ছোটগল্পের কথকতা

ভূমিকা

কবিতা ও নাটক বাদ দিয়ে সৃজনশীল সাহিত্যের যে-শাখা কথাসাহিত্য নামে পরিচিত সেখানে দুটি ভাগ, ছোটগল্প এবং উপন্যাস। নভেলা নামে তৃতীয় একটি শ্রেণি চিহ্নিত হয়ে থাকলেও উপন্যাসের সঙ্গেই তার সাদৃশ্য বেশি। ক্ষীণ কলেবর, শুধু এই কারণেই উপন্যাসের সঙ্গে তার ভেদরেখা টানা হয়েছে, চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের জন্য নয়। নভেলাকে ছোটগল্পের পূর্বসূরি মনে করা হয় তার ক্ষীণ কলেবরে জীবনের খ-াংশকে প্রতিফলিত করার জন্য, যদিও এই প্রতিফলন উপন্যাসের কাছাকাছি। বোকাচিচওর ‘ডি ক্যামেরন’ আর চসারের ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’কে মনে করা হয় নভেলার আদি দৃষ্টান্ত হিসেবে। আসলে এ-দুটি অনেকগুলি গল্পের সংকলন।

 

ছোটগল্প ও বাস্তবতা

ছোটগল্প আকারে এবং কাহিনির বিস্তারে সংক্ষিপ্ত বলেই দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এর নৈকট্য রয়েছে। একদিনে বা অল্প সময়ে পড়া বা বলা যায় বলে ছোটগল্পই জনপ্রিয়। শৈশবে রূপকথা শোনার যে-আগ্রহ তার নিবৃত্তি ঘটে ছোটগল্পের আকারেই। ডি ক্যামেরন, ক্যান্টারবেরি টেলস, আরব্য উপন্যাস কিংবা জাতক কাহিনির
এক-একটি গল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ বলেই সেগুলি ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যময় ও চরিত্রধর্মী। যেভাবেই শেষ হোক না কেন স্বয়ংসম্পূর্ণতা ছোটগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য। একটি গল্পের অবশ্য একাধিক সমাপ্তি থাকতে পারে কিন্তু লেখক যেটি বেছে নেন সেই সমাপ্তিই যথাযথ, এই বিবেচনা তাঁর থাকে বলে গল্প বলা হয়েছে এটা ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, ‘শেষ হয়ে হইলো না শেষ’, ছোটগল্পের সমাপ্তিতে এ-ধরনের অতৃপ্তি এবং ভবিষ্যতের প্রত্যাশাও থাকতে হয়। এটাই স্বাভাবিক, কেননা জীবন চলমান এবং অনেক কাহিনি এবং ঘটনার সমাহার সেখানে। একমাত্র মৃত্যুই আনে ব্যক্তিজীবনে যতি; কিন্তু গল্প যদি হয় পরিবার নিয়ে, গোষ্ঠী নিয়ে, তাহলে জীবন-অন্বিষ্ট হতে হলে ধারাবাহিকভাবেই গল্প বলে যেতে হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে উপন্যাসও জীবনের পূর্ণ প্রতিফলন নয়, কেননা স্থান ও পাত্র স্থাবর হলেও সময় জঙ্গম। উপন্যাস শেষ হলেও সময় শেষ হয় না। গল্প জীবনকে খণ্ড খণ্ড ভাগ করে দেখে জীবন-যাপনের প্রক্রিয়ায় যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয় তার ভিত্তিতে এবং সংঘটিত ঘটনার সুনির্দিষ্টতার কারণে। এইসব অভিজ্ঞতা অথবা ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ অবশ্য ছোটগল্পের বর্ণনায় থাকে না। কেবল গল্পের প্রয়োজনে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা বা ঘটনার যে-অংশগুলি প্রাসঙ্গিক সেগুলিকে বাছাইয়ের পর যুক্তিগ্রাহ্যভাবে গ্রথিত করার কৌশলেই ছোটগল্পের শিল্প-পরিচিতি। মোপাসাঁর মতে, দৈনন্দিন জীবনের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে কোনগুলি লেখার কাজে অপ্রয়োজনীয় সেসব বাদ দিতে জানতে হবে, কেননা সবকিছু লেখায় সন্নিবেশ করা অসম্ভব। লেখায় বাস্তবতা আনার জন্য বাস্তবতার মায়া সৃষ্টিই লেখকের উদ্দেশ্য আর এর জন্য ঘটনা পরম্পরার অনুসরণ নয়, যুক্তিসংগতভাবে তাদের নির্বাচনই লেখকের উদ্দীষ্ট।

(‘মোপাসাঁ’, পিয়ের অ্যান্ড জাঁ)

নির্বাচিতভাবে বাস্তবকে উপস্থাপিত করে বলেই ছোটগল্পের কাঠামো এবং বর্ণনায় যান্ত্রিকতা এসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত না হয়ে কাহিনির অংশগুলি হতে পারে আরোপিত। উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পে অলীকের বা মায়াজালের (ইল্যুশন) উপস্থিতি সাধারণ হওয়ার জন্য লেখায় বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য অনেক বেশি ব্যঞ্জনাধর্মী হতে হয়। এই ব্যঞ্জনাধর্মিতা আসে ভাষার ব্যবহারে, ন্যারেটিভের কৌশলে। ছোটগল্পের তত্ত্ব নিয়ে প্রথম যিনি বক্তব্য রেখেছিলেন, এডগার এলান পো, তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কোনো বিশেষ পরিণতি বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির জন্য লেখক সবকিছু বিশদভাবে বর্ণনা করলে উদ্দেশ্যসাধনে ব্যর্থ হবে। যে-বিশদ বর্ণনা গল্পের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ, লেখক সে-সম্বন্ধে লিখবে কিন্তু নিজের মতামত দেবে না, এই ছিল তাঁর অভিমত। এলান পোর দীর্ঘদিন পর আমেরিকান ছোটগল্প-লেখক জেমস কার্ভার প্রায় একই কথার পুনরুক্তি করে বলেছিলেন যে, ছোটগল্পের ভাষায় যদি এমন বর্ণনা থাকে যা লেখকের ভাবালুতাকে প্রশ্রয় দেয় অথবা যা অসংগত অথবা সঠিক নয় তাহলে পাঠকের রসবোধ ক্ষুণ্ণ হবে (‘জেমস কার্ভার’, অন রাইটিং)। হেনরি জেমস এ-ধরনের লেখাকে বলেছিলেন, ‘দুর্বল নির্দিষ্টকরণ’, উইক স্পেসিফিকেশন অর্থাৎ যা বলা উচিত বা উদ্দীষ্ট সেখানে ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়া। এই ব্যর্থতার বিপরীতে তাৎপর্যপূর্ণ বিশদময়তার দৃষ্টান্ত হিসেবে মার্কেজের লেখার উলেস্নখ করে ছোটগল্প-লেখিকা ফ্লানারি ও’কনর বলেছেন, যখন একজন লেখক ফ্যানটাসি বা অলৌকিক বিষয় নিয়ে লিখছেন তখনো তাঁকে বাস্তবতাকেই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে অগ্রসর হতে হবে। লেখার একটি বিষয় বাস্তবতার যত কাছাকাছি হবে সেই পরিমাণেই তাকে লেখকের কল্পনাপ্রসূত বলে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। বাস্তবের বিপরীতে বলেই ফ্যানটাসিকে বিশ্বাসযোগ্যতার সব উপকরণ আত্মস্থ করতে হবে। এভাবে কল্পনা আর বাস্তব একাকার হয়ে যাবে। লেখার প্রক্রিয়ায় অনুভূতিপ্রবণতা, অভিজ্ঞতা, এইসব যতই কার্যকরী গুণাবলি বা শর্ত হোক না কেন কল্পনাশক্তির জারক-রসেই তারা সৃজনশীলতায় পর্যবসিত হয়। মার্কেজের ছোটগল্প ‘এ ভেরি ওল্ড ম্যান উইথ এনোরমাস উইংস’ গল্পে একটি মৃত্যুপথযাত্রী শিশুকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পৃথিবীতে নামার মুহূর্তে দুর্ঘটনায় পতিত দেবদূতকে কেবল বর্ণনা শুনেই অলৌকিক বলে মনে হয় না। তার অলৌকিকতা বিশ্বাস্য হয়েছে বর্ণনায় বাস্তবতার শরণাপন্ন হওয়ার জন্য। আপাত বিরোধিতার মধ্যেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এখানে, অনেকটা যেন দ্বান্দ্বিকতার সূত্র অনুসরণ করে। একই পরিণতি দেখতে পাওয়া যায় কাফকার ছোটগল্প ‘মেটামরফোসিসে’, যেখানে গ্রেগর সামসা পোকা হয়ে যাওয়ার পরও মানুষের মতো বোধশক্তিসম্পন্ন থাকার ফলে তার দৃষ্টিতে এবং বর্ণনায় বাস্তবতা আগের মতোই থাকে, কেবল নিজের অসিত্মত্ব ছাড়া। বাস্তবতার বৃহৎ অংশ অপরিবর্তিত থাকে বলেই মানুষ থেকে তার পোকায় পর্যবসিত হওয়ার উদ্ভট ঘটনাকে ফ্যানটাসি বলে মনে হয় না। ফ্ল্যানারি ও’কনরের মতে, সত্য এখানে বিবৃত হয়নি বরং ঘটনার বিকৃতির মাধ্যমে সত্যকে আবিষ্কার করার প্রয়াস রয়েছে। সেই সত্যটি হলো এই যে, যা দৃশ্যমান তাই সম্পূর্ণ সত্য নয়। সুতরাং গভীর অন্তর্দৃষ্টি অর্জনে লেখকের জন্য ঘটনা বা প্রকৃতিকে পুনর্বিন্যস্ত করার ক্ষমতা অর্জন প্রয়োজন। (ফ্ল্যানারি ও’কনর, রাইটিং শর্ট স্টোরিজ)। তাৎপর্যপূর্ণ ডিটেইলের পরিবেশনায় লেখক সবকিছু বলে দেয় না। বর্ণনার দ্বারা বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করে পাঠককে বাস্তবতার কাছে পৌঁছে দেয় মাত্র।

মোপাসাঁ যাকে বলেছেন ‘ইল্যুশন অব রিয়েলিটি’, বাস্তবতার মায়া সৃষ্টি, উপন্যাসের চেয়ে ছোটগল্পেই তার প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজন বেশি। উপন্যাসে বাস্তবতা তার নিজের রূপেই অনেকটা প্রতিফলিত হতে পারে, কেননা সেখানে বৃহৎ পরিসর, অসংখ্য পাত্র-পাত্রী এবং ঘটনার সন্নিবেশ থাকে। ছোটগল্পের সীমিত পরিসরে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ডিটেইলের ব্যবহার করে বাস্তবতার মায়া বা অলীকরূপ সৃষ্টি করতে হয়। উপন্যাসের তুলনায় আরো তীব্রভাবে এবং সচেষ্ট হয়ে এই পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে হয় ছোটগল্প-লেখককে।

অলৌকিককে অথবা খণ্ডত বাস্তবকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাই যদি ছোটগল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাহলে সৃজনশীল লেখার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তার সম্পৃক্তি স্পষ্ট হয়ে আসে। স্পর্শকাতর মনে বাস্তবের খ-াংশ অভিঘাত সৃষ্টি করে। বুদ্ধি এবং মননশীলতার আবেদনের তুলনায় মুহূর্তের আবেগ-অনুভূতিই স্পর্শকাতর মনে চাঞ্চল্য আর অস্থিরতা সৃষ্টি করে বেশি। এদিক দিয়ে ছোটগল্প কবিতা, বিশেষ করে গীতিকবিতার সমধর্মী। গীতিকবিতার মতোই ছোটগল্পও ‘ইমোশনস রিকলেকটেড ইন ট্রানকুইলিটি’র মতো এক প্রয়াস। উপন্যাসের সঙ্গে এখানেই তার প্রধান গুণগত পার্থক্য। একই কারণে কবিতার মতো ছোটগল্পেও উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক আর চিত্রকল্পের ব্যবহার জনপ্রিয় শুধু নয়, অধিক প্রয়োজনীয়।

আধুনিক ছোটগল্পে মননশীলতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। ঘটনাভিত্তিক কাহিনি নয়, কেবল একটি বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যও গল্প লেখা হয়েছে। যেমন, উইলিয়ম ফকনারের ‘দি বিয়ার’ গল্পটি। এইসব গল্পে ছোটগল্পের সনাতনী নাটকীয়তা বা আকস্মিকতা নেই। কিন্তু বক্তব্যটি যতই গভীর ও তাৎপর্যময় হবে গল্পে বাস্তবের নির্মাণ সেই অনুপাতে অনুপুঙ্খ হওয়া প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রেও বাস্তবের নির্বাচিত খ-াংশের (দৃশ্য-শব্দ-চরিত্র) বিশ্বাসযোগ্য সন্নিবেশই উদ্দেশ্যকে সফল করতে পারে। আবেগের প্রকাশ অথবা মননশীল চিন্তার উপস্থাপন, উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, ছোটগল্পে ইল্যুশন অর্থাৎ অলীক-বাস্তবতার সৃষ্টি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকছে। এর ফলে রোমান্টিকধর্মী ছোটগল্পও আবেগসর্বস্ব অর্ধবাস্তবতায় পর্যবসিত হয় না। অপরদিকে মননশীল বিষয় নিয়ে লেখা ছোটগল্পেও সৃজনশীলতার মেজাজ অক্ষুণ্ণ থাকে।

ছোটগল্প তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে কিনা তার অনেকটাই নির্ভর করছে সৃজনশীল লেখার প্রক্রিয়ায় যে পঞ্চম এবং শেষ পর্যায় অর্থাৎ ন্যারেটিভের ব্যবহারের ওপর। স্পর্শকাতর মন লেখকের সহজাত প্রবৃত্তি; অভিজ্ঞতা তাঁর যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ; কল্পনার আশ্রয়ে লেখার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের তাগিদও জন্মগত প্রবণতা। কিন্তু ন্যারেটিভের ব্যবহার একান্তই পরিশ্রম ও সাধনার ফসল। এখানে জন্মগতভাবে প্রাপ্ত মেধা কিছুটা ভূমিকা পালন করলেও পরিশ্রম ও নিষ্ঠার বিকল্প নয়। যেহেতু উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পের পরিসর সীমাবদ্ধ সেজন্য তার ন্যারেটিভ আরো সংহত এবং তীক্ষন হতে হয়। অধিক বাক্য ব্যয় মানেই ছোটগল্পের সংহত রূপ বিঘ্নিত করা এবং কাঠামোতে শৈথিল্য এনে পাঠকের মনোনিবেশ বিশ্রস্ত করে দেওয়া। ছোটগল্পের ন্যারেটিভে যে ঠাসবুনন, সেখানেই পাঠকের অর্ধেক তৃপ্তি। কথাসাহিত্য শ্রেণির হলেও ছোটগল্পের গদ্য আর ন্যারেটিভ উপন্যাসের তুলনায় দর্শনীয় এবং গুণগতভাবে পৃথক। এই গদ্য এবং ন্যারেটিভের ব্যবহারে যে-লেখক যত বেশি সিদ্ধহস্ত ও পারঙ্গম, ছোটগল্পের আঙিনায় তাঁর বিচরণ তেমনি স্বচ্ছন্দ হবে।

 

ছোটগল্পের বিষয়

বিষয়ের দিক দিয়ে ছোটগল্পের সঙ্গে উপন্যাসের পার্থক্য অনেক। জীবনের বৃহৎ অংশ নিয়ে উপন্যাস, ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে ছোটগল্প, এ-কথা সবাই জানে। ছোটগল্পের স্বল্পপরিসরে যে-জীবন সেখানে অবশ্য ক্ষুদ্রাংশও তাৎপর্যে সমগ্রের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। একটি চরিত্র বা একাধিক চরিত্রের এমন পরিচয় থাকে, যার ফলে তাকে বা তাদের শনাক্ত করা যায়। বড় কোনো সমস্যা বা ঘটনার ভূমিকা ও ছোটগল্পে তার উপস্থিতি পটভূমিতেই সীমাবদ্ধ, চরিত্রের ওপর অভিঘাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তার অবতারণা। প্রেম-বিরহ থেকে দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং যুদ্ধ সবই হতে পারে এইসব বড় ঘটনা এবং সামষ্টিক অভিজ্ঞতাও হতে পারে ছোটগল্পের বিষয়। কিন্তু ঘটনা যতই ব্যাপক (যেমন দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ) ছোটগল্পে তার ভূমিকা ততই পরোক্ষ এবং উপস্থিতি দূরবর্তী। বিভূতিভূষণের ‘অশনি সংকেত’ গল্পে যুদ্ধ গ্রাম থেকে অনেক দূরে কিন্তু গ্রামের মানুষ তার অভিঘাতে ক্রমেই বিপর্যস্ত। দুঃখ, দারিদ্র্য এবং অসুস্থতা নিয়ে লেখা ছোটগল্পে ঘটনার বিস্তারের প্রয়োজন পড়ে না, কেননা চরিত্রের ওপর এদের অভিঘাত তাৎক্ষণিকভাবেই দেখানো যায়। কমলকুমার মজুমদারের ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্প স্বল্প ঘটনার ভিত্তিতেই বাঙ্ময়। ও হেনরির ‘দি লাস্ট লিফ’ গল্পে মৃত্যুপথযাত্রী শিল্পীর অমরতা তাঁর রোগভোগের অসহায়ত্বকে অতিক্রম করে যায়। পাঠককে তীব্রভাবে আলোড়িত করার জন্য দারিদ্র্য এবং অসুস্থতা দুই-ই মোক্ষম বিষয় এবং এদের ব্যবহার ছোটগল্পে অধিক সফল। উপন্যাসে দারিদ্র্য এবং অসুস্থতা আসতে পারে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে মূল ঘটনার পরিণতি হিসেবে অথবা উৎসে কার্যকারণের ভূমিকায়। অবশ্য এর ব্যতিক্রম রয়েছে, যেমন বাংলায় ‘আকালের সন্ধানে’, জার্মান ভাষায় টমাস ম্যানের ডেথ ইন ভেনিস উপন্যাস।

উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পের বিষয়বস্ত্ত সীমাহীন। যে-কোনো দৃশ্য-বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শই হতে পারে গল্পের বিষয়বস্ত্ত। কেবল স্পর্শের বিষয়ে চেকভের ‘দি কিস’ গল্প উলেস্নখযোগ্য। গন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সাদাত হাসান মান্টোর ‘বু’ গল্পটি স্মরণযোগ্য। ছোটগল্পে দৃশ্য ব্যবহারের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ও হেনরির ‘দি লাস্ট লিফ’। বর্ণ নিয়ে লেখা গল্পের মধ্যে এ এস বায়াটের মাতিস বইটির উলেস্নখ করতে হয়। এসব ছাড়াও সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর, অন্যের কাছে শোনা কোনো ঘটনা, পথে যেতে যেতে দেখা কোনো মুখ অথবা শোনা অসম্পূর্ণ সংলাপ এবং এপিফ্যানির মতো চকিতে ঝলসে ওঠা কোনো ভাবনা – এসবই ছোটগল্পের প্রেরণা দিতে পারে। এমনকি অন্যের লেখা কোনো গল্প পড়েও নিজের ভাষ্য অনুযায়ী একটি গল্প লেখার তাগিদ অনুভব করা যেতে পারে। বিষয়ের নির্বাচনে অর্জিত অভিজ্ঞতাই মূল উৎস, যা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ হতে পারে। এইসব অভিজ্ঞতা অনুভূতিপ্রবণ (স্পর্শকাতর) মনে কি এবং কেমনভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে সে-বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। যে মন যত বেশি স্পর্শকাতর ও অনুভূতিপ্রবণ এবং যার কল্পনাশক্তি উর্বর সেখানে সামান্য অভিজ্ঞতাই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে প্রকাশের তাগিদ দিতে পারে।

ছোটগল্পে সার্বিকভাবে একটি বিষয় থাকে এবং তার ওপর কাহিনি তৈরি করা হয়। যেমন প্রেম, ভালোবাসার বিষয়টি, এই বিষয়কে কেন্দ্র করে চরিত্রের সমাবেশে কাহিনির কাঠামো নির্ধারিত। যেহেতু পরিসর স্বল্প এবং চরিত্রসংখ্যাও অনধিক, সে-কারণে কাহিনি বিসত্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই। কাহিনির ভেতর থাকে ঘটনা যা কাহিনির পটভূমি ও বর্তমান নির্ধারিত করে আর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ইঙ্গিত দেয়। ঘটনাগুলি যত স্বল্পই হোক, কার্যকারণের সম্পর্কে যুক্ত, যার ভিত্তিতে কাহিনিতে সম্পূর্ণতার আভাস দেওয়ার চেষ্টা থাকে। সীমিত পরিসরের জন্যই ঘটনার সন্নিবেশ এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রে ইঙ্গিতধর্মী হতে হয়। ঘটনার বিশদ বর্ণনার তুলনায় ঘটনার অভিঘাতে চরিত্রের ওপর কী প্রতিক্রিয়া হয় এবং পরবর্তীতে কীভাবে সেই প্রতিক্রিয়ার ফলে ঘটনা প্রভাবান্বিত হয় ছোটগল্পে সেই বিষয়টিই প্রধান। অনেক সময় ঘটনার সন্নিবেশে এবং চরিত্রের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে কাহিনির পরিণতি বা বিন্যাস সম্বন্ধে পাঠককে অনুমান করে নিতে হয়। কার্যকারণ ব্যাখ্যা করে কাহিনি সম্বন্ধে উপসংহার টানার দায় ছোটগল্প লেখকের সেই পরিমাণে নেই যা আছে ঔপন্যাসিকের। ইঙ্গিতময়তা, আভাস প্রদান, পরোক্ষ মন্তব্য এইসব প্রকরণগত বৈশিষ্ট্যের জন্য ছোটগল্পে মিথের, মেটাফরের এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার উপন্যাসের তুলনায় বেশি। এই বিবেচনায় ছোটগল্প অনেকটা কবিতার কাছাকাছি। অবশ্য প্রকরণগত এইসব বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে উপন্যাসের সঙ্গে ছোটগল্পের পার্থক্য বর্তমানে অনেকটাই অপসৃত। কিন্তু উপন্যাসের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ কাহিনি বলার দায়িত্ব যেমন ছোটগল্পের নেই, পস্নট বা কার্যকারণ সম্পর্কিত ঘটনার বিশদ বর্ণনা না থাকার জন্য তাকে সমালোচনার দায়ভার গ্রহণ করতেও হয় না। লুই বোর্হেসের গল্পের মতো অস্পষ্টতা এবং কমলকুমার মজুমদারের গল্পের দুর্বোধ্যতা ছোটগল্পের নান্দনিক গুণ বলেই বিবেচিত। এক কথায় রূপকথার মতো ছোটগল্প-লেখককে, ‘আমার কথাটি ফুরলো, নটে গাছটি মুরলো’ বলে শেষ করতে হয় না।

 

ছোটগল্পে সময়

ছোটগল্পে তাৎক্ষণিকতার ভূমিকা বেশ প্রবল। উপন্যাসের মতো ছোটগল্পের কাহিনি যে-কোনো সময়ে, ঘটনার অনেক পর, অভিজ্ঞতা অর্জন পুরনো হয়ে এলে এবং সময় নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করে, এমন বিচিত্রভাবে লেখা স্বাভাবিক নয়। ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখা তাই জনপ্রিয়, কিন্তু ছোটগল্পে সমসাময়িকতাই বিষয়কে ধারণ করে থাকে। এর প্রধান কারণ ছোটগল্প-পাঠক বর্তমান অথবা সাম্প্রতিক অতীত সম্বন্ধেই জানতে চায়। ঠিক যেমন সংবাদপত্রের পাঠক আশা করে তাজা খবর, ছোটগল্পেও পরিবেশন করতে হয় চলমান জীবনের ছবি। কার্লোস ফুয়েমেত্মস ছোটগল্প-লেখকদের অভিহিত করেছেন শেহেরজাদীর উত্তরসূরি হিসেবে। শেহেরজাদীর মতো ছোটগল্প-লেখককেও দ্রম্নত গল্প বলে যেতে হয় নিঃশেষিত হওয়ার বা বাতিল হয়ে যাওয়ার পরিণতি এড়ানোর জন্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস ভবিষ্যতেও অনেককালব্যাপী লেখা যাবে এবং বেশ যৌক্তিক হবে সেই চেষ্টা, কেননা ঘটনা থেকে সময়ের দূরত্বে নির্মোহ হয়ে লিখতে পারবে কথাসাহিত্যিক তাঁর উপন্যাস। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছোটগল্প লেখার সময় সীমাবদ্ধ, এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছোটগল্প লিখলে সেই সৃজনশীলতা তেমন আকর্ষণীয় মনে হয় না। অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতির তাজা উপস্থিতি সেখানে নেই বলে তা হয় এমন এক কল্পনাশ্রয়ী যেখানে স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। যান্ত্রিকতার কাছাকাছি এসে এই সৃজনশীলতা বাস্তবের মায়া সৃষ্টি করতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়।

কবিতার মতো ছোটগল্পও ‘ইমোশন্স রিকলেক্টেড ইন ট্রানকুইলিটি’ হলেও, ঠিক কবিতায় যেমন ছোটগল্প লেখার ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞতা অর্জন এবং প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা এই দুই পর্বের মধ্যে সময়ের খুব বেশি ব্যবধান রাখা যায় না। ফুয়েমেত্মসের মতো আবার বলতে হয়, ছোটগল্পকে সফল হতে হলে তার সৌন্দর্য, অর্থ এবং আবেগের তীব্রতা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্যক্ত করা ছাড়া উপায় নেই। শেহেরজাদীর মতো ছোটগল্প-লেখককে যে এক ধরনের মৃত্যু এড়ানোর জন্য গল্প বলে যেতে হয়, ফুয়েমেত্মসের এই উক্তি বেশ অর্থময় এবং সেই কারণে প্রণিধানযোগ্য (ভূমিকা : লাতিন আমেরিকার ছোটগল্প)। অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখার বিলাসিতা ছোটগল্প-লেখকের জন্য নয়। এই বাধ্যবাধকতার মধ্যে ছোটগল্পের যেমন শক্তি (কল্পনার সাহায্যে বাস্তবের মায়া সৃষ্টি করে বিশ্বাসযোগ্য হওয়া), তেমনি দুর্বলতাও (সময়ের স্বল্পতার জন্য বাস্তবের মায়া সৃষ্টিতে অসম্পূর্ণতা কিংবা নিছক সাংবাদিকতার মতোই ডকুমেন্টারি হয়ে যাওয়া) নিহিত। যেহেতু কোনো অভিজ্ঞতাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় এবং কোনো লেখকের একান্ত মনে হলেও অন্যের অভিজ্ঞতার অতীত নয়, সেই কারণে গবেষণা করে লেখার শর্তটি পূরণ করা যায় না। চমৎকার কাহিনি বা বিষয়বস্ত্ত সত্ত্বেও কল্পনা যেন স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে না এবং ন্যারেটিভে বা আঙ্গিকে যে-কুশলতা থাকা প্রয়োজন সবসময় তার পরিস্ফুটন ঘটে না। এ-কারণে একজন ছোটগল্প-লেখকের স্মরণীয় ছোটগল্পের সংখ্যা হয় সীমিত এবং কারো কারো ক্ষেত্রে তাও নয়। সময়ের দাবি মেনে নিয়ে কালজয়ী হওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ছোটগল্প-লেখকের কাছে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। কল্পনাশক্তির প্রখরতা এবং আঙ্গিক ও ন্যারেটিভ-সচেতনতা এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় যেমন সহায়ক, অন্যকিছু সেই তুলনায় যে কম, এ-কথা জোর দিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

ছোটগল্পে দৃষ্টিকোণ

ছোটগল্পের দৃষ্টিকোণ একাধিক হতে পারে। যেমন – প্রথম পুরুষ, দ্বিতীয় পুরুষ এবং তৃতীয় পুরুষ। ‘আমি’ বর্ণনাকারী ছোটগল্পে যেমন স্বাভাবিক, সফল উপন্যাসে তেমন নয়। উপন্যাসের ব্যাপ্ত পরিসরে বর্ণনাকারী ‘আমি’ হলে যেমন আত্মজীবনীর স্পর্শ এসে যায়, ছোটগল্পে অবশ্য সেই আশঙ্কা থাকে না। কনরাড যদিও তাঁর হার্ট অব ডার্কনেস উপন্যাসিকা প্রথম পুরুষেই শুরু করেছেন, যেখানে মার্লো টেমস নদীতে স্টিমারে বসে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুরু করেছেন, কিন্তু প্রথম অধ্যায়ের পর তিনি তৃতীয় পুরুষের বর্ণনার সাহায্যই নিয়েছেন। ছোটগল্পে প্রথম পুরুষের বর্ণনা শুধু সফল নয়, এক অর্থে অপরিহার্যও বটে। এখানে ‘আমি’ নিছক কেন্দ্রীয় চরিত্র অথবা লেখক স্বয়ং হতে পারেন। প্রথম পুরুষের বর্ণনার সুবিধা এই যে, বর্ণনাকারী নিজের দেখা এবং অনুভবকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে তুলে ধরতে পারে এবং মতামত প্রকাশ করতে পারে। অসুবিধা হলো এই যে, অন্য চরিত্রের মনের গভীরে প্রবেশ তার পক্ষে সহজ হয় না। অনুমানের ওপরেই নির্ভর করতে হয় বেশি। এর ব্যতিক্রম হলে সেটা আরোপিত এবং অস্বাভাবিক মনে হবে। দ্বিতীয় পুরুষে কাহিনির বর্ণনাও ছোটগল্পে সংগত এবং সফল। অবশ্য ‘তুমি’ এবং ‘তোমার’ সম্বোধন করে যে-বর্ণনা তার পেছনে প্রথম পুরুষই অনেকটা উপস্থিত থাকে। ছোটগল্প-লেখকদের মধ্যে হেমিংওয়ে তাঁর বেশকিছু গল্পে দ্বিতীয় পুরুষের বর্ণনার এই আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন। ফরাসি নব্য উপন্যাসধারার লেখক এলান রব গ্রিলে তাঁর ছোট উপন্যাস জেলাসিতে দ্বিতীয় পুরুষের বর্ণনার সাহায্য নিয়েছেন মনস্তাত্ত্বিক বিশেস্নষণের সুবিধার জন্য। বড় উপন্যাসে এই আঙ্গিক খুব কার্যকর নয়, কেননা, তখন বর্ণনা স্বতঃস্ফূর্ত না হয়ে আরোপিত মনে হয়। পাঠকের কাছে দীর্ঘ এই বর্ণনা একঘেয়েও মনে হবে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে ‘তুমি’ বলতে লেখক পাঠককেই বোঝাতে চান এবং যেন তার হাত ধরে গাইডের মতো সবকিছু দেখাতে দেখাতে ধারাবিবরণী দিয়ে যান। ‘তুমি’ তখন আর বর্ণনাকারী থাকে না, অদৃশ্য বর্ণনাকারীর মাধ্যম হয়ে যায়। উপন্যাসের মতো তৃতীয় পুরুষের বর্ণনা ছোটগল্পে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রচলিত। এখানে লেখক সবজান্তা হয়ে চরিত্রের বাহ্যিক এবং মানসিক জগতের সব তথ্য পরিবেশন করেন।

বর্ণনাকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে (আমি, তুমি, সে, এইসব মাধ্যমে ব্যবহার) ছোটগল্প যেমন ভার্সাটাইল বা সব বিষয়ে পারঙ্গম, উপন্যাস তার তুলনায় বেশ হ্যান্ডিক্যাপ্ড বা বাধাগ্রস্ত। ছোটগল্প-লেখক বর্ণনার জন্য কোন দৃষ্টিকোণ বেছে নেবেন তার অনেকটাই নির্ভর করে বিষয়বস্ত্ত, বিশেষ করে কাহিনির বিন্যাসের ওপর। প্রথম এবং দ্বিতীয় পুরুষের বর্ণনায় যে-নাটকীয়তা আছে তৃতীয় পুরুষে তেমন নেই। কিন্তু সেজন্যই যে ওই দুটি দৃষ্টিকোণ অধিক পছন্দের এমন মনে করার কারণ নেই। ছোটগল্পের বিষয়বস্ত্ত যদি হয় নাটকীয়তা-বর্জিত তাহলে প্রথম এবং দ্বিতীয় পুরুষের দৃষ্টিকোণ যথাযথ এবং সফল নাও হতে পারে।

 

ছোটগল্পের নান্দনিকতা

ছোটগল্পে কাঠামোগত এবং গুণগত কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের প্রত্যাশা থাকে। এর পেছনে লেখকের প্রত্যক্ষ ভূমিকা এবং সিদ্ধান্তই মুখ্য ভূমিকা পালন করে, না পাঠকের রুচি, মেধা ও মনন পরোক্ষে থেকে কার্যকরভাবে প্রভাব বিস্তার করে, এ-নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। দুটি একে অন্যের বিকল্প নয়। লেখক ও পাঠক উভয়ে মোটামুটি একই মানস-জগতের অধিবাসী এবং সেই সূত্রে সাধারণ সমঝোতায় পৌঁছুতে সমর্থ। কোথাও লেখক হয়তো একটু অধিক অগ্রসর কিন্তু সেখানেও ছোটগল্পের ধারাবাহিকতার সঙ্গে তার সামান্য হলেও যোগসূত্র থাকে। খুব কম লেখকের পক্ষেই ঐতিহ্য-বিচ্ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ এককভাবে নিজের ক্ষেত্র নির্মাণ ও পরবর্তীকালে তার ভিত্তিতে স্বীকৃতি অর্জন করা সম্ভব হয়। সেজন্য ছোটগল্প লেখককে তাঁর উদ্ভাবনশীলতা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রবণতার অধিকারী হয়েও সৃজনশীল লেখায় এই মাধ্যমে সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলি প্রদর্শন করতে হয়। এইসব বৈশিষ্ট্য এবং গুণের সমাহারই ছোটগল্পের নান্দনিকতা।

প্রথমেই ছোটগল্পের যে বৈশিষ্ট্য থাকতে হয় সেটি যে তার সীমিত পরিসর, তা উলেস্নখের অপেক্ষা রাখে না। এটি কেবল বাহ্যিক এবং দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা নয়, যদিও সেভাবেই শর্তটি পূরণ হয়ে থাকে। ছোটগল্পের বিষয়বস্ত্ত যাই হোক তার বর্ণনায় সংক্ষিপ্ততা একটি বিশেষ ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। আকারে বড় হলে বিষয়বস্ত্তটি ব্যক্ত হয় ঠিকই কিন্তু রস সৃষ্টির সেই ব্যঞ্জনা থাকে না। পাঠকের মনে অভিঘাত এনে দ্যোতনা সৃষ্টিতেও অন্তরায় ঘটে। চলমান জীবনের সামান্য একটি অংশকে তুলে ধরতে চায় বলেই বিন্দুতে সিন্ধুর অসীমতা আনতে হয় ছোটগল্পে। সুতরাং কেবল বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান হয়ে ছোট আকারের হলেই ছোটগল্প রসোত্তীর্ণ হবে না, তার ভেতর সসীম থেকে অসীমে উত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকতে হয়। এই অর্থে ছোটগল্প একই সঙ্গে ছোট এবং বিশাল। ‘শেষ হয়ে হইলো না শেষ’ এই কৌতূহল, অস্থিরতা এবং অতৃপ্তির আভাস জাগিয়ে তুলতে পারলেই ছোটগল্পের ক্ষুদ্রাকার সার্থক। জীবনের জটিলতা যতই বৃদ্ধি পেয়েছে, মেধা ও মননশীলতার চর্চা যতই অগ্রসর হয়েছে এবং সৃজনশীল সাহিত্যের ভাণ্ডার যতই সমৃদ্ধ হয়েছে ছোটগল্পের এই অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যেরও তেমনি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর প্রকাশ ঘটেছে। অন্তর্গত চরিত্রের এই ক্রমবিকাশ যে ছোটগল্পে অনুপস্থিত তার সার্থকতা নেই। মোপাসাঁ, চেকভ অথবা ও হেনরি কালজয়ী ছোটগল্প-লেখক। কিন্তু বর্তমানে তাঁদের মতো গল্প লিখলে ছোটগল্পের ক্রম অগ্রসরমান ইতিহাসকেই অস্বীকার করা হবে, যার জন্য সেসব ছোটগল্প গৃহীত হবে আকর্ষণীয়, কিন্তু সেকেলে হিসেবে। সুতরাং ছোটগল্পকে অবশ্যই স্বল্পপরিসরে সীমিত হতে হবে এবং সেইসঙ্গে বিশালত্বের ব্যঞ্জনাধর্মিতা হতে হবে তার অন্তর্নিহিত গুণ। আর যেহেতু জীবন চলমান এবং মানসিকতার চর্চা সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর কিংবা জটিল থেকে জটিলতর হওয়াই অনিবার্য, সেই কারণে ছোটগল্পের ব্যঞ্জনা সৃষ্টির অন্তর্নিহিত শক্তিতেও সজীবতা এবং সচলতা কাঙিক্ষত। ছোটগল্প এভাবেই সহজ ও শিথিল বর্ণনার সরল কাহিনি হিসেবে শুরু করে জীবনের ঘন-নিবদ্ধ ও বহুমাত্রিক ধারাবিবরণীতে পরিণত হয়েছে। ছোটগল্পের আদি পর্বে রূপকথা, উপকথা, লোকগাথা, জীবজন্তুর গল্প (যেমন, জাতক গল্প) ধাঁধা, উপদেশমূলক গল্প (এসপস্ ফেবলস্) চরিত্রচিত্রণ, ইতিহাসের খ-াংশ অথবা জীবনী ইত্যাদি সবকিছুই এই শাখার অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হলেও বর্তমানে তাদের সঙ্গে পার্থক্য থাকার বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এমনকি আরব্য রজনীর অথবা বোকাচিচওর ‘ডি ক্যামেরন’ নামে গল্পগুচ্ছের সঙ্গেও আধুনিক ছোটগল্পের আকার-প্রকারগত (বিশেষ করে প্রকার) পার্থক্যের প্রতি জোর দেওয়া হয়ে থাকে।

আগেই বলা হয়েছে ছোটগল্পে একটি বিষয় থাকে। বিষয়টি ঐতিহাসিক হতে পারে অথবা সমসাময়িক। ব্যক্তির মানসপ্রক্রিয়া কিংবা সামষ্টিক জীবনের ঘটনাপ্রবাহের খ-াংশ নিয়ে ছোটগল্প লেখা যেতে পারে। তাৎক্ষণিক এবং ব্যক্তিগত থেকে চিরায়ত ও বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতাও হতে পারে ছোটগল্পের বিষয়বস্ত্ত। বাস্তবভিত্তিক, অর্ধেক বাস্তব, অর্ধেক কল্পনা অথবা সম্পূর্ণতই কাল্পনিক বিষয় নিয়ে লেখা যায় ছোটগল্প। উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পেই বিষয়বস্ত্ত লেখকের বক্তব্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত। উপন্যাসে লেখক জীবনের বেশ বড় ক্যানভাসে অনেক ঘটনা এবং চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে একটি কাহিনি বলেন যার ভেতর তাঁর বক্তব্য থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। আকারের জন্যই ছোটগল্পে কাহিনির চেয়ে লেখকের বক্তব্য, তার নিজস্ব মতামত বা যে-দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি জীবনকে পর্যবেক্ষণ করছেন সেই বৈশিষ্ট্য প্রধান হয়ে ওঠে। প্রথম থেকেই বিষয়টিকে ছোটগল্প-লেখক আত্তীকরণ করে নেন এবং নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী শৃঙ্খলার সঙ্গে তাঁর বর্ণনা করেন। উপন্যাসের মতো ছোটগল্পে অনেক ঘটনা ও চরিত্রের সমাবেশে এই বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন থাকে না বলে ছোটগল্পের যেমন সীমাবদ্ধতা, আবার একই সঙ্গে এখানে তার শক্তিরও উৎস। ছোটগল্প-লেখক প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিষয়বস্ত্ত পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গল্পের পরিণতি তাদের জানাই থাকে এবং বলতে গেলে সেই পরিণতির দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্যই গল্পের কাহিনি, ঘটনা এবং চরিত্রদের ব্যবহার করা হয়। দার্শনিক বিষয় অথবা আটপৌরে জীবন সম্বন্ধে লেখকের বক্তব্য যাই হোক না কেন ছোটগল্পে বিষয়বস্ত্ত বেশ সুনির্দিষ্ট এবং বলতে গেলে পূর্বনির্ধারিত। এ-কারণে বিষয়বস্ত্ত বর্ণনায় আদ্যোপান্ত একটি ঐক্যের বন্ধন সুস্পষ্ট। বহু ঘটনা ও চরিত্রের সমাহারে বিষয়বস্ত্তর এই ঘন-নিবদ্ধতা অর্থাৎ ঠাসবুনন এবং ঐক্যবোধকে ক্ষুণ্ণ করা হলে ছোটগল্পের চরিত্রহানি ঘটে। কোনো কোনো ছোটগল্পে বিষয়বস্ত্ত বলতে একটি ধারণা বা আইডিয়ার ব্যবহার হতে পারে। চরিত্র এবং ঘটনা সেই ধারণাকে ব্যক্ত করার ভূমিকা পালন করে মাত্র। জীবনের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিপাত অথবা জীবন ও প্রকৃতি সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট ধারণা, ছোটগল্পের বিষয়বস্ত্ত যাই হোক না কেন, সেই বিষয়বস্ত্তটি অন্তিমে উপলব্ধিযোগ্য হতে হবে। প্রথম থেকেই বিষয়বস্ত্তর নির্যাসের প্রতি মনোযোগ এবং বিষয়বস্ত্তর বর্ণনায় অখ-তা থাকলে (মনোযোগ বিঘ্নকারী ঘটনা বা চরিত্রের অনুপস্থিতি) এই শর্ত পূরণ হতে পারে।

উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও ঘটনার ভূমিকা রয়েছে। ছোটগল্পের ঘটনা হয়তো অতীতের, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়বস্ত্ত নির্ধারিত হয়েছে এবং কাহিনি অগ্রসর হচ্ছে। ঘটনা বর্তমান কালেরও হতে পারে এবং বিষয়ের বর্ণনায় তারও ভূমিকা একই থাকে। ঘটনা সহজ-সরল    অথবা জটিল হতে পারে। ঘটনার সঙ্গে গল্পের চরিত্রের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ হতে পারে। ঘটনার উলেস্নখ প্রত্যক্ষভাবে করা যায় অথবা পরোক্ষে স্মৃতিচারণায় কিংবা প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে করা যেতে পারে। যেভাবেই ঘটনার অবতারণা করা হোক এবং ঘটনা ব্যবহৃত হোক, ছোটগল্পে একাধিক ঘটনা অথবা ঘটনার জটিলতার অবকাশ নেই। আবার চরিত্র বিশেস্নষণ অথবা পরিপ্রেক্ষিতের বর্ণনাই যদি বিষয়বস্ত্তর মূল উদ্দেশ্য হয় তাহলে ঘটনার বিশদ বিবরণও অপ্রয়োজনীয় হবে। ঘটনা সম্বন্ধে প্রধান শর্ত হচ্ছে এই যে, বিষয়বস্ত্তর উপস্থাপনায় তার প্রাসঙ্গিকতা এবং উপযোগিতা থাকতে হবে।

গল্পে ঘটনার তাৎপর্য ও ভূমিকা সংঘর্ষ বা বিরোধ সৃষ্টিতে। এই সংঘর্ষ গল্পের একাধিক চরিত্রের মধ্যে, চরিত্র ও সমাজের সঙ্গে চরিত্র ও তার ভাগ্যের সঙ্গে, চরিত্র ও প্রকৃতির সঙ্গে হতে পারে। ব্যবহারিক দিক দিয়ে বাইরে দৃশ্যমান অথবা মানসিকভাবে হওয়ার কারণে অদৃশ্যে থেকে এই সংঘর্ষ অথবা বিরোধিতা রূপ নিতে পারে। আবার এই সংঘর্ষ একই ব্যক্তির নিজের মানসজগতের অন্তর্গত বিষয় হতে পারে। সংঘর্ষ সৃষ্টিই ঘটনার মূল ভূমিকা এবং সার্থকতা। বিষয়বস্ত্তকে পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় এবং অনুকূল ঘটনার অবতারণা ও ব্যবহার করা হয়েছে কিনা ছোটগল্পে সে-বিষয়টি বিশেষ করে বিচার্য। বিষয়বস্ত্তকে যদি মনে করা হয় কাহিনির সমার্থক তাহলে ঘটনাকে ধরতে হবে কাহিনির নির্মাণসামগ্রীর অন্যতম হিসেবে। ছোটগল্পে একাধিক ঘটনা থাকা বাঞ্ছনীয় নয়, কেননা এর ফলে বিষয়বস্ত্ত বা কাহিনির ঐক্য ব্যাহত হয়। ঘটনার বর্ণনার তুলনায় ঘটনা-পরবর্তী মানসপ্রতিক্রিয়া এবং পরিবর্তনের বর্ণনাই উন্নত পর্যায়ের সৃজনশীলতার পরিচায়ক। প্রয়োজন অনুযায়ী এই বর্ণনা প্রথম, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় যে-কোনো পুরুষেই হতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ (কোন পুরুষে বর্ণনা হবে) বিষয়বস্ত্ত এবং বক্তব্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা সেই বিবেচনা প্রধান। ঘটনা দিয়ে শুরু করে ঘটনা দিয়েই শেষ করার যে সনাতন পদ্ধতি বর্তমানের ছোটগল্পে তার ব্যবহার এখন বেশ দুর্বল বলে বিবেচিত। আধুনিক ছোটগল্পে ঘটনা অবশ্যই থাকে, স্পষ্ট বা অস্পষ্ট যেভাবেই হোক না কেন, কিন্তু তাদের ভূমিকা গৌণ। মুখ্য হলো ঘটনার ফলে চরিত্রের মানসিক প্রতিক্রিয়া এবং প্রকৃতি ও সমাজে পরিবর্তনের আভাস। যদি অতীত ঘটনা দিয়েই গল্প শুরু হয় তাহলে অবশ্য এই পরিবর্তন ইঙ্গিতময়তায় সীমাবদ্ধ থাকে না, আরো বিশদ হয়। কাহিনি বা বিষয়বস্ত্ত যাই হোক, ছোটগল্পে ঘটনার ভূমিকা গৌণই বলতে হবে, বিশেষ করে ধারাবাহিক ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কভিত্তিক বিন্যাস। ঘটনার তুলনায় ঘটনা-উত্তর প্রতিক্রিয়া এবং প্রভাবের বিশেস্নষণই এখানে মুখ্য। এখানেও দূরবর্তী সময়সীমায় প্রতিক্রিয়া দেখানো নয়, বর্তমান এবং সীমিত সময়ের ব্যাপ্তিতেই তার পর্যালোচনা অথবা ইঙ্গিতময় উলেস্নখ প্রাধান্য পায়। ঘটনার এই সীমিত ও পরোক্ষ ভূমিকার জন্যই ছোটগল্পে মনস্তত্ত্ব, পরাবাস্তববাদ, জাদুবাস্তবতা, এসবের সূক্ষ্ম বিশেস্নষণ ও ব্যবহার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। মোপাসাঁ যাকে বলেছিলেন, ‘ইল্যুশন অব রিয়েলিটি’, ছোটগল্পেই তার প্রয়োজন তীব্র এবং সেই কারণে উপস্থিতিও বেশি দেখা যায়। ঘটনা এখানে নিমিত্ত মাত্র। জীবন ও প্রকৃতি, এমনকি আধিভৌতিকের উদ্ভাসন ঘটাতে সমর্থ বলেই ঘটনা প্রাসঙ্গিক। ঘটনা বহুলতা কিংবা ঘটনার বিশদ বর্ণনা নয়, ঘটনা-উত্তর প্রতিক্রিয়ার প্রভাবই ছোটগল্পের অন্বিষ্ট।

ছোটগল্পে চরিত্র বিষয়বস্ত্তকে প্রতিষ্ঠিত করার বাহন। চরিত্রকে কেন্দ্র করেই ঘটনা ঘটে এবং প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সীমিত পরিসরের জন্য এবং বিষয়বস্ত্তর প্রতি মনোযোগ অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে ছোটগল্পে বেশি চরিত্র থাকা অস্বাভাবিক তো বটেই, ক্ষতিকরও। ছোটগল্পের মূল বিষয় বা বক্তব্য পরিস্ফুট করার জন্য কয়েকটি চরিত্রই যথেষ্ট। একটি চরিত্রের দ্বারাই এই উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে। ছোটগল্পে চরিত্রকে ধীরে ধীরে বিকশিত করার উপায় নেই এবং তার প্রয়োজনও পড়ে না। ঘটনার অভিঘাতে যে-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তারই ভিত্তিতে চরিত্রটির মৌলিক গুণাবলি সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। সক্রেটিস যেমন বলেছিলেন, ‘উই আর আওয়ার ডিজায়ার্স’, আমাদের কামনা-বাসনাই আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে, তার সত্যতা সন্দেহের অতীত। ছোটগল্পের চরিত্র শনাক্ত করার জন্য মনোজগতের চেতনা ও অবচেতনার বিশেস্নষণ প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। চরিত্র সম্বন্ধে যে-সকল প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক তার মধ্যে রয়েছে : (ক) চরিত্রগুলির স্বরূপ কী? (খ) তারা কী চায়? (গ) কী চিন্তা-চেতনা তাদের উদ্বুদ্ধ করে? (ঘ) চরিত্রদের কার্যকলাপের পেছনে কী কারণ রয়েছে? (ঙ) এই কার্যকলাপ চরিত্রগুলি সম্বন্ধে কী জানায়? (চ) চরিত্রগুলি কি তাদের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে সমর্থ হয়? (ছ) চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কি সরাসরি বর্ণনা করা হয়েছে, না সে-সম্বন্ধে ঘটনা এবং চরিত্রের ক্রিয়া থেকে অনুমান করে নিতে হয়? (জ) চরিত্রগুলি কি-টাইপ না ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যম–ত? (ঝ) চরিত্রগুলি কি মনগড়া অথবা বিমূর্ত ধারণার প্রতীক? (ঞ) চরিত্রগুলির ক্রিয়া কি লেখক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বা আরোপিত, না স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক? (ট) চরিত্রগুলিকে নায়ক এবং খলনায়ক, সাদা-কালোর মতো এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়, নাকি তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ উভয় গুণাবলিরই সমাবেশ রয়েছে? চরিত্র সম্বন্ধে এসব প্রশ্ন উপন্যাসেই অধিক প্রাসঙ্গিক ও প্রযোজ্য হলেও ছোটগল্পে চরিত্রের ভূমিকা প্রধান হলে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা উপলব্ধির জন্য এসব বিবেচনায় আনতে হয়। যেসব ছোটগল্পে চরিত্র বেশি নেই এবং তাদের বাহ্যিক জীবন ও ক্রিয়াকর্ম বিস্তারিতভাবে বর্ণনায় স্থান পায় না, সেই ক্ষেত্রে প্রশ্নগুলির সব না হলেও কয়েকটি অবশ্যই প্রাসঙ্গিক হবে। যেমন, মূল চরিত্রটি যদি আর্কেটাইপ হয় তাহলে চরিত্রটির বৈশিষ্ট্যগুলি স্পষ্ট হয়েছে কিনা জানা প্রয়োজন। যেমন, সিন্ডারেলা বা ড. হাইড অ্যান্ড মি. জেকিল চরিত্রের আদলে ছোটগল্পের মূল চরিত্র নির্বাচন করা হলে শেষ পর্যন্ত তার ক্রিয়াকলাপ চরিত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্যতা দেয় কিনা সে-বিষয়টি বিচার্য হবে। এমন চরিত্রের অবশ্যই কতগুলি পরিচিত বৈশিষ্ট্য থাকবে এবং ঘটনা-স্রোতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সেসব বৈশিষ্ট্য একটি অনিবার্য পরিণতির দিকে গল্পকে নিয়ে যাবে। যেখানে চরিত্র কোনো টাইপ নয়, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল সেসব গল্পে চরিত্রের অগ্রগতি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হবে। লেখকের কল্পনা অলীক বাস্তবের সৃষ্টি করলেও সেখানে চরিত্র নির্মাণে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে। ফ্যানটাসি ধরনের গল্পে কল্পনার পাখা অনেকদূর বিসত্মৃত হতে পারে এবং সেখানে চরিত্রের যে-স্বতঃস্ফূর্ততা তার সঙ্গে বাস্তবের মিল না থাকলেও ‘কল্পনা-বাস্তবতার’ সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়ার কারণে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারে। আবার বাস্তব জীবনে কল্পলোকের বা ফ্যানটাসির কোনো চরিত্র থাকতে পারে। যেমন মার্কেজের গল্পে দেখা যায়। এসব গল্পে অবাস্তব চরিত্র তার অলৌকিক এবং অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেই বাস্তব জীবনের সঙ্গে পরিচিত কার্যকলাপের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করে বিশ্বাসযোগ্য হয়। যেমন, স্টিফেন ভিনসেন্ট বেনেটের গল্প ‘দি ডেভিল অ্যান্ড ড্যানিয়েল ওয়েবস্টার’। প্রথাগতভাবে বাস্তবসম্মত ছোটগল্পে চরিত্র প্রধান হোক অথবা গৌণ, তার বা তাদের বর্ণনায় মনস্তাত্ত্বিক বিশেস্নষণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কল্পকাহিনির চরিত্রকে যেমন ভিতর এবং বাহির দুদিক থেকেই বর্ণনা করে যেতে হয়, বাস্তবসম্মত অর্থাৎ বাস্তবতাভিত্তিক ছোটগল্পে সেই বাধ্যবাধকতা থাকে না।

ছোটগল্পে সংলাপের ভূমিকা গৌণ, কেননা, সীমিত পরিসরে বিসত্মৃত সংলাপের সুযোগ নেই। সংলাপের মাধ্যমে ছোটগল্পের কাহিনিকে বা বিষয়বস্ত্তকে সম্পূর্ণভাবে উপস্থাপিত করতে হলে যে সময় এবং স্পেস প্রয়োজন সেসব নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ন্যারেটিভের সাহায্যেই ছোটগল্প পরিণতির দিকে অগ্রসর হয় এবং সেই বর্ণনাকারী প্রথম, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় পুরুষ হতে পারে। সংলাপের জন্য সীমিত স্থান বরাদ্দের কারণে ছোটগল্পের সংলাপের ভাষা হতে হয় ঋজু, মেদহীন এবং লক্ষ্যভেদী। গল্পের কোন অংশ বর্ণনানির্ভর হবে আর কোথায় সংলাপের সাহায্য নেওয়া বাঞ্ছনীয় সে-বিবেচনায় কুশলতা এবং শিল্পমনস্কতার পরিচয় দিতে হয়। সংলাপের ভাষা চরিত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে এবং আদ্যোপান্ত একই ধরনের হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিষয়বস্ত্তর সঙ্গেও সংলাপের সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। যেমন, বিয়োগান্তক গল্পে রসিকতাপূর্ণ সংলাপ বেমানান। সংলাপে বৈচিত্র্য থাকলে বিষয়ের তাগিদেই তার যৌক্তিকতা। ছোটগল্প যে কেবল অথবা প্রধানত সংলাপনির্ভর হতে পারে না, তা নয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে হেমিংওয়ের ‘হিলস লাইক হোয়াইট এলিফ্যান্টস’ গল্পটির উলেস্নখ করা যেতে পারে।

উপন্যাসের মতো অপরিহার্য না হলেও স্থান এবং পরিবেশের উলেস্নখ ছোটগল্পে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। স্থান-কালনিরপেক্ষ গল্প হতে পারে, কিন্তু তা ব্যতিক্রম। ছোটগল্পের বিষয়, চরিত্র-বিশেস্নষণ এবং ঘটনাবিন্যাস, এসবই স্থান এবং কালনির্ভর এই অর্থে যে, বিশেষ স্থানে ও কালেই একটি ন্যারেটিভ বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। যেখানে স্থান ও পরিবেশ ঘটনা এবং চরিত্রের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে সেইসব ক্ষেত্রে স্থানের বর্ণনা খুবই প্রাসঙ্গিক। তবে গল্পে স্থান ও কালের হঠাৎ পরিবর্তন অথবা ঘন ঘন পরিবর্তন বাঞ্ছনীয় নয়। উপন্যাসের মতো ছোটগল্পে স্থানের জন্য বিশদ বর্ণনার সাহায্য নেওয়া যায় না এবং অনেক ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনও পড়ে না। কিন্তু সামান্য হলেও স্থান ও পরিবেশের সূক্ষ্ম এবং আন্তরিক বর্ণনা ছোটগল্পের আবহাওয়া তৈরিতে কার্যকর। আর বাস্তবতার মায়া সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সীমিতভাবে হলেও ডিটেইলসের ব্যবহারে স্থানকে পরিচিত করানো বাঞ্ছনীয়। চরিত্র এবং ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্থান ও সময়ের উলেস্নখ বর্ণনায় গল্পের পরিণতিতে একটি একক ঐক্যের সৃষ্টি করতে পারে, যা ছোটগল্পের উদ্দেশ্য পূরণে বেশ সহায়ক। ছোটগল্পে স্থান ও সময় সম্বন্ধে যেসব প্রশ্ন রাখা সমীচীন তার মধ্যে রয়েছে : (ক) লেখক কি প্রয়োজনের অতিরিক্তভাবে স্থান ও সময়ের বর্ণনা করেছেন? (খ) যে ডিটেইলসের ব্যবহার করা হয়েছে সেইসব কি চরিত্রের আবেগ-অনুভব সৃষ্টির ব্যাখ্যায় প্রাসঙ্গিক? (গ) স্থানের বর্ণনায় শুধুই কি দৃষ্টির ইন্দ্রিয়কে মনে রাখা হয়েছে, না অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের জন্যও খোরাক রয়েছে? (ঘ) গল্পে কি স্থান ও সময়ের ঘন ঘন পরিবর্তন হয়েছে, না তাদেরকে নিয়ন্ত্রিত রেখে একটি ঐক্যের বন্ধনে গ্রথিত করা হয়েছে? গল্পের বিষয়বস্ত্তভেদে এসব প্রশ্নের মধ্যে এক বা একাধিকের যথাযথ উত্তর গল্পে স্থান ও সময়ের ভূমিকা স্পষ্ট করে। অবশ্য এমন ব্যতিক্রমী গল্পও লেখা যেতে পারে, যেখানে বিষয়বস্ত্ত স্থান ও কালনিরপেক্ষ।

ছোটগল্পের কাঠামো বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। বর্ণনা আদি থেকে মধ্যবর্তী স্থান হয়ে সরলরেখায় অমেত্ম পৌঁছতে পারে। এই শৈলীর কাঠামো বেশ পুরনো এবং সেই কারণে উৎকর্ষের মানদ– নিচে। অন্ত দিয়ে শুরু করে ফ্ল্যাশব্যাকে গল্পের আদিতে পৌঁছানোর রীতিও বহু ব্যবহৃত। এর ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য আছে কিন্তু উলেস্নখযোগ্য শিল্পমূল্য নেই। কোনো গল্পের পরিণতি আসতে পারে অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা সংলাপের মাধ্যমে। এই বৈশিষ্ট্যও বহুল ব্যবহৃত। গল্প যে-কোনো স্থান (কাঠামোগতভাবে) থেকে শুরু করা এবং শেষ করা সম্ভব হলে তার রচনায় কুশলতা থাকে। চলমান জীবনের একটি ক্ষুদ্রাংশ নিয়ে ছোটগল্প হওয়ার জন্য এর কাঠামোতে আদি, মধ্যবর্তী স্থান এবং অন্ত বলে সুচিহ্নিত পর্ব থাকার বাধ্যবাধকতা নেই। পাঠকের মনে একটি বিশেষ আবেগ বা অনুভূতি সৃষ্টির জন্য কাঠামোকে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। যেহেতু ছোটগল্পে বর্ণনা আভাসে-ইঙ্গিতেই বিষয়বস্ত্তকে উপস্থাপিত করে, সেজন্য কাঠামোতেও তার প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন। অবয়বে বর্ণনায় কিংবা সংলাপে কিছু অস্পষ্টতা ছোটগল্পের ইঙ্গিতধর্মী বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাস্তবের অনুপুঙ্খ প্রতিফলন নয়, বিমূর্ত অথবা অর্ধবিমূর্ত উপস্থিতি গল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলে। কেননা বর্ণনায় সবকিছু থাকে না, পাঠককে অনুমানও করে নিতে হয়। আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছোটগল্পে যেমন স্বাভাবিক, উপন্যাসে ততটা নয়। উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পে এ-দিক দিয়ে লেখকের অনেক বেশি স্বাধীনতা।

ছোটগল্পের ভাষা একদিকে যেমন ঋজু, মেদহীন, লক্ষ্যভেদী হওয়া প্রয়োজন আবার ব্যঞ্জনা সৃষ্টির জন্য উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পের ব্যবহারও থাকা চাই। স্থান-কালের বর্ণনা এবং চরিত্রের আবেগ-অনুভব ব্যক্ত করার জন্য এসব অলংকার বেশ কার্যকর। ইঙ্গিতময়তা এবং অস্পষ্টতা সৃষ্টির জন্য উপকথা, অতিকথা
অথবা অন্য কোনো লেখার উলেস্নখ কার্যকর হতে পারে এবং গল্পকে অসাধারণত্বের বৈশিষ্ট্যদান করে। আপাত সরল কাহিনির ভেতর গভীরতর অর্থের ও তাৎপর্যের উপস্থিতি পাঠকের মেধা ও মননকে সচকিত করে তোলে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ফকনারের ‘দি বিয়ার’ গল্পে জন কিটসের ‘ওড অন গ্রিসিয়ান আর্নে’র উলেস্নখের কথা বলা যায়। ছোটগল্পের ভাষা যেখানে সহজ, সেইসব ক্ষেত্রেও এমন ঘন-নিবদ্ধতা বা কমপ্যাক্টনেস থাকা প্রয়োজন, যার ফলে তা বর্ণনাকে শিথিল হতে দেয় না। হেমিংওয়ের গদ্য এখানে উলেস্নখযোগ্য। জটিল বাক্যবিন্যাসে গল্পের বর্ণনা কৌতূহল এবং রহস্য সৃষ্টিতে বেশ কার্যকর। যেমন, কমলকুমার মজুমদারের ছোটগল্প। সব পাঠকের জন্য না হলেও এ-ধরনের ছোটগল্পের সাহিত্যমূল্য অনেক। উন্নত ভাষার এই সচেতন ব্যবহার ছোটগল্প-লেখকের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, কেননা এর ফলে জনপ্রিয়তা অর্জনের সহজ ও অনায়াস উপায়টি বর্জন করা হয়। যে-ছোটগল্পে কোনো বিশেষ অঞ্চল অথবা কোনো বিশেষ শ্রেণির চরিত্র থাকে, তার ভাষা সেই অঞ্চল ও চরিত্রের প্রতিনিধিত্বকারী হওয়া প্রয়োজন। এখানে লেখকের স্বনির্বাচিত জটিলতা বা অস্পষ্টতার তেমন প্রয়োজন পড়ে না, আঞ্চলিক ভাষাই মানসিকভাবে সেই আবহ সৃষ্টি করে।

ভাষার অন্তর্গত কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ন্যারেটিভের অংশ হিসেবে প্রতীকের ব্যবহার গল্পে ইঙ্গিতময়তা সৃষ্টিতে বেশ কার্যকর। প্রতীকের ব্যবহার ন্যারেটিভকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যায়। গল্পের অর্থ তখন একাধিক স্তরে উপলব্ধির সুযোগ ঘটে। একটি চরিত্র, বিশেষ ঘটনা অথবা বস্ত্ত প্রতীকের ভূমিকা পালন করতে পারে। উপকথা, অতিকথন, ইতিহাস, এমন অনেক টেক্সটই প্রতীকের উৎস হতে পারে।

অনেককিছুর মতোই ছোটগল্পও অংশের যোগফলের অতিরিক্ত কিছু। চরিত্র, ঘটনা, স্থান-কাল এবং ভাষাসহ ন্যারেটিভ এই সবকিছু ব্যবহার করে এমন একটি গল্প বলতে হবে যা নিটোল, বিশ্বাসযোগ্য এবং ফলাফল সৃষ্টিতে মোক্ষম। এই সফলতা অর্জনে গল্পের সকল উপায়-উপকরণেরই ভূমিকা রয়েছে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো সংমিশ্রণের কুশলতা। লেখক তাঁর জন্মগত প্রতিভা, সহজাত প্রবণতা এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে এই সাফল্য অর্জন করতে পারেন।