চিত্রপটে তারুণ্যের আচড়

জাহিদ মুস্তাফা
নবীন পাঁচজন শিল্পী, যাঁদের বয়স পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ – তাঁদের অাঁকা একচল্লিশটি এবং কিউরেটরের একটি কাজ নিয়ে প্রদর্শনী – শিরোনাম ‘ফ্রি ফল’। চলেছে ঢাকার গুলশানের নতুন শিল্পালয় বেঙ্গল লাউঞ্জে। অভিনব এ-প্রদর্শনীর শিল্পীরা হলেন – মোহাম্মদ হাসানুর রহমান, শেহজাদ চৌধুরী, ইয়াসমিন জাহান, আয়েশা সুলতানা ও সালজার রহমান।
ফ্রিফল একটি যৌথ ড্রয়িং প্রদর্শনী। সব ড্রয়িংই কাগজে অাঁকা। মোটা কিংবা পাতলা কাগজ আর ট্রেসিং কাগজ – এসব নানা কাগজে শিল্পীরা এঁকেছেন পেনসিলে, স্ট্যাপলার পিন দিয়ে, গ্রাফাইটে, চারকোলে ও অ্যাক্রিলিকে। প্রদর্শনীর নামকরণ হয়েছে ব্রিটিশ কোরিওগ্রাফার গ্যাবি অ্যাগিস-নির্মিত ক্ষুদে চলচ্চিত্র ফ্রি ফিল থেকে। গ্যালারির এক কক্ষে চলচ্চিত্রটি চলছিল। নিয়মানুবর্তী নৃত্যের বাইরে আনন্দ প্রকাশের বন্ধনহীন আবেগ ফুটে উঠেছে এতে। এর সঙ্গে মুক্ত অঞ্চলের স্বাধীনতা যেন সাজুয্যময় হয়ে উঠেছে। বোধকরি এ-কারণেই প্রদর্শনীর এ-শিরোনাম নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশিষ্ট শিল্প-সমালোচক জর্জিও গুইলিয়েলমিনো, যিনি ঢাকায় ইতালির রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত, তিনি এ বিশেষ প্রদর্শনীর কিউরেটর।
আমাদের শিল্পাঙ্গনে অঙ্কনপ্রধান কাজের প্রদর্শনীর পরিমাণ তেমন বেশি নয়। মাধ্যম আর বিষয়ের ভারে শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধারা যখন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, তখন ভারহীন ধারালো অঙ্কনের কাজ আমাদের চোখকে স্বস্তি দেয়। ‘ফ্রি ফল’ শীর্ষক এ-প্রদর্শনীর কাজগুলো সেই স্বচ্ছন্দ স্বস্তি এনেছে। সামান্যকটি মাধ্যম দিয়ে কাগজের বুকে শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলেছেন নিজেদের আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযোজনা।
এ-প্রদর্শনীর অন্যতম অংশগ্রহণকারী ও কনিষ্ঠতম শিল্পী আয়েশা সুলতানার বয়স এখন মাত্র আটাশ। যশোরে জন্মগ্রহণকারী এ-শিল্পী ২০০৮ সালে পাকিস্তানের লাহোরের বিকন হাউস ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে আর্ট এডুকেশনে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করেছেন। দেশ-বিদেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন আয়েশা। শুধু পেনসিল দিয়ে বড় কাগজে বড় স্কেলের সাহায্যে রেখা টেনে টেনে জ্যামিতিক ত্রিভুজ এঁকে একটি ভর বিন্দুতে উপনীত হওয়ার টানটান টেনশন অনুভূত হয়েছে তাঁর একটি অঙ্কনে। সামান্য উপকরণ ব্যবহার করে অনুভূতির এ-প্রকাশকে শিল্পিত উপস্থাপনায় তুলে ধরার এ-প্রয়াস আমাদের বিস্মিত করে বৈকি! নয় টুকরো কাগজের পেছনে স্কয়ার রেখার ভাঁজ ফেলে ওপরে পেনসিল শিশ বা গ্রাফাইট রেখার অসংখ্য টোন দিয়ে পুরো স্পেসটাকে ভরে দেওয়া হয়েছে। খুব সাধারণ কাজ। এটি উপস্থাপনের ধরনটি আধুনিক।
ক্যাটার্যাভক্ট শিরোনামে আয়েশার চারটি কাজ আরো অভিনব। কাগজের বুকে স্টাপল করা অসংখ্য পিন দিয়ে স্পেসকে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন শিল্পী। প্রায় বর্গাকার কাঁথার মতো কোনোটার অবয়ব দাঁড়িয়েছে। লম্বাটে কাগজে একটি লম্বা বৃক্ষের রূপ যেন ফুটে উঠেছে আরেকটিতে। মাধ্যমের অভিনবত্বে সহজ-সাবলীল অঙ্কনের এ-পদ্ধতি আমাদের চোখকে বিস্ময়াবিষ্ট করে।
মোহাম্মদ হাসানুর রহমান প্রদর্শনীর সবচেয়ে অগ্রজ শিল্পী। কাজ করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে। চিত্রকলার প্রিজারভেশন বিশেষজ্ঞ তিনি। ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসলের নর্দামব্রিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ইজেল পেইন্টিং সংরক্ষণশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর করেছেন। এর আগে ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্যে স্নাতকোত্তর করেছেন।
একজন ভাস্কর হিসেবে ড্রয়িংয়ের প্রতি তাঁর পূর্ব অনুরাগ থাকাই স্বাভাবিক। হাসানের সাতটি ড্রয়িং এ-প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। আপাদমস্তক নারীদেহ নিয়ে তাঁর এসব ড্রয়িং। লম্বা কাগজের বুকে অ্যাক্রিলিক ও কালি প্রয়োগ করে স্বচ্ছন্দ তুলি চালিয়ে ড্রয়িংগুলো করেছেন শিল্পী। নতুন কিছু বলা যাবে না এগুলোকে। পরিবেশনায় নতুনত্ব আছে। লালচে কালো বর্ণের গভীরতা দিয়ে বিবসনা নারীর নানা রূপকে চিত্রিত করার প্রয়াস আমাদের অঙ্কনচৈতন্যকে মুগ্ধতা দেয়। সেই যেন শিল্পশিক্ষা-জীবনের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নিরাভরণ নারীর শরীর কাঠামো অঙ্কনের অনুশীলন স্মৃতি ফিরে এলো হাসানের এ-কাজগুলো দেখে। ত্রিভঙ্গে দাঁড়ানো ফিগারগুলো আলো-ছায়ায় গুণে এবং বর্ণলেপণের স্বাচ্ছন্দ্যে সার্থক হয়ে উঠেছে।
শেহজাদ চৌধুরী শিল্পী, ফটোগ্রাফিও করেন। কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নানা রাজ্যের পত্র-পত্রিকায়। দেশে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে কাজ করেন; ফিল্ম বানান, কিউরেটর হিসেবেও কাজ করেন। ‘ভূমিহীন ভূমি’ শিরোনামে কাগজে অ্যাক্রিলিক, পেনসিল, গ্রাফাইট ও কালি দিয়ে নানা টোনের রেখা টেনে টেনে স্পেস ভরেছেন। একটি আনুভূমিক, কিন্তু সহজের মধ্যেও সৌন্দর্য বিদ্যমান। ফ্রেমবদ্ধ করে দেয়ালে দৃষ্টিসীমায় ঝুললে মন্দ লাগে না। ট্রেসিং কাগজে রেখাঙ্কন করে শেহজাদ দেয়ালে ঝুলিয়েছেন তাঁর দুটি চিত্রকর্ম। এর একটির শিরোনাম ‘অন এ লোটাস কোয়েস্ট’। ট্রেসিং পেপার সরাসরি ঝুলানোয় নানা ঢেউ হয়ে যাওয়ায় কাজ দুটি দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠেনি। তাঁর আরেকটি অঙ্কনের শিরোনাম ‘শিরোনামহীন আলো’। কাগজে কালি ও চারকোল দিয়ে লম্বাকৃতির টোন এনে মাসকিং টেপ উঠিয়ে কাগজের বুকের সাদা রেখা বের করে দেওয়ায় এ-অঙ্কনে নতুনত্বের ধারণা এসেছে।
ইয়াসমিন জাহান নূপুর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর করেছেন ২০০৪ সালে। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশন কর্তৃক পুরস্কৃত হয়ে কমনওয়েলথ কানেকশন ইন্টারন্যাশনাল আর্টস রেসিডেন্সি করেছেন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী-আয়োজিত ১৭তম নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীতে সম্মান পুরস্কার অর্জন করেছেন। বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি।
প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্রকর্মের সংখ্যা এগারোটি। কাজগুলো কাগজে পেনসিলে কিংবা কাগজে জলরং ও পেনসিলে অাঁকা। জ্যামিতিক ফর্ম বিশেষ করে নানারকম স্কয়ার ও ত্রিভুজকে প্রায় পিঙ্ক রঙে কাগজের ওপরে ও নিচে এঁকে, তার সঙ্গে পেনসিলে টেনেও রেখা টেনেছেন। নূপুরের এ-কাজগুলোর শিরোনামের দিকে তাকানো যাক। তাঁর এসব কাজের শিরোনাম হচ্ছে – দ্য ভয়েস অব স্পেস, মাই স্যাটল হ্যাজ গন, ইন টু দ্য সোলেম আর্ট ও মাইন্ড স্কেপ।
চিত্রপটের ওপরাংশ থেকে ক্রমান্বয়ে ত্রিভুজ শেপ গড়ে তার ভেতর ঘাসের মতো টেনে দিয়েছেন পেনসিলে। স্পেসের প্রয়োগে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে কাজ। তাঁর আরেকটি অঙ্কনে চিত্রপটের ঊর্ধ্বাংশে আমরা দেখি, মেঘের মতো তুলট রূপ পেনসিলে অাঁকা আর নিচে শিল্পীর কয়েকটি চুলের জট। এ-কাজেও অভিনবত্ব লক্ষ করি আমরা।
স্থপতি সালজার রহমান এ-গ্রুপের আরেকজন নবীনতম শিল্পী, যিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্র ছিলেন। কাঠের ওপর স্টেনসিল করে রং স্প্রে করে তিনি এঁকেছেন যুদ্ধবাজের ছবি। শিরোনাম দিয়েছেন ‘স্বাপ্নিক নাৎসি’। যুদ্ধের ভয়াবহতা পৃথিবীর মানুষ ও পরিবেশকে বিষাক্ত করে, মানবিক মূল্যবোধ হরণ করে, মানুষকে পণ্য করে। পৃথিবী ধ্বংসের বিপদাশঙ্কা তৈরি করে। সে-বিপদকে মনে করিয়ে দিয়েছেন সালজার তাঁর চিত্রকর্ম দিয়ে। তাঁর কাজ বক্তব্যপ্রধান; শিল্পের গুণ এখানে গৌণ হয়েছে।
অপেক্ষাকৃত নবীন শিল্পীদের নিয়ে এ-প্রদর্শনীর আয়োজন শিল্পাঙ্গনে নতুন চিন্তা ও ধ্যান-ধারণাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে বলে মনে করি। একটা বিষয় ভাবতে ভালো লাগছে – আমাদের নবীন শিল্পী ও নবীন ভাবনা নিয়ে শিল্পবোদ্ধাদের এ-চৈতন্যোদয় শুভ লক্ষণ হয়ে দেখা দেবে। 