চালককে সরিয়ে দেওয়ার পর

হামিদ কায়সার

আমাদের বাসটা যখন যাত্রার প্রারম্ভ ধকল কাটিয়ে মাত্র চলতে শুরু করেছে, পেয়ে গেছে সবটুকু স্বতঃস্ফূর্ততা, তখনই লোকটির আগমন Ñ ছোটখাটো শরীর, জলপাই রঙের অদ্ভুুত বেমক্কা পোশাক পরনে Ñ চকিতে একবার মনে হচ্ছিল আরব-জোব্বা আরেকবার লাগছিল টেক্সাসীয় ওভারকোটের মতো, টাইট হয়ে লেগে আছে চিমসানো শরীরে, অ্যাশ কালারের বিশাল বোতামগুলো যেন তাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছিল। মাথায় চতুর্ভুজ টুপি, তা এমন আবলুস কালো যে, হঠাৎ মনে হতে পারে একটা কালো বেড়াল যেন চোখ বুজে ঘুমিয়ে আছে মাথায়, ঝামরিকাটা সন্ধ্যার কোনো ছায়া-অন্ধকারে।
লোকটা সবার সামনে, যেখানে ড্রাইভার বসে থাকে তার পাশেই দাঁড়িয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই বুঝিবা ভীষণ শব্দে হাততালি দিয়ে উঠল। তা এত জোরে যে, কানের পর্দা ছাপিয়ে মগজে এসে লাগছিল। প্রথমে মনে হচ্ছিল আমার, লোকটা বুঝি এ-বাসেরই একজন Ñ গাইড অথবা কন্ট্রাক্টর গোছের কেউ, অথবা মালিক নিজেই হবেন। তাই যখন ঝটপট দ্রুত হাতে দুপাশের জানালার সব পর্দা নামিয়ে দিতে লাগল এবং চলন-বলনে বেশ একটা আগ্রাসী ভাবভঙ্গি দেখাতে লাগল, আমার বা আমাদের মনে বিন্দুমাত্রও প্রশ্নের উদ্রেক হলো না, লোকটা কেন এসব করছে, ভালোই তো বাইরের নিসর্গ উপভোগ করা যাচ্ছিল – গুচ্ছ-গুচ্ছ গ্রাম, জলমগ্ন, জল ছাপিয়ে মাঝে মাঝে গাছ, টাগৈর, ধান বা পাটের জমি, কখনো বা বিরান প্রান্তর, হঠাৎ নারীর চুলের সিঁথির মতো ছুটে যাওয়া এক একটা কাঁচা মাটির পথ অথবা স্রোত-হারানো কোনো নদী। যেসব দেখতে দেখতে মনে বেশ কোমল অনুভূতিও কাজ করছিল। আর, এর মধ্যেই কিনা এসব উপদ্রব!
মনকে বোঝাতে চাইলাম, হয়তো এ-বাসের এটাই নিয়ম Ñ দুপাশই ঢেকে রাখতে হয়। দেখতে দেখতে জানালার দুপাশটা বিদঘুটে কালো পর্দায় ঢেকে গেল। সামান্য কোনো ফাঁক বা আলোর সরু রেখার আভাসও নেই সেখানে। যেন পর্দা শক্ত কোনো ক্লিপে আটকানো। দুপাশটা ঢেকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে লোকটা আবার এগিয়ে গেল বাসের সেই একেবারে সামনে। এবং আমরা কিছু বোঝার আগেই দ্রুত এবং চটপটে ভঙ্গিতে সে বাসের সামনের কাচটাও ঢেকে দিতে লাগল,     যে-কাচ দিয়ে ড্রাইভার পথ দেখে দেখে গাড়ি চালাচ্ছিল অত্যন্ত সাবধানী এবং দ্রুত ভঙ্গিতে।
আমি ভেতরে ভেতরে এই প্রথম আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম, ড্রাইভার গাড়ি চালাবে কীভাবে, যখন সামনের কোনো দৃশ্যপটই দেখা যাচ্ছে না Ñ রাস্তা অথবা রাস্তার দুপার্শ্ব, যেখানে মাঝে মাঝেই বিপজ্জনক বাঁক। সে-বাঁক পেরিয়ে বিপরীত দিক থেকে যেমন একটার পর একটা গাড়ি আসছে তো আসছেই, পেছনের অনেক গাড়িও ওভারটেক করে যেতে চাইছে আগে আগে। কিন্তু আমি ছাড়া মনে হলো না আর কেউ এ-বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। সবাই টুলটুল করে তাকিয়ে শুধু তামাশা দেখছে। নিজেকে ভীষণ বিপদাপন্ন মনে হলো। মনে হলো, যেহেতু ড্রাইভার সামনের কোনোকিছু দেখতে পাচ্ছে না Ñ এখনই বাসটা ছিটকে নিচে পড়ে যাবে রাস্তা থেকে কোনো খাদে অথবা কোনো বিদ্যুতের খাম্বায় বাড়ি খেয়ে তড়িতাহত হবে অথবা আমরা সবাই দলেমুচড়ে পড়ে থাকব রাস্তার পিচে অথবা তলিয়ে থাকব পানির নিচে। ভয়ের বিবমিষা থেকেই কি-না, আমি শেষ পর্যন্ত সিট থেকে উঠে দাঁড়ালাম। অস্থির পায়ে লোকটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
লোকটা আমার দিকে সকৌতুকে তাকাল। যেন পরিস্থিতিটা বুঝে নিতে চাইছে। আমি গভীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় চেঁচিয়ে জানতে চাইলাম, ‘সামনের কাচটা এভাবে ঢেকে দিয়েছেন কেন? ড্রাইভার দেখবে কীভাবে?’
আমার কথা শুনে ভারী আশ্চর্য হলো জলপাই পোশাকধারী। যেন এমন কথা জীবনে কখনো শোনেনি। বেশ হেঁয়ালির সুরেই বলল, ‘ড্রাইভার? কোথায় ড্রাইভার? ড্রাইভার থাকলে তো দেখবে!’
লোকটার কথায় চমকে এবং তার চোখের ইশারামতোই ড্রাইভিং সিটের দিকে তাকিয়ে ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। আশ্চর্য! নিমিষের মধ্যেই কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল ড্রাইভার। এই তো একটু আগেই তাকে দেখছিলাম। কাঁচাপাকা পুরুষ্টু গোঁফের মানুষটা, ভারী চশমা, ব্র্যাক ব্রাশ চুল Ñ এখনো চেহারাটা স্পষ্ট মনে করতে পারি, সাদা একটা পাঞ্জাবির ওপর কালো স্লিভলেস কোট পরেছিল। ভালোই তো চালাচ্ছিল গাড়ি, বিশেষ করে কালো পর্দাটা সামনে ঝুলিয়ে দেওয়ার পরও মনে হয়নি তার আত্মবিশ্বাসে সামান্য চিড় ধরেছে। হঠাৎ কোথায় সে-ড্রাইভারকে অদৃশ্য করে দেওয়া হলো? এখন ড্রাইভারবিহীন এ-গাড়িটা চলবে কীভাবে? কিন্তু আমি ততোধিক আশ্চর্যান্বিত হয়ে আবিষ্কার করছিলাম গাড়িটা ঠিক আগের মতোই রুদ্ধশ্বাস গতিতে ছুটছে। কিন্তু সেটা আর কতক্ষণ? একসময় না একসময় মুখ থুবড়ে তো পড়তেই হবে। অনিবার্য সেই পতন। আমি পেছন ফিরে মানুষগুলোর দিকে একনজর তাকালাম। উদ্বেগে বলে উঠলাম, ‘এতগুলো মানুষের জীবন নিয়ে আপনি খেলছেন কেন?’
লোকটা আরো ততোধিক হেঁয়ালির স্বরে বলল, ‘মানুষ? কোথায় মানুষ? মানুষ কেউ থাকলে তো খেলবো?’ লোকটি আবার আমাকে চোখের ইশারায় পেছনের দিকে তাকাতে বলল।
আমি ডানে-বাঁয়ে আমার সামনে-পেছনে চারদিক তাকিয়ে অবাক হতেও ভুলে গেলাম, কোনো মানুষ নেই। মানুষ তো মানুষ, জনপ্রাণীরও চিহ্ন নেই। কেমন ভোঁজবাজির মতো একটা ব্যাপার। এতবড় বাসে কেবল আমি, আমি একা – আর সামনেই সে-লোকটা; যার অদ্ভুত ক্ষমতা আমি একের পর এক ওয়াকিবহাল হচ্ছি, মুখে বিটকেলে ফিচেল হাসি। কী যে অসহায় লাগছে আমার। এতটা বিপন্ন বোধ জীবনে কখনই করিনি। প্রতিটি সিট পূর্ণ ছিল মানুষে – নানাবয়সী মানুষে – নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ। তারা ছিল কথায় মুখর, কারো কারো হাসিঠাট্টার শব্দ মাঝে মধ্যেই ভেসে আসছিল। শিশুর কান্নায় একবার খুব বিরক্তও হয়েছি। কেউ একজন হঠাৎ একটা গানও ধরেছিল, বোধহয় ওরা গ্র“প বেঁধে এসেছিল। গানটা আর শেষ করতে পারেনি কোনো একজনের ঠাট্টার তোড়ে। তার বদলে এখন কী ধরনের দমবন্ধ পাঁশুটে নিস্তব্ধতা। আমার বুকের ভেতর একটা চিৎকার ভেঙেচুরে আছড়ে পড়ল। বিশেষ করে সামনের বাঁ-পাশের লম্বা সিটে বসা কুমারী তরুণীটির জন্য অদ্ভুত এক মায়াটান অনুভব করলাম।
কী ধারালো মুখশ্রী ছিল মেয়েটার। কালিদাস-বর্ণিত নায়িকার আদল। স্ফটিকস্বচ্ছ চোখ, চাঁদ কপোল, খাড়া নাক, কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট। বুদ্ধির ঝিলিকের সঙ্গে এমন লজ্জাবনত দৃষ্টি আমি আর কখনো দেখিনি। একটা কলাপাতা রং লালপাড় শাড়ি পরেছিল। আমার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই চোখাচুখি হচ্ছিল আর মুখ নামিয়ে নিচ্ছিল। ঠিক কোথা থেকে, কখন উঠেছিল বাসে খেয়াল করিনি। তবে দৃষ্টিবিনিময় হচ্ছিল এ-ঘটনার          তিন-চারটে আগের স্টেশন থেকেই আর মেয়েটিকে ঘিরে আমার মনের মধ্যে একটা ঘোর ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল, যেমন বাষ্পীভূত হয় জলকণা, বৃষ্টি হওয়ার জন্য, তেমনি শাশ্বত একটা আবেগ আমার বোধ-চৈতন্যে ছড়িয়ে পড়ছিল। একটা শীতল প্রচ্ছন্ন বৃষ্টির ঝিরিঝিরি অথবা টলটলে পুকুরে ফোটে থাকা অসংখ্য পদ্মর অনুভব মনে বইছিল। বেশ কয়েকবারই স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে আমার ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার জন্য। যদিও আমি ঠিক জানি না, ওর সঙ্গে কী নিয়ে কথা হতো আমার। অথবা আদৌ হতো কি-না, হয়তো লজ্জা কি সংকোচে কথা না বলেই মেয়েটির সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচতাম। অবশ্য সেটাও হতে পারত কথার চেয়েও জুতসই এবং হৃদয়বেদী অভিব্যক্তি, যার সম্ভাবনার ছিটেফোঁটাও এখন আর অবশিষ্ট নেই, আমি সেই আক্ষেপেই গভীরভাবে পুড়তে লাগলাম। এবং এইমাত্র একটি সত্য আবিষ্কার করলাম,              সে-মেয়েটির মুখ ছাড়া বাসের আর কারো মুখের ছবি, চেহারার ছাঁচ কিচ্ছু আমার মনে নেই। আমার হৃদয়ে কেবল সে-মুখটিই খোদাই করা রয়েছে। আমি যখন সেই লাবণ্যরসে ডুবেই আমার বিপন্নতাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করছি, তখনই কী আশ্চর্য, সেই চতুর্ভুজ টুপি আর জলপাই আলখেল্লা পরা লোকটি বলে উঠল, ‘তুমি কি শ্যামাঙ্গিনীকে ফিরে পেতে চাচ্ছ? দাঁড়াও এক সেকেন্ড প্লিজ!’
আমার মতামত বা হ্যাঁ না-র অপেক্ষা না করেই, মেয়েটিকে সেই আশ্চর্য লোক ফিরিয়ে আনল। চোখের সামনেই আমি মেয়েটিকে পরিস্ফুটিত হতে দেখলাম। অভিভূত হবো কি হবো না আমার মনের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার ঝড় বইতে লাগল। কারণ, আমি যে-মেয়েটিকে দেখেছিলাম এ-মেয়েটি যে সেই-ই তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু তার বেশভূষায় অদ্ভুত সব পরিবর্তন এসেছে। কলাপাতা রং শাড়ির বদলে সে এখন পরে আছে স্লিভলেস শেমিজ, তার সঙ্গে মানিয়ে মিনি স্কার্ট, যা ওর হাঁটু থেকে নিতম্বের পুরো অংশকে ভালোভাবে স্পষ্ট করে রেখেছে। স্বভাবতই ওর শরীর থেকে একটা তীব্র বন্যগন্ধী আমোদ ফেটে বেরোচ্ছে। আমি যখন সেই উত্তাপের আঁচ পেতে শুরু করেছি, তখনই লোকটি আমার উদ্দেশে চোখ টিপ মেরে মেয়েটির পাশে বসল এবং মেয়েটিকে তুলে নিয়ে নিজের কোলের ওপর বসাল। মেয়েটা তীব্র মদালস চাহনীতে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দুজন আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নাচা শুরু করল। যেন আমাকে দেখাতেই। আমার হৃদয়কে ব্যাপকভাবে খুঁড়ে রক্তাক্ত করতেই যেন লোকটি বাসজুড়ে মেয়েটিকে নিয়ে নাচতে লাগল আর ওর শরীর থেকে একটার পর একটা ড্রেস খুলে ছুড়ে ফেলতে লাগল শূন্য হাওয়ায়। চালকবিহীন বাসটার গতি তখন আরো বেড়ে টালমাটল হয়ে উঠেছে।