চিত্রশিল্পে তাঁর বাঙালিয়ানা

রবিউল হুসাইন

বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে জয়নুল আবেদিন স্বরবর্ণের ব্যঞ্জনায় চিহ্নিত। একটি ভাষা-নির্মাণে যেমন স্বরবর্ণের প্রাথমিক ব্যবহার ও অবশ্যম্ভাবিতা উপযুক্ত, অতিশয় গঠনমূলক, তেমনি জয়নুল আবেদিন। সদ্য বিভক্ত মুসলিম জনগোষ্ঠী ধর্মীয় কুসংস্কারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, যখন অন্যান্য দেশে তার, বিশেষ করে চিত্রশিল্পে বিন্দুমাত্র অমনোযোগ নেই, সেই সময়ে এই উজ্জ্বল আবির্ভাব খুবই প্রয়োজনীয় এবং তাই তিনি এদেশের মানুষ ও শিল্পীদের শিল্পাচার্য।

দেশের বহমান হাহাকার, দারিদ্র্য, দুঃখকষ্ট, অবিচার, অবহেলা, মানুষের ক্ষুধা, ন্যূনতম চাহিদা ও অধিকার – শিক্ষা, আশ্রয়, চিকিৎসা, জীবিকা-সংস্থান, বিনোদনের অভাব-অনটন চিত্রশিল্পের মতো নান্দনিক পরিধিতে কী করে ওইসব কদর্য-কদাকার শ্রীহীন রূপ, মানুষের আত্ম-অবমাননার আলেখ্য, সত্যের বাস্তব প্রকটতার ক্যানভাসে এসে গেল, আদি সৌন্দর্যপিপাসুরা তা ভেবে হকচকিত। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে জয়নুল আবেদিনই এদেশে প্রথমবারের মতো অসুন্দরের রূপকার, যা সত্যি এবং কঠিন, যেটাকে এড়িয়ে গেলে নিজেকে ফাঁকি দিয়ে জীবনকেই অস্বীকার করা হয়। অনেকটা বাধ্য হয়ে সৌন্দর্যের পুরোহিতরা বড্ড অনিচ্ছায় এই রূপকে চিরকালের রূপ বলে স্বীকার করেন।

দরিদ্র দেশের এই চিরন্তন রূপ প্রায় প্রতিটি দেশে আন্তর্জাতিক ও ধ্রুপদী হিসেবে পরিগণিত। এই দুর্ভিক্ষের বাস্তব-আখ্যান চিত্রমালার যেন শেষ নেই। অসম সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ফল প্রতিনিয়ত অপরিবর্তনীয় রূপে বিরাজমান। একটি আঁচড়ও তার এখন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তনের দাবি রাখে না। এমনই বিষয় জয়নুলের সস্তা হলদেটে মোটা কাগজে মোটা তুলির কালো কালির ভয়াবহ দাগে চিরজাগরূক।

গ্রামবাংলার মানুষের রূপকার তিনি, কিন্তু তাঁর চিত্রের নির্মাণশৈলী কি কোনো গ্রামীণ রূপের আলোকে উদ্ভাসিত – এই প্রশ্ন নেতিবাচক উত্তর পায়। তাঁর শৈলী ইউরোপীয়  পশ্চিমা-প্রতীচ্যিক, তাই আধুনিক এবং আলোকচিত্রের হুবহুতায় ছবিগুলোর বাস্তবমুখী সাবলীলতা দেখা যায়, যদিও তিনি চিন্তা-ভাবনা কর্মকান্ডের বিষয়ে ছিলেন অতিশয় দেশজ ও প্রাণবন্ত। তাঁর শিক্ষা আধুনিকতায়, দেশজ রীতির চিত্রধারা নির্মাণ, লোকজশৈলী সেখানে অনুপস্থিত, সেই হিসেবে পথিকৃৎ। এই সৃষ্টিশীলতা আগে কারো মধ্যে দেখা দেয়নি, তাই তিনি এদেশের প্রথম পূর্ণ আধুনিক শিল্পী। এখন প্রশ্ন, ইউরোপীয় রীতিতে ছবি আঁকা ছাড়া দেশজ রীতিতে ছবি আঁকলে সেটা কি আধুনিকতার পর্যায়ে পড়ে না? উত্তর, না, পড়ে না। কারণ, এখানে বিষয় মুখ্য নয়, শৈলীটিই মুখ্য, তাই।

জয়নুলের সামনে দুটি ধারা বিদ্যমান ছিল এবং শক্তিশালী, সচল সেগুলো। একদিকে অবন ঠাকুরের নব্য-ধ্রুপদী রীতি, অন্যদিকে যামিনী-নন্দর বাংলার লোকজধারার পুনর্জাগরণরীতি। জয়নুল এর কোনোটিতেই হাত দেননি। এর বদলে তিনি শুদ্ধ শিল্পের আধুনিক সর্বশেষ সাম্প্রতিক ধারাতে অবগাহন করার ব্রতে নিমগ্ন হয়েছিলেন। তাঁর রেখাপ্রধান বাস্তবধর্মী আলোকচিত্রধারায় পরিবেশিত কষ্টের মানচিত্র, দুঃখের সৌন্দর্য, কমই বেশি, স্বল্পতাই বহু ও অনেক। এরকম মানুষের বড় বড় কষ্ট ও দুঃখ তখন ভিক্ষার অভাবকালে দুর্ভিক্ষের অমানবিক হুবহু সংবাদপত্রের সংবাদচিত্র ধরনের স্পষ্ট অঙ্কন চিত্রাবলি সবার মধ্যে আলোড়ন তোলে। হয়তো ছবিগুলো পেইন্টিং বা বর্ণলেপন শিল্পকলা পর্যায়ে পড়ে না; কিন্তু অনস্বীকার্য, এগুলোর দ্বারা প্রমাণিত হয়েছিল, ’৪৩-এ একদার ব্রিটিশ উপনিবেশ ও রাজতন্ত্রের আকাশে যেখানে সূর্যমন্ডল চিরজাগরূক, কখনো অস্তায়মান হয় না, তার শেষ সময়ের অবিচার, শোষণ-শাসন-নিপীড়নের প্রামাণ্য দলিল, যা বহুদিন যাবৎ বহমান ছিল তাদের শাসনকালে।

অসামান্য স্কেচগুলো আলোকচিত্রের বাস্তবতায় হুবহু, দুর্ভিক্ষের কঠিন ভয়ংকর সৌন্দর্য কি নিষ্ঠুর জীবন্ত! মানুষের দুঃসহ বাস কত হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক! এসবের প্রকাশ চিত্রশিল্পে, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো প্রচন্ড শব্দের হুহুংকারে চৌচির। এতকিছুর পরও লক্ষ করা যায়, নির্মোহ বিবেচনায়, জয়নুলের এই যে প্রিয় ও সহজাত অঙ্কনরীতি, স্কেচ বা বাস্তবমুখী আঁচড়-প্রক্রিয়া, তা থেকে তিনি বেশিদূর এগোতে পারেননি। কথাগুলো অপ্রিয় হলেও সত্যি। মাঝেমধ্যে এই গন্ডি থেকে তিনি প্রাণপণে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু আবার তার সহজাত স্বাচ্ছন্দ্যের কাছে ফিরে গেছেন।

তাঁর বিখ্যাত ‘পাইন্যার মা’, ‘মা ও ছেলে’, ‘দুই মহিলা’ বা ‘প্রসাধনরতা দুটি মেয়ে’র ছবিগুলোতে বাংলার লোকজ ধারাগুলো বেশ জোরালো। আবার ‘চারটি মুখ’, ‘গুণটানা’ বা ‘একাকী বনে’ ছবিগুলোতে আধামূর্ত-বিমূর্ততার আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সাবলীলতা, নিজস্ব শৈলী বা এদেশে পৃথক এক জয়নুলীয় ভঙ্গি সৃষ্টিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ এবং বাস্তবতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সুবিখ্যাত প্রতীকী চিত্র ‘ষাঁড়ের বিদ্রোহ’, মইয়ের ওপর গতিময় জমি চষা, গরুর গাড়ি কাদায় আটকে যাওয়া থেকে ঠেলার সংগ্রাম, সাঁওতালদের ছবি, ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে পিতা-পুত্রের চিন্তিতমুখে ফেরিঘাটে প্রতীক্ষা, পুকুরে ছিপ ফেলে ধৈর্য নিয়ে মাছ ধরা প্রভৃতি ধ্রুপদী ছবিতে।

জয়নুলের বিষয় সাধারণ মানুষ, সাধারণ দৃশ্য, যেখানে সাবলীলতা ছাড়া আকস্মিকতার বাড়াবাড়ি নেই। এদেশের নদী, মানুষ, দিগন্তজোড়া আকাশ, গাছপালা, অবলা জীবজন্তু, পাখপাখালি তাঁর সচল তুলিতে সব মিলিয়ে সাধারণ দৃশ্য; কিন্তু অসাধারণ উপস্থাপনায় এক অপূর্ব বাঙালিয়ানায় ভাস্বর। বিষয়গুলো মুহূর্তেই হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত, গতিময় ও বহুমাত্রিক।

গতির উদ্দাম চঞ্চলতা এদেশের ক্যানভাসে এর আগে, এমনকি পরেও, কোনো শিল্পীর কাজে এমনভাবে উপস্থাপিত হয়নি। এই চঞ্চল গতিময়তা তাঁর প্রধান শিল্প-চরিত্র। কিন্তু সেটাকে টেনে বহুদূর প্রসারিত করতে নানান কারণে স্থিতিহীন হয়ে পড়েছিলেন জয়নুল। তিনি যেমন সংগঠক, শিক্ষক, তেমনি ছিলেন একজন শিল্পী ও সামাজিক কর্মকান্ডে জড়ানো অস্থির মানুষ। তাই বোধহয় এ-কথা আজ বললে ভুল হবে না যে, তাঁর শৈল্পিক ক্ষমতার যে অভূতপূর্ব স্ফুরণ প্রথমে যেভাবে প্রকাশছটায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে যাচ্ছিল, পরবর্তীকালে তা সময়, যত্ন, সুযোগ ও পরিচর্যার অপর্যাপ্ততার কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।

তৃতীয় বিশ্বের শিল্পী-সাহিত্যিক-সংগীতজ্ঞদের এটি এক ট্র্যাজেডি যে, একজন যখন তাঁর শৈল্পিক প্রতিভার দীপ্তি নিয়ে বিকশিত হন, তখন আশেপাশে অন্য কিছু না থাকায় এসবের প্রাতিষ্ঠানিক দায়দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে জোটে এবং তিনি তা বাস্তবে রূপ দিতে এগিয়ে আসেন দেশ, দশ, শিল্প ও নতুন প্রজন্মের মুখ চেয়ে। এতে তাঁর শিল্পীসত্তার শৈল্পিক বিকাশ সময় ও সুযোগের অভাবে সাবলীলভাবে পরিস্ফুট হতে পারে না। প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় সব শিল্প ও শিল্পীর ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায়, যাঁরা এমনতর সামাজিক-সাংস্কৃতিক কূপমন্ডূকতার শিকার হন।

সদ্য বিভক্ত একটি দেশে তার জনগণের জন্যে যখন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই, সেই দায়দায়িত্ব জয়নুলের মতো শিল্পী ও শিল্পসচেতন মানুষের ওপর পড়লো। এই সাংগঠনিক বিপুল কর্মকান্ডে তাঁর শিল্পী হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ তদানীন্তন আর্ট কলেজ বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ সৃষ্টির বাস্তবায়নে আমলাদের লাল ফিতার বাধাকে অতিক্রম করতে অনেকাংশে সাহায্য করে এবং তিনি সফলকাম হয়ে এদেশে চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গোড়াপত্তন করেন।

এখানে বলা যায়, এর মধ্য দিয়ে তাঁর শিক্ষকতার মহান পেশায় জীবনকে উদ্বুদ্ধ করেছে সত্যি, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সৃষ্টিধর্ম ও শিল্পশৈলী। কিন্তু তাই বা বলা যায় কেমন করে। আমরা যদি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সৃষ্টিকে ব্যতিক্রমী একটি ইনস্টলেশন আর্ট বা স্থাপনাশিল্প হিসেবে ভাবি ও মূল্যায়ন করি, তাহলে তা অনবদ্য এক সৃজনশীলতার উদাহরণ হয়ে প্রতিষ্ঠা পায় এবং জয়নুল সেই বিচারে এদেশের প্রথম ও পথিকৃৎ  স্থাপনাশিল্পী বলে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

ক্রমাগত উত্তরণ বিভিন্নভাবে ও পর্যায়ে একজন মহৎ শিল্পীর অন্যতম লক্ষণ। জয়নুলের লক্ষণ তেমনি শিল্পীর পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে ও কার্যক্রমে পরিলক্ষিত হয়। এদেশের এ যাবৎ যাবতীয় শিল্প ও শিল্পী সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশের তিনিই একক সৃষ্টিকর্তা – এ-কথা সর্বতোভাবে সত্যি ও তা অনস্বীকার্য।

প্রতিটি উন্নতিশীল দারিদ্র্য, ধর্মান্ধ ও অশিক্ষাপীড়িত দেশে এইভাবে অনেক সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁর নিজস্ব কাজের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্যে একধরনের আত্মাহুতি দিয়ে থাকেন। জয়নুল তেমনি একজন শিল্পী ও সচেতন শিল্প এবং দেশপ্রেমিক মানুষ। সমস্ত বাধা-বিপত্তির মাঝ দিয়ে তিনি দৃঢ়পদে অকুতোভয়ে নির্দিষ্ট ও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে এগিয়ে গেছেন, এখানেই জয়নুলের জয়।

শিল্প সবসময় মূল উৎসকে ঘিরে সর্বাপেক্ষা আপন স্বাভাবিকতায় সৃষ্টিশীল হয়। যে-স্বেচ্ছাচারী নয়, বরং স্বাধীনতাচারী, তার ক্রমোন্নতি অপরের কাঁধ বেয়ে নয়; বরং সে সর্বদাই নিজস্ব পথচারী। ই.বি. হাভেল এই কারণকার্যতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদ, দেশীয় ঐতিহ্যবাদ, নাকি আধুনিকতাবাদ – ঐতিহ্যবাদের মিলন-সেতু – এই তিনটি ধারায় আমাদের বিশেষ করে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি একদা-ঔপনিবেশিক শাসনামলের দেশে শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চা হয়ে আসছে এবং শিল্প-আন্দোলন, শিল্পালোচনা, শিল্প-মতবাদ, শিল্পচর্চা ও শিল্পীগোষ্ঠী এই ত্রিধারাতেই আবর্তিত হচ্ছে।

বিভাগোত্তরকালে শিল্পকর্মচর্চার মূলে হাভেল, তারপর জাপানি শিল্পী ওকুয়াকুরা, যাঁরা অবনীন্দ্রনাথের শিল্পগুরু ছিলেন আর তাঁর পরিচর্যা ও মননে গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, অসিত হালদার, মুকুল দে একে একে এই শিল্পচর্চায় নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। অবনীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত শিল্পধারায় যামিনী রায়, মনীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, আব্দুর রহমান চুগতাই, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় উল্লেখ্য। এর ভেতর একক রবীন্দ্রনাথ, তিনি প্রথম ভারতীয় আধুনিক ও ব্যতিক্রমী শিল্পী, যিনি মনের অবচেতনকে কেন্দ্র করে কোনো স্কুলের প্রথাগত শিক্ষাপদ্ধতি ব্যতিরেকে নিতান্তই নিজের জন্যে, পরে সবার জন্যে শিল্প সৃষ্টি করে গেছেন। ভারতীয় শিল্পকলার গৌরবময় ঐতিহ্য অনুসরণ করে এসবের পাশাপাশি তাঁরা বিষয়ে দেশীয় কিন্তু কৌশলে ইউরোপীয় রীতি ব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে তখন কিছু সমমনা শিল্পী মিলে ক্যালকাটা গ্রুপ শিল্পীগোষ্ঠীর আবির্ভাব হলো। এঁদের উদ্দেশ্য হলো, সনাতন রীতি ভেঙে অন্যরকম কিছু করা। তাঁরা হলেন – গোপাল ঘোষ, নীরোদ মজুমদার, প্রাণকৃষ্ণ পাল, প্রদোষ দাশগুপ্ত, পরিতোষ সেন, রামকিংকর প্রমুখ। জয়নুল এঁদের সঙ্গে না থেকেও এক পৃথক বলিষ্ঠ বাঙালিয়ানা ঘরানার পথিকৃৎ শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ঈর্ষণীয়ভাবে। শিল্পী নন্দলাল এঁদের মধ্যে অন্যরকমের, যিনি সর্বদা পদ্ধতিগত ও বিষয়বস্ত্তগত উভয় দিক দিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনুসারী ছিলেন। জয়নুলের পরিবেশ এমনই ছিল। দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা থেকেই তাঁর শিল্পের হৃদয়-কাড়া সৃষ্টিসম্ভার। শিক্ষক জয়নুল, শিল্পী জয়নুল, সংগঠক জয়নুল – এই ত্রিযজ্ঞের সাধনায় কে শ্রেষ্ঠ আজ জিজ্ঞাসিত হলে বলা যায়, কিছু প্রতিভাধর মানুষ দেশের ক্রান্তিকালে প্রাকৃতিক নিয়মে এরকম জন্ম নিয়ে থাকেন, জয়নুল সেরকমই এক পথিকৃৎ, ব্যতিক্রমী ও সম্পূর্ণভাবে বাঙালিয়ানায় ব্যাপৃত শিল্পী ও মানুষ। তিনি কার্য ও সময়কালের প্রতিভাদীপ্ত পুরুষ, যিনি এদেশের প্রতিটি শিল্পী ও শিল্পকালের জন্যে এক চিরকালের পিতৃপ্রতিম ব্যক্তিমানস হয়ে সবার মধ্যে বেঁচে থাকবেন।

শিল্পীর নির্মাণ উপকরণ, উপাদান, বিষয় ও বিষয়ী তাঁর পরিবেশ-প্রতিবেশ সব মিলে গড়ে ওঠে। দেশের অসহায় মানুষ, গ্রাম্য বধূ, জল, মেঘ, নৌকো, আকাশের ভেতর তাদের সীমাহীন দুঃখ-দারিদ্র্যই জয়নুলের উপজীব্য। প্রতিটি বিষয় বাস্তবঘেঁষা, মডেলমুখী কিন্তু তাঁর ছবির অনন্য গুণে মডেলের মনুষ্য-মুখ বা দেহকে অতিক্রম করে তাদের বোধ-অনুভবের প্রতিক্রিয়া অন্য জগতে নিয়ে গেছে। নিখুঁত ড্রইং ও তার অসামান্য গতি বোধের অনুপুঙ্খতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মোটা তুলির ধারণক্ষমতা, তুলি চালনার কমবেশি মোটা-সূক্ষ্মতার সাবলীলতা, আলো-ছায়ার নির্মাণ গতিকে থামিয়ে মুহূর্তেই ফ্রিজশটের ক্যামেরা-কুশলতা, সামান্যের মাঝে অসামান্যের ঝিলিক, রঙের অনতি-প্রয়োজন ব্যবহার এবং সর্বোপরি সবার ওপর দিয়ে বিষয়কে ছাড়িয়ে বোধের হৃদয়গ্রাহিতা – এসবই ধ্রুপদী মাত্রায় বিভূষিত হয়ে এদেশের নিজস্ব ভান্ডারের অক্ষয় জয়নুলীয় সম্পদ হিসেবে সংরক্ষিত।

জয়নুলের কাক কালো রং নিয়েই ক্যানভাস থেকে উড়ে চলে যেতে চায় দ্রুত – এমনই গতিময় বাস্তবায়িত শিল্পশৈলী! তাঁর রৈখিক কালো মোটা দাগ ও আঁচড় স্টেইন্ড গ্লাসের কালো সীমানার মতো, যার ভেতরে রঙের উজ্জ্বল পূর্ণতা, জাপানি ও চৈনিক জলরঙের রীতি-কৌশলের সহজ-সরলতা যেমন, তেমনি কঠিন ও বিশুদ্ধ মাত্রার। কব্জির জোর বিষয়ের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে, যা কিছুটা প্রকৃতিদত্ত ও নিরন্তর অনুশীলনের ফসল।

রেখা ছবির প্রাণ – এটাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে অনেকের কাজে মূলত মৌলিকতার স্বাক্ষর দৃষ্টিগোচর হয়। আমাদের দেশের রশিদ চৌধুরীর শিল্প-সৃষ্টিতে কালো রেখা-রঙের ঘনত্ব ও সীমানা তার রহস্য সৃষ্টির অন্যতম চাবিকাঠি, তেমনি ভারতের নীরোদ মজুমদার বা ফিদা হুসেনের শিল্পেও  এ-রীতি সাবলীল ও মুখ্য। শিল্পী শাহাবুদ্দিনের কাজেও জয়নুলের প্রাতিষ্ঠানিক রীতির অঙ্কনশৈলী ও ক্ষিপ্র-পরিশীলিত গতি লক্ষণীয়, বোহেমিয়ান শিল্পী সুলতানের ছবিতেও।

এই কালো রৈখিক আঁচড়-রীতি দেশজ পরিবেশ-পরিস্থিতিতে অন্য আদি ঠিকানার সন্ধান দেয়, যার মূল সুদূর অজন্তা-ইলোরায়। গ্রামবাংলার রূপকার যেমন জয়নুল, এ তো একমাত্র আদি ও মুখ্য, তেমনি কবিতায় জসীম উদ্দীনের মতো সহজ-সরলে বিষয়ীভূত, যেখানে গ্রাম বা দেশের মানুষই প্রধান। সেই সময়ে মুসলিম জাগরণে নজরুল-জসীমের কবিতা, গান, জয়নুলের ছবি, আববাসউদ্দীনের কণ্ঠ যেমন অপরিহার্য, তেমনি জাতীয়তাবাদের নবজাগৃতির পরবর্তীকালে স্বাধীনতার চেতনালব্ধ আকাঙ্ক্ষাও সেখানে অন্তর্লীন ছিল।

জয়নুলের ছবির ধ্রুপদী ইউরোপীয় রীতি তাঁর দেশপ্রেমের বিপরীতে, বিষয়টি আশ্চর্য লাগে, তবে তাঁর বিষয় সর্বদাই দেশজ, মাটি ও গণমুখী – একথাও আশ্চর্য! এর ভেতরেও বাংলার আদি লোকজ-আধুনিক ধারার অনুসারী কামরুল হাসান অথবা শুদ্ধ ইউরোপীয় সমকালীন আধুনিকতায় সম্পূর্ণ নিমজ্জিত মোহাম্মদ কিবরিয়া বিপরীত বৈপরীত্যে নিমগ্ন। কলাবিদ্যা যতখানি দেশজ, ততখানি আত্মস্বাধীনতামূলক ও নিজস্ব, যেখানে শিল্প-সৃষ্টিই মুখ্য বিষয়। বর্তমানে প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশ, যারা স্বাধীনতাপ্রাপ্ত হয়েছে, সেখানে শিল্প-সৃষ্টিতে দেশজ বিষয় ও উপাদানের নিজস্বতা সৃষ্টি শুদ্ধ শিল্পের মূল্যায়নে অন্যতম মাপকাঠি বলে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষ করে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও শিল্পের ওপরেই এই হিসাবটা বর্তায়, যেহেতু একটি দেশের প্রকৃত পরিচয় ও নিজস্বতা এসবের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। এই বিচারে জয়নুলের অবশ্যই সার্বিকভাবে সফলতা প্রাপ্য, তিনিই পথিকৃৎ, একান্তভাবেই দেশজ, যা তার শিল্প-চেতনার দূরদৃষ্টির পরিচয় বহন করে। ঢাকার শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও সোনারগাঁওয়ে লোকজ জাদুঘর, ময়মনসিংহ জাদুঘর ও শিল্পীদের জন্যে পৃথক শিল্পগ্রাম প্রতিষ্ঠা খুবই সুদূরপ্রসারী অনন্য প্রচেষ্টা হিসেবে স্বীকৃত। এভাবে একটি দেশ তার হারানো ঐতিহ্য খুঁজে পায় এবং স্বাধীনভাবে তার বিকাশে নিরন্তর চর্চা করে, তবে অবশ্যই তার ফলে নিজস্বতার ধারাবাহিকতা আসবে, যা তার জন্যে এক অক্ষয় সংযোজন।

পথিকৃতেরা সময়ের ফসল সর্বদাই, পরিবেশ তাঁদের প্রাকৃতিকভাবে প্রয়োজনে সৃষ্টি করে থাকে। সময় যখন পেরিয়ে যাবে সুদূর ভবিষ্যতে, জয়নুলের নাম এই শ্রদ্ধা-বিনয়ভাবে জন্মশতবার্ষিকীতে শিল্পীমানুষ হিসেবে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং জয়নুলকে যতখানি প্রবন্ধ, বার্ষিকী, সেমিনার, সভা-সমিতি ও বক্তৃতায় মনে করবে, তার চেয়ে বেশি মনে করবে তার ‘পাইন্যার মা’, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম’ – যা স্বাধীনতার অগ্রগামী, ‘দুর্ভিক্ষের অসহায় মানুষ’, ‘ডাস্টবিন’, ‘কাক’, পঁয়ষট্টি ফুটের নবান্ন আর তিরিশ ফুটের ‘নভেম্বর গোর্কির ’৭০’-এর স্ক্রল-দীর্ঘ ছবিগুলো।

মানুষ বা সংগঠকের পরিচয় শিল্পীর পরিচিতিকে ম্লান করতে পারে না, কেননা একটি মানুষের জন্ম ও জীবনের সার্থকতা তার নিজস্ব সৃষ্টিতে বিধৃত অবশ্যই, অন্য কিছুতেই নয়, যেহেতু সৃষ্টি সর্বদাই নিজস্ব ও অতিবিশ্বস্ত পরিচয়ে সমৃদ্ধ। তাই শিল্পী জয়নুলই জয়নুলের আদি, অকৃত্রিম ও অন্যতম পরিচয়, অন্য পরিচিতি বাহুল্য মাত্র। এই মহান পথিকৃৎ শিল্পী-সংগঠকের জন্মশতবার্ষিকীতে জানাই প্রাণঢালা শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং ভালোবাসা।