চিত্রকলা ও কথাসাহিত্য

রবিন পাল

এঙ্গেলস বলেছিলেন রাজনৈতিক, আইনবিষয়ক, দার্শনিক, ধর্মীয়, সাহিত্যিক, শিল্পবিষয়ক ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিকাশের ভিত্তি হলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বিকাশ। এগুলো পরস্পরের ওপর এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপরেও প্রতিক্রিয়া করে। (Letter to Heinz Starkenburg, Jan. 26, 1894). এ-কথাও জানছি, মানুষের বৈষয়িক ক্রিয়াকলাপ এবং তাদের বৈষয়িক আদান-প্রদানের সঙ্গে ভাবনা, ধারণা, চেতনার উৎপাদন গ্রথিত হয়ে থাকে। (The German Ideology) শিল্পকলার বিকাশে শ্রমের ভূমিকা আছে, সেইসঙ্গে সৌন্দর্যবোধের বিকাশে ও বৈষয়িক জীবন, মানবশ্রম, সামাজিক জীবন অভিঘাত সৃষ্টি করে। সৌকর্যতত্ত্ব শুধু সুন্দরের অভ্যর্থনায় তৎপর নয়, অভিজ্ঞতার সমগ্রতাকেও, প্রত্যক্ষণ ও ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতাকে তার অর্থ ও তাৎপর্যকে অন্বিত করে এ-কথা বহু প্রাচীন, পেস্নটোর কাল থেকে। পেস্নটো মনে করতেন চিত্রকলা প্রকৃতির অনুকারক মাত্র। তাচ্ছিল্যে চিত্রকলাকে দর্পণ গণ্য করতেন। অ্যারিস্টটল বলেন, শিল্পের অনুকৃতগঠন কবিতা, নাটক, চিত্রকলা, স্থাপত্য, সংগীত, নৃত্যকে এবং এসবের দর্শককে বাঁধে একসূত্রে। শিল্পের মধ্যে যেহেতু কাঠামো ও বিন্যাসগত এক আভ্যন্তরবোধ থাকে, তাই অ্যারিস্টটলের মতে এই মাত্রাসৃজন ভ্রান্ত নয়, পেস্নটো যা মনে করতেন, বরং তার আছে একটা fictional status. আর এই ফিকশন্যাল স্ট্যাটাস ধারণা থেকেই তিনি ট্র্যাজিক ড্রামার মধ্যে বিধৃত বিকীর্ণ অনুভবকে আলোচনায় এনেছিলেন। মধ্যযুগীয় চিত্রকলায় একটা প্রয়োজনীয় শিক্ষামূলকতার অভিপ্রায় থাকত। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি মনে করতেন, মানুষের চোখ হলো আত্মার জানালা, তাই শিল্পের অনুকৃতি ও বাসত্মবতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। বুর্জোয়া যুগ জন্ম দিলো বিশ্বসাহিত্যের, চিত্রকলা এবং সাহিত্যের বহুবিচিত্র বিকাশ শুরু হলো। পেস্নটো, অ্যারিস্টটল, মার্কস, এঙ্গেলস এঁরা কেউই চিত্রকর বা কথাকার ছিলেন না। মধ্যযুগের মুখ্য লক্ষণ পরলোকমুখিতা, আধুনিক যুগের মুখ্য লক্ষণ ইহলোকমুখিতা। নবজাগরণ ছিল মানব-স্বীকৃতি। উপন্যাসের যে-দুটি প্রধান লক্ষণ বাসত্মবধর্মিতা ও ব্যক্তিচরিত্র সৃষ্টি এ-ধারণার পথিকৃৎ সেরভামেত্মস (১৫৪৭-১৬১৬), পৃথিবীর বাসত্মব তথ্য প্রতিফলিত করতে চাইলেন উপন্যাসে। ফিউডাল নয়, বুর্জোয়া যুগই উপন্যাসের জন্ম সম্ভব করেছে, মুদ্রাযন্ত্র, গদ্যপত্র, পুসিত্মকা, বই প্রকাশ, অক্ষরজ্ঞান বৃদ্ধি, বিভিন্ন বৃত্তিজীবী মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে ওঠা সম্ভব করল উপন্যাসের বহুমাত্রিক বিস্তার, গালিভারস ট্রাভল্স (১৭২৬), রবিনসন ক্রুশো (১৭১৯) তার দুটি অভিজ্ঞান। বাসত্মবধর্মী উপন্যাসের প্রতিষ্ঠা ফিল্ডিং (১৭০৭-৫৪) থেকে, এলো বিশ্বাস্য কাহিনি, পরিচিত নরনারী, সমাজের বাসত্মব সমস্যা, মানব-হৃদয়বেদনা, সংলাপে বর্ণনায় অনুভবের শিল্পরূপ আনল উপন্যাস। সত্মাঁদাল ও ভিক্টর হুগো আকাশের নীলিমা ও পথের পঙ্কিলতাকে প্রতিবিম্বনের পক্ষপাতী ছিলেন কথাসাহিত্যে। এই যুগেই আমরা দেখব কথাসাহিত্য ও চিত্রকলা পারস্পরিকতায় সমৃদ্ধ হল, চিত্রকলার প্রভাব পড়ল নানাভাবে কবিতায়, কথাসাহিত্যে; উলটোটাও ঘটতে শুরু করল। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় বিশ্বাস করতেন – ‘শিল্প সাহিত্য, নৃত্যনাট্য ইত্যাদির মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। এজন্যই সৌন্দর্য-সাধনার ক্ষেত্রে শিল্পের সঙ্গে সংগীতের, সংগীতের সঙ্গে নৃত্যের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়ে থাকে।… প্রত্যেক শিল্প যেমন ভিন্ন তেমনি শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রায় একই শক্তির উপলব্ধি হয়ে থাকে।’ তিনি মনে করেন – ‘শিল্পের ভাষা মূলত ভাবপ্রধান। ভাষার মধ্যে থাকে নিহিত সম্ভাবনা। শিল্পের ভাষা প্রকাশ পায় আকার ও ভঙ্গির আশ্রয়ে। শিল্প সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন আবেগ ও উদ্দীপনা। এ দুয়ের যুগপৎ মিশ্রণে সীমিত বাসত্মবতা বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে।’ অতএব আমরা বলতেই পারি, গড়ে উঠছে চিত্রভাষা, কথাসাহিত্য ভাষা, আবার এ দুটিই শিল্পভাষার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের পরবর্তী আলোচনার এটি এক চালিকাশক্তি। অবনীন্দ্রনাথ, আর এক চিত্রকর, বলেছিলেন রানী চন্দকে – ‘শিল্পী যে সে শুধু ছবিই আঁকবে কেন? তার সৃষ্টি যে দিকে যে রূপে ফুটে উঠবে সেই দিকেই সে যাবে।’ আমাদের আলোচনায় এটি আর এক প্রবণতার চিহ্নায়ক। Helmut Hatzfeld তাঁর Literature Through Art : A New Approach to French Literature (Oxford University Press, 1952) বইয়ে সাহিত্য ও চিত্রকলার পরস্পর সাপেক্ষতা নিয়ে বিসত্মৃত আলোচনা করেছেন। আমরা শুধু কথাসাহিত্য ও চিত্রকলার পরস্পর সাপেক্ষতা নিয়ে কিছু কথা এখান থেকে তুলে নেব এবং তার সঙ্গে আমাদের দেশজ উদাহরণ সংযোজন করব। ভিক্টর হুগো যুগপৎ কবি ও ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাত। গীতিকাব্যিকতার প্রকাশ হিসেবে, চিত্রকলার উদাহরণ হিসেবে হ্যাজফেল্ড বলেন, নেপোলিয়নের সারল্য সম্পর্কে যে-মিথ প্রচারিত তা কথাকার হুগোর ‘Lui’ কবিতায় ব্যক্ত, যে-সারস্যকথা ভেরনেট, গ্রস ও অন্যান্য চিত্রকরের সারল্য চিত্রণে (নেপোলিয়নের) প্রকাশিত। ফরাসি রোমান্টিকদের মনে নেপোলিয়নের দুঃসাহসের যে-অনুভব সেটাও ভিক্টর হুগোর কবিতার (Les châtiments) এবং আতোয়ান গ্রসের Napoleon at Arcole চিত্রে প্রতিফলিত। যেসব সৈনিক ওয়াটারলু-র যুদ্ধে সম্রাটের গৌরব রক্ষার্থে আত্মদান করেছে তা যেমন নানা চিত্রে, তেমনি হুগোর Les Miserables, সত্মাঁদালের La Chartreuse de Parme, থ্যাকারের Vanity Fair, এর্কমান চাট্রিয়াঁর ওয়াটারলু উপন্যাসে প্রতিফলিত। রোমান্টিক যুগের ফরাসি চিত্রকররা তাঁদের চিত্রকে সংবেদনার উৎসবে, রঙের কার্নিভালে মোহিত করতে চেয়েছেন, যা Gericault-এর নানা চিত্রে (The Raft of the Medusa, L’ Argus প্রভৃতি) আছে, তেমনি মেলে হুগোর Notre-Dame de Paris রচনায় (যেমন – কাঠের শাসিত্মসত্মম্ভে কোয়াসি মোদো চাবুক খাচ্ছে, অত্যাচারিত হচ্ছে বর্ণনায়)। ইউজেন দেলাক্রোয়ার Les Massacres de scio এবং হুগোর L’ Enfant gree (১৮২৯)-র বর্ণনা একই ধাঁচের। রোমান্টিকদের – চিত্রকর ও কথাকার – Local colour প্রীতিই পরে বাসত্মববাদের – The art of crude ও ইন্দ্রিয়মনস্ক ব্যক্তিত্বের ডিটেলে আগ্রহান্বিত করে। প্রতীক আন্দোলনের কালে চিত্র ও কথাসাহিত্য নতুন করে সামীপ্য অর্জন করে, রোমান্টিক যুগের প্রতিযোগিতা নতুন মাত্রা পায়। দ্যমিয়েরের ছবি ও বালজাকের বর্ণনা যেমন। দ্যমিয়েরের প্রতীকী সৃষ্টি সেরভামেত্মস দ্বারা কখনো প্রাণিত (যেমন – Don Quixote and Sancho Panza) তিনি প্রাত্যহিক জীবনের বর্ণনায় গভীর ভাবের দ্যোতনা দিতে পারতেন। দ্যমিয়েরের The Uprising ছবির বর্ণনা বালজাকের Le Pere Goriot উপন্যাসের Pension Vauquer মনে করিয়ে দেয়। দুজনেই প্রয়োগ করেন রোমান্টিক প্রতীকতা, যা সমসময়ের দ্বারা সৃষ্ট। বালজাকের Euge©nie Grandet উপন্যাসের গ্রাঁদে দ্যমিয়েরের চিত্র স্মরণে আনে। কৃপণ গ্রাঁদের সদৃশ চিত্র চিত্রকর Thomas Couture-কৃত L’Amour de l’or (১৮৪৩) স্মরণ করায়। হুগোর দারিদ্রে্যর চিরন্তনী Millet-অঙ্কিত The Reapers-এর সঙ্গে তুলনীয়। পারিবারিক চিত্রণেও মিলেটের কিছু ছবি তুলিত হতে পারে। (যেমন The First Step).

রোমান্টিক পর্বের পর শিল্পকলা সাহিত্যকে ব্যাপকতরভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। লেখকরা চিত্রণের পদ্ধতি অনুসরণ করতে লাগলেন। প্রথমত, চোখে পড়ে ন্যারেশন অপেক্ষা ডেসক্রিপশনের জয়গাথা। গুস্তাভ কুর্বের ধাঁচ আমরা পাব গুস্তাভ ফ্লোবেরের
কথাসাহিত্যে। প্রথমজনের Funeral at Ornans এবং দ্বিতীয়জনের বোভারির কবরদান তুলিত হয়ে থাকে। ফ্লোবেয়র অবশ্য বর্ণনাকে উপন্যাস সমগ্রতার সঙ্গে অন্বিত করেছেন। ভূদৃশ্যের আবহকে তুলে ধরার দৃষ্টান্ত বালজাকের Les Chouans রচনায়, ফ্লোবেয়র অবশ্য টুকরো দৃশ্য না এনে চিত্রের সামগ্রিকতায় নজর

দিতেন। যেমন মাদাম বোভারি উপন্যাসের এক স্থানে বসন্ত সায়াহ্ণের বর্ণনা (দ্বিতীয় খ-, ৬৪ অধ্যায়) সাহিত্যে ইমপ্রেশনিজম এলো কিছুটা প্রতীকিতা মিশিয়ে – আবহের মুখ্যতা, প্রসঙ্গ অপেক্ষা মূর্ছনা, অচেতন রূপান্তরণ, বাঙ্ময়তায় প্রাধান্য না দেওয়া, প্রকৃতি অভিঘাত উত্থাপনে সূক্ষ্মতা, ব্যঞ্জনা বিকাশ, অনেক সময় কার্যকারণমনস্কহীন বাক্য রচনা, পরিপ্রেক্ষেত রচনায় অস্পষ্টতা, আটপৌরে শৈলী, ক্রিয়াপদ দ্বারা ব্যাখ্যান অল্পতা ইত্যাদি। কুর্বের চিত্রলতা কখনো-কখনো মোপাসাঁর বর্ণনা মনে করিয়ে দেয় (যেমন – Pecheurs d’ Islande-তে অস্পষ্ট আলোয় উত্তর সমুদ্র বর্ণনা, Pierre et Jean-তে মাস্ত্তলের কাঠ, সমুদ্রকে নীল কাপড়) ইমপ্রেশনিস্টরা শহর চিত্রণে যে-নৈপুণ্য প্রকাশ করেন তা জোলার প্যারিস বর্ণনায়, L’ Assommoir-এর শোক মিছিল বর্ণনায় মেলে। রেনোয়া তাঁর Les Grands Boulevards all printemps চিত্রে যে-ধরনের আবহ নির্মাণ করেন তা ফরাসি বাসত্মববাদী উপন্যাসে লভ্য। (ফ্লোবেয়রের মাদাম বোভারি), মনের Cathedral of Rouen চিত্রের তুলনীয়তা জোলার Une Page d’amour উপন্যাসে প্যারিস বর্ণনায়। ইমপ্রেশনিজম মগ্ন জল, রোদ, স্পন্দন প্রভৃতিতে, তাঁরা এবং সতীর্থ লেখকরা বেছে নেন শিল্পীজীবন, সাহিত্যিক, সমালোচক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, মডেল, ক্যাবারে গায়িকাদের – প্যারিসের বোহেমিয়ানবৃন্দ। মাদাম বোভারির একটি বর্ণনা (তৃতীয় খ-, তৃতীয় অধ্যায়) সুরাট-অঙ্কিত রবিবারের বিকেল, যার বিষয় হলো La Grande Jatte (১৮৮৬)-এ।

প্রম্নসত্ম তাঁর Du cote© de chez Swann (দ্বিতীয় খ-) যে বিকেল সূর্যের আলো বর্ণনা করেন তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় কোনো চিত্রের কথা। রেনোয়ার Le moulin de la Galette (১৮৭৫) ছবিটি এবং মোপাসাঁর Pierre et Jean-এর বহুবর্ণিল টয়লেটের বর্ণনাসদৃশ। এ-ছবির ভদ্রলোকদের কথাবার্তা, নাচ যেন ফ্লোবেয়রের ভাষাবহ। ঘোড়দৌড় যেমন চিত্রকরদের তেমনি লেখকদের বিষয় করায় আকৃষ্ট করেছিল। গতিয়ের বা বোদলেয়রের শিল্প-ধারণা যেন সেজানের ছবিতে রূপ পায়। সাহিত্যও হয়ে উঠতে পারে পেন্টিংয়ের সহায়ক। রেনোয়ার বসন্ত বাগানের ছবি ফ্লোবেয়রের Luncheon of the Boating party, রেনোয়ার Le Moulin de la Galette ও ফ্লোবেয়রের Le bal de vaulyessard, কিংবা Seurat’s ও Edmond গোঁকুরের cirque বা রেনোয়া ও ফ্লোবেয়রের Theatre Box পরস্পরের নিবিড় নৈকট্য নিয়ে আজো বিদ্যমান।

নারায়ণ সান্যালের রেখা ও লেখা একই উৎসসঞ্জাত। দেলাক্রোয়া চিত্রিত করেন গ্যেটের ফাউস্ট। তুলুস লোত্রেক এবং রেঁদ ফ্লোবেয়রের কথাসাহিত্য বিচিত্রিত করার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার এঁকেছেন নিজের লেখা ঠাকুরমার ঝুলির ছবি। উপেন্দ্রকিশোর হাফটোন পদ্ধতিতে ছবি ছাপার পথিকৃৎ, অন্যদিকে তিনি গল্পকার এবং নিজ গল্পের ছবি আঁকিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ কবিতাটি সাদায়-কালোয় চমৎকার এঁকেছিলেন, কবিতাটিসহ তা মুদ্রিত হয়। সুকুমার রায় তাঁর পাগলা দাশু, লক্ষ্মণের শক্তিশেল
প্রভৃতি গদ্যের ছবি আঁকেন। তাঁর বিচিত্র বিষয়ের ছবি – ‘ট্যাঁশগরু’, ‘কুমড়ো পটাশ’, ‘রামগরুড়ের ছানা’। রবীন্দ্র সহজপাঠ সচিত্র করেন নন্দলাল বসু, জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সাত ভাই চম্পাকে চিত্রিত করেন, জীবনস্মৃতিরক্তকরবীকে চিত্রিত করেন গগনেন্দ্রনাথ। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই সচিত্র করেছেন – সে গল্পগ্রন্থ। কল্পনার উৎস যখন এক লেখা ও ছবির ভিন্নতা অনেক ক্ষেত্রেই
রচনা-আস্বাদকে প্রত্যাশিত পূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়।

চিত্রকররা ছবিতে ধ্যান-নিমগ্ন থাকলেও গান শোনেন, গল্প পড়েন, কেউ-কেউ গল্পও লিখে ফেলেন। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের চিত্রনিরীক্ষা সকলের কাছে
পরিচিত, তাঁর কত্তামশাই গল্পগ্রন্থটি অবশ্য ততটা পরিচিত নয়। শ্রম্নতি-লিখিত গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এক্ষণ শারদীয় সংখ্যা ১৩৭৯-তে। তিন অংশে বিভক্ত এই গল্পটি স্পষ্টত আত্মজৈবনিক, অন্ধ হয়ে যাওয়া এক শিল্পীর আত্মদীর্ণ, শিল্প-সাধনার গল্প। এক অর্থে philosophic story, প্রথমাংশে রুদ্রনারায়ণ বা কত্তামশাই অনুভব করেন চারদিকে ‘এতো অন্ধকার’ সব আলো জ্বালা, কিন্তু তিনি দেখতে পান না। এখানে আছে split personality রুদ্রনারায়ণ ও কত্তামশাইয়ের কথা। নতুন জগতে অভিযান শুরুতে মানুষের কোলাহলে এক উজ্জ্বল গোল আলো ভাসে, যা অবসাদ আনে। চাকর শ্যামের সান্নিধ্যে কথাবার্তায় বাইরের জগৎকে জানার চেষ্টা। ফুল স্পর্শ করে কোমল আকার সম্পর্কে ধারণা। আসেত্ম-আসেত্ম ক্রোধ প্রশমিত হয় – ‘অন্ধকারজগতে প্রাণের স্পন্দন, নতুন সৌন্দর্য তাঁর হাতের আয়ত্তে আসে।’ আয়নায়, নগ্ন নারীমূর্তির সামনে অবচেতন বাসনা, চরিত্রটিকে রক্তমাংসল করে তোলে। শ্যাম ও কত্তামশাই দুজনেই মোমের পুতুল গড়ে। চাটুজ্জে চরিত্রটিকে আনা হয় বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য, সাধু চরিত্রটিও তাই। প্রথমজনের ছেলে অ্যাকসিডেন্টে মৃত। দ্বিতীয় অংশে অনেক দিনের ব্যবধানে কত্তামশাই। শ্যামের বয়স বৃদ্ধি, নারী আকর্ষণ পস্নটের বৈচিত্র্য আনে। নতুন চাকর কেষ্ট আসে। নিয়তির সঙ্গে কথোপকথন গল্পটিকে philosophic করে তোলে, বার্গম্যানের চলচ্চিত্রের মতো। কত্তামশাই ‘শাশ্বত সৃষ্টি’তে নিমগ্ন, বিপুল আনন্দে ভুলে যান মৃত্যুভয়। তৃতীয় অংশে সৃষ্টির নতুন কৌশল ক্রম প্রসারিত। কত্তামশাই ভেসে যায় আকারহীন-বর্ণহীন অসীম শূন্যতার মধ্যে। গল্পটিকে আকর্ষণীয় করার জন্য – পস্নটের বৈচিত্র্য, উপমার নবীনত্ব, এমনকি প্রবচন ব্যবহার। ‘হাতের পাতা খাবি খাওয়া মাছের মতো’, ‘ভাবের মাছি ভনভন করে ঘুরে বেড়ায়’, ‘বউ রেঁধেছে ঝালের ঝোল/ খেতে যেন গুড় অম্বল। চমৎকার প্রকাশ। অনুরূপ শ্রম্নতি গল্প ‘কীর্তিকর’ বেরিয়েছিল জয়শ্রী বৈশাখ ১৩৮১-তে।

লিওনার্দোর নোটবুকসে চিত্রকলা সংগীত কবিতার পাশে আছে অনেক গল্প, যা জীবজন্তুবিষয়ক, নীতিমূলক, বিদ্রূপাত্মক, রূপকধর্মী। এই সকল রচনা সামাজিক অনুষ্ঠানে পঠন বা আবৃত্তির জন্য। এসব গল্পের ভাষা সহজ-সরল, যাতে হাস্যরস উচ্ছ্রিত, তা সংক্ষিপ্ত অথচ মর্মভেদী। বাংলা ঘরানার শিল্পী অসিতকুমার হালদার নিবেদন করেছিলেন রাজগাথা (ইন্ডিয়ান প্রেস লিমিটেড, ১৩৫৬)। এখানে প্রাচীন রাজপুতদের রাজগাথাকে তিনি কথারূপ দিতে চেষ্টা করেন। বইটি টডের রাজস্থান বইটি থেকে উপকরণে সমৃদ্ধ, রেখাচিত্র আছে ১৭টি। এছাড়া অসিতকুমার অবনীন্দ্রের রাজকাহিনি, অ্যানিবেশামেত্মর The Sweet Singer of Rajputana নামক মীরা বাইয়ের গল্পও চিত্রিত করেন। অসিত হালদার রাজপুত মহান ব্যক্তিত্ব নিয়ে (যথা শিলাদিত্য, বাপ্পাদিত্য প্রভৃতি) কবিতা লিখেছিলেন। আমরা উলেস্নখ করতে পারি প্রখ্যাত ভাস্কর, চিত্রী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর কথা। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শেষের কবিতা উপন্যাসে কিছু চিত্র উদাহরণ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ১৯২৪-এ লেখা ‘আমার বাবা’ রচনায় তিনি চরিত্র চিত্রায়ণে সাহসী প্রকাশের পরিচয় দেন। দেবীপ্রসাদ পিশাচ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। তাঁর তিনটি গল্পের বই আছে – বলস্নভপুরের মাঠ, বুভুক্ষু মানব, মাংসলোলুপ। কিছু গল্প কলেস্নাল প্রভৃতি পত্রিকায় বেরিয়েছিল। গল্পগ্রন্থে গল্পের সঙ্গে তিনি ছবিও দিয়েছিলেন। প্রখ্যাত চিত্রকর পরিতোষ সেন লিখেছিলেন – জিন্দাবাহার, যাতে আছে ৯টি গল্প – দর্জি হাফিজ মিঞা, সিন পেন্টার জিতেন গোঁসাই, ডেন্টিস্ট আখতার মিঞা, প্রসন্নকুমার, আমি, আগুন, নবাবু সেজোবাবু, হে অর্জুন, জামিলার মা। এর সঙ্গে আছে ৯টি ছবি, নিজের আঁকা। পরিতোষ বলেন – ‘তাই মনে হল শব্দ দিয়ে প্রতিকৃতি রচনা করলে কেমন হয়। এই বইটি সেই প্রয়াসেরই ফল। সৃষ্টির রহস্য আমাকে প্রতিনিয়তই বিস্মিত করে। চিত্রকরের দৃষ্টিতে আমি তা প্রতি জাগ্রত মুহূর্তে অনুভব করে থাকি।’ আগুন ও হে অর্জুন আমার এ অনুভবেরই অভিব্যক্তি। তাঁর বর্ণনাশৈলীর অনুপম দৃষ্টান্ত – ‘এক হাতে গেরুয়া রঙের খুরি, অন্য হাতে লম্বা একটি তুলি। আবার চুপ। দেখি হাঁটু অবধি নামানো হাতের তুলিটি নড়াচড়া করে উঠে শূন্যে কী সব আবোলতাবোল রেখা টানছে। কোন মুহূর্তে হাতটি উঠে যে সাদা পর্দায় দাগ কাটতে আরম্ভ করেছে তা যেন তিনি টেরও পেলেন না। কখনো সরল রেখা, কখনো বক্র, কখনো ডাইনে, কখনো বাঁয়ে, কখনো নিচে, কখনো ওপরে, পরপর রেখা পড়তে থাকল। লাফ দিয়ে টুলের ওপর উঠে পর্দার ডগায় ও এদিক-ওদিক সব রেখা টানলেন – যেমনই বলিষ্ঠ আর তেমনই ঋজু। তড়াক করে নেমে তুলি খুরি রেখে তামাক সাজলেন।’ (সিন পেন্টার জিতেন গোঁসাই) আর একটি উদাহরণ – ‘ঢাকা জেলায় আমাদের গ্রামের কথা মনে এলেই চোখের সামনে একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবি ফুটে ওঠে। আগাগোড়া সবুজ রঙ দিয়ে আঁকা। নানা রকমের সবুজ থাকে থাকে সাজানো। অনেকটা নামকরা আধুনিক মার্কিনি আর্টিস্ট মার্ক রথকো-র আঁকা ছবির মতো। এককথায় বলা যায়, সবুজের সমুদ্র।’ (হে অর্জুন) দ্বিতীয় উদাহরণে আছে প্রকৃতি-বর্ণনায় আধুনিক শিল্পীর দৃষ্টান্ত তুলনা। কখনো সে-ভাষা জীবনানন্দকে স্মরণ করিয়ে দেয় – ‘হে সময়, হে সূর্য, হে মাঘ-নিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া, আমাকে জাগাতে চাও কেন।’

অন্যদিকে সাহিত্যিকরা শিল্পী-মানসের আগ্রহ পরিপূর্তির জন্য কখনো-কখনো চিত্রচর্চা করেছেন। আমরা এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের চিত্রচর্চাকে সর্বাগ্রে উলেস্নখ করব। প্রৌঢ়ত্বে রবীন্দ্রনাথ চিত্রচর্চার ব্যাপকতায় নেমেছেন, আলোচকরা সেইসব শিল্পকর্মকে যেমন বিশ্বচিত্রকলা ঐতিহ্যে বরণ করে নিয়েছেন, কখনো জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের তুলনীয় মনে করেছেন অথবা রবীন্দ্রসাহিত্যে যেসব মনোভাব অব্যক্ত তার আভাস আবিষ্কার করেছেন। বিচিত্রিতা বইটির কথা উলেস্নখ করতে পারি, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ১২ জন শিল্পীর ৩১টি ছবি সামনে রেখে ৩১টি কবিতা লিখেছেন; যে-প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষ বলেছেন এ যেন উলটোরকম illustration বা ছবিকে কথা দিয়ে দেখা। বনফুল ছবি এঁকেছেন, তারাশঙ্কর ছবি এঁকেছেন সে-প্রসঙ্গও উলেস্নখ করতে পারি; যদিও বনফুল বা তারাশঙ্করের ছবি ঠিক মাত্রা অর্জন করতে অনেক সময়ই সফল হয় না। সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র পরিচালক হলেও সাহিত্যিক হিসেবে সুবিখ্যাত। তাঁর অনেক-অনেক ছবি আমরা দেখেছি নিজের লেখার ইলাস্ট্রেশন হিসেবে, কখনো অন্যের লেখায়, সন্দেশ পত্রিকার পাতায় তার পরিচয় ধরা আছে। তাঁর অসংখ্য প্রচ্ছদ বাংলা চিত্র ঐতিহ্যে উলেস্নখযোগ্য এ-কথা সবাই জানেন। আম আঁটির ভেঁপু বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর একাংশ অবলম্বনে কয়েকটি প্রসিদ্ধ ইলাস্ট্রেশন চিরস্মরণীয়। কমলকুমার মজুমদার উপন্যাস বা গল্প লিখেছেন এবং একই সঙ্গে প্রচুর ছবি, প্রধানত ওয়াটারকালার, এঁকেছেন, যার একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে। ঈশ্বর গুপ্তের এবং প্রচল ছড়ার সঙ্গে ছবি বা কাঠখোদাই তাঁর চিত্রচর্চার আশ্চর্য নমুনা বটে। এক সময় দেশ পত্রিকায় তিনি একাধিক চিত্রপ্রদর্শনীর রিভিউ করেছেন, যদিও আজো সেগুলো গ্রন্থিত হয়নি। বাঙলার মনোলোক ও অন্যান্য চিত্র এবং বঙ্গীয় শিল্পধারা ও অন্যান্য প্রবন্ধ এই দুটি বই তাঁর চিত্র-পা–ত্যের নিদর্শন। তাঁর আঁকা ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায় যে, তাঁর রং ব্যবহারে স্বকীয় পদ্ধতি ছিল যথেষ্ট

উন্নতমানের। হালকা রং ব্যবহারই তিনি পছন্দ করতেন এবং তার বিন্যাস ছিল পরিপূর্ণ ক্লাসিক্যাল পদ্ধতির। বাংলার লোকশিল্প হিসেবে পুতুল, কাঁথা ও পট ছিল তাঁর একান্ত প্রিয় এবং ঢোকরা কামারদের পিতলের কাজও তাঁর কাছে আদরণীয় ছিল। লৌকিক রীতি বজায় রেখে আধুনিকতা নির্মাণে তাঁর পারদর্শিতা পেয়েছে স্বীকৃতি। প্রখ্যাত চীনা কথাসাহিত্যিক লু সুন চীনা ছবি নিয়ে লিখেছেন, রোমা রোলাঁ মাইকেল এঞ্জেলোর জীবনী লিখেছেন। ফরাসি কথাসাহিত্যিক আঁদ্রে মালরো লিখেছিলেন The Voice of Silence (১৯৫১), যা শিল্প ইতিহাস ও আলোচনা হিসেবে খ্যাত। মালরো অতীত চিত্র ঐতিহ্যের বৈচিত্র্যকে রসজ্ঞের কাছে তুলে ধরেছেন, শিল্পী কীভাবে শিল্পৈষণায় বিজয়মনস্ক তা দেখান গ্রিস এবং নবজাগরণের ইউরোপে মানুষ চিত্র ও ভাস্কর্য দ্বারা মানব-মহিমাকে সমুজ্জ্বল করে তুলে ধরেছে। চিত্রকলা তার বর্ণবৈভব ও ফর্মের বিস্ময় দিয়ে ভাগ্যকে অতিক্রম করে গিয়েছে। বিশৃঙ্খলা, ঔদ্ধত্য, মৃত্যু পরিকীর্ণ জগতে শিল্প প্রতিষ্ঠা দিয়েছে মানব মহত্ত্বের।

চিত্রকর ও কথাসাহিত্যিকদের পারস্পরিক সখ্য ও বিরাগ আবেদন রচনার ঐতিহ্য ফরাসি দেশে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। জোলা ও ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকরদের সম্পর্ককথা স্মরণীয়। জোলা গল্প-উপন্যাস লেখা ছাড়াও ছিলেন আর্ট ক্রিটিক। মানে এবং সেজানের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল যথেষ্ট। জোলা ও সেজান স্কুলজীবনের বন্ধু। তবে জোলা পরে মানের ছবি বেশি পছন্দ করতেন। ইমপ্রেশনিস্টদের নিয়ে তাঁর একাধিক প্রবন্ধ চিত্রকরদের প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সাহায্য করেছে। পরিণত বয়সে বাল্যবন্ধু সেজানের যে-ছবি L’ Oeuvre উপন্যাসে আঁকেন এক অশান্ত ও ব্যর্থ চিত্রী হিসেবে তা সেজানকে মর্মাহত করে। বালজাক ও রদ্যাঁর সম্পর্কও এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয়। রদ্যাঁর বালজাক ভাস্কর্য এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। রিলকে ও রদ্যাঁর সম্পর্কও এখানে উলেস্নখ্য। পরাবাসত্মববাদী ও দাদাপন্থীদের মধ্যে লেখা ও ছবি চর্চার যুগপৎ প্রবণতা মনে রাখার মতো। পরাবাসত্মব-তত্ত্বের উদ্গাতা আঁর্দ্রে ব্রেঁত উপন্যাস লিখেছিলেন। আমাদের দেশে চলিস্নশের দশকে আইপিটিএর আমলে কবি ও চিত্রকরদের পারস্পরিকতা ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ। সুকান্তর কবিতাকে মোহনীয় দীপ্তিদানে দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের স্কেচগুলো গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা নিয়েছিল। বিষ্ণু দে ছবি আঁকেননি বটে তবে যামিনী রায়ের সঙ্গে তাঁর সৌহার্দ্য বহুশ্রম্নত। তিনি যামিনী রায়ের ওপর পুরো একটি বই লিখেছেন, যামিনী রায়ও বিষ্ণু দে-র অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন। বিষ্ণু দে-র ‘চড়ক ইস্টার ঈদের রোজা’ এই দীর্ঘ কবিতাটি যামিনী রায়ের জন্মদিন উপলক্ষে লেখা। এ-কবিতায় আছে বিশ্বপটভূমির উত্থাপন ও সে-সম্পর্কে কবির মতামত। চতুর্দিকে ঘৃণার অগ্নিযজ্ঞের মাঝে আনন্দরূপমমৃত সন্ধান করেছেন কবি। ‘বিদেশীর চোখে যামিনী রায় ও তাঁর ছবি’ প্রবন্ধে বলছেন – ‘যামিনী রায়ের চিত্রের চিত্রধর্মনির্দিষ্ট শুদ্ধতাই বোধহয় তাঁর চিত্রসাধনার সবচেয়ে বড় কথা। আর তাঁর কাজের অবিশ্রাম বৈচিত্র্য বিস্তার।’ ১৮৭৪-এ মানের ছবি প্রত্যাখ্যাত হলে এগিয়ে আসেন মালার্মে এবং জোলা। মানে প্রায়শ চিঠি লিখতেন। ১৮৬৬, ৭ মের চিঠি জোলাকে তাঁর ৭ মে, ৪ মের শিল্পবিষয়ক প্রবন্ধ পড়ে। বুকলেটের প্রচ্ছদ সম্পর্কে ১৮৬৬, ১৫ অক্টোবর, ১৮৬৭ ফেব্রম্নয়ারি-মার্চের চিঠি। Therese Raquin-এর দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা পড়ে মুগ্ধ হয়ে লেখক শিল্পীগোষ্ঠীর অন্যতম হিসেবে বরণীয় মনে করেন, জোলার Madeleine Ferat পড়ে মুগ্ধ হন, Therese Raquin-এর নাট্যরূপের প্রশংসা করে বলেন, এটা একটা Masterly piece of writing. ১৮৭৩, ১৭ ফেব্রম্নয়ারি ও এপ্রিলের চিঠিতে বলেন – আপনার শেষতম বইটি পৌঁছেছে, বেশ ভালো দেখতে, যথেষ্ট প্রতিশ্রম্নতিপূর্ণ মনে হচ্ছে। জোলার জার্মিনাল বেরোনোর চার সপ্তাহের মধ্যেই বইখানি ভ্যান গঘের হাতে পৌঁছে যায় এবং অতঃপর তাঁর ছবির ভেতরে ঔপন্যাসিকের মৃণ্ময় জগৎ কীভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সে-কথা ভাইকে চিঠিতে লেখেন। আর একটি চিঠিতে ভ্যান গঘ বলেন – জোলার ধরিত্রী (La Lerre) পড়ে চাষির ছবি আঁকি, তখন এটাই দেখাতে চাই, এসব বই পরিণামে আমাদের বাঁচারই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। কথাকার স্যাঁ-স্যুপ্যেরির ভাষায় ভ্যান গঘ ‘বহুবিধ সম্পর্কের একত্রীকরণের রূপকার।’ জার্মান কথাসাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস উপন্যাস নাটক কবিতা প্রবন্ধ লেখা সত্ত্বেও ভাস্কর্য রচনা করেছেন, ছবি এঁকেছেন, তাঁর ছবির একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে। সে-প্রদর্শনীতে ছিল আশিটি এচিং, বিয়ালিস্নশটি লিথোগ্রাফ, ছিয়ানববইটি ড্রইং, সাতাশটি স্কাল্পচার। গ্রাস বলেন – আমার ড্রইংস আমাকে শেখায় লেখার জন্যে আসলে প্রয়োজন কত কম কথার। আবার কবিতা আমাকে জানায় শিল্পী হিসেবে আমি কীভাবে পাঠোদ্ধার করব না-বলা বাণীর।

পূর্ণেন্দু পত্রী বলেন (সাহিত্যের ছবি আর ছবির সাহিত্য) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোতে দেখা যাবে ছবি কীভাবে হয়ে ওঠে উপন্যাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আলফ্রেড কাজান বলেন (অ্যান আমেরিকান প্রসেসন) গাট্রুর্ড স্টেইনের পেইন্টিং কালেকশন না দেখে, তাঁর সঙ্গে পেইন্টিং বিষয়ে কথাবার্তা না বললে হেমিংওয়ের প্রতিভার যথাযোগ্য স্ফুরণ হতো না। প্রখ্যাত লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যিক আলোহা কার্পেমিত্ময়ের ছিলেন স্থাপত্য বিশেষজ্ঞ, কিউবার স্থাপত্য মহাকোষের সম্পাদক। তাঁর উপন্যাসে এই চিত্রজগতের আলো-আঁধারির খেলা মাঝেমধ্যেই ছায়া ফেলেছে। পরিতোষ সেন তাঁর আবু সিম্বাল, পিকাসো ও অন্যান্য তীর্থ রচনায় রুশোর ছবির নেশা, সংগীতের পাগলামির কথা বলেছেন, পোর্ট্রেট আঁকার লক্ষ্য যে মডেলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটুকু বজায় রেখে রঙের নির্বাচন, ডিজাইন ও ফর্মের স্বাধীনতা নেওয়ার কথা বলেছেন। নীরদ মজুমদার তাঁর পুনশ্চ পারী বইতে বোদলেয়রের কবিতার কথা বলেন, জাক প্রেভেরের ‘প্রতিকৃতি আঁকা’ কবিতাটি পুরো অনুবাদ করে দেন, ন্যাচারালিস্ট জোলার ড্রইংয়ের কথা বলেন, ককতোকে বলেন – আপনার ছবি দেখে আমার মনে হয় প্রথমে আপনি কবি, দ্বিতীয় দফায় চিত্রকর, তৃতীয় দফায় নাট্যকার এবং অবশেষে জগদ্বিখ্যাত ফিল্মমেকার। নীরদবাবুর লেখা থেকে জানতে পারি, ভালেরি নিজেও ছবি আঁকতেন, ভালো স্কেচ করতেন। নীরদবাবুর ভ্রমণসঙ্গী ছিল শঙ্করের আনন্দলহরী এবং ফরাসি কবিতার একটি সংকলন।

এবার আমরা আলোচনার দ্বিতীয় পর্যায়ে যাচ্ছি। শুরু করি বঙ্কিমচন্দ্রকে দিয়ে। বঙ্কিমের মনোযোগ দাবি করেছে ছবি এবং ভাস্কর্য দুটোই। বঙ্গদর্শনে (কার্তিক-চৈত্র ১২৮১) লালমোহন শর্মা-স্বাক্ষরিত ‘ভারতবর্ষীয় আর্যজাতির আদিম অবস্থা’ নিবন্ধে আর্যজাতির চিত্রনৈপুণ্য দৃষ্টান্তসহ বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশ পেল। ‘আর্যজাতির সূক্ষ্ম শিল্প’ প্রবন্ধে বঙ্কিম বাঙালির শিল্প ঔদাসীন্য বা সৌন্দর্য সম্বন্ধে চৈতন্যের অভাব প্রসঙ্গ বিশেস্নষণ করেন। দুর্গেশনন্দিনীতে (১৮৬১) প্রকৃতি ও নারীর শোভা বর্ণনায় তাঁর নৈপুণ্য চিত্রকরসুলভ। বঙ্কিমের মন কবির, দৃষ্টি চিত্রশিল্পীর। বিশেষণাত্মক শব্দে গড়ে তুলেছেন আকারমাত্রিক রেখাভঙ্গি। প্রথম উপন্যাস থেকেই বঙ্কিম চিত্রমনস্ক। মেহেরউন্নিসা কবিতা রচনায় চিত্রলিখনে সকলের মন মুগ্ধ করতেন। সে আপন মনে ছবি আঁকে, মতিবিবির কাছে ছবির গুণাগুণ যাচাই করে। মৃণালিনীতে (১৮৬৯)ত মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণগৃহে দুটি তরুণী কক্ষপ্রাচীরে আলেখ্য লিখছিল। পদ্মসরোবরের মোটিফ ভারতীয় শিল্পে প্রিয় প্রসঙ্গ, বঙ্কিমের কাছেও, ‘বিদ্যাপতি ও জয়দেব’ প্রবন্ধে জয়দেবের কবিতা প্রসঙ্গে পদ্মপ্রসঙ্গ ব্যবহৃত। বিষবৃক্ষ উপন্যাসে ‘সিত্মমিত প্রদীপে’ শীর্ষক অধ্যায়ে বঙ্কিম নগেন্দ্রর শয়নকক্ষে সজ্জিত চিত্রাবলির বিসত্মৃত বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে আছে ইংরেজ শিষ্য জনৈক দেশি চিত্রকরের কথা, যিনি আসলে আর্ট স্কুলের ছাত্র অন্নদাপ্রসাদ বাগচী। শ্যামাচরণ শ্রীমানী-রচিত সূক্ষ্ম শিল্পের উৎপত্তি ও আর্যজাতির শিল্পচাতুরী (১৮৭০) বাংলায় লেখা প্রথম শিল্পপুসত্মক, অভিভূত হয়ে বঙ্গদর্শনে বঙ্কিম এর আলোচনা করেন। শ্যামলী চক্রবর্তী মন্তব্য করেন – ‘বঙ্কিমের বিশেষত্বই এই যে তাঁর রচনার প্রায় সর্বত্র শিল্প-প্রসঙ্গ বা চিত্রসজ্জাকে কাহিনির বিষয়ের সঙ্গে, ভাবের সঙ্গে বা পরিপার্শ্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী মিলিয়ে দিয়েছেন।’ রজনী উপন্যাসে যে ‘সেক্সপিয়র গেলেরি’র কথা আছে তা বঙ্কিমকে অনুপ্রাণিত করে থাকবে। বিষবৃক্ষে নগেন্দ্র-কক্ষ বর্ণনায় কালিদাস গ্যালারি স্বগোত্রীয়। আনন্দমঠে দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামে প্রবল মন্বন্তরে ঘরের দেয়ালের আলপনাটি মস্নান হয়নি, উলেস্নখ আছে। ‘শকুন্তলা মিরন্দা ও দেস্দিমোনা’ প্রবন্ধে বঙ্কিম চিত্রপ্রসঙ্গ ব্যবহার করেন চরিত্রায়ন প্রসঙ্গে – ‘শকুন্তলা চিত্রকরের চিত্র, দেস্দিমোনা ভাস্করের গঠিত সজীবপ্রায় গঠন।’ ভারতীয় মিনিয়েচার ছবির সঙ্গে বঙ্কিমের পরিচয় হয় এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহ ও আর্ট স্কুলসংলগ্ন ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের মাধ্যমে। ভারতীয় বর্ণমালা চিত্রের সঙ্গেও যে তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন তাঁর প্রমাণ বঙ্কিমের টোড়ি রাগিণীর রূপবর্ণনা। ১২৭৯-র বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত ‘সঙ্গীত’ নিবন্ধে এই প্রাচীন ভারতীয় রাগিণীর ধ্যানরূপ বিবরণ এবং রাগপুত্রপুত্রীর চিত্ররূপের নিহিত তাৎপর্যের বিশেস্নষণ রয়েছে। মৃণালিনী চরিত্র বর্ণনায় বঙ্কিম লিখছেন – ধৈর্যশীলা প্রকৃতি-প্রাসাদে মৃণালিনী হেমচন্দ্র মুখে-মুখে দাঁড়াইলেন, যেন ‘অবিকল পাহাড়ি কলমের রাধাকৃষ্ণের যুগলমিলন।’ উদয়গিরি খ-গিরির মৃত্তিকা-প্রোথিত ভগ্ন মৃত্তিকা ও প্রসত্মর মূর্তিতে বঙ্কিম আবিষ্কার করেন প্রাচীন মহীয়সী কীর্তি। সীতারাম উপন্যাসে (১৮৮৭) ১৩শ পরিচ্ছেদে আছে ললিতগিরি উদয়গিরির কাব্যিক বর্ণনা। ‘শ্রী’ ও ‘জয়মত্মী’ চরিত্রদুটিকে লেখক নিয়ে যান উড়িষ্যার সেই গিরিগুহায়। বলা চলে শিল্পের নানা শাখায় ছিল তাঁর আগ্রহ, পটচিত্রে দুর্বলতা, ভাস্কর্যের সুসামঞ্জস্যে গঠনবিন্যাসে মুগ্ধতা। বর্ণবৈপরীত্যের চমৎকার উদাহরণ – ‘শ্যাম সলিলে শ্বেত মুক্তাহার’ (ইন্দিরা), ‘দ্বিরদশুভ্র স্কন্ধদেশে সুবর্ণ পুষ্পশোভিত নীল উত্তরীয়’ (যুগলাঙ্গুরীয়)।

রবীন্দ্রনাথ, আগেই বলেছি, জীবন অপরাহ্ণে চিত্রকলার অবিরাম স্রোতে মানুষকে মুগ্ধ করেছিলেন। নন্দলাল বসুর আঁকা এক ছাগলের ছবি দেখে প্রশসিত্ম কবিতা লিখে ফেলেন (ছবি আঁকিয়ে – ছড়ার ছবি), চোখের বালির ভূমিকায় আছে – ব্রোঞ্জ কাস্টিংয়ের উপমা। লিপিকার ‘সিদ্ধি’ কবিতায় জনৈক কাঠকুড়োনি মেয়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন – ‘যেন সে এমন একটা ছবি যা কেবল রেখায় টানা ছিল, চিত্রকর কোন্ খেয়ালে কখন এক সময়ে তাতে রঙ লাগিয়েছে।’ রবীন্দ্রসাহিত্যে চিত্রচর্চার প্রভাব আছে নানাভাবে। যেমন –
ক) অর্থবন্ধনহীন রচনা – কখনো সারিবদ্ধ ছবি খ) ভাষার উদ্ভটত্ব – সাধু, চলিত (গল্পসল্প – বাচস্পতির প্রসঙ্গ) – ‘পাঠশালার পেডেন্ডোকে দেখলেই তাঁর আনতারা যেত ফুসকলিয়ে। বুকের ভিতরে করতে থাকল কুড়ুক্কুর কুড়ুক্কুর কুড়ুক্কুর। এমন ছেলেকে বেশি পড়ালে সে একেবারেই ফুসকে যাবে।’ গ) তুচ্ছতার স্থান (তুলনীয় অবনীন্দ্র রচনা) ঘ) ভাষায় স্কেচ – ‘এদিকে বেলা বেড়ে যায়; ব্যসত্ম গৃহিণীর আঁচলটার মতো বাড়িগুলোর কাঁধের উপর থেকে রোদ্দুর খানা গলির ধারে খসে পড়ে।’ গলি, লিপিকা। প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায়, নিসর্গদৃশ্য ও জীবজন্তু বর্ণনায় চিত্রে এসেছে কল্পনার অতিরেক। প্রথম পর্যায়ের মুখাকৃতিতে বাল্য কৈশোর স্মৃতিলোকের অধিবাসীদের ছাপ আছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের মুখাকৃতিতে কল্পনার প্রাধান্য ও অতিরেক। স্বীকার্য অ্যাকাডেমিক ড্রইংয়ে ছিল অনৈপুণ্য। অন্যদিকে সাহিত্যে মুখ বর্ণনা – গোরা – ললিতা প্রসঙ্গে (১৫শ অধ্যায়) গোরা – সুচরিতা প্রসঙ্গে (২০ অধ্যায়) কুমু  (যোগাযোগ) সরলা (মালঞ্চ) প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে স্মরণীয়। ছবি আঁকার নিজস্ব পথ নির্মাণে আগেই বলেছি এক্সপ্রেশনিস্ট দ্বারা কথা মনে পড়ে। রবীন্দ্রসাহিত্যে শিল্পীচরিত্র প্রসঙ্গে সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন ‘চিত্রকর’ গল্পের কথা। পুনশ্চ কাব্যের ‘রঙ রেজিনী’ কবিতার কথা। সে বইয়ের সুকুমারের কথা যে ‘চাইলে ছবি আঁকা শেখে নন্দলালবাবুর কাছে।’ সে দশ বছর ধরে ছবি আঁকা অভ্যাস করেছে বিলেতে, কাউকে দেখায়নি। রবিবার গল্পের অভীককুমার শিল্পী, যে ছবির আঁকার শখ চরিতার্থ করতে গিয়েছিল সরকারি আর্ট স্কুলে কিন্তু বুঝল এখানে বেশিদিন শিখলে ‘ওর হাত হবে কলে তৈরি, ওর মগজ হবে ছাঁচে ঢালা।’ কাগজে বলল অভীককুমার বাঙালি টিশিয়ান। অভীক গর্জন করে বলে সে আর্টিস্ট, যা লোকের ফাঁকা মনের গুহায় প্রতিধ্বনি তুলল। হাতে টাকা জমলে সে অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে পূর্ণ পরিস্ফুট আর্টিস্টরূপে বোহেমিয়ানি করতে লাগল। প্রণয়িনী বিভাকে অভীক মনে করে ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ছবির সঙ্গেই মেলে।’ গল্পসল্পর ‘পট’ রচনায় ‘অভিরাম দেবদেবীর পট আঁকে, যে-ঘরে সে পট আঁকে তা তার ঠাকুরঘর। এই বইয়ের ‘নতুন পুতুল’ গল্পে আছে দুটি শিল্পী-চরিত্র – এক গুণী প্রবীণ পুতুল বানায় রাজকন্যাদের জন্য, আর একজন তরুণ যে কিছু গড়ে কিছু গড়ে না, কিছু রং দেয় কিছু বাকি রাখে। ‘ভুলস্বর্গ’ গল্পের বেকার লোকটা ঝিনুকের যে সাজসজ্জা করে তা দেখে এলোমেলো ছবি মনে হয়। রবীন্দ্র-সৃষ্ট শিল্পীরা অল্পবিসত্মর ভাগ্যবিড়ম্বিত, ‘চিত্রকর’ গল্পের নায়িকা সত্যবতীর মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে শিল্পীর এক আশ্চর্য বলিষ্ঠতা। জাপানযাত্রীতে আছে চিত্রোপম নিসর্গ বর্ণনা (২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৩), সে-তে আছে রহস্যভরা ল্যান্ডস্কেপ (১নং)।

আরভিং স্টোন শিল্পী ও বরেণ্যদের জীবনী উপন্যাস রচনার জন্য অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে আছেন। তাঁর Agony and the Ecstasy (১৯৬১) উপন্যাসটি মাইকেল এঞ্জেলোর জীবননির্ভর, আছে সমসাময়িক সময়, নবজাগরণ, রাজকুমারকে বিষদান, দ্বন্দ্বরত পোপবৃন্দ, শক্তিমান মিডিচি পরিবার, ক্ষ্যাপা সন্ন্যাসী শোভনার্দা প্রভৃতির কথা। মাইকেল এঞ্জেলোর প্রেম রুগ্ণ লোরেঞ্জোকন্যার প্রতি, মার্কো আল্ডোভ্রান্ডির প্রতি, শেষ প্রেম অসুখী ভিত্তোরিয়া কোলোন্নার প্রতি। ঈশ্বর-আদিষ্ট প্রতিভা নিয়ে তিনি মহত্তম শিল্প রচনা করেছিলেন। মাইকেল এঞ্জেলো বিখ্যাত ডেভিডের মূর্তি নির্মাণে সিস্টিন চ্যাপেল চিত্রায়ণে বিখ্যাত হয়ে আছেন। এছাড়া সেন্ট পিটারের গম্বুজ নির্মাণ করেন। ৭৭৭ পৃষ্ঠার বইতে উপন্যাসটি বিন্যসত্ম। শেষে আছে নোটস ও গ্রন্থপঞ্জি। তাতে উলিস্নখিত অজস্র বই, শিল্প-কৌশল, শিল্প-ইতিহাস কথা। মূল রচনার সহায়তার কথা যেমন আছে তেমনি আছে একটি প্রয়োজনীয় শব্দ টীকা তালিকা (যেমন মাদ্রে মিয়া, মাম্মা মিয়া – মায়ের আদরের সম্ভাষণ, পালাজ্জো (রাজপ্রাসাদ) পস্নাজা (চত্বর)

ইত্যাদি। মাইকেল এঞ্জেলোর কাজগুলি কোথায়-কোথায় গেলে দেখতে পাওয়া যাবে, কবে সেগুলি তৈরি সেসব কথাও আছে। ১১টি অধ্যায়ে বিন্যসত্ম এই সুবৃহৎ উপন্যাসটি শিল্পীজীবন কথা তথা ইতিহাস কথায় ভাস্বর। বর্ণনা অপেক্ষা নাটকীয়তা, সংলাপের যথোচিত গুরুত্ব রচনাকে করে তুলেছে আকর্ষণীয়।

আরভিং স্টোনের আর একটি বই Lust for Life, যাতে চমৎকারভাবে উপন্যাসের ঢঙে বিখ্যাত চিত্রী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে। আর কোনো শিল্পী সৃজন-তাগিদে এমন উন্মত্ত হননি, এমন পরিব্যক্ত হননি প্রচল সুখ আবহ থেকে। এই প্রতিভাদীপ্ত শিল্পী, তাঁর জীবন ছিল দারিদ্রে্যর, অনুৎসাহের, উন্মত্ততার, হতাশার বিরুদ্ধে অবিরাম সংঘাতে মুখর। উপন্যাসটি নিপুণভাবে প্যারিসের ইমপ্রেশনিস্ট যুগ-পরবর্তী আবহকে তুলে ধরেছে, ভ্যান গঘের শিল্পৈষণা বিকাশের ইতিবৃত্তও আছে। এই শিল্পীকে তাঁর শিল্পকর্মময় জীবনের স্বরূপে যেমন তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি আছে তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিচয়। তাঁর সংঘাত তীব্র, জীবন্ত, কষ্টমুখর জীবনসমৃদ্ধ এই উপন্যাসটি এক দুর্লভ আবেগ ও জীবন্ত স্বরূপে চিত্রিত। ১৯৩৪-এ প্রথম প্রকাশের পর থেকেই পাঠক-সমাজের আকর্ষণে পুনর্মুদ্রণ ঘটেই চলেছে। ৮টি অধ্যায়গুচ্ছ আছে এবং সর্বসমেত ৮০টি অধ্যায়ে বিন্যসত্ম উপন্যাসটি উপন্যাস হিসেবে অতীব জনপ্রিয়। কখনো অধ্যায়ের শীর্ষনাম ভ্যান গঘের কোনো স্মরণীয় উক্তি দিয়ে তৈরি। লেখক বলেছেন উপন্যাস করার লক্ষ্যে তিনি ঘটনাবিশেষে গুরুত্ব দিয়েছেন, ক্ষুদ্র ঘটনারও বাসত্মবতা বিচার করেছেন আবার শিল্পীর জীবনের কিছু গুরুত্বহীন প্রসঙ্গ শিল্পের কারণে বাদ দিয়েছেন। তাঁর এই উপন্যাস-রচনায় উৎস উপাদান হয়েছে শিল্পীর তিন খণ্ড চিঠি, যা ভাইকে লেখা। এছাড়া তথ্য সন্ধানে গেছেন হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্সে, ভ্যান গঘের বন্ধু ও ভক্তদের কাছে।

Depths of Glory উপন্যাসটি আরভিং স্টোন লেখেন প্রখ্যাত শিল্পী কামিল পিসারোকে নিয়ে। ইনি ছিলেন ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের সূচনা পর্বের বরেণ্য শিল্পী। এখানে চিত্রিত শৈশবাবধি শিল্পীজীবন, গৃহভৃত্যাকে বিবাহ, ব্যাপ্ত কঠোর জীবন তথাপি শিল্পে দায়বদ্ধতায় অবিচল। এ-শিল্প তৈরি করেছে ক্রোধ, কলঙ্ক, তাঁকে ও তাঁর সতীর্থ বন্ধুদের অভিযুক্ত করেছে, ফলে এসেছে অবহেলা, দারিদ্র্য, ভুল বোঝাবুঝি তথাপি মানে, দেগা, ভ্যান গঘ, রেনোয়া, সেজান, মেরি কাসাৎ, বার্থ মোয়াস ও আরো কয়েকজন দুর্দান্ত শিল্প-প্রতিভা অসিত্মত্ব উজ্জ্বল হয়ে আছে। আরভিং স্টোন তাঁর আশ্চর্য লেখনীতে, ব্যাপ্ত, চমকপ্রদ অনুপুঙ্খ ক্যানভাসে এই জীবনপ্রবাহকে দিয়েছেন অনবদ্য শিল্পরূপ। উপন্যাসের স্থান শিল্পের রাজধানী প্যারিস আর সে-বর্ণনার সঙ্গে সৃষ্ট হয়েছে এক মহান শিল্পীর অদম্য সাহস। শিল্পী জীবনের সত্যতা সন্ধানের কোনো ফসল নষ্ট না করে ঔপন্যাসিক নাটকীয় জীবনবৃত্তান্তকে তীব্র সজীব করে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। সমালোচকদের একাংশ আরভিং স্টোনের রচনায় কল্পনাতিরেক ও সংবেদনশীলতার বাড়াবাড়ি দেখলেও রচয়িতা কিন্তু গবেষণালব্ধ তথ্য ব্যবহারে রচনার কাঠামোকে শক্ত জমিতে স্থাপন করেছিলেন।

অনেকে বলেন, সমারসেট মমের The Moon and Sixpence (১৯১৯) ভবঘুরে অপ্রচল শিল্পীজীবন আলেখ্য, যদিও অনেকের মতো এ-উপন্যাস পল গগ্যাঁর জীবনাশ্রিত। উপন্যাস হিসেবে এ-রচনাটির জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ। জেমস হুনেকার-রচিত Painted Veils (১৯২০) নিউইয়র্কের শিল্পভুবন নিয়ে রচিত। এ জীবন রচয়িতার খুব পরিচিত। অনেক বাসত্মব মানুষকে এ-উপন্যাসে স্বনামে আনা হয়েছে। এছাড়া তৎকালীন জীবন-বাসত্মবতার কিছু-কিছু প্রসঙ্গকে তিনি রচনার প্রয়োজনে বদলে নিয়েছেন বলা হয়ে থাকে।

ফরাসি চিত্রকর তুলুস লোত্রেকের জীবনাশ্রিত উপন্যাস মূল্যাঁ রুজ। লোত্রেক বাল্যকালেই চিত্রশিক্ষা করেন। দুটো পা-ই ভেঙে যায়। ১৮৮২ থেকে প্যারিসে চিত্রাঙ্কন শিক্ষা, ১৮৮৭-তে নিজস্ব স্টুডিও। প্রায়ই যেতেন বলরুম ও ক্যাবারেতে। লোত্রেক ব্রম্নয়ান্টের গানের চিত্ররূপ দেন, ক্যাবারে হল স্যাঁ লাজারের দেয়ালে নৃত্যরতাদের ছবি এঁকে দেন। অঙ্কিত মানুষকে দিতেন উলেস্নখ্য মর্যাদা। নানা মহিলা চিত্রণ এবং ব্যতিক্রমী মানুষ, অনন্য দেহবৈশিষ্ট্য ছবিতে আনতেন। খেলার জগৎ নিয়ে চিত্র, মহিষ চিত্র। ইংল্যান্ডে অস্কারওয়াইল্ডের ছবি করলেন কয়েকটি স্ট্রোকে। বারবনিতাজগৎ নিয়ে ছবি আছে দেগার মতো। এই বিচিত্র জীবন, বিষদভরা জীবন নিয়ে লেখা হয় মূল্যাঁ রুজ, লেখক ছিলেন পীয়ের লা মূর। মনোজ ভট্টাচার্য অনূদিত, দেবব্রত মুখার্জি-চিত্রিত বইটিতে লোত্রেকের ১০টি আকার নিদর্শন আছে। বইটির পাঁচটি অধ্যায়। উপন্যাস শুরু হয় লোত্রেক তাঁর মায়ের ছবি আঁকছেন। রীতিমতো সংলাপবহুল, আকর্ষণীয় উপন্যাস। প্যারিসের চিত্রকলার জগৎ ব্যক্তি-শিল্পীর বিপদের পাশে। এই শিল্পী-জীবনাশ্রিত উপন্যাসকে বলা হয়ে থাকে Kunshlerroman বা Artist Novel, যা Bildungsroman বা Novel of
Growth-এর একটি শাখারূপে গণ্য।

২০০৩-এ Dan Brown রচিত-Da Vinci Code উপন্যাসটি এবং পর পরই চলচ্চিত্রটি এ-শহরে আসার পরই রীতিমতো শোরগোল উঠেছিল। হার্ভার্ডের সিম্বলজিস্ট রবার্ট ল্যাংডন মধ্যরাতে ফোন পান যে, ল্যুভরের বৃদ্ধ কিউরেটর মিউজিয়ামের মধ্যে নিহত। নিহতের শরীর ও মেঝে নানা প্রতীকে স্থিত। এই প্রতীক উন্মোচনে ল্যাংডনকে সাহায্য করে এক ফরাসি সাংকেতিক লিপিবিশারদ সোফি নুভু। তারা শেষ পর্যন্ত ক্লু পায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির শিল্পকর্মে।

লিওনার্দোর বিখ্যাত ড্রইং The Vitruvian Man ধাঁচে শরীরটি রাখা। এছাড়া আছে এক অ্যানাগ্রাম এবং Fibanacci’s বিখ্যাত সংখ্যাধাঁধা। এই সূত্রে চলে আসে The Priory of Sion, the knights Jemplar,  বিতর্কিত Vatican prelature  (Opus Dei); এটি ১১১৯ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত খ্রিষ্ট-সমাধি, গমনকারী তীর্থযাত্রী রক্ষাকল্পে সামরিক ও ধর্মীয় সংঘ। এই দলের বিশেষ যৌনকৃত্য আভাসিত। লিওনার্দো-রচিত ক্লু ধরে ল্যাংডন ও সোফি এগোয়। মৃত কিউরেটর ছিল পূর্বোক্ত দি প্রায়োরি অব সিওন নামক গোপন গোষ্ঠীর সভ্য, যার সভ্য ছিলেন – নিউটন, হুগো, দ্য ভিঞ্চি। এই কিউরেটর এক ঐতিহাসিক গোপন তথ্য রক্ষা করেছিলেন, তাই তাঁকে অনুসরণ ও হত্যা করা হয়। পূর্বোক্ত দুজন হত্যারহস্য সমাধান করে ভিঞ্চির চিত্র-সাহায্যে। এটি একটি gleefully erudite suspense novel. চিত্রসূত্র অবলম্বনে হত্যারহস্য সমাধানের উপন্যাস হিসেবে বিশ্ববাসীকে একদা তোলপাড় করেছিল।

এবার বলি চিত্রকর নিয়ে বাংলায় লেখা একটি বিখ্যাত উপন্যাসের কথা। সমরেশ বসু-রচিত দেখি নাই ফিরে (ডিসেম্বর, ১৯৯১) রামকিঙ্করকে নিয়ে লেখা একটি অনবদ্য উপন্যাস। সমরেশ ভেবেছিলেন উপন্যাসটি করবেন পঞ্চপাঠক – রক্তাক্ত ঊষা, সকালের ডাক, রৌদ্রদগ্ধ দীর্ঘবেলা, ছায়া দীর্ঘতর, অন্ধকারের আলোয়। দ্বিতীয় পর্ব শামিত্মনিকেতন যাত্রা, তৃতীয় পর্ব রামকিঙ্কর শিল্পীজীবনের উত্তুঙ্গপর্ব, চতুর্থ পর্ব তাঁর প্রতিভা সূর্যের অসত্মগামিত্ব এবং পঞ্চম পর্ব জীবনসায়াহ্ন ও প্রয়াণ। সমরেশ এ-বিষয়ে আকৃষ্ট হন নানা কারণে। রামকিঙ্কর এ শতাব্দীর এক বড় শিল্পী, তাঁর জীবনে আছে প্রচুর নাটকীয়তা, আছে অসম্ভব বিশ্বাস এবং অবিরত সংগ্রাম। তাছাড়া তথাকথিত ভদ্রলোক ও মধ্যবিত্তদের ভ-ামি ভেঙে ফেলার মধ্য দিয়ে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করা। রামকিঙ্করের মধ্যে লক্ষ করেছিলেন আপন প্রতিচ্ছবি। রামকিঙ্করের মতোই লাঞ্ছনা, অপমানে হার মানেননি। লড়াই করেছেন দারিদ্রে্যর সঙ্গে। বহুমাধ্যমের সিদ্ধশিল্পী হলেও বিকাশ ভট্টাচার্যের ইলাস্ট্রেশন এ-উপন্যাসের মহত্ত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। রামকিঙ্কর ও সমরেশ দুজনেরই ছিল সমান প্যাশন, ভিগার, দৃপ্তপৌরুষ, দুজনেরই প্রিমিটিভ, ওয়াইল্ড হেড। রচনা পড়তে-পড়তে নিবিষ্ট পাঠক অনুভব করতে পারবেন আত্মস্মৃতির মমতা। এসব কারণেই ভগ্নস্বাস্থ্য সত্ত্বেও দুরন্ত জেদ নিয়ে নানা ডকুমেন্ট জোগাড়ে বাঁকুড়া থেকে দিলিস্ন গিয়েছেন। বাঁকুড়ার উপভাষা, গ্রাম্যশিল্পের উপকরণ প্রাণপণে আয়ত্ত করতে সচেষ্ট হন। রদ্যাঁর জীবনকেন্দ্রিক

উপন্যাস Naked Came I তাঁকে কিছু অনুপ্রেরণা দিয়েছিল, যা নিজে উলেস্নখ করেছেন। শামিত্মনিকেতন-পর্ব চিত্রণে হিমশিম খেয়েছেন কারণ এ-পর্বের পরিজ্ঞাত তথ্যাদি অনেকেই জানেন। রামকিঙ্কর তাঁর কথায় এক ঐতিহাসিক চরিত্র, তাই শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসের প্রেক্ষাপট রাখতে হয়েছে। তবে যতটুকু ব্যবহার করলে উপন্যাস গড়ে উঠবে সেটুকু ব্যবহার করতে সচেষ্ট থেকেছেন। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র, ঔপন্যাসিক দুজনেই ছবি আঁকতেন, unorthodox জীবনযাপন করতেন, নাট্যে ঝোঁক ছিল, দুজনেই শিক্ষিত রক্ষণশীল জগতে ব্রাত্য পরিগণিত, দুজনেরই যৌন-আবেগ অতিরিক্ত। অন্যদিকে রামকিঙ্কর সমরেশের মতো সুবক্তা নন, গ্রামীণ আবহে অভ্যসত্ম। এ-উপন্যাসের কেন্দ্রীয় রং লাল ও ইমপ্রেশনিস্ট ধরনে বিকেলের ছবি। বাঁকুড়ার ভাষা উপন্যাসের বুনোট নির্মাণে সহায়ক। রামকিঙ্করের ধ্যানতন্ময়তা, প্রকৃতি উপকরণ থেকে রং বানানো পাঠককে মুগ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ একটু দেরিতে। তার পরই গল্প লাফ দিয়ে চলে আসে বাঁকুড়ায়, অনন্ত জ্যাঠার প্রতিমা গড়া। গল্পে তাত্ত্বিকতা নেই, যান্ত্রিকতা নেই, ব্যক্তিজীবনের সীমা-সংকীর্ণতা নেই। রদ্যাঁ অনুপ্রাণিত করেছে রামকিঙ্করকে। মিসেস মিলোয়ার্ডের কাছে ভাস্কর্য শিক্ষাকালে জানানো হয়। রদ্যাঁ তাঁর মাথায় ঢুকে বসে আছেন বলা হয়। প্রকৃতির ভূমিকা এ-উপন্যাসে পর্যাপ্ত, বিষয়ের সঙ্গে চমৎকার মিলে গেছে। শামিত্মনিকেতনের শিক্ষা-সংস্কৃতির আবহ নির্মাণে এতটুকু বাড়াবাড়ি নেই, গল্প ব্যক্তিশিল্পী ও সমাজ-প্রসঙ্গের মধ্য দিয়ে চলে প্রত্যাশিত পরিমিতিবোধে। ইতিহাসের বড় সময়, ছোট সময়, ব্যক্তিগত সময় অদ্ভুতভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন সমরেশ তাঁর অনন্য প্রতিভা স্পর্শে। সমরেশ বসুর একেবারে গোড়ার দিকের উপন্যাস নয়নপুরের মাটির মুখ্য চরিত্র একজন লোকচিত্রকর, অন্যদিকে তারাশঙ্করের অরণ্যবহ্নি উপন্যাসের সূত্রপাতে জনৈক লোকচিত্রকর মেলায় পটচিত্র খুলে-খুলে সর্বসমক্ষে প্রাচীন শৌর্যবীর্যের উপাখ্যান বর্ণনা করছে। লোকজীবন ও লোকচিত্রের এই সমন্বয় অন্যত্রও দেখা যাবে।

নারায়ণ সান্যালের আবার যদি ইচ্ছা কর উপন্যাসটিকে বলা যেতে পারে ভ্যান গঘ, গগ্যাঁ জীবনের ভারতীয়করণ। চন্দ্রভান গর্গ, গগনবিহারী পাল, বটুকেশ্বর দেবনাথ চিত্রকর হিসেবে পরিচিত হন। জমিদারপুত্র চন্দ্রভানের বাল্যকাল বঙ্গভঙ্গের সময়ে বটুকেশ্বরই ছাড়পত্র পান আর্ট স্কুলের। অকালে মাতৃহারা চন্দ্রভান বঙ্গভঙ্গের কর্মী। রেভারেন হেনরি শারদ্যাঁর আশ্রিত ঊর্মিলা, চন্দ্রভানের কাছেই মাইকেল এঞ্জেলো, রাফায়েল, এল গ্রেপে প্রভৃতির ছবির পরিচয় পায়। ঊর্মিলার পিতা ফরাসি, মা ভারতীয়, পরিত্যক্ত হয়ে আশ্রিত। সর্বস্বান্ত ভিনসেন্ট বা চন্দ্রভান কোলিয়ারিতে এসে রংতুলি ক্যানভাস কাগজ হাতে নিল। একদা মোমবাতির আগুনে হাত পুড়িয়েছে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে। ডাকাবুকো গগন বা গগ্যাঁ ঢাকা ছেড়ে স্ত্রী ছেড়ে নির্জনে ছবি আঁকে, পরে কলকাতার চটকল বসিত্মতে দুর্গত জীবনে। বটুক হগ সাহেবের বাজারে দোকান দেয়, নানা জাতের ছবি আঁকে। বসুমতীতে তাঁর ‘পূজারিণী’ ছাপা হয়। অবনীবাবুর শাজাহান, গগনের কার্টুন প্রশংসিত। চন্দ্রভান হেদোর রেলিংয়ে ছবি নিয়ে বসে, তার বউ উপদংশগ্রসত্ম। তার ভাই সুরজ থাকে দিলিস্নতে, ওখান থেকে টাকা পাঠায় দাদাকে। মেয়েদের ছবি আঁকার জন্য বসিত্মর লোক গগনের মাথা ফাটিয়ে দেয়। মরণাপন্ন গগ্যাঁ বটুকের বাড়িতে, বটুকের স্ত্রী সুলেখার সঙ্গে প্রেম, পরে সুলেখার আত্মহত্যা। বটুকেশ্বর স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছবি আঁকা ছেড়ে দেয়। গগ্যাঁ এঁকেছিল ‘The Nude’ (গগ্যাঁর ঐতিহাসিক ছবি)। চন্দ্রভানের বউ তাকে ছেড়ে চলে যায়, শিল্পীর মসিত্মষ্ক বিকৃতি। মাঝে-মাঝে আক্রমণ। বেশ্যাবাড়িতে চন্দ্রভান, যে আসলে বাতাসী। রাঁচিতে ভিনসেন্ট, ওখানে গগ্যাঁর  খাওয়া, ‘আলুর ভোজ’ (ভ্যান গঘের আঁকা) আঁকা, দুজনে দুজনকে দেখতে পারে না। খুর নিয়ে মারামারি। নিজের কান কেটে পাঠিয়ে দেয় ঊর্মিলাকে। উন্মাদাগারে ব্যায়াম (ভ্যান গঘের ছবি) আঁকা হয়। কানকাটা ভিনসেন্টকে বিদ্রূপে বিপর্যসত্ম করে রাঁচির লোকেরা। তার আত্মপ্রতিকৃতি (ভ্যান গঘের আঁকা) অপমানিত শোকাহত বৃদ্ধ (গঘের আঁকা) স্মরণীয়। উন্মাদ ভ্যান গঘ আত্মহত্যা করে, গগন পাল দেশত্যাগী হয়, বটুকেশ্বর ফিরে যায় বরিশালে। ১৯৫৩-তে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে শিল্প-বিশেষজ্ঞ রবার্ট ম্যাকগ্রেগরির চিঠি, তিনি জানতে চান গগ্যাঁ বিষয়ে। গগ্যাঁ ও গগন পাল মিশে যায় শেষ অধ্যায়ে। তাহিতি অধ্যায়, দাড়িঅলা পাহাড়িয়া, থাকে আদিবাসী এক মেয়ের সঙ্গে, কুষ্ঠ হয়, মৃত্যুতে শেষ। উপন্যাস হিসেবে উৎকৃষ্ট নয়। সমান্তরাল মেলানো কষ্ট করে। কিন্তু বিখ্যাত ছবির কথা আছে। তিন প্রধান শিল্পীর চরিত্রচিত্রণে ব্যক্তিত্ব ফুটেছে। বইয়ের গোড়ায় মূল ছবির উদাহরণ – ‘সমুদ্রবক্ষে নৌকা’ (১৮৮৯), ‘আলুর ভোজ’ (১৮৮৫), ‘আর্লের সাঁকো’ (১৮৮৮), ‘ডাকপিয়ন রোশিন’ (১৮৮৯) এ ছাড়া প্রতিটি অধ্যায়ের সূচনায় নারায়ণ সান্যাল-অঙ্কিত অনেক
স্কেচ আছে। নারায়ণবাবু প্রবঞ্চক বইটিতে ভেরমীরের ছবি জাল করা এক বাসত্মব চিত্রকরের জীবনবৃমত্মান্ত লিখেছেন, রদ্যাঁকে নিয়ে উপন্যাসপ্রতিম একটি বই আছে। দুটি লেখাই অনবদ্য আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে লেখা।

এখানে আমরা কারন্থ নামে এক কন্নড় ঔপন্যাসিকের কথা উলেস্নখ করতে চাই, যাঁর রচনাগুলোতে মুখ্য চরিত্র হয় শিল্পী অথবা শিল্পকলার নানান বিষয়ে সংশিস্নষ্ট। তাঁর শিল্পীবিষয়ক উপন্যাসগুলোর মধ্যে আছে জনৈক নর্তকী কথা (১৯৪৮), অপেরা শিল্পী, নাট্যকার কথা (১৯৬৬), নর্তকী ও শিল্প-আলোচক কথা (১৯৬৬), থিয়েটার ও নাট্যকার কথা (১৯৭৫)। একটি উপন্যাসের চরিত্র রাম বেহালাবাদক, অপর একটিতে যশোবন্ত রাও চিত্রশিল্পী। লেখক কারন্থ নাট্যসংশিস্নষ্ট ব্যক্তিত্ব, তাই নর্তকী, নাট্যকর্মী কথা অনেক রচনাতেই আছে। নানা লেখায় তিনি শিল্পীর সামাজিক ভূমিকার কথা বলেছেন। জানা যাচ্ছে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কন্নড় ভাষায় শিল্পী-উপন্যাস অনেক লেখা হয়। এ এন কৃষ্ণা রাও শতাধিক উপন্যাস লেখেন, যার অনেক কটিই এই গোত্রভুক্ত হতে পারে। Udayarage চিত্রকরবিষয়ক, Sangrama (ভাস্করবিষয়ক), ইনিই শিল্পী-উপন্যাস জনপ্রিয় করে তোলেন। কৃষ্ণ রাওয়ের উপন্যাসগুলোতে দেখা যাবে একজন শিল্পী তাঁর খ্যাতি ও গৌরবের শীর্ষে ওঠার পর নারীলুব্ধ হয়ে ওঠেন, শিল্প ক্ষতিগ্রসস্ত হয়, শেষে হয় তিনি নারীলোভ থেকে সরে আসতে পারেন অথবা ধ্বংস হয়ে যান। তবে অনেক ক্ষেত্রে শিল্পীর শিল্পত্ব যথোচিত গুরুত্ব পায়নি। এ কারণেই বলা হয় কন্নড় ভাষার এ জাতীয় উপন্যাসগুলো রোম্যান্টিক ও illusionary. পূর্বোলিস্নখিত কারন্থ বাসত্মবনিষ্ঠ। এই দুজন এবং টি আর সুববা রাও যেসব শিল্পী-জীবনের কথা এঁকেছেন, তাঁরা দ্বিধাবিভক্ত সত্তার শরিক।

প্রাসঙ্গিক বোধে আমরা কয়েকটি তথ্য উলেস্নখ করতে পারি। বাণী রায় অনুবাদ করেছিলেন মোনালিসা উপন্যাসটি, ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায় কিছু গল্প লেখেন, চিত্রকর ভূপেন খক্কর ইংরেজিতে গল্পের বই লেখেন, লিওনার্দোর গল্প অনুবাদ করেছেন বিজয় দেব। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রী দাঁড়ের ময়না উপন্যাস লিখে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেছিলেন।

সাহিত্য ও চিত্রকলার পারস্পরিকতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা গেল। এর ভিত্তিতে পাঁচটি প্রসঙ্গে উপনীত হতে পারি – ১) সাহিত্য টেক্সটের ডিটেলস চিত্রে রূপায়িত হচ্ছে, ২) চিত্রের ডিটেলস এসে পড়ছে সাহিত্য টেক্সটে, ৩) সাহিত্যের কিছু কনসেপ্ট ও মোটিফ ব্যাখ্যাত হচ্ছে শিল্প-ডিজাইনে, ৪) চিত্রাবলির কিছু মোটিফ বিশদ হচ্ছে সাহিত্য মাধ্যমে, ৫) সাহিত্য ও ভাষা-ভঙ্গির ফর্মসমূহ সুবোধ্য হয়ে উঠছে নানা আর্ট ফর্মে।

ইমপ্রেশনিজম এই টার্মটি উঠে এসেছে চিত্রকলার জগৎ থেকে। পরে সাহিত্য-আলোচনায় তা ব্যবহৃত হতে থাকে। ফরাসি প্রতীকবাদী কবিরা, লেখক অস্কারওয়াইল্ড, আর্থার সাইমনস ইমপ্রেশনিস্ট আখ্যা পান। এই টার্মটি উপন্যাসে বহির্বাসত্মব গৌণ করে মুখ্য চরিত্রের অন্তর্জীবনে কেন্দ্রস্থ হলেও ব্যবহৃত, যেমন জেমস জয়েস, মার্সেল প্রম্নসত্ম, ডরোথি রিচার্ডসন, ভার্জিনিয়া উলফ উপন্যাস প্রসঙ্গে। চেতনাপ্রবাহ রীতি প্রসঙ্গেও চিত্রকলার এই রীতিটি উলিস্নখিত হয়। পরাবাসত্মববাদের আন্দোলন ফ্রান্সে দেখা দেয় বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে। ফরাসি কবি-সাহিত্যিকরাই পরাবাসত্মব রীতি বেশি ব্যবহার করেছেন। যেমন – ব্রেতঁ, আরাগঁ, এলুয়ার, বেঞ্জামিন পেরে, ফিলিপ সুপো প্রমুখ। কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও পরাবাসত্মবের রীতি এসেছে – চেতন ও অর্ধচেতন মনোভাবনা প্রকাশে, ব্যক্তিগত বিশৃঙ্খলা উন্মোচনে, ব্যক্তিক নরক-চেতনায়। এসব ক্ষেত্রে চেতনাপ্রবাহ রীতি অনুসৃত। নাটক, উপন্যাসে যাঁরা এসব রীতি ব্যবহার করেছেন তাঁরা হলেন – আর্তো, আয়নেস্কো, জেনে, বেকেট, বারো, গ্রাক্, রবগ্রিরে, সারুৎ প্রমুখ।

কয়েকটি চিত্রপ্রভাবিত সাহিত্য বর্ণনা উপস্থিত করে প্রসঙ্গের যবনিকাপাত করা যাক।

ক) ‘অল্পবয়সী ষড়ৈশ্বর্যাশালিনী পতিপ্রাণা কর্ত্তা-কর্ত্তা বলিয়া প্রতিমার কাঠামো ছাড়িয়া জলে লাফ দিলেন। ক্রন্দন করিতে করিতে সন্তরণের বৃথা চেষ্টা করিলেন, দু-একবার ‘কর্ত্তা’ ডাক শোনা গেল। ইহার পর শুধুমাত্র রক্তিম জলোচ্ছ্বাস! কেননা চাঁদ এখন লাল। একটি মাত্র চোখ, হেমলকে প্রতিবিম্বিত চক্ষুসদৃশ, তাঁহার দিকেই, মিলন অভিলাষিণী নববধূর দিকে চাহিয়াছিল, যে চক্ষু কাঠের, কারণ নৌকাগাত্রে অঙ্কিত, তাহা সিন্দুর অঙ্কিত এবং ক্রমাগত জলোচ্ছ্বাসে তাহা সিক্ত, অশ্রম্নপাতক্ষম, ফলে কোথাও এখনও মায়া রহিয়া গেল।’

                (অন্তর্জলী যাত্রা, কমলকুমার মজুমদার)

খ) ‘পাখিটা এখন সোজাসুজি বাঘারুর এই পাথরটার দিকে তাকিয়ে। তাই ওর ঠোঁট-মাথা-ঝুঁটির আভাস আর আলাদা আলাদা চেনা যায় না। পাখিটার  পাথরটা থেকে বাঘারুর পাথরের মাথাটা সম্পূর্ণ দেখা যাবে না। তা হলে পাখিটা বাঘারুকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু পাথরটাকে দেখছে। এখন হঠাৎ উড়াল দিয়ে এই পাথরটাতে এসে যেতে পারে। বাঘারু স্থির হয়ে থাকে, নড়ে না। থুতনির নীচে তার হাত দুটো।
কনুই পর্যন্ত দুই দিকে সমানভাবে ছড়ানো। বাঘারু ধীরে-ধীরে তার শ্বাস-প্রশ্বাসটাও কমিয়ে আনে। আর সেই স্থিরতায় অপেক্ষা করে, পাখিটা শরীরটাকে কেমন এগিয়ে, গলাটাকে বাড়িয়ে, পাখা দুটো ছড়িয়ে, মাঝখানের এই ফাঁকটুকু ভরে, ঐ পাথর থেকে এই পাথরের মাথায় কোনাকুনি উড়ে এসে বসবে। বাঘারু তার সেই পুরো ওড়াটুকু দেখতে পাবে – এই প্রথম। পাখার ছড়ান দেখে বুঝতে পারবে কত লম্বা, ঠোঁটের চোখা দেখে বুঝতে পারবে পাতলা না মোটা।’

                (তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, দেবেশ রায়)

গ) ‘দুর্গা অস্ফুটে বলতে লাগল, পারি না, পারি না, পারি না, পারি না। আবার কানের কাছে কে বলল, রাক্ষসী। কে বলল, তর পাপে। মা, মা! বুড়ো ঠাকুর চেঁচাল। ভয়ে ভক্তিতে উত্তেজনায় অনেকে কাঁপাসুরে গলা মেলাল। আর নিত্যচরণের দুই চোখ তখন কালীর জিভ। সমসত্ম গা ফেটে ঘাম বেরুচ্ছে। কাদায় পা এলোমেলো হয়ে উঠেছে। যে কোনও মুহূর্তে টলে পড়ে যাবে। মুখ থেকে মালসাটা ফেলে দিল। গা ঘেঁষে শেষ বেড়ার আগুন। কাদার মধ্যে আগুন, মাটির বুকে আগুন। দাউ দাউ জ্বলছে। নাচতে নাচতে জ্বলছে। এলোমেলো পা ফেলে নাচতে নাচতে জ্বলছে। যে কোনও মুহূর্তে বুঝি টলে পড়ে যাবে। কাটা কনুই দুটো অদ্ভুত দেখাচ্ছে। একটা ক্লান্ত, অতিপ্রাকৃত আত্মা কোনও রকমে ডানা জাপ্টাচ্ছে। আর বলির ছাগলটার সঙ্গে রাস্তার কুত্তা কটা গলা মিলিয়ে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে।’

                (জটায়ু, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)

ঘ) ‘প্রাতঃকাল অতিক্রান্ত হইতে না হইতেই রৌদ্রের মধ্যে যেন একটা জ্বালা ফুটিয়া উঠে, সে জ্বালার শোষণে মাটির বুকের রস নিঃশেষিত হইয়া শুষ্ক হইতে চলিয়াছে। দিগন্তপ্রসারী শস্যক্ষেত্রে শস্যশীর্ষগর্ভা ধান্যলক্ষ্মী নীরস ধরণির বুকের উপর তৃষ্ণায় মৃতপ্রায় কিশোরী কন্যার মত এলাইয়া পড়িয়াছে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর বিবর্ণতা কিশোরীর সর্বাঙ্গে সঞ্চারিত হইতেছে। মাঠজোড়া ধানগাছগুলির পাতার প্রান্তভাগ হলুদ হইয়াছে। তবুও উদগমোনোন্মুখ ধান্যশীষের একটি ক্ষীণ হৃদ্যগন্ধে প্রান্তরটা ভরিয়া উঠিয়াছে – ধান্যলক্ষ্মীর অঙ্গসৌরভ। আর কানে বাজিতেছে, মাঠজোড়া সোঁ সোঁ শব্দ।’

ধাত্রীদেবতা, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়