিন্তু সামাদের মনে হয়, তপনের প্রিয় গগনশিরীষের অনুপস্থিতি তীব্র হাহাকার তুলতে পারে রুনুর খুব গভীরে। রুনুর তখন মনে পড়বেই, ধুন্ধুমার বৃষ্টিতে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া গাছটার দিকে একদা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত তপন; আর সে ভাবত, কোনো একদিন অঝোর বৃষ্টির ভেতরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকবে রুনু আর সে কয়েকটা সাদাকালো ছবি তুলবে তখন। নিউমার্কেটে রেশমি চুড়ি কিনতে গিয়ে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের মাঠে বসে ফুচকা খেতে খেতে এ-কথাটা রুনুকে বহুবার বলেছিল তপন সেই কবে কোন কালে – ঊনসত্তর অথবা সত্তরে। কিন্তু একটা ক্যামেরা জোগাড় করার আর সময় পায়নি তপন। তার আগেই উনিশশো একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তারপর কতই না ছবি তোলা হয়েছে রুনুর! কিন্তু বৃষ্টির ভেতরে রুনুর দাঁড়িয়ে থাকার ছবি কেউ তুলতে চায়নি, রুনুও বলেনি কাউকে তেমন একটা ছবি তুলে দিতে কোনোদিন। যে-মানুষটা একদা তার ছবি তুলে দিতে চেয়েছিল, সেই মানুষটাই যখন বেঁচে নেই, তখন তার তুলে দেওয়া ছবি শাড়ির ভাঁজে অতি সাবধানে সবার চোখের আড়াল করে রেখে দিয়ে অথবা লুকিয়ে-লুকিয়ে একটু দেখলেই বা কী লাভ হতো রুনুর! তার চাইতে তপনের এ-স্বপ্নটা অথবা এমন আরো অনেক স্বপ্নই বেশি জীবন্ত হয়ে জেগে থাকে রুনুর মনের ভেতর। কিন্তু সামাদ ভাইয়ের চিন্তাভাবনা অন্যরকম। সে কেবল তপনের ফেলে যাওয়া চিহ্ন খুঁজে বেড়ায়! এটা নিয়ে আবারো বিতর্ক করতে পারত রুনু। কিন্তু রুনুর জামাইয়ের উপস্থিতিতে সেটা আর হয়নি সেদিন। এ-ই হয় – রুনুর বাসায় বেড়াতে গেলে তপনকে নিয়ে তেমন কোনো কথাই বলতে পারে না সামাদ। তপন আর রুনুর কোনো এককালের সম্পর্কের কথা একান-ওকান থেকে কিছুটা হলেও জানে রুনুর জামাই। কাজেই তার সামনে তপনকে নিয়ে কথা বলতে সকল সময়েই অস্বস্তি হয় সামাদের। তো রুনুই যায় সামাদদের সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে প্রায় প্রায়ই। তপনকে নিয়ে তখন রুনুর সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যায় অনেক।

তপনের স্মৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত সিদ্ধেশ্বরীর মানুষজনকে আজকাল আর সহজে হাতের কাছে খুঁজে পায় না সামাদ। যেমন সাদেক আর বাসুদেব সত্তর দশকের শেষের দিক থেকেই দেশের বাইরে। বছর দুই-তিনেক পরপর দেশে বেড়াতে আসে ওরা। তখন ওদের সঙ্গে মৃত তপনকে নিয়ে অনেক গল্প হয়। মতিনের বাবা মোহাম্মদপুরে শিয়া মসজিদের ঢালে বাসা বানিয়েছে আশির দশকের প্রথম দিকে। মতিন তো মতিঝিলে তার ব্যাংকের কাজ শেষ করেই সোজা মোহাম্মদপুরে ফিরে যায়। সিদ্ধেশ্বরীতে সে তেমন একটা আসেই না আর। মাঝে মাঝে ফোনে এটা-সেটা কথা হয় মতিনের সঙ্গে। এদিকে তপনের মা মারা গেছে অনেক আগেই – তপন মারা যাওয়ার আট বছরের মাথায়। উচ্চ রক্তচাপ থেকে পয়লা স্ট্রোক হয় তপনের মায়ের এবং পরে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে যাওয়ার পর নষ্ট হয়ে যায় তার দুটো কিডনিই। কাজেই তপনের মায়ের পাশে বসে বসে তপনকে নিয়ে গল্প করাটাও বন্ধ হয়ে গেছে সামাদের। তাহলে তপনের ঘনিষ্ঠ মানুষজনের ভেতরে থাকল বাকি রুনু আর সামাদের ছোট বোন মাসুদা, যাদের সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় হাতের কাছে। রুনু থাকে দিলু রোডে আর মাসুদা ইস্কাটনে। তাই ১৯৭১ সালে তপন মরে যাওয়ার পর থেকে কোনো না কোনো রোববারে রুনুকে ফোন করে সামাদ : ‘ওই মিয়া! বুইড়া হয়া গেছি বইলা পাত্তা দিতেছ না – তাই না?’

‘আমারো তো ষাইট বচ্ছর পার হইছে! সেই জন্যেই তো আগলা মাসে আপনে একবারের জন্যেও ফোন দেন নাই! আমিও ফোন কারি নাই রাগ কইরা!’ ফোনে কথা বলতে বলতে তখন রুনু হয়তো হাসছে!

‘চইলা আসো আইজকা। রবিবার বইলা মৌচাক মার্কেট তো আইজ বন্ধ। আইজকা আমার আর দোকান খুলতে লাগব না।’

খুব জরুরি কাজ না-থাকলে রুনু তখন সিদ্ধেশ্বরীতে আসে। হয়তো রুনু কোনো রোববারে সামাদের বাসায় থেকে যায় সারাদিন। হয়তো কোনো রোববারে সে আসে কেবল ঘণ্টাখানেকের জন্য। কিন্তু রুনু আসে; সামাদ ডাকলে সচরাচর সে না-করে না, কেননা সে জানে, তপনের কথা খুব বেশি মনে না-হলে সামাদ তাকে খুঁজবে না। কিংবা কোনো কোনো রোববার সকালে সামাদকে ফোনে জিজ্ঞাসা করে স্বয়ং রুনু : ‘বাসায় আছেন নেকি সামাদ ভাই? নেকি শাড়িউড়ি বেচতে যাইতেছেন? আসুম আমি?’

সামাদ তখন বলে : ‘আরে মিয়া আইসা পড়ো না! আইজকা তো রবিবার। আমগো মৌচাক মার্কেট বন্ধ।’ পৃথিবীর যত কাজ সব বন্ধ করে দিয়ে রুনুর জন্য তখন অপেক্ষা করবে সামাদ। রুনু বাসায় ঢুকতেই সামাদ প্রতিদিন হন্তদন্ত হয়ে কথা শুরু করবে এভাবে : ‘আরে রুনু! তুমি আইসা পড়ছ? তোমার লগে খুব দরকারি কথা আছে!’ এবং প্রতিবারই রুনু উত্তর করবে : ‘জানি সামাদ ভাই। বলেন।’ তারপর বসার ঘরের সোফায় গিয়ে বসবে রুনু।

তেমন কোনো এক রোববারে, ধরা যাক ১৯৭৮ সালে, সামাদ রুনুকে বলে : ‘পরশুদিন কী হইছে জানো? পুরান জিনিসপত্তরের ভিতরে আমাগো ছোটকালের মার্বেলগুলা খুঁইজা পাইলাম। হরলিকসের বয়ামের ভিতরে মার্বেলগুলা কবে যে রাখছিলাম তা মনেই আছিল না!’

রুনু তখন কৈশোরের স্মৃতিতে আক্রান্ত হয়। সে বলে, ‘ওই যে আপনেরা রাস্তার উপরে যেই মার্বেলগুলা দিয়া খেলতেন – সেইগুলা? আমি আর মাসুদা মিল্লা আপনের মার্বেল চুরি করছি বহুত! আর আপনে খালি চেইতা যাইতেন।’

‘ঠিকই কইছ। চেতুম না ক্যান? একখান মার্বেলের অনেক দাম আছিল – তা জানো? বাসা থিকা পয়সা চুরি কইরা না-হইলে বাজারের পয়সা মাইরা শান্তিনগরের একটা দুকান থিকা মার্বেল কিনতে হইত আমাগো!’

সামাদের সে-কথা শুনে হাসতে থাকে রুনু আর মাসুদা। তখন রুনু বলে : ‘আমি না একবার তপনের গাঢ় নীল রঙের একটা মার্বেল চুরি করছিলাম! তপন সেইটা টের পাইছিল দুই-তিন দিন পরে। সে কি রাগ তার! তার রাগ দেইখা মার্বেলখান ফিরত দিছিলাম আর কি! মার্বেল নিয়া কেন যে আপনেরা এত ফালাফালি করতেন! আপনেগো ছেলেমানষি দেইখা আমি আর মাসুদা কতই না হাসছি!’

‘হরলিকসের বয়ামের ভিতরে তপইন্যার সেই নীল মার্বেলডাও খুঁইজা পাইছি জানো! ওইডা হের খুব পছন্দের মার্বেল আছিল। দেখবা তুমি?’

‘কই? বয়ামটা আনেন না! দেখি।’

সামাদ হরলিকসের বয়ামটা আনে। একটা প্লাস্টিকের বাটিতে মার্বেলগুলা ঢালে। তারপর নীল মার্বেলটা রুনুর হাতে তুলে দিয়ে বলে : ‘এইডা তুমি নিবা রুনু?’

নীল মার্বেলটা বাম হাতের পাঞ্জায় বসিয়ে রেখে মার্বেলের ওপরে ডান হাতের আঙুলগুলো বুলাতে বুলাতে সেই রোববার রুনু উত্তর করে : ‘আরে না! মার্বেলখান আপনের কাছেই থাক। আমি আইসা আইসা দেইখা যাব। হেইডাই ভালো।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু তুমি সেই ফুলদানিডা ঠিকঠাক মতো রাখছো তো? ওই যে তপইন্যা যেইডা তোমারে নিউমার্কেট থিকা কিনা দিছিল? রেশমি চুড়িও কিনছিলা তুমি সেইদিনকা।’

‘হ! সিরামিকের ছোট্ট একখান সাদা ফুলদানি। ফুলদানির গায়ে ফুলপাতার ছবি। ওইডাতে তো আমি এখনো ফুল রাখি।’

‘কামিনীফুল রাখ – তাই না?’

‘কামিনী ছাড়া আর কোনো ফুল রাখি না ওই ফুলদানিডায়। আপনের মনে আছে সামাদ ভাই, আপনের বন্ধু তপনের সবচাইতে প্রিয় ফুল আছিল কামিনী?’

‘মনে থাকব না ক্যান? রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পাশের একখান নার্সারি থিকা তুমি আর তপইন্যা ছয়খান না কয়খান জানি কামিনীফুলের গাছ কিনছিলা সেই আটষট্টি সনে। আলবত মনে আছে আমার।’

সেই রোববারে তখন রুনু বলতে থাকে : ‘সেইসুম আমি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে ক্লাস টেন শেষ করতাছি। আর তপন নটর ডেম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। তো আমি প্যাটের ব্যথা বইলা স্কুল থিকা পালায়া গিয়া তপনের সঙ্গে কামিনীফুলের গাছ কিনতে গেছিলাম। পাঁচখান গাছ কিনছিলাম আমরা। কী যে ভয় পাইছিলাম সেইদিনকা সামাদ ভাই! সেই প্রথম স্কুল থিকা পালাইছি! কেউ যুদি দেইখা ফালাইত, তা হইলে কী করতাম আমি?’

‘আর তপইন্যা কইছিল যে তুমি মুরগির লাহান ভীতু। তাই না?’ হাসতে হাসতে রুনুকে জিজ্ঞাসা করে সামাদ।

রুনু উত্তর দেয় : ‘এমন ফাজিল আছিল আপনের বন্ধু! কয় কী – এত ডরাও তুমি? মুরগির খোপের ভিতরে ঢুকো গিয়া!’

‘হ! তপন ভাইয়ের সাহস আমাগো খুব দেখা আছে!’ সামাদের বোন মাসুদা তখন সামাদ আর রুনুর আলোচনার ভেতরে ঢোকে। মাসুদা বলে : ‘একবার হইছে কী, তপন ভাইয়ের ঘরের জানালায় চোর আইসা খাড়াইছে। তপন ভাইতো ‘চোর! চোর!’ বইলা এমন একখান চিক্কুর দিলো যে আমার ঘুমই ভাইঙ্গা গেলগা। সাথে সাথেই আমি জানলা দিয়া তাকাইছি। দেখি যে চোর ব্যাটা একদৌড়ে আইসা দেয়াল পার হইয়া আমাগো বাসার ভিতরে লাফ দিতাছে। তখনো তপন ভাই চেঁচাইতেছে ‘চোর! চোর!’ বইলা। চিন্তা কর!’

স্বল্পভাষী মাসুদার তপন বিষয়ক স্মৃতির বর্ণনা শেষ হলে রুনু, সামাদ আর সামাদের বউ লুনা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে সোফায়। তখন সামাদের মনে পড়ে, একদা তপন তাদের বাসার বাগানে রাজারবাগ থেকে কিনে আনা কামিনীফুলের গাছগুলো লাগিয়েছিল খুব যত্ন করে। দুঃখের কথা হলো, তপনদের টিনের চালের বাসাটা কিছুদিন আগে ভেঙে ফেলে যখন অ্যাপার্টমেন্ট তোলা হয় তখন কাটা পড়েছে সেই কামিনীগাছগুলো।

সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম-মহল্লায়, ধরা যাক ১৯৭৮ সালের কোনো এক রোববারে, সামাদের বাসায় তপনকে নিয়ে এমনই বিভিন্ন আলোচনা হয়। সেই রোববারে সামাদদের বসার ঘরের সোফায় বসে পুবে তাকালে শ্রাবণের কালো মেঘের কোলে সাদা রঙের একটা নতুন পাঁচতলা বাসা চোখে পড়ে রুনুর। ওটা ১১১ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোড, যেখানে ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে জন্ম  হয়েছিল তপনের। কিছুদিন আগে পর্যন্তও সেখানে ছিল পাঁচ ইঞ্চি দেয়াল আর টিনের চালের একটা ছোট বাসা, তার সামনে মস্তবড় মাঠ, বাসাটার এদিক-ওদিক অনেক গাছপালা – আম, হিজল, পাকুর, মেহগনি, স্বর্ণচাঁপা, কামিনী – এসব। সেই রোববারে মাসুদার সঙ্গে সামাদদের দোতলার বারিন্দায় এসে দাঁড়ায় রুনু। মাসুদাকে সে বলে : ‘কী বানাইছে এইডা ওরা দেখ? পাঁচতালা একখান বাক্স! কী সুন্দরই না আছিল তপনগো টিনের চালের পুরানা বাসাডা! মনে আছে না তর?’

‘হ! ওইডা তর শ্বশুরবাড়ি হইতে পারত!’

‘কইছে তরে! মুক্তিযুদ্ধ থিকা ফিরা আইসা তপন যদি আমারে বিয়া না-করত? তা হইলে?’

‘কী যে কস না তুই রুনু! তর পিছে ঘুরতে ঘুরতে তপন ভাই জুতাক্ষয় কইরা ফালাইছিল! বেবাকেই জানে হেইডা!’

‘তা করছে। কিন্তু সে আবার টগরের লগে হাইসা হাইসা কথাও কইছে।’

‘টগরের কথা তো ভুইলাই গেছিলামগা! আরে ধুর! তপন ভাই জিন্দেগিতেও টগররে পাত্তা দেয় নাই। মহল্লার রাস্তায় মাইনষের লগে দেখা হইলে কি হাইসা কথা কওন যাইব না নেকি? এইডা কী কস তুই?’

‘কেন, তুই ভুলছস যে আমাগো সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের ক্লাস এইটের মাইয়ারা কিইসা ফাজিল আছিল? টগররে তারা ক্ষেপাইত তপনের নাম বইলা!’

‘তাতে কী হইছে? তপন ভাই তো তরেই ভালোবাসছে। মানস তুই? কেডা কী কইল না-কইল তা দিয়া কী যাইব-আইব?’

তখন হয়ত সেই রোববারে গগনশিরীষের মতো লম্বা করে মেয়েটার দুচোখ কান্নার দমকে টলমল করে উঠবে। মাসুদা সেটা দেখেও দেখবে না। মাসুদা খামোখা এদিক-ওদিক তাকাতে থাকবে এবং তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে তপনদের নতুন বাসাটার দোতলার বারিন্দায় চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পাঠরত একজন বৃদ্ধের দিকে। তখন হয়তো সামাদ বসার ঘর থেকে বারিন্দায় এসে রুনুকে শান্ত করতে সচেষ্ট হবে : ‘চলো রুনু! সিনেমা দেইখা আসি গিয়া। জোনাকি হলে রাজ্জাক-ববিতার সিনেমা লাগাইছে। নামডা মনে নাই! যাইবা তুমি?’

‘নাহ! বাসায় যাইগা। আমার না দম আটকাইয়া আসতাছে আবারো!’ এই বলে সেই রোববারে হন্তদন্ত হয়ে সামাদদের বাসা থেকে বের হয়ে যাবে রুনু। সামাদ আর মাসুদা জানবে যে সিদ্ধেশ্বরী রোড থেকে রিকশা নিয়ে রুনু যেখানেই রওনা দিক না কেন – কালীবাড়ি রোডে তাদের নিজেদের বাসায় অথবা তার দিলু রোডের আস্তানায় – সে ধুন্ধুমার বৃষ্টির ভেতরে পড়বেই! কিন্তু রুনুকে কিছুতেই আটকে রাখা যাবে না তখন। তপনের কথা উঠলে কখনো কখনো উলটোপালটা আচরণ করবে রুনু – এটা মেনে নিয়েছে বন্ধুরা সবাই।

এ তো গেল কোনো একটা রোববারের গল্প, যেদিন মৌচাক মার্কেটে সাপ্তাহিক ছুটি – সামাদের দোকানে যাওয়া নেই এবং দিলু রোড থেকে রুনু বেড়াতে এসেছে সিদ্ধেশ্বরীতে সামাদদের বাসায়। তা বাদে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা তপনের মৃত্যুর পর প্রতিদিনই কয়েকবার করে তপনের কথা মনে পড়ে সামাদের। যেমন এই মুহূর্তে, ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিলে, রুনুর বাসা থেকে ফিরে এসে বারান্দার অন্ধকারে চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছে সামাদ। সে ভাবছে ১৯৬০ সালের একটা দিনের কথা, যখন তারা সবে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়েছে। সামাদের কাজ তখন মহল্লার গাছে গাছে চড়ে বেড়ানো। একদিন সামাদ কচি ডাব পাড়তে তাদের নিজেদের নারকেলগাছে উঠেছে। নিচু আমগাছ ছাড়া কোনো গাছেই উঠতে পারে না তপন। তো তপন হাফপ্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নারকেলগাছের নিচে – গাছের গোড়া থেকে একটু দূরে। তখন সামাদের কচি হাত ফসকে নিচে পড়ে যাচ্ছে একটা ডাব। তাই দেখে চিৎকার করে বলছে সামাদ – ‘তপইন্যা! সইরা যা! ডাব পড়তাছে কিন্তু!’ তপন দূরে তাকিয়ে আকাশ দেখছিল – শ্রাবণের আকাশে কী সুন্দর গাঢ় কালো মেঘ করেছে! সামাদের সাবধানবাণীতে সে গাছের নিচ থেকে জলদি করে সরে যায় বটে তবে তার ডান পাটা পড়ে গিয়ে সোজা দেয়ালের সঙ্গের অগভীর একটা ড্রেনের ভেতরে। আর তখন সামাদকে গালিগালাজ করছে ময়লা পানিতে মাখামাখি তপন : ‘দাঁড়া! তুই আগে নাইমা ল! তরে আইজকা দেখাইতাছি!’ সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে এখনো হাসি পায় সামাদের। কতই না ভীতু ছিল তপন, কতই না ভাবুক, কতই না অগোছালো!

এমন আরো একটা পুরনো গল্প করা যেতে পারে। তখন সামাদরা ক্লাস নাইনে পড়ে। কোনো একদিন সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের মাঠে সামাদদের সঙ্গে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ চলছে শান্তিনগরের হ্যাপিদের। খেলাতে ৩-২ গোলে সামাদরা জিতে যায়। কিন্তু         শান্তিনগরের ছেলেরা দাবি করে বসে যে, সিদ্ধেশ্বরীর দেওয়া শেষ গোলের সিদ্ধান্তটা রেফারি ঠিক দেয়নি, কেননা স্ট্রাইকার আসলে অফসাইডেই ছিল। কাকরাইলের নজরুল রেফারি কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগেই সিদ্ধেশ্বরীর মতিন শান্তিনগরের রাজুকে একটা ঘুসি মেরে বসে। অমনি শুরু হয়ে যায় দুদলের মধ্যে হাতাহাতি। সিদ্ধেশ্বরীর মিডফিল্ডার সামাদ শান্তিনগরের ইকবালকে ঘুসি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় এবং তারপর সামাদ দেখতে পায়, তাদের ডিফেন্ডার তপন মাঠ ছেড়ে দ্রুত মহল্লার ভেতরে চলে যাচ্ছে। মারামারির পরে যখন শান্তিনগরের পোলাপাইন চলে গেছে তখন চোখমুখ ফোলা সামাদ তপনকে মহল্লার গলিতে পেয়ে অভিযোগ জানায় : ‘এই! তুই পালাইলি ক্যান?’ তখন তপন সামাদকে যুক্তি দেয় : ‘হ! ভালোই কইছ! হ্যাপিগো মাইর খাইয়া হাত-পা ভাঙ্গি আর কী!’ তপনের সেই কাপুরুষতায় ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েছিল মহল্লার বন্ধুরা। ‘তুই শালা আসলেই একটা গাদ্দার!’ এমনই উপসংহার টেনেছিল তোতলা কামাল।

কুড়ি বছরের জীবনে তপন সাহসের কাজ করেছিল মাত্র দুটো – এক, শেষপর্যন্ত সে রুনুকে প্রেম নিবেদন করতে পেরেছিল এবং দুই, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতে চলে গিয়েছিল। প্রথম গল্পটা রুনুর কাছে শোনা যেতে পারে যেহেতু সামাদকে তপন তেমন কিছুই বলেনি কোনোদিন। তবে দ্বিতীয় গল্পটা সামাদের নিজেরই জানা। কোনো এক রোববারে, ধরা যাক ১৯৮৩ সালে, সামাদদের হলুদ দোতলা বাসার ছাদে বসে যখন বিকালের চা খাচ্ছে রুনু, সামাদ আর লুনা, তখন প্রথম গল্পটা তাদের আলোচনায় চলে আসে। সেই রোববারে চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরায় সামাদ। রুনু আর লুনা বেইলি রোডের শাড়ির দোকানগুলোতে তাদের ভ্রমণের গল্পে তখন ব্যস্ত। সেদিকে সামাদের কোনো মনোযোগ নাই। তার মনে পড়ে, তাদের বাসার এই ছাদেই একদা কালীবাড়ি রোডের রুনুকে তপন ভালোবাসা জানিয়েছিল। তপন তখন নটর ডেম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে এবং রুনু সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে পড়ে ক্লাস টেনে। কোন ফাঁকে যে বয়েজ স্কুলের মাঠের আড্ডা ফেলে উঠে গেছে তপন – তা সামাদরা খেয়ালই করেনি! পরে মাসুদার কাছ থেকে জানা যায়, চুপিচুপি তপন চলে গিয়েছিল সামাদদের বাসার ছাদে। সেদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে ছাদে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছিল মাসুদা আর রুনু। ছাদে উঠেই মাসুদাকে বলেছিল তপন – ‘এই! তুই নিচে যা তো একটু। রুনুর লগে জরুরি কথা আছে আমার।’

‘কী কথা? ব্যাঙ্গের মাথা?’ – বলতে বলতে হাসতে হাসতে নিচে চলে গেয়েছিল মাসুদা। মাসুদার হাসির কারণটাও স্পষ্ট – রুনুর প্রতি তপনের মুগ্ধতার কথা সবার চাইতে তো সেই-ই ভালো জানত! কিন্তু মাসুদা ছাদ থেকে নেমে নিচে চলে যাওয়ার পরের ঘটনাটা সামাদ আর ভালোমতো জানে না। তার বোন মাসুদাকেও সে-কথা আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি কোনোদিন।

‘তুই কী কইছস রুনুরে ক দেহি!’ সেদিন রাতেই তপনকে অবশ্য এ-কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিল সামাদ।

‘কী আর বলুম? কইলাম যে আমি তারে ভালোবাসি।’ সংক্ষেপে উত্তর দিয়েছিল তপন।

‘আর কী করছস তুই? চুমাচাট্টি খাইছিলি নেকি?’

‘তর কি মাথা খারাপ, না প্যাট খারাপ? স্যান্ডেলের বাড়ি খাইতে কস আমারে? রুনুর রাগ জানস না তুই?’

‘না, তাও কইতেছিলাম আর কী! তো রুনু কী কইল?’

‘বিশ্বাস কর, হ্যাঁ কি না কিছুই কয় নাই সে।’ গম্ভীর হয়ে উত্তর দিয়েছিল তপন।

তপনের অনির্দিষ্ট কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল সামাদের। তপনকে সে সাহস দিয়েছে অনেকবার – ‘আরে ব্যাটা! কয়া দেখ না! রুনু তো রাজি হইলেও হইতে পারে!’ এত অনুপ্রেরণার পর তপন রুনুকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে পারল শেষ পর্যন্ত কিন্তু তার মনের কথা রুনুকে বোঝাতে পারল না! ফাইজলামি করছে না তো তপন?

তপন তখন উত্তর করেছিল : ‘আরে ব্যাটা ফালাইয়া রাখ তো এইসব! রাজি হইলে হইব, না হইলে না হইব। রুনু-ফুনু আমার জন্যে কোনো ফ্যাক্টর না।’

তারপর থেকেই সিদ্ধেশ্বরীর কালীবাড়ি রোডে তপনের যাতায়াত বেড়ে গিয়েছিল। ওই মহল্লার ৪৩ নম্বর বাসাটা রুনুদের। তপনের সেই নতুন উত্তেজনার সাথি হয়েছিল সামাদ খুব খুশি হয়েই। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় সামাদদের ছাদে তপনের প্রস্তাব শুনে কী উত্তর দিয়েছিল বা কী-কী বলেছিল রুনু তা আর কখনোই তাকে স্পষ্ট করে বলেনি তপন।

তাই কোনো এক রোববারে যখন রুনু আর লুনা গল্প করছে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের তাঁতের শাড়ির সৌন্দর্য নিয়ে, তখন সেই আলোচনাটাকে থামিয়ে দিয়ে সামাদ বলে : ‘এই রুনু! তোমারে একটা কথা জিগাই?’

‘আরে ভাই জিগান না! শাড়ি নিয়া আমাগো গল্প তো আইজ আর থামব না।’

‘ওই যে আমাগো বাড়ির ছাদে ঊনসত্তুর সালে তপইন্যা যে তোমারে প্রোপোজ করছিল, তুমি আসলে কী বলছিলা ওরে? ওই হারামজাদায় কিন্তু কোনোদিই আমারে ভাইঙ্গা কিছুই কয় নাই!’

সামাদের প্রশ্ন শুনে হেসেই ফেলে রুনু, তারপর বলে : ‘আর বইলেন না! মাসুদারে ছাদ থিকা ভাগায়া দিয়া আপনের বন্ধু প্রায় মিনিট পাঁচেক মাথা নিচু কইরা আমার সামনে খাড়ায়া থাকল। আমি তারে কই – কী কথা আছে জলদি বইলা ফালান। কিন্তু তপনের মুখ দিয়া কোনো কথাই বাইর হইতেছে না তখন। আমি তো আগেই বুঝছি যে চান্দু কী কইতে পারে! কিন্তু সে সাহসটা পাইতেছে না। তাই শেষ পর্যন্ত আমি তপনরে ঝারি লাগাইলাম – চুপ কইরা থাকলে কিন্তু আমি এখনই নিচে নাইমা যাইতেছি কইলাম! তখন আপনের বন্ধু ডর খায়া কইল যে, সে আমারে ভালোবাসে। কিন্তু সত্যিই আমি হ্যাঁ-না কোনো উত্তরই করি নাই। তো তপন আর আপনেরে পরিষ্কার কইরা কী কইব? আমি তারে বলতেই পারি নাই যে, আমি ক্লাস সেভেন থিকাই তার প্রেমে পড়ছিলাম! আমার খালি মনে হইল যে, আমি তারে আমার একটা স্বপ্ন উপহার দিব। তাই সেইদিনকা তারে বলছিলাম যে আমারে একখান নীল পাড় আর নীল অাঁচলের দুধ-সাদা রঙ্গের শাড়ি কিইনা দিতে। ব্যাস! তপনরে আর কিছুই বলি নাই আমি।’

তখন অবাক হয় সামাদ : ‘দেখছ কান্ডডা? আমারে শাড়ি কিনার কথা তপইন্যা কিছুই কয় নাই! কিইসা গাদ্দার আছিল ওই হালার পুত!’

‘আপনের বন্ধু শাড়ি কিনার কথা কেন আপনেরে কয় নাই সেইডা তো এখন আর তারে জিগাইতে পারতেছি না। আমি ভাবছিলাম যে আপনে জানেন।’ এই বলে ফের হাসে রুনু এবং সে সামাদকে তথ্য দেয় – ‘সাদা রঙ্গের শাড়িটা ও কিইন্যা দিছিল ঠিক একদিন পরেই। মাসুদার মনে থাকলেও থাকতে পারে।’

‘হ! খুব মনে আছে। নিউমার্কেট থিকা শাড়িডা কিনছিল তপন ভাই। তুই ওই সাদা শাড়িডা প্রায় প্রায়ই পরতি।’ এমনটাই জানায় মাসুদা।

‘কী তাজ্জব কথা! তপইন্যা হালায় শাড়ি কিনার কথা কেমনে ছুপাইছে আমার কাছে! অথচ দেখ, আমি আর তপইন্যা তহন সারাদিনই একলগে ঘুরতাছি, সুযোগ পাইলেই শান্তিনগর মোড়ে গিয়া তপইন্যার ঘাড় ভাইঙ্গা কাচ্চিবিরিয়ানি খাইতাছি! কখন যে ও চিপা দিয়া নিউমার্কেট গেছেগা – হেইডা আমি ধরবারই পারি নাই!’

এই বলে, ধরা যাক ১৯৮৩ সালের সেই রোববারে, চুপ করে যায় সামাদ। তপনের সেই লুকোচুরিতে সামাদ দুঃখিত হয় খানিকটা এবং আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে তাকিয়ে থাকে অন্ধকারের দিকে।

সামাদদের ছাদে তখন নীরবতা নামে সেই সন্ধ্যায়। তিনজন মানুষ – সামাদ, মাসুদা আর রুনু – তখন হয়তো চুপ করে ভাবতে থাকে সিদ্ধেশ্বরী মহল্লার শহীদ তপনের জীবনের কথা। হয়তো রুনুর মনে হয়, কমলাপুর রেলস্টেশনে গেরিলা অপারেশন করতে গিয়ে কুড়ি বছর বয়সে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মারা না-গেলে এখানে, হয়তো ঠিক তার পাশের চেয়ারটায়, বসে চা খেতে খেতে অনেক গল্প করত তপন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের মাঠে বসে বসে রুনুর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার দিনগুলোকে হয়তো সে স্মরণ করত। হয়তো নীলক্ষেত থেকে পলাশী মোড়ে যাওয়ার রাস্তাটার জারুল আর কৃষ্ণচূড়াদের গল্প বলত সে। এমনকি লুকিয়ে লুকিয়ে একদিন রুনুর সঙ্গে বলাকা সিনেমা হলে সিনেমা দেখার স্মৃতির কথাও তুলতে পারত তপন।  হয়তো সে বলতে পারত আগরতলার মেলাঘরে গেরিলা ট্রেনিংয়ের সময়ে মাষকলাই আর ভাত খেয়ে দিন কাটানোর গল্পগুলো। কিংবা সেই পুরনো স্বপ্নটার কথা আবারো হয়তো ব্যক্ত করতে পারত তপন : ‘ঢাকা শহরের মেয়র হইলে আমি মৌচাক মার্কেট থিকা পাকমটর পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশ দিয়া একগাদা গগনশিরীষ লাগাইতাম!’ তখন হয়তো মাসুদা আগের মতোই খোঁচাতো তপনকে : ‘দুনিয়ার এত ফুলের গাছ রাইখা আপনে মিয়া ঢ্যাঙ্গা একখান গাছ সিলেক্ট করলেন ক্যান? গগনশিরীষ দিয়া তো লাকড়ি ছাড়া আর কোনো কাজই হইব না!’ রুনুর মনে হয়, মাসুদার খোঁচা খেয়ে তখন নির্ঘাত রেগে যেত তপন; হয়তো সে বলত : ‘মাসুদা! তুই না একটা আস্তা গাধা! খালি ফুল লইয়া পড়ছস! গগনশিরীষ হইল সবচাইতে সুন্দর গাছ। দেখস না, মাটি থিকা কত্ত উপরে উইঠা গিয়া ডালপালা মেইলা দিয়া গগনশিরীষ কেমনে আকাশের দিকে চুপ কইরা তাকাইয়া থাকে? বুঝস কিছু তুই?’ তপনের রাগ দেখে তখন নিশ্চয় হাসত সামাদ, মাসুদা আর রুনু কারণ তারা তিনজনই জানত, তপনের গগনশিরীষ-প্রীতির সঙ্গে রুনুর একটা বিশেষ যোগ ছিল – রুনুর গড়নও তেমন লম্বা, একহারা।

 

দুই

কোনো এক রোববার বিকালে, ধরা যাক ১৯৯৯ সালে, সামাদদের বসার ঘরের সোফায় বসে সামাদ ২৭ মার্চ ১৯৭১-এর পুরনো গল্পটা আবারো বলতে শুরু করে রুনু, মাসুদা আর লুনাকে। গল্পটা নতুন কিছু নয়। তবু আড্ডার ভেতরে সামাদ বারবার ফিরে যায় উত্তাল মার্চের দিনগুলোতে। সেদিন রেডিওতে জরুরি এলানের মাধ্যমে সকাল ৮টা থেকে বারো ঘণ্টার জন্য ঢাকা শহরে কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। তার আগে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ৩২-পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যদের অনেক ট্যাংক পাকমটরের দিক থেকে আউটার সার্কুলার রোড ধরে রাজারবাগের দিকে এগিয়ে গেছে। রাত ১টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করেছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স। রাজারবাগের দিক থেকে পাওয়া গেছে জোর গোলাগুলির আওয়াজ। ‘তোমার মনে আছে রুনু, তখন দক্ষিণ দিকের আকাশ দাউদাউ আগুনে লাল আর রাতের অন্ধকার ছেদ করে এদিক-ওদিক ছুটছে গুলি আর গুলি!’

সামাদের কথায় মাথা নাড়ে রুনু। রুনু বলে : ‘আমরা তো ডরে লাইট নিভায়া দিয়া খাটের নিচে লুকায়া আছিলাম সারারাত! মশা উড়ায়া নিয়া যাইতেছিল!’

সামাদ স্মরণ করে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর গুজবটা এমনই ছিল যে, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পিলখানা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ২৫ মার্চ রাতে হামলা করবে পাকিস্তানি সেনারা। সেটাই হয়। তাই সে-রাতে রাজারবাগ ছাড়াও সিদ্ধেশ্বরীর উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে যখন প্রচন্ড গোলাগুলির আওয়াজ আসতে থাকে তখন বোঝা যায় যে, সে দিনগুলোতে ঢাকা শহরে গুজব বলে আসলেই কিছু ছিল না।

দমবন্ধ শহরে একসময় ২৬ মার্চের সকাল হয়। সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম-মহল্লার মানুষজনের চোখে-মুখে ঝুলে থাকে তীব্র আতঙ্ক – মহল্লার ভেতরে আবার আর্মিরা ঢুকে পড়বে না তো? যদি ঘরে ঘরে তারা মানুষকে খুন করে, তুলে নিয়ে যায় মেয়েদের! তবে? মানুষজন তখন বুঝতে পারে না, শহর ছেড়ে নিজেদের গ্রামের বাড়িতে পালিয়ে যাবে কিনা। নাকি পাকিস্তানি হানাদারদের নিধনযজ্ঞ থেমে যাবে জলদি জলদি? তপন, মতিন, সাদেক আর সামাদ মহল্লার ফাঁকা অলিতে-গলিতে সেই সকালে খুব সাবধানে হাঁটাহাঁটি করতে থাকে, যদি কারো কাছে শহরের কোনো খবর-টবর পাওয়া যায়। আউটার সার্কুলার রোডে সাবধানে উঁকি দিলে দেখা যায়, সেখানে থেকে থেকেই টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে পাকিস্তানি সেনাদের জলপাই রঙের জিপ। তাদেরকে ইতস্তত হাঁটতে দেখে বাড়িগুলোর জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা উৎকণ্ঠিত বয়স্করা বলে : এই তরা জলদি বাসায় ঢোক। কখন আজরাইল আইসা পড়ব? হেইডা কি কেউ কইতে পারে?

নিশ্চয় তোমার মনে পড়বে রুনু , তখনই বাসুদেবের বড়দা খবর আনে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা নাকি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে ঢাকা শহরের তাঁতিবাজার আর শাঁখারিবাজার এলাকা; হত্যা করেছে সেখানের নিরপরাধ মানুষজনকে। তা’বাদে বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি, ইংলিশ রোড, নওয়াবপুর, নয়াবাজার, গেন্ডারিয়া, সদরঘাট – এসব জায়গাতেও নাকি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে অসংখ্য মানুষের লাশ। ঢাকা মেডিক্যাল এবং মিটফোর্ড হাসপাতালে নাকি চিকিৎসার জন্য গিজগিজ করছে এই শহরের আহত মানুষদের দল। পাকিস্তানি সৈন্যদের এসব নৃশংস হত্যাযজ্ঞের খবর পাওয়ার পর আরো আতঙ্কিত, আরো বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম মহল্লার মানুষজন। এদিকে আউটার সার্কুলার রোড ছাড়াও সিদ্ধেশ্বরী রোডের দিকটায় – যে রাস্তাটা ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মৌচাক মার্কেট পর্যন্ত চলে গেছে – উঁকি দিলে দেখা যায়, সেখানেও টহল দিচ্ছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। কাজেই ২৬ মার্চ সিদ্ধেশরী রোড পার হয়ে কারফিউয়ের ভেতর দিয়ে কালীবাড়ি রোডের রুনুকে আর দেখতে যেতে সাহস পায় না তপন। ২৭ মার্চ সকাল ৮টাতে সাময়িকভাবে কারফিউ উঠে গেলে মহল্লার মানুষেরা সদাই করতে দৌড়ায় শান্তিনগর বাজারে। এভাবে যদি সামনের দিনগুলোতে বাড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে থাকতে হয় তবে শাকসবজি বা মাছমাংস না-হোক চাউল তো লাগবে, ডাউল লাগবে, আটা লাগবে, আর লাগবে মশলাপাতি; কেরসিন তেল অথবা লাকড়িও তো দরকার। কিন্তু তপন তার মাকে ‘ফালায়া রাখ এইসব!’ বলে পয়লাতেই দেখতে যায় রুনুকে।

না! সে-কথা রুনু ভোলেনি। রুনু আর তপন দুজনেই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে – রুনু কেবল ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে আর সেকেন্ড ইয়ারে তপন। কিন্তু তবুও সামাদের মুখে ২৭ মার্চ ১৯৭১-এর গল্পটা আবারো শুনতে ভালো লাগে রুনুর।

সেই রোববারে, ধরা যাক ১৯৯৯ সালে, সামাদ বলতে থাকে, ‘রুনুর অপেক্ষায় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ানোর চাইতে কালীমন্দিরের ভেতরের চত্বরে বসে থাকাটাই নিরাপদ বলে মনে হয় তপনের কাছে। কালীবাড়ি রোড দিয়ে যেহেতু সিদ্ধেশ্বরী থেকে সংক্ষেপে শান্তিনগর মোড়ে যাওয়া যায়, কাজেই সেই পথেও পাকিস্তানি সৈন্যদের টহলগাড়ি চলে আসার সম্ভাবনা থেকে যায়। কারফিউ উঠে গেছে তবুও কালীবাড়ির রোডে কোনো মানুষজন চোখে পড়ে না তপনের। একতলা আর দোতলা বাড়িগুলোর দরজা ভেতর থেকে আটকানো, কোথাও কোথাও কেবল জানালা খুলে রাখা একটু করে। কালীমন্দিরের পুরোহিত আর সেবাইতরা কাঁপছে বলির পাঁঠার মতো। মানিকগঞ্জের পুরোহিত তপনকে পেয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করে : ‘আমরা অহন কই যামু দাদা?’ সেই প্রশ্নের কোনো যথাযোগ্য উত্তর করতে পারে না সন্ত্রস্ত তপন। মন্দিরের চত্বর থেকে তপন তখন তাকিয়ে থাকে ৪৩ সিদ্ধেশ্বরী লেনের দোতলা বাড়িটা দিকে। সে দেখতে পায়, রুনুর ঘরের যে জানালাটা রাস্তার সঙ্গে সেটা ভেতরের দিকে খুলে রাখা আছে ইঞ্চি ছয়েক। বরাবরের মতো সেই জানলায় ঝুলছে লাল রঙের মোটা পর্দা। তীব্র অস্থিরতায় মিনিট পাঁচেক অতিক্রান্ত হওয়ার পর তপন দেখতে পায়, রুনুর জানালাটার একটা পাট পুরাটাই খুলে গেছে, সরে গেছে লাল পর্দার একটা অংশ এবং সেখানে ঘরের অন্ধকারের প্রচ্ছদে জেগে আছে রুনুর ক্লান্ত, আতঙ্কিত দুচোখ। তাকে দেখে হাসিহাসি মুখে দূর থেকে একবার হাত নাড়ে তপন। রুনু হাত নেড়েই তার উত্তর দেয়। কিন্তু রুনুর মুখে কোনো হাসি নাই। তখন মাত্র বারো গজ মতো ব্যবধান তাদের দুজনের ভেতরে। তাদের মাঝখানে মন্দিরের দেয়াল আর অপ্রশস্ত কালীবাড়ি রোড। সেই দূরত্বটুকু পার হয়ে রুনুর হাতটা একটু ধরে অস্থিরতা কমানোর সুযোগ পায় না তপন। দূর থেকেই যেন রুনু দেখতে পায়, তপনের চোখে মিলনের আকুতি আর তার জন্য বরাভয়। তা দেখে শেষ পর্যন্ত রুনুও একটু হাসতে পারে। রুনুর মলিন হাসি যেন তপনকে বলে দেয়? ‘আমি ভালো আছি। তুমি সাবধানে থাইকো!’

এভাবে তারা ২৭ মার্চ সকালে দূর থেকে পরস্পরের চোখের কথা পড়েছিল মিনিট দশেক মতো। এখানে সামাদ গল্পটা থামায়। চুপ করে থাকে রুনু। আর সে ভাবে, আতঙ্কের সে-শহরে তপনের সঙ্গে সেদিন একটু দেখা হওয়ার স্মৃতি একটুকুও ম্লান হয়নি এতদিনে!

রুনুকে দেখে এসে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে সামাদকে ধরে তপন; বলে : ‘চল ইউনিভার্সিটি যাই। হলের পোলাপাইনদের খবর নেওয়া দরকার। মইরাই গেছে কিনা তা কে কইব!’ কাজেই আবু জর গিফারি কলেজের ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্র সামাদ তার বন্ধুর অনুগামী হয়। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে তখন খুব একটা বেশি ছাত্রছাত্রী ছিলও না। পাকিস্তানি আর্মিরা হল অ্যাটাক করবে – এই ভয়েই অনেক আগে ছেলেমেয়েরা ফিরে গেছে নিজেদের শহরে বা গ্রামে অথবা আশ্রয় নিয়েছে ঢাকা শহরের অন্য কোনো আপাত নিরাপদ জায়গায়। তবে ২৫ মার্চ রাতে হলগুলোতে যে কজন ছিল, তাদের বেশির ভাগেরই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম বলে তপনদের মনে হয়। প্রথমেই তারা ইকবাল হলে যায় তপনের সহপাঠী ভোলার রশিদকে খুঁজতে। ইকবাল হলের দেয়াল ঝাঁজরা হয়ে গেছে হাজার হাজার গুলির আঘাতে – হয়তোবা মেশিনগানেরই গুলি হবে! দেয়ালের জায়গায় জায়গায় বিশাল গর্তগুলোতে তাদের চোখ আটকে যায় সবচাইতে বেশি। পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্যাংকের গোলা দাগিয়েছে সেখানে! হলের দোতলায় উঠলে দেখা যায়, অনেকগুলো রুম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রশিদের রুমটাও আগুন থেকে রক্ষা পায়নি। সারাটা হলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে জানলার ভাঙা কাচ, বই-পত্তর, বালিশ, তোশক ইত্যাদি। হলের রুমগুলোতে লাশ, দেয়ালগুলোর কাছে লাশ, হলের পুকুরপারে পড়ে আছে গোটা দশেক পুড়ে যাওয়া লাশ, ছাদেও লাশ। লাশগুলোর ভেতরে রশিদকে খুঁজে পাওয়া যায় না। গম্ভীর হয়ে যাওয়া তপন তখন সামাদকে বলে যে, তার হিসাবমতো ২৫ মার্চ রাতে কমপক্ষে শদেড়েক ছাত্র ইকবাল হলে ছিল। তাদের কেউ আর বেঁচে আছে বলে তার মনে হয় না।

তারপর আরেক সহপাঠী ডায়নাকে খুঁজতে রোকেয়া হলে ঢুকতে সাহসই পায় না তপন। মেইন গেট থেকে একটু ভেতরে ঢুকলেই দূর থেকে দেখা যায় ইকবাল হলের মতোই রোকেয়া হলের দেয়ালে অসংখ্য গুলির দাগ আর বিভিন্ন রুমে আগুনের চিহ্ন। তারা আরো দেখতে পায়, তিনজন মেয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে আছে সামনের মাঠটায়। কিন্তু রোকেয়া হলের কজন ডায়নাকে হত্যা করা হয়েছে ২৫ মার্চ রাতে তা বোঝা যায় না। ডায়নারা বেঁচে আছেই বা কজন? যারা বেঁচে আছে তারা কোথায় তখন? ক্যান্টনমেন্টে? সামাদ আর তপন তাও বুঝতে পারে না।

জগন্নাথ হলের দেয়ালেও জেগে আছে ইকবাল হল আর রোকেয়া হলের মতোই হাজার হাজার গুলির দাগ। সামনের দিকের রুমগুলোর জানালার ভাঙা কাচ নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। জগন্নাথ হলের ভেতরে আর ঢোকে না তারা যেহেতু হলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা একজন দারোয়ানের বিলাপ থেকে তারা আগেই বুঝেছে যে হলের ভেতরে কোনো লাশ আর পড়ে নেই; সবাইকে গোড় দেওয়া হয়েছে কোনো একটা গণকবরে, হয়তোবা অমলকেও। পেছনে তাকালে দেখা যায়, কামান দাগিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মাঠের ভেতরের শহীদ মিনারটা। শহীদ মিনারের ঠিক পেছনে মস্ত বড় একটা গণকবর। জগন্নাথ হলের একজন কর্মচারী জানায়, সেখানে পুঁতে রাখা হয়েছে হলের ছাত্র, মালি, দারোয়ান, বাবুর্চি, সুইপার, তাদের পরিবারের কিশোর-সদস্য, রিকশাওয়ালা আর ঠেলাগাড়িওয়ালাদের লাশ। তখনো গণকবরের তাজা মাটি ফুঁড়ে জেগে আছে মৃতদের হাতের পাঞ্জা, পায়ের আঙুল আর রক্তে মাখা জামাকাপড়ের অংশ। আর গণকবরটা ঘিরে বিলাপ করে চলেছে জগন্নাথ হলের মৃত কর্মচারীদের পরিবারের মানুষজন।

‘তখন আপনের বন্ধু খুব গম্ভীর হইয়া গেছিল, তাই না? এইডা পরে আপনে আমারে বলছিলেন।’ ধরা যাক ১৯৯৯ সালের সেই রোববারে সামাদদের ছাদে মোড়ায় বসে একথা বলে রুনু।

‘হ! ও তো রাইগা গেলে খামোশ হইয়া যাইত। একটু কথাকাটাকাটি হইছে তো সাতদিন কোনো কথা কয় নাই – মনে আছে না তোমার? জগন্নাথ হলের গণকবর দেখার পরে না তপইন্যা পুরাই চুপ হয়া গেছিলগা! তারপর তো ফের সাইকেল লয়া আমরা পুরান ঢাকায় গেছি।’ এই বলে থামে সামাদ।

উৎসুক রুনু তাকে বলে : ‘আপনে থাইমেন না সামাদ ভাই।’ রুনুর নিভে যাওয়া চোখে তাকিয়ে সামাদ জিজ্ঞাসা করে : ‘এই এক কথা আর কতবার শুনবা তুমি? তপন ওইদিন কই-কই গেছিল, কী-কী করছিল – সেইগুলা তো আমি তোমারে বহুতবারই বলছি!’

‘তাও বলেন। আমি তো প্রত্যেকবারই নতুন কইরা তপনরে খুঁইজা পাই আপনের গল্পের ভিতর দিয়া।’

তাই সামাদ সেই রোববারে, ধরা যাক ১৯৯৯ সালে, আবারো গল্প শুরু করে : ‘তপন পরে আমারে বলছিল যে এত মুর্দা দেইখা সে আর সাইকেল চালাইতে জোর পাইতেছিল না গায়ে। তাই আমিই সাইকেল চালাইলাম। সাইকেলের সামনের রডে ও বয়া থাকল চুপ কইরা। জগন্নাথ হল থিকা পলাশী হইয়া নীলক্ষেত বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ির দিকে যাওনের সময় রাস্তার মানুষজনে কইল, পুলিশ ফাঁড়ি জ্বালাইয়া দিছে, মাইরা ফেলছে ডিউটিতে থাকা বেবাক পুলিশগো। পুলিশ ফাঁড়ির সামনে আইসা তপইন্যা কইল : ‘সাইকেল থামা।’

তখন বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ির বারিন্দায় আর রাস্তার উপরে পইড়া আছে ইউনিফর্ম পরা পাঁচ-ছয়জন পুলিশের লাশ। আর রেললাইনের পাশের বাবুপুরা বস্তি পুইড়া একদম ছাই হইছে। বস্তির লোকজনগো লাশ পইড়া আছে রেললাইনের উপরে। বাইনচোত পাক আর্মিগো সেই গজব যদি তুমি দেখতা রুনু তা হইলে তুমি চিৎকার দিয়া কানতে থাকতা!’

‘তারপর তো তাঁতিবাজার গেছিলেন আপনেরা – তাই না?’ রুনু জিজ্ঞাসা করে সামাদকে।

এদিকে রুনুর চা ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু সেই রোববারে সামাদ আর রুনুকে তাড়া দেয় না – ‘ওই মিয়া! চা খাও!’ অনেক পুরনো গল্প হলেও তপনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে রুনু, শুনুক। সিগারেট ধরিয়ে তাই ফের সামাদ ২৭ মার্চের গল্পে ফিরে যায়।

‘পুড়ে যাওয়া বাবুপুরা বস্তির দিকে কঠিন চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে তপন; তারপর সামাদকে বলে : ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির ভিতর দিয়া বকশীবাজার যাবি। তারপর নওয়াবপুর দিয়া তাঁতিবাজার আর শাঁখারিবাজার। ওইদিকে অনেক মানুষ খুন করছে পাক আর্মিরা – বাসুদেবের বড়দা কইল না!’

আমি তাই-ই করলাম। যাওনের পথে পড়ল ইংলিশ রোড। দুইপাশের কাঠের কারখানাগুলা না পুইড়া এক্কেবারে কয়লা হইছে! নওয়াবপুর দিয়া যাওনের সময় দেখি, এক পাবলিক জোরে প্যাডেল মাইরা সাইকেল নিয়া আইতাছে উলটাদিক থিকা। হেয় তখন চিৎকার দিয়া কইল : শাঁখারিবাজারে গজব হইছে – গজব! কাইল রাতে কাউরে জিন্দা রাখে নাই কুত্তার বাচ্চা পাকসেনারা!’ তপইন্যারে লইয়া মুশকিলে পড়লাম সেই শাঁখারিবাজার গিয়া। ওইহানে রাস্তায় পইড়া আছে লাশের গাদা। পাকিস্তানি সৈন্যরা এক বাইড়তেই একশ জনের উপরে মানুষ জড়ো কইরা খুন করছে! তোমারে তো বলছি যে তপইন্যা তহন কইল : ‘আর কোনো বাইড়তে ঢুকিস না সামাদ! চল বাসায় যাইগা।’ আমার ইচ্ছা আছিল যে আর কয়ডা বাইড়তে ঢুকুম। তো তপইন্যা যাইব না জন্যে আমার আর যাওয়া হইল না। তপইন্যারে তখন পাগল-পাগল লাগতাছে। রাগে আর দুঃখে তপইন্যার চোখ দিয়া তখন পানি পড়তাছে টপটপ কইরা। আমিও আর কান্না আটকাইতে পারি নাই। তোমার মনে আছে রুনু, তারপর তো আমরা সাইকেল চালাইয়া সিদ্ধেশ্বরী ফিরত আসলাম?’

এটুকু বলে সামাদ থামে। তখন সেই রোববারের পড়ন্ত বিকালে, ধরা যাক ১৯৯৯ সালে, সামাদদের বসার ঘরের সোফায় বসে রুনু তার নিজস্ব স্মৃতিতে ফিরে যায় : ‘আপনেরা যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত পার দিয়া আগরতলা গেলেন ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে। ঢাকা থিকা ২৮ তারিখ যাত্রা করছিলেন আপনেরা – তাই না?’

‘হ! ঠিক কইছ। বহুত রিস্ক লয়া ঢাকা থিকা নরসিংদী হয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া গেছিলাম। ওইখান থিকা চৌমুহনী দিয়া সীমান্ত পার দিছিলাম আমরা। পাকসেনাগো চোখ এড়াইয়া কখনো বাসে চইড়া, কখনো হাঁইটা, কখনো নৌকা দিয়া গেছি। আগরতলার মোহনপুর শরণার্থী ক্যাম্পে আমরা পৌঁছাইছিলাম মে মাসের পয়লা তারিখে। যুদ্ধের ট্রেনিং দেওনের লিগা ওইখান থিকা দুই নম্বর সেক্টরের মেলাঘরে নিয়া গেল আমাদেরে।’

রুনু তখন সামাদকে প্রশ্ন করে, ‘আপনের মনে আছে সামাদ ভাই, ২৫ মার্চের পর থিকা ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত তপনের লগে আমার মাত্র একদিন দেখা হইছিল? মনে আছে, আপনে নিজে গিয়া আমারে নিয়া আসছিলেন আপনেগো বাসায়?’

‘খালুজান তো তোমারে ছাড়বই না! আমি খালুজানরে জোরই করলাম : রুনুরে যাইতে দেন খালুজান! দরকার আছে। দয়া কইরা আর কিছু জিগায়েন না আমারে! এই বইলা আমি কাঁচুমাচু হইয়া বয়া থাকলাম তোমাগো বসার ঘরের সোফায়। আমার বেয়াদবি দেইখা তো খালুজান থ!’ এই বলে হেসে ফেলে সামাদ।

‘শেষে আম্মাই আববারে রাজি করাইল ভিতরে নিয়া গিয়া। আমার চোখের দিকে তাকায়া আম্মা বুইঝা গেছিল যে আমি তপনের লগে দেখা করতে যাইতেছি। সেইদিনই আববা প্রথম জানল যে তার একমাত্র মাইয়া কারো লগে প্রেম করে।’

সামাদ বলে, ‘কালীবাড়ি রোড দিয়া হাঁইটা সিদ্ধেশ্বরী রোড পার হইয়া আমাগো গলিতে ঢুকতে লাগল তিন-চার মিনিট মতন। মনে হইতাছিল যেন তিন-চার বছর ধইরা হাঁটতাছি ওটুক রাস্তা! আর তোমার মনে আছে রুনু, তুমি খালাম্মার কালা বোরখা পইরা জোরে জোরে হাঁটতাছিলা আমার লগে? তুমি বোরখা পরছ? তাও আমি ডরে কাঁপাকাঁপি করতাছিলাম। পাকিস্তানি আর্মিরা দেইখা ফালাইলে তোমারে তো তুইলাও নিয়া যাইতে পারত! কী করতাম আমি তহন? মাইনষেরে কী জবাব দিতাম আমি?’

‘কিন্তু সামাদ ভাই, আমার কিন্তু ডর লাগে নাই! তখন আমার বয়স উনিশ। দিনদুনিয়ার অনেক কিছুই বুঝতাম না আমি। পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউন কিন্তু রাতারাতি আমার বয়স বাড়াইয়া দিয়া গেলগা! ভয় পাইছিলাম অনেক। আবার কই থিকা তখন সাহসও আইসা পড়ল, কইতে পারি না! সেইদিনকা আমার খালি মনে হইতেছিল, আমারে একবার না-দেইখা যুদ্ধে গেলে পর তপনের মনের ভিতরে খচখচ করতে থাকব। ওরে তো আমি চিনি! একদিন আমারে না-দেখলে পাগল হয়া যাইত কেমুন – মনে আছে না আপনের? তাই আমি ঝুঁকি নিছিলাম তপনরে দেখতে যাওয়ার জন্যে। নিজের সাহস দেইখা আমি নিজেই অবাক হইতেছিলাম তখন! আমি এহন যেইডা বুঝি, আসলে পঁচিশে মার্চের এক রাতেই আমাদের সকলের বাস্তবতা পালটায়া গেছিল।’

‘তোমার মনে আছে রুনু, আমার দোতলার ঘরে বইসা খালি সিগারেট ফুকতাছিল তপইন্যা? হেয় কোনো কথা কইতে পারতাছিল না? তো আমি তখন তোমারে কইছিলাম : রুনু! আমি নিচে যাইতাছি। আম্মার লগে কথা আছে।’

তারপর রুনু তার নিজের গল্প বলে : ‘আপনে নাইমা গেলে পরে তপনরে আমার বুকের ভিতর ধইরা রাইখা তার চুলে আঙ্গুল বুলাইতে বুলাইতে আমি শুধু তারে কইতে পারছিলাম – যুদ্ধ করতে গিয়া তোমার যদি খুব ভয় লাগে, যদি তুমি ভাইঙ্গা পড়ো, তা হইলে আমার মুখ মনে কইরো তুমি। আর তপন আমারে কইছিল – সাবধানে থাকবা তুমি। ভার্সিটি যাওনের কাম নাই। কওন তো যায় না যে কহন কী হয়া যায়! বাসার বাইরেও যাইও না তুমি। হানাদার পাক আর্মিরা আর তাগো দালালেরা তো এহন ঘর থিকা মাইয়াগো তুইলা লয়া যাইতাছে! তেমুন হইলে রায়পুরে তোমগো গ্রামের বাড়িতে চইলা যাইও না-হয়।’

একটু থেমে রুনু সামাদকে আরো বলে : ‘কিন্তু আমরা তখনো বুঝি নাই যে খালি শহর ক্যান দ্যাশের কোনো গ্রামও আসলে আস্ত থাকব না! জিঞ্জিরাই তার প্রমাণ! যাই হোক আর কোনো কথা হয় নাই আমাগো। তপনরে আমি অনেক আদর করছিলাম সেইদিনকা। জানেন সামাদ ভাই, আপনেরে কইতে লজ্জা নাই এখন, আমার আর তপনের যদি একটা বাচ্চা হইত, আমি কিন্তু বাচ্চাডা রাইখা দিতাম!’

রুনুর কথার পরে কোনো কথা বলতে তখন অনেকখানি সময় নেয় স্তম্ভিত সামাদ। মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সামাদ রুনুকে প্রবোধ দিতে সচেষ্ট হয়; বলে : ‘বাচ্চা না-থাইকা ভালো হইছে রুনু! বাপহারা বাচ্চাটারে মানুষ করতে কষ্ট হইত তোমার।’

‘না! ভালো হয় নাই! ভালো হয় নাই! এই যে দেখেন আমি নিজেরে ক্যামনে মাইরা ফালাইলাম? মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়া তপন মইরা গেল আর আমি এহন অন্য মাইনষের লগে সংসার করি। এই গ্লানি আমার প্রত্যেক দিনের! আপনে এইডা বুঝবেন না সামাদ ভাই! আমি তো বুঝি নাই যে তপনের মৃত্যু আমি কোনোদিন ভুলতে পারুম না!’

এই বলে অনেক অনেক দিন পরে, ধরা যাক ১৯৯৯ সালের সেই রোববারে, কান্নায় ভেঙে পড়ে রুনু। তার কান্নার আওয়াজ পেয়ে টেলিভিশন দেখা বন্ধ করে শোয়ার ঘর থেকে বসার ঘরে দৌড়ে আসে লুনা। লুনাকে জড়িয়ে ধরে হাহাকার করতে থাকে রুনু : ‘ভাবি! আপনেরা আমার তপনরে ফিরত নিয়া আসেন, না-হইলে আমারে মাইরা ফালান!’ রুনুকে শান্ত করার জন্য লুনা তখন রুনুর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে ধীরে ধীরে।

বিষণ্ণ সামাদ সেই রোববারে তাদের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে থাকে। সে আবারো ভাবতে বসে, ১৯৭১ সালে কমলাপুর রেলস্টেশনে গেরিলা হামলার প্ল্যানটা আরো ভালোভাবে করা দরকার ছিল! সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ রাত ১০টার দিকে রামপুরার শেল্টার থেকে উত্তর শাহজাহানপুর হয়ে পেছনদিক দিয়ে রেলস্টেশনে ঢুকেছিল সামাদ, তপন, মতিন, সাদেক আর বাসুদেব। অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কমলাপুর রেলস্টেশনের পাকিস্তানি আর্মিদের চৌকিতে অ্যাটাক করা। পাকিস্তানি আর্মিদের চৌকিটা রেলস্টেশনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায়। সেখানে গার্ড দিচ্ছে চারজন হানাদার সৈন্য আর দুজন রাজাকার। পরপর তিনদিন রেকি করার পর আক্রমণের পরিকল্পনাটা ছিল এরকম : পয়লাতে পুবদিক থেকে চারটা হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ করবে মতিন আর সাদেক। তিরিশ সেকেন্ড পর প্রথমে সামাদ পুবদিক থেকে, তারপর বাসুদেব দক্ষিণদিক থেকে পরপর স্টেইনগান ব্রাশ করবে। উত্তর শাহজাহানপুরের দিকে রিট্রিট করার সময় পুবদিকের দেয়ালের কাছ থেকে স্টেনগান দিয়ে বাকিদের কাভার দেবে তপন। পরিকল্পনামতো সামাদের নির্দেশে পয়লাতে আর্মিদের চৌকিতে গ্রেনেড চার্জ করে মতিন আর সাদেক। অতর্কিত আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই মারা পড়ে একজন পাকিস্তানি সৈন্য। সৈন্যরা এবং রাজাকাররা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছোটাছুটি শুরু করলে সামাদ তার স্টেনগানের পুরা ম্যাগাজিন ব্রাশ করে। তখন মারা পড়ে আরো একজন পাকিস্তানি সৈন্য এবং একজন রাজাকার। বাকি দুজন পাকিস্তানি সৈন্য এবং একজন রাজাকার নিচু দেয়ালের ওইপারে পশ্চিমের রাস্তার দিকে শেল্টার নিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে তাদের স্টেনগান আর থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে। বাসুদেব দক্ষিণদিক থেকে স্টেইনগান ব্রাশ করে একবার। তাতে করে পাকসেনা আর রাজাকাররা তাদের চৌকিতে ফেলে যাওয়া লাইট মেশিনগানটার কাছে কোনোমতেই আর ফেরত যেতে পারে না। তারপর দ্বিতীয়বার স্টেনগান ব্রাশ করে সামাদ।

ঠিক তখনই তারা দেখতে পায়, পশ্চিমদিকের আউটার সার্কুলার রোডে কই থেকে এসে উপস্থিত হয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটা টহল জিপ। জিপে পাঁচজন সৈন্য। সামাদরা তো তাজ্জব! অতিরিক্ত সৈন্য যোগ হওয়াতে পাকসেনা আর রাজাকারদের দলটার আক্রমণ তখন তীব্রতর হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে সামাদ আর বাসুদেব আরো দুই ম্যাগাজিন করে স্টেনগান ব্রাশ করে। পশ্চিমের দেয়ালের শেল্টারে থাকা পাকসেনা আর রাজাকাররা কেউই তাতে মরে না। তখন সামাদরা পুবের দেয়ালের দিকে পিছু হটে যায়। পুবদিকের দেয়ালের নিচে ঘাসের ওপরে শুয়ে স্টেনগান দিয়ে তাদের কাভার দেয় তপন। সে পরপর দুই ম্যাগাজিন গুলি ছোড়ে। ততক্ষণে রেলস্টেশনের দেয়াল পার হয়ে গিয়ে দেয়ালের ওইপার থেকে চায়ের দোকানের বেঞ্চের ওপরে দাঁড়িয়ে স্টেনগান দিয়ে তপনকে কাভার দিচ্ছে সামাদ আর বাসুদেব। তপন যখন লাফ দিয়ে দেয়াল টপকে ওইপাশে পড়বে ঠিক সেই মুহূর্তে তার পিঠে সে একঝাঁক গুলি খায়। তাল সামলাতে না-পেরে রেলস্টেশনের দেয়ালের ভেতরের ঘাসের ওপর পড়ে যায় তপন। কিন্তু তপনকে দেয়ালের ওইপাশে তুলে নিয়ে যেতে গেলে গেরিলাদের পুরা দলটাই ঝুঁকিতে পড়বে অবধারিত। এই বিবেচনার প্রায় দশ সেকেন্ড পরে শাহজাহানপুরের বিভিন্ন গলিতে রিট্রিট করে সামাদরা।

কাজেই অনেকদিন পরে, ধরা যাক ২০০৬ সালের কোনো এক রোববারে, সামাদদের ছাদে বসে বিকালের রোদ পোহাতে পোহাতে রুনুকে সামাদ তার অনুশোচনার কথা বলে : ‘তুমি তো জানো যে ওই অপারেশনের কমান্ডার আছিলাম আমি। আমার বুঝা উচিত আছিল যে প্ল্যানের বাইরেও দুর্ঘটনা ঘইটা যাইতে পারে। আমি তো ডাইনদিক থিকা সুলেমান আর রেজারে নিয়া যাইতে পারতাম রিজার্ভ ফোর্স হিসাবে! রেকি কিন্তু করছিলাম ঠিকঠাক – রাত ১০টার দিক চৌকিতে পাহারায় থাকব চাইরজন পাকসেনা আর দুজন রাজাকার। কিন্তু আতকা যে একটা টহলজিপ আইসা পড়তে পারে – এইটা আমার মাথায় আহেই নাই জানো! ওইখানে উপস্থিত থাইকাও আমি তোমার তপনরে বাঁচাইতে পারলাম না রুনু! আমার চোখের সামনে দিয়া হেয় গুলি খাইল! আহত তপইন্যারে আমি দেয়ালের এইপারে টাইন্যাও আনতে পারি নাই। কাপুরুষের মতো পালায়া গেছি আমি!’

তখন মাথা নিচু করে ছাদের রেলিংয়ে কনুইয়ের ভর রেখে দাঁড়িয়ে হাজি সাহেবের বাসার উঁচু গগনশিরীষটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামাদ। মনস্তাপের কারণে সে আর কোনো কথা বলতে পারে না।

তার পাশে দাঁড়িয়ে বারবার তাকে বোঝাতে থাকে রুনু : ‘আপনের কোনো ভুল আছিল না সামাদ ভাই! আমরা তো অনেককিছুই প্ল্যান করি। কিন্তু মাঝে মাঝে তো গ্যানজাম লাইগাই যায়। আপনে আর নিজেরে দুইষেন না প্লিজ!’

‘তুমি আমারে মাফ কইরা দিও রুনু’ – এই বলে বাম হাতের আঙুল দিয়ে মুখ ঢেকে হু-হু করে কাঁদতে থাকে সামাদ। অনেক মমতায় তখন তার পিঠে ধীরে ধীরে হাত বুলাতে থাকে রুনু।

সুস্থির হয়ে সামাদ একটা সিগারেট ধরায়, তারপর বলে : ‘তোমার তো মনে আছে যে ১৯৭১ সালে গেরিলা ট্রেইনিং শেষ কইরা মেলাঘর থিকা আমরা ঢাকায় ফিরা আসি জুলাই মাসের শেষের দিক। তখন আমাগো দলের শেল্টার আছিল বাসাবো আর রামপুরায়। আগস্টের পয়লাদিকে খিলগাঁও বাজারে দিনের বেলায় তিনজন খানসেনা খতম করি আমি, তপন আর মতিন। পিছন থিকা স্টেনগান দিয়া ব্রাশ করছিল তপইন্যা। আমি আর মতিন রিভলবার দিয়া তারে কাভার দিছিলাম। খানসেনারা ফায়ার ওপেন করার টাইমই পায় নাই জানো? আমাগো কেউ কিন্তু ধরা পরে নাই সেইদিনকা! না হইলে ধরো, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আমরা যে বাসাবোর কদমতলী পুলিশ ফাঁড়ি রেইড করছিলাম, তখনো তো আমরা মইরা যাইতে পারতাম! ভাবতে পারো তুমি, দিনেদুপুরে আমরা পনেরজন গেরিলা লাইট মেশিনগান, এসএলআর, স্টেনগান আর অটোমেটিক রাইফেল নিয়া পুলিশ ফাঁড়ি অ্যাটাক করছিলাম? পুলিশ আর রাজাকাররা তো আমাগো ফায়ার পাওয়ারের সামনে খাড়াইতেই পারল না! ওগো তেরজন মরছিল। আমরা যখন বিলের ভিতর দিয়া তিনখান নৌকা নিয়া ফিরা যাইতাছিলাম গেরামের দিক তখন পাকসেনাগো মুগদা-ক্যাম্প থিকা মিলিশিয়া আর রাজাকাররা মিল্লা আমাগো নৌকাগুলা টার্গেট কইরা লাইট মেশিনগান চালাইতে শুরু করল। গুলি লাইগা আমাগো একটা নৌকা ডুইবা গেছিলগা তহন। কিন্তু আমাগো কেউ মরে নাই, জানো?’

তারপর ধরা গলায় সামাদ রুনুকে জিজ্ঞাসা করে : ‘আর দেখো, কমলাপুর রেলস্টেশন অ্যাটাক করতে গিয়া আমি প্ল্যানিংয়ে ভুল কইরা বসলাম আর তোমার তপন গুলি খাইয়া মইরা গেলগা! তুমি কেমনে আমারে মাফ করবা রুনু?’

বেদনার্ত রুনু সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না।

রুনু তাকিয়ে থাকে পুবে যেখানে একদা বড় একটা মাঠের শেষে টিনের চালের একটা বাড়ি ছিল শিরীষ, আম, হিজল আর পাকুরের ছায়ায়; যেখানে তপন নামে একজন কিশোর হিজলের ছায়ায় বসে মুগ্ধ হয়ে আকাশে মেঘের কারুকাজ দেখত আর বলত : ‘রুনু! দেখ, ওই জায়গাটার মেঘগুলারে একটা হাতির মতন মনে হইতেছে, না? আর ওই যে দক্ষিণে ওই মেঘটা যেন ঠিক তোমার মুখের মতন দেখতে। কী সুন্দর!’ সেই তপন তারুণ্যে এসে তাকে ভালোবেসেছিল। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে অনেক স্বপ্ন ফেলে রেখে এই পৃথিবীর সুন্দর জীবন থেকে হারিয়ে গেল সে-ছেলেটা!

১৯৭১-এর আগস্টের ২৩ তারিখে চামেলিবাগে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য সেই ছেলেটার সঙ্গে গোপনে দেখা করে রুনু। এ-মুহূর্তে রুনু সামাদকে সেই গল্পটা আবারো বলতে থাকে। জুলাই মাসে তপনরা গেরিলাযুদ্ধ করার জন্য মেলাঘর থেকে ঢাকা শহরের ফিরে আসলেও আগস্টের ২৩ তারিখের আগে তপন আর রুনুর সাথে দেখা করতে পারেনি। তখন রাজাকারেরা গেরিলাদেরকে ধরার জন্য মহল্লায় মহল্লায় তৎপর। সেজন্য তপন তার চামেলিবাগের খালার শরণাপন্ন হয়। তপনের মেঝখালাই রুনুকে ফোন করে তার বাসাতে জরুরি কাজে যেতে বলে। মেঝখালার ফোন পেয়েই রুনু বুঝতে পারে যে তপন বেঁচে আছে এবং সে তখন ঢাকাতেই। তপনের সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দ আর উত্তেজনায় স্কুলপড়ুয়া ছোটো ভাইকে নিয়ে চামেলিবাগে ছোটে রুনু। পথে পথে পাক হানাদার আর রাজাকারদের টহল। তবে সে ভয়কে পাত্তা দেয় না রুনু। চামেলিবাগ পৌঁছিয়ে প্রথমেই রুনুর চোখে পড়ে যে তপন শুকিয়ে গেছে অনেক। হাসতে হাসতে তপন বলে : ‘কই থাকি না-থাকি! খাওয়াদাওয়ার ঠিক নাই। ঘুমের কোনো রুটিন নাই। শরীর তো শুকাতেই পারে একটু! দেশ স্বাধীন হলে ঠিক হয়ে যাবে সব। কিন্তু রুনুও তো অনেক শুকিয়ে গেছে!’ রুনু তখন তপনকে বলে : ‘আতঙ্কই যখন একটা দেশের বাস্তবতা হয় তখন সেই আতঙ্ক মানুষের শরীরে প্রভাব ফেলবেই!’

রুনু সামাদকে বলে : তপনের মেঝখালার চামেলিবাগের বাসায় রান্নাঘরের পাশে তখন ছোট একটা ঘর ছিল। নিশ্চয় ঘরটার কথা মনে আছে সামাদের। ওই ঘরে তখন পড়াশুনা করত মেঝখালার বাচ্চারা। সেখানে অপ্রশস্ত একটা খাটে হালকা নীল হাফ শার্ট আর গাঢ় ছাই রঙের প্যান্ট পরা তপন রুনুর হাত ধরে বসে থাকে। রুনুকে শিলং-ভ্রমণের গল্প শোনায় তপন – ট্রেনিংশেষে ক্যাম্প থেকে একদিনের ছুটি নিয়ে সামাদ আর সে একবার শিলং গিয়েছিল। মেলাঘর থেকে বাসে চেপে বিকালে তারা শিলং পৌঁছায়। পুলিশবাজারের একটা কমদামি হোটেলে গিয়ে স্বাদ করে অনেকদিন পর তারা সাদা ভাত খায় রুইমাছের ঝোল দিয়ে। তারপর থানা রোডের পায়েল সিনেমা হলে নাইট শোতে উত্তম-অপর্ণার সাড়া জাগানো ছবি জয়জয়ন্তী দেখে ফেলে তারা। পরদিন সকালে তারা শিলং পিকে উঠে মেঘেঢাকা শিলং শহরটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে কিছুক্ষণ। দুপুরে বাস ধরে তারা রাতের বেলায় ফিরে যায় মেলাঘরে। সেই প্রথম তাদের ট্রেনিংক্যাম্প থেকে ছুটি নেওয়া। সেই প্রথম তাদের শিলং-ভ্রমণ!

তপনের হাসি-হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মুগ্ধ হয়ে শিলং-ভ্রমণের সেসব গল্প শুনতে থাকে রুনু। একসময় তপন রুনুকে জিজ্ঞাসা করে : ‘বলো তো আমি শিলং গেছিলাম ক্যান?’ মৃদু হাসিতে উত্তর করে রুনু : ‘বিয়ের পর আমি তোমার সঙ্গে শিলং যাইতে চাইছিলাম। ভুলি নাই আমি!’ তারপর তারা দুজনে মিলে ফেলে আসা শান্তির দিনগুলো নিয়ে গল্প করে। তপনের সেভ করা মসৃণ গালে হাত বুলাতে বুলাতে রুনু তখন ভাবে – তাও ভালো যে তপনের সঙ্গে দেখা হলো! অবরুদ্ধ সেই ঢাকা শহরে পাকসেনা আর রাজাকারদের দৌরাত্ম্যের ভেতরে তাদের সেটুকু দেখাও তো না-হতে পারত! কিন্তু রুনু তখন জানত না যে, সেটাই তাদের শেষ দেখা হবে!

তারপর, ধরা যাক ২০০৬ সালের সেই রোববারে, সন্ধ্যার অন্ধকারে সামাদদের বাসার ছাদে বসে চায়ের কাপে একটা চুমুক দেয় রুনু এবং সে হাসতে হাসতে সামাদকে বলে : ‘১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের কথা কই। তহন কিন্তু আপনে তপনরে ছুটি দিতেই চান নাই! মনে আছে আপনের? না-হইলে তপন ট্রেনিং নিয়া ঢাকায় আসার পর, যেমনেই পারুক, সিদ্ধেশ্বরী আইসা আমার লগে দেখা করতই করত! আপনেও তো ওরে ভালো কইরাই চিনতেন!’

রুনুর কথা শুনে সামাদ হেসে ওঠে। তার কাজের পেছনে সে এভাবে যুক্তি দাঁড় করাতে চায় : ‘সেইসুমকার ঢাকা শহরের অবস্থার কথা তুমি কি ভুইলা গেছগা রুনু? তখন রাজাকারেরা কিলবিল করতাছে চাইরদিক। পাকবাহিনীর হাতে তারা ধরায়াও দিছে অনেক গেরিলারে। মনে নাই তোমার? তাই তোমার লগে লুকায়া লুকায়া দেখা করণের জন্যে তপনরে যাইতে আমি পারমিশন দেই নাই। আমাগো সিদ্ধেশ্বরী মহল্লার ফজইল্যা রাজাকারের কথা মনে আছে না তোমার? হেয় যুদি কুনুভাবে তপনরে দেইখা ফালাইত তা হইলে তারা তপনরে তো ধইরা নিয়া যাইতই, তোমাগো বাইড়তে রেড করতে ডাইকা নিয়া আসত পাক আর্মিদেরে! তুমি কী করতে পারতা তহন? ভাবছ একবার?’

রুনু স্মরণ করে যে গেরিলাযুদ্ধের জন্য ঢাকায় ফিরে আসার পর সামাদ আর তপন ভুলেও কোনোদিন সিদ্ধেশ্বরীতে তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। এবং এও ঠিক যে, তপন তার সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করতে এসে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে গেলে সবার জন্যই সমূহ বিপদের সম্ভাবনা ছিল। সামাদের সে-যুক্তিতে কোনো ভুল নাই। কিন্তু রুনুর মনে হয় যে, এতসব সাবধানতা অবলম্বনের পরেও পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ঠিকই মৃত্যু হয়েছিল তপনের। ছত্রিশ বছর ধরে সেই পরিতাপের কোনো মীমাংসা করতে পারেনি রুনু, আর পারবেও না!

সামাদদের ছাদ থেকে হাজি সাহেবের বাসার গগনশিরীষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রুনুর তখন মনে হয়, সেই প্রিয় মুখ এই পৃথিবীর কোথাও আর সে দেখতে পাবে না কোনোদিন! তা ভেবে রুনু অঝোরে কাঁদতে থাকে আর বলে: ‘সামাদ ভাই! এইবার আপনে কথা বন্ধ করেন। আমি আর নিতে পারতাছি না! আমি কেমনে সহ্য করতে পারব যে গুলি খাইয়া তপন ঘাসের উপরে চিত হইয়া পইড়া আছে, ও ব্যাথায় কাতরাইতাছে, নড়তে পারতাছে না! তপনের শরীরে ঢুইকা যাওয়া গুলিগুলা এখনো আমার বুকের ভিতরে জখম কইরা রাখছে – জানেন? আল্লাহর ওয়াস্তে থামেন আপনে!’

তো সেই রোববারে সামাদ তার গল্প থামায়। তারপর রাতের অন্ধকারে ফুলকি দিতে থাকে সামাদের হাতের জ্বলন্ত সিগারেট। রুনু আর মাসুদা ছাদ থেকে নিচে নেমে যায়।

 

তিন

২০১৩ সালের মাঝামাঝি হাজি সাহেবের হলুদ দোতলা বাসাটা ভেঙে ফেলে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডার। বাসাটার দক্ষিণপাশের দেয়ালের সঙ্গের পুরনো গগনশিরীষটা যখন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডার সমূলে কেটে ফেলে তখন খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে সামাদের। তার মনে পড়ে যায়, আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে ওই গগনশিরীষের দিকে তাকিয়ে রুনুর কথা ভাবত তার প্রিয় বন্ধু তপন; আর প্রায়ই বলত – ‘যদি রুনুরে নিয়া কবিতা লেখতে পারতাম!’ কিন্তু রুনুকে নিয়ে তপনের আর কবিতা লেখা হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কমলাপুর রেলস্টেশনে অ্যাকশনের সময় পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হয় তপন।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে সিদ্ধেশ্বরীতে ফিরে আসার পর আবুজর গিফারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে থার্ড ক্লাস পায় সামাদ। পড়াশোনায় হতোদ্যম হয়ে সে মৌচাক মার্কেটে তার বাবার শাড়ির দোকানে নিয়মিত বসতে শুরু করে। প্রতিদিন সকালে তাদের বাসা থেকে বের হয়ে মৌচাক মার্কেটে যাওয়ার জন্য রওনা করে সামাদ। সেই সময়ে হাতের ডাইনে হাজি সাহেবের বাসার দিকে সে তাকায় এবং সে দেখতে পায়, অনেক উপরে মাথা তুলে দূর আকাশে ছড়িয়ে গেছে গগনশিরীষটা। তখন তপন প্রায় প্রায়ই তার সঙ্গে হাঁটে আর তাকে জিজ্ঞাসা করে : ‘ওই সামাইদ্যা! খাড়া তো একটু! আচ্ছা দোস্ত, তর কি মনে হয় না যে রুনু আসলেই গগনশিরীষের মতন সুন্দর দেখতে? সেই রকম লম্বা, সেই রকম পাতলাসাতলা! কী কস তুই? সেই রকম গম্ভীর?’ সামাদ মাথা নেড়ে সায় দেয় তপনের কথায়। এভাবে তপনের সঙ্গে গলি ধরে চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে সে সিদ্ধেশ্বরী রোডে ওঠে এবং তারপর বামে অগ্রসর হয় মৌচাক মার্কেট বরাবর। তখন সামাদ তার মাথায় সারাদিনের কাজের তালিকা তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে যায় এবং তাই হতোদ্যম তপন মেজাজ খারাপ করে কোনো একসময়ে মহল্লায় ফিরে যায়।

এভাবে রোদে, বৃষ্টিতে অথবা কুয়াশায় তপনের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম-মহল্লার একমাত্র গগনশিরীষ। সেই সুন্দর গগনশিরীষটা দিনে দিনে আরো পুরনো হয়; আরো বাড়তে থাকে ঊর্ধ্বমুখে আকাশের দিকে। কিন্তু হাজি সাহেবের হলুদ দোতলা বাসাটার জায়গায় অ্যাপার্টমেন্ট ওঠার সময় কাটা পড়ে গাছটা! আর সেজন্য এখন সকালবেলায় বাসা থেকে বের হওয়ার পরেই সামাদের কাছে তপন খালি ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে : ‘গাছটারে তরা এমনে মাইরা ফালাইলি? অহন কী হইব আমার? রুনুর কথা আমি ভাবুম কী দেইখা?’

তিনদিন আগে, ১১ এপ্রিল ২০১৩-এর সন্ধ্যায়, রুনুর দিলু রোডের বাসায় বসে তপনের সেই অভিযোগটা রুনুকে জানাতে পারেনি সামাদ। রুনুর জামাইয়ের সামনে তপনের স্মৃতি নিয়ে মন খুলে আলাপ করাটা উচিত বলে মনে হয়নি তার। তো সেদিন রাতে বাসায় ফেরার পর সামাদের বউ লুনা সামাদকে বুদ্ধি দেয় : ‘তাইলে সামনের রোববারে রুনুরে আইতে কও।’ লুনার পরামর্শমতো শনিবার রাতে তাই রুনুকে ফোন করে সামাদ; ফোন করে বলে, ‘কাইল তো রোববার। আমি দোকান খুলুম না। সকালে আসবা একটু? কাম আছিল। অনেকদিন তো আসও না আমাগো বাসায়!’

‘আচ্ছা আসুমনে। কিন্তু এত তাড়া ক্যান? শাড়ি আনছেন নাকি আমার আর ভাবির লিগা?’ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে রুনু।

‘তোমাগো লিগা শাড়িউড়ি পরে আনন যাইব। অন্য একখান কাম আছে তোমার লগে। সামনাসামনি বলুমনে। ফোনে এতকথা কওন যায় নেকি?’

‘আপনে এত গম্ভীর ক্যান আইজকা? তপনের কথা মনে পড়তাছে, তাই না? বুধবারে আমার বাসায় আইসা আপনে তো ঠিকমতো কথাই কইতে পারেন নাই – জানি।’

‘হেইডা ঠিকই কইছো তুমি।’ এইটুকু বলে থেমে যায় সামাদ।

কাজেই আজ ১৪ এপ্রিল ২০১৩ রোজ রোববার সকালে সামাদদের বাসায় বেড়াতে আসে রুনু। আজ রোববার বসার ঘরের সোফায় বসে মাথা নিচু করে বিষণ্ণ সামাদ রুনুকে বলে : ‘তপইন্যা মইরা গেছে পরে বিয়াল্লিশ বছর ধইরা প্রত্যেকটা দিন আমি তাকায়া তাকায়া গাছটারে দেখছি আর তপইন্যার কথা ভাবছি। হাজি সাহেবের পোলারা অ্যাপার্টমেন্ট তুলতে গিয়া গগনশিরীষটারে মাইরা ফালাইল! গাছখান কাটতে না-করছিলাম! হেরা শুনে নাই। তা হইলে আমার কষ্ট লাগব না – কও?’

হাজি সাহেবের বাসার গগনশিরীষটার মৃত্যু হওয়াতে সামাদ কষ্ট পাচ্ছে দেখে আজ রোববার সকালে রুনু তাকে এভাবে বোঝাতে বসে : ‘এই যে আপনের বন্ধু মুক্তিযুদ্ধে গিয়া মইরা গেল, সে আসলে কই আছে কন তো দেখি? গেল বিয়াল্লিশ বছর ধইরা তপন আমাগো স্মৃতির ভিতরেই বাঁইচা আছে বহাল তবিয়তে। তাই না? এমন একটা দিনের কথা কন, যেইদিন তপনের কথা আপনের মনে পড়ে নাই? তার জন্যে কি গগনশিরীষের দিকে আপনের তাকায়া থাকতে লাগব নেকি?’

সামাদ আর কোনো কথা বলে না রুনুর কথার পিঠে। রুনু কিছুক্ষণ সামাদের ব্যথিত চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে জানায় : ‘গগনশিরীষের গাছটা কাইটা ফেলছে বইলা আমারো খুব কষ্ট লাগছে সামাদ ভাই! মুক্তিযুদ্ধের আগের দিনগুলাতে ওই গাছটা দেখতে দেখতেই তো তপন আমার কথা ভাবত! তপন মইরা গেছে পরে আমিও কতদিন আপনেগো ছাদে উইঠা গগনশিরীষটারে তাকায়া তাকায়া দেখছি আর তপনের কথা ভাবছি!’

‘লও তাইলে একখান কাজ করি চলো – আমাগো বাসার উত্তরের দেয়ালের লগে আমরা একখান গগনশিরীষ লাগাই। এমনো তো হইতে পারে যে দূর থিকা তাকায়া তাকায়া সেই গাছটা তপনে দেখব আর তোমার কথা ভাবতে থাকব! হইতেও তো পারে? কী কও তুমি?’

সামাদের সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর করে না রুনু। সে ধীরে ধীরে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়, ব্যাগের ভেতরে মোবাইল ফোনটা ঢোকাতে ঢোকাতে সে সামাদকে প্রস্তাব দেয় : ‘চলেন তাইলে গগনশিরীষের চারা কিনা নিয়া আসি গিয়া। ফকিরাপুল পানির ট্যাংকির কাছে রাস্তার পাশে আমি একটা নার্সারি দেখছি সেইদিনকা।’

সামাদ উঠে দাঁড়ায় সঙ্গে সঙ্গেই। একদৌড়ে সে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে। তারপর রুনুকে নিয়ে সে ফকিরাপুলের দিকে রওনা দেয়।

১৪ এপ্রিল ২০১৩ রোববার সামাদ আর রুনু ফকিরাপুল পানির ট্যাংকের কাছে গাড়ি থেকে নামে। গাড়ি থেকে নামার পর তারা আবিষ্কার করে যে নার্সারিটায় কেবলই ফুলগাছ, পাতাবাহার আর অর্কিড বিক্রি হয়। সেখানে গগনশিরীষ বা অন্য কোনো বৃক্ষের কোনো চারা নেই। সামাদ রুনুকে বলে : ‘এইডা ভুয়া নার্সারি! লও ধানমন্ডি যাইগা।’

সামাদের ধানমন্ডি যেতে চাওয়ার প্রস্তাবের পেছনে অবশ্য একটা কারণও আছে। মেয়েকে ধানমন্ডিতে স্কুলে নামাতে এসে সামাদ সাধারণত তিন নম্বর রোড দিয়ে সায়েন্স ল্যাবের রাস্তায় যায়। ধানমন্ডি তিন নম্বর রোডে যাওয়ার পথে চার নম্বর রোডের পার্কটার ধার ঘেঁষে গড়ে উঠেছে একটা বড় নার্সারি। আজ রোববার সেখানে গাড়ি থামায় সামাদ। নাহ্! এখানেও গগনশিরীষের চারা মেলে না। তাই নার্সারিওয়ালাকে রুনু জিজ্ঞাসা করে যে, গগনশিরীষের চারা পাওয়া যেতে পারে কোন জায়গায়। নার্সারিওয়ালা জানায়, শেরেবাংলা নগরে আবহাওয়া অফিস পাওয়ার আগেই হাতের বামে একটা নার্সারি আছে। সেই নার্সারিতে বিভিন্ন বৃক্ষের চারা বিক্রি হয়। কাজেই ধানমন্ডি থেকে সামাদ আবার গাড়ি টান দেয় শেরেবাংলা নগরের দিকে। শেষ পর্যন্ত সেই নার্সারিতেই গগনশিরীষের চারা খুঁজে পায় তারা।

সামাদ রুনুকে জিজ্ঞাসা করে : ‘কয়টা চারা কিনবা রুনু?’

রুনু বলে : ‘একটাই কিনি।’

সেখানে বিভিন্ন উচ্চতার গগনশিরীষের চারা আছে – এক ফুট থেকে শুরু করে আট-নয় ফুট পর্যন্ত। রুনু তার ইচ্ছা প্রকাশ করে : ‘বড় দেইখা চারা কিনি চলেন। তা হইলে গাছটা খুব কম টাইমে আকাশের দিক উইঠা যাইব। কী কন?’

কাজেই গগনশিরীষের আট ফুট মতো লম্বা একটা চারা পছন্দ করে তারা। কিন্তু রুনু আর সামাদের ভেতর মতবিরোধ দেখা দেয় গগনশিরীষের চারার দাম পরিশোধ করা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত রফা হয় যে তারা দুজনে মিলেঝিলে চারার দাম দেবে – রুনু অর্ধেক আর সামাদ বাকি অর্ধেক।

সামাদ আর রুনুর ভেতরে দ্বিতীয় মতবিরোধ দেখা দেয় সামাদদের বাসার দেয়ালের উত্তর-পূর্ব কোনায় গগনশিরীষের চারাটা বুনে দেওয়ার প্রশ্নে – কে লাগাবে গাছটা? সামাদ, না রুনু? কোদাল দিয়ে মাটিতে দুই ফুট মতো গভীর গর্ত খুঁড়ে নিয়ে সামাদ রুনুকে অনুরোধ করে : ‘তুমিই গাছটা লাগাও।’

রুনু কিছুতেই তা মানবে না। সে যুক্তি দেয় : ‘গগনশিরীষ লাগানোর প্ল্যান করছেন আপনে। চারাটা সেই জন্যে আপনেরই লাগানো উচিত।’

কিন্তু সামাদ রুনুকে বলে : ‘মহল্লার মানুষজনে জানব যে তপইন্যার কথা ভাইবাই তুমি এই গাছখান লাগাইছিলা। ভালো লাগব আমার।’

গগনশিরীষের চারাটা রুনুই মাটিতে বুনে দেয় শেষ পর্যন্ত। গগনশিরীষের গোড়ায় কোদাল দিয়ে টেনে মাটি ভরাট করে সামাদ। আর হাঁটু গেড়ে বসে দু-হাতের সবগুলো আঙুল দিয়ে গাছের গোড়ার এলোমেলো মাটি অনেকক্ষণ ধরে সমান করে দেয় রুনু। সামাদের বোন মাসুদা ছোট একটা বালতিতে করে পানি নিয়ে আসে। রুনু একটা মগ দিয়ে বালতি থেকে ধীরে ধীরে পানি ঢালে গগনশিরীষের চারাটার গোড়ায়। চারাটার সবুজ, চিরল পাতাগুলোয় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে রুনু উঠে দাঁড়ায় তারপর। সামাদের দিকে মলিন চোখে একটু তাকায় রুনু এবং মাসুদাকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করতে থাকে : ‘দেখ! আমার বুকে পাক আর্মিগো গুলি লাগছে কেমুন! বুক থিকা চিড়িক দিয়া রক্ত বাইর হইতাছে! দেখতাছস না তুই? চোখ নাই তর?’

১৪ এপ্রিল ২০১৩ রোববার ক্রন্দনরত রুনুর দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামাদ। কী বলে রুনুকে প্রবোধ দেওয়া যাবে, তা সে বুঝতে পারে না। r