চুম্বন

আফসার আমেদ

জয়নাল বলল, ‘মায়ের জর্দার প্যাকেটগুলো ব্যাগে তুলতে ভুলে যাওনি তো?’

শ্রীপর্ণা বলল, ‘আরে খুলে দেখে নাও না।’

‘দেখতে হবে না, নিয়েছ বললেই যথেষ্ট। আর সাবান-জর্দার প্যাকেট বিস্কুট আর বাদামের প্যাকেটের সঙ্গে মিশিয়ে নাওনি তো?

শ্রীপর্ণা বলল, ‘কখন ট্রেন ছাড়বে? এই ফাঁকা ট্রেনটায় উঠলে কেন?’ শ্রীপর্ণা আঁচল দোলায় মুখের সামনে।

‘গ্রামে যাবার ট্রেনের ব্যাপার-স্যাপার তুমি জানো না পর্ণা, এটাতে পছন্দমত সিট

পেয়েছ তুমি, ব্যাগ রাখার ফুরসত পেলে। দেরি হোক না, ভিড় ট্রেনে ওঠার ঝক্কি পোহাতে হল না তো তোমায়’ –

‘আরে থাক থাক, তোমাকে আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। এই প্রথম যাচ্ছি তোমার গ্রামের বাড়িতে, দেরি করে গেলে’ –

‘মা-আববুর জামাকাপড়গুলো তোমার ব্যাগে তো?’

‘সব নিয়েছি জয়। আমার শাড়ি-জামাও।’

‘তাদের কাছে নতুন বউ তুমি!’

‘ধেৎতেরি, যা হবার তা হবে, আমি ভয় পাই না।’

‘আমি তোমাকে সামলাবো না কিন্তু।’

‘ঠিক আছে, আমার মামলা আমি বুঝে নেব। কী যেন স্টেশনের নাম?’

‘হাউড়।’

‘গ্রামের নাম তো আদুল, স্টেশনের নামটা তো বললে হাউড়। মেছেদার আগে না পরে?’

‘মেছেদা পাঁশকুড়া ছাড়িয়ে।’

‘অটোরিকশায় পাঁচ কিলোমিটার? এখন তো সকাল আটটা তেরো, কখন পৌঁছবো?’

জয়নাল হাসল, ‘তা তো জানি না।’

‘মজা করো না জয়! সিরিয়াস হও।’

‘তোমার যে কী হবে!’

‘মানে? বোকার মতো দাঁত বের করে হাসছ কেন?’

‘আবার যদি ওরা তোমার-আমার বিয়ে দেয় মুসলমান মতে?’

শ্রীপর্ণা করুণ চোখে তাকাল জয়ের দিকে। তারপর বলল, ‘সেটা করবে না। আমরা সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টে যে বিয়ে করেছি।’

‘সমস্যা যদি বাধায়?’

‘তুমি সামলাবে।’

‘তোমাকে খুবই মেনে নেবে পর্ণা, খুব ভালবাসবে। কিন্তু ভালবাসাও যে নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে।’

‘কি যা-তা বলছ, তুমি একজন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক।’

‘তাতে কী হয়েছে, তুমিও কলকাতার কলেজে পড়াচ্ছ। এখন বল, তুমি কী করবে?’

‘আমি ভয়ে মারা পড়ব।’

‘তুমি এত বোকা?’

‘মানে?’

‘এসব কিছু আমাদের ছোঁবে না।’

‘তুমি এতক্ষণ আমার সঙ্গে মজা মারছিলে? অথচ তোমার গ্রামের আত্মীয়দের না দেখেই এত ভালবেসে ফেলেছি’ –

জয় কথাটা শুনল, কিছু উত্তর দিল না।

ট্রেন অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। ট্রেনে যথেষ্ট ভিড় হয়েছে। মুখোমুখি জানালার ধারে তারা বসেছে। পর্ণা হাওয়ার অভিমুখে বসেছে। চোখ মেলে ঘরবাড়ি মাঠ প্রান্তর দেখছে। রোববারের সকালে তারা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছিল। জয়ের হয়তো কথার আরামে ঘুম এসে গেছে, চোখ বুজিয়ে নিয়েছে। শ্রীপর্ণা বাইরে তাকিয়ে আছে। নতুন জায়গায় যাওয়ার আনন্দ তার মনে। কেন এমনটা হল তার মনে, ঠিক বলতে পারবে না। জয়কে বিয়ে করার জন্য? জয়কে ভালবেসে বিয়ে করেছে। মানুষ হিসেবে সে সৎ ও সজ্জন, কেননা এখনো জয়ের মনে গ্রামের ধুলো কাদা মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুরের স্পর্শ লেগে আছে। সম্পর্কের ঘোরপ্যাঁচ মিথ্যের কলুষ তাকে ছুঁতে পারেনি। ধর্ম মানে, কিন্তু তার দর্শন মানবিক। তাকে বিশ্বাস করে করে মরে যাওয়া যায়। কত কিছু বর্জন করে নিজেকে গড়েছে সে। একটা সেমিনারে পেপার দিয়েছিল জয়। তার পেপার শুনে আলাপ। তারপর তো মোবাইলে কথা হওয়া, দেখা হওয়া। কীভাবে যেন নিজেদের জুড়ে যাওয়া। এই জোড় এখন সম্পর্কের প্রসাদে মধুর হয়ে উঠেছে। বিয়ে করেছে, পরীক্ষার আগে ফরম ভরতি করার মতো করে। আগে থাকত জয় এলিয়ট রোডের মেসে, পড়ায় প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে। নিজের বাবা-মার কুদঘাটের ফ্ল্যাটে জয়কে নিয়ে গেছে পর্ণা, পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বাবা-মা ও বোনের সঙ্গে। যাতায়াত বেড়েছে। ধীরে-ধীরে জয়কে তারা মেনে নেয়। জয়ের এমনই গ্রহণযোগ্যতা। আট মাস পরে তারা বিয়ে করে। এখন তারা থাকে সাহাপুর হাউজিং গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারে। এইমাত্র তাদের বিয়ের বয়স দুমাস সতেরো দিন। জয় মা-বাবাকে জানায়নি। গত সপ্তাহে জানায়। তারা দেখতে আকুল হয় নববধূকে। আজ সেই উদ্দেশে যাত্রা করছে।

এই এক সপ্তাহ শ্রীপর্ণা জয়ের কাছে রূপকথা শোনার মতো আদুল গ্রামের গল্প শোনে। নদী, খেলার মাঠ, বনবাদাড়, চাষের মাঠ, প্রান্তরেখা, নয়ানজুলি, পুকুর-দিঘির গল্প শুনেছে। শুনেছে মা-আববুর কথা, আত্মীয়-প্রতিবেশীদের কথা। বর্ষার রূপ-গন্ধ নিসর্গের বর্ণনা শুনিয়েছে। শুনিয়েছে শীতের রোদ কতখানি মিষ্টি। আরো কত কিছু খাওয়া নিয়ে বলেছে।

শ্রীপর্ণা শুনে-শুনে গ্রামটাকে তার মতো করে কল্পনায় বানিয়েছে। কখন গিয়ে দেখে কল্পনার সঙ্গে মেলাবে, তা নিয়ে আগ্রহ তার বেড়েছে। গতকাল রাতে বিছানায় শুয়ে সেই কথা ভেবেছে, ঘুম আসে অনেক রাতে। খুব সকালেই ঘুম ভেঙে যায় তাদের। এপ্রিলের সকাল হতে বিলম্বও হয় না। পাঁচটার আগে থেকে চারপাশ আলোকিত হয়ে যায়। পৌনে সাতটায় বেরিয়ে আসে তারা।

শ্রীপর্ণা যাওয়ার পর, কেমন হবে ব্যাপারটা? আত্মীয়-পরিজনদের আচরণে কেমন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবে শ্রীপর্ণা? তা নিয়ে নিশ্চিন্ত
নয় জয়নাল। গ্রামের মানুষ তো নতুন কাউকে দেখলে অকপটে কিছু মন্তব্য করেই ফেলে। সেসব কথা কীভাবে নেবে শ্রীপর্ণা? খুব কি অপমানিত হবে? খুব কি আহত হবে? ব্যাপারটা খুব সুখকর হবে কিনা, তা নিয়ে দুর্ভাবনা থাকেই জয়নালের। মা-আববা জয়নালের বউ এই এইটুকু মনে রেখে তেমনটা ঘটাবে না – এই বিশ্বাস আছে জয়নালের। কিন্তু অন্য মানুষরা আলগা কথা ছুড়ে দিয়ে অপমান করতে পারে, বেফাঁস কিছু বলতে পারে। তাতে কেমন রকম আচরণ করতে পারে শ্রীপর্ণা? শ্রীপর্ণাকেও ভয়। অথচ প্রতিবেশী-পরিজনরা জয়নালের কেউ নয়, এমন তো নয়, তারাও আত্মজন, ভালবাসার লোক।

যা হওয়ার হবে। চারদিনের মামলা তো। তারপর ফিরে যাবে কলকাতায়। শ্রীপর্ণা আর না আসে আসবে না। এই গ্রাম, আত্মীয়স্বজন, গ্রামের মানুষ জয়নালের কাছে প্রিয়। প্রিয় এর মাটি, নিসর্গপ্রকৃতিও। তাকে আসতেই হবে। না এসে পারবে না।

ট্রেনের জানালার কাছে হাওয়ার মুখোমুখি বসে থাকতে-থাকতে শ্রীপর্ণা ঘুমিয়ে গেছে। দেখে শ্রীপর্ণাকে জয়নাল। গহনা পরেনি,
শাঁখা-সিঁদুর পরেনি। মানবিক রূপই তার শ্রেষ্ঠ অলংকার। শ্রীপর্ণাকে সামান্য সময় পরেই ঘুম থেকে তুলে জাগাতে হবে। কেননা আর একটা স্টেশন পর হাউড় স্টেশনে আসছে ট্রেন।

 

অটোরিকশা চলছে। স্টেশন-লাগোয়া রাস্তাটা মোটামুটি চলনসই। অটো রিজার্ভ করে নিয়েছিল জয়নাল। অন্য যাত্রী ছিল না তাদের অটোতে। শ্রীপর্ণা কথা বলছিল খুব, প্রশ্ন করছিল। শ্রীপর্ণার জানার কৌতূহল খুবই।

জয়নাল বলল, ‘ওই আমাদের হাইস্কুল।’

‘খুব নির্জন তো। চারদিকে গাছ দিয়ে ঘেরা। আমি এখানে ঘুরতে আসব।’

‘আপত্তি নেই।’

‘অমন মিনমিন করে বলছ কেন?’

‘গ্রামের স্কুল কি দেখাবার মতো কোনো কিছু আছে?’

‘তোমার পরিচয় আছে ওতে। তা কি তুমি অস্বীকার করো?’

‘তা কেন, যথেষ্ট আমার শ্রদ্ধা আছে।’

‘তাহলে দেখবে না কেন? – এই দেখো দেখো, একজন বউ ভ্যান-রিকশা চালাচ্ছে।’

‘গ্রামের মেয়েরা জীবিকার জন্য আকছার চালিয়ে থাকে।’

‘আমার খুব ভাল লাগছে, দেখতে, যেতে। ওটা কী?’

‘গ্রামীণ হাসপাতাল।’

‘রোগীদের চিকিৎসা হয়?’

‘পেটখারাপ আর জ্বরের ওষুধ ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। রোগীরা অনেক সকাল থেকে লাইন দেয়। ডাক্তার আসার ঠিক থাকে না।’

শ্রীপর্ণা কিছু একটা বুঝল।

অটো এবার ইটের রাস্তায় নেমে পড়েছে। গতি কমে গেছে। ঢিক ঢিক করে চলছে। শ্রীপর্ণা হঠাৎ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, ‘কতদিন থেকে অটো চলছে ভাই এই রাস্তায়? – আগে নাকি শুধু ভ্যান-রিকশা চলত?’

‘হ্যাঁ। এই আড়াই মাস হল অটোরিকশা চলছে।’

জয়নালকে জিজ্ঞেস করল পর্ণা, ‘তুমি জানতে?’

‘কেন জানব না, আমার গ্রামের সঙ্গে প্রতিদিন কথা হয়।’

‘আমাকে বলতে না!’

‘তুমি জিজ্ঞেস করোনি।’

এবার গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়েছে অটো। দু পাশাড়ি বাড়ি, পাড়া। পুকুর, জলের কল, ইলেকট্রিকের খুঁুটি। মনিহারি দোকান, মোবাইলের ব্যালেন্স ভরার দোকান, ইন্টারনেটে বসার ব্যবস্থা। এখন তো অনলাইনে ফরম ভরা, খবরাখবর পাওয়ার সুবিধে ভোগ করছে গ্রামের মানুষও। দামি সিগারেট থেকে শুরু করে, কোল্ডড্রিংকস, ফরেন লিকার সব কিছু পাওয়া যায়। এত সব জানাল জয়নাল শ্রীপর্ণাকে।

‘ডানদিকে যে দেখছ, ওটা মাদ্রাসা, ওই সামনে পাড়ার মসজিদ’, অটো আরো খানিকটা এগিয়ে গেলে, ‘এটা বিশালাক্ষীতলা, একটু ভেতরে গেলে শিবমন্দির, তারপর পঞ্চানন্দের মন্দির।’ কিছু পরেই সেসব পেরিয়ে যায় তারা। শ্রীপর্ণার চোখে বিস্ময়। নতুন কিছু দেখার আনন্দ চোখে-মুখে চলকে উঠছে। ‘এবার বুঝি তোমাদের বাড়ি আসবে?’

‘তোমাদের বাড়ি বলছ কেন, বলো আমাদের বাড়ি।’

‘ঠিক তাই, ভুল হয়ে গেছে, আমাদের বাড়ি। – অটো থেকে নেমে কি হাঁটতে হবে?’

‘না, রাস্তার পাশেই আমাদের বাড়ি। রাস্তাটা গ্রামের ভেতরে আরো খানিকটা চলে গেছে, বামুনপাড়া পর্যন্ত।’

‘বামুন বলছ কেন, ব্রাহ্মণ বলো, আমিও তো ব্রাহ্মণ।’

‘সরি, সরি।’

‘এ তো দেখছি সবাই একসঙ্গে থাকো।’

‘সবার সঙ্গে সবার সদ্ভাব।’

‘কীভাবে নেমে আমি যাব?’

‘সবাই যেভাবে যায়!’

‘আমি মাথায় আঁচল তুলে দেব?’

‘কেন?’

‘রাস্তায় এইখানকার মেয়েদের দেখছি এমনটা করতে।’

‘তোমার যেমনটা করার ইচ্ছে হবে, কোরো।’

শ্রীপর্ণা এই কথার কোনো উত্তর দিল না।

তাদের অটো যখন পাড়ায় ঢুকেছে, রাস্তার পাশে সব বয়সের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে শ্রীপর্ণাকে দেখছিল। নতুন বউ যে আসবে, তাদের কাছে খবরটা চাউর হয়ে গিয়েছিল। শ্রীপর্ণা তাদের হাবেভাবে বুঝতে পারছিল তাকে দেখছে, নতুন বউ দেখার কৌতূহলে। এই আসার খবরটা হাঁকাহাঁকি করে তার বাড়িতে অনেক আগেই পৌঁছে গেছে। মা-আববু, চাচা-চাচি, ভাইবোন নিশ্চয় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কাছে গিয়ে দেখল পাড়ার মেয়েরাও ভিড় করেছে। বাড়িতে হাঁকাহাঁকি। সবার চোখ খুশিতে চকচক করছে। মা-আববু সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খুবই সাধারণ মানুষ, বেশভূষাও তেমনই।

শ্রীপর্ণা মাথায় আঁচল তুলে নিয়েছিল। মা তাকে নামায় ও জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। মাকে প্রণাম করে শ্রীপর্ণা, বাবাকেও প্রণাম করে। সালাম কীভাবে করতে হয় শ্রীপর্ণা জানে না, শ্রীপর্ণাকে জয়নাল যদি সালাম করা শেখাত, শ্রীপর্ণা সালামই করত। তুতে রঙের তাঁতের শাড়িতে বউ হিসেবে মানিয়েছেও শ্রীপর্ণাকে। প্রণামের বিনিময়ে আববু শ্রীপর্ণাকে হাত জোড় করে নমস্কার জানায়।

ভিড়টা তাকে নিয়ে বাড়ির দালানে পৌঁছে যায়। ব্যাগগুলোও তারা নিয়ে যায়। হাউড় স্টেশন থেকে কেনা এক হাঁড়ি রসগোলস্নাও। আর জয়নাল বিচ্ছিন্ন হয় শ্রীপর্ণার থেকে।

মাটির দোতলা বাড়ি। টালি ছাওয়া। বাঁশের কাঠামো। মাঝে-মাঝে সংস্কার করতে হয়। মেরামতি লাগে। নিচের একটা ঘরে পৌঁছে যায় সে, যে-ঘরে তাদের ভারী-ভারী ব্যাগপত্তর রাখা হয়েছে। যেটা তার ঘর বলে চিহ্নিত। সুইচ দিতেই বৈদ্যুতিক ফ্যান চলে। মাটির বাড়ি এমনিতেই ঠান্ডা।

শ্রীপর্ণাকে বসানো হয়েছে দালানে। তার সঙ্গে মিশছে মহিলামহল। সেখানে ঠাঁই নেই জয়নালের। দালানে একটা ভাঙা হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারে বসানো হয়েছে শ্রীপর্ণাকে। একটা টেবিলফ্যান শ্রীপর্ণার দিকে তাক করে রাখা হয়েছে একটা টুলে বসিয়ে। পাখা চলছে হু-হু করে।

উঠোনতলায় মুরগি চড়ে বেড়াচ্ছে। ডানদিকে খড়ের টাল। দালানের ভেতর বস্তা-বস্তা ধান দেখে এসেছে। আববু চাষি মানুষ। হালবলদ রাখে গোয়ালে। গাইও আছে। এখনো লাঙল করতে পারে আববু। তালগাছে রসের ভাঁড় বাঁধে, শীতে খেজুরগাছেও। খেপা জাল ফেলে পুকুরের মাছ ধরতে পারে। কোদাল চালিয়ে মাটি কাটতে পারে। এসব কাজ জয়নালও পারে। এসব কথা শ্রীপর্ণা জানে না, জানতে চায় না বলে জানাতে পারেনি। গ্রামে এসে স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে জয়নাল। খিড়কির পুকুরে চলে যায় জয়নাল। পুকুরটা বেশ বড়ো। চারপাশের পাড়ে তাল নারকেল খেজুরগাছ। পুকুরের জলে তারই প্রতিবিম্ব, আকাশের নীলও। জলে দলবদ্ধ হাঁসেরা চড়ে বেড়ায়। এখানে এসে দাঁড়াতে শৈশবের অনেক স্মৃতির গন্ধ পায় জয়নাল। মনটা এখানেই ঝুঁকে থাকে, নুয়ে থাকে। সে তার অসিত্মত্বের সাড়ায় জেগে উঠতে থাকে।

শ্রীপর্ণা আছে মহিলামহলে।

জয়ের মা মুখ ধরে আরো একবার চুমু খায় শ্রীপর্ণাকে। একটু অস্বসিত্ম পেল পর্ণা, কিন্তু প্রকাশ করল না। তাকে ঘিরে আছে জয়ের আত্মীয়স্বজন মহিলারা। সবার মুখে হাসি-আনন্দ। এই আনন্দমুখরতা দেখে প্রথমটা হতচকিত হয়েছিল পর্ণা। আশপাশে জয়কে খুঁজেছিল কিন্তু পেল না। বুঝতে পারল এই আক্রমণের মুখে জয় তাকে একা ছেড়ে দিয়ে কোথাও একটা আছে। নিশ্চয় তার প্রিয় কিছু বোধ জড়ো করছে। তার গ্রাম, তার বাড়ি, জন্মভিটে, তার, তারই এসব। এই মেয়েরা তারই আত্মীয়-পরিজন।

আর একজন মাঝবয়সী মেয়ে তাকে চুমু খেল মুখে হাসি নিয়ে। বাঃ এঁদের চুমু-খাওয়া লৌকিকতা, রীতি? বেশ তো! ইনি জেঠিমা, জয়ের বড়ো চাচি। জয়ের বড়দি এল, শাশুড়ি বললেন শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছেন সকালে। সেও চুমু খায়। জয়ের ছোটবোনও এগিয়ে আসে। সে প্রথমে জড়িয়ে ধরে, তার পর মুখভরে চুমু খায়। মুখের অবস্থা যে কী হচ্ছে! যাকগে, ভাবল চুমু খাওয়া শেষ হয়েছে। কিন্তু চলতেই থাকল। এমন চুমু খাওয়ার কথা তো আগে কোনোদিন জানত না, মেয়েরা মেয়েদের আদর জানাতে চুমু খায়? তাতে আদর বাড়ে, আবেগ বাড়ে, খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নেয়। এই রীতির প্রেমে পড়ে যায়। নিজে মুখর হয়ে ওঠে নীরব হাসিতে। তাকিয়ে দেখে চুমু দিল যে-মেয়েটি তাকে, তাকে সমর্থন জানাল। ধন্যবাদ বলতে হয় না।

খুব ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে মেয়েরা, তাকে চুমু খাচ্ছে, আর হাসিমুখ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। একটা-একটা করে পাখির যেমন নেমে আসা, ফুলের খসে পড়ার মতো চুমুগুলোর ঠোঁট নেমে আসা, আসতে থাকে, নেমে আসতেই থাকে।