গ্রন্থটি নিরাপদ দূরত্বে রাখুন

গ্যাব্রিয়েল সুমন
ঘামসূত্র

টোকন ঠাকুর

গদ্যপদ্য
ঢাকা, ২০১২

১২০ টাকা

২০১২-এর বইমেলায় ঘামসূত্র বেরিয়ে গেল। বের হয়েই গেল, ঠেকানো গেল না। আমরাও কিনে বাড়িতে নিয়ে এসে পড়ে ফেললাম। ঘামসূত্র টোকন ঠাকুরের সর্বশেষ প্রকাশিত কবিতার বই, বের হয়েছে গদ্যপদ্য থেকে। ঘামসূত্র পাঠের অভিজ্ঞতা অন্য যে-কোনো কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতার চেয়ে একটু অন্যরকম। এই কবিতাগুলো টোকন ঠাকুরের কবিতার মতো যতটা, ঠিক টোকন ঠাকুরের মতোও ততোটা। ‘কবিতার পাঠ সবসময়ই কম। কে জানে, এতেই কবিতার মঙ্গল! তারপরও কারো কারো কবিতা পাঠককেই ডাক দেয়, টান দেয়, পাঠিকাকে শিস দেয়। টোকন ঠাকুরের কবিতাও ডাক পাড়ে, টান মারে, শিস দেয়। কারণ, টোকন ঠাকুরের কবিতায় লুক্কায়িত মায়ালাবণ্যের ধুধু কিংবা রসব্যঞ্জনার মধু একান্তই টোকনের নিজস্ব। সেই ধুধু, সেই মধু মনোযোগ দিয়ে কবিতাগুলো পাঠ করলেই আস্বাদিত হবে।’ ফ্ল্যাপে লেখা এই কথাগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই পড়তে গিয়েই।
৩২
পৃষ্ঠায়
খড়
৩৩
পৃষ্ঠায়
আগুন!
পুরো সম্পর্ক পুড়ে ছাই হয়ে যাবে
গ্রন্থটি নিরাপদ দূরত্বে রাখুন।
(কাব্যগ্রন্থ, পৃ ৫৬)

এ-মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতে নিজের ভেতর কৌতূহল হয় ৩২ আর ৩৩ পৃষ্ঠায় কী আছে? ৩২ পৃষ্ঠার খোঁজ নিতে যাই। সেখানে দেখি অদ্ভুত এক জট তৈরি হয়ে আছে। যেখানে আমি পাঠক দরজায় কড়া না নেড়েই ঢুকে পড়েছি। সেখানে দেখি ‘ভাষার সমস্যা’। ভাষায় জোছনা দেখানো যাচ্ছে না, সূর্যাস্ত দেখানো যাচ্ছে না, যুদ্ধ দেখানো যাচ্ছে না, রক্তের লালরং দেখানো যাচ্ছে না এবং দেখানো যাচ্ছে না বাতাসের বেয়াদব আচরণ। অথচ টোকন ঠাকুর এখানে মনোগমনের এক রহস্যময় অদ্ভুত ও অ্যাবসার্ড এক ভাষা ঠিকই তৈরি করে ফেলেছেন। ঠিক ঠিক স্পর্শ করা যায় প্রচ্ছন্ন দূরত্বের গল্প আর লৌহবেদনার ইতিকথা। এ গেল ৩২ পৃষ্ঠার ভাষাবিভ্রাট, ৩৩ পৃষ্ঠায় গিয়ে দেখি হাওয়ার প্ররোচনার ভাবনা সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে, সম্ভবত ঘ্রাণের একধরনের ভূমিকা থেকে যায় এই সরাসরি সম্প্রচারে। এখানে এক দিগ্ বালিকার সন্ধান পাই যে বড় হয় ঘরের ভেতর, ঘোরের ভেতর, পাতাবিহীন এক জনপদে। এই বেড়ে ওঠা শিহরণ শব্দের মানে বোঝার জন্য…

শিহরণ, তোর কথা কীভাবে লিখব আমি?
(‘উত্তরের হাওয়া’, পৃ ৩৩)

মূলত শিহরিত হতে হতেই ঘামসূত্র ধরে এগিয়ে যাই। বাক্য, শব্দ আর যতিচিহ্নরা মুগ্ধ করে ফেলে। অজস্র অসংখ্য লাইন ভালো লেগে যায়। কখনো কখনো কোনো কারণ ছাড়াই। যদিও এটা জানি যে, ভলোলাগা নিজেই একটা কারণ সুতরাং কখনো কখনো ভালোলাগার কোনো কারণ থাকে না।

চুপচাপ শব্দটি লিখে বসে আছি
দূরে কোথাও শব্দ হচ্ছে
দুপুর লিখে দেখলাম, ছায়া পায়ের নিচে চাপা খাচ্ছে
দুপুর লিখে আরো দেখলাম, ঘুঘু ডাকছে, বুকের মধ্যে
নির্জন নিজেই গাইছে এক খাঁ খাঁ ফাঁকা গল্পআঁকা চরিত্র ও
সময়ের গান
(গোয়েন্দা রিপোর্ট, পৃ ৫৮)

এই চুপ থাকার অনেক রকম মানে থাকে। এই দুপুরও সাধারণ কোনো দুপুর না। এই নিমগ্নতার ভেতর খুব সহজেই নিয়ে যাওয়ার মতো ক্ষমতাধর লাইন। এই ক্ষমতা সম্ভবত দীর্ঘ সাধনায় তৈরি হয়। সহজাতভাবেই মুগ্ধতা তৈরির ক্ষমতা টোকন ঠাকুর প্রকৃতিগতভাবেই ধারণ করেন। ‘জাদুকর’ কবিতায় তিনি সোজা হাত ধরে একটা ঘোরের জগতে নিয়ে যান পাঠককে। ঘোররাজ্যে নিয়ে গিয়েই সন্তুষ্ট নন তিনি; ঘোররাজ্যের সদর দরজা বন্ধ করে দেন। খুব সহজে বের হওয়ার আর উপায় থাকে না।

হতে পারে কিশোর ছিলাম –
তারও আগে নাছোড় ছিলাম;

হতে পারে বালক ছিলাম
হতে পারে আলপথে খসে যাওয়া কিশোরীর নূপুর, ঘুঙুর
ছিলাম মধুপুরের আমবাগানের ভৌতিক দুপুর…
হতে পারে পারে পাখি বা পালক ছিলাম
হঠাৎ খেয়াল করি, আমার কল্পিত ডানায় রোদ-বৃষ্টি-
ধুলোরাই
ভুল করে ৪১ না লিখে লিখে দিচ্ছে ১৪ বছর…

আমার বয়স আমাকে পাহারা দিয়ে
আমাকে গার্ড অব অনার দিয়ে
আমাকেই অন্ধ করে নিয়ে যাচ্ছে জাদুকর
জাদুকরের নাম ঘোর
(জাদুকর, পৃ ৭৯)

বস্তুত যেটা দাঁড়াতে চাচ্ছে – ঘামসূত্র অসংখ্য সুখপাঠ্য কবিতার একটি সংকলন। এই কবিতাগুলোতে আলাদা করে কোথাও ছন্দের ব্যবহার নেই। কিন্তু কোনো লাইনই ছন্দের বাইরে নয়। সহজাত একধরনের অন্তর্গত ছন্দের ব্যবহার লক্ষ করা হয় যায়। এই ছন্দ বাতাসের মতো মেঘের মতো নিজস্ব চলাচলরীতি অনুসরণ করে। কারো কারো কাছে হয়তো প্রচলিত ছন্দের ব্যবহার প্রত্যাশিত হতে পারে, সেখানে চাওয়া পূরণের প্রতি কবির কোনো দায়বদ্ধতা লক্ষ করা যায় না। এ প্রসঙ্গে কবির নিজের বয়ান ‘ছন্দ জানাও এক মারাত্মক সংকট/ শীত-বর্ষাও বৃত্তাবদ্ধ ছন্দে ছুটে আসে’ এই কবিতাগুলোর ভাষা কবির নিজস্ব ভাষা। কখনো এই ভাষা মৌন, ধ্যানী আবার কখনো ভাষাটি যথেষ্ট চটুল। সেক্ষেত্রে এই কবিতাগুলো, লাইনগুলো একধরনের সাময়িক উত্তেজনা ও মোহ তৈরি করলেও তা মহাকালের ঘাসের বুকের শিশিরের মতো কতক্ষণ টিকে থাকবে তা ঠিক অনুমেয় নয়। তবু এ-ভাষাটির এ-ভাবনাগুলোর এ-বোধের একধরনের ক্ষমতা আছে খুব গভীরে নাড়া দেওয়ার। কোথাও কোথাও এমনও মনে হয়েছে, বক্তব্য পরিমিত নয়। বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট এই প্রবাদ মেনে নিয়ে কোথাও দেখা যায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত বয়ানের দোষে দুষ্ট কোনো কোনো কবিতা। যদিও ব্যক্তিভেদে এই অভিযোগ খুব সহজেই খারিজ হয়ে যায় নিমিষেই। ভালোলাগা অবশ্যই কোনো সূত্র মেনে চলে না। এই মানা-না-মানা অভিযোগ অনুযোগ সত্ত্বেও কবিতাগুলো স্বকীয় অনন্য ও মানসম্মত।
নামকরণের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে প্রথম কবিতাতেই, এজন্যে পাঠককে আলাদা করে ঘর্মাক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
কামসূত্র লিখেছে কে? জানি না। চিনি না তাকে
পড়তে পড়তেই করি পর্যটন, ঘুরিফিরি, নানাসনের বাঁকে
এরইমধ্যে আমি ঘেমে উঠি, দৃশ্যত আমি মেঘে যাই
চলন্ত ট্রেনের বগী থেকে লাফ দিয়ে প্লাটফর্মে নেমে যাই
(ঘামসূত্র, পৃ ৯)

বাৎসায়ন কামসূত্র লিখেছিলেন। কাম কী আসলেও কোনো সূত্রের ধার ধারে? কাম হয়তো ঘামের চলাচলপথকে নিয়ন্ত্রণ করে, করতে পারে। ঘামকেও কখনো কখনো কোনো সূত্রের নির্দেশে চলতে হয়। এ-ঘটনাগুলো বা ঘটনার পেছনের ঘটনাগুলো টোকন ঠাকুরের একান্তই মৌলিক ভাবনা, ভাবনার নিজস্বতা। মধুর সঙ্গে মৌমাছির একধরনের মধুর সম্পর্ক ও সম্পর্কের অনুরণন থেকে যায়। সেখানেও কামের এক নান্দনিক প্রকাশ। এই পুস্তক পাঠকালে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই মধুর বিবরণ আগে আর কেউ কী দিতে পেরেছে, সুন্দরের পথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে?
মধুর পক্ষে ছিলাম
মধুর পক্ষে আছি
অন দ্য রেকর্ড, বাই বর্ন আমি
পুত্রমৌমাছি।