চিত্রকলায় জীবনকথা

ইব্রাহিম ফাত্তাহ

গত শতকের আশির দশকের শিল্পী শামীম সুব্রানা এই প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী করলেন ঢাকার ধানম–তে তাজ-লিলি সেন্টারের গ্যালারি ২১-এ। ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল – এই পাঁচ বছরে আঁকা শিল্পীর চলিস্নশটি ছবি নিয়ে এ-আয়োজন। এ প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছে শিল্পীর অকালপ্রয়াত সমত্মান অধ্যাপক খান সরওয়ার মুরশীদের দৌহিত্র সাবাব মুরশীদের জন্মদিন স্মরণে। ২০০৫ সালে মাত্র পনেরো বছর বয়সে কম্বোডিয়ার নমপেনে তার স্কুলে বাস্কেটবল খেলার সময় আকস্মিক অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

পুত্র হারানোর শোকে-অভিমানে কয়েক বছর ছবি আঁকা থেকে দূরে ছিলেন। পরিবারের ঐকামিত্মক আগ্রহে অকালপ্রয়াত পুত্রকে স্মরণ করেই আবার শুরু করেছেন সুব্রানা। বেদনাকে সঙ্গী করে প্রদর্শনীর শিরোনাম দিয়েছেন – ‘আমি কী বলি যখন আমি জীবনের কথা বলি’। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রং ও মিশ্রমাধ্যমে শিল্পী নির্বস্ত্তকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের দেখা ও অনুভবকে। প্রদর্শিত ছবি বিক্রির অর্থ দেওয়া হবে সাবাব মুরশীদ উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের তহবিলে। এ প্রদর্শনীর একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো – দর্শকের উপলব্ধির জন্য চিত্র-সন্নিহিত শিরোনাম কার্ডে নিজের কাজের ব্যাখ্যা যুক্ত করেছেন শিল্পী। ফলে শিল্পীর অনুভব ও প্রকাশ ধরনের সঙ্গে দর্শকের সরাসরি সংযোগে ছবি বুঝতে তাঁদের সুবিধা হবে।

এ প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলোর কতক শিরোনামে শিল্পীর বিশ্বপরিবেশ ও সমাজ-ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। যেমন ‘বিপস্নবী চিমত্মা’, ‘নগরায়ন’, ‘অভিবাসীত্ব’, ‘চত্বর’, ‘জনগণনা’, ‘বাল্যবিবাহ’, ‘জাগরণ’, ‘জলবায়ু পরিবর্তন’, ‘খাঁচাবন্দি পাখি’, ‘ঘূর্ণিঝড়ের পর’ শীর্ষক এসব চিত্রকর্মে সমকালীন বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে নানা ভাবনা-উদ্রেককারী বিষয়বস্ত্ত তুলে ধরা হয়েছে।

শামীম সুব্রানার চিত্রপটের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বিচিত্র বর্ণ ও আলোর উদ্ভাস। বাইরের দেখাকে নিজের অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে একেবারে অন্যরকম করে প্রকাশের প্রয়াস করেন যে-শিল্পীরা, সুব্রানা সেই দলের একজন। যেমন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে আমাদের সাহিত্যে। বিষয়টিকে চিত্রকলায় তুলে আনতে শিল্পীকে রং ও রূপকের আশ্রয় নিতে হয়। সুব্রানা তাঁর চিত্রকলায় এমন রূপ সৃজনের প্রয়াস পেয়েছেন। নানা রঙের বুননে শিল্পী তাঁর মনোভূমির মানচিত্র গড়েছেন। বস্ত্তনিরপেক্ষতার পথে পা বাড়িয়েছেন বলে তাঁর শিল্প-অভিযাত্রায় শিল্প-উপাদানের প্রাধান্য বিধৃত। তা সত্ত্বেও এই শিল্পীর চিত্রকর্মে আমরা অবলোকন করি সংক্ষুব্ধ সময়ের স্মারক, ব্যক্তিগত দুঃখ, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক কষ্টদায়ক নানা ঘটনাবলি নিয়ে শিল্পীর খেদ।

কিশোর বয়সে বাবার মৃত্যু, কিশোর-বয়সী সমত্মানকে অকালে হারানোর গভীর শোক, সপরিবারে জাতির পিতা হত্যার নারকীয়তা, তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চার নেতা হত্যার নিষ্ঠুরতা, নদীমাতৃক দেশে নদীর মৃত্যু, কাবাশরিফে শত-শত হাজির মৃত্যু এসব ঘটনা শোকাচ্ছন্ন করেছে শামীম সুব্রানাকে। শোকাতুর এই বেদনা, এই কষ্টের তীব্রতা শিল্পী তুলে ধরেছেন তাঁর চিত্রপটে রঙের বিন্যাসে।

কাবাশরিফে ২০১৫ সালে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় হাজারো হাজির মৃত্যু নিয়ে আঁকা সুব্রানার ছবির কেন্দ্রস্থলে কালো বর্গাকার গড়ন স্থাপন করে শিল্পী তাঁর চারদিকে হজযাত্রীদের সাদা পোশাকের রং ভারি করে লেপন করে চিত্রপটের নিচের দিকে রক্তের ধারার মতো রং প্রয়োগ করেছেন। ‘জাতীয়তাবাদের মৃত্যু’ শিরোনামে ছবি এঁকেছেন শিল্পী। এ কালে জাতীয়তাবাদ যেন মানবতার বিরুদ্ধে মারণঘাতী আক্রমণে লিপ্ত। এ ছবিতে সবুজের বিপরীতে লাল এমনভাবে প্রয়োগ করেছেন তিনি, এ যেন রাজনৈতিক কারণে রক্তপাতের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মনের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ থাকলেও সুব্রানা আশাবাদী। আলোকিত হৃদয়ে বর্ণিলতা ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ে নিজের চিত্রপটে, সৃজন-পসরায়। অনুভূতি প্রকাশের এই বর্ণিল আকুলতা সুন্দর প্রেমময় হৃদয়ের আবেগকে তুলে ধরেছে। অবশেষে বসন্ত, জ্যোৎসণাধারা, জীবনচক্র, আমাদের ভেতরের আলো এসব চিত্রকর্মে রঙের বিন্যাসে শিল্পীমনের রোমান্টিকতার প্রকাশ ঘটেছে।

শিল্পী জানেন – জীবন এক জটিল ঘূর্ণাবর্ত। দুঃখ-বেদনা-শোক আর আশা-আনন্দ নিয়েই মানুষের জীবন আবর্তিত। এজন্য দুঃখের সাগরে নেয়ে ওঠে আশায় বুক বেঁধেছেন শিল্পী সুব্রানা। কল্পনার পথ বেয়ে সুন্দরের ধ্যান হয়ে তাঁর চিত্রপটে ঝরনার মতো নেমে আসে বর্ণিল আনন্দ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে।

গত ৯ জানুয়ারি শনিবার থেকে শুরু এ-প্রদর্শনী চলেছে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।