ছেলেবেলা

নাসির আহমেদ

জোনাকি – রাতের ঝিল্লি মুখরিত নির্জনতা মেলে চরাচরে
জেগে আছো ছেলেবেলা দূরের কুয়াশাময় হিমঠান্ডা ঘরে!
টিনের চালায় ঝরে টুপটাপ স্মৃতি যেন আজো নিরন্তর
জলছবি হয়ে আছো কবেকার সেই তুমি বুকের ভেতর!

সন্ধ্যাক্রমে গাঢ়তর হয়ে রাত্রি পরিপূর্ণ বিকশিত হলে
ভরা পূর্ণিমার চাঁদ কী অপূর্ব টলমলে পুকুরের জলে!
এখন তেমন কোনো সৌন্দর্য কোথাও নেই, শুধু অন্ধকার
রবীন্দ্রনাথের গান, জীবনানন্দের কাব্যে মিশ্র হাহাকার।

মনে পড়ে মধ্যরাতে বেজে ওঠা পাড়াগাঁর ঢোলের আওয়াজ
চুম্বকের মতো টানে জরিতে সাজানো যাত্রামঞ্চ কারুকাজ
ছেলেরা নর্তকী সেজে মুগ্ধতার ছন্দে ছন্দে প্রপঞ্চ ছড়ায়
আলোমতি একা ঘরে, আজো তারই বিরহসংগীত শোনা যায়।

আলপথ পার হয়ে মধ্যরাতে হেঁটে যাই নিঃসঙ্গ বালক
পথ তবু অফুরান, পাখি উড়ে গেছে যেন কোমল পালক
পড়ে আছে সেই পথে, স্মৃতিজাগানিয়া রাতে আজো
কবেকার ছেলেবেলা কী করুণ বেহালার সুর হয়ে বাজো!

শৈশব-কৈশোর ছুঁয়ে স্বপ্ন হয়ে এসেছিলি অপূর্ব সময়
পেছনে তাকালে দেখি সবই তো আমার, তবু কেউ সত্যি নয়।

দুই

সেই ছোট্ট চারাগুলো এখন দীর্ঘতম, বয়সে প্রবীণ
শৈশবে বাবার সঙ্গে সুপুরির চারাবীজ বুনেছি একদিন।
স্পর্শের অতীত দূর উচ্চতায় চলে গেছে স্ব^জন আমার
যেন এ জীবন সত্যি আমার জীবন নয়, অন্যেরই খামার।

কতদিন পরে ফিরে নিজের গ্রামেই আমি কেমন অচেনা
সেই যে কিশোরী, যার মায়াবী দুচোখে ছিল স্বপ্নের আল্পনা
নিরন্তর ঢেউ হয়ে জ্যোৎস্নার ঘূর্ণিস্রোতে ভাসাতো হঠাৎ
তার মুখোমুখি হই, চেনে না কিছুতে, আহা এমনই বরাত!

উঠোনে ছড়ানো ধানে শালিক পাখিটি আজো ওড়ে
বালিকা তাড়ায় তাকে, এই দৃশ্য অবিকল স্মৃতিময় ঘোরে;
বালিকা বধূর জন্য মুগ্ধ সেই বালকের বুকে হাহাকার
এতকাল গত তবু সেই তৃষ্ণা কিছুতেই মিটলো না আর!

একাকী ঘুঘুর ডাকে কী যে ছন্দোময় হতো বুনো নির্জনতা
কাঁঠালিচাঁপার রং স্নিগ্ধ লাবণ্যের কাছে বলেছি সে-কথা
সে এখন চেনে না তো! কপালেও নেই সেই কাচপোকা টিপ
কই সেই খরস্রোতা আবেগের নদী? এ যে মৃত বালুদ্বীপ!

আলোছায়াময় সেই নারী ও নিসর্গ আজ ভেঙে যাওয়া হাট
সবই আছে বুকে চাপা, বন্ধ শুধু সময়ের নির্দয় কপাট।