গা বা ল

স্বকৃত নোমান

সকাল থেকে তিন গ্রাম ফেরি করেও দশ টাকা রুজি হলো না। এখন পড়ন্ত দুপুর। এই বেলা আর হবে কিনা তাও সন্দেহ। রুজি হবেই-বা কেমন করে? একে তো টেলিভিশনের যুগ, তার ওপর কার্তিক মাস। এই অদিনে কার মনে এত আনন্দ যে, টাকা-পয়সা খরচ করে সাপের খেলা দেখবে! আশ্বিন-কার্তিক মাসে কজন গেরস্তের গোলায় বাড়তি ধান থাকে? গোলায় ধান না থাকলে হাতে বাড়তি টাকা আসবে কোত্থেকে! দুই টাকাও এখন দুশো টাকার সমান। সম্পন্ন গেরস্তবাড়ির বউ-ঝিদের জন্য অবশ্য দু-চার টাকা তেমন কিছু নয়, কিন্তু বেহুদা কাজে এক পয়সাই-বা খরচ করবে কেন। বাড়ি-বাড়ি টেলিভিশন, হাটেবাজারে টেলিভিশন – কোনো-কোনো গ্রামে ডিশলাইনও এসে গেছে। রিমোটের এক টিপে চোখের সামনে ভেসে ওঠে কত চ্যানেল। সাপের খেলা তো মামুলি ব্যাপার, এমনকি খেলা আছে টেলিভিশনে যা দেখা যায় না! বনজঙ্গলের এমন কোন প্রাণী আছে, যা ডিসকভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে দেখা যায় না!

কিন্তু তরুনাথের পেট কি অতশত বোঝে? খরা-বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অদিন-সুদিন যা-ই হোক, সারা দুনিয়া বিরান হয়ে যাক – তিনবেলা না হোক, অন্তত একবেলা ভাত তো পেটে চালান করতে হয়। এলাকার চা-দোকানে বাকিতে চা-বনরুটি খেয়ে না-হয় তার দু-একদিন চলে যায়, কিন্তু পাঁচ ছেলেমেয়ের তো ভাত চাই। ধোঁয়া-ওঠা গরম গরম ভাত। একবেলা ভাত না পেলে কেঁদেকেটে বাপ-মায়ের মগজ খেয়ে ছাড়বে। অদিন হলেও তাই কিছু করার থাকে না তরুনাথের, সাপের ভাঁড়াটা কাঁধে নিয়ে রোজ সকালে বেরোতেই হয়। বীণ বাজিয়ে, সাপের খেলা দেখিয়ে, তাবিজ-কবজ বেচে রোজ শখানেক টাকা রুজি হলেই হয়, টেনেটুনে সংসারটা চালিয়ে নেওয়া যায়। সবদিন আবার একরকম যায় না। কোনো-কোনোদিন বিশ টাকা রুজি করতে মাথার ঘাম পায়ে পড়ে। কোনো-কোনোদিন আবার এক টাকাও পকেটে ঢোকে না। সকালে যেমন খালি পকেটে বেরোতে হয়, সাঁঝেও ঠিক খালি পকেটেই ডেরায় ফিরতে হয়। কুফা লাগলে এমনই হয়। আজো কুফা লেগেছে। সারাবেলা ঘুরেও পকেটে এক টাকা ঢুকল না।

কার্তিকে এসেও গরমের দাপট কমেনি। রাস্তার পাথুরে মাটি তপ্ত খোলার মতো। ধান দিলে খই ফুটবে, চাল দিলে মুড়ি। খালি পায়ে কতক্ষণ হাঁটা যায়? গ্রামের বড় রাস্তার ধারে কাঁঠালগাছটার তলায় ভাঁড়াটা নামিয়ে রাখল তরুনাথ। কালিময়লা সাদা কাপড়ে মোড়ানো ঝুড়ি দুটির ভেতর একটি গোখরো আর একটি দুধরাজ। গোখরোটার নাম রেখেছে বকখিলা, আর দুধরাজটার নাম মথিলা। গোখরোর বাচ্চাও আছে দুটি। বেঁচে আছে না মরে চিৎ হয়ে আছে কে জানে। সারাদিন ঝুড়ি দুটি একবারও খোলা হয়নি। খিদায়-গরমে হয়তো কাহিল হয়ে পড়ে আছে সরীসৃপগুলো। সকালে কিছু খাওয়ানো হয়নি। রাতে ডোবা থেকে চার-পাঁচটা ব্যাঙ ধরে এনেছিল তরুনাথের বড় ছেলে দেলুনাথ, ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছিল। ওই খেয়ে আছে এখন পর্যন্ত।

দরদর করে ঘাম ঝরছে তরুনাথের। টেট্টন কাপড়ের ফতুয়াটা ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। চোয়াল দুটিতে টনটনে ব্যথা। সেই সকাল থেকে বীণের নলটা মুখ থেকে সরেনি। বাংলা সিনেমার সুপার-ডুপার হিট প্রেমের গানের সুর, জারি-সারি ভাটিয়ালির বিচ্ছেদী সুর, হিন্দি সিনেমার ধুমধাড়াক্কা সুর – কোনো সুরই বীণে তুলতে বাদ রাখেনি, তবু কারো মন গলানো গেল না। উলটো লোকজন গাবালি বীণের সুর শুনলে হাসিঠাট্টা করে। বীণ বাজিয়ে তাই রোজগারের আশা কম। তবু বাজাতে হয়। সাপ ধরার ওস্তাদ তরু গাবাল গ্রামে ঢুকেছে, এ-কথা জানান দেওয়ার জন্য বিরামহীন বাজিয়ে যেতে হয়। কারো বাড়িতে সাপখোপের উৎপাত থাকলে বীণের শব্দ শুনলেই তার ডাক পড়বে। দু-টাকা রোজগারের এই একমাত্র পথ। ধানের গোলায়, খাটের কোনায়, ইঁদুরের গাঁতায়, নাকি বেড়ার ফাঁকফোকরে কেউটেটা লুকিয়ে আছে খোঁজ লাগাও। যত টাকা লাগে নাও, যে করেই হোক বাড়ি থেকে বালাই বিদায় করো।

সারাবেলা খোঁজাখুঁজি খোঁড়াখুঁড়ি করে বালাইটা নিজের কব্জায় আনে তরুনাথ। বাড়ির লেদাগেদা নারীপুরুষ সবার মুখে হাসি ফোটে, তরু গাবালের খোশনামে সবাই পাঁচমুখ, কিন্তু মজুরি দেওয়ার সময় শুরু হয় দরকষাকষি – ‘নেও নেও, এই দশ টেকাই নেও। বড় খারাপ সময়, হাতে একদম টেকা-পইসা নাই।’

মুখ বেজার করে তরুনাথ বলে – ‘এইটা কেমন কথা রে ভাই? সারাদিন আপনের বাড়িতে পড়ি থাইকলাম। আমি কি ভিখারি? আজকাল দশ টেকা তো ভিখারিকেও দেয় না। এইটা আপনের ক্যামুন ইনসাফ?’

: এ দেখ গাবালের কথা! আমি কইছি তুমি ভিখারি? আচ্ছা ঠিক আছে এক পট চাল নিয়া যাও।

: না না, এক পটে হবে না, আধা সের লাগবে। সঙ্গে এক হালি ডিম। তাবিজ পুঁতে সারাবাড়ি বন্দিশা করে দিছি, কখ্খনো আর সাপখোপ ঢুকতে পারবে না।

বাড়ি বন্দিশার কথা বলে কি আর বাড়ির কর্তার মন গলানো যায়? আর যাই হোক, গাবালের এই কথায় বিশ্বাস করে না কেউ। বাড়ি যতই বন্দিশা করা হোক, চার কোনায় চারটার বদলে আটটা তাবিজ পোঁতা হোক, সাপ কি আর ওসবের ধার ধারে? সময় হলে সাপ ঠিকই আসবে, মুরগির খোপে হানা দিয়ে উৎপাত শুরু করবে, মওকামতো মানুষের পা কামড়ে খতম করে ছাড়বে।

শেষ পর্যন্ত এক পট থেকে বাড়িয়ে দুই পট চাল, এক হালি থেকে কমিয়ে এক জোড়া ডিম দিতে রাজি হয় বাড়ির বউ। বউ-ঝিদের মন সবসময়ই নরম, ভয়েও কাবু সবসময়। সারাদিন তো বাড়িতে পুরুষকে থাকতে হয় না, থাকতে হয় তাদের। বাড়িতে সাপখোপ ঢুকলে ভয় তাদেরই বেশি।

কিন্তু আজ এমনই কুফায় পেল তরুনাথকে, কোনো বাড়ি থেকেই সাপ তাড়ানোর ডাক পড়ল না। আজকাল সাপের তেমন উৎপাতও দেখা যায় না। মাসে-দুমাসে দুয়েকটা সাপ হয়তো ধরা পড়ে। তাও জাতের সাপ নয়, যতসব অনামা-অচেনা সাপ। দুধরাজ, গোখরো, দাঁড়াশ হলে শহরে নিয়ে ভালো টাকায় বেচা যায়। একেকটি কম করে হলেও তিন-চারশো টাকা। তাতে দোকানের বকেয়া শোধ করে দু-একদিন ভালোভাবে সংসারটা চালানো যায়।

কাঁঠালগাছটার পেছনে পুকুরটাতে নেমে হাতমুখ ধুয়ে নেয় তরুনাথ, বীণের আগাটাও ভালো করে ধুয়েমুছে নিল। তারপর গাছতলার শুকনো দূর্বাঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল। এই বেলায় অন্য গ্রামে যাবে, নাকি ডেরায় ফিরে যাবে ঠিক করতে পারে না। খিদার চোটে মাথা ঘুরছে। রাগও উঠছে বেজায়। ইচ্ছে করছে সাপের ঝুড়ি দুটি লাথি মেরে পুকুরে ফেলে দিতে। ঝুড়ি দুটির দিকে যতবারই তাকায়, ততবারই তার রাগ খাইখাই করে ওঠে। তিরিশ বছর ধরে এই ঝুড়ি বয়ে বেড়াচ্ছে, শত-শত সাপ এই ঝুড়িতে পেলেপুষে রেখেছে, খেলা দেখিয়ে হাজার হাজার মানুষকে আনন্দ দিয়েছে, রুজিও তো কম করেনি। বাঁশ-বেতে গড়া, পরম যত্নে মাটি-গোবরে লেপা এই ঝুড়ির সঙ্গেই তার ওঠবস, ভেতরে বিষধর সাপেদের সঙ্গেই তার বসবাস। তারাই তার নিত্যসহচর। তাই ইচ্ছা করলেও ঝুড়ি দুটি ছুড়ে ফেলতে পারে না, ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও আগলে রাখতে হয়। তিরিশ বছর তো আর কম সময় নয়। এই দীর্ঘ সময় কাছে থাকলে শত্রুর প্রতিও তো মায়া জন্মে যায়। বড় মায়া তার ঝুড়ি দুটির প্রতি।

কিন্তু এখন, এই খাঁ-খাঁ দুপুরে খিদার চোটে অস্থির তরুনাথের ভেতর দয়ামায়া বলে কিছু নেই। ঝুড়ির ভেতর সাপগুলো             খিদায়-গরমে যত না ফোঁসফোঁস করছে, তার চেয়ে বেশি ফোঁসফোঁস করছে সে। ইচ্ছে করছে প্রাণীগুলোকে বের করে কেটে টুকরো-টুকরো করে দলেপিষে মাটিচাপা দিয়ে রাখতে। এ কেমন চুতিয়ার জীবন! এটা কি কোনো জীবন হলো? আসু গাবাল চুতিয়া কা বাচ্চা! রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে বাপের নাম ধরে গালি দেয় তরুনাথ। যত সর্বনাশের মূল তার চুতিয়া বাপটা। নাকের শ্লেষ্মাঝরা বন্ধ হওয়ার আগেই তাকে কী এক আজগুবি পেশা ধরিয়ে দিলো তার বাপ – বিষধর সাপ নিয়ে কারবার। দেশে কি কাজের অভাব? করার মতো কাজ কি আর নেই দেশে?

কিন্তু তার বাপেরই-বা কী দোষ? সেও তো বুঝেশুনে এই পেশায় আসেনি। তার বাপের বাপ, বাপের বাপ, বাপের বাপও তো বুঝেশুনে আসেনি। কবে আশুনাথের কোন পূর্বপুরুষ কালকেউটে ধরে পোষ মানিয়ে পালতে শুরু করেছিল, মনের আনন্দে বীণ বাজিয়ে সেই কেউটেকে নাচিয়ে রং-তামাশা শুরু করেছিল, রং-তামাশা করতে করতে আয়-রোজগারও শুরু করেছিল – সে-কথা কি লেখাজোখা আছে কোথাও? ঠিক কত পুরুষ আগে এই সাপের খেলা শুরু হয়েছিল, কত যুগ আগে বীণের আবিষ্কার হয়েছিল, কখন কোথায় তরুনাথের কোন পূর্বপুরুষের নামের আগে সাপুড়ে খেতাবটা জুড়ে গিয়েছিল – তরুনাথ তো দূরের কথা, তার বাপের বাপেরও জানা ছিল কিনা সন্দেহ।

জানার মধ্যে তরুনাথ জানে শুধু এটুকু, চার পুরুষ আগে ময়নামতি কি কুমিল্লার ওদিক থেকে এসে বাস্ত্তহারা একদল সাপুড়ে বিলোনিয়া রেলস্টেশনের পাশে রেলকোম্পানির জায়গায় তাঁবু ফেলেছিল। বিলোনিয়া তখন জমজমাট রেলস্টেশন। স্টেশনের পাশেই সরগরম হাট। উপজেলা বা জেলাশহরে যেতে হলে আশপাশের দশ গ্রামের মানুষকে এই স্টেশনে আসতে হয়। রোজ শত-শত মানুষের আনাগোনা। যেখানে মানুষ বেশি সেখানে সাপুড়েদের আয়-রোজগারও বেশি। ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা মানুষদের সাপের খেলা দেখিয়ে, তাবিজ-কবজ বেচে, সাপে কাটা রোগীর বিষ নামিয়ে রুজি তাদের তেমন খারাপ হয় না। খেয়েপরে বাড়তি টাকা জমানোও যায়। কিন্তু টাকা-পয়সা জমানোর ধার ধারে না সাপুড়েরা। দুদিনের জীবন, ভালো খেয়ে ভালো পরে বাঁচার মতো বেঁচে থাকাতেই তারা অভ্যস্ত। ভবিষ্যৎ নিয়ে অত ভাবনা-চিন্তা নেই। ভাবনা কিসের? একেকজনের সাত-আটটা ছেলেমেয়ে। ছেলেরা একদিন বড় হবে, রোজগার করে মা-বাপকে খাওয়াবে। পেটকে কষ্ট দিয়ে টাকা-পয়সা জমানোর কী দরকার?

যুগের পর যুগ চলে গেল, বাপ মরে ছেলে মরল, নাতি বুড়ো হয়ে পুতিও মরল, বিলোনিয়ার ট্রেন কত লক্ষ-কোটিবার স্টেশন ছেড়ে গেল, কিন্তু এই স্টেশন ছেড়ে আর কোথাও যাওয়া হলো না সাপুড়েদের। ততদিনে তারা আর সাপুড়ে নেই, হয়ে গেছে গাবাল। গাবালের মানে কী, নিজেরাও জানে না। হয়তো সাপুড়েরই আরেক নাম। শহরের লোকরা তাদের সাপুড়ে বলেই জানে, কিন্তু গ্রামে তাদের পরিচিতি গাবাল হিসেবেই। সাপে কেটেছে? যাও গাবালপাড়ায়। ঘরে সাপ ঢুকেছে? ডাকো আশুনাথ, বসুনাথ, তরুনাথ গাবালকে।

হঠাৎ একদিন সরকারি হুকুমে বিলোনিয়ার ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল। লোকজনের যাতায়াত কমতে-কমতে বিরান হয়ে গেল জমজমাট এই স্টেশন। দারুণ ভাটা পড়ল গাবালদের রোজগারে। কী করে এখন গাবালরা? বিলোনিয়া স্টেশন ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে? না, তা কেমন করে হয়? এই মাটিতে তাদের চার পুরুষের বাস, এখানে এসে তারা সুখের ছোঁয়া পেয়েছে, মাতৃভাষা হিন্দির পাশাপাশি বাংলা ভাষাটাও শিখেছে। তাদের ছেলেপিলেদের নাড়ি এখানকার মাটির গভীরে পোঁতা। এই মাটি ছেড়ে তারা কোথায় যাবে? গেলেই কি আর শান্তিমতো থাকতে পারবে? দুদিন পরপরই জায়গার মালিকের হুঁশিয়ারি – ‘জায়গা খালি করো।’ মালিকের কথায় পাত্তা না দিলে পুলিশের ঠ্যালা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে, পাছায় ডান্ডার বাড়ি লাগিয়ে সোজা জেলহাজতে ভরবে। এখানে তো আর সেই ঝামেলা নেই। রেলকোম্পানির জায়গা, যতদিন ইচ্ছা থাকা যায়। উচ্ছেদ করতে চাইলে কিছু টাকা খরচ করে লিজ নিয়ে নিলেই ঝামেলা খতম। বছর বছর কিছু টাকা না-হয় দিতে হবে। না দিলেও ক্ষতি নেই। কোনোদিন কেউ জোর করে উচ্ছেদ করতে আসবে না। সারাদেশে কত জায়গা রেলকোম্পানির। কত জায়গা দখল-বেদখল হয়ে আছে। বিলোনিয়ার ছোট্ট এটুকু জায়গা নিয়ে এত ভাবনা কী তাদের!

কিন্তু থাকেই-বা কেমন করে? কেবল স্থায়ী বসতি থাকলে তো আর বেঁচে থাকা যায় না। বাঁচার জন্য খানাদানাও তো চাই। পেটের খিদা চাগা গিয়ে উঠলে ঘর-বসতি সব বিরক্তিকর লাগে, জগৎ-সংসার অন্ধকার মনে হয়। পেটের খিদা মেটানোর জন্যই তো গাবালদের পূর্বপুরুষরা দেশে-দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে যুগযুগান্তর।

শেষ পর্যন্ত পথে নামতে হলো গাবালদের। সাপের ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে সকালে বের হয়। মাইল মাইল পথ হেঁটে, গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে ডাল-আলুভর্তা দিয়ে দুবেলা ভাত খাওয়ার মতো টাকা রোজগার করে সাঁঝে ডেরায় ফেরে। টেনেখিঁচে সংসারটা কোনোরকম চালিয়ে নেয়।

কিন্তু এখন এমন যুগ পড়েছে, টেনেখিঁচেও কিছু হয় না। দিনের পর দিন একবেলা খেয়ে থাকতে হয়। কোনো কোনো দিন একবেলাও জোটে না। গাবালদের ছেলেপিলেরা সাপের কারবার ছেড়ে নানা পেশায় ঢুকে পড়ছে। ময়মুরুবিবরা যতই বলুক, বাপদাদার পেশাটাকে ধরে রাখার কথা, কেউ পাত্তাই দেয় না। কেউ বালুমহালের লেবারি করে, কেউ বাসের হেলপারি, কেউ হোটেলের বয়, কেউ চালায় রিকশা, কেউবা ঠেলাগাড়ি। যে কজন গাবাল পূর্বপুরুষের পেশাটাকে ধরে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাল, তারাও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারল না। কমতে-কমতে তরুনাথের মতো আর মাত্র চার-পাঁচজন গাবাল এই পেশায় আছে এখন। তরুনাথও পেশা ছাড়তে চায়, কিন্তু পারে না। না পারার কারণ ওই এক মায়া। বাপের আমলের লাউয়ের খোলের বীণটার মায়া, বাঁশ-বেতের ঝুড়ি দুটির মায়া, পেলেপুষে রাখা সাপগুলোর মায়া। এত মায়ার ফাঁদে পড়ে পেশাটা ছাড়া হয় না তার। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে সাপগুলো বেচে দিয়ে, ঝুড়িগুলো লাকড়ি হিসেবে চুলায় পুড়িয়ে আলম মহাজনের কাছ থেকে একটা রিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতে। মহাজনের সঙ্গে একবার কথাও পাকাপাকি করে ফেলেছিল। ভাড়া বাবদ মহাজনকে দিতে হবে দিনে পঞ্চাশ টাকা। যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে মেরামতের টাকা তরুনাথের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারল না। ওই মায়া তার লুঙির কাছা ধরে টেনে ধরে রাখল।

কাঁঠালগাছতলায় দূর্বাঘাসের ওপর তরুনাথ কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল বুঝে উঠতে পারে না। কয়টা বাজে, তাও আন্দাজ করতে পারে না। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। খিদায় পেটের নাড়িভুঁড়ি উলটে বমি আসার জোগাড়। আশপাশে কোথাও দোকানপাট নেই। চিথলিয়া স্টেশন প্রায় এক মাইল দূরে। পকেটে দু-টাকার দুটি নোট আছে, স্টেশনে গিয়ে এককাপ চা আর একটা বনরুটি খেয়ে নেওয়ার কথা ভাবল। এই বেলা আর গ্রামফেরি করা হবে না। গতকালের মতো আজো খালি পকেটে ডেরায় ফিরতে হবে। অবুঝ ছেলেমেয়ের মায়ামাখা মুখগুলো তরুনাথের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তারা অপেক্ষায় আছে কখন ফিরবে সে। রাত ৮টা হোক কি ১০টা, সে ফেরার আগে চুলায় হাঁড়ি চড়ানো হয় না কোনোদিন। স্টেশনের মুদিদোকানদারও এখন আর বাকিতে সদাইপাতি দিতে চায় না। আগের আটশো টাকা বাকি পড়ে আছে, এখন বাকির কথা শুনলেই মা-বোন ধরে গালাগালি শুরু করে।

চিথলিয়া স্টেশনের চা-দোকান থেকে বেরিয়ে রেলরাস্তায় ওঠে তরুনাথ, স্লিপার গুনতে-গুনতে হাঁটতে থাকে। এক থেকে একশ পর্যন্ত গুনতে পারে, তারপর তালগোল পাকিয়ে বসে। আবার শুরু করে গোনা, আবার তালগোল। আসলে এর বেশি গুনতে পারে না নিরক্ষর তরুনাথ। হোক একশ পর্যন্ত, তবু ভালো। স্লিপার গুনতে গুনতে হাঁটলে পথের দূরত্বের কথা খেয়ালে থাকে না। খিদার কথাও না। ঘোরের মধ্যেই দীর্ঘ পথটা ফুরিয়ে আসে। দুটি টাকা থাকলে বাসভাড়া দিয়ে উপজেলা শহর পর্যন্ত যাওয়া যেত, চা-রুটি খাওয়ায় সেই উপায়ও নেই এখন। বাসে উঠে কন্ডাক্টরকে বলেকয়ে বিনাভাড়ায় যাওয়া যায়, কিন্তু বাসে তাকে উঠতে দিলে তো! সাপের ঝুড়ি দেখলেই কন্ডাক্টর হেই-হেই করে ওঠে। গাবালরা যে ভাড়া দেয় না, কন্ডাক্টর তা ভালো করেই জানে। কখনো ভাড়া দিলেও সহজে নিতে চায় না। সাপের ঝুড়ি দেখে অন্য যাত্রীরা নাক সিঁটকায়, কন্ডাক্টরের সঙ্গে চিল্লাফাল্লা করে।

সাঁঝ নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। চারদিকে ঘুটঘুটে আঁধার। আকাশের কোথাও চাঁদ নেই। কৃষ্ণপক্ষ চলছে হয়তো। নাকি অমাবস্যা কে জানে! চাঁদের হিসাব আগে রাখত তরুনাথ। অমাবস্যা-পূর্ণিমা এলে তার রোজগার বেড়ে যেত, তাবিজ-কবজ বেচাকেনার ধুম পড়ে যেত; সাপে-কাটা রোগীও কম আসত না। এখন আর সেদিন নেই। দিন এখন উপজেলা শহরের ডাক্তারদের। গোখরোয় কাটুক কি ধোড়ায়, রোগীকে নিয়ে লোকজন ছোটে ডাক্তারের কাছে।

মুহুরি নদীর ব্রিজ পার হয়ে ভাঁড়াটা একপাশে নামিয়ে রেখে স্লিপারের ওপর বসে পড়ল তরুনাথ। রেললাইনের একপাশে পায়েহাঁটার রাস্তা। হাটুরেরা সদাইপাতি নিয়ে বাড়ি ফিরছে। অন্ধকারে মানুষের আবছায়া দেখে কেউ কেউ গলাখাকারি দিয়ে প্রশ্ন করে – কে?

: আমি। জবাব দেয় তরুনাথ।

: আমি কে?

: তরুনাথ।

: কোন গ্রামের?

: আরে দাদা আমি তরু গাবাল।

: ও তাই কও। তা আন্ধারে বসে কী করো?

: জিরাচ্ছি দাদা। হাঁটতে-হাঁটতে হয়রান।

: জিরাও-জিরাও। মুহুরির গাঙের ঠান্ডা বাতাসে গা জুড়াও।

গা আসলে জুড়ায় না তরুনাথের। পেটে যে চিতার আগুন জ্বলছে! পেটের আগুন লকলকিয়ে মাথার দিকে ওঠে। মগজগুলো বলকাতে শুরু করে। তারপর আগুন আবার নামতে শুরু করে পায়ের দিকে। পায়ের তালু দিয়ে গরম ভাপ বেরোতে থাকে।

: কে?

: আমি তরু।

: কোন তরু?

: তরু গাবাল।

: ওরে ববাপ্! কয় টেকা কামাইলা আজ?

: এই আরকি দাদা…।

হাটুরেদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বিরক্তি লাগে তরুনাথের। বড় জ্বালাতন করে মানুষগুলো। খামোকাই এটা-সেটা প্রশ্ন করে। কেউ কেউ এমন খতরনাক, টর্চলাইটের আলো মুখের ওপর ধরে রাখে। রাখে তো রাখেই। তরুনাথ মুখ ঘুরিয়ে নিলেও আলোটা সরায় না। সে প্রতিবাদও করতে পারে না। পারত, যদি সে গাবাল না হতো। রিকশাওয়ালা-ঠেলাওয়ালা, কামার-কুমার, জেলে-মালো, মুচি-মেথরেরও প্রতিবাদের ভাষা আছে; কিন্তু গাবালদের নেই। থাকলেও প্রতিবাদ করার উপায় নেই। উলটাসিধা কথা বললে      দু-চারটা চড়-থাপ্পড় দিয়ে বসলে কী করার আছে তার? রাতের আঁধারে তাকে মেরে-কেটে মুহুরি গাঙে ভাসিয়ে দিলে কে আসবে প্রতিবাদ করতে?

ভাঁড়াটা কাঁধে তুলে নিল তরুনাথ, পেনসিল ব্যাটারির টর্চলাইটের মৃদু আলো ফেলে হাঁটা ধরল আবার। ভাঁড়াটা আগের চেয়ে দ্বিগুণ ভারী মনে হয়। কেউ যেন ঝুড়ির ভেতর রেললাইনের পাথর ভরে দিয়েছে। নইলে এত ভারী লাগছে কেন? রাগটা আবার চাগিয়ে ওঠে তরুনাথের। মুহুরির ব্রিজের ওপর থেকে ঝুড়ি দুটি ছুড়ে নিচে ফেলে দেওয়ার কথা ভেবেছিল একবার। পারেনি ওই মায়ার কারণে। সর্বনাশা মায়া তার দিলটাকে ভিজিয়ে দিয়েছে, মা মনসা এসে তার দুহাত আগলে ধরেছে। বড় সর্বনাশা এই মায়া। তার চেয়ে বেশি সর্বনাশিনী মনসা দেবী।

মনসার কথা মনে জাগলে দ্বিগুণ রাগ ওঠে তরুনাথের। কতদিন পূজা দেয় না। পূজা আসলে দিতে ইচ্ছে করে না তার। ভক্তের দুঃখে যার দিল ভেজে না, সে কিসের দেবী? কিসের পূজা দেবে তাকে? কিসের বিষহরি সে? সে তো বিনাশকারিণী। নইলে পিতা শিব আর স্বামী জগৎকারু কি তাকে প্রত্যাখ্যান করে? মা চন্ডী কি তাকে ঘৃণা করে?

হাঁটতে-হাঁটতে মঠের টিলার কাছাকাছি চলে আসে তরুনাথ। এখান থেকে গাবালপাড়া বেশিদূর নয়। টিলার উলটোদিকে গাবালদের গোরস্তান। তরুনাথের তিন পুরুষ শুয়ে আছে এখানে। মাটি সরালে বাপ আশুনাথের হাড়গোড় এখনো পাওয়া যাবে। হিন্দুদের মতো শ্মশানে পোড়ানো হয় না গাবালদের, মুসলমানের মতো কবর দেয়। ফারাক শুধু এটুকু, মুসলমানরা কবরে মড়াকে শুইয়ে দেয়, গাবালরা দেয় বসিয়ে। মাটিচাপা দেওয়ার আগে খড়ের বিড়ায় আগুন ধরিয়ে মড়ার মুখে খানিকটা মুখাগ্নি করে। ব্যস, এটুকুই।

রেলরাস্তা ছেড়ে গোরস্তানের দিকে হাঁটা ধরে তরুনাথ। হাঁটতে হাঁটতে বাপ আশুনাথের কবরের সামনে এসে দাঁড়ায়। সাপের ভাঁড়াটা আর বইতে পারছে না সে। আগের চেয়ে ভাঁড়াটা এখন চারগুণ ভারী মনে হচ্ছে। তিরিশ বছর ধরে এই ভাঁড়া বয়ে যাচ্ছে। কই, কোনোদিন তো এতটা ভারী মনে হয়নি! কে জানে কী হয়েছে আজ। সাপের সুরত ধরে মা মনসা ফাঁকফোকর গলিয়ে ঢুকে বসে আছে কিনা কে জানে!

থাক বসে মনসাদেবী। পরোয়া নেই তরুনাথের। টর্চের আলোয় পথের ধারে বাপের কবরটা ঠাওর করতে অসুবিধা হয় না তার। কবরের সিথানে বসে ঝুড়ি মোড়ানোর কাপড় দুটির গিঁট খোলে। কাপড় দুটি গলায় জড়িয়ে ঝুড়ির ঢাকনা খোলে। আলোর ছটায় ফণা তুলে ফোঁসফোঁস করে ওঠে বকখিলা আর মথিলা। অন্য সময় হলে তরুনাথ বলত – ‘সবুর সবুর বকখিলা, সবুর মথিলা’। কিন্তু এখন তার মুখে রা নেই। বকখিলা ও মথিলার চেয়ে বেশি ফুঁসছে সে। সাপ হলে সে এখন ফণা তুলে লেজের ওপর খাড়া থাকত। আর যাই হোক, এই সাপ নিয়ে আজ ডেরায় ফিরছে না সে। দরকার হলে উপোস থেকে মরবে, তবু না। তবু আর সাপ নিয়ে কারবার নয়।

কোনো একটা ভাঙা কবরে সাপগুলোসহ ঝুড়ি দুটি রেখে মাটিচাপা দিয়ে রাখার কথা ভাবে তরুনাথ। আসুনাথের কবরের পাশে একটা ভাঙা কবর আছে বটে। চাইলে ঝুড়ি দুটি কবরটার ভেতরে রেখে খড়কুটো লতাপাতা দিয়ে ঢেকে দিতে পারে। কিন্তু পারে না ওই এক মায়ার কারণে। সন্তানের মতো এতদিন পেলেপুষে রেখেছে সাপগুলোকে, এত সহজে কি তাদের ক্ষতি করা যায়!

বাঁহাতে টর্চ আর ডানহাতে বকখিলার লেজ ধরে ঝুড়ি থেকে টেনে বের করে আনে তরুনাথ। তাকে মাটিতে ছেড়ে দিয়ে মথিলাকেও বের করে আনে। ঢাকনা খুলে দেওয়ায় বাচ্চাগুলোও হিসহিস করতে করতে ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। বাধা দেয় না তরুনাথ। যাক চলে যেদিকে ইচ্ছা হয়।

আচমকা টর্চের আলোর দিকে মুখ করে বকখিলা ফোঁস করে ফণা তোলে। সোনালি আলো ঝিলিক মারে ভয়ংকর ফণায়। তরুনাথের ঠোঁটের কোনায় বিষণ্ণ হাসি। আলোটা সে উলটোদিকে ঘুরিয়ে ধরল। মৃদু অন্ধকারে খেয়াল করল, বকখিলা আর মথিলার পিছু-পিছু বাচ্চাগুলোও ধীরগতিতে আশুনাথের কবরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ঝুড়ি দুটি হাতে নিয়ে গোরস্তানের সরু পথ ধরে সামনে আগায় তরুনাথ। ওদিকে কবর নেই, ঘন জঙ্গল। একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসল তরুনাথ। বুকপকেট থেকে দেয়াশলাই বের করল। শুকনো পাতা জড়ো করে ঝুড়ি মোড়ানোর সাদা কাপড় দুটিতে আগুন ধরিয়ে দিলো। কাপড়ের আগুন ছড়িয়ে পড়ে শুকনো পাতায়। জ্বলন্ত আগুনের ওপর ঝুড়ি দুটি উপুড় করে রাখল তরুনাথ, ঝুড়ির ওপর রাখল বীণটাকেও। কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠল, শুকনো গোবরপোড়া গন্ধ ছড়াল চারদিকে। ধীরে-ধীরে আগুন গ্রাস করে নিল ঝুড়ি আর বীণটাকে।

জঙ্গলের পথ ছেড়ে রেলরাস্তায় উঠে আসে তরুনাথ। লুঙির কাছায় মুখের ঘাম মুছে নেয়। চোখের কোনায় জমে-ওঠা অশ্রুবিন্দুগুলোও বাদ যায় না। অন্ধকার আরো গাঢ় হতে থাকে। হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দেয় তরুনাথ। আলম মহাজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। রিকশা ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে এখনি কথা পাকাপাকি করা দরকার। পঞ্চাশে না দিক, ষাট টাকায় ভাড়া দিলেও তার আপত্তি নেই।