চারটি জোড়াতালি দেওয়া একটি প্রেমের গল্প

Charti-Jora-Tali-Dewa-Akti-Galpha

পিয়াস মজিদ

জোড়াতালি দেওয়া গল্প হয় নাকি?

হবে না কেন?

জোড়াতালি দেওয়া ফিল্ম যদি হতে পারে, কবিতা হতে পারে, চিত্রকর্ম হতে পারে, তবে গল্প নয় কেন? আর গল্প যদি হয় জীবনের প্রতিভাস তবে বিচার করে দেখলে দেখা যাবে মানুষের জীবন কত না জোড়াতালির সমাহার। এই সব জোড়াতালি রিফু করে তবে একটা ধোপদুরস্ত জীবন মেলে, এই রক্তমাংসের ঝরনা বওয়া মানুষ-জীবনে।

কুরো সাওয়ার ড্রিমস ফিল্মে দেখতে পাই কানকাটা ভ্যান গঘের চিত্রমহলের গল্প আর রোদ-বৃষ্টির মধ্যিখানে খেঁকশিয়ালের বিয়ের গল্প একাকার হয়ে যায়। কিংবা এই তো বলিউডের বম্বে টকিজ ফিল্মে মোরব্বার গল্প আর যৌনতার গল্প কোনো এক অদৃশ্য আলকেমিতে এক হয়ে যায়। কদিন আগে চলে যাওয়া কবি উৎপলকুমার বসুর পুরীসিরিজের সব কবিতা তো একই রকম পুরী সমুদ্রের গর্জনময় না; কিন্তু কোথাও না কোথাও গর্জনের আভা ঠিকই লেগে থাকে। আর সৈয়দ হকের জলেশ্বরীর গল্পগুলোয় মনোহরকে খুঁজে না পাওয়া কিংবা শরবতির পাশ ফেরার মধ্যেও একটা অন্তর্গত ঐক্য ঠিক-ই থাকে।

সে-ভরসা থেকেই আমরা প্রেমবিষয়ক দশটি ছাড়া-ছাড়া গল্প অথবা গল্প মতো কোনো কিছু দশটা একমালায় গেঁথে দিতে চাইলাম। প্রেমবিষয়ক হাজারটা ভালো গল্পের ভিড়ে কোনো সম্পাদকই এমন জোড়াতালি দেওয়া গল্প ছাপতে উৎসাহী নন নিশ্চয়ই। তবু বলে যেতে চাই, এইসব ছিন্ন-ছিন্ন প্রেমকথা; যার মধ্য থেকে প্রেমের ছিটেফোঁটা অনুভবও যদি সঞ্চার হয় আপনাদের মাঝে, তবেই কৃতার্থ এই অক্ষম গল্পকার।

প্রেম নিয়ে কত কথা বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে – আবার কেন হৃদয় খুঁড়ে তবে বেদনা জাগিয়ে তোলা! না-না, তুলতে তো চাইছি না – আমি শুধু আমার ‘আমি’টার প্রকাশ ঘটাতে চাইছি। ভদ্রপাঠক ভদ্রপাঠিকা, আপনাদের সকাশে। আপনারা প্রকাশ কর্মকারের ছবি দেখুন, কি হাসান আজিজুল হকের অপ্রকাশের ভার পড়–ন; ক্ষতি নেই কিন্তু আমার গল্পও শুনুন একটু।

 

এইসব অগ্নি ও হিম

ইদানীং মুভি দেখে সময় কাটছে নিলয়ের অথচ নিজের জীবন তার মুভির চেয়ে কম বিচিত্র নয়। বছর-আটাশের এই যুবকজীবনটাকে একটা মুভি-আওয়ার ছাড়া আর কীই-বা বলা চলে? তবে মুভির যেমন মধুর বা বিধুর সমাপন থাকে কিংবা আধুনিক-উত্তরাধুনিক মুভির যা হোক একটা সোনালিধূসর ধাঁধা; তেমন কিছু নেই নিলয়ের জীবনে। এই শুধু টেনে চলা; সে গোলাপ হোক আর ঘানিই হোক।

মুভিতে ব্রেক আওয়ারের মতোই হঠাৎ মনে পড়ল আজ ইমনের জন্মদিন। কী দেওয়া যায় ইমনকে? না, বইপত্র কিছু নয়। আঁতলামি ভাবে বন্ধুরা। আবার বই ছাড়া দেবই বা কী? বেছে-শুনে কিনতে পারে না তো কিছুই। যাক ওরিয়ানা ফাল্লাচির তোমার হাত বাড়িয়ে দাও দেওয়া যাক।

বইটিতে উইশিং নোট লিখতে-লিখতে মনে পড়ল শর্মির কথা। এক জন্মদিনে শর্মিকে হাত বাড়িয়ে দাও উপহার দিলে পরদিন ক্লাসে শর্মির কাছের বন্ধু-বান্ধবী এসে টিপ্পনী কাটতে লাগল, ‘ব্যাপার কী নিলয়! আজকাল নাকি অনেকের দিকে হাত-টাত বাড়িয়ে দিচ্ছ।’ পুরনো সব মনে পড়তেই একা-একা হেসে উঠল নিলয়। আজ কোথায় হাত, কোথায় শর্মি। শুনলাম, দুই সন্তানের জননী আর বছর-বছর ঢাকা-দুবাই ফ্লাই করছে স্বামীপ্রবরের কল্যাণে।

ধুর, কিসের ভিতর কী, পান্তাভাতে ঘি। আজকাল যেন মুভি দেখতে-দেখতে মন্তাজ-কোলাজ-ক্লোজ-লং এমন নানান শট পেয়ে বসেছে। কিন্তু ইমন ফোন দিয়ে বলেছে, ‘মামা, বার্থডে পার্টিতে লংটাইম নিয়া আসবা। শর্টকাটে ভাগতে চাইলে মাইর খাবা।’

পার্টি আর কি? বাবুর বাসায় ব্যাচেলর-হইচই। আজকাল তো পার্টিতে সব্বাই বোতল টেস্ট করে আর আমরা চাইলাম একটু উরাধুরা কিছু; বন্ধুকে জানা না-জানাটা টেস্ট করা। বার্থডে বয় ইমনকে নিয়ে বলতে শুরু করলাম একে-একে পিনাক, অনিক, মাশফিক, শাহরুখ, বাবু ও আমি। এই বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে সবাই একমত হওয়া গেল যে, ইমনের সব ভালো শুধু নিজের ভেতর কী যেন লুকিয়ে রাখে।

বিয়ার-ভদকার বদলে নিরীহ-হলুদ ফ্যান্টায় চুমুক দিতে-দিতে সবার মতো আমিও ফ্লোর নিলাম। ‘কাম অন ম্যান। বার্স্ট করে দাও নিজেকে এই খেলো সভ্যতার সামনে’… বলতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম নিজের কাছে নিজেই। ইমনকে কে বলছে এই কথাটা, নিলয়? যার ভেতর শত শত অগ্নিগিরির নিঝুম বসত। বুকচাপা আগুনের হল্কা অন্য কারোর গায়ে লাগার ভয়ে জীবনের প্রোফাইলে ‘ইন এ রিলেশনশিপ’ স্ট্যাটাস লেখা হলো না যার – সেই নিলয়!

‘আমি যাই ফ্রেন্ডস’ বলে আবার নিজের অনলে ডুব দেওয়ার মোহে দৌড় লাগাল নিলয়।

দাঁড়াও আমার অন্তর্গত অগ্নিসুন্দরী, আসছি আমি।

ছুটে চলি ঝরা পাতার মৌসুমে, দাউ-দাউ  অগ্নিমঞ্জরির দিকে।

তবে পোড়াতে পোড়াতে ক্লান্ত হয়ে ব্রত চক্রবর্তীর কবিতার কথামতো আগুন এখন নিজেই পুড়ছে ভীষণ। তাই প্রেমের অভাবে, অগ্নির নিদারুণ অভাবে নিলয় ডিসেম্বর-জানুয়ারির শীত হয়ে যায়। পৌষ-মাঘের পৃথিবীতে কেউ না কেউ ঠিক টের পায় একজন কারো প্রেমাকুল অবয়ব কুয়াশা আকারে ঝরে পড়ে ভূমি ও আকাশের আঙিনায়।

(অনুসিদ্ধান্ত : শীতকাল মূলত নিলয় নামে এক বিরহী প্রেমিকের হিম-হাড়)

 

কেরু সাহেবের প্রেম

কেরু অ্যান্ড কোং –

দর্শনা,

চুয়াডাঙ্গা।

 

পাশাপাশি দুটি কবর

আমি ভাবি কোনো মৃত সাহেবের সমাধি হয়তো।

আর কেরু কারখানার আরদালি আমাকে বলে, ‘মশাই, মানুষের না – এগুলো কুকুরের কবর।’

‘দুটোই?’

‘হ্যাঁ, কেরু সাহেবের প্রিয় কুকুর জোড়ার একটি অসুস্থ হয়ে মারা যায়। আর একটাকে উনি বিলেতে চলে যাওয়ার আগে নিজেই গুলি করে মারেন।’

‘বলেন কী? প্রিয় জিনিসকে কেউ নিজে গুলি করে মারতে পারে?’

আরদালি বলে, ‘পারে-পারে। গভীর প্রেম হলে পারে!’

‘সেটা কেমন?’

‘কেরু সাহেব অবশিষ্ট কুকুরটাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারছিলেন না। আর উনি বিশ্বাসই করে উঠতে পারেননি যে অন্য কেউ কুকুরটাকে তার মতো করে ভালোবাসতে পারবে। তাই নিজ হাতে প্রিয় কুকুরের ভবলীলা সাঙ্গ করে কবর দিয়ে এখন নিজেই কোথাও কবর হয়ে আছেন।’

 

আমি একবার কেরু সাহেবের কুকুরের কবরের দিকে আর একবার আকাশের অসীম শূন্যে তাকাই। শুনতে পাই শূন্যতা থেকে কেউ একজন বলছে – ‘প্রেমের তুমি কিছুই জানো না, বাছা।’

(অনুসিদ্ধান্ত : চেনাজানা মানবীয় অভিজ্ঞতার বাইরে বিপুল-বিস্তীর্ণ প্রেমপথে আমরা তো শিশু-পথিকমাত্র)

 

মহল্লার মাস্তানের প্রেম

 

রাজু এলাকার প্রতিষ্ঠিত মাস্তান।

রাজুর মাস্তানির ভেতর কোনো দয়ামায়ার স্থান নেই।

রাজুর ভয়ে অস্থির সবাই।

সেই রাজু প্রেমে পড়ল।

রাজু প্রেমে পড়ল ঊর্মির।

লালগোলাপ উপহার দিলো।

উত্তরে ঊর্মি রাজুর গালে চড় কষাল।

মেজাজ বিগড়ে গেলে মানুষের হাতে-পায়ে ছুরি চালাতো রাজু।

সেই রাজু নিজের হাত কাটা রক্তে গায়ে ঊর্মির নাম লিখলো।

ঊর্মির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রাজু এবংবিধ বহু প্রচেষ্টা চালালো।

কিন্তু ঊর্মির চোখে কিছুই পড়ল না।

রাজু প্রেমে পড়ল।

আর

ঊর্মি আমেরিকায় উড়াল দিলো।

বিরহে রাজু মরলো।

রাজু মাস্তানের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যারা তার মৃত্যু কামনা করতো সেই মহল্লাবাসী তার কবরের পাশে সাইনবোর্ড ঝুলালো।

রাজু দিওয়ানার মাজার

 

(অনুসিদ্ধান্ত : প্রেম একটা বিরল প্রজাতির বিষ। একমাত্র এই বিষ সেবন করলেই মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে রাজুর মতোই মধুপুরের ঠিকানা পেয়ে যেতে পারে)

ঈশ্বরীর দিকে অবিরত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন। আজকের বক্তা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। বিনয়ের ঈশ্বরী-সেই গায়ত্রী। বিশ্ববিদ্যাজগতের এক নারীনক্ষত্র। বক্তৃতা দিচ্ছেন গায়ত্রী আমাদের মনোকৌণিক অবভাস, ভাষার ছলনা, সাম্রাজ্যবাদী শয়তানি ইত্যাদি বিষয়ে আর আমার সব কেমনই গুলিয়ে যাচ্ছে কেবল। মান্না বসে ছিল পাশের শ্রোতা-সিটে। বলল, ‘বুঝছিস, চক্রবর্তীর চক্র থেকে হয়েছে বিনয়ের চাকা।’ আরে তাই তো… ফিরে এসো চাকা… রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে ফিরে এসো তুমি। বিনয় মজুমদার; আজকালকার আর্ট ফিল্মের শুরুতে রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দের বদলে বিনয়ের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে ফিল্মমেকাররাও তাদের অতিআধুনিক কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা জানান দিতে ভোলেন না। কিন্তু গায়ত্রী কি ভুলে গেছে বিনয়কে? সিনেট ভবনে এতো-এতো বুদ্ধিভারী মানুষের মাঝে এই কথাটা তাকে জিজ্ঞেস করার জো নেই। হয়তো অঙ্কসুন্দরী মিস ফজিলতুন্নেসা যেমন নজরুলকে স্বীকার করেননি, গায়ত্রীও তেমনি। তবে কী আশ্চর্য, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে ফজিলতুন্নেসা হল আর এখানেই চিরতরে শুয়ে আছেন নজরুল এবং এখানেই আজ বক্তৃতা করছেন বিনয়ের ফুল্লরা, বিনয়ের ঈশ্বরী – গায়ত্রী। না, ঘটলো না কোনো আকস্মিকের খেলা, গায়ত্রীকে পেলাম না কাছাকাছি আমরা। বক্তৃতা শেষে গায়ত্রী চলে যাচ্ছে একটা সাদা গাড়িতে করে আর বিনয় মজুমদারের অতিকালো ভূত শিমুলপুরে বসে এ খরজ্যৈষ্ঠে লিখে চলেছেন অবিরাম ঈশ্বরীর উদ্দেশে তার অঘ্রাণ অনুভূতিমালা।

 

লাস্ট আর্মেনিয়ামের প্রেম

রিমন আর মিনার দুই বন্ধু। এপিটাফ অন্বেষণ তাদের খুব প্রিয়। কারণ এক একটি এপিটাফ এক একটি গল্প। মৃতের কবরগাত্রের এপিটাফে আসলে জীবনের গল্পই খোদাই করা থাকে। গভীর করে অনুভবে আসে আর্মেনিয়ান চার্চের দুটো এপিটাফ। পারস্যের কারমেনে জন্ম নিয়ে উনিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের চাঁদপুরে প্রয়াত ম্যাক. এস. ম্যাকারটিকের কবরে তার প্রিয়তমা লিখেছে – ‘তাঁকে ভীষণ ভালোবাসতাম বলেই তার না থাকা আমার কাছে গভীর দুঃখের। তবু সে আছে স্মৃতিতে আমার। নীরব রোদনে তাকে অনুক্ষণ ভালোবাসি, মনে রাখি, পেতে চাই একান্ত আপন করে।’ আর ম্যাকারটিকের কাল্পনিক উত্তরও তার প্রিয়তমা খোদাই করে গেছেন এইভাবে – ‘আমার জন্য কেঁদো না, প্রিয়তমা। মৃত নই, আমি এখানে ঘুমিয়ে আছি মাত্র। আমি তো তোমার ছিলাম, ছিলাম ঈশ্বরেরও। তিনিই হয়তো আমাকে ভালোবাসতেন বেশি। তাই তোমার কাছ থেকে ডেকে নিয়ে গেছেন তার নিজস্ব ঘরে।’

রিমনের এপিটাফ-উৎসাহী বন্ধু মিনারই মুনতাসীর মামুনের বইপত্র ঘেঁটে বের করলো যে, ১৭৯১-এ স্থাপিত পুরান ঢাকার আরমানিটোলার এ চার্চের প্রাঙ্গণে অষ্টাদশ শতকের বহু পুরনো কবর আছে। কলকাতার ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে আনা পাথরে মৃতের এপিটাফগুলো জীবন পেয়েছে।

আরমানি গির্জার গেট সবসময় প্রায় বন্ধই থাকে। এই দেশ থেকে আরমেনীয়রা এখন বিলুপ্তপ্রায়। এই সম্প্রদায়ের শেষ ব্যক্তিটি এখন শুধু জীবিত আছে। তার স্ত্রী-পরিজনের কবর এখানে আর সন্তানেরা থাকে সুদূর কানাডায়।

আরমেনিয়ান সিমেট্রির পাহারাদার শংকরের সহায়তায় একদিন এখানে ঢুকে শেষ আরমেনীয় বৃদ্ধ মিনাস মার্টিরোসেন সিরকোকে জিগ্যেস করলো, ‘কেন আপনি এখানে আছেন একলা একা?’

সিরকোর উত্তর, ‘মহিমান্বিত ঈশ্বরের অভিশপ্ত সন্তান হিসেবে এই কবরের স্মৃতিবাহক হয়ে ধুঁকে-ধুঁকে যেন বেঁচে আছি আমি। এই কবরসমূহ আর এপিটাফগুলোর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে বাঁধা আমি। কী করে ছেড়ে যাই এদের?’

 

প্রেম-দশমী

– আমার মৃত্যু জীবনভর বসে বসে কারো হাতে তৈরি করা শুভেচ্ছা।

সে কি প্রেম!

– প্রেমের মড়া জলে ডোবে না। তবে আগুনে পুড়ে।

এই যেমন হিমার স্মৃতি আমাকে ভাসিয়ে নিতে পারেনি তবে খাক করে দিয়ে গেছে।

– ভুলের মতন প্রেম।

প্রেমের মতন গাঢ় ভুল।

(কবিতা সিংহের কবিতা ‘প্রেম’)

– জীবন একটা রূপারহস্য

প্রেম একটা হীরারহস্য।

অর্থাৎ প্রেম জীবনের চেয়েও রহস্যবান। আর আমরা বিশাল রুপালি জীবনকে ছারখার করে দিতে পারি প্রেম নাম্নী হীরার ক্ষণিক স্পর্শের লোভে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, প্রেম-ট্রেম কিছু নয়, আমরা আসলে মূল্যবান ধাতুলোভী।

– রশীদ করীমের কথাটি খুব সত্য – ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’। গোলাপের স্থায়িত্ব যেমন অল্প কয়েকদিনের, প্রেমের স্থায়িত্বও তেমন। সামান্য কদিনই এর সৌরভ অটুট থাকে। গোলাপের শুকনো পাপড়ি বইয়ের পৃষ্ঠার ভাঁজে রেখে আমরা যেমন মাঝে মধ্যে পুরনো ঘ্রাণ খুঁজি ঠিক তেমনি মৃত প্রেমের বিগত সুবাস আমরা অনেক সময় পরবর্তী জীবনেও শুঁকতে চাই। অর্থাৎ প্রেমের স্মৃতিকেই প্রেম ভেবে ভ্রম করি।

– নজরুলের গানে আছে –

মালঞ্চে আজ কাহার যাওয়া আসা।

ঝরা পাতায় বাজে

মৃদুল তাহার পায়ের ভাষা ॥

প্রেম আসলে কিছ নয়, দুহাত ভরে তুলে নেওয়া কেবল কারো ‘পায়ের ভাষা’।

– আশেক যারা জ্বলে পুড়ে খাক হয় তারা অন্য ধরনের।

পোড়া গ্রামের উপর করারোপ করো না, প্রেমিককে বকো না।

অন্যদের একশ গুণ ‘সঠিক’ কথার চেয়ে তার ‘ভুল’ বলাটিও ভালো।

(আশা করি আপনারা মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির এ-কবিতার মতো ‘প্রেম’ নামক ভুলের প্রেমে পড়বেন বারবার)

– মানুষ আসলে অত্যন্ত ভীতু প্রকৃতির প্রাণী। একাকিত্বকেও সে ভীষণ ভয় পায়। তাই সে সঙ্গী খুঁজে প্রেম করে। মানুষের কোষ থেকে ভয়কে বিলুপ্ত করে দিলে প্রেমের হারও কমে যাবে।

– লোহার মতো প্রেমেও মরচে পড়ে। তখন সুখের বদলে মরচেপড়া প্রেম মরচেপড়া পেরেকের মতোই ভয়াবহ অঘটন ডেকে আনতে পারে, সুতরাং সাধু সাবধান।

– মানুষ আসলে আদ্যন্ত প্রেমী। তাই জীবৎকালে হরেক কিসিমের প্রেমে রঞ্জিত হওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুর পর পছন্দসই জায়গায় সমাধিস্থ হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করার মাধ্যমে মৃত্যু-উত্তর একরকমের প্রেমই প্রকাশ করে যায় নিকটজনের কাছে।

অনুসিদ্ধান্ত : নিলয়, রাজু কিংবা কেরু সাহেবের গল্পচ্ছলে এতক্ষণ প্রেমের কথা বলছিলাম নাকি একটা স্বপ্ন দেখছিলাম? গুলিয়ে গেলে সমস্যা নেই, কারণ আমার এই মুহূর্তের ভাবনা অনেকটা প্রয়াত কবি সিকদার আমিনুল হকের ‘নতুন প্রেম’ নামের কবিতাটির মতোই –

জীবন একটা স্বপ্ন আর কিছুই নয়।

একটা ক্রোধ। সেই ক্রোধটা হলো

প্রেম বিষয়ে লঘু-গুরু এতকিছু বোঝার পরও

আমি আরও একবার ‘প্রেমে পড়েছি’।