ছয় তরুণের কালি ও কলম পুরস্কার জয়

আবসার জামিল

স্বীকৃতি – তা যে-সময়ে বা যে-বয়সেই হোক না কেন, সবসময়ই যে-কোনো কাজে প্রেরণা জোগায়, কাজের গতি বাড়িয়ে দেয়, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে। গত ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য সাতজন নবীন ও প্রবীণকে পুরস্কৃত করেছে সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতিবিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম এবং বেঙ্গল পাবলিকেশন্স।

যুগে যুগে নবীনরা সমাজকে ভেঙেচুরে বিনির্মাণ করেছে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে কালে কালে জমা হওয়া পুরনো জঞ্জাল দুহাতে সাফ করে সত্য সুন্দর সঠিক পথের দিশা দেখিয়েছে। রাষ্ট্র সমাজ জাতি সর্বত্র ন্যায়নিষ্ঠার অনির্বাণ আলো জ্বেলেছে। একটি জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি এগিয়ে নেওয়ার ভারও সানন্দে নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে তরুণরা। সেই তরুণদের সাহিত্যচর্চাকে গতিশীল ও বেগবান করার লক্ষ্য নিয়ে মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম প্রবর্তন করেছে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’।

গত ৩০ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে প্রদান করা হয় ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৭’। দশমবারের মতো প্রদত্ত এ-পুরস্কারের পাঁচটি বিভাগে এবার বিজয়ী হয়েছেন ছয়জন। তাঁরা হলেন – কবিতা বিভাগে
যৌথভাবে নিশিন্দা পাতার ঘ্রাণ গ্রন্থের জন্য হোসনে আরা জাহান ও জুমজুয়াড়ি গ্রন্থের জন্য মিজানুর রহমান বেলাল; কথাসাহিত্যে এই বেশ আতঙ্কে আছি গ্রন্থের জন্য তাপস রায়; প্রবন্ধ গবেষণা ও নাটক বিভাগে আলতাফ শাহনেওয়াজ তাঁর নৃত্যকী গ্রন্থের জন্য, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাহিত্য বিভাগে মুক্তিযুদ্ধের অজানা ভাষ্য গ্রন্থের জন্য মামুন সিদ্দিকী এবং শিশু-কিশোর সাহিত্যে হরিপদ ও গেলিয়েন গ্রন্থের জন্য রাজীব হাসান।

মাঘের হিম বিকেলে এ-আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। সম্মানীয় অতিথির আসন অলংকৃত করেন প্রখ্যাত রবীন্দ্র-গবেষক ও প্রাবন্ধিক-অনুবাদক ড. মার্টিন কেম্পশেন। তিনি মূলত জার্মানির নাগরিক হলেও রবীন্দ্র-গবেষণায় মনোনিবেশ করে গত চলিস্নশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে অবস্থান করছেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট শিল্প-সমালোচক, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। কালি ও কলমের সম্পাদকম-লীর সভাপতি এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানমঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়ের এবং পত্রিকাটির সম্পাদক আবুল হাসনাত। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এবং কালি ও কলম সম্পাদকম-লীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরী।

তরুণদের সাহিত্যচর্চাকে উজ্জীবিত ও গতিশীল করার লক্ষক্ষ্য ২০০৮ সালে প্রবর্তন করা হয় ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’। সে-বছর দুটি বিভাগে এ-পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০০৯ সালে বিভাগ বেড়ে দাঁড়ায় তিনটি। ২০১০ সালে যোগ করা হয় আরো দুটি বিভাগ। ফলে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচটি বিভাগেই বই চাওয়া হয়। মাঝে ২০১৪ সালে তিনটি বিভাগে বই চাওয়া হলেও ২০১৫ সালে ফের পাঁচটি বিভাগেই পুরস্কার প্রবর্তন করে কালি ও কলম। প্রতিটি বিভাগে পুরস্কার বিজয়ীকে এক লাখ টাকা, একটি ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়ে থাকে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন লুভা নাহিদ চৌধুরী। তিনি ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কারে’র বিচারকম-লী অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, কবি ও অধ্যাপক মাহবুব সাদিক এবং কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে সবিশেষ ধন্যবাদ জানান। মার্টিন কেম্পশেনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথের পদার্পণের দীর্ঘদিন পরে রবীন্দ্র-অনুরাগী এবং রবীন্দ্র-অনুবাদক ও গবেষক ড. মার্টিন কেম্পশেন এই জটিল বিষয়টির গবেষণায় নিযুক্ত হয়ে সেখানকার প্রকৃত চিত্র যথাযথ উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। জন্মসূত্রে তিনি জার্মান; কিন্তু ভারতবর্ষে আছেন প্রায় চলিস্নশ বছর। জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে আদৃত হয়েছিলেন সে-অনুসন্ধানে ব্যাপৃত আছেন তিনি। তিনি আরো বলেন, আগামী ১ ফাল্গুন কালি ও কলম ১৫ বছরে পদার্পণ করবে। এ-উপলক্ষে কালি ও কলম বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করছে।

লুভা নাহিদ চৌধুরীর বক্তব্য শেষে ২০১৭ সালে পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। পরে ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেওয়া এ-পুরস্কার নিয়ে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। ২০১৭ সালের বিজয়ীদের উদ্দেশে শংসাবচন পাঠ করেন যথাক্রমে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, অধ্যাপক মাহবুব সাদিক এবং ইমদাদুল হক মিলন। শংসাবচন পাঠশেষে প্রত্যেক বিজয়ীর হাতে একটি ক্রেস্ট, পুরস্কারের অর্থমূল্যের চেক ও সনদপত্র তুলে দেন মঞ্চে উপস্থিত বিশিষ্টজনেরা।

এরপর প্রথমে বক্তৃতা করেন কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়ের। তিনি বলেন, আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে, ১৫ বছর ধরে কালি ও কলম নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। এজন্য তিনি কালি ও কলমের সম্পাদকম-লীর সভাপতি আনিসুজ্জামান ও পত্রিকাটির সম্পাদক আবুল হাসনাতকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের স্বপ্ন ছিল কালি ও কলম

বিশেষ অতিথি সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, আজ অত্যন্ত আনন্দের দিন। আজ একই সঙ্গে দুটি আনন্দ আমরা উদযাপন করছি। কালি ও কলমের ১৫ বছরে পদার্পণ এবং তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার প্রদান। তিনি বলেন, কালি ও কলম এদেশের পাঠকদের সাহিত্যরুচি গড়ে দিয়েছে। অনেক কণ্ঠকে বাঙ্ময় করে দিয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্যকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গসহ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে কালি ও কলম। পুরস্কারপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, যে-কোনো পুরস্কার আনন্দদায়ক; দায়িত্ববোধ তৈরি করে। সেইসঙ্গে বইয়ের কাটতি বাড়াতে সাহায্য করে। আজকে যারা পুরস্কার পেল, তাঁদের কাছ থেকেও আরো বেশি ভালো লেখা প্রত্যাশা করব।

সম্মানীয় অতিথি মার্টিন কেম্পশেন তাঁর শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, আমি খুবই গর্বিত যে, এ-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরেছি। তিনি বলেন, কালি ও কলমে যুক্ত হয়েছি তিন বছর আগে। আমি দেখেছি কালি ও কলমে দুই বাংলা এক হয়ে গেছে। পুরস্কারপ্রাপ্তদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে তিনি বলেন, সাহিত্যিকদের কাজ হলো সমাজের সেবা করা। সে-কাজটি আপনারা ভালো করে করতে পারবেন বলে আমি মনে করি। মার্টিন কেম্পশেন বলেন, আজকের সমাজে তরুণরা লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখছে, কিন্তু কজনেই-বা লেখক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়? আজকের তরুণরা লেখালেখির মাধ্যমে সমাজসেবা করতে চাইছে, সেটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। সমাজের জন্য সে কঠিন কাজটির বড় প্রয়োজন রয়েছে। তিনি আরো বলেন, লেখালেখির জগৎটা ভিন্ন। এ-জগতে সবাই আসতে চায় না। এই তরুণদের অভিনন্দন, তাঁরা লেখালেখির জীবন বেছে নিয়েছেন। তাঁরা লেখার জগতে এসে সমাজের উপকার করছেন, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।

এরপর প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বক্তব্য রাখার পালা থাকলেও তিনি পুরস্কৃতদের অনুভূতি শুনে বক্তব্য রাখার মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করেন। সে-অনুযায়ী একে একে বক্তব্য রাখেন পুরস্কারপ্রাপ্ত ছয়জন তরুণ কবি ও লেখক।

প্রথমেই মামুন সিদ্দিকী বলেন, আমার দাদা স্কুলশিক্ষক ছিলেন, পুঁথি পড়তেন। আমার রক্তে রয়ে গেছে দাদার সেই পুঁথি পড়ার, সাহিত্যচর্চার নেশা। তিনি বলেন, আমার বাবা আমাকে লেখক হতে দিতে চাননি; কিন্তু আমি লেখক হয়েছি। আমি ২৪ বছর ধরে সাহিত্যচর্চা করছি। মামুন বলেন, আমার মা সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত নন। কিন্তু তিনিই আমাদের লালনপালন ও শিক্ষিত করেছেন। তাই আমার আজকের এই আনন্দের সবটুকু নিবেদন করছি আমার মায়ের চরণতলে। এ-পুরস্কার আমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে বলে আমি আশাবাদী।

মিজানুর রহমান বেলাল বলেন, জুমজুয়াড়ি বইটি লেখার জন্য আমি ১৭ বছর একটি ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সেই দীর্ঘ সময়ের ফল ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ অর্জন করায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত।

হোসনে আরা জাহান বলেন, কবিতায় সত্যের সন্ধান থাকে, থাকে মিথ্যার অনুসন্ধান। একজন কবি কবিতায় সত্য ও মিথ্যার অনুসন্ধান করেন।

তাপস রায় লেখালেখির জন্য তাঁর পরিবার ও শ্রদ্ধাভাজন লেখকদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, আমার সমত্মান ওমকে আমি আমার পুরস্কার উৎসর্গ করছি। কারণ এটাই আমাদের শুরু।

আলতাফ শাহনেওয়াজ বলেন, নৃত্যকী লিখতে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। লেখালেখির জন্য উৎসাহ প্রদান করায় আলতাফ তাঁর
বাবা-মা, পরিবার, শিক্ষক, কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

কালি ও কলমকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাজীব হাসান বলেন, ‘কালি ও কলম পুরস্কার’ বাংলাদেশের নবীন সাহিত্যিকদের কাছে সাহিত্যের নোবেল হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা একটা অমত্মঃসারশূন্য সময়ে বাস করছি। আমরা যারা লেখালেখি করি তাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। রাজীব বলেন, বাংলা সাহিত্যের বয়স চৌদ্দশো বছর। তাই এ-গৌরবোজ্জ্বল সাহিত্যের ঐতিহ্য আমাদের ধরে রাখতে হবে, এটা আমাদের দায়িত্ব।

প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তাঁর বক্তব্যের শুরুতে রবীন্দ্র-গবেষক মার্টিন কেম্পশেনকে বাংলাদেশে স্বাগত জানান। তিনি পুরস্কারপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, সমাজে আলোর পথে জঞ্জাল রয়ে গেছে এখনো। রাজনীতিকরা ক্ষমতা ও অর্থের সমীকরণ মিলিয়ে চলেন। কবি-সাহিত্যিকরা মানুষের হৃদয় বুঝে চলেন। তাঁদের সান্নিধ্যে এলে হৃদয় প্রসারিত হয়। চীনা প্রবাদ আছে, কবি-সাহিত্যিকরা ফুলের মতো। আমি ফুলের বাগানে এসেছি। এখান থেকে আমি ফুলের সৌরভ নিয়ে ফিরে যাব। তথ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা বাংলার চার হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস ধারণ করছি। সেই সমৃদ্ধ জনপদের উত্তরসূরি আজকের পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকরা। চার হাজার বছরের আশা, সুখ, দুঃখ, বেদনাকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাঁরা, তুলে এনেছেন বাংলার উত্থান-পতনের কথা।

বাংলাদেশে ‘সংস্কৃতির ঘাটতি’ রয়েছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, হয়তো আমাদের রাজনীতির উত্তরণ হবে, সমস্যার সমাধান বা উন্নয়ন হবে অনেক; কিন্তু সংস্কৃতির ঘাটতি থেকে গেলে আমরা হোঁচট খাবো। লেখকরা সেই সংস্কৃতির ঘাটতি পূরণ করবেন। আমরা আজ সেই সৃষ্টি চাই, পরিচয়ের সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। প্রাচীন কবি আলাওলকে স্মরণ করে মন্ত্রী বলেন, চারশো বছর আগে এ-বাংলা কে শাসন করেছে, জাতি তা মনে না রাখলেও কবি আলাওলকে ঠিকই সবাই মনে রেখেছেন। আজ থেকে পাঁচশো বছর পর আমাকে কেউ মনে না রাখলেও হয়তো আজকের পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-লেখকদের লেখা মনে রাখবেন, তাঁদের নামও।

সবশেষে বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানটির সভাপতি আনিসুজ্জামান। পুরস্কৃতদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ইতিপূর্বে কালি ও কলম পুরস্কার পাওয়া তরুণদের অনেকেই সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, কালি ও কলম পুরস্কারটি অপাত্রে দান করা হয়নি। তিনি বলেন, একটি সত্যের মুখোমুখি হতে চাই, লেখক-সাহিত্যিকের কাছে পাঠকের কী প্রত্যাশা? প্রত্যাশা দুটো, পাঠক সাহিত্যের মধ্যে সৌন্দর্য ও সত্য খোঁজ করেন। আর এ দুটোর মেলবন্ধন ঘটানো সাহিত্যিকের প্রধান কাজ। তিনি বিচ্যুত হলে সাহিত্যিকের পদবাচ্য থাকেন না। আমরা আশা করব, আজকের তরুণ লেখকরা সৌন্দর্য ও সত্যের মেলবন্ধন ঘটাবেন। প্রতিবছরই বইমেলার পরিধি বাড়ছে উলেস্নখ করে আনিসুজ্জামান বলেন, এর মাধ্যমে প্রমাণ হচ্ছে বাংলাদেশে মুদ্রণ মাধ্যম এখনো টিকে আছে এবং বহুদিন টিকে থাকবে। সভাপতির বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব। এরপর মঞ্চে আসেন লাইসা আহমেদ লিসা। বিশিষ্ট এ-রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী তাঁর সুললিত কণ্ঠে মোহিত করে রাখেন উপস্থিত সবাইকে। সুরের মাধুরী যখন শেষ হলো, ঘড়ির কাঁটা তখন রাত আটটার ঘর পেরিয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে নিজ গন্তব্য-অভিমুখে ফিরতে শুরু করেন সবাই। সে-সময় হয়তো অনেক তরুণ কবি-সাহিত্যিকের মনে এ-স্বপ্নই বাসা বেঁধেছে, আগামী বছর এ-স্বীকৃতি আমিও পেতে পারি!

 

জীবনানন্দ-ভূমেন্দ্র গুহ গবেষণা পুরস্কার পেলেন

সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ

নতুন চর্যাপদ গ্রন্থের জন্য ‘জীবনানন্দ-ভূমেন্দ্র গুহ গবেষণা পুরস্কার’ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। পুরস্কার হিসেবে এক লাখ টাকা, স্মারক ও একটি সনদ দেওয়া হয় তাঁকে।

গত ৩১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ধানম–র ‘বেঙ্গল বই’ প্রাঙ্গণে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে এ-পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এ আয়োজনে বিশেষ অতিথি ছিলেন রবীন্দ্র-গবেষক মার্টিন কেম্পশেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে একক বক্তৃতাও করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠানমঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের সভাপতি আবুল খায়ের এবং কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত।

শুরুতেই এ-পুরস্কার প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।

রবীন্দ্র-গবেষক মার্টিন কেম্পশেনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আবুল হাসনাত বলেন, মার্টিন কেম্পশেন জন্মসূত্রে জার্মান; কিন্তু ভারতবর্ষে আছেন প্রায় চলিস্নশ বছর। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সনিষ্ঠ ভক্তি এবং অনুরাগে যুক্তিনিষ্ঠ বিশেস্নষণের সাহায্যে জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে আদৃত হয়েছিলেন সেই অনুসন্ধানে ব্যাপৃত আছেন তিনি।

রবীন্দ্র-গবেষণায় জড়িয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে মার্টিন কেম্পশেন বলেন, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পাঠ করে আমি বিমুগ্ধ হয়ে যাই। তখনো বুঝতে পারিনি যে, রবীন্দ্র-সাহিত্য আমার জীবনের বড় অংশ হয়ে উঠবে। পরে রবীন্দ্রনাথের বাংলা কবিতা ও তার অনুবাদ পড়ে আমি বাংলা পঙ্ক্তি ও ছন্দের শক্তির জায়গাটা অনুধাবন করতে পারি। তিনি বলেন, রবীন্দ্রকাব্যের একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে অনুবাদ করতে গিয়েও জটিলতার মুখে পড়তে হয়েছে। বাংলা ভাষা ও ছন্দ যুগপৎভাবে ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করা কঠিন ছিল। অনুবাদ করতে গিয়ে আমিও নিজের মধ্যে সত্যিকারের কবিত্ব অনুভব করি।

পুরস্কার গ্রহণের পর নিজ অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, আট বছর ধরে গবেষণার ফল এই বই। এ-ধরনের বইয়ের প্রকাশক পাওয়া কঠিন। বইটির প্রকাশক কথাপ্রকাশ প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার জসিম উদ্দিনকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

সভাপতির বক্তব্যে আনিসুজ্জামান বলেন, মার্টিন কেম্পশেন নিজে কবি না হলেও তাঁর মধ্যে একজন কবি লুকিয়ে আছে। সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের বই নতুন চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদের বিশেষ কাজে আসবে। কেননা এ-ধরনের গবেষণা বাংলা সাহিত্যে বিরল।

‘জীবনানন্দ-ভূমেন্দ্র গুহ গবেষণা পুরস্কার’ প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট :  ভূমেন্দ্র গুহ ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট এ শল্যচিকিৎসক মারা যান ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে। কলকাতায় তিনিই একমাত্র গবেষক ছিলেন, যিনি জীবনানন্দ দাশের হাতের লেখা যথাযথভাবে পাঠোদ্ধার করতে পারতেন। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত জীবনানন্দ সমগ্রের জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন। কলকাতা জাতীয় গ্রন্থাগার ও অন্যান্য পাঠাগারে গিয়ে প্রায় তিন বছর ধরে তিনি এই সম্পাদনার কাজটি করেন। কিন্তু এ-কাজের জন্য কোনো সম্মানী তিনি গ্রহণ করতে রাজি হননি। পরবর্তীকালে হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর স্মরণে ‘জীবনানন্দ-ভূমেন্দ্র গুহ গবেষণা পুরস্কার’ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স।

এই সিদ্ধান্তের আলোকে ড. আনিসুজ্জামান, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ও বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের নির্বাহী পরিচালক
আবুল হাসনাত ২০১৭ সালে প্রকাশিত সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের নতুন চর্যাপদ গ্রন্থটিকে ‘জীবনানন্দ-ভূমেন্দ্র গুহ গবেষণা পুরস্কার ২০১৭’-এর জন্য নির্বাচিত করেন। r