চিত্রাঙ্গদা : কিছু তথ্য

সাগরিকা ঘোষ

উনিশ শতকে নবজাগরণের ফলে যখন উত্তরাধিকারের চর্চা শুরু হলো, তখন নৃত্যকলার চর্চাও সুশিক্ষিত বাঙালিরা করেছে। উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অবশ্যই ঠাকুর পরিবার। স্বয়ং দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন অভিনয়-অনুরাগী। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, তাঁর মেজোভাই গিরীন্দ্রনাথ ও ছোটভাই নগেন্দ্রনাথও ছিলেন অভিনয়ে উৎসাহী। তাই তাঁরা বাড়িতে মঞ্চ স্থাপন করে গীত ও নাটকের চর্চা শুরু করেন। গগনেন্দ্রনাথ, গুণেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরা সবাই সমবেতভাবে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জোড়াসাঁকো থিয়েটার নামে একটি নাট্যসম্প্রদায় গড়ে তোলেন। অভিনীত হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী ও একেই কি বলে সভ্যতা, রামনারায়ণ তর্করত্নের নবনাটক প্রভৃতি নাটক। এমনকি ১৭৭৫ সালে বিলেতি থিয়েটার কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ‘অপেরা ইন মুজিকা’র অনুকরণে বাংলা ভাষায় গীতিনাট্যের চর্চাও লক্ষ করা যায় ঠাকুরবাড়িতে।
এই সাংস্কৃতিক পরিবেশেই বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের। কেবল এদেশীয় সংস্কৃতি নয়, বিলেত যাওয়ার পূর্বেই তিনি বিদেশি সংস্কৃতির সংস্পর্শ লাভ করেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আনুকূল্যে। চিরকালের নিরীক্ষা-উৎসুক শিল্পী রবীন্দ্রনাথ স্বরকে বেঁধেছেন সুরে, সুরকে বেঁধেছেন ছন্দে। তিনি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তাই বলেছেন –
আমি বিচিত্রের দূত। নাচি নাচাই,
হাসি হাসাই, গান করি, ছবি অাঁকি,
যে আবিঃ বিশ্বপ্রকাশের অহৈতুক
আনন্দে অধীর আমি তাঁরই
দূত।১
বিচিত্রের দূত দিয়েছেন আমাদের বিচিত্র সাহিত্যসম্ভার। তা নানা আঙ্গিকে, নানা রসে-বর্ণে পরিপূর্ণ। উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, গান, কবিতা তো আছেই তারই সঙ্গে কাব্যনাট্য, গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য তাঁর সৃষ্টির নানা দিগন্তকে চিহ্নিত করেছে। আর মনে হয়, এর মধ্যে চিত্রাঙ্গদা (কাব্যনাট্য ও নৃত্যনাট্য) তাঁর প্যাশন।
১৯১৩-১৪-এর পর, বলা ভালো, গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদে সফলতা অর্জন করে উৎসাহী রবীন্দ্রনাথ অনুবাদকর্মে ক্রমশ স্বাধীন হয়ে উঠলেন। বিদেশি বন্ধুদের সহযোগিতা ছাড়াই তিনি একের পর এক কবিতা, কাব্যনাট্য, রূপক-সাংকেতিক নাটকের অনুবাদের কাজে মনোনিবেশ করলেন। ১৯১৩-তে প্রকাশিত হলো আরো দুটি অনূদিত কাব্যগ্রন্থ – দি ক্রিসেন্ট মুন ও দি গার্ডনার। অবশ্য অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লিখিত একটি পত্র থেকে জানা যায়, ১৯১২, ১৬ জুন (যেদিন বিলাতে পৌঁছেছিলেন রবীন্দ্রনাথ) থেকে ১৯১২-র আগস্ট মাস – এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কেবল গীতাঞ্জলির পান্ডুলিপিই প্রস্ত্তত করেননি, এরই সঙ্গে চিত্রাঙ্গদা, মালিনী ও শিশুর তর্জমা করেছেন। সম্ভবত চিত্রাঙ্গদাই ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর প্রথম নাটক। ১৮৯২ সালে কাব্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা রচনার ২১ বছর পরে ১৯১৩ সালে চিত্রা নাম নিয়ে ইংরেজি অনুবাদটি প্রকাশিত হয়। শিরোনামটির সংক্ষিপ্তকরণের কারণ হিসেবে ১৯১৩ সালের ৭ নভেম্বর শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি উইলিয়াম রোদেনস্টাইনকে পাঠান –
The name of the heroine in Mahabharata is Chitrangada but as you have no soft dental d in your alphabet and as your readers are sure to put accent in the wrong place making it sound very unmusical, I have ventured to cut it short, retaining the first portion of it which I am sure was the only portion used by her parents if she ever did have any name and parents to boot. (Mary M. Lago, Imperfect Encounter, Harvard University Press, 1972, p 129).২
কালেক্টেড পোয়েমস অ্যান্ড প্লেজ (১৯৩৪) প্রকাশের প্রস্ত্ততিপর্বে অক্সফোর্ডে গবেষণারত অমিয় চক্রবর্তীকে মাদ্রাজ থেকে ২৩ অক্টোবর ১৯৩৪-এ কবি লিখলেন –
আমার সমস্ত ইংরেজি কবিতাগুলোকে একসঙ্গে মিলিয়ে ছাপাবার প্রস্তাবটা ভুলো না। ইয়েট্স্ কিংবা কোনো কবির সাহায্য নিয়ে বাছাই করা ভালো। ওতে বিস্তর কাঁচা জিনিষ আছে – হয়তো কাঁচা লাইনগুলোকেও ঝালাই করা দরকার।৩

প্রত্যুত্তরে অমিয় চক্রবর্তী জানান, কাব্যসংগ্রহ প্রস্ত্ততিকরণের জন্য ইয়েট্সের প্রয়োজন নেই। পরবর্তী পত্রে জানান, ড্যানিয়েল ম্যাকমিলান এই এডিশনের বিষয়টি নিয়ে খুব উৎসুক। উৎসাহী রবীন্দ্রনাথ তখন অমিয় চক্রবর্তীকে তাঁর পুরাতন বন্ধু স্টার্জ মুরের কাছে যেতে বলেন। স্টার্জ মুর এই প্রস্তাবে সম্মত না হলে কবিগুরু আবেদন রাখেন আর্নেস্ট রিজের কাছে। এই আবেদন রিজ সানন্দে গ্রহণ করেন। ১৯৩৫-এর আগস্ট মাসে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে আসেন অ্যান্ড্রুজ এবং সেপ্টেম্বর মাসে নির্বাচিত কবিতার তালিকা সংগ্রহ করে পৌঁছোন বিলেতে। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে তিনি আর্নেস্ট রিজের সঙ্গে যোগাযোগ করে রিজের ওপর সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।
চিত্রাঙ্গদা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের আস্থা যে কত গভীর তার প্রমাণ মেলে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে প্রেরিত একটি পত্রে –
চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যটি একটি বিশেষ সৃষ্টি। যাকে ইংরেজী ভাষায় বলে ক্রিয়েশন। জিনিষটি যদি কোন য়ুরোপীয় গুণীর রচিত হোত তাহলে দেশের লোক ভিড় করে আসত, অথবা যারা নোবেল প্রাইজ দিয়ে থাকে তাদের পাঞ্জার ছাপ থাকত তাহলেও জিনিষটাকে ভালো লাগতে এবং ভালো বলতে কার্পণ্য থাকত না।৪
তাঁর এই প্যাশনের কারণেই বোধহয় চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যটি এতোবার মঞ্চস্থ হয়েছে। কেবল কলকাতাতেই নয়, পাটনা, এলাহাবাদ, দিল্লি, লাহোর, মিরাট, লখনউ, আমেদাবাদ, মুম্বাই, নাগপুর, আসাম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, আসানসোল, এমনকি বাংলাদেশের খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা প্রভৃতি স্থানে। এই তথ্যও জানা যায় যে, বিশ্বভারতীর ঋণশোধের জন্য চিত্রাঙ্গদা অভিনয়ের মাধ্যমে অর্থসংগ্রহের পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন –
কবি যেদিন দিল্লীতে পৌঁছিয়াছিলেন, সেইদিনই সন্ধ্যায় গান্ধীজি ও কস্তরীবাঈ কবির সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসেন। গান্ধীজি তাঁহার হস্তে ষাট হাজার টাকার একখানি চেক দিয়া বলেন যে, কবির যে বয়স তাহাতে তাঁহার পক্ষে এভাবে অর্থের জন্যে ঘুরিয়া বেড়ানো সমীচীন হইবে না; এই টাকায় বিশ্বভারতীর ঋণ শোধ হইবে।৫
উত্তর ভারতে চিত্রাঙ্গদা অভিনয়ের পরে নির্মলকুমারী মহলানবীশকে প্রেরিত পত্রের মধ্য দিয়ে চিত্রাঙ্গদার ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রবল অনুরাগ ব্যক্ত হয় –
আমাদের চিত্রাঙ্গদার পালা সম্বন্ধে যতই কমিয়ে বলি না কেন মনে হবে অহংকারের অত্যুক্তি।৬
চিত্রাঙ্গদার প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্যাশনের চূড়ান্ত নজির ৬ এপ্রিল ১৯৩৬-এ অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা একটি পত্র –
চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের খবর পেয়েছো কিনা জানি নে। গল্পটাকে নাচে গানে গেঁথে নাট্যমঞ্চের উপরে প্রকাশ করা হয়েছে। এই পালাটা নিয়ে আমরা জয়যাত্রায় বেরিয়েছিলাম। কলকাতা পাটনা এলাহাবাদ দিল্লী মিরাট লাহোর এই কয় জায়গায় আসর জমিয়েছিলুম। সকল জায়গা থেকেই প্রভূত প্রশংসা পেয়ে এসেছি। যদি প্রত্যক্ষ দেখতে তাহলে বুঝতে গানে নাচে বর্ণচ্ছটার সমবায়ে সমস্তটার ভিতর দিয়ে অপরূপ সৌন্দর্য্যের কী রকম উৎকর্ষ অভিব্যক্ত হয়েছিল।৭