গোলাপ ও মোহনলাল

আহমেদ মুনির

মোহনলাল এই পাড়ায় থাকত। ১৭ বাই সি হলুদ চারতলা বিল্ডিংয়ের নিচতলায়। কিন্তু সে-ব্যাপারে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারে না। এখন সোবহান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কপাল কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করেন – ‘কোন মোহনলাল? পনেরো বছর ধরে এই বাড়িতে আমরাই থাকি। কই এমন নামে এখানে কেউ ছিল বলে শুনিনি তো।’

লিচুবাগানের গলিটা সরু হতে হতে ঠিক যেখানে গিয়ে রক্তনালির আকার ধারণ করেছে সেখানে মুখোমুখি দুটি বিল্ডিং। তারই একটা টিনের ঘেরা দেওয়া চারতলা হলুদ বাড়ি, হোল্ডিং নম্বর ১৭ বাই সি। সোবহান সাহেবের কথা ঠিক হলে সে-বাড়ির এক তলায় মোহনলাল হয়তো কোনো কালেই ছিল না। আর তার ছোট্ট এক রুমের বাসার বারান্দায় ফুলের টবও ছিল না। সে-টবটায় একটা টকটকে লাল গোলাপও কোনোদিন ফোটেনি। এ-বিষয়ে রেশমাকে প্রশ্ন করলে সে কোনো উত্তর দেয় না। বলে, জানি না। অথবা বলে, এসব জানার কী প্রয়োজন?

রেশমা বা তার স্বামী আজমলের এসব ফালতু বিষয় নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? আজমলকে ইপিজেডের বাস ধরতে ভোর পাঁচটায় উঠতে হয় ঘুম থেকে। তখনো রেশমা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাত আটটায় আজমল ঘরে আসার পর খুব কষ্ট করে ঘণ্টাখানেক জাগতে পারে। ভাতের দলাটুকু কোনোমতে গিলে এরপর সে আর দুনিয়ায় নেই। সাত বছর ধরে এ-ই চলছে। শুক্রবারও বিছানায় গড়িয়ে দিন কাটে তার। মাঝে কেবল একবার বাজারে যাওয়ার জন্য জাগতে হয়। সন্ধ্যায় পেপার হাতে নিয়েও ঢুলতে থাকে সে। রেশমা যথাসাধ্য এসব বিষয়ে আজমলকে সহযোগিতা করে। এমনকি সপ্তাহান্তে একবার শুতে হয় এতদিনেও প্রায় অচেনা রয়ে যাওয়া লোকটির সঙ্গে। সিটি করপোরেশনের শিক্ষা বিভাগের কাজের মতোই এটাকে রুটিন দায়িত্ব মনে করে সে। কেবল নজির এলেই এই রুটিনে ওলট-পালট ঘটে। নজির তার নাভির চারপাশে আঙুল বোলাতে বোলাতে প্রশ্ন করে, ‘আমাকে গোলাপ আনতে নিষেধ করো কেন? কখনো ফুল আনতে হলে রজনীগন্ধা নয়, গোলাপই আনব।’

রেশমা কঠোর গলায় বলে – ‘না, গোলাপ নয়। ফুল আনার দরকার কী?’ নজির নাছোড়বান্দা। ‘তবে কেন গোলাপ আনতে মানা সে-কথা শুনি?’ না, তাও বলবে না রেশমা। ১৭ বাই সি বাড়ির উল্টোদিকে সাদা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের নিচতলায় কোনো কোনো দুপুরে তবু নজির রেশমার নাভির চারপাশে আঙুল বুলিয়ে জানতে চায়, ‘কেন গোলাপ নয়?’

দুই

কোনো কোনো দিন দুপুরে স্কুল থেকে বাসায় না গিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নজির। কোথায় যায় কে জানে? বউকে বলে দেয়, ‘খেয়ে নিও মিটিং আছে।’ তারপর সারাদিন লাপাত্তা। বিষয়টা রেশমারও অজানা। ‘নজির, মাঝে মাঝে কোথায় যাও?’ রেশমার এই প্রশ্নের উত্তরে কেবল বলে, ‘যাই। এখানে-সেখানে যাই।’ সিটি করপোরেশনের স্কুলে চাকরির সুবাদে করপোরেশনের অফিসেই রেশমার সঙ্গে দেখা। নজিরের কনফারমেশন নিয়ে ঝামেলা হচ্ছিল। রেশমা দ্রুত কাজগুলো করে দিয়েছিল সেবার। এরপর মুঠোফোনে যোগাযোগ আর সখ্য গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। সময় যা নিয়েছে নজির। তার সব কাজেই এমন দ্বিধা। চোখ বড় করে সে রেশমার দিকে তাকিয়ে থাকত প্রথম প্রথম। রেশমার হাতটা টেবিলের ওপর তার স্পর্শের আওতায় জালে ধরা পড়া রুই মাছের মতো ছটফট করত। তবু কী করবে বুঝে উঠতে পারত না। সে বরং রেশমার কপালের সামনে এসে পড়া একগুচ্ছ চুলের দিকে তাকিয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিত। সেসব ঘটনা এখন পুরনো বইয়ের ওপর ধুলার মতো জমে আছে। নজিরের মনেও পড়ে না। এখন সে রেশমার নাভির চারপাশে আঙুল বোলাতে বোলাতে এটা-ওটা জানতে চায়। আর এ-কথা সে-কথার পর ঘুরেফিরে আসে গোলাপের প্রসঙ্গ। দুপুরটা গনগনে হয়ে ওঠে তখন আরো। রেশমার মনে হয় আঙুল নয়, তপ্ত লোহার দুটো শিক তার শরীরময় ঘুরছে। সে নজিরকে ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দেয় তখন। টিনের বেড়াকে ধাক্কা দিতে দিতে একটা একঘেয়ে ঘূর্ণিবাতাস গোঙানির মতো শব্দ করে বয়ে যায় জানালার পাশ দিয়ে। রেশমা কাপড় ঠিক করে বিছানা থেকে উঠে বসে। দৃঢ় গলায় বলে, ‘আজ আর ভালো লাগছে না। চলে যাও।’ নজিরও কোনো কথা না বলে চলে যায়। রেশমা বিদায় জানানোর প্রয়োজন বোধ করে না। অথবা সে-সুযোগ নজিরই দেয় না তাকে।

 

তিন

ইপিজেড থেকে সল্টগোলা ক্রসিং পার হওয়ার আগেই আজমল ঘুমিয়ে পড়ে। কখনো পাঁচটার গাড়িতে উঠতে পেরেছে বলে মনে পড়ে না তার। ছটার শিফটের লোকজনের সঙ্গেই বাসে উঠতে হয় তাকে। এই বাসের অধিকাংশ যাত্রী বিভিন্ন ফ্লোরের মেয়ে। অনেকের কাছেই সে সাক্ষাৎ শয়তান। ফ্লোর ইনচার্জদের এমন না হলে চাকরি টিকিয়ে রাখাই অসম্ভব। আজমলকেও তাই তেমনই হতে হয়েছে। প্রোডাকশন ঠিক সময়ে দেওয়ার জন্য যতটা কঠোর হতে হয় ততটাই হয়েছে, তার বেশি নয়। তবু মেয়েরা কেউ তার পাশে বসে না। এমনকি ফ্যাক্টরির জুনিয়র এক্সিকিউটিভরাও নয়। এটা ঊর্ধ্বতনের প্রতি সম্মানবোধ থেকে যে নয়, তা বুঝতে পারে সে। তবু এসব তার গা-সওয়া। সল্টগোলা ক্রসিং পর্যন্ত বাসটা লাশের গাড়ির মতো শব্দহীন থাকে। ক্রসিংটা পেরোনোর পর আজমল ঘুমিয়ে পড়লে ফিসফাস আর হাসির শব্দ বাড়তে থাকে। আধো ঘুমের মধ্যে আজমলও সেসব খুনসুটিতে যোগ দেয়। অবশ্য সবাই আজমলের নাক ডাকাটাই শুনতে পায়। একদিন কেবল এসবের ব্যতিক্রম ঘটে। সেটা বিবাহবার্ষিকীর দিন বলে নাকি তুমল বৃষ্টির কারণে, বুঝতে পারে না আজমল। সল্টগোলা ক্রসিং ফেলে বাস ফকিরহাট, বনানী কমপ্লেক্স মোড়ে চলে এলেও আজমলকে জেগে থাকতে দেখে অস্বস্তি হয় সবার। কিন্তু এসব খেয়াল করে না সে। জানালার ঝাপসা কাচের দিকে তাকিয়ে কেবল একগুচ্ছ গোলাপের কথাই ভাবে। কাজির দেউড়ি নেমে ভিজতে ভিজতে ফুলের দোকানে ঢুকে বাছাই করে গোলাপ কেনে। টকটকে লাল গোলাপের ওপর দোকানদার স্প্রে করে দেওয়ায় আরো তাজা দেখায়। প্রেমের ঘামের মতো বিন্দু বিন্দু পানির ফোটা জমে পাপড়ির ওপর। এরপর যেন পানির ফোঁটাগুলো ঝরে না পড়ে, তেমন সতর্কতা নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে সে। সেবারই প্রথম আজমলের গোলাপ নিয়ে যাওয়া। আর সেবারই শেষ। রেশমা কোনো কথা না বলে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল গোলাপগুলো। ‘ফুল আনতে কে বলছে? এসব আর আনবা না, এত রোমান্টিকতা আমার পছন্দ নয়।’ রেশমার এমন মুখঝামটা খেয়ে আবার আগের আজমল হয়ে ওঠে সে। আর আধো ঘুমের ভেতরে ভাত খেতে খেতে রেশমাকে প্রশ্ন করে সে, ‘কেন গোলাপ আনবো না, কেন?’ কিন্তু ফ্যাক্টরির মেয়েদের মতো রেশমাও আজমলের কথা শুনতে পায় না। ভাত গেলার বিদ্ঘুটে শব্দের নিচে প্রশ্নটা চাপাই পড়ে থাকে।

 

চার

লোকটা দেখতে খুব বিশ্রী। বিশ্রী মানুষকে অনায়াসেই মেনে নেওয়া যায়, তাদের সঙ্গে হরদম কাজ করাও সম্ভব। কিন্তু তেমন কোনো মানুষকে প্রেমের আকুতি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখার মতো দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! মোহনলালকে দেখে এমন বিপর্যস্ত অনুভূতি হতো রেশমার। ব্যাপারটা প্রথমদিকে খেয়াল করেনি সে। ঘরের চাবি হারানোর ঘটনার পর সে প্রথমবার ভালো করে দেখে মোহনলালকে। চাবি হারিয়ে ঘরে ঢুকতে পারছিল না অনেকক্ষণ। দুপুরবেলা পুরো পাড়াটা যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সদর দরজা আর গেট পর্যন্ত অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল। আজমলকে ফোন দিয়ে জানা গেল, তার কাছেও নেই। আশপাশের ফ্ল্যাটগুলোর দরজাও বন্ধ। তালা-চাবিওয়ালার খোঁজ দিতে পারে কে? আর তখনই  অপোজিট বিল্ডিংয়ের গেটের সামনে মোহনলালকে শুকনো পাতাহীন মান্দারগাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে। লম্বাটে গর্তে বসে যাওয়া মুখ, ময়লা গায়ের রং আর কোটরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া চোখগুলো একরকম ভরসাই দিয়েছিল। যা হোক এমন চেহারার একজন মানুষ উপকারের প্রতিদানের আশায় অন্তত কাছে ঘেঁষতে সাহস করবে না। ‘এখানে চাবিওয়ালা আছে কোথাও? চাবিটা হারিয়ে ফেলেছি, ঘরে ঢুকতে পারছি না।’ লোকটা হকচকিয়ে উঠে মান্দারগাছ থেকে জ্যান্ত মানুষে পরিণত হয়। ‘দেখছি’, বলেই গলি দিয়ে অদৃশ্য হয়। মিনিটদশেকের মধ্যেই চাবিওয়ালা হাজির। তালা খোলার পর রেশমা চাবিওয়ালাকে টাকা দিয়ে নতুন চাবি হাতে দ্রুত ঢুকে পড়ে ভেতরে। মোহনলালের কথা তার মনেই থাকে না। অথবা মনে থাকলেও সৌজন্য দেখানোর প্রয়োজন বোধ করে না। এর পরদিন থেকে প্রায়ই মোহনলালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখত সে। কখনো গলির মুখে, যেখানে রিকশা থেকে সে নামত সেখানে, কখনো ১৭ বাই সি বিল্ডিংয়ের গেটের সামনে। সে তাকালে লোকটা চোখ সরিয়ে নেওয়ার কথা। অন্তত এসব ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটতে দেখেছে সে। এ-ধরনের চেহারার লোকদের আত্মবিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও থাকে না। তাই মেয়েদের সামনে পড়লে নিজেদের আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। কিন্তু মোহনলাল সরাসরি তাকিয়ে থাকত। অন্য কোনো মেয়ে হলে জানতে চাইত, কিছু বলার আছে কি-না। কিন্তু রেশমা তাও করে না। সে লোকটার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন নয়, এটা বুঝিয়ে দিতে চায়। তাতেও তেমন ফল হয় না। অফিস থেকে বাসার পথে নানা জায়গায় সে মোহনলালকে দেখে। রেশমার গা গুলিয়ে উঠত। গোসলখানায় ঢুকে অনেকক্ষণ ধরে গায়ে সাবান ঘষত সে। ঘষে ঘষে তুলে ফেলতে চাইতো লোকটার কুৎসিত দৃষ্টি। এসব কথা রেশমা ভুলে যেতে চায়; কিন্তু নজিরের জন্য ভয় হয় তার। সে জানে, একদিন নজিরকেও কথাগুলো বলতে হবে। আর ভ্যাপসা গরমের দিনগুলোতে হাঁপিয়ে উঠতে উঠতে অপেক্ষা করে রেশমা।

 

পাঁচ

‘তোমার কী হইছে? খালি অন্যমনস্ক থাকো আজকাল।’ শিরিনের এ-প্রশ্নের উত্তর দেয় না নজির। শিরিনের চেয়ে সাইকেলের প্রতি বেশি মনোযোগ তার। বারান্দার এক কোণে রাখা সাইকেলটা মুছতে মুছতে ঠোঁটে ঝুলে থাকা সিগারেট থেকে ধোঁয়া ছাড়ে সে। স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো সাইকেলের প্যাডেল দুটো একবার সামনে আরেকবার পেছনে ঘোরায়। চেইনের ফাঁকে ফোঁটা-ফোঁটা গ্রিজ ঢালে। ব্রেকের তারগুলো পরখ করে দেখে ঠিক আছে কিনা। কাজটা সারতে পনেরো মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু নজির একই কাজ বারবার করতে থাকে। শিরিন আনাজ কলা আর তেলাপিয়া মাছ চুলায় তুলে দিয়ে এসে দেখে, তার স্বামী তখনো নিবিষ্টমনে একই কাজ করে যাচ্ছে। ভাতের পাতিল নামিয়ে মাড় গালতে দিয়ে আবারও বারান্দায় আসে সে। ‘কী হইছে বলো তো!’ শিরিনের গলা চড়তে থাকলেও বিকার নেই নজিরের। অনেকক্ষণ পর সে উঠে আসে। তারপর শান্ত গলায় বলে, ‘বদরপাতির মাজারে যাবা? সেখানে মানত করলে নাকি বাচ্চা হয়?’

শিরিন এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না। ‘বালের কথা বলো! ডাক্তার বলছে সমস্যা তোমার। তুমি চিকিৎসা করাবা না, মানত-ফানত করে নিজের দোষ ঢাকতে চাও!’

কথা আর এগোয় না। শিরিন সেলাই মেশিন নিয়ে বসে পড়ে। মেশিনের ঘড়-ঘড় শব্দের কারণে তার গজগজানি নজিরের কানে যায় না। শব্দটা তাকে একরকম আড়াল দেয়। আড়ালের ভেতর থেকে বেরও হতে চায় না সে। একমনে মেশিনের সুইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের পলকে কাপড়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করতে করতে এগিয়ে চলেছে সুইটা। যেমনটা বিছানায় করে সে। করতে হয়। রেশমা বা শিরিনের মধ্যে পার্থক্য কই। কাপড়ের শেষ প্রান্তে এসে দাঁত দিয়ে সুতা ছিঁড়ে ফেললে সুইটা বিশ্রাম পায়। আনন্দ, বিষাদ বা বিরক্তি নয়, নজিরেরও তেমন বিশ্রামেরই অনুভূতি হয়। দুটো কাপড় জোড়া দিয়ে পোশাকের চেহারা দেওয়ার মধ্যে যে নিছকই প্রয়োজনের ব্যাপার আছে, একটা কিছু শেষ হওয়ার ব্যাপার আছে, এটা অনেকটা সেরকম। নজির ঘড়-ঘড় শব্দের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ প্রশ্ন করে, ‘অর্ডার না থাকলেও সেলাই করতে বসো কেন?’ শিরিন ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয়, ‘অভ্যাস হয়ে গেছে।’

 

ছয়

‘আমি পোর্ট হাসপাতালের সাবেক রেডিওলজিস্ট সোবহান চৌধুরী। এখানে পনেরো বছর ধরে থাকি। রিটায়ারমেন্টের পর থেকেই। কীসব বাজে কথা বলতেছেন?’ রেশমার সব তালগোল পাকিয়ে যায়। লোকটা পর্দা টেনে ধরলেও ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সাজানো-গোছানো বসার ঘর, দেয়ালে নজরুলের চাদরপরা ফটোগ্রাফ ঝুলছে। স্ত্রী বা মেয়ে হয়তো নজরুলগীতি গায়। রেশমা অনুমান করার চেষ্টা করে।

‘আসলে আমি গত বেশ কয়েকমাস ধরে লোকটাকে এ-ঘর থেকে বের হতে দেখেছি। একটা ফুলের টবও ছিল। ভেবেছি, নিচের ঘরগুলো ব্যাচেলর রুম।’ রেশমা এদিক-সেদিক তাকায়। না টবের কোনো চিহ্ন নেই কোথাও। টাকমাথায় বারকয়েক হাত চালিয়ে সোবহান সাহেব জোরে জোরে মাথা নাড়েন। ‘এটা ফ্যামিলি কোয়ার্টার। তাছাড়া কোনো হিন্দু এ-বাড়িতে ছিল না কখনো। আমি সব ফ্ল্যাটের ভাড়াটেদের চিনি। বাড়িওয়ালা হিন্দুদের ভাড়াও দেন না।’

মোহনলালকে অনেকদিন গলিতে, রাস্তায় কোথাও না দেখে খোঁজ নিতে এসেছিল রেশমা। আর সে নিশ্চিত, অন্তত মাসখানেক আগেও লোকটা এখানেই থাকত। সে নিজেও একবার এসেছিল। টিনের গেট পার হলে আঙিনার বাঁপাশেই মোহনলালের ঘর। সিঁড়ি ঘরের ঠিক পাশে। অথচ এখন সিঁড়িটা যেন আরো দু-তিন ঘর পিছিয়েছে। তার আগে বড় বড় দুটি ঘর। একেবারে কোনার ঘরের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন সোবহান সাহেব। নীল পর্দাটা ধরে যেন ভারসাম্য রক্ষা করছেন। রেশমা শেষ চেষ্টা করে। ‘এখানে দারোয়ান নেই?’ সোবহান সাহেব আবারও ভ্রু কুঁচকান। ‘এ-পাড়ার কোনো বাড়িতে দারোয়ান আছে বলে শুনিনি। আর আপনারও তো জানার কথা। পাঁচ বছর ধরে এখানে আছেন।’ এবার নীল পর্দাটা সামান্য সরে যায়। বয়স্ক একজন মহিলা সোবহান সাহেবের কাঁধের পাশ দিয়ে উঁকি দেন। ‘ভেতরে আসেন না!’ সরু গলাটা শুনে রেশমা আন্দাজ করার চেষ্টা করে, ইনিই নজরুলগীতি করেন কিনা! রেশমা মাথা নাড়ে, ‘না। আরেকদিন আসব।’ এভাবেই মোহনলাল-সংক্রান্ত কৌতূহলের ইতি ঘটে তার। আসলে কী মনে করে লোকটার খোঁজ নিতে গিয়েছিল সে নিজেই বুঝতে পারে না। আর লোকটাকে যদি সত্যিই সেখানে সেদিন পেয়ে যেত, তবে এরপর যা যা ঘটতে পারত তাও ভাবতে থাকে সে। তার অনুতাপ হচ্ছে বুঝতে পেরে মোহনলাল দ্বিগুণ উৎসাহে অপেক্ষা করত। কখনো কোনো রাস্তায় আসা-যাওয়ার পথে দেখা হতোই। অন্তত এই অস্বস্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে রেশমার নির্ভার লাগে। তবু এসব তো বহু পুরনো কথা, যা রেশমা কাউকে বলতে চায় না। কিন্তু সে জানে, নজিরকে একদিন এসব বলতেই হবে। সেজন্য ভ্যাপসা গরমের দুপুরে সে অপেক্ষা করে থাকে।

 

সাত

আজমল মদ, সিগারেট, চা কিছু খায় না। এমন নিরাসক্ত মানুষটা হঠাৎ হঠাৎ ঘুমের ভেতরে জেগে ওঠে প্রবল আসক্তি নিয়ে। রেশমা ফিরিয়ে দিলে শিশুর মতো হয়ে ওঠে সে। ‘প্লিজ, আমি পারছি না।’ রেশমা বারবার ফিরিয়ে দিলেও একই কথা বলে লোকটা। সে আশ্চর্য হয়। লোকটা ভিখিরির মতো শরীর চায়। আর রেশমা হতভম্ব হয়ে এসব দেখতে থাকে এবং লোকটার মধ্যে আত্মসম্মানের ছিটেফোঁটাও খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। ঝুঁকে আসা শরীরটা সরিয়ে দিয়ে বলে, ‘অন্য মেয়ে মানুষের কাছে যাও না কেন? আমি তো যাই অন্য লোকের কাছে। কিন্তু এভাবে কারো হাতেপায়ে ধরি না।’ তবু আজমল আসে। বলে, ‘প্লিজ, তুমি যাই করো তাতে কিছু যায় আসে না। আমি পারছি না।’

আজমল আসলেই পারে না। আর সব হয়ে গেলে, পাশ ফিরে শুয়ে মুহূর্তের মধ্যে নাকডাকা শুরু করে। নিজেকে সাফ-সুতরো করে নেওয়ার অবকাশও পায় না। সকালে আজমলের চেহারা দেখে রেশমা বুঝতেই পারে না, লোকটা আদৌ রাতের কথা মনে রেখেছে কি-না। এসবই হয়তো সে ঘুমের ঘোরে, আধো জাগ্রত অবস্থায় করে। নয়তো কতবার ঘুমের ভেতরে ফুঁপিয়ে উঠতে দেখেছে সে আজমলকে। বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে আবার থেমে গিয়ে নাক ডাকে। লোকটার জন্য মায়াই হয় রেশমার।

কিন্তু নজির এর উল্টো। বরং ইদানীং নজিরকে প্রোভক করলেও সাড়া পায় না সে। কী যেন ভাবে সারাক্ষণ। দাঁত দিয়ে নখ খুঁটে, নয়তো সিগারেট টানতে থাকে একটার পর একটা। আজ হয়তো তাকে বলতেই হবে। কারণ অন্যরাও ঠিক এমনই করেছে। খাটে শুয়ে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে-খুঁটতে প্রশ্ন  করেছে, ‘কেন গোলাপ আনব না বলো?’ নজিরও সে-দশায় এসে উপস্থিত হয়েছে। তবু রেশমা অন্যদের যেভাবে, নজিরকেও সেভাবে সাবধান করেছে। ‘এটা আমি কখনোই বলব না। তোমার শোনা উচিত হবে না।’ সে সাবধানবাণী অন্যদের কানে যেমন পৌঁছায়নি, নজিরের কানেও পৌঁছাবে না, সেটা সে জানে। আর বিছানার বিষয় না হলেও জবরদস্তি তো এখানেও আছে। নিজেকে খুলে ধরতে গেলে রেশমার একই রকম অনুভূতি হয়।

নজির আজ আর অন্যদিনের মতো জানতে চায় না। কেবল পা নাড়ায়। একবার ডান পা-কে বাঁ পায়ের ওপর, আরেকবার বাঁ পা-কে ডান পায়ের ওপর তুলে দোলাতে থাকে। রেশমার অসহ্য লাগে। না বললে এই পা বদলের ঘটনা সারাদিনই দেখতে হবে। রেশমা তাই নিজ থেকেই বলতে শুরু করে। ‘মোহনলালের মতো কুৎসিত মানুষ দুনিয়ায় একটাও নাই। এমন একটা লোক প্রেম নিবেদন করলে কেমন লাগে বলো? আরও নীরব প্রেম নিবেদন।’

‘লোকটা অ্যান্ট্রেন্স পাইলো কেমনে?’ নজির সিগ্রেট ধরায়। মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। ‘আজমলের কারণে। চাবির ঘটনা তাকে বলার পর সে নিজ উদ্যোগে মোহনলালের সঙ্গে পরিচিত হয়। গলিতে বৃষ্টি হলেই পানি ওঠে। রাস্তা পর্যন্ত গোড়ালিসমান পানি। পানি জমলে আমার প্রায়ই শাড়ি ভিজে যেত। একদিন দেখি বাসার গেট থেকে রাস্তা পর্যন্ত ইট-বিছানো। প্রথমে বুঝি নাই। ভেবেছি বাড়িওয়ালার কাজ। এরপর একদিন লোকটা ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে হাজির। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে, আজমল সাহেব টাকা দিয়ে গেছেন। বাজার করে দিতে বললেন।’ রেশমা দম নেয় একটু। পাশে শুয়ে থাকা নজিরের মুখটা পড়ার চেষ্টা করে। তার গায়ের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে গলা নামিয়ে বলে, ‘আমি তখন বুঝলাম আজমল ওরে ইউজ করা শুরু করেছে। এ নিয়ে বহু ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু মোহনলালের কী দোষ? সে তো ইউজ হওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। অথচ একদিনও মুখের দিকে তাকাইনি। কীভাবে তাকাব! ভীষণ বিশ্রী লোকটা।’

নজির হাঁটু দুটো ‘দ’ বানিয়ে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। রেশমার পা তার আলিঙ্গন থেকে খসে পড়ে। অথবা সে নিজেই খসিয়ে দেয়। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, ‘ইউজ করস ক্ষতি কী? আর চেহারা খারাপ বলেই ওর সঙ্গে শুতে ইচ্ছা হয় নাই?’ রেশমা কোনো উত্তর দেয় না। নজিরের দিক থেকে কঠিন আঘাত আসবে সে জানত। তবু নিজেকে সামলাতে পারে না। চোখ মুছে যোগাসনের ভঙ্গিতে বসে সে। বড় করে নিশ্বাস নিয়ে ধাতস্থ হতে চায়। গুমোট গরমের ভেতরে মাথার ওপর ঘুরতে-থাকা সিলিং ফ্যানের বাতাসে মোহনলালের গায়ের গন্ধের মতো একটা ঘ্রাণ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। গন্ধটা নাকে লাগে রেশমার। আশ্চর্য! মোহনলালের এই একটা বিষয় কেবল সহনীয় ছিল। যতবার তার কাছাকাছি হয়েছে মৃদু একটা গোলাপের গন্ধ টের পেয়েছে সে। লোকটা কী গোলাপজল মাখত, নাকি আতর? না, সেসবের গন্ধ তো এত জীবন্ত নয়। এটা কি গোলাপগাছটার জন্য? এ-রহস্য সে কোনোদিন ভেদ করতে পারবে না। রেশমার তখন মনে পড়ে যায় গোলাপগাছটার কথা। একদিন কৌতূহলী হয়ে গেট দিয়ে উঁকি দিয়েছিল। টবের গোলাপগাছে পানি দিচ্ছিল মোহনলাল। তখন রেশমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এসেছিল কথাগুলো। ‘এতবড় গোলাপ কখনো দেখি নাই।’ গলার স্বর ফ্যাসফ্যাসে হলেও মোহনলাল কথা বললে আশপাশের আর সবকিছু যেন থেমে যায়। শুনতে খারাপ লাগে না। মোহনলাল বলে, ‘এটা আমি লাগাই নাই। এখানে একটা খালি টব ছিল। আপনাকে যেদিন প্রথম দেখলাম সেদিন দেখি একটা চারা। আর যতদিন আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে, একটা করে পাতা গজাতে দেখছি। কিছুদিন আগে ফুল এসেছে।’ রেশমার মনে হয়েছে পুরোটাই বানানো। কিন্তু শুনে কেমন শিহরণ জেগেছিল। যতদিন তাকে দেখেছে, ততদিন একটা করে পাতা গজিয়েছে। তাহলে এই গোলাপ! সেটা কেন, কী প্রক্রিয়ায় গজাল? রেশমা কোনো কথা না বলে ফিরে এসেছিল সেদিন। পরদিন আজমল অফিস যাওয়ার পর ভোরে হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ। ঘুমচোখে দরজা খুলতেই দেখে মোহনলাল। সরাসরি তাকিয়ে তার দিকে। ডান হাতে ধরা গোলাপটা এগিয়ে দেয়। রেশমা হতভম্ব। প্রশ্রয় পেয়ে এতদূর এগিয়েছে! কোনো দ্বিধা, সংকোচ নেই আচরণে, চোখে-মুখে। বিহবল ভাবটা কাটিয়ে মুখের ওপর দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল সে।

 

আট

‘দরজা বন্ধ করে দিলা কেন? লোকটা তো অন্যায় কিছু করে নাই!’ গোলাপের গন্ধটা অন্তর্নিহিত। নজির একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে চলেছে। ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে রেশমার। ‘দরজা বন্ধ করছি কেন আসলে জানি না। এরপর দরজায় পিঠ লাগিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম খেয়াল ছিল না। কেন নিই নাই? নিলে ভালো হতো না খারাপ হতো, এসব মনে আসে নাই। খালি মনে হয়েছে, আমি দরজাটা এইভাবে বন্ধ করে দিলাম!’

‘তারপর?’ নজির শুধায়। সিগারেটের জন্য প্যাকেটটা বের করে দেখে আর নেই একটাও। ‘বস সিগ্রেট নিয়ে আসি।’ নজির বেরিয়ে গেলে রেশমা একটু অবসর পায়। হঠাৎ আশঙ্কা জাগে, নজির আর ফিরবে না। প্রতিবার তো এমন হয়েছে। সবাই এভাবেই চলে গেছে। গল্পটা শেষ হওয়ার জন্যই যেন অপেক্ষা করে ওরা। কিন্তু নজির ফিরল। খাটে আধশোয়া অবস্থায় ছাদের দিকে মুখ করে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে সে। অনেকক্ষণ পর যেন বহুদূর থেকে তার গলা শোনা যায়। ‘মোহনলাল কোথায় এখন?’

‘জানি না। তিন বছর আগের ঘটনা এটা। এরপর আর কোথাও তাকে দেখি নাই। কিন্তু কেন যেন মনে হয় একদিন কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যাবে। আর আমার খুব ভয় লাগে এটা ভেবে।’

‘তার বাসায় কে থাকে এখন?’ নজির এবার আর সিগারেট ধরায় না। বরং প্যাকেটটা দুই আঙুলে ধরে ঘুরাতে থাকে। ‘ওই ঘটনার কয়েকদিন পর মোহনলালের বাসায় গিয়ে দেখি সব অচেনা লাগছে। ওই রুমটাই নাই। টানা বারান্দার ওপর টবটাও নাই।    সে-জায়গায় বড় দুই রুমের একটা ফ্যামিলি কোয়ার্টার। সোবহান চৌধুরী নামের এক লোক নাকি সেখানে পনেরো বছর ধরে থাকে।’ রেশমা কথা শেষ করে মুখ ঘুরিয়ে দেখে ঘরে কেউ নেই। নজির কখন নিঃশ্বব্দে চলে গেছে কখন।

 

নয়

রেশমা জানে, নজির আর আসবে না। কিন্তু নজির সেটা জানে না। নজির জানে না যে, সে চাইলেও আর রেশমার কাছে যেতে পারবে না। আর রেশমা যে তাকে সাবধান করেছিল, সেটাও তার মনে পড়ে না। মাঝে একবার রেশমা তার স্কুলে গিয়েছিল। ছুটির পর সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে হাঁটছিল নজির, পাশে রেশমা।

‘তোমাদের বাচ্চা নেই কেন?’ নজির হঠাৎ প্রশ্ন করে। আশ্চর্য! নজির গত দেড় বছরে একবারের জন্যও এ-কথা জানতে চায়নি। আজ হঠাৎ এই কৌতূহলের কারণ বুঝতে পারে না সে।

‘আমি নিই না। মানে এখন কীভাবে সামলাব।’ রেশমার এই কথা যেন কানে পৌঁছায় না তার। ‘বদরপাতির মাজারে গেলে পারো। সেখানে মানত করলে নাকি বাচ্চা হয়।’ নজিরের এই কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না সে। কেন এসব বলছে সেটা জানবার ফুরসতও মেলে না। নজির তার আগেই সাইকেলে উঠে প্যাডেল চালিয়ে দেয়। রেশমা জানত এমনটাই হবে। নজির আর আসবে না। সবার বেলায় তাই ঘটেছে। আর নজির তো সেটা জানে না। বরং রেশমার কাছে যাওয়ার কথা মনেই থাকে না তার। তার নাভির চারপাশে আঙুল বুলিয়ে দুপুরটা কাটিয়ে বিকেল করে বাসায় ফেরার কথাও মাথায় আসে না। সে বরং বকশীরহাট, জেলরোড ধরে একটানা সাইকেল চালিয়ে বদরপাতির মাজারের সামনে একটু দাঁড়ায়। তারপর আবার পেছনদিকে ঘুরে সারসার আতরের দোকান আর আমানতশাহের মাজার ফেলে এগিয়ে যায়। মাঝে হঠাৎ একটা সরু গলিতে ঢুকে এদিক-সেদিক দেখতে দেখতে এগোয়। দেয়ালে ফাটলধরা, বটের চারা-গজানো ফিরিঙ্গিদের আমলের তৈরি কোনো দালানের পাশে তার সাইকেলের গতি কমে যায়। একটা পানদোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা মোহনলাল নামে কেউ কি থাকে এই গলিতে?’

দোকানদার পান বানাতে বানাতে বলে, ‘মোহনলাল কী? আগেপিছে কিছু নাই?’ নজিরের হঠাৎ খেয়াল হয়, এটা জানা হয়নি। তবু সে চট করে বলে, ‘মোহনলাল সরকার।’ দোকানদার মাথা নাড়ে, ‘চিনি না। থাকলেও থাকতে পারে। আপনে পাশের ফ্ল্যাটগুলাতে গিয়া খোঁজ নেন।’

নজির উৎসাহ পায় না। আসলে সে এমনিই কথাটা জানতে চাইছিল। জেলরোড পার হয়ে লালদিঘি, সেখান থেকে নিউমার্কেট, টাইগারপাস হয়ে নজির পাহাড়তলীর দিকে চলে যায়।

 

দশ

নজির সাইকেল নিয়ে কেন শহরময় ঘোরে এটা শিরিনের কাছে একটা রহস্যই বটে। তবে শিরিন জানে না, এখন তার ঘোরাঘুরির একটা উদ্দেশ্য আছে। এখন সে শহরের আনাচে-কানাচে ঢুঁ মারে আর লোকজনকে প্রশ্ন করে, মোহনলাল নামে কেউ এ-পাড়ায় থাকে কি-না। কতরকম মোহনলালের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে এরই মধ্যে। কারো পেট মোটা, কেউবা চিমসে, কারো দাঁত উঁচু। তবে কাউকেই মনে ধরেনি তার। আর মনে ধরলেই বা কী? মোহনলালকে খুঁজে পেলে কী বলত সে? সে কেবল খোঁজার জন্যই খোঁজে। আর এভাবে খুঁজতে খুঁজতে রাত হয়ে যায়। আজকাল প্রায়ই গভীর রাতে বাড়ি ফেরে সে।

‘কী ব্যাপার, সারাদিন কোথায় থাকো?’ বরাবরের মতো শিরিনের এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না নজির। বাড়িতে ঢুকে বারান্দায় সাইকেল রেখে শুয়ে পড়ে সে। প্রায়ই খাবার মুখে তোলে না। কিছুদিন আগে বারান্দার খালি একটা টবে গোলাপের চারা আবিষ্কার করে সে। ‘তুমি লাগিয়েছ?’ শিরিনকে এ-প্রশ্ন করে জানা গেল, কেউ লাগায়নি, গাছটা আপনা-আপনিই গজিয়েছে। এরপর ঘরে ফিরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোলাপগাছ নিয়ে সময় কাটাতে শুরু করে সে। যতদিন সে মোহনলালের খোঁজে বেরিয়েছে, ততদিন ফিরে এসে একটা নতুন পাতা দেখেছে। গাছটাও বেড়েছে তড়তড় করে। নজির খুব একটা অবাক হয় না। সে ভাবে, মোহনলাল তবে মিথ্যা বলেনি! গোলাপগাছ তাহলে এভাবেই গজায়। একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নজির এও আবিষ্কার করে, মোহনলালকে আর এখানে-সেখানে খোঁজ করার প্রয়োজন নেই। ভাঙা গাল, উসকো-খুসকো চেহারা, কোটরে বসে যাওয়া চোখ নিয়ে লোকটা তার সামনেই দাঁড়িয়ে। গোলাপের মতো মোহনলালেরও কীভাবে জন্ম হয় এটাও আবিষ্কার করে সে। কিন্তু শিরিন বুঝতে পারে না, নজির কেন দিন দিন এমন উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। লোকটা যেন নিজের মধ্যেই নেই। খেতে বসে বিড়বিড় করে। ভাত ছিটায় প্লেটের আশেপাশে। কিন্তু খায় না তেমন। শিরিন নিরুপায় হয়ে সেলাই মেশিন চালায়। সেলাই মেশিনের ঘড়ঘড় শব্দের মধ্যে তখন পরিপার্শ্ব বিলুপ্ত হতে থাকে।

চার মাস পর রেশমাও অন্য সবার মতো নজিরের কথা ভুলে যায়। প্রায় রাতে আজমলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার সময়ও মনে পড়ে না নজিরের কথা। আর সে যখন বলে, ‘অন্য মেয়ে মানুষের কাছে যাও না কেন, আমি তো যাই অন্য লোকের কাছে।’ তখনো সেই অন্য লোকটিকে মনে পড়ে না তার। করপোরেশন থেকে বাসায় ফেরার সময় একমনে হাঁটে। ব্যাগ খুলে মোবাইলের কললিস্ট চেক করে না। নজিরের মিসডকল আছে কি-না দেখে না। তখন তার একটা কথাই মনে হয়, এ-গল্পটা তার জীবনে না থাকলেই ভালো হতো। তবু এটা আজমলের হাতের মতো। বারবার ফিরে আসে। আর এই জবরদস্তি কতদিন চলতে থাকবে এটা ভাবতে ভাবতে ঘুমায় সে। সেরকমই এক সকালে রেশমার ঘুম ভেঙে যায় কড়া নাড়ার শব্দে। আজমল অফিসে গেছে কখন সে বলতে পারে না। ঘুমচোখে উঠে দরজা খোলে। তাহলে সে যা ভেবেছিল সেটাই সত্যি! মোহনলালের সঙ্গে আবার দেখা হবে এই আশঙ্কায় কোনো ভুল ছিল না?

সেই ভাঙা গাল, কালো রুক্ষ চেহারা। কোটরে বসে যাওয়া চোখ, এলোমেলো চুল আর একটা মৃদু গোলাপের গন্ধ। রেশমা স্তব্ধ হয়ে দেখে। লোকটার পিঠের দিক থেকে এসে পড়া আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল তার। সে হাত দিয়ে চোখ ঢাকে।

হাতের আড়ালের কারণে লোকটা ঢাকা পড়ে যায়। সে কিছু বলতে চায় কি-না সেটাও খেয়াল করে না রেশমা। তবু সে যেটা করতে চায়নি অথবা কেন করেছে জানে না, সে-কাজটাই করে। দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।

‘আমি কেবল একটা গোলাপ দিতে চেয়েছিলাম।’ দরজার ওপাশ থেকে বলা কথাগুলো রেশমার কানে পৌঁছায় কি-না বোঝা যায় না।

আর নজির এভাবে দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতে দেখে বুঝতে পারে মোহনলালের গল্পটা সত্যি ছিল। আর রেশমার দরজাও এভাবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ-পাড়ায় মোহনলাল নামে একজন থাকত  কি-না সেটা আর তার কাছে গুরুত্ব বহন করে না। সে কেবল রেশমার দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই দেখে। কদিন আগেই গোলাপটা ফুটেছিল টবে। আর আজ ভোরে অনেকটা যেন ঘুমের ঘোরেই সাইকেল নিয়ে চলে এসেছিল রেশমার কাছে। নজির গোলাপটা রেশমার বন্ধ দরজার কাছে রেখে সাইকেলে চড়ে বসে। তারপর রক্তনালির মতো সরু রাস্তা ধরে অদৃশ্য হয়।

আর রেশমা বন্ধ দরজার অপর পাশে পিঠ ঠেকিয়ে বিলাপের মতো বিড়বিড় করতে থাকে আপনমনে – ‘হায়, দরজাটা আমি বন্ধ করে দিলাম!’ অথচ রেশমা তো জানত, এমনটাই ঘটবে। প্রতিবারই সে দরজা বন্ধ করে দেবে, আর পরে খোঁজ করতে গিয়ে জানবে মোহনলাল নামে কখনোই কেউ এ-পাড়ায় থাকত না।