ছিন্নমূল সময় – ছিন্নমূল যাপনের ব্যতিক্রমী নির্মাণ

ছন্দম চক্রবর্তী
কৌরবের অন্নদাস

মধুময় পাল

গাঙচিল
কলকাতা, ২০১০

১৭৫ রুপি

কৌরবের অন্নদাস দশটি গল্পের সমবায়। গল্পগুলির প্রকাশ এবং নিশ্চিতভাবে জন্ম ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে। ২০১০-এ গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। সন-তারিখের হিসাবটুকু বলে রাখা এই জন্যেই যে, এক হিসেবে সময়-কাল বেঁধে রাখে এ-গ্রন্থের গল্পগুলিকে।
গল্পপাঠে প্রবেশের আগে যে নাতিদীর্ঘ প্রস্তাবনাটি জুড়ে দেন গল্পকার, তাতে মনে হয় কোথাও যেন কুণ্ঠাজনিত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুর লেগে থাকে। মধ্যবিত্ত পাঠকের সাবধানী মনকে মাঝেমধ্যেই বিব্রত করতে পারে তাঁর আখ্যান, তাই কি ঈষৎ সংশয়ী তিনি? তাই কি তিনি পাঠককে আগেভাগেই সাবধান করে দিতে চান যে, এই গল্পগুলি মূলত রাষ্ট্রের হৃদয়হীনতা ও শাসকের অমানবিকতার কথা বলে? তদুপরি গল্পগুলির পাতায়-পাতায় তাজা বারুদের মতো জমতে থাকে শাসিতের ক্রোধ ও ক্ষুব্ধ চিৎকার; বিপজ্জনক ফুলকির মতো ইতিউতি প্রতিবাদ। ‘পোলিটিকালি ইনকরেক্ট’ শীর্ষক রচনাটিতে লেখেন তিনি, ‘…এখানে শাসিতের কণ্ঠস্বর চড়া পর্দায় শোনা যায়। দেশভাগের দেশভিখারিদের কথা, উচ্ছিন্ন হয়ে উচ্ছন্নে-যাওয়াদের কথা, স্বপ্ন থেকে সম্ভাবনা থেকে অবিরাম উৎখাত হতে-থাকাদের কথা।’
খুঁটিয়ে দেখলে, শোষিত মানুষের ইতিহাস আদতে ক্রমাগত ছিন্নমূল হওয়ার গল্প – শাসকের খামখেয়ালে অথবা সচেতন অভীপ্সায় ক্রমান্বয়ে ঠাঁইনাড়া হওয়ার বৃত্তান্ত। বাঙালির চৈতন্যে এই উন্মূলনের স্মৃতি গভীরভাবে খোদাই করা আছে দেশভাগের অনুষঙ্গে। যুগান্তরে গড়ে ওঠা অস্তিত্ব থেকে হঠাৎ উচ্ছেদ আর গজিয়ে ওঠা নিরালম্ব অনিশ্চয়তায় বাধ্যতামূলক আত্মসমর্পণের এই সহনাতীত অভিজ্ঞতা লেখকের অর্জিত – ‘নয় মাস বয়সে মা আর দিদিমার কোলে চেপে সীমান্ত পেরিয়ে উদ্বাস্তু।… ক্যাম্প আর দখলঠাঁই আর বস্তিঘরে বেড়ে ওঠা। অনিশ্চয়তার তাড়া খেতে খেতে, পতনের কিনারা ঘেঁষে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া।’ ব্লার্বে খোদিত লেখক সম্পর্কিত এই পঙ্ক্তিমালাকে স্মরণে রেখে আলোচ্য গ্রন্থের গল্পগুলিকে পড়লে আন্দাজ করা যায়, স্মৃতি আর গল্পের আখ্যান  অন্তর্বয়নে কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে। বোঝা যায়, উদ্বাস্তু বা উৎখাত হয়ে যাওয়া (অথবা হতে যাওয়া) ত্রস্ত, অসহায়, ক্ষুব্ধ, তেড়িয়া, নীরব, মুখর – হাজারো চরিত্রের হাবভাব – কথাবার্তার মধ্যবর্তী কথকের অঞ্চলগুলি কেন শাস্ত্রবিরোধীভাবে ব্যক্তিগত ও উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে ওঠে।

দুই
মোদ্দা কথাটা হলো, সম্প্রতি উন্নয়নতত্ত্বের উৎপাতে ক্রমাগত উৎখাত হওয়া মানুষের বৃত্তান্তই বেশিরভাগ গল্পে বলেন লেখক। শুধু বাস্তুচ্যুত নয়, আজকের মানুষ – সাধারণ, তুচ্ছ, প্রান্তিক মানুষ ঠাঁইনাড়া হয় তাঁর পরিবেশ থেকে, প্রকৃতি থেকে তার আজন্মলালিত সামাজিক সংস্কৃতি থেকে। বৃহৎ পুঁজি তার অনিঃশেষ আকাক্সক্ষা মেটাতে মানুষকে স্বপ্ন দেখায় – গগনচুম্বী বহুতল, ঝাঁ-চকচকে মহাসড়ক, মহার্ঘ্য মলশোভিত এক বিজাতীয় স্বপ্ন; লোভ দেখায় – সাধ্যাতীত বিলাস আর ভোগের লোভ। আর যারা স্বপ্নে অভিভূত হলো না, লোভে বিবশ হলো না, তাদের ভয় দেখায় রাষ্ট্র – প্রয়োজনে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ভয়। পাপ অথবা পতন – উন্নয়নের দুনিয়ায় এই দুটি বিকল্পের সামনে দাঁড়ানো অসহায় মানুষ যেদিকেই যাক, শেষ পর্যন্ত পতিত হয় সে। যেমন ধরা যাক ‘অয়ি, হাত ধরো, করেক্ট করো’ গল্পটির কথা। গল্পটির মূল চরিত্র অর্থাৎ কথকের মধ্যবিত্ত মন চারপাশের জগৎটার প্রতি সন্দিগ্ধ, উন্নয়নের রথচক্রে তরতরিয়ে বাড়ন্ত নগরের প্রগতিকে সে ফালাফালা করে সমালোচনায় :
আমি যেখানে এখন থাকি, কলোনির পেটে জন্মানো প্রতিবন্ধী সন্তানের মতো পাড়ায়, নিকাশি ব্যবস্থা খুব খারাপ – ময়লা জল সরার খাল প্রায় বুজিয়ে বহুতল হয়েছে, পানীয়জল খুব খারাপ – কনস্টিপেশন-অ্যামিবায়োসিস ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে, দুটো সাইকেল রিকশা পাশাপাশি চলার মতো রাস্তা নেই – কলোনি আমলের বাঁশ-কঞ্চির বেড়া পড়ে-পাওয়া পয়সার গরমে ইঁট-সিমেন্ট হয়ে সীমানা বাড়িয়ে নিয়েছে, আলো-হাওয়ার চলাচল একরকম নিষিদ্ধ – এ বাড়ির দেওয়ালের গায়ে ও বাড়ির দেওয়াল, এ বাড়ির রান্নাঘরের গায়ে ও বাড়ির টয়লেট, প্রতিটি ফ্ল্যাট জানে পাশের ফ্ল্যাটের সঙ্গম কবে, কেমন শীৎকার, বর্গফুট পিছু দর ন্যূনতম আড়াই হাজার, সেখানে অবশিষ্ট খালের ওপরে সিমেন্টের ব্রিজে যে ছেলেরা দাঁড়ায়, তাদের মুখ থেকে অহরহ ঝরে শিশ্নফালি যৌননালী মাতৃযোনি হেগোপোঁদ অতি-পূর্বপুরুষের মলদ্বার, শুনে শুনে খালের কালো জলের গা গোলায় যেন।
চতুর্দিকের ভণ্ডামি, অফিসে ম্যানেজারের বদমায়েশি ও বঞ্চনাজনিত ক্ষোভ প্রায়শ অনূদিত হয় তার স্ল্যাংয়ের তিক্ততায়। অথচ এই মানস-বিরোধিতার মধ্যে-মধ্যে ধ্র“বপদের মতো উঠে আসে পলিটিক্যালি করেক্ট থাকার চিন্তা; বাসের কন্ডাক্টরের শাসকবিরোধী কথায় সন্দেহ জাগে, লোকটা ‘ইনকরেক্ট পলিটিক্সের কথা বলছে না তো!’ ভালো না-থাকার অসহিষ্ণুতাকে তার দ্বিধাকম্পিত মধ্যবিত্ত মন ডুবিয়ে দিতে চায় ভালো থাকার অসম্ভব স্বপ্নে। তাই তাকে নিরুপায়ভাবে ভাঁজতে হয় সমঝোতার অশ্লীল সুর – ‘আমি ম্যানেজারের জন্য একটা অশ্লীল গল্প ভাবতে চাই। অয়ি বাস্তবতা, প্লিজ হেল্প মি, আমার হাত ধরো, আমাকে গল্প দাও, স্টোরি অব গ্লোবালাইজড সেক্স অ্যান্ড প্রফিট। আমাকে করেক্ট করো।’ ‘ফোন এক, ফোন দুই’য়ের অরিজিতের গল্পটা এই অর্থে সমধর্মী যে সে-ও মধ্যবিত্ত; আদতে হাড়ভাঙা খাটুনি আর শোষণে হাড্ডিচুর শ্রমিক হলেও করপোরেট সংস্থার চাকুরে – হোয়াইট কলার; অধিকন্তু চারপাশের মহানাগরিক পরিবেশ সম্পর্কে তীব্র অসন্তুষ্টি তার মনেও জেগে থাকে। কিন্তু স্বাতন্ত্র্য এইখানে যে, ঊর্ধ্বতন কর্তার সঙ্গে বাক্যালাপে আগ্নেয়গিরির মতো তার প্রবল ক্রোধ তির্যক শব্দবন্ধে যদিও প্রকাশ পায় সামান্যই, তবু শব্দ-মধ্যবর্তী নীরব ভাবনায় তা পুঞ্জীভূত হতে থাকে ক্রমশ। দূরভাষে কথোপকথনের সময়ে। স্বমেহনের বীভৎস উল্লাসে অসহায় অধস্তন যেন প্রতিশোধ নিতে পারে।
অবশ্য আরেক ধরনের মানুষের কথা পাই ‘সেই মেয়েটা জ্বলছে’, ‘অটোক্রেসি’, ‘মাতঙ্গিনীর পুত্রকন্যা’, ‘বাতাসে ঘুরুর ঘুরুর’ বা ‘আমাদের পাড়ার মহাভারতে’র মতো গল্পে। ‘অয়ি, হাত ধরো, করেক্ট করো’র কথকের মতো চাকুরে জীবনের গ্লানি, অথবা ‘ফোন এক, ফোন দুই’য়ের অরিজিতের মতো বিবাহবিচ্ছেদের যন্ত্রণায় কাতর হওয়ার অবকাশ তাদের নেই, অনিশ্চয়তায় অস্থির তাদের যাপনের প্রতি মুহূর্ত – অতি সাধারণ প্রান্তিক মানুষ তারা। বিপ্লা হাজু, ভেঁটকি, অটোহরি, বোচন, রাফা, হিরণ খামারু বা হরিশ বিজলির মতো নাম তাদের – তুচ্ছ, বিকৃত, সহজেই বিস্মরণীয়। উন্নয়নের ছকবন্দি জীবনের বিভিন্ন গলি-ঘুপচির চরিত্র তারা। চাষিদের কাছ থেকে কারখানা তৈরির নাম করে কেড়ে নেওয়া জমির পাহারাদার বিপ্লা হাজুর আসল নাম বিপ্লব হাজরা; উন্নয়নের রথের ভার বইতে বইতে নামের মতো মানুষও কীভাবে খাটো ও জান্তব হয়ে যায় তার নিদর্শন ‘সেই মেয়েটা জ্বলছে’র বিপ্লা হাজুরা। নামের বিবর্তন সূত্র ধরে সেই অমানবীকরণের প্রবচনসুলভ এক অনবদ্য ব্যাখ্যা জোগান কথক – ‘সূর্যোদয়ের এক পাহারাদার বিপ্লা হাজু। বাপ-মা শখ আর স্বপ্ন দিয়ে রেখেছিল ‘বিপ্লবকুমার হাজরা’। সেটাই আদর কিংবা অন্য কোনো চোটে বিপ্লা হাজু। ওই যেমন বণিকের পাল্লায় পড়ে ‘রেভোলিউশন’ লিপস্টিক মেখে হয় ‘রেভলন’।’ এই সংকলনের অন্যতম সেরা গল্প ‘অটোক্রেসি’র অটোহরিও ব্যতিক্রমী হতে পারে কই। পেটের ধান্দায় অটোসাম্রাজ্যে প্রবেশের পর ব্যবসা ও রাজনীতির জটিল আবর্তে হরিপ্রসাদ পুচ্ছ খসিয়ে ক্রমশ হয়ে ওঠে উন্নয়নযজ্ঞের ঠাঙাড়ে সৈন্য, অটোহরি। পুরনো নৈতিকতায় বুঁদ, হয়তোবা তাই পার্টিতে প্রান্তিক কুমুদদা একদা তাকে বলেছিল –
…অটো হল ক্ষুদ্রতার প্রতীক, অসভ্যতা অসততার প্রতীক। ওরা ওই প্রতীক তৈরি করেছে। অটো গাড়ি নয়, গাড়ি বলে চালানো হচ্ছে, বুকে ধক নেই, ক্ষীণজীবী, কেতরে বেঁচে থাকে, লবচবানি পুলিশ আর পার্টির দয়ায়, এই দয়া তাকে অসৎ লোভী করে। হরিপ্রসাদ, তুমি আর তোমার বাবা-মার সন্তান নও। তাদের স্বপ্ন ইচ্ছার অবশেষ তোমার মধ্যে আর নেই। তুমি, তোমরা রাষ্ট্রনেতাদের অবৈধ ও পরিকল্পিত সন্তান। তোমাদের বাড়ানো হচ্ছে, আরো বাড়বে। তোমরা অটোক্রেসির খোচর, ঠ্যাঙাড়ে। আজ দামপার্টির হয়ে খাটছ, কাল রামপার্টির হয়ে খাটবে।
বাস্তবিক, অটো আর অটোক্রেসির গোপন সখ্যের চমৎকার নির্মাণ ঘটায় এই আখ্যান। কিন্তু নিছক সেই কারণেই গল্পটি ব্যতিক্রমী নয়, আসলে ভাষার বহুস্তরিক ব্যবহারে ‘অটোক্রেসি’ দেখায় যে, পার্টির নির্দেশ না-মানা অটোহরি অটোর রুট থেকে বাদ পড়েই যে শুধু ‘আপরুটেড’ হয় তাই নয়, নীতি-বিগর্হিত দলতন্ত্র এবং তারও আগে মনুষ্যত্ব-বিবর্জিত পুঁজিতন্ত্রের খপ্পরে পড়ে কীভাবে একটু-একটু করে অটোহরিরা বিচ্ছিন্ন হয় প্রকৃতির সান্নিধ্য-ছুঁয়ে বেঁচে থাকা পাড়া-গাঁ শহরতলির শান্ত জীবনে বিছানো মানবতার শিকড় থেকে। ‘বাতাসে ঘুরুর ঘুরুর’ গল্পে বিজয়গড়ের মোড়ে দাঁড়ানো ‘ফ্যাদড়া নাক, কেলে, চোয়াড়ে’ চেহারার নাম-না-জানা লোকটা কি সে কথাই বলে না :
…আমি ছিন্নমূল। তোমরাও। একটা জায়গা পেয়ে গেছ বলে, জায়গাটা ভুলভাল হয়ে গেছে জেনেও বাড়ি বানিয়ে ফেলেছ বলে, আমাদের যন্ত্রণাটা বুঝবে না। আমরা হাতে কাজ চাই, একটু ভালোবাসার জমি চাই। ছিল। মোটামুটি ছিল। কী না কী হবে বলে উৎখাত করল। …কত ছিন্নমূল জানো? ভিটে থেকে, ক্ষেত থেকে, দেশ থেকে, শহর থেকে, কীর্তন-বাউল থেকে, সুফি-দরবেশ থেকে, নীতি থেকে, প্রেম থেকে, বন্ধুত্ব থেকে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূলের মূলে ফেরার তাগিদ কি পিটিয়ে ঠাণ্ডা করা যায়? যায় না।
প্রায় তত্ত্বের মতো করে অজ্ঞাত লোকটা মারমুখী, উন্নয়ন-কাতর, দলপরবশ শহুরে মানুষগুলিকে বোঝায়। তাত্ত্বিক না হয়েও উন্নয়নের উচ্ছিষ্টে প্রতিপালিত হতে-হতে বিপ্লা হাজু কিংবা অটোহরিও কি বোঝে না মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যন্ত্রণা। যারা বোঝে তারা এটাও বোঝে যে, চিরকাল মূলে ফেরার তাগিদকে পিটিয়ে ঠান্ডা করা যায় না। তাই রাষ্ট্রের সর্বশক্তি আর শাসকের রক্তচক্ষুকে সঙ্গী করে ঘটে চলা উন্নয়নের প্রবল ঢক্কানিনাদের মধ্যে সিদ্ধেশ্বরীতলার নগণ্যজন হিরণ খামারু গলা নামিয়ে নগণ্যতর হরিশ বিজলিকে বলে, ‘বাতাসে ঘুরুর ঘুরুর শব্দ পাস? ওদের ট্যান্ডাইম্যান্ডাইয়ের মাথার ওপর দিয়ে শব্দটা আসতেছে। ওদের ভ্যাকভ্যাকাইয়ের ভিতর ফুঁড়ে শব্দটা আসতেছে।’ সন্দেহজনক ও দুর্বোধ্য, অতএব বিপজ্জনক শব্দটা ক্ষমতার হাড় হিম-করা শৃঙ্খলায় বিপর্যয়ের গন্ধ বইয়ে দেয়। ফ্ল্যাটবাসী মধ্যবিত্তের মতো, চাকরিবিলাসী মধ্যবিত্তের মতো নীরব আত্মজ্বলুনি নয়, ক্রমশ বিপ্লা হাজু, অটোহরি, হরিপদরা ক্ষমতাবানদের চোখে চোখ রেখে এক অন্য ভাষায় কথা বলতে থাকে।
আসলে যে-ডিসকোর্সটিকে ক্রমশ তৈরি করে বিপ্লা হাজুরা তা হলো, শোষিতের চোখ দিয়ে শোষণতন্ত্রের কাঠামোটাকে দেখা, শাসকের মুন্শি-খাজাঞ্চি, ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে বর্ণনা। ফলে ত্রাসের শিরশিরানির সঙ্গেই সেখানে লেগে থাকে তিত্কুটে বিদ্রƒপ, উছলেপড়া রাগের গরগরানি। ‘মাতঙ্গিনীর পুত্রকন্যা’র হরির চায়ের ঠেকে রাফা-ন্যাদা-মোরালদার সংলাপে রাজনীতির নিজস্ব ডিসকোর্স মাঝেমধ্যে ডানা মেললেও সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিক মানুষের রাগ-ব্যঙ্গের সার্থক তর্জমা ঘটে খর্বাকার বাক্য ও স্ল্যাং-ঘেঁষা ডিকশনে। যেমন :
…আজ বাইক্যালাদের খাল খিঁচে নিয়েছে পাড়ার লোক। কী গো শোনোনি তোমরা? পাড়াতে দুদিন ধরে র‌্যালা হল! রিনাদিকে অত্তেষ্ঠ করত একটা বাইক্যালা। ওই পোমোটারটা। ছবিদের হাম্পু করে তুলে দিয়ে ফ্ল্যাট করেছে। পরশুদিন, হ্যাঁ লক্খিবার, গলির মোড়ে রিনাদিকে চেপে ধরে চুমা খায়। রিনাদির ভাই বান্টি পোর্তিবাদ করেছিল। বান্টিকে দুটো বাইক্যালা রড দিয়ে পেটায়। পাড়ার লোক সেদিনই বাইক্যালার গাঁড়ে… না না, পুলিশ এসে বাঁচাল। আজ সকালে মালটাকে হাতের কাছে পেয়ে হাড্ডি জাম ক্যালান কেলিয়েছে। পার্টিও বাঁচাতে আসেনি। (সব সন্ত্রাস শান্তি হয়ে আছে)
‘বাইক্যালা’ নিছক ‘বাইকওয়ালা’র অপভ্রংশ নয়; বরং প্রান্তিক মানুষ দ্বারা প্রোমোটার বা রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট বাইকবাহিনীর এক বিশেষ বর্ণনা, যার মধ্যে মিশে থাকে ক্ষমতার অশ্লীল আস্ফালনের (বা ‘র‌্যালা’) বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ জনতার ভাষিক প্রতিক্রিয়া। খেয়াল করে দেখলে, ‘হাম্পু করে’ দেওয়া, ‘গাঁড়ে’ (রড ঢুকিয়ে দেওয়া?) অথবা ‘হাড্ডি জ্যাম ক্যালান’ ক্যালানো – মেনকাকথিত এই ক্রিয়াপদগুলি, যেগুলো আদতে শোষকের ক্রিয়া আর শোষিতের প্রতিক্রিয়া – ভীষণভাবে শারীরিক। কারণ, এই গল্পগুলি তো সেই বাস্তবতার কথা বলে যেখানে খেটে-খাওয়া মানুষের নিছক মন নয়, শরীরী অস্তিত্বই বিপন্ন। আর শরীরী বিপন্নতাজনিত ভয়, ক্ষোভ ও বিরুদ্ধতায় এই ধরনের ডিসকোর্সে উপর্যুপরি ব্যবহৃত হয় শরীরী বিপর্যাসের উপমান, বিশেষত জনন ও জননাঙ্গকে বিপর্যস্তকারী শব্দাবলি। এমনকী, যেখানে বিরুদ্ধতা নয়, ক্ষমতার কাছে সচেতনভাবে আত্মসমর্পণ করছে মানুষ – হয়তো লোভে অথবা নিরুপায় বলে, তবু তার বাচনের মধ্যে যেন অজ্ঞাতসারেই মিশে যায় সেই ক্ষমতার প্রতি ক্যারিকেচারের সুর। যেমন ধরা যাক ‘অটোক্রেসি’ গল্পে অটোজিকোর কথা। পার্টির অন্যায় হুকুম সবাইকে তামিল করতে হয়, অটোজিকোও না বলতে পারে না। আত্মপক্ষ সমর্থনে তার বাচনটি নেহাতই সংক্ষিপ্ত, যদিও অব্যর্থ – ‘অটোজিকো বলে, পতাকাগুলোর সাইজ দেখেছিস। বিচি শুকিয়ে মটর হয়ে যায়। না কে বলবে?’ ক্ষমতার প্রচণ্ডত্ব ধরা থাকে পতাকার বিশালত্বে; আর তার যে শরীরী প্রতিক্রিয়ার বর্ণনা দেয় অটোজিকো তা কার্যত হয়ে ওঠে সেই ক্ষমতা-দম্ভের ক্যারিকেচার।

তিন
অবশ্য, বিরুদ্ধতা নয়, বিষণœতাও এই সংকলনের অন্যতম অঙ্গীরস। জমি ও বসত থেকে উৎখাত, প্রতিবেশ ও বিশ্বাস থেকে উৎখাত – শেষমেশ স্মৃতির মাধুর্য থেকে ক্রমান্বয় বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে চলে সেই বিষাদের সুর। যেমন, সংকলনের মাঝ-বরাবর বিন্যস্ত ‘সব সন্ত্রাস শান্তি হয়ে আছে’। গল্পটি কবিরাজ নলিনীচরণের দীর্ঘ জীবনের আখ্যান – স্বল্পায়তন আটটি খণ্ডে বর্ণিত। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর পর নলিনীচরণ ও কিরণবালার সংসার পুনরায় বিপর্যস্ত হয় দেশবিভাগের অভিঘাতে। উদ্বাস্তু দম্পতি পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে ওঠেন গঙ্গাতীরে রাজমহল পাহাড়ের কোনো রিলিফ ক্যাম্পে, তারপর গোবরার বস্তি, তারপর হয়তোবা অন্য কোনো বস্তিতে। ছিন্নমূল নলিনীকুমারকে বিচ্ছিন্নতার নতুন মন্ত্র শিখিয়েছিলেন সহ-উদ্বাস্তু নিত্যসত্য দাস : ‘…জীবনের যে মানে বুঝতেন, পার্টিশনের পর তা ব্যাবাক ধ্বংসস্তূপ। যে চিকিৎসাবিদ্যা আপনি শিখেছেন তা লোমছেঁড়া কাম। যে আচরণ শিখেছেন, তা গাধার বাতকর্মের চেয়ে অসার।’ সেই তো বিচ্ছিন্নতার শুরু, পরের দীর্ঘ সময় জুড়ে ক্ষুণিœবৃত্তির জন্য মর্মান্তিক লড়াই, ক্লান্ত কিরণবালার বিনাচিকিৎসায় মৃত্যু – ক্রমশ যেন নিজের অস্তিত্ব থেকে পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যায় মানুষটা। গল্পের শেষে প্রায় আত্মবিস্মৃত নলিনীকুমারের সামনে পাড়ার যে সাম্প্রতিক খবরটা পেশ করে মেনকা অর্থাৎ ‘বাইক্যালা’ জনৈক ‘পোমোটারে’র দৌরাত্ম্য এবং পার্টির প্রশ্রয় ও পুলিশের আশ্রয় সত্ত্বেও জনতার গণধোলাই – সেটি অবশ্য সংকলনের অন্যান্য গল্পের থেকে চরিত্রে ভিন্ন নয়। তবু যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের উচ্চকিত স্বরের পাশে গোটা গল্পের জমিতে নিবিড়ভাবে মিশে থাকা বিচ্ছিন্নতার গভীর বিষাদ।
আসলে আরেক ধরনের ডিসকোর্স আছে আলোচ্য গল্পগুলিতে, যা মূলত হারিয়ে-যাওয়া অথবা হারাতে-বসা শিকড়ের কথা বলে – মিলিয়ে যাওয়া প্রকৃতি-আবাদ-বসতের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কবিতার মতো আত্ম-আলাপী সেই সব পঙ্ক্তি আখ্যানের গায়ে ভারী বিষণœতার পর্দা টেনে দিতে চায়। যেমন :
জায়গাটা তিনি দেখেছেন বিরানভূমি, মাইল মাইল মাঠ, হোগলার বন, জলাজমি, হামলে পড়া কালো মেঘ, বিদ্যুতের মারকাটারি খেলা, ঘুঘুর ডাকে পাতাকুড়–নির কান্না, খালের জলে কাঠকুড়–নির হাসি, দরমা-খড়ের ছোট ছোট ঘরের চালে পুঁইডগা লাউডগা, সুনয়নী খালে ভাঙা বজরায় শেকল-বাঁধা পায়ের কঙ্কাল আর কেষ্টঠাকুর, তেলাকুচ ফল আর টিয়ের ঝাঁক, মাটির গন্ধমাখা ফসলের পুরুষ ও নারী, আরো কত কী দেখেছেন তিনি এইখানে। তারা সব গেল কোথায়? (‘অটোক্রেসি’)
কুমুদার মতো অটোহরিও হারিয়ে যাওয়া উত্তরপঞ্চান্নর জন্য দুঃখ পায়; দুপুরে বৃষ্টি হলে সাদিক ‘ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ঠেসে যাওয়া’ আধুনিক বিজয়গড়েও টের পায় বাতাসে ভুরভুর করছে ‘কলোনির পুরোনো গন্ধ’ (‘সব সন্ত্রাস শান্তি হয়ে আছে’); কারা যেন এখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে সত্তরের ‘স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র’, শোষণহীন ওলাবিবিতলা রিপাবলিকের জন্য (‘কৌরবের অন্নদাস’); মহৎ বিশ্বাসের কঠিন রাস্তা থেকে সরে আসার জন্য আত্মগ্লানিতে কি বিষণœ হয় না অভিজিতের মন (‘ফোন এক, ফোন দুই’)। এই বিষণœতা অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না, বরং বিষণœতার পর্দা ছিঁড়ে কুঁকড়ে থাকা, দাবিয়ে রাখা মানুষজনের কেউ কেউ যে ফুঁসতে থাকে, খিস্তির তুবড়ি ছিটিয়ে অথবা শান্তভাবে প্রতিরোধের প্ল্যান কষে – সেই আপাত অরব কিন্তু ক্রমশ বাক্সময় স্বরকে আলোচ্য সংকলনের গল্পগুলিতে চিনে নিতে পারি আমরা। এক অনবদ্য ভাষাপ্রকল্পে সেই স্বরনির্মাণের প্রক্রিয়াটিকে মূর্ত করে তোলেন গল্পকার।

চার
কৌরবের অন্নদাসের গল্পগুলির আখ্যানপ্রযুক্তি যে অন্যরকম গল্প বানিয়ে তোলার চেষ্টাটি যে এখানে পূর্বাপর প্রত্যাহৃত বলে মনে হয়, তার অন্যতম কারণ এই গল্পগুলিতে চরিত্র ও কথকের ডিসকোর্স আগাগোড়া আলাদা নয়, বরং তারা প্রায়শ পরস্পর সমীকৃত। চরিত্রদের মতো করেই কথক এখানে মাততে পারেন তকরারে, উগড়ে দিতে পারেন ক্রোধ, দ্রবীভূত হতে পারেন বেদনায়, তবে সবচেয়ে ভালো বিদ্ধ করতে পারেন তীক্ষè বিদ্রƒপে। এমনকি সবচেয়ে মরমি পঙ্ক্তির ভেতর থেকেও বার করে আনতে পারেন তীব্র ঠাট্টা। প্রসঙ্গত ‘সেই মেয়েটা জ্বলছে’ গল্পটি শুরু হয় এভাবে – ‘সার সার শালখুঁটির ওপর হিম ঝরেছে সারা রাত। এখন মৃতদেহের মতো শীত সব। ধর্ষিত ক্ষেতের ওপর হিম ঝরেছে সারারাত। এখন মৃতদেহের মতো শীতক্ষেত।’ জীবনানন্দীয় ভাষাভঙ্গির যেন চোরাটান আছে এই চিত্রকল্পটিতে; ‘এখন মৃতদেহের মতো শীত সব’ অথবা ‘এখন মৃতদেহের মতো শীতক্ষেত’ – বাগর্থের সীমা ভেঙে তৈরি করে দেয় এমন এক উপযুক্ত আবহ যেখানে মানবতার বলাৎকার ঘটবে সারা রাতজুড়ে। শক্তিশালী চিত্রকল্পের দৃষ্টান্ত আলোচ্য গল্পগুলিতে কম নেই; কিন্তু যা বলছিলাম, কখনো কখনো চিত্রকল্পের নিজস্ব সম্মোহনের জাল কেটে প্রমুখিত হয়ে ওঠে যে-বিদ্রƒপ, তা অপ্রত্যাশিত এবং তাৎপর্যপূর্ণ। ‘আমাদের পাড়ার মহাভারতে’র শুরুর দিকে কথকের ভাষ্য : ‘খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানা গান গাওয়া, দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভেতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যাওয়া দিয়ারায় এখন বড় বেশি উন্নয়ন।’ গ্রামিক জীবনের ছন্দকে চুরমার করে চাপিয়ে দেওয়া হয় পুঁজি-পরিকল্পিত উন্নয়নের ধাঁচা – সেই বেখাপ্পা জবরদখলের বোধটিই সংশ্লেষে ধরা থাকে ‘এখন’ শব্দটির পূর্ববর্তী চিত্রকল্প (লক্ষণীয় এটিও জীবনানন্দীয় ঐতিহ্যেই নির্মিত; সেই ঐতিহ্যে বাংলার গ্রামিক সৌন্দর্যে লগ্ন থাকে এক চিরকালীনতা) এবং পরবর্তী উন্নয়নের (লক্ষণীয় বিশেষণগুচ্ছ ‘বড় বেশি’) বৈপরীত্যে। এভাবেই নিরাপদ দূরত্ব ছেড়ে বারবার আখ্যানের ভেতর ঢুকে পড়ে কথক – মন্তব্য, ব্যাখ্যা ও তর্কে গল্পকে নিয়ে যায় সন্দর্ভের সীমানায়। যার সার্থক উদাহারণ সংকলনের নামগল্পটি। সমকালীন ঘটনাবলির সঙ্গে অন্তর্বয়নে মহাভারতে আজীবন ব্রহ্মচর্যে স্থিত ভীষ্মের অবিচলিত সততার মিথটি এ-গল্পে যেন নতুনভাবে বিশ্লেষিত হয়। বিচ্যুতিহীন নৈতিকতার প্রতিষ্ঠিত চিহ্নগুলি আসলে কীভাবে রাষ্ট্রের তাঁবেদারিতে নিবেদিত হয়, প্রায়-গল্পহীন কৌরবের অন্নদাস সে-কথাই বলে। কিন্তু তাতে করে আখ্যানের গঠন বিন্দুমাত্র শিথিল হয় না, পিছলে পড়ে না পাঠকের মনোযোগ।
গল্পগুলির এই প্রতর্কশীল চরিত্র পাঠকের সামনে একটা সুযোগ করে দেয়; মনে হয় সর্বজ্ঞ কথকের কথকতা-শোনা অসহায় শ্রোতা নই আমরা; চলমান শব্দস্রোতের সঙ্গে সংলাপ ও সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে আমাদেরও স্বর। বস্তুত সমকালের অজস্র ঘটনা ও প্রসঙ্গ এমনভাবে ছড়ানো থাকে গল্পগুলিতে যে, আমাদের ঠোক্কর খেতেই হয়, এড়িয়ে যাওয়ার পথ থাকে না। ব্যক্তিগতভাবে আমরা যারা সনৎ রায়চৌধুরী বা কুমুদদার মতো বিশ্বাসের প্রকোষ্ঠে দৃঢ়ভাবে স্থির ও গভীরভাবে নিশ্চিত নই, তারা এড়িয়েও যেতে পারি না, উড়িয়েও দিতে পারি না। তবে সবিনয়ে বলা ভালো, আলোচ্য গল্পগুলিতে বিবেকপ্রতিম এই চরিত্রগুলিকে সর্বদা অব্যর্থ মনে হয়নি, যেমন মনে হয়নি বিজয়গড়ের মোড়ে দাঁড়ানো ‘বাতাসে ঘুরুর ঘুরুর’ গল্পের  সে-লোকটির বক্তৃতাকে। না, তাঁদের বক্তব্য ভ্রান্ত বা বিশ্বাস জোরালো নয়, তা বলছি না; বরং উলটোটা। আসলে আলোচ্য গল্পগুলিতে এক অনিশ্চিত সময়ের পটে সাধারণ মানুষের বিপন্নতা, যন্ত্রণা ও ক্ষোভ যেভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে তাতে করে আকস্মিকভাবে ভেসে ওঠা এই স্মিত প্রত্যয়ী কণ্ঠস্বরগুলিকে কিছুটা আপতিক বলে মনে হয়েছে। অনেক গল্পেই শেষমেশ ক্ষোভ, ক্রোধ ও প্রতিবাদ দানা বাঁধছে প্রতিরোধে। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে এই সংকলনের বেশিরভাগ গল্প তুঙ্গ স্পর্শ করেছে সেইখানে, যেখানে যুগপৎ ক্ষোভ ও যন্ত্রণা বোমার স্পি­ন্টারের মতো বিশৃঙ্খলভাবে উৎক্ষিপ্ত হতে দেখেছি আমরা। মনে রাখা দরকার, বাংলা সাহিত্যের সূচনাবিন্দু চর্যাগীতি থেকে মানুষ তার দুঃখ ও বেদনার কথা বলেছে; উৎপীড়কের বিরুদ্ধে উগড়ে দিয়েছে রাগ ও শ্লেষ। চর্যার গানে নগর থেকে উৎখাত, হাড়হাভাতে মানুষের যে-কণ্ঠস্বর মাঝেমধ্যে উচ্চকিত হয়ে উঠেছে, ঐতিহ্যের অনুবর্তনে তা যেন নতুনভাবে রূপ পাচ্ছে সাম্প্রতিক বাংলা আখ্যানে। তুচ্ছ-প্রান্তিক মানুষ মধ্যবিত্ত লেখকের ধার করা ভাষায় নয়, কথা বলতে চাইছে নিজস্ব স্বরে। সেই অমার্জিত রুক্ষ স্বরের রূপায়ণে কৌরবের অন্নদাস বাংলা প্রতিবাদী সাহিত্যের সাধক-বিরল ধারাটিতে যুক্ত করল নিজেকে।